আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ২৩

আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ২৩
অবন্তিকা তৃপ্তি

এত রাতেও তোফাজ্জল ফোনে কারো সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলছেন। ফাহিমা কিছুসময়ের ওখানে থেকে তারপর অদিতির রুমে গেলেন। অদিতি বিছানার উপর বসেছিল। ওর মুখ সেভাবেই থমথমে; শূন্য! ফাহিমাকে দেখে অদিতি ঢোক গিলে; ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন—— ‘ওরা আসবে না মা?’
ফাহিমা কাপড় গোছাতে গোছাতে বললেন—— ‘না; ফারদিন পর্তুগাল চলে গেছে আজ।’

অদিতির মনটাই আচমকা এই খবরে দারুণ খুশি খুশি হয়ে গেল। এসব কার কাজ ওর বুঝতে একটুও অসুবিধা হচ্ছে না। অদিতি ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি ঝুলিয়ে জানালার বাইরে তাকাল; ধ্রুবকে এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। ধ্রুব ওদের জানালার সামনে একটা চেয়ারে বসে আছে; ওর হাঁটুর উপরে ইফাজ বসে ক্যামেরা নিয়ে কিছু একটা করছে। ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে ইফাজকে দেখছে; মাঝেমধ্যে শিখিয়ে দিচ্ছে কিছু। অদিতি অপলক দেখতেই থাকলো ধ্রুবকে। ফাহিমা হঠাৎ বললেন—— ‘তোর বাবা ভীষণ আতঙ্কে আছেন। গ্রামবাসীর কাছে কী জবাব দেবেন!’
অদিতি দ্রুত চোখ সরিয়ে ফেলল ধ্রুবর দিকে। বিছানা থেকে উঠে মায়ের দিকে চেয়ে বলল—— ‘মা; এই গয়না-গাঁটি খুলে ফেলব? আমার অসহ্য লাগছে।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ফাহিমা কিছু একটা ভাবলেন;তারপরে বললেন—— ‘মেহমানরা আছে বাইরে; আরও কিছু সময় পরে থাক।’
অদিতি অবাক হলো; মায়ের মুখ-চোখ সুবিধার লাগছিল না। মা মনে হচ্ছিল; কিছু একটা লোকাচ্ছে। এখনোও এগুলো আর পরে রাখার মানে কী? তবুও অদিতি বরাবরই বাধ্যগত মেয়ে; ও সেভাবেই গয়না-শাড়ি পরে থাকল!
ফাহিমা কাপড় ভাঁজ করে সেগুলো হাতে নিয়ে তোফাজ্জলের রুমে ঢুকলেন। তোফাজ্জল সবে ফোন কেটেছেন। উনি বিছানার উপর বসে আছেন; কিছু একটা ভাবছেন যেন। ফাহিমা শুকনো ঢোঁক গিলে উনার পাশে বসলেন; কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন—— ‘খবর পেলেন?’
তোফাজ্জল উঠে দাঁড়ালেন; পেছন ঘুরে গুরুগম্ভীর গলায় এটুকু বললেন স্রেফ—— ‘গ্রামবাসীদের চলে যাওয়া দরকার!’

ফাহিমা উঠে দাঁড়ালেন; বিস্মিত হয়ে বললেন—— ‘কী খবর পিন আগে সেটা তো বলুন। ধ্রুব সম্পর্কে কী বলেছে ওরা?’
তোফাজ্জল উত্তর দিলেন না। পাঞ্জাবি ঠিক করে বাইরে বেরিয়ে এলেন। ফাহিমা দাড়িয়ে রইলেন সেভাবেই! ধ্রুব তোফাজ্জলকে দেখে ইফাজকে রেখে উঠে দাঁড়াল। ওর ভ্রু কুঁচকানো; তোফাজ্জলকে দেখে সুবিধার লাগছিলো না। তোফাজ্জল সবার দিকে চেয়ে পুরনো স্বরে ফিরে; ভাবগম্ভীর কণ্ঠে বললেন—— ‘খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে আপনারা এবার বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নিন।’
মেহমানদের মধ্যে এটা শুনে কিছুটা শোরগোল পরে গেল হঠাৎ। তোফাজ্জল সেটা দেখে বললেন—— ‘আমার মেয়ের পড়াশোনা শেষ হয়নি; তাই আমি নিজেই এই বিয়েতে মানা করে দিয়েছি। আমার মেয়ে রাজি না এই বিয়েতে; আমার মেয়ের ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা।’

