আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৯
সালমা খাতুন
আরমান গটগট পায়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতেই আবির একটা বাঁকা হাসি দিলো। এটাই তো চাইছিলো ও। ওকে যে ওর দেওয়া কথা রাখতেই হবে। যেভাবেই হোক ওদের দুজনকে এক করতেই হবে।
আবির ওদের পরে যে পোস্টে আছে তাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে, আবির আর মায়াও বেরিয়ে যাই অফিস থেকে। অফিস এখনো ছুটি হয়নি। কিন্তু আরমান আর আবির তবুও চলে গেলো। যেহেতু আজকে একটা মিটিং চলছিল।
বাইরে এসে মায়া আবিরকে বলল, “ভাইয়া আমি চলে যেতে পারবো। আপনি চলে যান।”
আবির:- “একদম চুপচাপ এখানে দাঁড়াও। আমি গাড়ি নিয়ে আসছি।”
এই বলে আবির চলে গেলো পার্কিং লটে থেকে গাড়ি আনতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবির চলে আসলো। তারপর মায়ার জন্য ওর পাশে মানে সামনের সিটের দরজা খুলে দিলো। মায়াও উঠে বসে সিট বেল্ট লাগিয়ে নিলো। এরপর প্রথমেই আবির মায়াকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে গেলো। মায়ার জন্য ভারী খাবার অর্ডার করে নিজের জন্য কফি অর্ডার দিলো। তারপর ওদের খাওয়া শেষ হলে আবারো গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ি ওদের বাড়ি যাওয়ার রাস্তা ধরতেই মায়া বলে উঠলো, “ভাইয়া একবার হসপিটাল যেতে হবে।”
আবির অবাক হয়ে বলল, “হোয়াট?? হসপিটাল কিন্তু কেন??”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মায়া দুঃখিত গলায় বলল, “পাপা হসপিটালে ভর্তি আছে ভাইয়া। ডাক্তার বলেছে পাপা আর বেশি দিন বাঁচবে না।”
তখনো ওদের গাড়ি চলছিল। মায়ার বলা শেষ কথাটা শুনে আবির জোড়ে ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে দিলো। যেনো কথাটা শোনা মাত্রই থমকে গেলো ও। মায়া মুখ তুলে তাকলো আবিরের দিকে। আবিরও তাকালো মায়ার দিকে। মায়ার দুই চোখে তখন অশ্রুর ধারা। পিছনে গাড়ির হর্ন শুনে আবির গাড়িটা রাস্তার একপাশে লাগালো। তারপর মায়াকে জিজ্ঞাসা করলো, “কি হয়েছে আঙ্কেল এর??”
মায়া কান্না ভেজা গলায় বলল, “ক্যান্সার। লাস্ট স্টেজ। কেমোথেরাপি চলছে। তবুও বাঁচবে কিনা গ্যারান্টি নেই।”
মায়ার কথা শুনে আবির নিজের মুখের ভাষা যেনো হারিয়ে ফেলল। ও কি বলে মেয়েটাকে সান্ত্বনা দিবে বুঝতে পারলো না। এই মেয়েটার যে ওর বাবা ছাড়া এই দুনিয়ায় আর কেউ নেই। যদি ওর বাবার কিছু হয়ে যাই তাহলে কোথায় যাবে এই মেয়েটা? এই দুনিয়া যে বড়ই নিষ্ঠুর তা যদি হয় আবার একটা অনাথ মেয়ের জন্য। মায়া তখনো মাথা নিচু করে নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে। আবির ওর হাতটা মায়ার মাথায় রেখে বলল, “সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ। আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখো।”
মায়া মুখে কিছু বলল না। শুধু ওরনা দিয়ে চোখের পানিটুকু মুছে নিলো। তারপর নিজেকে স্বাভাবিক করতে চাইলো। ও চাই না ওর দূর্বলতা গুলো কাউকে দেখাতে। কিন্তু এই মানুষটার সামনে কিছুতেই নিজেকে আড়াল করতে পারে না। কষ্ট গুলো বেরিয়েই যাই।
আবির:- “আর তাই তুমি তোমার বাবাকে বাঁচাতে আরমানের পার্সোনাল সার্ভেন্ট এর কাজ করতে এসেছো তাই তো?”
মায়া মুখে কিছু বলতে পারলো না। শুধু মাথা নড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো। আবির আবারও বলল, “কিন্তু তুমি যে আগে একটা কম্পানিতে জব করতে ডিজাইনারের?”
