আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ৩১

আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ৩১
অবন্তিকা তৃপ্তি

সবসময় নিঃসঙ্গ, আধার রাতের ন্যায় স্থবির ইয়ামিন বাড়িতে আজ বড্ড কোলাহল। আশপাশে মানুষের বড্ড ভিড়! পুলিশ ব্যারিকেড, পুরো রাস্তাটা জুড়ে দুই সারি পুলিশ রক্ষী দাঁড়িয়ে, তাদের চোখে কোনো সমঝোতা বা দয়া দেখা যাচ্ছিল না। সাংবাদিকদের ক্যামেরার ফ্ল্যাশ একটার পর একটা চমকাচ্ছে, এখানকার ভাইরাল নিউজের প্রতিটা মুহূর্তে ক্যাপচার করতে পারলেই টিআরপি তুঙ্গে।

এইসব কিছুর মধ্যে, খাদ্য মন্ত্রী সৌরভ ইয়ামিনের একমাত্র ছেলে, তার ডান হাত ধ্রুব ইয়ামিন ভিড় ঠেলে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। বাড়ির ভেতরটা আজ খুব অস্বাভাবিক লাগছে।বাড়িতে ঢুকে সদর দরজার সামনে ঠাঁই ধ্রুব দাঁড়িয়ে গেল। সামনের সোফাটায় ভীষণ নীরব হয়ে বসে আছেন সৌরভ! তার চোখ স্থির,চোখের নিচে গভীর কালি, শরীরটা কিছুটা যেন একদিনেই ভেঙ্গে আসতে চাইছে। দুহাত একটার ভিতরে আরেকটা ঢুকিয়ে নিজের মুখের সাথে চেপে চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। ধ্রুব কেন যেন নিজের জন্মদাতার বাবার দিকে বহুদিন পর এভাবে তাকাল। সৌরভ ভেতরে ভেতরে এতটা ভেঙ্গে পড়েছিলেন; এসব ধ্রুবর নজরে কিভাবে পরলো না? কোথায় ছিলো ধ্রুব? অদিতির মধ্যে এতটাই ডুবে ছিলো; আশপাশ প্রায় ভুলতেই বসেছিল ধ্রুব।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ধ্রুব চোখ সরিয়ে আশেপাশে তাকাল। সোফার টেবিলের ওপর হরেক রকমের ফাইল ছড়ানো, কিছু ফাইল উন্মুক্ত হয়ে পরে আছে দুদুকের টিম মেম্বারদের হাতে। দুদকের টিম একটার পর একটা ফাইল চেক করে যাচ্ছে, তাদের মুখাবয়ব তীক্ষ্ণ, গভীর মনোযোগে দিয়ে সৌরভ ইয়ামিনের কীর্তিকলাপ আজ খুঁজে পেলেই প্রমোশন আটকায় কে?
সৌরভের দুপাশে পুলিশ দাঁড়িয়ে।তার থেকে একটু দূরে সোফায় দ্বিতীয় স্ত্রী তৃণা বসে আছে। বারবার সৌরভের দিকে চেয়ে ফুপিয়ে উঠছে। সেদিকে ধ্রুবর মন নেই। সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল; দুদকের টিম প্রধান ধ্রুবকে দেখে ফাইল থেকে মাথাটা তুলে ঠোঁটটা বাকিয়ে হাসল। বড় বিশ্রী ঠেকলো সেই হাসিটা ধ্রুবর কাছে! ধ্রুব হেঁটে তার সামনে দাঁড়াতেই, দুদকের টিম প্রধান রাকিব হোসেন উঠে দাঁড়িয়ে ঠোঁটে বিজয়ীর হাসি ঝুলিয়ে হাত বাড়িয়ে বললেন——-‘হ্যাই ইয়াং ম্যান। ভেরি ভেরি নাইস টু মিট ইউ।’