কথাগুলো শুনে ধ্রুব আহাম্মকের ন্যায় তোফাজ্জলের দিকে তাকিয়ে রইলো! উনি কবে থেকে সন্তানদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য দেওয়া শুরু করেছেন? আজ কেন যেন তোফাজ্জলকে দেখে স্বাভাবিক লাগছিল না।
অদিতি ঘর থেকে এসব কথা শুনে খুশিতে মুখে হাত চাপা দিয়ে পালঙ্গে বসে পরলো; ওর চোখে জল জমে গেছে রীতিমতো! তোফাজ্জলের এমন কথা ওর নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না।
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে আছে এখনো; ওর এসব কাণ্ড বিশ্বাসযোগ্য লাগছে না মোটেও। তোফাজ্জল নিজের সন্তানদের ইচ্ছাকে এত দাম দেন না; অথচ গ্রামবাসীকে এভাবে বললেন যেন উনি একজন আদর্শ বাপ! শেষমেশ মেহমানেরা চলে গেলেন সবাই। তোফাজ্জল ইফাজকে ধ্রুবর কাছ থেকে টেনে নিয়ে ঘরে ঢুকে ঘরের খিল দিলেন। ধ্রুব বাইরেই দাঁড়িয়ে রইল তখনও।

ঘরে ঢুকে ধ্রুব সোজা ইমনকে কল দিলেন; ইমন সবে বাইরে থেকে ফিরে নিজের ঘরে ঢুকছিলো। ধ্রুবর কল পেয়ে ফোন লাউডস্পিকারে দিয়ে; ও শার্ট খুলতে খুলতে বলল —— ‘কীরে; ঘটনা কদ্দুর?’
ধ্রুব কিছুটা চিন্তা নিয়ে বলল —— ‘ডোন্ট নো! আমার অদিতির বাবাকে সুবিধার লাগছে না।’
ইমন গা থেকে টিশার্ট খুলতে খুলতে; অবাক হয়ে বলল —— ‘ওই ব্যাটা কি তোর অ্যাক্টিং ধরে ফেলল নাকি?’
ধ্রুব কোমরে হাত দিয়ে ভাবুক গলায় বলে গেলো—— ‘জানি না। আমার সন্দেহ হচ্ছে; মনে হচ্ছে উনি ভেতরে ভেতরে তালগোল কিছু একটা পাকাচ্ছেন।’

ইমন এবার হেসে হেসে বলল —— ‘তোর শ্বশুর তো! তোর মতোই ক্রিমিনাল মাইন্ডের। জমবে ভালো তোদের।’
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকাল; চুড়ান্ত বিরক্ত হয়ে বললো —— ‘হয়েছে মজা করা? এখন আমাকে আইডিয়া দে; কী করব এখন?’
ইমন গাল চুলকে বিভ্রান্তি নিয়ে বলল——‘তুই তোর নিজের মতো কাজ চালিয়ে যা। এন্ড উনাদের প্রতিক্রিয়া দেখে যা। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে—রেজাল্ট পজিটিভ।’
ধ্রুব ভ্রু বাঁকিয়ে বলল——‘বাট আমার সেটা মনে হচ্ছে না।’
ইমন ভ্রু বাঁকিয়ে বলল——‘তুই আমার কথামতো কাজ কর; এটা তো মাত্র ডোজ নাম্বার ওয়ান দিলি। বাকিগুলো ধীরে ধীরে সময়মতো দিয়ে দিবি। এখন আরাম করে ঘুমা!’
তারপর আবার ইমন জিহ্বা কামড়ে বলল ——-‘ওহ, সবে মাত্র ১০টা বাজে। তুমি তো আবার রাত ৪টা না বাজলে ঘুমাও না। আচ্ছা বাই তাহলে।’
ধ্রুব ফোন কেটে দিল। তারপর সেটা টেবিলের ওপর রেখে বিছানায় বসলো। দুহাতে মাথার চুল খামচে ধরে মাথা নিচু করে বসে থাকল! ____