মায়া একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, “জানেন তো ভাইয়া এই দুনিয়ায় একটা মেয়ের বেঁচে থাকা অনেক কঠিন। এই দুনিয়ায় কিছু মানুষরুপি হাইনা বাস করে। যারা সুযোগ পেলেই অসহায় মেয়েদের ছিঁড়ে খেতে চাই। আমকে ওই অফিসের ম্যানেজার মলেস্ট করার চেষ্টা করেছিলো। তাই ছেড়ে দিয়েছি ওই চাকরি। চাকরি ছাড়ার পরের দিনই ওই কম্পানির এম.ডি নিজে দেখা করতে এসেছিল আমার সাথে। নিজে আমার বাড়ি এসে জানতে চেয়েছিল চাকরি ছাড়ার কারণ। ডাবল মাইনে দিতে রাজি ছিল আমায় আবারও ওই অফিসে জয়েন করার জন্য। কিন্তু আমি রাজি হয়নি। তার কিছু দিন পরই পাপার ক্যান্সার ধরা পড়া। ধরা অবশ্য অনেক আগেই পড়েছিল। পাপা জানতো। পাপা নিজেই ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে একা একাই চিকিৎসা করাচ্ছিল। আমি ভেঙ্গে পড়বে ভেবে পাপা আমায় কিছু জানতে দেয়নি। পাপার শরীরও দিন দিন ভেঙে পড়ছিল আমি কিছু বললে বলতো বয়স হয়েছে, এমনি একটু শরীর খারাপ তাই এমন হচ্ছে।
এরপর এই কিছুদিন আগে পাপার অতিরিক্ত শরীর খারপ শুরু করে। হসপিটালে নিয়ে গেলে আমি জানতে পারি। আর সেই থেকেই পাপা হসপিটালে ভর্তি। এরপরে অনেক জায়গায় চাকরির জন্য গিয়েছিলাম কিন্তু পাইনি। আপনি তো জানেন পড়াশোনাও বেশিদূর করিনি।
আবির কি বলবে বুঝতে পারলো না। মায়াকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা যে ওর নেই। ও আর কিছু না বলে গাড়ি স্টার্ট দিলো হসপিটালের উদ্দেশ্যে।
হসপিটালে…..
আবির আর মায়া প্রবেশ করলো ওর বাবাকে যেই কেবিনে রাখা আছে সেই কেবিনে। ওর বাবা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। মায়া গিয়ে ওর বাবার মাথায় হাত রাখতেই ওর বাবা চোখ মেলে তাকালো।
আশরাফ সাহেব:- “এসেছিস মা? তোকে বলছি আমায় বাড়ি নিয়ে চল মা। আমার এখানে একদম ভালো লাগছে না। ভীষণ কষ্ট হয় আমার।”
মায়া ওর চোখের পানি আড়াল করে ধরা গলায় বলল, “আর একটু কষ্ট সহ্য করো পাপা, দেখবে তুমি ঠিক হয়ে যাবে সেই আগের মতো। দেখো তোমার সাথে কে দেখা করতে এসেছে।”
আবির এগিয়ে গেলো আশরাফ তালুকদারের কাছে। উনার অবস্থা দেখে কি বলবে ভেবে পেলো না। শেষ যখন উনাকে দেখেছিল, তখন পুরোপুরি সুস্থ ছিল। সেই মানুষটিকে এই অবস্থায় দেখে ভীষণ খারাপ লাগছে। আশরাফ সাহেব আবিরকে দেখে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “আবির বাবা, তুমি এসেছো? এতোদিন কোথায় ছিলে? আসোনি যে? আগে তো প্রায় আস্তে।”
আবির:- “আমি দেশে ছিলাম না আঙ্কেল। এই এক সপ্তাহ হলো ফিরেছি। আপনি চিন্তা করবেন না। একদম ঠিক হয়ে যাবেন।”
আশরাফ সাহেব:- “আর ঠিক, দেখছো তো কি অবস্থা? আমি জানি আমি হয়তো আর বাঁচবো না। এই নিয়ে আমি কোনো চিন্তাও করি না বাবা। চিন্তা শুধু আমার মেয়েটাকে নিয়ে। এই দুনিয়ায় আমি ছাড়া ওর যে আর কেউ নেই। যদিও বা মেয়েটার বিয়ে দিলাম সেটাও আবার ডিভোর্স হয়ে গেলো। আমি না থাকলে তুমি আমার মেয়েটাকে একটু নিজের বোন ভেবে দেখে রেখো বাবা। তোমার কাছে আমি হাত জোড় করে অনুরোধ করছি। খুব চিন্তা হয় আমার মেয়েটার জন্য।”
কথা গুলো বলতে বলতেই আশরাফ সাহেব কেঁদে ফেললেন। ওনার কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে তবুও মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে কথা বলছেন। এদিকে মায়ার চোখে তখন অশ্রুর বন্যা। এমন কঠিন পরিস্থিতি দেখে আবিরের চোখ থেকেও দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। মায়া নিজেকে সামলে মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে বলল, “পাপা আমি কিন্তু এবার খুব রেগে যাচ্ছি। তুমি কি সব উল্টা পাল্টা বকে চলেছো তখন থেকে। তুমি যদি এসব বলো তাহলে আমি আর তোমার সাথে দেখা করতে আসবো না। শুধু মাত্র ডাক্তারের সাথে কথা বলে তোমাকে বাইরে থেকে দেখেই চলে যাবো।”
আশরাফ সাহেব মুচকি হেসে বললেন, “সে আমি খুব জানি তুই আসবি কি আসবিনা। তুই যে আমার একমাত্র শেষ সম্বল মা। তুই না আসলে তো আমি আরোই মরে যাবো।”