ধ্রুব উত্তরে নিজেও হাসে, মাথা নত করে ঠোঁট চেপে হেসে আবার তাকালো। কিছুই যেন এই মুহূর্তে এখানে হচ্ছে না; যেন রাকিবকে দেখে তার নাকে ঘুষি বসাতেও ধ্রুবর একটুও ইচ্ছে হচ্ছে না; সেরকম ভাবভঙ্গি নিয়েই ধ্রুব হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলো, উত্তরে বলল——-‘থ্যাংক ইউ! ফাইল-গুলো থেকে কিছু পেলেন?’
সৌরভ ছেলের দিকে মাথা তুলে তাকালেন। ধ্রুব এত্ত স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছেটা কি করে? ধ্রুবর আচরণ সুবিধার ঠেকল না। রাকিব হাতের উন্মুক্ত ফাইলের দিকে চেয়ে বলল———-‘বড়সড় গণ্ডগোল তো আছেই। যা পেয়েছি তাতেই জেল, হান্ড্রেড পার্সেন্ট। বাকি যা চেক করছি, তার তো বোনাস! ই‍্যয়ু নো!’

বলেই রাকিব চোখ টিপে হাসলো। ধ্রুব গা-ছাড়া ভঙ্গিতে সোফায় বসল। পায়ের উপর পা তুলে; অভদ্রের ন্যায় পা নাড়াতে নাড়াতে দুহাত সোফার হাতলে রেখে রাকিবের দিকে চেয়ে বললো————“জেল? উমম… গুড ওয়ার্ড!আচ্ছা, মন্ত্রী মানুষের জেল আদৌ হতে দেখেছেন কখনো? আপনি যে আগে সরকারের পা চাটতেন, তাদেরকেও দেখেছেন, তাদের কারো কোনো কারণে জেল হয়েছে? ওসব জেল নয়; নতুন মোড়কে জাস্ট একটা হাওয়া বদল আমাদের জন্যে! রাইট?’

ধ্রুবর পা নড়ছে; রাকিব ধ্রুবর নাড়ানো পায়ের দিকে তীক্ষ চোখে চেয়ে আবার ধ্রুবর দিকে তাকাল। ধ্রুব রাকিবকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আচমকা বড্ড বিনিয় নিয়ে তড়িগড়ি করে বলল———‘ আরে; দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন; জাস্ট হ্যাভ অ্যা সিট।’
রাকিবের মেজাজ গরম হচ্ছে ধীরে ধীরে। অথচ ধ্রুবর ঠোঁটে অসভ্যের ন্যায় একটা হাসি। সেই হাসি দেখে গা-পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে রীতিমত। রাকিব আলগোছে সোফায় বসল। তারপর নিজে বিশ্রী ভাবে বললো———-‘ বড্ড উড়ছ ধ্রুব! এত বিশ্বাস ভালো নয়।’
তারপর নিজের মুখটা ধ্রুবর দিকে এগিয়ে এনে ফিসফিস করে বলল———‘মিডিয়াকে খবরটা আমিই পাচার করেছি! জেল নাকি হাওয়া বদল তা তো দেখতেই পারবে সামনে। ওয়েট!’
বলে ক্রূর হাসল রাকিব! ধ্রুব উত্তরেদাঁত ঠোঁটে চেপে মাথা নিচু করে হেসে আবার তাকাল; ও রীতিমত হেসে উড়িয়ে দিল রাকিবের কথা-গুলো! তাদের কথার মধ্যে, দুদকের টিম মেম্বারদের একজন এসে রাকিবের কানে কিছু বলল—‘স্যার, এই ছেলেটার সম্পর্কে কিছু পাওয়া যায়নি।’
রাকিব রেগে তাকাল ওই মেম্বারের দিকে। শীট, সমস্ত প্ল্যান ভেস্তে গেছে! সে ধ্রুবর দিকে চেয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বললো