তোফাজ্জল ওইদিন রাতভর চিন্তায় ছিলেন। যে খবর দিয়েছে; তার মতে —-ধ্রুব বরিশালে থাকে, ভালো মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানিতে ফটোগ্রাফির কাজ করে। মাসে চৌত্রিশ হাজার টাকা স্যালারি। ছেলে ভালো, বাবা-মা দুজনেই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। ভালো পরিবার। অদিতির জন্য এমন ছেলে ভাবাই যায়।
তোফাজ্জল সেদিন পুরোটা রাত ঘুমাতে পারলেন না। শুধু ভাবলেন; ধ্রুবর সম্পর্কে! গ্রামের লোকদের যে হিংসা-প্রতিশোধপরায়নতার নজর তার পরিবারের উপরে পড়েছে তাতে যে কেউ যেকোনো ষড়যন্ত্র করে ফেলতে পারে। তোফাজ্জলের উচিত- দ্রুত অদিতির বিয়ে দিয়ে দেওয়া: গ্রামের লোকের থেকে নিজের সম্মান রাখতে এছাড়া আর উপায়ও নেই।

তবে যে ছেলের কাছে তিনি খবর নিয়েছেন, সে আধা ঘণ্টার ভেতরে দ্রুত ধ্রুবর সম্পর্কে সব বলে দিল যেন ও পূর্ব থেকেই জানত সব। ব্যাপারটা একটু খটকা লাগলেও পরে মনের ভুল ভেবে এড়িয়ে গেলেন উনি। তোফাজ্জল রাতের শেষ প্রহরে সিদ্ধান্ত নিলেন— তিনি ধ্রুবের সঙ্গে কথা বলবেন। অদিতির কথাও তুলবেন। ধ্রুব যদি ভালো ছেলে হয়, তাহলে তার ভদ্র-শান্তশিষ্ট মেয়ে অদিতির জন্যে ও মন্দ হবে না।
সকালে আগের মতোই; ধ্রুব সকাল সকাল উঠল। ঘড়ির কাঁটায় তখন সবে ৮টা। ধ্রুব খেতে বসেছে; পাশে তোফাজ্জল বসা। তোফাজ্জল গাঢ় চোখে তাকে নজরে রাখছেন। ধ্রুব ফাহিমার সঙ্গে মনখুলে গল্প করছেন। ইফাজের সঙ্গেও টুকটাক কথা চালাচ্ছে। তোফাজ্জল ওইদিন সারা দিন ধ্রুবকে নিজের চোখে দেখলেন। তার চলাফেরা, কথাবার্তার ধরন, গ্রামের লোকদের সঙ্গে ব্যবহার—সবকিছু দেখলেন। এসব দেখে তিনি একপর্যায়ে সন্তুষ্ট হলেন এবং সিদ্ধান্ত নিলেন—ধ্রুব অদিতির জন্য উপযুক্ত!

পরদিন সকালে তোফাজ্জল ঘুম থেকে উঠে ; ধ্রুবর বাংলোর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ধ্রুব তখন রুমে ফোনে ইমনের সঙ্গে কথা বলছিলো। তোফাজ্জল ঘরের বাইরে পায়চারি করতে করতে ভাবছেন—ধ্রুবর সামনে কথাটা কীভাবে তুলবেন! ফাহিমা কাপড় মেলে দিতে দিতে উঠোনে স্বামীকে উসখুশ করতে দেখে এগিয়ে উনার পাশে এসে দাঁড়ালেন; উনার দ্বিধা দূর করার জন্যে বললেন———‘এত কী ভাবছেন? বলে ফেলুন। মেয়ের জন্য ভালো পাত্র পেলে আমাদের ইগো সরিয়ে বলতে দোষ কী?’
তোফাজ্জল ফাহিমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা অন্যমনস্কভাবে বললেন——‘ধ্রুবকে কি আমরা নিজেদের ভুল ভেবে নিচ্ছি না তো? ও যদি——।’

