আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ২৪

আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ২৪
অবন্তিকা তৃপ্তি

বাস চলছে নিজের গতিতে। লক্ষ্মীপুর টু ঢাকার বাস শারীরিকভাবে ভাঙাচোরা; লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু তখন হুটহাট অন্য কোনও বাসের টিকিট না পেয়ে সেটাই কিনে উঠেছে ধ্রুব। দুটো সিটের টিকিট কিনেছে; ওর পাশের সিটটাসহ! রাগ ওর মাথার ভেতরটা আপাতত ধপধপ করছে। কেউ পাশে বসলে তাকেও খু/ন করতেও দ্বিধা করবে না ধ্রুব, এমন ভয়াবহ রাগ জমে আছে মাথায়।
ধ্রুব বাসে উঠে; বাসটা লক্ষ্মীপুরের গণ্ডি পেরোতেই ধ্রুবর ভেতর থেকে বড় এক দীর্ঘশ্বাস বেরুলো। ধ্রুব জানালার বাইরে, পথের দিকটাতে চেয়ে দেখতে দেখতে বিড়বিড় করলো ————‘ই‍্যয়ু মেইড ধ্রুব ইয়ামিন অ্যা বিগ লুজার, অদিতি। নাও; ইউ শুড সেলিব্রেট;রাইট! সিলেব্রেট বিকজ; ধ্রুব এখন থেকে তোমার কেউনা; হি ইজ নোওয়ান; জাস্ট অ্যা লুজার।’

বাস অনেকটা পথ পেরোতেই ধ্রুবর ফোনে ইমনের কল এলো; তখন সকালের দিকে হুট করে কল কেটে দেওয়ায় ইমন বুঝতে পেরেছে- গণ্ডগোল তো কিছু একটা হয়েছেই। ইমনের কল পেয়ে ধ্রুবর মাথা সচল হলো; ও কল রিসিভ করে কানে ধরল। ওপাশে ইমন কল ধরতেই চেঁচিয়ে উঠল——‘ওই কল ধরস না ক্যান আমার? গার্লফ্রেন্ড পেয়ে বন্ধুর লাগে গাদ্দারী করো?’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ধ্রুব ইমনের ওসব ফাজলামো কানে না তুলে;উল্টো ইমনের উপরেই চেঁচিয়ে উঠলো——-‘আগে তুই আমারে আনসার দে! সুমনের কাছে আমার-অদিতির পার্সোনাল ছবি কীভাবে গেল?”
ইমন খাচ্ছিল; ও খাওয়া থামিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ——‘আরে এই সুমনটা আবার কে?”
ধ্রুব পরিচয় দিল পুরোটা; সঙ্গে সেদিনের বিচারের কথা-গুলো বলে; আজকের সকালের পুরো ঘটনা শর্টকার্টে বিবরণ দিল। সব বলা শেষে ধ্রুব এবার রাগ-জেদ নিয়ে বলে গেলো———‘অদিতির গ্রামের একটা লোক, আমাকে জানেও না ভালোভাবে। হি টার্নস আউট টু অ্যা স্পাই! ওর কাছে আমার আর অদিতির…’
ধ্রুব থামল; রাগ মাথায় এতটা চড়ে আছে যে বাকি বলতেও পারছে না। ইমন ভ্রু কুঁচকালো; সন্দেহ নিয়ে বললো ——‘তোর আর অদিতির?’

ধ্রুব হতাশ শ্বাস ফেলে; চোখ উল্টে উত্তর দিল ——‘আমাদের হাগ করার ছবি আছে ওর কাছে। এন্ড দিস বাস্টার্ড ছবিগুলো সোজা ব্লা/স্ট করেছে অদিতিরই বাবার সামনে। পুরো প্ল্যান রুইন করে ফেলেছে, ব্লা/ডি! আমি ওকে খু/ন করে ফেলব, ইমন; ট্রাস্ট মি।”
ইমন হুট করে অবাক হয়ে সটান দাঁড়িয়ে গেল, বলল ————‘হোয়াট? ছবিগুলো ওই পোলা পেল কীভাবে?”
ধ্রুব রেগে; বাম হাতের আঙ্গুলে কপাল চুলকাতে চুলকাতে বলল ———‘সেটা আমি কীভাবে জানব? ওই সময় ওই রুমে আমি আর তুই ছিলাম।’

