আমার শহরে রংধনু উঠেনা শেষ পর্ব 

আমার শহরে রংধনু উঠেনা শেষ পর্ব 
Arishan Nur

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো। আস্তে আস্তে নিরিবিলি পরিবেশটা কেমন গুমোট, ভুভুরে পরিবেশে পরিনত হলো। বর্ষার এই পরিস্থিতিতে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। কোন কিছুই ভালো লাগছিল না। একে তো সকাল থেকে না খাওয়া তার উপর সে সামান্য অসুস্থও। ফারাজের জন্য এবারে দুশ্চিন্তা হতে লাগলো। ছেলেটা এমন কেন করলো?

সে বেশ কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল। ছয়টা বাজতেই চোখ গেল নিচের দিকে। ফারাজকে নিচের রোড থেকে হাসিখুশি অবস্থায় ফিরে আসতে দেখে তার মেজাজ চটে যায়৷ দুই মিনিট পর বেল বাজার শব্দ কানে আসে। বর্ষা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। দরজা খেলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই তার৷ কিন্তু মুহুর্তের মধ্যে তার কান আওয়াজে ফেটে যাওয়ার উপক্রম। বিরতিহীন ভাবে ফারাজ বেল বাজিয়েই যাচ্ছে৷ যেকেউ ভাবতে পারে যে বাসায় বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে।
বর্ষা বড় বড় পা ফেলে দরজা খুলে দিয়ে একটা ধমক দিয়ে বলে, কি সমস্যা আপনার? অপেক্ষা করা যায় একটা সেকেন্ড? যত্তোসব!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বর্ষার ধমক খেয়ে ফারাজ তাজ্জব বনে গেল। শান্ত-শিষ্ট মেয়েটার এমন রাগী লুক দেখে সে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়৷ আমতাআমতা করে বলে, ভাবছিলাম ঘুমে আছো।
বর্ষা রাগী চোখে তার দিকে তাকিয়ে থেকে দৃঢ গলায় বলে, আপনি দুপুরে এলেন না কেন?
ফারাজ দ্বিতীয় দফার ভ্যাবাচেকা খায়। সে তাকে পালটা প্রশ্ন করব, জেরা করা হচ্ছে?
–প্রশ্নের উত্তর দিন।

ফারাজ পকেটে হাত গুজে কপট রাগ দেখিয়ে বলে, এই সামন থেকে সরো। ভেতরে ঢুকতে দাও। মুখের সামনে পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেন? আর একটা কথা বউ-বউ ভাব নেওয়ার দরকার নাই। তোমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন দেখছি না।
শেষের লাইন দুইটা শোনামাত্র বর্ষা হুট করে রাগ উঠলো। হুটহাট রেগে যাওয়া তার ছোট বেলার স্বভাব। রাগে তার ফর্সা মুখ লাল হয়ে আসলো।
সে রাগ দেখিয়ে সামান্য উঁচু আওয়াজে বলে,তাহলে কাজের মেয়ে হয়ে পড়ে থাকব? আপনার ফুট-ফরমায়েশ খাটার জন্য এসেছি এখানে?

ততোক্ষণে ফারাজ তাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা লাগাতে ধরবে তার আগেই বর্ষা তার কোন কথা না শুনেই ফ্ল্যাটের বাইরে বের হয়ে সিড়ি ধরে নামা শুরু করে। ফারাজ সম্ভবত কিছু বলতে চাচ্ছিল কিন্তু বর্ষার গমনে আর বলা হলো না।
ফারাজ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করে, আরে আরে যাও কই?
বর্ষা পিছনে ঘুরে তার দিকে তাকিয়ে বলে, সেটা আপনাকে বলার প্রয়োজন মনে করছি না।
নিজের কথা নিজেকেই ঘুরিয়ে দেওয়ায় তৃতীয় দফায় শকড সে। বিড়বিড়িয়ে বলে, ওহ গড়। মেয়েটাকে কি জীনে আঁচড় দিলো নাকি?এমন উদ্ভট আচরণ কেন করছে?

বর্ষা বেশ দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে বাসার বাইরে চলে গেলো। বাসার সঙ্গে লাগোয়া রাস্তা। রাস্তার দুইধারে বেশ গাছ-পালা। ননভেম্বরের শুরুর দিকে কেমন স্নিগ্ধ থাকে পরিবেশ
চারপাশে লাইট জ্বালানো আছে। হলুদ-সাদা আলোয় বর্ষা মুগ্ধ না হয়ে পারলো না।
সে রাস্তা ধরে হাঁটা ধরল। যেদিকে চোখ যাচ্ছে সেদিকেই হেঁটে যাচ্ছে সে। কোনকিছুরই পরোয়া করেনি সে। চোখ যেদিকে যায় সেদিকেই হাঁটছে। জোরে জোরে হাঁটার ফলে একটা সময়ে সে হাপিয়ে উঠে ফলে সে হাঁটা থামিয়ে দেয়৷ পা ব্যথা করছে এখন। একটা দম ফেলে পেছনে ঘুরতেই তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে এলো। বুক ধক করে উঠলো তার। সেকি!

এটা কোন রাস্তা? আশেপাশে তাকাতে লাগলো সে। কিছু ই মনে আসছে না কোনদিক দিয়ে এসেছে। প্রথমে ডানে বাক নিয়েছিল এরপর আর মনে নেই। তবে বিপদে পড়েও তার মধ্যে ভাবান্তর হলো না। সে আরো সামনে এগিয়ে গেলো। সামনের বাড়ির দিকে মুগ্ধ চোখে তাকালো। ডুপ্লেক্স বাড়ি। সাদা রঙের। বাসার দেয়ার ঘেঁষে বাগানবিলাস ফুল ফুটে আছে। দূর থেকে হলদে আলোয় চমৎকার লাগছে। সঙ্গে মৃদ্যু বাতাসে মনটা হালকা ভালো হলো তার। সে মনে মনে ঠিক করলো বাকি জীবন এই বাসার সামনে বসেই কাটিয়ে দিবে সে। তাও ওই বাসায় ফিরে যাবে না। কখনোই না।

বর্ষা নিচে নেমে যাওয়ায় ফারাজ মোটেও বিচলিত হলো না। সে রুমে এসে গোসল সেড়ে গুনগুন করে ইংলিশ গান গাইতে লাগলো। সাউন্ড বক্সে গান শুনতে ইচ্ছা করছে। আজকে অনেকদিন পর সে খুশি। হাতে বেশ কিছু টাকা আছে বর্তমান। সোনার চেইনটা বিক্রি করে ভালো টাকা পেয়েছে। এ চেইন বিক্রি করতেইই এতো দেরি হলো তার! এক্সপেকটেশনের চেয়ে টাকা বেশি পেয়েছে জন্য মুডটাও ভালো। ডাইনিং রুমে আসতেই চোখ পড়ে খাওয়ার টেবিলের দিকে।

খুব সুন্দর করে খাবার সাজানো আছে। সে ঝাপি উঠিয়ে দেখলো মুরগির মাংস, ডাল আর বেগুন ভাজী। মুরগির মাংস দেখেই তার ক্ষুধা পেয়ে যায়৷ একদন্ড অপেক্ষা না করে সে খেয়ে বসে যায়। টেবিলে সুন্দর করে সালাদ বানিয়ে রাখা। কিন্তু সবই ঠাণ্ডা। ভাতও শক্ত হয়ে গেছে। খাবার দেখে বোঝা যাচ্ছে এই টেবিলে আজ কেউ খায়নি। তখনি তার সকালের ঘটনার কথা মনে পড়লো। সে বর্ষাকে দুপুরে রান্না করতে বলেছিল। মেয়েটা তার কথা অনুযায়ী রেঁধেও রেখেছিল কিন্তু সে আসেনি। এই কারণেই কি সে রাগ দেখালো? কি আশ্চর্য! তার উপর রাগার কি আছে? ফারাজের খাওয়া আর হল না।

সে প্লেট রেখে উঠে দাঁড়ালো এবং বাসার বাইরে বের হলো। সময় তো পয়তাল্লিশ মিনিট অব্দি হলো! বর্ষা এখনো আসেনি। তাকে ডেকে আনা দরকার। ফারাজ দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলো বর্ষা ডানদিকে গেছে। ডান দিকে গেছে শুনে কিছুটা স্বস্তি পেল। ডানদিকে সব আবাসিক এরিয়া। কিছু দূর গিয়েই রাস্তা শেষ। সহজেই খোঁজা যাবে। সে দ্রুত পা চালানো৷ রাস্তার শেষ মাথায় পৌঁছাতেই তার নজরে আসলো এক সাদা পরীর দিকে। সাদা পরী বলে ডাকাটাই শ্রেয় বোধহয়! মানুষ কি এতো সুন্দর হতে পারে? আচ্ছা পরীরা কি শাড়ি পড়ে? পড়ে বোধহয় কারন তার চোখের সামনে যেই পরীটা দাঁড়িয়ে আছে সে সাদা সুতির কাজ করা শাড়ি পড়ে আছে৷ গোলাপি ফুলের সামনে সাদা শাড়ি পরিহিত মেয়েটাকে দেখেই তার বুক হুহু করতে লাগলো। সবকিছু উল্ট-পাল্ট হতে শুরু করে। ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে সে সামনের গিয়ে পা ফেলে যেতে লাগলো।

সাদা শাড়ি পরিহিতা রমনী ভীষণ ব্যস্ত। তার হাত নাগাল পাচ্ছে না বাগানবিলাসদের থোকায়! সে পা উঁচু করে দুহাত উপর করেও কুল পাচ্ছে না।
ফারাজ তা দেখে মিটমিট করে হেসে বলে, ফুল চাই তোমার?
ফারাজের কন্ঠস্বর কানে যাওয়া মাত্র সে হচকচিয়ে উঠে পেছনে ঘুরে। দুইজনের চোখাচোখি হতেই ফারাজ তার কাছে এসে দাঁড়ালো হাত বাড়িয়ে খুব সহজেই গাছ থেকে কয়েকটা গোলাপি ফুল ছিঁড়ে তার হাতে ধরিয়ে নিয়ে আস্তে করে বলে, সব ফুল কিন্তু ছিঁড়া যায় না।

–মানে?
— কিছু না। দুপুরে খাওনি কেন?
বর্ষা তার প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে বলে, তাতে আপনার কি?
— আমার কিছু-ই না। চল বাসায় চলো।
— আমি যাব না৷
— তাহলে যাবে কই?
বর্ষা গাল ফুলিয়ে বলে, আমি এখানেই থাকব। দরকার হলে ফুটপাতে রাত কাটাব।
ফারাজ তার বাচ্চামি দেখে হালকা হাসলো। এরপর বলে উঠে, ফ্রাইড রাইস খাও?
বর্ষা সামান্য বিব্রতবোধ করতে লাগলো।ফারাজ আচমকা তার হাত ধরে ফেলে। সে চেচিয়ে উঠে বলে, আমার হাত কেন ধরলেন?

— রিল্যাক্স! হাত ধরেছি। অন্যকিছু ধরিনি যে এতো রিয়্যাক্ট করবে।
— আপনি হাত ছাড়ুন।
— চল সামনে আগাই।
— আপনি খুব বিরক্তকর!
— জানি।
ফারাজ হাঁটা শুরু করলো। তার হাতের মাঝে বর্ষার নরম তুলতুলে হাত এখনো আবদ্ধ আছে। বর্ষা মুখে হাত ছাড়তে বললেও নিজ থেকে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেনি। সেও ছাড়েনি আর।
তারা হাঁটা ধরে সামনে আগাতে থাকে। ফারাজ তাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে, আচ্ছা পরীরা কি শাড়ি পড়ে?
বর্ষা বলে উঠে, পরী বলে কিছু আছে নাকি!
সে মনে মনে বলে, তাহলে তুমি কে?
ফারাজ তাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে এসে একেবারে কর্ণারের একটা ফাঁকা জায়গায় বসলো। বর্ষা মুখ কালো করে বলে, এখানে কেন আনলেন?

— আমার উপরে রাগ তো ভাতের উপর ঝাড়লে তাই ভাবছি রাগ কমানোর জন্য কিছু করা উচিত।
— আমার রাগ নিয়ে আপনার খুব দুশ্চিন্তা বুঝি?
ফারাজ মেন্যু কার্ড দেখতে দেখতে বলে, দুশ্চিন্তা না! বাট আই কেয়ার৷
বর্ষা তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে বলে, কেয়ার না ছাই।
অর্ডার দেওয়ার খুব দ্রুত খাবার পরিবেশন করা হলো। মাশালা ফ্রাইড রাইস, চিকেন কারি, বীফ সিজলিং। সঙ্গে সালাদ।
বর্ষার দিকে খাবার এগিয়ে দিয়ে ফারাজ বলে উঠে, চামচ দিয়ে খেতে সমস্যা হলে হাত দিয়ে খাও। বি কমফোর্ট।
বর্ষার কথাটাা কর্ণপাত হওয়া মাত্র ফর্সা গাল লজ্জায়,অপমানে লাল হয়ে আসলো। সে বলে উঠে, আমি গ্রামে থাকি জন্য কি ভাবেন চামচ দিয়ে খেতে পারি না?

— ব্যাপার টা এমন নয়।
— আপনার সংকোচ বোধ হয় তাই না আমার সঙ্গে থাকলে? এইজন্য কাউকে আমার আসল পরিচয় দেন না৷
— বড্ড বেশি বকো তুমি। খাওয়ায় মনোযোগ দিই? ঠাণ্ডা হলে টেস্ট থাকে নাহ।
বর্ষা কিছু না বলে খাওয়ায় মনোযোগ দিল৷কথা বলেই বা কি? ফারাজ তার কোন প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক দেয় না।
সেরাতেও ফারাজ নিজ থেকে তার রুমে আসে একসঙ্গে শোয়ার জন্য। বর্ষা এ নিয়ে একটা কথাও বলেনি। যেভাবে চলছে চলুক। সাতদিন পর ফারাজের বাবার সঙ্গে তার মাও আসবে। তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।

সেরাতেও ফারাজ তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমালো। সকাল পর্যন্ত সব ঠিক থাকে। নাস্তা সেড়ে ফারাজ বের হয়৷ কিন্তু যখন ফিরে আসে তখন সে মোটেও স্টেবেল ছিলো না। সম্পূর্ণ মা-তা-ল অবস্থায় ছিল৷ তাকে ওই অবস্থায় দেখে বর্ষা কান্না করে দেয়৷ কিন্তু আগামী চারদিন তার জন্য বাসাটা নরক হয়ে যায়। প্রায় প্রতিরাতে ফারাজ খুব রাত করে ফিরত। এবং অবশ্যই সেই সময় সে হুশে থাকত না। দুপুর পযর্ন্ত ঘুমাত। সবকিছু কেমন ঘোলাটে হয়ে উঠলো বর্ষার কাছে৷
আটদিনের মাথায় রুহুল আমীনের সঙ্গে বর্ষার মা মিসেস আমেনাও ঢাকায় আসেন। মেয়েকে দেখতে। সেদিন ফারাজের অবস্থা সবচেয়ে অশোচনীয় ছিল। সেরাতে সে ফযরের আযানের পর ফিরে। এবং তার মুখ গা দিয়ে জঘন্য ভোটকা একটা গন্ধ বের হচ্ছিল। বাসায় এসেই তিনবার বমি করে ঘুমাতে গেছে।

ফারাজকে ওই অবস্থায় দেখে আমেনা বেগমের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। রুহুল আমীনের সঙ্গে তুমুল মনোমালিন্য চলতে থাকে তার। মায়ের দিকে করুন চোখে তাকিয়ে থাকে সে। আসলে তার কিছু বলার নাই। এমন একজনের সঙ্গে সংসার করা সম্ভব না। একয়েকটা দিন তার কাছে নরক সমতুল্য ছিল। অনেক কথা কাটাকাটির পর ফয়সালা হয় আমিনা তার মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। এর মধ্যে যদি ফারাজ নিজেকে শুধরাতে পারে তাহলে ফেরত আসবে নাহলে তালাক।
যখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছিল ওই সময় ফারাজও উপস্থিত ছিল। সে একটা কথাও বলেনি। আসলে তার নে-শার ঘোর কাটেনি তখনো। সেন্স নাই তেমন একটা। কি হচ্ছে কিছুই বুঝে পাচ্ছে না। শুধু বুঝতে পারছে বর্ষা আর এখানে থাকবে না।

এই টুকুই তার মস্তিষ্কে গিয়ে বারবার আঘাত করতে থাকে। সে হাঁসফাঁস করতে লাগে। বর্ষার দিকে তাকায় সে। একি বর্ষা কাঁদতে।কিন্তু কেন? প্রশ্ন করা হলো না। তার চোখের সামনে বর্ষাকে নিয়ে তার মা চলে যায়। তাদের যাওয়ার দৃশ্যপট দেখে একবারো ফারাজের মনে পড়েনি, তার অর্ধেক সম্পত্তি হাতছাড়া হচ্ছে। বরং এই কথা তার মনেই ছিল না। বারবার ব্রেইনে সংকেত পেশ হচ্ছিলো, তার স্ত্রী চলে যাচ্ছে। কি আশ্চর্য! শেষবেলায় ফারাজের মনে পড়লো বর্ষা তার স্ত্রী! যাকে জড়িয়ে ঘুমালে ঘুম ভালো হয়! যার মুখের দিকে তাকালে পূন্য হয়!যার হাতের রান্না খেলে সে তৃপ্তি পায়। যার চোখের দিকে তাকালে একটা চমৎকার পৃথিবী ভেসে উঠে। যেই রঙিন পৃথিবী হতে সে মাঈল-মাঈল দূরে! সেই মানুষটার গমনে সে ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়ে।