ফাহিমা তার কথা থামিয়ে বললেন——‘ওমন কিছুই না। আপনি যান, কথা বলুন। আপনার বিচার কখনো ভুল হয়না।’
তোফাজ্জল-ফাহিমার কথোপকথন দূর থেকে শুনে ইফাজ এক দৌড়ে অদিতির ঘরে গেল। অদিতি তখন নিজের বিছানা গোছাচ্ছিল। ইফাজ গিয়ে বিছানার ওপর লাফিয়ে পরলো! ঝাড়ু হাতে অদিতি রেগে গেল; রাগ দেখিয়ে বলল——‘মাত্র বিছানা গুছিয়েছি,ময়লা করে ফেলবি। উঠ বিছানা থেকে।’
ইফাজ ভ্রু নাচিয়ে-নাচিয়ে বললো ——‘যা বলতে এসেছি না; শুনলে তুমি আমাকে কোলে তুলে নাচবে।’
অদিতি বিরক্ত হয়ে বলল——‘কী খবর?’
ইফাজ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল——‘আগে চকলেট দাও; তারপর বলব।’
অদিতি পাত্তা দিল না; ইফাজ বোধহয় আবার ঢপ মারছে। ও ঝাড়ু দিয়ে বিছানার আরেক পাশ ঝাড়তে ঝাড়তে বললো ——‘আমার কাছে চকলেট নেই। ভাগ এখান থেকে।’
ইফাজ এবার অদিতির কাছে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল——‘তোমার আর ধ্রুব ভাইয়ার নামে খবর আছে গো; খবর আছে।’

অদিতির বুক কেঁপে উঠল;ঝাড়ু হাতে ও অবাক হয়ে ইফাজের দিকে তাকাল! ইফাজ হাসছে;অদিতি ফাঁকা ঢোক গিলে আশপাশে কেউ আছে কিনা দেখে নিল; দরজায় খিল তুলে দিল। তারপর ও দ্রুত ড্রয়ার থেকে চকলেট নিয়ে ইফাজের হাত থামিয়ে দিয়ে ওর পাশে বসল; কম্পিত গলায় বলল ——‘ক…কী খবর; বল আমাকে।’
ইফাজ চকলেট খেতে খেতে জবাব দিল ——‘আব্বা তোমার বিয়ের কথা বলবে আজ ধ্রুব ভাইয়ার সঙ্গে। আমি শুনেছি মা আর আব্বা কথা বলছেন; ধ্রুব ভাইয়ার কাছে তোমার নাম প্রস্তাব রাখবেন।’
অদিতির সমস্ত রূহ যেন এ কথা শুনে মুহূর্তেই কেঁপে খানখান হয়ে গেল। ও সটান দাঁড়িয়ে গেল; চোখ বড়বড় করে তাকাল ইফাজের দিকে। অবিশ্বাস্য গলায় বলল ——‘তুই ফ…ফাজলামো করছিস।’
ইফাজ হেসে হেসে বলল ——‘ফাজলামো না; যা শুনেছি তাই বলেছি। বিশ্বাস করলে করো, না করলে নাই।’
অদিতি থম হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ইফাজের কথা শুনে মনে হচ্ছেনা- ও মিথ্যা বলছে। অদিতিকে রোবটের মতো দাড়িয়ে থাকতে দেখে ইফাজ হেসে বিছানার উপরে উঠে অদিতির গলা জড়িয়ে ধরে বলল ——‘ধ্রুব ভাইকে আমার হেব্বি লাগে। তোমার সঙ্গে বিয়ে হলে আমি এখন থেকে তাকে সবার সামনে দুলাভাই ডাকব। আর একাকি ডাকতে হবে না।’

অদিতি ভ্রু কুঁচকালো; কাপা গলায় বলল ——‘এ.একাকী দু…দুলাভাই মানে?’
ইফাজ অদিতিকে ছেড়ে দিয়ে হতাশ গলায় ঠোঁট উল্টে বলল ——‘ধ্রুব ভাইয়া আমাকে উনার ক্যামেরা দিয়ে শর্ত দিয়েছেন যেন আমি তাকে একা পেলে দুলাভাই বলে ডাকি; আর কাউকে যেন দুলাভাই না ডাকি।’
অদিতি ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল ইফাজের দিকে; পরপর শব্দ করে হেসে ফেলল। অদিতি ইফাজকে কোলে নিয়ে বলল ———‘ক্যামেরা একেবারে দিয়ে দিয়েছেন?’
ইফাজ কোল থেকে নামার জন্যে ছটফট করতে করতে উত্তর দিল———‘হ্যাঁ; সঙ্গে ফিল্ম দিয়েছে এত্তগুলা।’
অদিতি হেসে হেসে ইফাজের গালে চুমু খেলো। ইফাজ লজ্জা পেয়ে গেল যেন; ও কোল থেকে নেমে এক দৌড়ে বাইরে চলে গেল। অদিতি এবার বুকে হাত চেপে জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগলো; ওর সারা শরীর কাঁপছে রীতিমত। কি শুনছে এগুলা? অদিতি সোজা দৌড়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো; কান পেতে শোনার চেষ্টা করল বাবা-মায়ের কথা।

