আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব ১৭
ইয়াসমিন খন্দকার
আয়ুশের বদলে যাওয়া ব্যবহার ঈশিতাকে অবাক করেছে। সে বারবার গেছে আয়ুশের সাথে কথা বলার জন্য কিন্তু আয়ুশ তাকে ফিরিয়ে দেয়। ঈশিতা বুঝে উঠতে পারে না কি তার সমস্যা কেন সে এমন অবহেলা করছে। তবে ঈশিতা ঠিক করে নিয়েছে সে যে করেই হোক আবার আয়ুশের মন জয় করবেই। এটা যতই কঠিন কাজ হোক সে করবেই। ঈশিতার এমন ভাবনা থেকেই সিদ্ধান্ত নিলো আজ সে বাড়ির সবার জন্য রান্না করবে। এতে শুধু আয়ুশ নয় বাকি সবার মন জয় করতে পারবে।
যেই ভাবা সেই কাজ। এই ভাবনা থেকেই আয়ুশ সহ পরিবারের সবার জন্য রান্না করতে লাগল ঈশিতা। বিভিন্ন রকম রান্না করলো একা হাতে। ঈশিতা ভাবলো এই রান্না দিয়েই সবার মন জয় করা সম্ভব।
তবে সে হোচট খেলো যখন এত কষ্ট করে রান্না শেষে সে সবাইকে পরিবেশন করতে গেলো। আলতাফ তালুকদার তো ঈশিতাকে দেখেই রেগে গেলেন। জাহানারা বেগমকে রাগ দেখিয়ে বললেন,”এসব রান্না কি এই মেয়েটা করেছে?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জাহানারা বেগম মাথা নাড়ালেন। আলতাফ তালুকদার রেগে বলেন,”তোমার সাহস কি করে হয় এমনটা করার? কি করে ভাবলে তুমি যে তোমার রান্না করা খাবার আমরা খাবো? আমরা কেউ এই খাবার স্পর্শ করবো না।”
গুলশেনারা বেগম বলেন,”খাবারের উপর এভাবে রাগ দেখাতে নেই আলতাফ। আল্লাহ নারাজ হন।”
“তুমি যাই বলো না কেন আম্মা, আমি এই মেয়ের হাতের পানিও স্পর্শ করব না।”
বলেই আলতাফ তালুকদার উঠে চলে যান। ঈশিতার দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে নোনাজল। গুলশেনারা বেগম রাগ করে বলেন,”এই মেয়ে তুমি রান্না করতে গেলে কেন? তোমার জন্য আমার ছেলেটা না খেয়ে রইলো। কিন্তু আমি তো আর অন্ন নষ্ট করতে পারবো না। এই ঐশী চল আমরা অল্প খেয়ে উঠে পড়ি।”
ঐশী মাথা নাড়ালো। দুজনে অল্প পরিমাণে খেয়ে উঠে পড়লো। সবার এমন ব্যবহার একদম আশা করে নি ঈশিতা। সে ভেবেছিল তার প্রথম বার রান্না সবাই বেশ আয়েস করে খাবে। কিন্তু সবার থেকে যা ব্যবহার পেল তা অবিশ্বাস্য। জাহানারা বেগম এসে ঈশিতাকে শান্তনা দিয়ে বললেন,”তুমি একদম চিন্তা করো না। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে দেখো। সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর যাইহোক না কেন, আয়ুশ তো আজ তোমার রান্না খেয়ে ভীষণ খুশি হবে দেখে নিও। আয়ুশের সব রাগ জল হবে। পরিবারের বাকি সবাই একটু বেশিই রেগে আছে তাই হয়তো সময় লাগবে কিন্তু আয়ুশ আজই একদম আবার আগের মতো তোমায় কাছে টেনে নেবে। এটা আমার বিশ্বাস।”
শাশুড়ীর কথায় ভীষণ ভরসা পেল ঈশিতা। তার মনে হলো এবার বুঝি সব ঠিক হয়ে যাবে। আয়ুশ তো প্রায়ই বলত, ঈশিতার সাথে একটা সুখের সংসার সাজাতে চায়। এবার ঈশিতা নিজে থেকে এত কিছু করছে জানলে তার থেকে খুশি আর কেউ হবে না।
ঈশিতার বাকি দিন গুলো চলে গেলো আয়ুশের অপেক্ষায়। এজন্য সে নিজেও না খেয়ে রইলো। উদ্দ্যেশ্য, আয়ুশ ফিরলে সব মান অভিমান মুছে দুজনে মিলে একসাথে খাবে। জাহানারা বেগমও ঈশিতার এই সিদ্ধান্তে বড্ড খুশি। খুশির জোয়ার বইছে তার মনের মাঝে।
তিনি তো সবসময় এটাই চেয়েছিলেন যে ঈশিতা এবার সংসারী হোক। তাদের মাঝে সব সমস্যা মিটে যাক।
যাইহোক, দুপুরে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরলো আয়ুশ। আয়ুশ কলিং বেল চাপতেই ঈশিতা গিয়ে নিজে দরজা খুলে তাকে হাসি মুখ উপহার দিলো। কিন্তু আয়ুশ তাকিয়ে রইল থমথমে গম্ভীর মুখে। ঈশিতার এটা ভালো লাগল না। তার সমস্ত খুশিও যেন মিলিয়ে গেল। আয়ুশ ঈশিতাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকলো। আয়ুশ সামনে এগোতে নিতেই ঈশিতা সাহস করে বলল,”আমি আজ নিজের হাতে আপনার জন্য অনেক কিছু রান্না করেছি। আপনি খাবেন তো?”