ইমন ধ্রুবর বলার ইঙ্গিত দ্রুতই ধরে ফেলল; ভ্রু উঁচু করে সঙ্গেসঙ্গে নিজের দিক পরিষ্কার করে বলল ———‘ভাই কসম, আমি ছবি তুলিনি। আমার সামনে দুটো মানুষ লুতোপুতো করছে; এসব দেখতেই তো আমার শরম লাগে।”
ইমনের এই মুহূর্তে করা মজা ধ্রুবকে বিরক্ত করলো। ধ্রুব চোখ-মুখ কুঁচকে বলল ——‘ফাজলামো কমা। লিসেন; আমি ঢাকা আসছি আজ। আই অ্যাম শিওর ছবিগুলো ওই ছেলেগুলোই লিক করেছে। তুই এখন ওদের কাছে যাবি; আমি এড্রেস মেসেজ করেছি। তোর কাজ হচ্ছে তুই খবর বের করবি ওই ব্লা/ডি রা/স্কেল-গুলোর মুখ থেকে। বাকিটা আমি এসে দেখে নেব।’

ইমন মাথা নেড়ে সায় দিল। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করল ——‘আর অদিতি? ও ঠিক আছে?’
ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ——-‘ইয়াহ, শি ইজ সেইফ। বাট অ্যাই অ্যাম ইন ডেঞ্জার। তুই যা বলেছি, ওগুলো কর আগে।’
ইমন ধ্রুবর আতঙ্ক; ওর চিন্তা বুঝে। এবার আর ফাজলামো না করে নরম গলায় বললো ——‘ওকে ওকে। দেখছি আমি; তুই সাবধানে আয়।’

অদিতি বারবার ধ্রুবকে কল দিচ্ছে। বাসের মধ্যে ধ্রুব ওই কল কেটে দিচ্ছিল বারবার। রাগে ধ্রুব তখনো স্বাভাবিক হচ্ছে না। অদিতি শেষ পর্যায়ে দিশেহারা হয়ে মেসেজ করল ———‘ধ্রুব, আল্লাহর ওয়াস্তে কলটা রিসিভ করুন, প্লিজ।”
ধ্রুব মেসেজ দেখল, তারপর মেসেজবার থেকে সেটা সরিয়ে থম হয়ে বসে রইল। অদিতি আবার কল করলো; কেটে দিল ধ্রুব। এই পর্যায়ে অদিতি মেসেজ করলো ———‘অ্যাই অ্যাম সরি। আমার বাবার অপমানের শাস্তি আমাকে কেন দিচ্ছেন, ধ্রুব! আমি আপনাকে বারবার সতর্ক করেছিলাম; করিনি আমি?”
ধ্রুব এবারের যাত্রায় ফোন হাতে মেসেজ সিন করল! অদিতি সিন করেছে দেখে সঙ্গে সঙ্গেই আবার কল করল ধ্রুবকে। ওপাশ থেকে ধ্রুব কল রিসিভ করে কোনো ভনিতা না করে স্রেফ বলল ——‘কি বলবে বলো?”
অদিতি কান্না আটকে ব্যাকুল গলায় বলল ——‘আপনি ঠিক আছেন তো, ধ্রুব?”

ধ্রুব নিজের রাগ সামলে উত্তর দিল ——‘আই’ম ফাইন।”
অদিতি আবারও বললো ——‘সবকিছুর জন্যে আমি সরি, ধ্রুব।”
ধ্রুব এবার নিজের রাগ সংবরণ না করতে পেরে চেঁচিয়ে উঠল ——‘অদিতি: হোয়াট সরি? তোমার বাবা আজ আমাকে অপমান করেছে, আম ফাইন উইথ দ্যাট; ট্রাস্ট মি। কিন্তু উনি তোমাকে কেন নোংরা বলে? কে দিয়েছে উনাকে সেই রাইট? হু?”