হঠাৎ তোফাজ্জল-ফাহিমার কথার মধ্যে বাইরে এসে ঢুকল সেদিনের বিচারে সেই ছেলেটা; নাম সুমন। উঠোনের সামনে থেকে ডাকল ——‘চাচা; আছেন বাড়িতে?’
তোফাজ্জল কথার মধ্যে ভ্রু কুঁচকালেন; সদর গেইটের দিকে তাকালেন ফিরে। ফাহিমা মানুষ দেখে আঁচল দিয়ে মাথা ঢেকে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল। সুমনের হাতে ব্যাগ; সে এগিয়ে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াল তোফাজ্জলের। তোফাজ্জল ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকালেন; সুমন হেসে বললো ——‘আপনার বিচারে আমি গ্রাম থেকে চলে যাচ্ছি, চাচা। তবে যাওয়ার আগে কিছু জানিয়ে যেতে চাই।’
তোফাজ্জল বললেন ——‘পরে জানিও; আমি ব্যস্ত এখন।’

তোফাজ্জল কথা বলে ধ্রুবর ঘরে ঢুকবেন, তার আগেই সুমন বলল ——‘আপনার ঘরে যে আপনি এক চরিত্রহীনকে জায়গা দিয়েছেন সেটা গ্রামবাসীকে জানিয়ে দিয়ে এলাম চাচা।’
তোফাজ্জল থেমে গেলেন মুহূর্তেই; ভ্রু কুঁচকালেন! সুমনের দিকে ফিরে বললেন ——‘মানে?’
সুমন তোফাজ্জলের বিস্মিত মুখের দিকে চেয়ে বিশ্রী হাসল! মুখ এগিয়ে আনলো উনার দিকে; হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে রেখেই বলল ——‘এই যে আপনি ধ্রুব ইয়ামিন নামক একজন বরিশালের লোক নিজের ঘরে জায়গা দিয়েছেন। সে আসলে ঢাকার খাদ্য মন্ত্রীর বজ্জাত, উগ্র চরিত্রহীন ছেলে। গ্রামে এসেছে গ্রামের মেয়েদের গোপনে ফুসলানোর জন্য। আপনি গ্রামের প্রধান হয়ে সেই ছেলেকে নিজেরই বাড়িতে জায়গা দিয়েছেন। আপনার যুবতী মেয়ে কি আদৌ প্রেম করছে না তার সঙ্গে; তার কী গ্যারান্টি? আর আপনি যে ইচ্ছে করে গ্রামের বাকি মেয়েদের বিপদে ফেলছেন না তারই বা কি গ্যারান্টি?’

অদিতি ওদের কথা শুনতে পারছে না; তবুও ওর মন কেন যেন কু ডাকছে। ওর হাসিখুশি মুখটা মুহূর্তের মধ্যে মলিন হয়ে গেল! ওদের কথা বলার ভঙ্গি ওর ভালো লাগছে না। অদিতি ধীর পায়ে জানালা থেকে সরে দাঁড়াল। আস্তে করে সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পর্দার আড়ালে তাকাল বাইরে। তোফাজ্জল রেগে তাকালেন সুমনের দিকে; বললেন———-‘ আমার সঙ্গে বেয়াদবি আমি বরদাস্ত করব না সুমন। কি প্রমাণ আছে তোমার কাছে? আমি খবর নিয়েছি; ধ্রুব ভালো ছেলে।’

সুমন হাসল কথাগুলো শুনে। ওর ফোন নিয়ে তোফাজ্জলকে একটা একটা করে ছবি দেখাল। তোফাজ্জল দেখলেন! ধ্রুব একটা নীল শাড়ি পরা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আছে; যার মুখ দেখা যাচ্ছে না; শুধু পেছনের দিক দেখা যাচ্ছে। পরের ছবিতে ধ্রুব ওই মেয়ের কপালে চুমু খাচ্ছে; আরেক ছবিতে ধ্রুব ওই মেয়ের গালে চুমু খাচ্ছে। এসব দেখে তোফাজ্জলের মাথায় রীতিমত বাজ পড়ল।
অদিতি দূর থেকে এসব ছবি দেখে আঁতকে উঠে মুখে হাত চেপে সরে গেল দু কদম। এটা…এটা তো ওর ছবি; ওর কিডন্যাপের দিনের ছবি। এটা…এটা সুমন ভাইয়ের হাতে কি করে এলো? অদিতির ঘাম ছুটে গেছে মাথার দিকে। কি হচ্ছে সামনে; ও এসব আন্দাজ করতে পারছে এক্ষুনি। অদিতি শ্বাস-প্রশ্বাস এলোমেলো হয়ে গেল। ধ্রুব! ধ্রুব কোথায় এই মুহূর্তে?

তোফাজ্জল হতভম্ব হয়ে গেলেন ছবিগুলি দেখে। উনি এবার চেঁচিয়ে ডাকলেন———‘ধ্রুব! বাইরে বেরোও।’
ধ্রুব রুমে ইমনের সঙ্গে কথা বলছিল। তোফাজ্জলের হাঁকডাক শুনে ও দ্রুত ফোন কেটে ভদ্র ছেলের মতো শার্ট ঠিকঠাক বেরিয়ে এলো বাইরে। তোফাজ্জলের পাশে সুমনকে বিশ্রী হাসি হাসতে দেখে ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে তাকাল; তোফাজ্জল সুমনের ফোন নিয়ে ধ্রুবর সামনে দাঁড়ালেন। শুরুতেই জিজ্ঞেস করলেন———‘তুমি কোথায় থাকো?’
ধ্রুব থমকাল; এই ধরনের প্রশ্ন এখন হুটহাট করার মতো নয়! ধ্রুব চুপ করে আছে দেখে তোফাজ্জল রেগে বললেন———‘কোথায় থাকো তুমি? আমার বাড়িতে কি উদ্দেশ্যে এসেছ?’

ধ্রুব মাথা বাকিয়ে দূরে অদিতির হতভম্ব-ভয়ার্ত চোখের দিকে তাকাল! অদিতির চোখ-মুখ ছিলো চূড়ান্ত ভয়ার্ত; ও ধ্রুবর দিকে চেয়ে শুকনো ঢোক গিলে চোখ নামিয়ে ফেলল! ধ্রুব বুঝতে পারলো- ও ধরা পরে গেছে। ও শান্ত চোখে তোফাজ্জলের দিকে তাকাল; কণ্ঠটা বোধহয় একটু কাপলোও! ও বললো———‘আমি ঢাকায় থাকি।’
তোফাজ্জল এবার যেন রেগে ফে/টে পড়লেন; বললেন———‘ঢাকায় থাকো; ঢাকার মন্ত্রী বাপের বজ্জাত উগ্র একটা ছেলে; এই গ্রামে ফস্টিনষ্টি করার জন্যে এসেছ;এর বাইরে আর কিছু বলার আছে তোমার?’
ধ্রুব রাগলো ভেতরে ভেতরে; আজ অব্দি কেউ ওর সঙ্গে এতটা গলা উঁচু করে চিৎকার করে কথা বলার সাহস পায়নি; ধ্রুব দেয়নি কেকে সেই সাহস-টুকু। অথচ তোফাজ্জল ওকে যা-তা গলায় বলে যাচ্ছেন। ধ্রুব রাগ নিয়ন্ত্রণ করে; শান্ত গলায় বলল———‘আমি এমন ছেলে নই আংকেল। আমার মিথ্যা বলার কারণ ছিলো। আপনি শান্ত হন; আমি এক্সপ্লেন করবো আপনাকে।’