মায়া মিথ্যা রাগ দেখিয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “আবার তুমি এই কথা বলছো? যাও তোমার সাথে আর কথাই বলবো না। আড়ি।”
আশরাফ সাহেব মুচকি হেসে বললেন, “দেখেছো আবির বাবা, আমার মেয়েটা এখনো কতটা ছেলেমানুষি করে। আচ্ছা আবির বাবা তুমি কি জানো ও এখন কোথায় চাকরি করছে? ও তো হঠাৎ করেই ওই জবটা ছেড়ে দিয়েছিল। আমার চিকিৎসা করতে তো অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। তারপর এখন বলছে আবার একটা কম্পানিতে কাজ করছে, সেখান থেকে নাকি লোনও নিয়েছে। তুমি এই বিষয়ে কিছু জানো? আসলে কি বলোতো বাবা, ভীষণ ভয় হয় মেয়েটাকে নিয়ে।”
আবির একবার মায়ার দিকে তাকালো। দেখলো মায়া অসহায় চোখে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। আবির বলল, “হ্যাঁ আঙ্কেল। মায়া আমি যেই কম্পানিতে কাজ করি সেই কম্পানিতেই ডিজাইনার হিসাবে জয়েন করেছে। আর আপনি ওর জন্য একদম চিন্তা করবেন না। আমি আছি তো আমার বোনকে দেখে রাখার জন্য।”
আশরাফ সাহেব সস্তির শ্বাস ফেলে বললেন, “যাক বাবা, কিছুটা চিন্তা মুক্ত হলাম মেয়েটা আমার তোমার কম্পানিতে কাজ করছে শুনে। আমার পুরো বিশ্বাস আছে তুমি আমার মেয়েটাকে দেখে রাখবে।”
এভাবে আরো কিছুক্ষন কথা বলল ওরা। মায়ার বাবার কথা বলতে কষ্ট হলেও তা কাউকে বুঝতে দিলো না। খুব আস্তে আস্তে কথা গুলো বলছিল। তারপর মায়া আবির ডক্টরের সাথেও দেখা করলো। এরপর বেরিয়ে গেলো, মায়াদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। মায়ার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনতে। ওরা পৌঁছে গেলে, আবির ওদের বাড়ি ঢুকলো না ও জানালো এখানেই অপেক্ষা করবে। কারণ আসেপাশে আরো কিছু বাড়ি আছে। মায়াকে একটা ছেলের সাথে বাড়িতে ঢুকতে দেখে যদি কেউ কিছু মনে করে সেই ভেবে আবির বাড়ির ভিতরে গেলো না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মায়া একটা ব্যাগ নিয়ে হাজির হলো। তারপর ওরা দুজনেই রওনা দিলো শাহরিয়ার ম্যানশনের উদ্দেশ্যে।
শাহরিয়ার ম্যানশন…..
বাড়ির কলিং বেল বাজিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে মায়া আর আবির। মায়ার হার্টবিট বেড়ে গেছে। এতোক্ষণে নিশ্চয় এই বাড়ির সবাই ফিরে এসেছে। কি বলবে ও সবাইকে। কিভাবে দাঁড়াবে ও সবার সামনে। আর আরমানের মা তো ওকে একদম পছন্দ করে না। ওই মহিলাকে দেখলেই তো মায়ার ভয় লাগে। এসব ভাবতে ভাবতেই দরজা খোলার আওয়াজ হলো, মায়া সামনে তাকিয়ে দেখলো রুবি দাঁড়িয়ে আছে। আবির এগিয়ে গেলেও মায়া গেলো না।
আবির পিছনে তাকিয়ে দেখলো মায়া এখনো দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে।
আবির:- “কি হলো? ওখানে দাঁড়িয়ে কেনো এসো!!”
এই বাড়ির সবাই ড্রয়িংরুমের সোফায় বসা ছিল। আবিরের আওয়াজে সবাই ঘুরে তাকালো, এটা দেখার জন্য আবির কাকে ডাকছে।
মায়া ভয়ে ভয়ে মাথা নিচু করে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। আর মায়াকে দেখার সাথে সাথে সবাই অবাকের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো সবাই। মায়া কিছুটা এগিয়ে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
ঠিক তখনি শোনো গেলো গম্ভীর গলার এক মহিলার আওয়াজ, তিনি সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলছেন, “ওহ তাহলে চলে এসেছো তুমি? আসো তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম।”
আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৮
মায়া মুখ তুলে তাকালো সামনের দিকে। মহিলাটি আর কেউ না আরমানের মা মিসেস সাবিনা শাহরিয়ার। খুব সুন্দর কাজের একটি শাড়ি পড়ে আছেন উনি। আঁচল টা এক পিন করে হাতে ধরে আছেন। গলায়, কানে, হাতে স্বর্ণের অলংকারে সেজে আছেন তিনি। দেখতেও ভীষণ সুন্দরী মহিলাটি। কথাটা বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো।