আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ৩৬

আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ৩৬
অবন্তিকা তৃপ্তি

বিবাহিত জীবনের প্রথম রাতটি ধ্রুব-অদিতির বড্ড দীর্ঘ কাটল! শ্বশুরবাড়িতে থাকায় বেচারা ধ্রুবর কপালে সেদিন আর বাসর জুটেনি।! তার ওপর সকাল সকাল ইফাজ দরজায় ধাক্কাচ্ছে! ধ্রুব-অদিতি ঘুমিয়েছে ফজরের প্রায় অনেক পরে।
বরাবরই সকালের ঘুমটা অদিতির আগে ভাঙে। শরীর স্ট্রেচ করে ঘুমঘুম চোখে সবার আগে নিজের দিকে একবার তাকাল! পরনের সুতির শাড়ির আঁচল গায়ে নেই; ওটা শরীর থেকে সরে গিয়ে আরামে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। শরীর অজস্র ক্লান্ত, মাথাটা ভারী লাগছে; শরীরের এই ক্লান্তি-টুকু বুঝিয়ে দিচ্ছে— সারারাত ওদের এক-ফোঁটাও ঘুম হয়নি।

ধ্রুব ঘুম থেজে উঠার আগেই; সতর্কভঙ্গিতে শাড়ির আঁচল গায়ে জড়িয়ে দ্রুত উঠে বসে গেল। হামি তুলে পাশে তাকাতেই দেখে, ধ্রুব ওপাশে মুখ ঘুরিয়ে উদোম গায়ে বালিশে পুরো মুখ-নাক গুঁজে ঘুমাচ্ছে। পিঠের খাঁজে শ্বাস নেওয়ার প্রতিটি ওঠানামা স্পষ্ট!
অদিতি ধ্রুবর ওমন উদোম গা এই প্রথম দেখলো। ধ্রুব কখন শার্ট খুললো? ওর দৃষ্টি প্রায় আটকে গেল ধ্রুবর পেটানো পিঠের দিকে। বিয়ের আগে, বয়ফ্রেন্ড হওয়া সত্ত্বেও ধ্রুব কখনোই ওর সামনে নির্লজ্জতার পরিচয় দেয়নি। সবসময় একটা সীমারেখা রেখেছে। আর আজ? বিয়ে হতে না হতেই শার্ট খুলে আরামে ঘুমানো হচ্ছে?
হরমোনের ওমন জ্বালাতনে; দেখা গেল অদিতি ওভাবেই তাকিয়ে রইলো ধ্রুবর অর্ধ-নগ্ন দেহের দিকে। ধ্রুবর ব্রড শোল্ডার, ডিপ ওয়েস্ট শেপ, অ্যাবস-এর খাঁজ, পুরোটাই ভীষন ম্যানলি। ঢোক গিলে, অনিচ্ছাসত্ত্বেও, অদিতি তাকিয়ে রইল। মাথার ভেতর কেমন একটা আনচান অনুভূতি খেলে গেল হঠাৎ!
ওপাশ থেকে আবার ধাক্কা এলো দরজায়——‘এই আপু, উঠো! দুলাভাইর বাবা শহরে যাবে এখন। তোমাদের রেডি হতে বলল।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অদিতির ধ্যান ভাঙে; বেহায়া হরমোন-গুলো পালিয়ে যায়। ও ধড়মড় করে উঠে দরজার দিকে তাকাল। হ্যাঁ খোদা, সে এতক্ষণ কি দেখছিল! নিজের কপালে নিজে থাপ্পড় দিয়ে নিজেকে ফিসফিস করে শাসিয়ে বললো—-‘নির্লজ্জ মেয়ে কোথাকার! চোখ কই, কই যায় তোর?’
লজ্জায় দুহাতে মুখ ঢেকে হেসে ফেলল ও। তারপর আবার নিজেকে স্বাভাবিক করে ধ্রুবকে ডাকতে যাবে বলে ওর দিকে তাকাল। ধ্রুব এখনও সেভাবেই দুহাতে মাথার বালিশ চেপে ধরে মুখ গুঁজে ঘুমাচ্ছে। ইফাজের ডাক ওর কানে পোছাচ্ছে না এখনো। অদিতি আস্তে করে ডাকল—‘ধ্রুব! অ্যাই ধ্রুব।’
ধ্রুব বালিশে মুখ গুঁজে রাখা অবস্থায় ঘুমঘুম কণ্ঠে অস্পষ্ট স্বরে বলল——‘উ-মমম…’
গলার স্বরটা শোনামাত্রই অদিতির গায়ের লোম অব্দি যেন দাঁড়িয়ে গেল। বুকের ভেতর ধুকপুক-ধুকপুক শুরু হলো! ধ্রুব ঘুমন্ত অবস্থায় কি সবসমময়ই এতটা হাস্কি আর লো টোনে কথা বলে? বিয়ে না হলে ধ্রুবর এই আকর্ষণীয় দিকটা কি মিস করে যেত না অদিতি?