অদিতি বোঝানোর চেষ্টা করলো ——‘আব্বা জানতেন না ওটা আমি।”
ধ্রুব আবার চেঁচিয়ে উঠল ——‘জানেন না তাহলে একটা মেয়েকে নিয়ে এমন কথা বলার অধিকারও উনার নেই। কিন্তু ওটা যদি তুমি না-ও হতে, অন্য কোনো মেয়ে তো হতো। উনি কিভাবে এসব বলেন? আই ক্যান্ট বিলিভ।”
অদিতি থেমে গেল; ধ্রুব দাঁত খিঁচে বলে গেলো ——‘ ই‍্যয়ু নো হোয়াট? তোমার বাবা একজন আস্ত সেলফিশ মানুষ! উনি উনার সম্মান, গৌরবের কাছে অন্ধ হয়ে গেছেন, লিটারেলি! আর তুমি তোমার সেই বাবার জন্যে আমাকে সাফার করাচ্ছো।”

অদিতি এসব শুনে তব্দা খেয়ে গেল। ও বলল ——‘আব্বা সেলফিশ নন, পরিস্থিতি এমন——”
ধ্রুব এবার চুড়ান্ত বিস্মিত হয়ে বলল ——‘ফর গড’স সেক, তুমি এখনো তোমার বাবাকে ডিফেন্ড করে যাচ্ছো!’
ধ্রুব ভুল ভাবছিল। অদিতি সঙ্গেসঙ্গে বোঝার ভঙ্গিতে বললো——‘আমি কাউকেই ডিফেন্ড করছি না, ধ্রুব; আপনি আমাকে ভুল ভাবছেন।”
ধ্রুব অদিতির এসব পক্ষ নিয়ে কথা বলাতে কথায় এবার বিরক্ত হতে শুরু করলো। ধ্রুব নিজের রাগ-টুকু অদিতির সামনে প্রকাশ করতে চাইল না। ও স্রেফ চাপা গলায় বললো——‘অদিতি, ফোন রাখো।’
অদিতি অবাক; কিছু বলতে চাইলো——‘আপনি…’
ধ্রুব এবারও চাপা গলায়; নরম থাকার ভান করে বললো ——‘আই সেইড, ফোনটা কাটো। আমি তোমার এসব পক্ষ ধরে কথা বলা জাস্ট নিতে পারছি না।”
অদিতি হতভম্ব হয়ে শুনে গেল ধ্রুবর কথা; পরমুহূর্তে ওর চোখ টলমল করে উঠল। এমন আচরণ করলো তো ধ্রুব! ঠিক আছে; ও আস্তে করে কলটা কেটে দিলো।

কল কেটে ফোনটা রীতিমত বিছানার উপরে ছুঁড়ে ফেলে দুহাতে মাথার চুল খামচে বিছানায় বসে গেল।ধ্রুব ওর সঙ্গে এমন করে কথা-গুলো কেন বলল? এখানে ওর দোষ কোথায়? ধ্রুবকে অদিতি বারবার; বারবার মানা করেছে। তারপরও কেন থাকল ওর বাড়িতে। ও তো ধ্রুবকে কোনো আশা দেয়নি। অদিতির বারবার মনে পরছে; ধ্রুবর সঙ্গে তোফাজ্জলের দেওয়া আচরণ-গুলো। দিলটা ছিড়ে যাচ্ছে সেসব মনে করে। কিন্তু…কিন্তু এসবে ওর এত খারাপ লাগবে কেন? ওরা তো প্রেম করছে না। তবে কিসের অদিতির এত দায়বদ্ধতা! ও ধ্রুবকে নিজের জায়গা থেকে বারবার সতর্ক করেছে! তবুও সে থেকেছে, অপমান সহ্য করেছে। এখানে অদিতির দোষটা কী? আর তোফাজ্জলের এই রূপ তো অদিতি জানতোই; এমনটা হবে সেটাও জানত। ধ্রুবকে কি বলেনি ও সেসব? এখন ধ্রুব কিসের এত রাগ; এগ্রেসিভ আচরণ দেখাচ্ছে।
অদিতি ভাবতে পারছে না আর; হঠাৎ নিজের ভাবনার এসব দন্ধের মাঝে ওর দরজায় ডাক পরলো —‘অ্যাই অদিতি, খেতে আয়।”