———‘অন্যায় করে প্রমাণও লুটপাট করেও ফেলেছো দেখছি?’
ধ্রুব উত্তরে হাসল, তার হাসি ছিল এবার ভিন্ন! ওসোফা থেকে হাত দুটো সরিয়ে একটা কুশন নিয়ে সেটি কোলের ওপর রেখে আরাম করে বসে বড় একটা শ্বাস টেনে বলল———‘ করতে হয় স্যার। আশেপাশে কিছু কুত্তার-বাচ্চা গুলো আছে না? ঘেউঘেউ করে কানের পোকা নাড়ানোর জন্য সবসময় বসে থাকে। সো সিলি, না?’
রাকিবের মুখটা ধ্রুবর গা-লি শুনে অপমানে লাল হয়ে গেল! চুপচাপ উঠে দাঁড়াল সোফা থেকে।ধ্রুবর দিকে চেয়ে বলল ——-‘ শীঘ্রই দেখা হচ্ছে কোর্টে। সারাজীবন জেল তো দিতে পারব না; কিন্তু হয়রানি তো করবোই! গুড বাই!’
বলেই সামনের পুলিশের দিকে চেয়ে কিছু একটা ইশারা করে চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে বেরিয়ে গেল সদর দরজা দিয়ে। পুলিশ কর্মচারী সৌরভের দিকে চেয়ে নিচু গলায় বলল——-‘স্যার, যেতে হবে।’
সৌরভ বড় করে শ্বাস ফেললেন! তৃণা এবার এগিয়ে আসলেন সৌরভের দিকে। অস্থির গলায় পুলিশ-গুলোর দিকে চেয়ে বললেন——-‘উনি একদম যাবে না। তোমাদের টাকা দিয়ে রাখে কেন? কিছু করতে পারছো না তোমরা?’
পুলিশ কর্মচারী গলাটা একটু নিচু করে বলল——‘সরি ম্যাম! মিডিয়া জেনে গেছে পুরো ব্যাপার। এখন চাইলেও কিছু করার নেই আমাদের হাতে।’

তৃণা বহু কষ্টে কান্না আটকে রেখেছিল। সৌরভ উঠে দাঁড়াতেই সে দৌড়ে সৌরভের কাছে গেলো; বললো———‘বারবার বলেছিলাম মন্ত্রী পদ ছেড়ে বিজনেসে হাত লাগান। এখন কি হবে? আমার এই দুনিয়ায় কেউ নেই সৌরভ! তুমিও চলে গেলে আমি একা হয়ে যাব।’
সৌরভ আলগোছে তৃণার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন ———‘ফিরব আমি। ফিরে কিছু মানুষকে জ-বাইও করবো। কেদো না।’
বলে সাদা পাঞ্জাবি ঠিকঠাক করে পুলিশকে বললেন———‘চলো।’

সৌরভ ধ্রুবর দিকে একবার চেয়েই চোখ সরিয়ে আগে-আগে হাটা ধরলেন। সৌরভ চলে গেলেন পুলিশের গাড়ি করে। সৌরভ যেতেই তৃণা এবার ধ্রুবর দিকে এগিয়ে গেল। ধ্রুব তাকিয়ে ছিল সদর দরজার দিকে। তৃণা এসে সোজা ধ্রুবর সামনে দাঁড়িয়ে গেল; অধৈর্য‍্য ভঙ্গিতে বললো———-‘ধ্রুব, প্লিজ তোমার বাবাকে নিয়ে আসো! তার জন্যে যা কিছুর দরকার করো, যা ইচ্ছা। তাও তাকে প্লিজ নিয়ে আসো! তোমার কাছে হাতজোড় করছি আমি।”
ধ্রুব তৃণার দিকে তাকাল; তার এবার অস্বস্তি হচ্ছে। এই মহিলাকে সে দু-চোখে দেখতে পারে না। সেটা উনিও জানেন। তাই নিজেও কখনো আগ বাড়িয়ে ধ্রুবর সামনে আসেননি। তবে আজ তার কথাগুলো ধ্রুবকে অস্বস্তি দিচ্ছে। ধ্রুব উঠে দাঁড়াল সোফা থেকে। তৃণা আবারো বলল——-‘ভালো লোয়ার আছে আমার কাছে, ধ্রুব। তুমি বললে আমি যোগাযোগ…”
ধ্রুব তৃণার কথা থামিয়ে দিল। চোখ তুলে একবারের জন্যেও ওই মহিলাকে না দেখে, তীব্র অস্বস্তি নিয়ে স্রেফ বলল——-‘আমি দেখছি। আপনি চিন্তা করবেন না।”
বলে এক মুহূর্তে দাঁড়াল না, বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।তৃণা সেখানটায় সোফায় হেলে বসে পরলো!

আজ ঠিক গুনেগুনে দুই দিন পর, ধ্রুব সেক্রেটারি রাহুলকে সাথে নিয়ে পপুলার ব্যাংকে এসেছে। ব্যাংকে ঢুকতেই, ব্যাংকের ম্যানেজার দ্রুত এগিয়ে গেল;———-‘ ধ্রুব স্যার! আপনি? কোনো দরকার?’
ধ্রুব আশপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখল। কর্মচারীরা বারবার আড়চোখে ওর দিকে তাকাচ্ছে, ধ্রুর চোখে চোখ পরতেই দ্রুত লুকিয়ে নিচ্ছে নিজেদের নজর! ধ্রুব মনেমনে হাসে! এখানের সবাই বিক্রি হয়ে গেছে! ধ্রুব সবার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে বলল——-‘কোক আনান। কথা বলি কিছুক্ষণ।”

ধ্রুবর বলা এটুকু শুধু কতগুলো শব্দ ছিলো না; বরং আতঙ্কিত বো*ম ছিলো! ম্যানেজারের গলা যেন শুকিয়ে এল, তবে সে হাসি মুখে বলল——-‘জি, জি। আসুন, ওই রুমটায় বসি।এই ছোটন, দুই ক্যান কোক এবং দুটো প্যাটিস নিয়ে আয়। আসুন ধ্রুব স্যার।’
ধ্রুব নির্বিকার হেঁটে চলল। ম্যানেজার তাকে নিয়ে একটি ঘরে ঢুকল। ঘরটিতে ঢোকার পর ধ্রুব পায়ের ওপর পা তুলে বড় শ্বাস ফেলে শরীর স্ট্রেচিং করতে করতে ঘরটাকে একটু ভালোভাবে দেখে নিল। তারপর চেয়ারে বসতে বসতে ম্যানেজারের দিকে না চেয়েই বলল——-‘রোলেক্সের ঘড়ি কবে থেকে পরা শুরু করলে, ওসমান?’
ব্যাংকের ম্যানেজার ওসমান এ কথা শোনা-মাত্রই তাড়াহুড়ো করতে করতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হাতটা আড়াল করার চেষ্টা করলো,ফাঁকা ঢোক গিলে বললো ——-‘সবই আপনার দয়া ভাই।”

ধ্রুবর স্রেফ হাসল; রুমটা ভালো করে দেখতে দেখতে জবাব দিলো———-‘দয়া! ভালো বলেছো কিন্তু।’
ওসমান ঢোক গিলে। আজকে ধ্রুবকে কিছুই স্বাভাবিক লাগছে না। সৌরভ ইয়ামিন জেলে যাওয়ার পর, ধ্রুব প্রথমদিনেই এসেছিল ব্যাংকে। তার সেদিনের কথা বলার ভঙ্গিমা আর আজকের কথা বলার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত! আজ যেন অন্য এক ধ্রুব!
ওসমান সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো; তীক্ষ্ম চোখে ধ্রুবর মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছে আপাতত। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা ছেলে কোক এবং প্যাটিস এনে রাখল। ধ্রুব কোকের বোতল খুলে সেটাতে চুমুক দিল। কোকের ঠাণ্ডা তরল তার গলায় ঢালতে ঢালতে হঠাৎ বলে উঠলো———-‘ওসমান, আমাকে এক মাস আগের ১১ তারিখের সিসি টিভি ফুটেজটা একটু দেখাও তো। কষ্ট করে এলাম, সিনেমা দেখে যাই। কী বলো?”
‘সিনেমা? সোজা ১১ তারিখের?’—-