তোফাজ্জল শুনলেনই না ধ্রুব কি বললো; উনি রেগে বললেন———‘কি এক্সপ্লেন করবে তুমি?’ এসব—-
বলে সুমনের থেকে ফোন নিয়ে ধ্রুবকে ছবি-গুলো দেখালেন। ধ্রুব ছবিগুলি দেখে; ওর চোখ বড়বড় হয়ে গেল।এটা তো ওর আর অদিতির ছবি! ও আহাম্মকের মতো দ্রুত মাথা তুলে দূরে অদিতির দিকে তাকাল। অদিতির চোখ টলমলে; অদিতি জানে জানে এখানে কেটে ফেলে দিলেও এই মেয়েটা যে অদিতি সেটা সে স্বীকার করবে না। বরং নিজের ঘাড়ে নিবে চরিত্রহীনের অপবাদ! কিন্তু অদিতি জানে; ধ্রুবর জীবনে অদিতিই সর্বপ্রথম নারী।
ধ্রুব অদিতির থেকে চোখ সরিয়ে ফেলল। মাথাটা নামিয়ে ফেলল;উত্তর দিল না কিছু। তোফাজ্জল বললেন———‘উত্তর দাও। আমার গ্রামে আমারই বাড়িতে তুমি মিথ্যা বলে থাকছিলে এতদিন; তোমার উদ্দেশ্য কি?’
তোফাজ্জল একটু থামলেন; অবিশ্বাস নিয়ে এবার বললেন———‘ধ্রুব; তুমি কি নারী পাচার করো?’
ধ্রুব থমকাল; মাথা তুলে হতভম্ব হয়ে তাকাল তোফাজ্জলের দিকে। বলল———‘আমি এমন ছেলে নই! আর ছবির এই মেয়েটাকে আমি ভালোবাসি! ব্যাস; আর কিছু না।আমাদের সম্পর্ক পবিত্র; ছবিতে যা দেখাচ্ছে আমাদের মধ্যে তেমন কোনো নোংরা সম্পর্কই নেই।’

তোফাজ্জল চোখ বুজে শ্বাস ছাড়লেন। হেসে তাচ্ছিল্য করে বললেন———‘বুঝতে পারছি; এ কেমন ভালোবাসা। এই মেয়ের বাপের জন্যে আজ আমার আফসোস হচ্ছে। এলোমেলো শাড়ি পরে ঢলাঢলি করে তোমার সঙ্গে। দোষটা এই মেয়েদের না; দোষটা ওদের বাবা-মায়ের; যারা ওদের ঘরে একটা নোংরা মেয়ে পয়দা করেছে।’
ধ্রুব এবার আর নিজের রা একটুও সামলাতে পারল না; আঙুল দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল———‘এনাফ আংকেল; আপনি আমাকে বাজে বলার, খারাপ বলার, নষ্ট বলার যা ইচ্ছা বলুন; ওকে নয়। ওকে একদম নয়। আমি জানি; ও কতটা পিউর একটা মেয়ে। আপনি জানেন না; কিচ্ছু জানেন না আপনি।’

তোফাজ্জল রাগের মাথায় কি বলছেন, উনি নিজেও জানেন না। মূলত উনি আহত হয়েছেন—উনার গৌরব আজ আহত হয়েছে। ধ্রুবকে এত ভালো ভাবেন; উনার বিচার কখনো ভুল হয় না, সেটাই জানতেন উনি এতদিন। আজ উনার চোখের বিচার নস্যাৎ প্রমাণিত হয়েছে। নিজের প্রতি নিজেরই ঘেন্না ধরে গেল তোফাজ্জলের।
ধ্রুবর চোখ মারাত্মক লাল হয়ে আছে; যেকোনো মুহূর্তে ও তোফাজ্জলকেও——
ধ্রুব রেগে অদিতির দিকে তাকাল। অদিতি ততক্ষণে কেঁদে ফেলেছে। ফাহিমা চেঁচানো শুনে দৌড়ে এলেন বাইরে। ততক্ষণে যা ঘটার ঘটে গেছে। ধ্রুব নিজেকে শান্ত করলো; শুধুমাত্র অদিতির চোখের পানি দেখে। শুধু অদিতির বাবা বলেই,ও নিজেকে ছোট করে বলল———‘একটা মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হচ্ছে আংকেল। আপনি রাগের মেজাজে আছেন; আমরা বসে কথা বলি; প্লিজ?’