অদিতি থামল; চোখের পানি মুছতে মুছতে ভাঙা গলায় বলল——‘তোমরা খেয়ে নাও; আমি একটু ঘুমাবো।”
ফাহিমা আর ডাকাডাকি করলেন না; গত দু’রাত মেয়েটা একটুও ঘুমায়নি; সারাক্ষণ কেমন অন্যমনস্ক হয়ে থেকেছে। বাড়িতে এতগুলো ঝামেলা হয়ে গেল; এখন একটু বিশ্রাম নেওয়া উচিত। তিনি চলে গেলেন। অদিতি বিছানার উপরে মাথা রেখে শুয়ে পরলো; বালিশ ভিজে গেল তার চোখের জলে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই অদিতির ফোনটা বেজে উঠল। ও দুহাতে চোখ মুছতে মুছতে উঠে বসল। ফোন হাতে নিয়ে দেখে তানিয়ার কল। এমন মুহূর্তে তানিয়ার ফোন পেয়ে অদিতির থামল কিছুসময়ের জন্যে। ও কল রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে তানিয়া অস্থির গলায় বলতে লাগলো———‘অদিতি,ধ্রুব ভাই এক্সিডেন্ট করেছে। আমরা এই মুহূর্তে উনাকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি। তুই কি আসবি?”

‘এক্সিডেন্ট!’— পুরো কথা শুনে থ হয়ে গেল অদিতি! সে ফোনটা আবার সামনে নিয়ে নাম্বার দেখল। কয়টা বাজে? এক ঘণ্টা হয়েছে ধ্রুবর সঙ্গে কথা হয়েছে। এই এক ঘণ্টার মধ্যে এক্সিডেন্ট! অদিতি হতভম্ব হয়ে বলল——‘তুমি মজা করছো নাকি? তানিয়া, আমি মজার মুডে নেই। আমার লাইফে এমনিতেই অনেক ঝামেলা চলছে।”
তানিয়া এবার অধৈর্য হয়ে বলল——‘তোকে আমি ছবি পাঠাচ্ছি। ভাইয়ার অবস্থা খারাপ; আই ডোন্ট নো কী হবে সামনে। তুই আয়, প্লিজ।’

অদিতি কেঁপে উঠল! চট করে কম্পিত হাতে ফোন কান থেকে নামিয়ে ছবি দেখল।ছবিতে ধ্রুবর পুরো মুখ র/ক্তে ভেসে যাচ্ছে; চোখ দুটি নিভু নিভু; কপাল ফেটে গেছে একপাশে। অদিতির বুক আচমকা ধ্বক করে উঠল! ওর সম্পূর্ণ শরীর যেন ঠান্ডা হয়ে গেল; মুখে হাত চেপে উঠে দাড়িয়ে গেল। তানিয়া ততক্ষণে কল কেটে দিয়েছে।
অদিতি দাড়িয়ে আছে; ওর তখনও স্থির হয়ে ছবি দেখছে। তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরেছে। বিশ্বাস হচ্ছে না- ছবিগুলো ধ্রুবর। ধ্রুব… আজ ধ্রুবর যদি কিছু হয়ে যায়, অদিতি জীবনেও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। সারাজীবন এই অপরাধবোধ বয়ে বেড়াতে হবে। আর তাছাড়া সে নিজেও মরে….!

এর পরেরটুকু আর ভাবে না অদিতি।তাড়াহুড়ো করে ফোন বিছানায় ফেলে ব্যাগ গোছাতে লাগল। ব্যাগ গোছাতে গোছাতে ফাহিমাকে সজোরে ডাকতে লাগলেন। ফাহিমা ডাক শুনে দৌঁড়ে অদিতির রুমে এলেন।
অদিতি তখন পুরো রুম এলোমেলো করে দৌঁড়ে দৌঁড়ে ব্যাগ গুছাচ্ছে; পাগলের মতো লাগছিল তাকে। ফাহিমা পুরো রুমে একবার চোখ বুলিয়ে; অবাক হয়ে অদিতির দিকে তাকিয়ে বললেন—‘কই যাচ্ছিস তুই?’
অদিতি ব্যাগে এলোমেলোভাবে কাপড় ঢোকাতে ঢোকাতে অস্থির গলায় জবাব দিল——‘ঢাকায় যাচ্ছি।’
ফাহিমা অবাক হয়ে বললেন—‘আজ কেন? তোর না পরশু যাওয়ার কথা?”
অদিতি থামল; তবে কিছু না ভেবেই তৎক্ষণাৎ জবাব দিল——‘আমার ফ্রেন্ড এ/ক্সিডেন্ট করেছে; অবস্থা ভীষণ খারাপ। আমার যাওয়াটা দরকার, মা। আব্বা কোথায়? আব্বাকে বুঝিয়ে দিও।”

