আমার হায়াতি পর্ব ৩২
Nahar Adrita
সকাল সাতটা, দিনের একেবারে শুরুর দিক। রাতের কালো আবেশ তখনও পুরোপুরি কেটে যায়নি, আকাশে হালকা নীলের সাথে মিশে থাকে কুয়াশার সাদা পরত। পাখিদের কিচিরমিচির ডাক ভেসে আসে, বাতাসে থাকে ভেজা ঘাসের সুবাস। এই সময়টা নতুন করে শুরু করার, শান্ত অথচ প্রাণবন্ত এক আবহ তৈরি করে।
বাড়ির সকলে উঠেই যার যার কাজে লেগে পড়েছে। আদিব, রাজসহ সকলে মিলে আসিফকে আবারও হলুদ দিয়ে গোসল করাচ্ছে। দুপুরেই বিয়ে পড়ানো হবে বলে সকলে ব্যস্ত প্রস্তুতিতে। আদিব বাকা হেসে বললো,
ওদিকে হায়াতরা মিলে আসিফের রুম ফুল দিয়ে সাজাচ্ছে । ঠিক তখনই আরাবি একটি লাল গোলাপ তুলে নিয়ে নিজের কানে গুঁজে নিলো। হায়াতের চোখে পরতেই এক গাল হেসে বললো,
– দেখো নুপুর, রিয়া, মিনহাজা! আরুকে কতো কিউট লাগছে, তাই না ?
মিনহাজা মুচকি হেসে বললো,
– হ্যাঁ ভাবি, একদম পুতুলের মতো লাগছে।
তার কথায় বাকিরাও মাথা নাড়লো। নুপুর হেসে বলতে শুরু করলো,
– আমার যদি আরেকটা ভাই থাকতো, তবে আরাবিকেই ভাবি করে আনতাম।
রিয়া দুষ্টুমি করে বললো,
– হ্যাঁ, আমি ভাবছি রাজ ভাইয়ের সাথেই আমাদের আরুকে বিয়ে দিয়ে দিই। কেমন হবে, ভাবি ?
সকলের হাসি-ঠাট্টার মাঝে লজ্জায় আরাবি কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো । হায়াত এগিয়ে গিয়ে আরুর গালে আলতো একটা চুমু খেয়ে হাসতে হাসতে বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– না না, আরুকে কখনোই রাজ ভাইয়ার মতো গোমড়া মুখো মানুষের সাথে বিয়ে দেওয়া যাবে না। আমাদের ডার্ক রোমান্স গল্প পড়ুয়া আরাবির জীবন তো শেষ হয়ে যাবে যদি এমন গম্ভীর মুখো কারো সাথে বিয়ে হয়ে যায় !
কথাটা শুনে সকলে আবারও হেসে উঠলো। কিছুক্ষণ আড্ডা শেষে সবাই আবার রুম সাজানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলো।
এদিকে আসিফ গোসল সেরে রুমে ঢুকলো। ভেতরে ঢুকতেই দেখে চারপাশে ফুলের সাজ আর বোনদের হাসাহাসি। মাথা চুলকে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
– তোদের এসব করতে কে বলেছে ?
হায়াত মুচকি হেসে জবাব দিলো,
– কে আবার ভাইয়া, আপনার ভাইয়ের কড়া আদেশ—বাসর ঘর সাজাতেই হবে।
রিয়াও হেসে মাথা নাড়িয়ে বললো,
– হ্যাঁ, আদিব তো ভোর পাঁচটায় উঠে ফুল কিনে এনেছে।
আসিফ তোয়ালে কাঁধে রেখে দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ চোখ গেলো আরাবির দিকে। কানেই তখনো সেই গোলাপ। আসিফের বুকের ভেতরটা কেমন যেন ধক করে উঠলো। মনে মনে ভাবলো,
মেয়েটা সত্যিই ভীষণ সুন্দর… সামান্য একটা ফুলেই কী অদ্ভুত মানিয়েছে তাকে।
সকাল দশটা। সকলে একে একে নাস্তা সেরে নিলো। খাওয়া-দাওয়া শেষ হতেই আদিবের দাদি সবাইকে গোসল সেরে তৈরি হতে বললেন। কথা মতো সকলে হাত-মুখ ধুয়ে যে যার মতো রেডি হতে চলে গেলো।
এমন সময় বাড়ির গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো আরাবির মা-বাবা। সবে মাত্র সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছিলো আরাবি, কিন্তু বাবা মাকে দেখে আনন্দে দৌড়ে নেমে এলো নিচে। হায়াতও এক গাল হেসে দ্রুত নেমে এলো।
আরাবি ছুটে গিয়ে মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরলো, আর হায়াত ভদ্রভাবে সালাম জানিয়ে জড়িয়ে ধরলো। চারপাশে হাসির রোল উঠলো। মিসেস সুফিয়া আর
মিসেস অরোরা তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে অতিথিদের ডাইনিং টেবিলের দিকে নিয়ে গেলেন।
আরাবির মা একজন গাইনোকলজিস্ট বিশেষজ্ঞ, আর তার বাবা সাহানুর খান একজন ব্যাঙ্কার।
এদিকে আদিবের ঘোর বিপদ, পাঞ্জাবির একটি বোতাম খুলে গিয়েছে। অনলাইনে অর্ডার করা করলেও নতুন পাঞ্জাবি আসতে তিন দিন লেগে যাবে, এখন চাইলেও বাইরে গিয়ে কেনার সুযোগ নেই, সময়ও কম।
হায়াত পা টিপে টিপে রুমে ঢুকতেই দেখলো, আদিব চিন্তিত মুখে বসে আছে। কপাল কুঁচকে হায়াত বললো,
– কী হয়েছে ? গোসল করে পাঞ্জাবি পরছেন না কেনো, নাকি অন্য কিছু পরবেন ?
আদিব দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিলো,
– বোতামটা খুলে গেছে… নতুন কেনাও সম্ভব না।
হায়াত এগিয়ে এসে আদিবের কোলে বসল। আলতোভাবে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। আদিব মুহূর্তেই লাজুকপাখি কে কাছে টেনে আবেশে ডুবে গেলো। প্রায় দশ মিনিট পর ছেড়ে দিয়ে হায়াত মুচকি হেসে বললো,
– অনলাইনে অর্ডার করুন তাহলে।
আদিব গলায় মুখ ডুবিয়ে ফিসফিস করে বললো,
– এটা তো খাবার না বউ, বললেই যে সঙ্গে সঙ্গে চলে আসবে।
হায়াত এবার বোঝলো সমস্যাটা আসলেই গুরুতর। সে ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ ভেবে ওয়ারড্রোব খুলে সুই-সুতা বের করলো। আদিবের হাত থেকে বোতামটা নিয়ে নিপুণভাবে সেলাই করতে লাগলো। তিন মিনিটের মধ্যেই কাজ শেষ।
হাতের কাজের নিখুঁত ফলাফল আদিবকে দেখিয়ে হায়াত মুচকি হেসে বললো,
– এবার আর কোনো সমস্যা নেই।
আদিব হেচকা টান দিয়ে হায়াতকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। গলায় নাক ডুবিয়ে আদিব প্রশংসা করলো,
– বাহ! আমার বউ দেখি সব কাজেই পারদর্শী।
হায়াত চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে হাসলো,
– হ্যাঁ, টুকটাক জানি। আচ্ছা, এবার যান তো, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিন ।
আদিব আর কিছু না বলে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো।
কিছুক্ষণ পর আরাবি, নুপুর আর অন্যরা রুমে এলো। হায়াত তখন বিছানার চাদর ঠিক করছিলো। সবাই ডিভানে বসলো। আরাবি হাতে শাড়ি নিয়ে বসে বিরক্ত মুখে বললো,
– এই জানু! আমাকে কেন শাড়ি পরতে হবে ? তোরা পর না !
হায়াত কাজ করতে করতেই বললো,
– না না আজকে সবাই পরবো তো তোকেও পরতে হবে।
কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে সকলে নুপুরের রুমের দিকে রওনা দিলো। হায়াত আলমারি থেকে একটি গাঢ় মেরুন রঙের শাড়ি বের করে নিয়ে বাকি মেয়েদের সাথে চলে গেলো।
মুহূর্তের মধ্যে হাসি-আনন্দে ভরে উঠলো রুম। একে একে সবাই সাজগোজ শুরু করলো। শাড়ির গুঁজে নিলো, টিপ পরে নিলো কপালে । হায়াত নিজে সেজে নিয়ে আরাবির খোপায় আলতো করে একটা লাল গোলাপ গুঁজে দিলো। মেয়েটাকে যেন আরও বেশি সৌন্দর্য্য ফুটে উঠলো।
এদিকে বাড়ির বড়রা—মা , চাচীরা—তরুণীদের সাথে তাল মিলিয়ে সেজে নিচ্ছেন।
একসময় সবাই একসাথে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো। ড্রইংরুম যেন ছোট্ট এক আনন্দ।
আদিবের চোখ হায়াতের উপর গিয়ে থমকে গেলো। হায়াতকে যেন আজ নতুন করে দেখছে,এতদিনের চেনা মানুষটা হঠাৎ অন্য এক জগৎ থেকে নেমে এসেছে যেন। একটু বেশিই সুন্দর লাগছে তার লাজুকপাখিকে।
ঠিক তখনই ড্রইংরুমে প্রবেশ করলেন রাকিব চৌধুরী আর জাকির চৌধুরী,, দুজনেই সাদা পাঞ্জাবিতে দারুণ লাগছিলো। হায়াত মিষ্টি হেসে বললো,
– বাবা, চাচ্চু, মাশাআল্লাহ আপনাদের অনেক সুন্দর লাগছে। অনেকদিন পর দেখলাম আপনারা সাদা পাঞ্জাবি পরলেন।
দুই ভাই হেসে হায়াতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। পাশে বসা মিসেস অরোরা আর সুফিয়া মুখ গোমরা করে বললেন,
– হ্যাঁ, তাদেরই শুধু সুন্দর লাগছে, আমাদের নয় নাকি ?
হায়াত হেসে তাড়াতাড়ি বললো,
– আরে না আম্মু, আপনাদেরও দারুণ লাগছে।
এই সময় রাজ এসে হাজির হলো আসিফকে নিয়ে। বিয়ের সাজে আসিফকে রাজপুত্রের মতো লাগছে। মিসেস সুফিয়া এগিয়ে এসে ছেলের কপালে চুমু খেলেন,
– বাজান, আম্মুর জন্য বউ না, একেবারে লক্ষ্মী মেয়েকেই নিয়ে আসো।
আসিফ মৃদু হেসে দৃষ্টি ফেললো,চোখ গিয়ে থমকালো আরাবির দিকে। কালো শাড়িতে মেয়েটি যেন একেবারে অপরূপা। নিজের অজান্তেই আসিফের বুকের ভেতর কেমন এক ধাক্কা খেলো ক্রাশ ! মনে মনে নিজেকে গালি দিতে লাগলো,
কখনো কোনো মেয়েকে এভাবে ভালো লাগেনি, এভাবে তাকিয়েও দেখি নাই। আজ হঠাৎ এ কেমন অনুভূতি?”
আসিফের ভাবনার মাঝে হঠাৎ আদিব তার পিঠে চাপড় মেরে বললো,
– এখনই বউ নিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখার দরকার নেই স্যার, আগে চলুন বিয়ে করিয়ে বউ নিয়ে আসি।
আদিবের কথায় সকলে হো হো করে হেসে উঠলো। আরাবির মা-বাবাও এসে মেয়ের পাশে দাঁড়ালেন।
হঠাৎই রাকিব চৌধুরীর ফোনটা বেজে উঠলো। সবার দৃষ্টি ঘুরে গেলো তার দিকে। তিনি চশমাটা টেনে ঠিক করে কল রিসিভ করলেন। ওপাশে কী বলা হলো সেটা শোনা গেলো না, কিন্তু মুহূর্ত পরেই তার হাত থেকে ফোনটা প্রায় পড়ে যাচ্ছিলো।
ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লেন রাকিব চৌধুরী।
বাবা….! বলে চিৎকার করে ছুটে গেলো আদিব, বাবাকে জাপটে ধরলো।
হঠাৎ পুরো ঘর স্তব্ধ। সাংবাদিকরা ব্যস্ত ক্যামেরা ক্লিক করতে, একজন তো ভিডিও করতেই শুরু করেছে। রাজ রেগে গিয়ে সবাইকে থামাতে লাগলো, শাহাদাত ছুটে গিয়ে দরজায় সামনে দাঁড়িয়ে গেলো।
রাকিব চৌধুরীকে সোফায় বসানো হলো সকলে মিলে । হায়াত দৌড়ে গিয়ে বরফ এনে তার মাথায় চাপালো,কারণ তিনি চিন্তায় পড়ে গেলে সহজেই ব্লাডপ্রেশার বেড়ে যায়।
আসিফ হাঁটু গেড়ে বসে কণ্ঠ কাঁপিয়ে বললো,
– কী হয়েছে চাচ্চু ?
জাকির চৌধুরী ভাইয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে বললেন,
– কিছু বলো ভাই, এতটা অস্থির কেন,কি হয়েছে।
আদিবও কেঁপে কেঁপে বললো,
– বাবা, কিছু হয়েছে ? অফিসে কোনো সমস্যা… আমি গেলে দেখি ?
অবশেষে কপালে হাত রেখে ভেঙে পড়া কণ্ঠে বললেন রাকিব চৌধুরী,
– কনের খবর এসেছে… বউ পালিয়েছে অন্য ছেলের সাথে। বাড়িতে কান্নার রোল উঠেছে। প্রেস-মিডিয়া পেছনে লেগে আছে। আমার ব্যবসার সর্বনাশ হয়ে যাবে। এখন বলো আমি কী করবো ?
কথা শেষ হতেই ঘরে একসাথে চিৎকার, কান্না আর অবিশ্বাসের শ্বাসরোধী আবহ। আসিফের মা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। জাকির চৌধুরী রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে কনের বাবাকে ফোন করে ক্ষোভ উগড়ে দিতে লাগলেন।
সময় যেন থমকে ছিলো প্রায় এক ঘণ্টা। তারপর হঠাৎ নীরবতা ভেঙে মিসেস অরোরা চিন্তিত গলায় বললেন,
– আচ্ছা, চাইলে একটা কাজ করতে পারি…
সবাই তাকালো তার দিকে। তিনি চোখ সরালেন না, ধীরে ধীরে আরাবির মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– আপা, একটা আবদার আছে… রাখবেন?
অবাক দৃষ্টিতে মিসেস সায়মা জবাব দিলেন,
– হ্যাঁ আপা, বলুন। চেষ্টা করবো।
মিসেস অরোরা এক দমে বলে ফেললেন,
– আসলে… এই বিপদের মুহূর্তে আমি চাই আপনার মেয়েকে আমাদের আসিফের সাথে বিয়ে দিতে। আপা বুঝতেই পারছেন, এতোক্ষণে নানান কথা রটতে শুরু করেছে।
মুহূর্তেই মিসেস অরোরার কথায় পুরো ঘরটা যেনো নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। কারও মুখে কোনো শব্দ নেই, শুধু চাপা নিঃশ্বাস আর অস্থিরতার আবহ।
জাকির চৌধুরী ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন আরাবির বাবার কাছে। তাঁর দুটো হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে কণ্ঠ ভারী করে বললেন,
– ভাই হিসেবে চাইছি… আপনার মেয়েটাকে আমাদের ঘরে দেবেন। কথা দিচ্ছি, কোনোদিনও ভালোবাসার ঘাটতি অনুভব করবে না। আরাবিকে নিজের সন্তানের মতো যত্নে রাখবো।
ঘরজুড়ে এক মুহূর্তের নীরবতা। সবার চোখ এবার ঘুরলো আরাবির দিকে। মেয়েটা চুপচাপ বসে আছে, চোখ নামানো, ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু কোনো কথা বলছে না।
হায়াত দম বন্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে আরাবির মুখে। মনে মনে আতঙ্কে ভাবছে,
“যদি আরাবি আসিফ ভাইকে না মেনে নেয়…? যদি মাথা নেড়ে না বলে দেয় ?
সময় যেন থেমে গিয়েছিলো…………
প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে বোঝানো-সমঝানোর পর অবশেষে আরাবির মা-বাবা মাথা নিচু করে সম্মতি জানালেন। সবার মুখে স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে গেলো।
রাকিব চৌধুরী কণ্ঠ দৃঢ় করে আদিবের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– কাজিকে ফোন দাও, আদিব। এখানেই, এই মুহূর্তে ওদের বিয়ে পড়ানো হবে।
নীরব ঘরে হঠাৎ যেনো আলো জ্বলে উঠলো। সবার মুখে একে একে আনন্দের হাসি ফুটে উঠলো।
শুধু আসিফের মুখে ছিলো অন্যরকম এক মুচকি হাসি। যেন ভেতরে ভেতরে সে এটাই চাইছিলো—হাজারো অজুহাতের আড়ালে এই মুহূর্তটাই যেনো তার জন্য অপেক্ষা করছিলো।
হায়াত মুচকি হেসে বললো,
— ইসস আরু বেবি, তোর কি ভাগ্য রে! নিজের বাসর ঘরটা আজ নিজেই সাজিয়েছিস।
হঠাৎ কথা শুনে আরাবি বড় বড় চোখ করে তাকালো হায়াতের দিকে। কিছুক্ষণ পর হায়াত আর কিছু না বলে রান্নাঘরে চলে গেলো। বিকেল হয়ে আসছিলো, সকলে যেনো একটু চা খেলে ভালো লাগে।
চা বসিয়ে গুনগুন করতে করতে চামচ নাড়ছিলো হায়াত। ঠিক তখনই পেছন থেকে দু’টো বাহু এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে। চমকে উঠে পেছনে তাকাতেই দেখলো আদিব। বুকের ওপর ঠেলা দিয়ে গম্ভীর মুখে বললো,
– ধুর, এভাবে হঠাৎ করে কেউ আসে ! জানেন , আমি কতো ভয় পেয়ে গিয়েছি …
আদিব ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে কানে কানে বললো,
– তাই নাকি, লাজুকপাখি ?
– হু, তাই। কিন্তু আপনি এখানে কেনো…?
আদিবের চোখ নামলো হায়াতের বক্ষের দিকে। মৃদু গলায় মজা করে বললো,
– এইতো… একটু দুধ খেতে এলাম।
হায়াত অবাক হয়ে পাশে রাখা খুন্তি হাতে তুলে নিলো।
– কী বললেন আপনি ?
আদিব সঙ্গে সঙ্গে একটু দূরে সরে গেলো।
– আরে না না জান ! আমি বলতে চেয়েছিলাম, তোমার দুধ দিয়ে চা খাবো।
হায়াত চোখ কুঁচকে তাকালো।
– কিহহহহহ্ !
আদিব হাত নেড়ে তাড়াতাড়ি বললো,
– না না, দুধ চা! বউ, রাগ করলে নাকি ? আমি তো মজা করছিলাম। আচ্ছা আচ্ছা, তুমি থাকো, আমি যাচ্ছি।
কথা শেষ না হতেই আদিব সরে গেলো। আর হায়াত হো হো করে হেসে উঠলো।
দশ মিনিট পর গরম গরম চা নিয়ে হায়াত একে একে সবার হাতে ধরিয়ে দিলো। চায়ের পেয়ালার ভেতর ধোঁয়া উড়তে উড়তেই যেনো ঘরটা আরও উষ্ণ হয়ে উঠলো।
সেই সময় দরজায় টোকা পড়লো। কাজি সাহেব এসে পৌঁছেছেন। মুহূর্তেই সবাই গুছিয়ে বসলো। আসিফকে আর আরাবিকে ডেকে এনে দু’টো সোফায় বসানো হলো। পরিবেশ হঠাৎ থমথমে, শুধু সবার নিশ্বাস আর দোয়া-দরুদ পড়ার সুর ভেসে আসছিলো।
কাজি সাহেব নিয়ম মেনে দোয়া শেষ করে কবুল বলতে বললেন। আসিফ দৃঢ় কণ্ঠে এক নিঃশ্বাসে বলে দিলো,
– আলহামদুলিল্লাহ কবুল।
কিন্তু আরাবির ঠোঁট কাঁপছিলো। চোখ ভিজে উঠলো, দু’ফোঁটা নোনা জল গড়িয়ে পড়লো গালে। তারপর কাঁপা গলায় সেও উচ্চারণ করলো,
– আলহামদুলিল্লাহ কবুল….
ঘরজুড়ে সবার মুখে তখন “আলহামদুলিল্লাহ” ধ্বনি। শুকরিয়া আদায় হলো, একে একে মিষ্টি মুখ করানো হলো সবাইকে।
কেউ খেয়াল করলো না—কোণের সোফায় বসে থাকা আসিফ নিঃশব্দে মাথা নিচু করে এক মুঠো হাসি চেপে রেখেছিলো। যেন এটাই তার কাঙ্ক্ষিত চাওয়া আজ পূরণ হওয়ার মুহূর্ত।
সকলে মিষ্টি মুখ করে নিলো। আস্তে আস্তে সকল আত্নীয় স্বজনদের খাওয়ানোর পর্ব শুরু হলো। আরাবি হায়াতের রুমে বসে আছে, আর হায়াত একে একে মিসেস সুফিয়ার দেওয়া গহনা গুলো আরাবিকে পরাচ্ছে। আরাবি একমনে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে, খানিক পর বললো,
– বুঝলি জানু……মানুষ বলে যেটা মন থেকে চাওয়া হয় সেটা নাকি সহজে পাওয়া যায় না,কিনৃতু আবার বেলায় ঠিক তার অন্যটা হলো।
হায়াত যেনো আরাবির কথা তেমন একটা বুঝলো না,তাই আনমনে সাজাতে লাগলো।
সাজানো প্রায় শেষ, এখন আরাবির দিকে হা হয়ে নুপুর, মিনহাজা, রিয়া। লাল টুকটুকে শাড়ি আর গা ভর্তি গহনাতে আরুকে বেশ আবেদনময়ী লাগছে।
সবাই মিলে আসিফের রুমে আরাবিকে বসিয়ে দিলো, আরাবি একটু ঘাবড়ে গিয়ে হায়াতের দিকে তাকালো। হায়াত আরাবিকে বুঝালে আসিফ কিছু বলবে না।
একটু পর আসিফকে নিয়ে আদিবরা আসলো, সকল মেয়েরা আসিফের দরজার সামনে দাড়ালো, আসিফ অনেকক্ষণ জোরাজুরি করার পর ১০ হাজার টাকা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো।
আরাবি চুপচাপ বসে আছে, আসিফ গিয়ে মুচকি হেসে দরজা আটকে দিল।আরাবির ঘোমটা একটু উঠিয়ে আসিফ মুচকি হেসে মনে মনে ভাবলো, কি বলে কথা শুরু করবো,সে তো এখন আমার বউ৷
গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
– ভালো আছেন মেডাম।
আরাবি চোখ বন্ধ করে বললো,
– আমি ওয়াশরুমে যাবো।
আসিফ বুঝতে পারলো আরাবি একটু ঘাবড়ে গিয়েছে, তাই মনে মনে হেসে বললে,
– হ্যা যাও। ওইযে ওইখানে।
আরাবি দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকতে গিয়ে ধপাস করে পরে গেলো শাড়ির সাথে বেজে গিয়ে।
আসিফ পেছনে তাকাতেই হা হয়ে গেলো, আরাবি ফ্লোরে হা হয়ে পড়ে আছে। অনেক কষ্টে হাসি কন্ট্রোল করে আরাবিকে ওঠে বসতে সাহায্য করলো। আরাবি লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে। আসিফ ঠোঁট কামড়ে হেসে বললো, বেশি ব্যথা পেয়েছো ?
আব্ নাহ…..
আসিফ আর কিছু না বলে আরাবিকে কোলে তুলে নিল। আরাবি যেনো আরও বেশি লজ্জা পেয়ে গেলো। আরাবিকে বিছানায় বসিয়ে আসিফ ড্রয়ার থেকে মলন এনে আরাবির পায়ে লাগিয়ে দিতে লাগলো ।
আরু একটু পর পরই পা সরিয়ে নিচ্ছে, আসিফ রাগী চোখে তাকালো।
আসিফ মলন লাগাতে লাগাতে হালকা গলায় বললো,
– তোমার কষ্ট হলে কিন্তু আমিই সবার আগে বুঝবো, মনে রাখবে, এমন করবে না ওকে ।
আরাবি মুখ লুকিয়ে ফিসফিস করে উত্তর দিলো,
– এত যত্ন নিচ্ছেন কেন?
আসিফ গম্ভীর স্বরে বললো,
– কারণ তুমি এখন শুধু আমার বউ নয়, আমার আমানতও।
ঘরটা যেন এক মুহূর্তে নরম আলোয় ভরে উঠলো। বাইরে থেকে সবার হাসি-ঠাট্টা ভেসে আসছে, কিন্তু ভেতরে দু’জনের নীরবতাই সবকিছুকে ছাপিয়ে গেলো।
আসিফ আস্তে করে আরাবির হাতের আঙুল ধরে বললো,
– ভয় পেয়ো না, আমি একদিনে সবকিছু চাই না। ধীরে ধীরে… তোমার সময় মতো…
আরাবি চোখ নিচু করে নীরব রইলো, কিন্তু ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসি ফুটে উঠলো।
এদিকে রাজ মনে মনে কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসলো, সবার উদ্দেশ্য করে বললো,
আজ রাতে ছোট খাটো চা কফি, মিষ্টি দিয়ে আড্ডা দিলে খারাপ হয় না।
হায়াত কিছু বললো না,কিন্তু সকলে রাজি হয়ে গেলো, সকলে মিলে ঠিক করলো রাত দুটোর পর পার্টি শুরু হবে।
সকলে ফ্রেশ হতে রুমে চলে গেলো।
আদিব আর হায়াত রুমে এসে বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়লো। আদিব হায়াতের ওষ্ঠে নিজের ওষ্ঠ পুড়ে নিল। মিনিট পাঁচেক পর বললো,
– বউ আজ আমার বড্ড প্রেম প্রেম পাচ্ছে।
হায়াত কপাল স্লাইড করে বললো,
– ওটা তো আপনার প্রতি ঘন্টায়ই পায়।
আদিব হেসে হায়াতকে বুকের ওপর নিয়ে বললো,
– ধুর পঁচা আমি ওটা বলিনি, আমি ভাবছিলাম চলো একটু লং ড্রাইভে যাবো।
এরপর গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পরলো দুজন, আস্তে আস্তে চলতে শুরু করলো৷ আর আদিব একটা হিন্দি গান ছেড়ে দিলো, আদিব ড্রাইভ করছে টাঙ্গাইলের রাস্তায় আর হায়াত আদিবের কাধে মাথা দিয়ে গুন গুন করছে।
গাড়ির হেডলাইটে অন্ধকার পথটা আলোকিত হয়ে উঠছে। চারদিকে টাঙ্গাইলের নির্জন রাস্তায় হালকা কুয়াশা নেমে এসেছে। জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস হায়াতের শাড়ির আচলঁ উড়িয়ে দিচ্ছে।
হায়াত মাথা গুঁজে আছে আদিবের কাঁধে, গুন গুন করে গানের সুর মিলাচ্ছে। আদিব একবারের জন্যও চোখ সরাচ্ছে না রাস্তা থেকে, তবু হাসিটা লুকাতে পারছে না।
– বউ, জানো ? এই রাত … সবকিছু একেবারে সিনেমার মতো লাগছে,মনে হচ্ছে আমার চাওয়া পাওয়া সব পূরণ হচ্ছে, আজ রাতে আমরা বেবি নেওয়ার প্রসেসিং শুরু করবো..!