ওসমান একটু হকচকিয়ে গেল। ধ্রুব….ধ্রুব কি কোনোভাবে সব জেনে গেছে? না জানবে কিভাবে? জানার কোনো চান্সই নেই।ওসমান শিওর হওয়ার জন্যে আবার মাথা সামনে এনে জিজ্ঞেস করলো——-‘জি স্যার?’
ধ্রুব ওসমানের চোখের দিকে তাকালো! তীক্ষ্ম চোখে ওসমানের চোখ দেখতে দেখতে বলল——‘১১, ১১ তারিখ! সিসিটিভি ফুটেজ লাগবে আমার। এনে দাও।’
ওসমান রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছল, তারপর কম্পিত গলায় বলল——-‘ জি স্যার, আনছি।’
ওসমান বলল এবং দ্রুত বেরিয়ে গেল। রাহুল তখন আরাম করে প্যাটিস খাচ্ছিল। ধ্রুব খাওয়ার মচমচ শব্দে কিছুটা বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকাল এবং বলল——-‘খেতে এসেছ নাকি এখানে?খাওনি জীবনে এগুলো?”

রাহুল খাবার খাওয়া থামিয়ে কিছুটা ভ্যাবলার মতো ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে বলল——-‘স্যার জেলে যাওয়ার পর আমার উপর দিয়ে রোলার কোস্টার যাচ্ছে স্যার। আজকে একটু রিল্যাক্স আছি। একটু খেয়ে নেই প্লিজ?’
ধ্রুব চোখ উল্টে হতাশ হয়ে শ্বাস ফেলল এবং ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে বলল——-‘ঠিকাছে; গেলো।’
কিছুক্ষণ পর, ওসমান সিসিটিভি ফুটেজ ল্যাপটপে নিয়ে হাজির হলো। ধ্রুব আরাম করে ফুটেজ দেখতে বসে! ১১ তারিখের সকাল থেকে টেনে ভিডিও দেখে যায়। দুপুরের টাইমে আসতেই হুট করে ভিডিও ক্র্যাক হয়ে গেল। ওসমান বাঁকা হাসল মনেমনে! চান্দু এবার কি করবে? ওসমান মুখটা বড্ড দুঃখী বানিয়ে বললো——-‘ শিট; ভিডিও ক্র্যাক হয়ে গেছে স্যার। আমাদের কাছে তো এটার আর এক্সট্রা মেমরি নেই।”
ধ্রুব রাগার ভান করে চেঁচিয়ে বললো———‘শিট এখন কি হবে?’

ওসমানও ঠোঁট উল্টে তাকালো ধ্রুবর দিকে! ধ্রুব ওই মুখের দিকে চেয়ে হঠাৎ ওর ডান চোখটা টিপে হেসে বলল ———‘ডোন্ট ওরি, আমার কাছে এর এক্সট্রা ফুটেজ আছে।”
বলে পকেট থেকে একটা পেনড্রাইভ বের করে ল্যাপটপে লাগাল। ওসমানের চোখ বড় হয়ে গেল। পেনড্রাইভ? এটা তো হারিয়ে গিয়েছিল! ধ্রুব কোথায় পেল? ওসমানের মেরুদণ্ড দিয়ে যেন একটা শীতল স্রোত চলে গেল। তাদের ব্যাংকের মধ্যেই কেউ ধ্রুবের সাথে হাত মিলিয়েছে! কে করেছে এই গাদ্দারি! হঠাৎ করে বুকের মধ্যে যেন একটা কঠিন চাপ অনুভব করতে লাগল। সামনে যা হবে; ভাবতেই গলাটা শুকিয়ে এলো!

ধ্রুব ফুটেজে দেখল, ১১ তারিখের দুপুরে, বিরোধী দলের মন্ত্রী কামরুল ব্যাংক অফিসে এসেছে, সঙ্গে দলবল। ওসমান ওদের রিসিভ করেছে। ওদের দলের একজন লোক ব্যাংকের সকল কর্মচারীর হাতে লুকিয়ে টাকার বান্ডিল তুলে দিচ্ছে, ওসমানের মুখে হাসি লেগেই আছে। তারপর ওসমানের হাতে কয়েক বান্ডেল টাকা তুলে দিতেই ওসমান একটা ফাইল এগিয়ে দিল কামরুলের দিকে। ফাইলটা দেখেই ধ্রুব নিজের মোবাইল বের করে একটা ফটো দেখিয়ে ওসমানকে বলল ——-‘দেখো তো ওসমান; এই ফাইলটাই আমার বাপের হারানো ব্যাংকের সেই ফাইল কিনা?’
ওসমান ভয়ে হেলে পরে দেয়ালের ওদিকে। দেয়াল হাতে চেপে আতঙ্ক নিয়ে; ভয়ার্ত চোখে ধ্রুবর দিকে তাকায়। ধ্রুব এবার রেগেমেগে উঠে দাঁড়ায় চেয়ার থেকে, চিৎকার করে বলে——-‘ কু—ত্তার বাচ্চা; তুই গা—দ্দারী করস আমার বাপের লগে? মাস শেষে কম টাকা নিস? তোর টাকার নিচেই শা—লার বাচ্চা তোরে পুঁ—তে রাখবো আমি ধ্রুব! শুয়——‘
বাকি কথা বলার আগেই ওসমান রীতিমত মাটিতে শুয়ে ধ্রুবর পা চেপে ধরে কেঁদে ফেলে———-‘মাফ করে দেন স্যার! আল্লাহর ওয়াস্তে! মাফ করে দেন। আমি নিজে কোর্টে সাক্ষী দিব, ইয়ামিন স্যারের পক্ষে। আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো! আর এমন ভুল হবে না স্যার। আজকের মতো মাফ দেন।’

ধ্রুব ব্যাংক থেকে বের হয়ে এসেছে! আকাশের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে লম্বা করে শ্বাস টানল নিজের ভেতর! অনেকদিন পর একটু খোলা হাওয়া শ্বাসনালীতে পৌঁছাল যেন! রাহুল তার পিছনে এসে দাঁড়াল. এতদিন পর রাহুল একটু স্বস্থির শ্বাস ফেললো! বললো———‘আল্লাহ আপনার উপর রহম করুক স্যার। আজকে বাসায় গিয়ে লম্বা ঘুম দিব। কালকে তো আদালতের শুনানি।’
ধ্রুব আকাশের দিকে চেয়ে রইল; জবাবে সময় নিয়ে বলে উঠলো——‘কিচ্ছু শেষ হয়নি এখনো! অনেক কিছু এখনো বাকি, রাহুল। লেটস সি।’

রাহুল ভ্রু কুঁচকাল, তার মুখাবয়বে একটু সন্দেহ ফুটে উঠল। কিছুটা ভাবনা মনে রেখে বলল——-‘মানে? আর কী করবেন আপনি এখন?’
ধ্রুব মৃদু হাসল, হাসির মধ্যে কিছু একটা তো অবশ্যই ছিলো! ধ্রুব আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকাল! শার্টের মধ্যে ঝুলিয়ে রাখা সানগ্লাস একহাতে চোখে লাগিয়ে, স্রেফ বলল——-‘বলে দিলে তো ক্লাইম্যাক্স ফিল করতে পারবে না। সো…’
রাহুল দুদিকে মাথা নাড়াল! ধ্রুব স্যার ঠিক বলেছে! ধ্রুব বাইকের দিকে এগুচ্ছে; রাহুল সেটা দেখে বললো——-‘আপনি বাড়ি যাবেন স্যার?’
ধ্রুব বাইকের দিকে এগোতে এগোতে, আঙ্গুলের ডগায় বাইকের চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে জবাব দিলো——-‘ইয়াহ! বাড়ি; মাই ওয়ান অ্যান্ড অনলি হোম!”

রাহুল হেঁটে চলা ধ্রুবর সুডৌল পিঠের দিকে চেয়ে হেসে কৌতুক গলায় বললো ——-‘অদিতি ভাবি?’
ধ্রুব মুচকি হেসে বাইকে উঠলো! হাত দিয়ে হেলমেট মাথায় গলিয়ে নিয়ে; হ্যান্ডেল ধরে ইঞ্জিন চালু করতে করতে বলল——-‘দিন দিন চালাক হয়ে যাচ্ছো, রাহুল।’
রাহুল মাথা চুলকে হেসে বলল——-‘কাদের সাথে থাকি, দেখতে হবে না?’
ধ্রুব হাসল, তার হাসিতে কিছুটা নস্টালজিক অনুভূতি ছিল। হেলমেট মাথায় লাগিয়ে, বাইকের ইঞ্জিন চালু করে, শো আওয়াজে বেরিয়ে গেল নিজের পার্সোনাল হোমের উদ্দেশ‍্যে!