ফাহিমা বললেন——‘তোর বাপ তো বাজারে গেছে। আসবে রাতে। কাল যা তাহলে। ফ্রেন্ডই তো শুধু।’”
অদিতি এবার ধীরে পিছন ফিরে তাকাল ফাহিমার দিকে।টলমলে চোখে; ভাঙা গলায় বলল এটুকু——-‘ও..ওর কিছু হলে আমি ম..মরে যাব, মা। আমার যাওয়াটা দরকার।”
ফাহিম ভ্রু কুঁচকালেন; অদিতির এমন পাগল-পাগল অবস্থা দেখে সন্দেহ নিয়ে বললেন——‘ফ্রেন্ডটা কে শুনি?’
অদিতি থমকে গেল; কি উত্তর দিবে এখন? ফাহিমার প্রশ্নের জবাব যে ওর কাছে নেই। অদিতি কখনো চোখে-চোখ রেখে মিথ্যা বলতে পারেনা। তেমনি আজও পারেনি; ও দৃষ্টি লুকাতে লুকাতে জবাব দিলো ——-‘আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড; নাম…নাম জান্নাত। আসি, মা। আব্বাকে বুঝিয়ে দিও তুমি, প্লিজ। আমি পৌঁছে কল করব।”
ফাহিমা মেয়ের দিকে তখনো অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। অদিতি দরজা খুলে দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হলো।

ধ্রুবকে ডাক্তার চেকাপ করে দেখছিল; ধ্রুবর কপাল বেশি ফেটেছে। সেলাই লাগবে। আপাতত ধ্রুবর সেলাই চলছে। রুমের বাইরে ইমন ও ধ্রুবর থ্রি ইডিয়েটের দল অস্থির-ভাবে পায়চারি করছিল। পাশেই তানিয়া বসে আছে; তাকে খবর দিয়েছে ইমন। যেন ওর মাধ্যমে অদিতিকে টেনে বাড়ি থেকে এখানে আনা যায়। অনেক হয়েছে এদের ঝগড়া-বিবাদ। এবার যদি অদিতি ধ্রুবর অসুস্থতা দেখে একটু গলে! পা/ষাণ মেয়ে; চার আনা নেই গায়ে শক্তি। অথচ আস্ত এক ধ্রুবকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে। সাহস কম না এই মেয়ের!

ইমনের পাশে সৌরভ দাঁড়িয়ে আছে; তিনি হাসপাতাল আসছে পর থেকে ফোনে কথা বলছেন। এতক্ষণ হাসপাতালে বসে থেকে তার জরুরি কাজগুলো নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু ছেলের জন্য সব কাজ ফেলে রেখে এখানে বসে আছেন। যতই ধ্রুব তাকে বাবা না মানুক, তিনি তো ছেলে মানেন। তাই তার পিতৃ সত্ত্বা তাকে ছুটে নিয়ে এসেছে হাসপাতালে।
সৌরভের দিকে একপল চেয়ে ইমন ধীর পায়ে তানিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়াল; তানিয়া দ্রুত সিনিয়রকে সম্মান দেখিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তানিয়ার পাশে দাড়িয়ে ইমন নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল——‘অদিতিকে কল দিয়েছিলে?’
তানিয়া সঙ্গেসঙ্গেই বলল——‘জি ভাইয়া, আসছে ও।’
ফোন করার তিন ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে; এতক্ষণে এসে পৌঁছে যাওয়ার কথা। ইমন ভ্রু কুঁচকে ঘড়ি দেখে নিয়ে বলল——‘এত সময় তো লাগার কথা—-‘”

ইমনের কথা শেষ হওয়ার আগেই দেখা গেল অদিতি হাঁপাতে হাঁপাতে করিডোরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে ছোটখাটো ব্যাগ; চুল এলোমেলো; কোনো রকমে গায়ে ওড়না টেনে বেরিয়ে পরেছে বোঝাই যাচ্ছে। ইমন অদিতিকে দেখে খুশি হলেও মুহূর্তেই মুখটা গম্ভীর করে ফেলল ও। মেয়েটাকে ধ্রুব লাই দিয়েই এত সাহস বাড়িয়েছে; ইমন এতো লাই দিবে না ধ্রুবর মতো।যত লাই দেবে; তত এই চার আনার ছোটখাটো মেয়েটা তার বন্ধুর দিল ভে/ঙ্গেচুরে খানখান করে দিতে থাকবে।