হায়াত চোখ মুদে আস্তে বললো,
– হুসস, বাড়ি গিয়ে ওটা বুঝবো, এখন মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালান।
টাঙ্গাইলের গ্রামের রাত দশটা, শান্তি সবদিকেই বিরাজ করছে। খোলা আকাশে চাঁদের নরম আলো পড়ছে ধানক্ষেতের উপর, যেখানে হালকা হাওয়া দুলছে ধানের গাছেদের পাতা। দূরে কুকুরের ভৌকন আর কেউ কোথাও ধীর আওয়াজে কথা বলার শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঘরগুলোতে মৃদু আলো জ্বলছে, কেউ হয়তো রাতের খাবার খাচ্ছে, কেউ আড্ডা দিচ্ছে। বয়সী মানুষরা হয়তো বারান্দায় বসে দিনের ঘটনার গল্প করছেন, আর ছোট ছেলেমেয়েরা ঘরে খেলাধুলা শেষ করে ঘুমের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই সময় গ্রাম যেন এক শান্ত ও স্বপ্নময় আবহে ডুবে থাকে।
গাড়িটা থামলো একটা নির্জন চায়ের দোকানের সামনে। দোকানদার হাই তুলতে তুলতে গ্লাসে ধোঁয়া ওঠা চা ঢালছিলো। আদিব নেমে দু কাপ চা অর্ডার দিলো।
হায়াত গাড়ি থেকে নেমে চারপাশে তাকিয়ে হাসলো,
– আহা, রাতে গ্রামটা কি শান্ত তাইনা। কিন্তু এতো শান্ত পরিবেশ কেনো এই দিকে।
আদিব কাপ হাতে এগিয়ে এলো। দু’জন মাটির বেঞ্চে পাশাপাশি বসল। টিনের ছাউনিতে টুপ টুপ করে শিশির ঝরছে, আর দূরে জোনাকির আলো ঝিকমিক করছে। হায়াত চায়ের কাপে ফুঁ দিতে দিতে হেসে বললো,
– এই চায়ের স্বাদটা মনে হয় শহরেও রাতের বেলায় কোনোদিন পাওয়া যাবে না।
– হুম, শহরের কফিশপে লাখ টাকা বিল দিলেও এই স্বাদ আসবে না।
আদিব একটু হাসলো , আর হায়াতের কপালে আস্তে টোকা দিলো।
চা শেষ করে দু’জন নদীর ঘাটে গিয়ে দাঁড়ালো। চাঁদের আলো পানির ওপর ঝিকমিক করছে। হায়াত নিজের ওড়না দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া থেকে মুখ ঢাকলো। আদিব পাশে দাঁড়িয়ে হাতটা শক্ত করে ধরলো।
– জানো হায়াত, তোমাকে ছাড়া এই দৃশ্যটা কেমন যেনো ফাঁকা লাগতো। ফ্রেন্ডদের সাথে আসলেও এতো ভালো লাগতো না।
আমার হায়াতি পর্ব ৩১
– ফাঁকা তো হবেই… আমি ছাড়া তো আপনার জীবনটাই ফাঁকা।
দু’জন হেসে উঠলো। তারপর নিস্তব্ধ রাতের মাঝে শুধু নদীর ঢেউ আর তাদের হাসির শব্দ ভেসে বেড়াতে লাগলো। আদিব আস্তে আস্তে হায়াতের দিকে ঝুঁকে পরলো, ছোট ছোট করে অসংখ্য চুমু খেলো হায়াতের সারা মুখে। হায়াতও আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো।
প্রায় মিনিট পাঁচেক পর হায়াত আর আদিব ওঠে পরলো নদীর পার থেকে। এরপর গাড়িতে ওঠে পরলো দুজন। হায়াত আর আদিব আস্তে ধীরে গাড়িটি চলতে থাকলো।