রুহুল আমীনও ফারাজের উপর কড়া নজরদারি করেন। কোথাও বের হতে দেননি। আস্তে আস্তে যখন নে-শার প্রভাব কাটে ফারাজ বুঝতে পারে সে বর্ষাকে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু এই অসাধ্য সাধন কীভাবে হলো সে জানে না! ততোদিনে যোগাযোগের বাইরে বর্ষা। কোথাও বর্ষার অস্তিত্ব নেই। তার বুকের কোনো একপাশটায় খালি খালি লাগে। খাওয়ায় রুচি হয় না। ঘুম হয় না। দুর্বিষহ লাগতে শুরু করে দিনগুলো।
বাবা কোথা থেকে একটা রিহ্যাবের ফর্ম এনে তার হাতে দিয়ে বলল, আগামী ছয় মাস তুমি আন্ডার অবজারভেশনে থাকবা। আমি কিছু শুনতে চাই না।

বাবার সঙ্গে অনেকদিন পর কথা হলো ফারাজের। ফারাজ প্রথমেই বলে উঠে, আব্বু আমি আগের মতো স্বাভাবিক হতে চাই। এই জীবন অসহ্য লাগছে। আমার জীবনে আমি বর্ষাকে চাই। প্লিজ একবার ওর সাথে যোগাযোগ করার ব্যবস্থা করে দাও৷ প্লিজ!
রুহুল আমীন ছেলের কথায় বিষ্মিত হয়ে যান।অপলক চেয়ে থাকেন কিছুক্ষণ৷ এরপর বর্ষার নাম্বার দিয়ে যান।
বাবা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে কল লাগায়। কিছুক্ষণ পর বর্ষার কন্ঠস্বর ভেসে আসে। কন্ঠস্বরটা ফারাজের কাছে কাঠফাটা মরুভূমিতে এক পশলা বৃষ্টির মতোন লাগে।
সে করুন গলায় বলে, বর্ষা প্লিজ কাম ব্যাক।
ওপাশ থেকে চুপ করে থাকে সে। ফারাজ অনবরত বলে যায়। আমি এম সর‍্যি। আমার কিছু চাই না। টাকা-পয়সা, সম্পত্তি কিছু না। শুধু তোমাকে চাই।

আমার শহরে রংধনু উঠেনা পর্ব ৫

— নে-শা করে ফোন দিয়েছেন কি?
— উহু বরং নে-শার ঘোর কেটে গেছে। প্লিজ একটা চান্স দাও আমাকে। একটামাত্র চান্স!
— ফারাজ জানেন, মানুষের মন আর গাছ কিছুটা একরকম! দুটোরই প্রচুর পরিচর্যা প্রয়োজন। পরিচর্যা ছাড়া গাছ যেমন মরে যায় তেমনি অবহেলা পাওয়া মন মৃত হয়ে যায়। আবার পানি পেলে গাছ সূর্যের আলোর উপস্থিতিতে খাদ্য তৈরি করে যেমন তরতাজা হয়ে উঠে তেমনই মানুষের মনও সালোকসংশ্লেষণ ঘটিয়ে পুনরায় জীবিত হয়। তবে মানুষের মনের সালোকসংশ্লেষণ ঘটতে পানি বা আলো দরকার পড়ে না। দরকার পড়ে কেবল এক ফালি আপনজনের যত্ন এবং দু’মুঠো ভালোবাসার! আমি চাই আপনি খারাপ পথ থেকে ফিরে আসুন। আপনি পুরুষ হিসেবে খুব ভালো। হয়তোবা মানুষ হিসেবেও ভালো।কিন্তু অন্ধকারাচ্ছন হয়ে পড়েছেন। আপনি যদি আবার সুস্থ-স্বাভাবিক হন আমি ফিরে আসব৷
— সত্যি আসবে তো?

— হ্যাঁ আসব।
— এতোদিন অপেক্ষা করতে পারবে? অন্যকেউ যদি তোমাকে কেড়ে নিয়ে যায়?
— আমি আপনার জন্য অন্ততকাল অপেক্ষা করতে রাজী শুধু আপনি শুধরে যান।
— কিন্তু আমার শহরে রংধনু উঠে না যে!
— আপনি জানেন ভারী বর্ষনের পর ঝকঝকে আকাশে রংধনু উঠে? আমাদের জীবনে এখন ভারী বর্ষণ চলছে। আশা করি এই বর্ষনের পর খুব দ্রুত আপনার-আমার শহরে রংধনু উঠবে।
ফারাজের চোখ গেল রিহ্যাবের সেই ফর্মটার উপর। সে ফর্মটা খুব যত্ন নিয়ে পূরণ করে ভাবতে লাগে, আদৌ কি তার জীবনেও রংধনু উঠবে?

( লেখাঃArishan Nur ) এই লেখিকার আরও লেখা গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন এই গল্পের সিজন ২ পড়তে চাইলেও এখানে ক্লিক করুন