অদিতি ইমনদের দেখে থমকে গেল; নিজের অনুভূতি সামলে ধীর পায়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়াল। ইমন অদিতিকে দেখে ভ্রু বাঁকিয়ে বলল——-‘তোমাদের না মান-অভিমান চলছে? তো এখানে কী? ধ্রুবকে দেখতে এসেছো?’
অদিতি মাথাটা নামিয়ে ফেলল; চুড়ান্ত অপরাধবোধ নিয়ে জবাব দিল ——‘সে কেমন আছে এখন? কোন রুমে?’
অদিতির এত চিন্তা দেখেও ইমন রাগী গলায় বললো——-‘ধ্রুবকে মেরে ফেললেই তো পারো; খামোকা বেচারাকে কষ্ট কেন দিচ্ছো?’
অদিতি তাকিয়ে রইল ইমনের দিকে; পরপর ব্যাকুল গলায় বলতে লাগলো——-‘সব আমার জন্য হয়েছে ভাইয়া। আমার বাড়ি থেকে—‘

ইমন অদিতিকে পুরো কথা বলতে না দিয়ে সৌরভের দিকে চেয়ে দ্রুত থামিয়ে দিল——‘ওকে ওকে; বুঝে গেছি। পাবলিকলি আর আমার বন্ধুর কষ্টের কথা আর বলো না; বোন।’
অদিতি থামল। ওর চোখ দুটো ফাঁকা;কান্না দমিয়ে রাখার দরুন গলা বারবার ওঠানামা করছে। হয়তো ইমনকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছে, কিন্তু বলতে পারছে না। ইমন সেটা বুঝে; অদিতিকে এ যাত্রায় আশ্বস্ত করে বলল——-‘ডোন্ট ওরি; তোমার হয়েও না হওয়া প্রেমিক ধ্রুব ঠিক হয়ে যাবে। সেলাই চলছে; বাকিটা আল্লাহ ভরসা।’

ডাক্তার রুম থেকে থেকে বের হতেই ইমন ওদিকে দৌড়ে গেল। অদিতি যাবে কি যাবে না ভাবছিল; ওপাশে সৌরভও দাঁড়িয়ে।তাই অদিতি সঙ্কোচ দেখিয়ে দূর থেকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইল ডাক্তারের দিকে। তানিয়া পাশ থেকে সেটা দেখলো! অদিতি-ধ্রুবর এই করুন প্রেমকাহিনি তানিয়াকে আকৃষ্ট করলো। ও ধীর পায়ে অদিতির পাশে এসে দাড়িয়ে ওর কাঁধে আলতো করে হাত রাখলো; বলল——‘ এখানে দাড়িয়ে না থেকে শুনে আয় যা।’
অদিতি দুহাতে চোখ মুছে; ভাঙা গলায় বললো শুধু—‘আমার জায়গা এখানেই।”
তানিয়া অদিতির ভাঙা মন বুঝে ওর কাঁধে হাতটা চেপে ধরে। এয়ক্ষ্ণে ভরসা পেয়ে এতদিনের জমিয়ে রাখা কান্না-গুলো যেন ছুটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। অদিতি ফাঁকা ঢোক গিলে কান্না আটকে বললো——‘সব আমার জন্য হয়েছে; তানিয়া। আমি তার এই অবস্থার জন্য দায়ী। তার কিছু হয়ে গেলে আমি নিজেকে কোনোদিন মাফ করতে পারব না, কোনোদিন না।’

বলে চোখের জল মুছে ফেলল অদিতি। তানিয়া অদিতির সামনে এসে দাড়ালো। ওর কান্নাভেজা মলিন মুখ দেখে বড্ড মায়া হলো তার। ও অদিতির গোলগাল-সরল মুখটা আগলে ধরে তার চোখের জল মুছে সান্ত্বনা দিয়ে বলল—‘ঠিক হয়ে যাবে সব; চিন্তা করিস না। একটা কথা; ধ্রুব ভাইকে নিয়ে তোর এত পুড়ছে কেন? তোর তো রিলেশনে নেই উনার সঙ্গে; রাইট? ফিরিয়ে দিয়েছিলি না ধ্রুব ভাইকে?’
অদিতি তাকিয়ে রইল তানিয়ার দিকে; এর কোনো জবাব যে ওর নিজের কাছেও নেই। তানিয়া সেই চাওনি রেখে হালকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো—-‘ দেখ অদিতি। তুই নিজেও কষ্ট পাচ্ছিস, বেচারা ধ্রুব ভাইকেও কষ্ট দিচ্ছিস। কেন এসব করে যাচ্ছিস, অদিতি? কিসের জন্যে? তুই এক পা এগোলে বাকিটা ভবিষ্যৎ আল্লাহ দেখবেন। কেন নিজেকে এভাবে আটকে রাখছিস?”