তোফাজ্জল থামলেন; শান্ত চোখে ধ্রুবকে দেখলেন। পরে সাফসাফ জানিয়ে বললেন———‘তুমি আজকেই এই গ্রাম থেকে এক্ষুনি এই মুহূর্তে চলে যাবে। তোমার ব্যাগপত্র গোছাও।’
ধ্রুব এবার যেন মারাত্মক অধৈর্য‍্য হলো; অস্থির ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো দু কদম; বলল———‘আংকেল আমি এক্সপ্লেইন করব সব; প্লিজ! আমাকে জাস্ট দু মিনিট সময় দিন।’

অদিতি শুধু তাকিয়ে ছিল ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব যে জীবনেও কারো কাছে মাথা নত করে; কাউকে অনুরোধ করে কিভাবে শিখেনি; আজ অদিতির জন্যে ও কারো সাম্বে মাথা নত করল। অদিতি এসব দেখার আগে কেন ধ্রুবকে রাগ দেখিয়ে চলে যেতে বললো না; কেন ধ্রুবকে নিজের লাইফে আসার জন্যে লাই দিল—- আজ বড্ড আফসোস হচ্ছে অদিতির। অপরাধবোধে অদিতির গা জ্বলে উঠল যেন। ও মাথা নাড়িয়ে টলমলে চোখে চেয়ে বিড়বিড় করতে লাগলো—‘চলে যান ধ্রুব; চলে যান। আর কত আমার অ/পমান সইবেন?’
ধ্রুব অদিতির বারণ শুনলো না; ওর দিকে তাকাল না; বরং তোফাজ্জলের কাছে এগিয়ে এসে কাতর গলায় বলল———‘এই বেগ ইউ আংকেল; জাস্ট দু মিনিট।’

তোফাজ্জল চোখ বন্ধ করে শ্বাস ছাড়লেন; ধ্রুবর দিকে আর একবারের জন্যে তাকালেন না; পেছন ফিরে শান্ত গলায় স্রেফ বললেন———‘তোমার কাছে আর দশ মিনিট আছে; দশ মিনিট পরে তোমার মুখ আমি এই গ্রামের কোথাও দেখতে চাই না।’

তোফাজ্জল চলে গেলেন ঘরে। ঘরে ঢুকেই দরজায় খিল তুলে দিলেন। অদিতি জানালার পাশে দাড়িয়ে ছিলো; বাবা আসতে দেখেই ও ঘরে ঢুকে গেল। নিজের ঘরে ঢুকে ও জানালার পাশে পর্দা সরিয়ে তাকাল বাইরে! অদিতির চোখ টলমলে; কান্নায় ভেসে যাচ্ছে ওর দুই-চোখ! কি থেকে কি হয়ে গেল আজ? ড্রাইব-অদিতির বিয়ের কথা থেকে এখন এসব! এটা কি কোনোভাবে দুঃস্বপ্ন হতে পারেনা! ধ্রুবর মন থেকে অদিতির বাবার করা অপমান কি অদিতি কোনভাবে মুছে ফেলতে পারেনা?

আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ২২

ধ্রুব তখন হতাশ হয়ে সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখ-মুখ উত্তপ্ত; রাগে মাথার ভেতরটাও ফা/টছে। সুমন তার দিকে তাকিয়ে বিশ্রী হেসে চলে গেল। ধ্রুব অদিতির দিকে তাকাল; অদিতির কান্নাভেজা চোখ ধ্রুবর ভেতরটা অব্দি নাড়িয়ে ফেলল। ধ্রুব চোখ নামিয়ে ফেলল; ওর এতদিনের প্ল্যান- এতদিনের অভিনয় সব মুহূর্তেই জলে গেল। অদিতিওই বোধহয় আর ধ্রুবর পাওয়া হলো না। সেদিনই ধ্রুব নিজের ব্যাগপত্র নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা দিল। শেষবারের জন্যেও অদিতির সঙ্গে দেখা করতে পারলো না; অদিতির কান্নাভেজা মুখ দেখেই ফিরে যেতে হলো ওকে খালি হাতে!

আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ২৪