অদিতি ধ্রুবকে মেসেজ পাঠিয়েছিল কয়েকটা, কিন্তু এখনও তার একটারও রিপ্লাই আসেনি। অস্থির অদিতি তার পড়ার টেবিল থেকে উঠে বিছানায় অস্থিরভাবে এলোমেলো ভঙ্গিতে পুরো রুম-ময় পায়চারী করে যাচ্ছে! ধ্রুবকে অদিতির একবিন্দুও বিশ্বাস নেই। সেদিনের পর না ফোন; না কোনও টেক্সট! কিচ্ছু নেই। কি করছে; কোথায় যাচ্ছে; কি ভাবছে কিছুই জানতে দেয়নি অদিতিকে। ও কল দিলেও কলটা রিসিভ করার ফুরসত তার নেই। এদিকে টেনশনে ওর মাথা ফেটে যাবার উপক্রম! ধ্রুব ইয়ামিন…অদিতি নিজে আস্ত এক টেনশনের বস্তা নিজের ইচ্ছায় মাথায় তুলেছে! রাগ লাগছে ভীষণ!

অদিতির এসব ভাবনার মধ্যে হঠাৎ ওর ফোনে মেসেজ এলো না। রিপ্লাইয়ের বদলে ডাইরেক্ট কল এলো, ধ্রুবর কল! অদিতি দ্রুত কল রিসিভ করল, কানে ধরে, দ্রুত গলাতে অস্থিরতা নিয়ে বললো———‘ধ্রুব? কোথায় আপনি এখন ? ঠিক আছেন তো? কল দিলে কল ধরেন না; মেসেজ দিলে সিন করেননা। কি করছেন, কোথায় যাচ্ছেন কিছু জানান ন…
ধ্রুব হেলমেট খুলে বাইকের হ্যান্ডেল ঝুলিয়ে, তৃপ্তির হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে ফোন কানে ধরে বললো——‘রিল্যাক্স অদিতি! অ্যা’ম কমপ্লিটলি ফাইন।’
অদিতি স্বস্থির শ্বাস ফেলল। ধ্রুব এবার ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে বলে উঠল———‘আইসক্রিম নাকি কফি ডেট? হুইচ ওয়ান উড বি প্রেফারেবল ফর ম্যাই লেডি?’
আচমকা এত ঝামেলার মধ্যে ধ্রুবর এমন কথাতেই অদিতি ভ্রু কুঁচকে ফেলল, ডাকলো—-‘ধ্রুব?’
অপাশ থেকে ফিরতি জবাব এলো——‘হু?’
অদিতি কিছুটা সন্দেহ নিয়ে বললো———‘আপনি ঠিক আছেন তো?’

আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ৩০

ওপাশ থেকে এবারেও ঠোঁট চেপে হেসে জবাব এলো—-‘অ্যাবসুলেটলি, কমপ্লিটলি, টোটালি।’
অদিতি এবার আরো সন্দেহ হলো! ধ্রুব তো এতটা ফুরফুরে মেজাজে কখনো কথা বলে না। অদিতি ভ্রু বাঁকিয়ে প্রশ্ন করলো———‘ধ্রুব, আপনার কথার টোন বদলে গেল কেন হঠাৎ?’
ধ্রুব জবাবে বড় একটা নিঃশ্বাস নিজের মধ্যে টেনে নিয়ে; অন্যরমম গলায় বললো———‘অ্যাই ডোন্ট নো! বাট অ্যাই অ্যাম ফিলিং লাইক…লাইক অ্যা স্কাই! সামথিং…সাম ফিলিংস ইজ জাস্ট কিলিং মি; অদিতি! নিচে এসে একটা শক্ত হাগ দিলে মেইবি আই উইল ফিল বেটার?’

আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ৩২