অদিতি সরে গেল; অস্থির গলায় বলল——‘তুমি জানো না আমার পরিস্থিতি। আমি এমন—-‘
তানিয়া ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল——-‘আমি জানি সব। সঙ্গে এও জানি, তুই অযথা বিষয়টাকে জটিল করে তুলছিস। নিজের উপর ভরসা রাখ। এমন হাজারো জটিলতার মধ্যেও মানুষ প্রেম করে বিয়ে করে। আপাতত নিজেকে একটা সুযোগ দে। প্রেম জীবনে বারবার আসে না, অদিতি। আর ধ্রুব, তার ময় বেপরোয়া-উগ্র একটা ছেলে শুধুমাত্র তোর জন্য নিজেকে এতটা বদলে ফেলেছে— এটার মানে তুই বুঝিস?’

অদিতি তানিয়ার থেকে চোখ সরিয়ে আলগোছে রুমের দিকে তাকাল; যেখানে ধ্রুব নিস্তেজ অবস্থায় শুয়ে আছে। তার মুখে লাগানো অক্সিজেন মাস্ক; হাত-পা অব্দি নড়ছে না। কপালে ব্যান্ডেজ; যার উপরে র/ক্তের ছোপ ছোপ দাগ। অদিতি ওদিকে চেয়ে রইল নির্নিমেষ। তানিয়া অদিতির চাওনি লক্ষ করে নিজেও তাকাল ওদিকে। একসময় অদিতি বলে উঠল——‘আমি তার সাথে শুধুমাত্র টাইম পাস করতে চাই না, তানিয়া। যদি কোনোদিন আমি তাকে কষ্ট দিই; বিয়ে করতে না পারি, সেদিন? সেদিন কী হবে? আমার ভীষণ ভয় হচ্ছে। তার মন ভেঙ্গে ফেললে আমার সারাজীবন অপরাধবোধ হবে।’

তানিয়া অদিতির মতো ওপাশে চেয়ে থাকতে থাকতে জবাব দি——‘টাইম সব বলে দেবে। আর তুই এটা চিন্তা কর; যে তুই যেন-তেন কাউকে ভালোবাসিস না। সে ধ্রুব, ধ্রুব ইয়ামিন! তোর জন্য সে সমস্ত পৃথিবী উল্টে ফেলতেও পারে। সম্ভব তার জন্য সেটা।’

আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ২৩

অদিতি তাকিয়ে রইল অচেতন ধ্রুবর দিকে।ধ্রুবর ওই ফ্যাকাশে মুখটার অদিতি আজও বড় টানে। এই ছেলেটা প্রেমিক হিসেবে দুর্দান্ত হবে। আর অদিতি সবসময়ই মনেমনে ধ্রুবর মতোই কাউকে চাইত; যে ওর জন্যে দুনিয়ার শব্জে বাজি লড়তে পারে।একদম হঠাৎ করে, মনের কোথাও যেন এগিয়ে যাওয়ার একটা আশা দেখতে পেল অদিতি।তারপর হঠাৎ করেই ওর মন থেকে সমস্ত ভয় উবে গেল। গ্রামের চাপা স্বভাবের অদিতি হুট করে সিদ্ধান্ত নিল— ওপাশে যে ছেলেটি র/ক্তাক্ত অবস্থায় শুয়ে আছে, তার হাতে হাত মিলিয়ে অনেকটা পথ চলবে সে। একটা সুযোগ দিবে নিজের জীবনকে। যা হয়ে যাওয়ার হোক; ধ্রুব নামক ওই ছেলেটাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সমস্ত পথ অদিতি হারিয়ে ফেলছে। বরং ওকে আকড়ে ধরার পথ খুলে দিচ্ছে একের পর এক। অদিতি অস্থির হয়ে উঠলো; ওই বখাটে-উগ্র ধ্রুবর প্রেমিক সত্ত্বা দেখার জন্যে। কবে সুস্থ হবে ধ্রুব ইয়ামিন?

আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ২৫