অদিতি এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল, নিজের বুকে হাত রেখে ধীর নিঃশ্বাস নিল। অদিতি; মিসেস ধ্রুব! এখন তোমার আপনার স্বামীকে ডেকে তোলার সময়। তার প্রেমে পড়ার সময় এখন অবশ্যই নয়। প্রেমে পড়ার সময় যখন আসে; তখন তো ভয়ে-লজ্জায় মুখ লুকিয়ে থাকিস- তাহলে এখন এত প্রেম উদয় কোত্থেকে হচ্ছে? ফাজিল মেয়ে; আব মিসটেক; ফাজিল ওয়াইফ হবে ওটা।
নিজে নিজেকে প্রবোধ দিয়ে ; অদিতি আবার ডাকল——-‘ধ্রুব, উঠুন! আমাদের রেডি হতে হবে!’
ধ্রুব কিছুটা নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে গেল! অদিতি হতাশ হয়ে মুখ বাঁকাল! যে ছেলে সকাল বারোটার আগে ঘুম থেকে ওঠে না, তার জন্যে ফজরের পর ঘুমিয়ে সকাল সাতটায় ওঠা প্রায় অসম্ভব! কিন্তু এই অসম্ভবকেই সম্ভব অদিতিকে করতে হবে।

অদিতি একটু দ্বিধায় পড়ল, কীভাবে ডাকবে? হাত বাড়িয়ে ধ্রুবর পিঠ ছুঁয়ে ডাকতে যাবে— মাঝপথে থেমে গেল! লজ্জায় ওর হাতটা কাঁপছে। কীভাবে ছোঁবে ধ্রুবকে? উদোম গায়ে…অদিতি চোখ বন্ধ করে নিজের মনকে শক্ত করল। স্বামীই তো! আর সে তো শুধু ঘুম থেকে তোলার জন্যে ডাকবে।
শ্বাস ছেড়ে ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে দিল। আলতো করে ধ্রুবর পিঠ ঠেলল——‘ধ্রুব, প্লিজ উঠুন! ওরা ডাকছে আমাদের। অ্যাই ধ্রুব!’
ধ্রুব এত ডাকাডাকিতে চোখ খুলল। বালিশে মুখ গুঁজে সেভাবেই মাথা ঘুরিয়ে এপাশে তাকাল অদিতির দিকে! অদিতির নিঃশ্বাস আটকে গেল!
ধ্রুবর চোখদুটো ভারী, ঘুম জড়ানো। নাক অব্দি ঢেকে আছে বালিশে; শুধু ওই চোখ-দুটো দেখা যাচ্ছে। রুক্ষ কপাল, সূক্ষ্ম আইব্রো, আর ওই চোখ! অদিতি এক পলক তাকিয়ে রইল। বুকের ভেতর একটা ধাক্কা লাগল যেন!
ধ্রুব সেভাবেই মুখ গুঁজে রাখা অবস্থায় হামি তুলে; অস্ফুট স্বরে বলল—‘ডাকতেছো কেন? ঘু-ঘুম কমপ্লিট হয়নি আমার।’

অদিতি ভ্রু বাঁকাল, জবাব দিল——‘কেন ঘুমাননি? বলিনি আমি, ঘুমিয়ে যাই চলুন? আপনিই তো পাগলামি করলেন।’
ধ্রুব এবার ভ্রু উঁচালো! চোখের ভেতর একরকম দুষ্টুমি খেলে গেল! মুহূর্তের মধ্যেই অদিতির হাতটা টেনে নিয়ে ওকে নিজের পাশে শুইয়ে ফেলল!
“আঁ।’——- আচমকা আক্রমণে চেঁচিয়ে উঠল অদিতি।
ধ্রুব শক্ত করে সাপের মতো প্যাঁচিয়ে ধরে ওর ঘাড়ে মুখ গুঁজে বলল——‘চুপ! নিজেও ঘুমাও এখন।’
অদিতি তৎক্ষণাৎ ছটফট করে উঠতে গেল——‘না না, এখন ঘুমানো যাবে না! আমাদের রেডি হওয়া লাগবে! ডাকবে আমাদের! ধ্রুব,আমি কিন্তু বকা খাব আব্বার।’
ধ্রুব ওর ঘাড়ে মুখ গুঁজেই অস্ফুটে বলল——‘বকবে না। তুমি এখন ম্যারিড, আংকেল বুঝেন এসব।’
অদিতির চোখ বড় হয়ে গেল! এটা আবার কী ধরনের উত্তর! ধ্রুব আসলেই ঘুমিয়ে আছে, নাকি জেগে থেকে ওকে নিয়ে মজা নিচ্ছে?

ধ্রুব হালকা হেসে ঘাড়ে নাক ঘষতেই, অদিতি শিউরে উঠে——-‘আহ! প্লিজ! ধ্রুব।’
ধ্রুব এবারও ছাড়ল না! বরং আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে বলল——‘প্লিজ; আর জাস্ট পাঁচ মিনিট।’
‘না।’——— অদিতি এবার আর কিছু না শুনে ধ্রুবকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল! তারপর বিছানা থেকে একদম ঠেলে নামিয়ে দিল ওকে!
ধ্রুব অবাক হয়ে বললো——‘হেই; আমাকে শক্তি দেখাচ্ছো তুমি? আমি চেপে ধরবো নাকি?’
অদিতি ধ্রুবর টিশার্ট-জিন্স বের করে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো———‘প্লিজ!’
অদিতির গলায় অনুরোধ; চোখে কাতরতা ইচ্ছে করেই দেখানো হলো ধ্রুবকে। ধ্রুব ভ্রু কুচকে চেয়ে; পরপর হতাশ ভঙ্গিতে চোখ উল্টে তাকাল; ———-‘ম্যানুপুলেশন; ড্যাম! যাচ্ছি!’
অদিতি হাসল; তারপর ধ্রুবকে হাত ধরে টেনে ওয়াশরুমের দিকে ঠেলতে লাগল——‘আর কথা না, ফ্রেশ হয়ে আসুন! আমি ওয়েট করব!’

খাবার টেবিলে সবাই নবদম্পত্তির জন্যে অপেক্ষা করছে। সৌরভ তোফাজ্জলের পাশে বসে আছেন। ধ্রুবর বন্ধুরা চেয়ারে বসে খাচ্ছে; আর ঢুলছে ঘুমে। অদিতি মাথায় শাড়ির আঁচল টেনে চুপচাপ ধ্রুবকে পাশ কাটিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। ধ্রুব ওর যাওয়ার দিকটায় এক মুহূর্ত চেয়ে থেকে আবার সবার দিকে তাকাল।
রাজন ধ্রুবকে দেখেই; দুষ্টু ইঙ্গিতে হেসে ডাকল—‘ ধ্রুব ভাই যে; আসেন আসেন।’
ধ্রুব ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকাল; নিশ্চয়ই সবগুলো মিলে এখন দুনিয়ার অসভ্যতা শুরু করে দিবে। ও ছোট করে নিঃশ্বাস ছেড়ে জিন্সের পকেটে হাত গুঁজে ধীরে এগিয়ে এসে চেয়ারে বসলো।
চেয়ারে বসতেই; সৌরভ বললেন—-‘আমাদের খেয়ে বেরুতে হবে, ধ্রুব। ঢাকায় জরুরি মিটিং আছে।’
ধ্রুব মাথা ঝাঁকিয়ে ইঙ্গিত দিল; সে শুনেছে!

ইমন ওদের আড়াল করে মুখটা একটু এগিয়ে এনে ধ্রুবর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল——-‘ফার্স্ট নাইট কেমন কাটল, মামা? দেখি তো, তোর গলা দেখি! লাভ বাইট পাইছিস?’
বলেই অসভ্য হেসে ধ্রুবর টি-শার্টের কলার ধরতে যাবে, ধ্রুব মুহূর্তের মধ্যে ওর হাত শক্ত করে চেপে ধরে মুচড়ে ফেলল! ওমন হাতের ব্যাথাতেও, ইমন খিলখিল করে হাসছে! ধ্রুব ওর হাত আরো শক্ত করে মুঠোতে পুড়ে চেপে ধরে, কঠিন স্বরে বললো——-‘ঢাকা গিয়ে তোকে যদি আমি কুত্তার মতো দৌড় না খাওয়াই, তাহলে আমার নামও ধ্রুব না। ঢাকায় যাইতে দে আগে।’
বলে ধ্রুব ওর হাত ছেড়ে আবার খেতে মন দিল। ইমন হাসছে তখনো রাক্ষসের মতো। ওই হাসিতে রাগে ধ্রুবর গা অব্দি জ্বলে গেল। ধ্রুব ওর দিকে চেয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল——‘ছাগল একটা; পকেটে কাল রাতে এগুলা কী দিসোস?অদিতি যদি বাই চান্স দেখে ফেলত, কী বিশ্রী হতো ব্যাপারটা!’
ইমন এই কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ার ভান করে বলল——-‘ওমা! বিবাহিত কাপলের জন্য এগুলা আবার বিশ্রী কবে থেকে হলো? এগুলাই তো এখন তোদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু।’
ধ্রুব আবার দাঁত কিড়মিড় করে তাকাল। তারপর খাবার টেবিলের নিচেই রেগে পা বাড়িয়ে লা-থি বসিয়ে দিল সোজা ইমনের হাঁটুতে।

‘আহ!’— আর্তনাদ করে উঠে হাঁটু চেপে ধরে ইমন। ওর চিৎকারে সবাই তাকালো ওর দিকে। ধ্রুব নির্বিকার মুখে খাচ্ছে, যেন কিছুই জানে না!
তোফাজ্জল ভ্রু কুঁচকে বললেন———‘চেঁচাচ্ছো কেন?’
ইমন নিজের ব্যথা গিলে ফেলার চেষ্টা করে ধ্রুবর দিকে তাকালো। ধ্রুব ওর দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। গিরগিটি একটা!
ও তোফাজ্জলের দিকে চেয়ে মিথ্যা হাসি হেসে বলল——‘পোকা, আংকেল।’
তোফাজ্জল ইমনের ওই পোকার কামড় তেমন একটা পাত্তা দিলেন না। আবার সৌরভের সঙ্গে গল্প করতে মন দিলেন। তোফাজ্জল অন্যদিকে তাকাতেই ইমন ধ্রুবর দিকে চেয়ে চাপা স্বরে বলল——-‘তুই বিয়ে করে বদলে গেছিস, ধ্রুব! ছিঃ! এত চেঞ্জ? আমি জাস্ট ভাবতেই পারছি না।’
ধ্রুব হতাশ ভীষণ! চোখ উল্টে শ্বাস ছেড়ে আবার খেতে মন দিল। খেতে খেতে রান্নাঘরের দিকে তাকাচ্ছে। অদিতির কন্ঠ শোনা যাচ্ছে। ফাহিমার সঙ্গে কথা বলছে। কিছু একটা নিয়ে ফাহিমা ওকে উপদেশ দিচ্ছেন; আর নিশ্চয়ই এই মেয়েও সব উপদেশ-গুলো গিলে খাচ্ছে।

গাড়িতে অদিতির দরকারি জিনিসপত্র তোলা হচ্ছে। ঘরে ফাহিমা একটা সুটকেসে কাপড় গুছিয়ে দিচ্ছেন। ফাহিমা কাপড়ের ভাঁজ দেখেশুনে ঠিক করছেন আর বারবার আঁচলে চোখ মুছছেন। অদিতি চুপ করে বিছানায় বসে আছে, বুকের মধ্যে যেন কিছু ভারী হয়ে আছে, শ্বাস নিতে পারছে না। ও চুপ করে দেখে যাচ্ছে কম্পিত হাতে ফাহিমার কাজ!

ফাহিমা কাপড় গোছাতে গোছাতে বলে যাচ্ছেন নিজের মা-মা কথা-গুলো———-‘ও বাড়ি যাচ্ছিস, অদিতি। কাউকে কষ্ট দিস না। শ্বশুর-শাশুড়ির মান রাখিস, তাদের মায়া দিস। তৃণা ভাবি ধ্রুবর সৎ মা হলেও, তুই কোনোদিন উনাকে সৎ মা হিসেবে দেখবি না। আপন শাশুড়ি ভাববি। ধ্রুবকে বোঝাবি, যেন ওর বাবার সঙ্গে মিলে চলে। ওর বাবার অভিমানটা যে কত গভীর, তুই বুঝিস? মেয়েদের হাতে অনেক ক্ষমতা রে মা! ওরা চাইলে, পুরুষদের সমস্ত অভিমান দু’দিনেই গলে যায়। তুই বোঝাস ধ্রুবকে যে ওর বাবা ওকে কতটা ভালোবাসে। এসব রাগ যেন ঝেড়ে ফেলে দেয়!’
অদিতি মাথা হেলাল, ঠোঁট চেপে রেখেছে শক্ত করে। চোখের জল আটকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ওর হাতে হয়তবা অনেক শক্তি; অনেক অনেক ক্ষমতা। ধ্রুবকে তো ও পেয়েছেই; তবে আদৌ কি সেটা পাওয়া বলে? মিথ্যা বলে; বাবাকে ঠকিয়ে করা এই বিয়েকে অদিতি কি নাম দেবে?
ফাহিমা দরকারি সব জিনিস ঠিকঠাক করে সুটকেস লক করলেন। তারপর সেটা পাঠিয়ে দিলেন বাইরে, গাড়িতে তোলার জন্য।

অদিতি এবার উঠে এসে পেছন থেকে শক্ত করে ফাহিমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ গুঁজে নিশব্দে চোখের জল ছেড়ে দিল! অস্ফুট স্বরে আহ্লাদ নিয়ে বললো——–‘ভীষণ মিস করবো তোমাকে!’
ব্যাস, এ কথাতেই যেন এই মায়ের সব কান্না বাঁধভাঙা নদীর মতো বেরিয়ে এলো। ফাহিমার গাল বেয়ে পানি ঝরছে, কণ্ঠ কাঁপছে————‘ভা- ভালো থাকিস! নিজের যত্ন নিস! আল্লাহ চাইলে তোরও একটা সুখের সংসার হবে, দোয়া করি আল্লাহর কাছে।’
অদিতির ভীষণ কান্না পাচ্ছে। ও কি ঠকালো তাদের? এই বিয়ে— এই সম্পর্ক… এটা কি সত্যি? এটা কি কোনোভাবে ঠকানো নয়? অদিতির বুকটা যেন ভারী হয়ে এলো। ও ফাহিমার কাঁধে মুখ গুঁজে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে ফিসফিস করে বলল——-‘আমার এই বিয়েতে তুমি খুশি তো, মা?’
ফাহিমা সঙ্গে সঙ্গেই উনার গলায় রাখা অদিতির হাতের উপর হাত রেখে বললেন—‘ওমা! সোনার টুকরো জামাই পেয়েছিস, খুশি হব না? তোর আব্বাও অনেক খুশি।’
অদিতি চেয়ে রইল! ফাহিমা ওকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলেন। অদিতি কাঁদছে; ফাহিমা বড্ড আদুরে ভঙ্গিতে ওর চোখের জল মুছে কপালে চুমু দিলেন। গভীর স্বরে বললেন———‘ভালো থাকিস। নিজের যত্ন নিস। পড়াশোনা চালিয়ে যাস। সৌরভ ভাই বলেছেন, হোস্টেল থেকে বই নিয়ে ওখানেই পড়বি। পড়াশোনা ছাড়িস না, ওটা তোর সাথে আমারও স্বপ্ন!’

অদিতি কেঁপে উঠল,একটা মৃদু হাসি দিয়ে মাথা ঝাঁকাল।
বাইরে থেকে ডাক আসছে। ফাহিমা ওর হাত ধরে বেরিয়ে এলেন। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ধ্রুব চোখে সানগ্লাস পরে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। অদিতি সাথে সাথে শাড়ির আঁচলটা মাথায় আরও ভালো করে টেনে নিল।
সৌরভ-তোফাজ্জল দাঁড়িয়ে আছেন একসঙ্গে। অদিতি ধীরে পায়ে বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
সৌরভ অদিতিকে দেখে; তোফাজ্জলের দিকে চেয়ে হাসিমুখে বললেন———‘মেয়েকে বিদায় দাও এখন। আমি গাড়িতে উঠে বসি।’
সৌরভ চলে গেলেন। তোফাজ্জল স্থির দাঁড়িয়ে আছেন! মুখ কঠিন, কিন্তু চোখে যেন চাপা কিছু কষ্ট! অদিতি চুপচাপ বাবার পাশে দাঁড়াল। তোফাজ্জলকে দেখেই ওর ভয় লাগছে। যেন মনে হচ্ছে—- উনি অদিতিকে দেখেই বুঝে যাবেন— এই বিয়ে মিথ্যা, উনাকে তার সরল মেয়ে ঠকিয়েছে। চোখ লুকিয়ে ফেলল অদিতি! চোখে চোখ মেলানোর সাহস ওর মধ্যে একটুও নেই।
তোফাজ্জল ওর দিকে চেয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর অদিতি ভয় নিয়ে নিচু গলায় বলল——-‘আ-আব্বা… আসি! দ-দোয়া করবেন।”

তোফাজ্জল একদৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন, গম্ভীর স্বরে বললেন——-‘সুখী হও, সংসারে আল্লাহতায়ালা রহমত দিক!”
অদিতি এতদিন পর বাবার স্নেহমাখা স্পর্শ মাথায় পেয়ে ডুকরে কেঁদে ফেলল! কান্নাটা যেন বুকের ভেতর থেকে ফুলে-ফেপে উঠল। ধ্রুব ওর কান্নার শব্দ শুনে ব্যাকুল ভঙ্গিতে বড়বড় পা ফেলে হেঁটে এলো। বাবা-মেয়েকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে; আর এগুলো না। ওভাবেই দূরে দাড়িয়ে রইল। অস্থির হয়ে ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেল অদিতির দিকে। তোফাজ্জল মেয়ের কান্নায় অস্থির হওয়া ধ্রুবকে দেখলেন এক মুহূর্তের জন্য— তীক্ষ্ম চোখে মেয়ের স্বামীকে জরিপ করলেন খানিকক্ষণ।

ধ্রুব এসে অদিতির পাশে দাঁড়াতেই তোফাজ্জল মেয়ের কাঁধে হাত রাখেন। নিজের আবেগ-টুকু বরাবরের মতো লুকিয়ে; অদিতির কাঁধে চাপড় দিয়ে বললেন———‘কেদো না। পড়াশোনা করতে চাইলে অনুমতি আছে। করতে পারো। যাও এখন। তোমার শ্বশুরের ঢাকাতে কাজ আছে, দেরি হচ্ছে ওর।”
অদিতি তবুও কাঁদতেই থাকল।তোফাজ্জল মেয়ের কান্নার সামনে গলে যাচ্ছেন। ঢোঁক গিললেন; তারপর ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় কোনরকম বললেন———‘ও-ওকে নিয়ে যা। দেরি হচ্ছে তোমাদের!’

বলে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে ঘুরে চলে গেলেন ভেতরের দিকে। হয়তো একটু দাঁড়ালেই মেয়ে আর স্বামীর ঘরের জন্যে বেরোতে পারত না। তোফাজ্জল চলে যেতেই ধ্রুব অদিতিকে নিজের দিকে টেনে নিল।
অদিতি ধ্রুবর কাঁধে মুখ গুঁজে দিল, ওর কাঁধের টিশার্ট ভিজে যাচ্ছে ফোঁটাফোঁটা কান্নায়। ধ্রুব একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলল। ওর চোখে ভাসল প্রথম দিন দেখা অদিতিটা— যে লাজুক মেয়েটা চোখ তুলে তাকাত না, যার আঙুলের ডগায় সবসময় নার্ভাস কাঁপন লেগে থাকত।
ধ্রুব একজন পারফেক্ট স্বামীর ন্যায় আগলে নিলো স্ত্রীকে———‘ওকে; ওকে! ডোন্ট ক্রাই, আমরা এক মাস পরে আবার আসব। কান্না করে না, অদিতি। অ্যাই মেয়ে; থামো এবার।’
অদিতি কোনো উত্তর দিল না। ধ্রুব ওর মাথায় হাত রাখল, আলতো করে বুলিয়ে দিতে লাগলো চুলের ভেতর দিয়ে। সেসময় বহু কষ্টে অদিতিকে গাড়িতে তুলতে পেরেছিল ধ্রুব।

ভীষণ বড়সড় একটা তিনতলা বাড়ি। বাড়ির নেমপ্লেটে খোদাই করে লেখা —-‘ Iyamins family’! অদিতি এর আগে একবার এসেছিল এই বাড়িতে, তবে ধ্রুবর প্রেমিকা হয়ে। তখন ওদের না ছিল কোনো বৈধ সম্পর্ক, না ছিল কবুলের জোর। আজ অদিতি এই বাড়ির বউ!
ধ্রুব শক্ত করে অদিতির হাত চেপে ধরে এগিয়ে চলেছে, সামনে সৌরভ-তৃণা দাঁড়িয়ে, এদের চোখে কৌতূহল। অদিতি চোখ নামিয়ে তাকাল ওদের দুজনের একসঙ্গে চেপে রাখা হাতে। ধ্রুবর আঙুল এখনো ওর হাতের আঙুলে একসঙ্গে জড়িয়ে আছে শক্তভাবে। আবার মুখ তুলে ধ্রুবর দিকে তাকাল ও। ধ্রুব তখন চোখে সানগ্লাস পরে আছে, গম্ভীর মুখে কথা বলছে ইমনের সঙ্গে। পেছন পেছন রাজন; সুমন অদিতির বাপের বাড়ি থেকে আনা ব্যাগ নিয়ে এগুচ্ছে।

বাড়ির ভেতর তখন ভিড়। সৌরভ ইয়ামিনের নতুন পুত্রবধূকে দেখতে এসেছে অনেক মানুষ। তৃণা ঘরে ঢুকেই; রুমে ব্যাগ রেখে রান্নাঘরের দিকে এগুলেন। যাওয়ার আগে অদিতির দিকে তাকিয়ে বললেন———‘রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। তারপর কিছু মুরুব্বি আছেন, দেখা করতে হবে। সমস্যা হবে না তো তোমার? টায়ার্ড বেশি?’
ধ্রুব তখন দূরে দাড়িয়ে ফোনে কথা বলতে বলতে দ্রুতপায়ে সিড়ি ভাঙছে। অদিতি তৃণার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল——‘গোসল করতে হবে, তারপর আসি?’
তৃণা হেসে বললেন——‘ঠিক আছে। যাও, ফ্রেশ হয়ে নাও।’

অদিতি আঁচল সামলে সিঁড়ি ভাঙতে লাগল ধীরপায়ে।ধ্রুবর রুমের সামনে এসে দাঁড়াতেই ওর কানে এলো উচ্চস্বরে কথা কাটাকাটি। ইমন আর ধ্রুব এককথায় ঝগড়া করছে! অদিতি দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই ইমন ওর দিকে তাকাল, এবার যেন আরো পেয়ে বসেছে।
ধ্রুবকে পাশ কাটিয়ে; ইমন কথা তুলল——‘অদি— ওহ, সরি, ভাবি। আপনার হাসব্যান্ডকে বোঝান! আমরা সারপ্রাইজ রেডি করছি আপনাদের জন্যে। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড, প্লিজ!’
অদিতি চোখ ছোট করে তাকাল দু’জনের দিকে। এদের কথা বলার ধরন মোটেও স্বাভাবিক নয়। ও কিছু বলার আগেই ধ্রুব বলে উঠল——‘ছাগলামি পরে কর! ফ্রেশ হয়ে নেই আমরা। দু’জনেই টায়ার্ড।’
ইমন এবার অদিতিকে ছেড়ে ধ্রুবর কানের কাছে বিড়বিড় করে বলল——‘বেড সাজাব মাম্মা! কোঅপারেট করবি না?’
ইমন ধ্রুবর কানের কাছে মুখ বাড়িয়ে রেখেছে; ধ্রুব ঢোক গিলে একটা দৃষ্টি ফেলল অদিতির দিকে, অদিতি ভ্রু কুচকে ওদের আচরণ বোঝার চেষ্টা করছে।
ধ্রুব সরে গেল দুকদম! ইমনের দিকে চেয়ে, আবার অদিতির দিকে তাকাল। খানিক কেশে উঠে তারপর হাত পকেটে গুঁজে নিয়ে দোনামোনা করে বলতে থাকে———‘অদিতি, নিচে যাই আমরা? গেস্টদের সঙ্গে কথা বলে খেয়ে উপরে উঠব।’

অদিতি অবাক; ও ভ্রু কুঁচকে বলল——‘কিন্তু আমি গোসল করব না?’
ধ্রুব ওর কাঁধে হাত রেখে; আলতো একটা ধাক্কা দিয়ে বলল——‘পরে, গেস্ট ফার্স্ট!’
বলে অদিতিকে ঠেলে সিঁড়ির দিকে এগুতে লাগলো। অদিতি তখন বারবার পেছনের দিকে চেয়ে বলতে থাকে——‘ আগে রুমে ব্যাগ ইও রেখে আসতে দিন। কি করছেন? ধ্রুব?’
ধ্রুব ওসব শুনে না। ঠেলে নিয়ে নামতে লাগল সিড়ি ভেঙ্গে।
নিচে নেমে অদিতি শাড়ির আঁচল মাথায় টেনে তৃণার পাশে বসতেই তিনি অবাক হয়ে বললেন——‘তুমি এখানে? যাওনি রুমে?’
অদিতি চোখ সরিয়ে তাকাল ধ্রুবর দিকে। সে তখন ডাইনিং টেবিলের দিকে হেঁটে, জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালছে।
‘ন… না!’——- অদিতি জবাব দিল সেভাবেই।
তৃণা এসবে তেমন মাথা ঘামালেন না। বরং আলতো করে অদিতির কাঁধ চেপে ধরে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন ইয়ামিন বাড়ির পুত্রবধূর সঙ্গে—‘কাকিমা, ও অদিতি। ধ্রুবর বউ।’

অদিতি নিচু স্বরে সবাইকে সালাম দিল। অদিতিকে সবাই আগাগোড়া তখন দেখতে ব্যস্ত। এক মহিলা ঢঙের স্বরেই তো বলে উঠলেন——‘ধ্রুব বিয়ে করল শেষে? তা এই ছেলেমেয়ের ঘরে টিকবে তো? যা রাগ তোমার স্বামীর!’
কিছুটা ব্যাঙ্গ করেই বললেন কথাটা! অদিতি চোখ নামিয়ে বসে রইল। ও জানে না এই কথার উত্তরে কী জবাব দেবে। ধ্রুব আজ অব্দি ওর সঙ্গে রেগে কথা বলেনি; এমন নয়। তবে সীমিত সেই রাগ। রাগ কমে এলে; নিজেই এসে কথা বলে। অথবা রাগের সময়টুকুতে ও জানে; কিভাবে রাগ নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়। ধ্রুব সবসময়; সব অবস্থাতেই অদিতির প্রতি ভীষণ দায়িত্বশীল! ধ্রুবর এই দিকটা অদিতির ভীষণ রকম টানে নিজেকে।
অদিতির ভাবনার মধ্যে পান চিবোতে চিবোতে এক দাদি মহিলা সভার মধ্যে বিস্ফো-রণ ঘটিয়ে বলে উঠলেন——‘ওসব রাগী; বদমেজাজি স্বামী গো ঘরে একটা জিনিসই বান্ধবার পারে। একটা বাইচ্চা! বিয়ার পরপর ট্যাপলা-ট্যাপলি নিয়া নিলে স্বামীগো কদর বেড়ে যায় বাইচ্চার মার!’
এক মুহূর্তের জন্য পুরো ঘরটা নিঃশব্দ হয়ে গেল! অদিতি চোখ বড় বড় করে তাকাল দাদির দিকে। ধ্রুব তখন গ্লাস থেকে পানি খাচ্ছিল, কথাটা কানে যেতেই ও পানি মুখে হঠাৎ কেশে উঠল! কোনোরকমে পানি গিলে বড়বড় চোখে তাকাল অদিতির দিকে।

অদিতি ধ্রুবর ওই চাওনি দেখে মুখ নিচু করল সাথে সাথে।লজ্জায় শেষ ও। বিয়ের একদিনের মাথায় এসব কথা; তাও ধ্রুবর সামনে। মাটি ফাঁক করে ভূগর্ভে ঢুকে পড়তে মন চাইছে ওর এই মুহূর্তে।
ধ্রুব অদিতির থেকে চোখ সরাল; তারপর দ্রুত পকেট থেকে ফোন নিয়ে সেটাতে চোখ রেখে বড়বড় পা ফেলে সোফার দিকে এগুলোও। যেন ও এখানের কোনো কথাই শুনেনি। একপ্রকার যেন পালিয়ে বাঁচল। ও জানে, এখানকার কথা এরপর এখন লাগামছাড়া হয়ে যাবে! ওরা আজ কেন বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে ধ্রুবকে— ‘লাস্ট নাইট; নাথিং হ্যাপেন্ড!’ —-ধ্রুবর মুখটা সে কথা মনে করিয়ে ভোতা হয়ে থাকল পুরোটাসময়!
রাতের খাবারের আয়োজন হচ্ছে। ধ্রুব সেভাবে তখনও সোফায় বসা। ইমন কাজ শেষ করে, ধ্রুবর পাশে বসল! ধ্রুব স্বভাবতই জিজ্ঞেস করল———‘ কাজ শেষ?’
কথাটা ধ্রুব তেমন দুষ্টু ইঙ্গিতে বলেওনি। কিন্তু ইমন সেটা শোনে বাকা চোখে ধ্রুবকে আগাগোড়া দেখে দুষ্টু চোখে বললো ———‘এহহে, রাহা নেহি যাতা, উউ?’
ধ্রুব এটা শোনামাত্রই সোফার কুশন তুলে সেটা দিয়ে ইমনের মাথায় মেরে দিল——‘জাস্ট শাট অ্যাপ!’
ইমন হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। ধ্রুব ওর হাসি শুনে গা রীতিমত জ্বলে গেলো; ও ধপ করে সোফা থেকে উঠে চলে গেল দুতলার দিকে!

ধ্রুবর রুমের পাশের রুমটাই গেস্ট রুম। ধ্রুব সোজা ওই রুমে গিয়ে চেঞ্জ করে নিলো। বাইরের টিশার্ট-জিন্স পাল্টে বাসার আরামদায়ক টিশার্ট-ট্রাউজার পরে নিলো। বাথরুম থেকে বেরুতেই দেখে, অদিতি গেস্ট রুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল ঝাড়ছে। হয়তো অন্য রুম থেকে গোসল নিয়েছে।
দরজা হালকা ভিড়িয়ে রাখা। ধ্রুব সুযোগ পেল সম্ভবত। হাতের ভেজা টাওয়াল বিছানার উপর ফেলে, ধীর পায়ে এগুলো। অদিতি ভেজা চুল কাঁধের পাশে এনে ঝাড়ছে। পেছনের ব্লাউজের দিক বেশ ভেজা। ধ্রুব আলতো করে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই রীতিমতো আঁতকে উঠে সামনে ঝুঁকে গেল তার স্ত্রী।
‘আ..আপনি? এ রু..রুমে?’——— অদিতি টাওয়াল হাতে স্থির হয়ে গেল প্রায়। ধ্রুবর বিয়ের পর এই হুটহাট ছোয়া এখনো না ঠিকঠাক হজম হয়না তোফাজ্জল হায়াতের এই ভদ্র কন্যা অদিতি হায়াতের। এখনো শরীর কাপে; মনে হয় নিজেকে অবশ। ধ্রুব ছুয়ে দিলেই; মনে হয় এই বুঝি সব শেষ হলো! এই বুঝি ধ্রুব হরণ করে নিলো ওর লজ্জা-গুলোকে একের পর এক; দয়া-মায়াহীন ভাবে।

ধ্রুব ওর ভেজা ঘাড়ে নাক ঘষতে ঘষতে বলল—— ‘ উওমম..স্মেলিং লাইক ফ্লাওয়ারস!’
অদিতি৪ ঘাড়ে ধ্রুবর ছোয়া; উষ্ণতা ঘিরে রেখেছে দুজনকে! ঘাড় এর ওই অংশ আবেশে বারবার সরিয়ে নিতে নিয়ে অদিতি নিচু গলায় জবাব দিল—— ‘লা..ল্যাভেন্ডার ব..বডি ওয়াশ ইউজ করেছি।’
ধ্রুব ঘাড় থেকে মাথা তুলে আয়নায় নিজেদের দিকে তাকাল। অদিতি লজ্জায় চোখ নামিয়ে রেখেছে; ঠোঁট কাপছে। উফ; নেশালো সেই দৃষ্টি! ধ্রুব হাত নামিয়ে আনলো; কোমরের কাছে হাত রেখে সেফটিপিন খুলতে যাবে; তার আগেই অদিতি টাওয়াল হাতে ছুটে পালিয়ে যেতে চায়।
অথচ সম্ভব হয়না; তার আগেই শাড়ির আঁচল আটকে যায় ধ্রুবর হাতের মুঠোয়। অদিতি থেমে যায়; চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে। বুকের কাছে শাড়িটা চেপে ধরেছে ততক্ষণে; যেন ধ্রুব খুলে না ফেলতে পারে। ধ্রুব শাড়িটা ধীরে ধীরে টানছে, অদিতি একটু একটু পিছিয়ে যাচ্ছে ধ্রুবর দিকে। একসময় অদিতির পিঠ লেগে গেল ধ্রুবর বুকে; মুহূর্তেই শিউরে উঠল ও!

ধ্রুব অদিতির শাড়ির আঁচল ছেড়ে দিল! আলতো করে হাত রাখলো অদিতির দুই পাশের কোমরে! অদিতির গায়ে যেন কাঁটা দিয়ে উঠল; ও দুহাতে নিজের শাড়ি খামচে ধরলো! ধ্রুব অদিতির কোমর টেনে ওকে আরও কাছে টেনে, ওর কানের লতিতে ঠোঁট রাখল! জমে উঠে অদিতি আওড়ালো——‘ছা..ছাড়ুন! কে..কেউ এসে—‘
ধ্রুব কোমরে রাখা হাতের বাঁধন শক্ত করতেই; অদিতি ঠোঁট কামড়ে সেই হাতখানা চেপে ধরলো হঠাৎ! ধ্রুব ফিসফিস করে ওর কানের কাছে বললো——‘আমরা ম্যারেড, অদিতি। যদি কেউ এসেও যায়, হোয়াটস দ্য ম্যাটার?”
অদিতি চোখ বুজে আছে। ধ্রুব ওর গালে গাল ঘষে হেসে ফেলে বললো——‘আরে, চোখ তো খুলো।’
অদিতি ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকালো! ধ্রুব ওর চোখের দিকে, আয়নায় তাকালো। দুজনের চোখে চোখ মিললো! হারিয়েই গেল ওরা! অদিতি আয়নায় নিজেদের দিকে তাকিয়ে রইল; তারপর আস্তে করে নিজের মাথাটা হেলিয়ে দিল ধ্রুবর গালের উপর। এক দৃষ্টিতে দুজন দেখে যাচ্ছে দুজনকে।
একসময় ধ্রুব অদিতির কানের ঝুমকো আঙুলের ডগা দিয়ে নড়িয়ে দিয়ে মদ‍্যক কণ্ঠে প্রশ্ন করল——‘কি বলছিল দাদীরা আজ? বেবি নিলে আমি তোমার হাতের মুঠোয় থাকব?’
অদিতি লজ্জায় মাথা সরিয়ে নিলো! ধ্রুব শুনেছে তাহলে? ছিঃ! কি লজ্জার ব্যাপার! চোখ-মুখ কুঁচকে আই-ঢাই করে বলে উঠল——‘না, না! উনারা বলছিলেন—‘

ধ্রুব অদিতির ঠোঁটে আঙুল ঠেসে ধরল; বলা বন্ধ হয়ে গেল মেয়েটার। বড়বড় চোখে তাকাল ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব অদিতির ঠোঁটের দিকে পিপাসার্ত চোখে চেয়ে বলে গেল——‘দাদিদের একটু জানিয়ে দিবে— ধ্রুবকে কেমন ভাবে তাদের বৌমা নিজের হাতের মুঠোয় দলাই-মলাই করে পিষে রেখেছে? ওরা শুনলে— আর বেবির কথা বলে আপনাকে আর লজ্জায় ফেলবে না।’
অদিতি বাকহারা! ধ্রুব আলগোছে খুলে ফেলা সেফটিপিন আটকে দিল কোমরের কাছে শাড়িতে। তারপর ঘাড়ে ছোট্ট চুমু খেয়ে বলল——‘লিসেন; রাতে সারপ্রাইজ আছে!’
অদিতি বোকার মতো বলে বসল—— ‘কার জন্যে?’
ধ্রুব বিরক্ত হলো; ভ্রু কুঁচকে বলল——‘কটা ওয়াইফ আমার?’
অদিতি হেসে ফেলল শব্দ করে———‘সরি! একটাই বউ আপনার; আমি জানি এটা।’
অদিতি আবার মাথাটা হেলিয়ে দিল ধ্রুবর গালের উপর। ধ্রুব অদিতির দিকে চেয়ে আলতো গলায় ডাকলো——‘অদিতি?”

অদিতি চোখ বুজে; গায়ের সম্পূর্ণ ভর রেখেছে ধ্রুবর গায়ে। সেভাবেই অস্ফুটে জবাব দিল—— ‘হু?’
ধ্রুব কণ্ঠে প্রবল ঘোর নিয়ে বলল——‘আমরা এখন আমাদের বাড়িতে আছি। আমার রুম আমাদের মতো করে সাজিয়ে দিলে আজ, আমি কি পারমিশন পাব? রিমেম্বার, লাস্ট নাইট? কি বলেছিলে তুমি?’
অদিতি চোখ খুলে তাকাল আয়নায় নিজেদের দিকে। ধ্রুবর চোখে নেশা! ও নেশাতে অদিতির মরণ সই! মরণ-টুকু যে ও সাদরে গ্রহণ করবে; মেলে দিতে চাইবে নিজেকে তার ভালোবাসার তরে! অদিতির কি মুখ ফুটে বলা লাগবে যে— ধ্রুব যা চায়; ওর চাওয়াটাও তাই?

আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ৩৫

ওকে চুপ থাকতে দেখে, ধ্রুব তাড়া দিল—— ‘আনসার দাও!’
অদিতি জবাবে স্রেফ মাথা নাড়লো দুদিকে; তারপর ধ্রুবর কাছ থেকে শাড়ির আঁচল ছুটিয়ে নিয়ে একপ্রকার পালিয়ে গেল গেস্ট রুম থেকে।
ধ্রুব মাথার ঝাঁকড়া চুল পেছনের দিকে ব্যাকব্রাশ করে তৃপ্তির হাসিটুকু ঠোঁটে ফুটিয়ে অদিতির পেছন পেছন নেমে এল!

আমার প্রেমিক ধ্রুব পর্ব ৩৭