আয়ুশ ঈশিতার কথা শুনে দাঁড়িয়ে পড়লো। ঈশিতার মনে আশার সঞ্চার হলো। সে খুব সুন্দর করে থালায় খাবার বাড়ল আয়ুশের জন্য। অতঃপর তার দিকে খাবার বাড়িয়ে দিয়ে বললো,”এই নিন, খান।”
আয়ুশ কিছুক্ষণ চুপ করে দেখলো। তারপর এমন এক কাণ্ড করে বসলো যা ঈশিতা কল্পনাতেও আনে নি। এক মুহুর্তে সব খাবার ছুড়ে মারলো দূরে। চিৎকার করে বললো,”কোন সাহসে তুমি আমার জন্য খাবার করেছ? কি ভেবেছ টা কি তুমি? তোমার মতো দুশ্চরিত্রা মেয়ের হাতের রান্না আমি খাবো?”
ঈশিতা হতবাক হয়ে বললো,”আয়ুশ! এসব কি বলছেন আপনি? আমি দুশ্চরিত্রা!”
জাহানারা বেগম, আলতাফ তালুকদার, গুলশেনারা বেগম, ঐশী সবাই ছুটে এলো আয়ুশের চিৎকার শুনেই। জাহানারা বেগম এসে বললেন,”কি হয়েছে আয়ুশ? এভাবে চেচাচ্ছিস কেন?”
“চেচাব না তো কি? এই মেয়েটার এত অডাসিটি হয় কিভাবে? আমার জন্য কেন রান্না করেছ ও?”
” ও তোর স্ত্রী আয়ুশ।”
“কিসের স্ত্রী? যেই মেয়ে বিদেশে গিয়ে আমার অলক্ষ্যে অন্য ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়ায় তাকে আমি স্ত্রীর মর্যাদা দেব?”
ঈশিতার চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু পড়ছে। সে অবিশ্বাস্যের কণ্ঠে বলে,”আমার নামে এসব বাজে কথা বলা বন্ধ করুন। কিসের ভিত্তিতে এসব বলছেন আপনি?”
আয়ুশ ভীষণ ক্ষেপে আছে।
“আমি চাই নি সবাইকে এসব দেখাতে কিন্তু তোমার এই অভিনয় দেখে আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না।”
বলেই সে সবাইকে তামিম ও ঈশিতার কিছু ছবি আর সাথে সেই ড্রামার ভিডিওটাও দেখায়। এটা দেখে ঈশিতা স্তব্ধ। জাহানারা বেগম বলেন,”ছি ঈশিতা ছি! আমি কত বিশ্বাস করেছিলাম তোমায় আর তুমি সেই বিশ্বাসের এই প্রতিদান দিলে?”
আলতাফ তালুকদার বলেন,”দেখলে তো জাহানারা এই জন্য আমি শুরু থেকে এই মেয়েকে পছন্দ করি না। তোমরা মা-ছেলে তো এই মেয়েকে নিয়ে অনেক আদিখ্যেতা দেখিয়েছ। এবার বোঝো তার ফল।”
ঐশী বলে,”বিদেশে যাওয়ার আগে তো খুব বড় বড় কথা বলেছিলে যে, তোমার চরিত্র হেফাজতে রাখার দায়িত্ব তোমার। এই তার নমুনা?”
গুলশেনারা বেগম রেগে বোম। তিনি বলেন,”আয়ুশ তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এক্ষুনি এই পাপটাকে এই বাড়ি থেকে দূর কর। ওর ত্রীসীমানায় থাকতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে। এইজন্য বলছিলাম বউকে বিদেশে না পাঠাতে। এবার দেখেছিস তো এর পরিণাম।”
ঈশিতা সবার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আপনারা বিশ্বাস করুন..এই সব কিছু মিথ্যা। আমার আর তামিম ভাইয়ের মধ্যে এমন কিছু নেই।”
আয়ুশ ঈশিতাকে শক্ত করে ধরে বলে,”একদম মিথ্যা কথা বলবে না। আমি তোমার লেখা ডায়েরি পড়েছি। তুমি সেখানে লিখেছ তুমি তামিমকে পছন্দ করো।”
“হ্যাঁ, করতাম পছন্দ। কিন্তু সেটা বিয়ের আগে। বিয়ের পরে আমি ওনাকে সেই নজরে আর দেখিনা।”
“একটার পর একটা মিথ্যে, একটার পর একটা মিথ্যে শুধু বলেই যাচ্ছ।”
ঈশিতা জাহানারা বেগমের সামনে গিয়ে বলে,”মা, আপনি অন্তত আমায় বিশ্বাস করুন।”
জাহানারা বেগম একটা অবিশ্বাস্য কাহিনি করে বসেন। ঠাস করে থাপ্পড় মারেন ঈশিতাকে। আর বলেন,”তোমাকে বিশ্বাস করাই আমার জীবনের সবথেকে বড় ভুল। দূরে যাও আমার থেকে। আমার ঘৃণা হচ্ছে তোমায় দেখে।”
“মা, আপনিও?”
“খবরদার আমায় মা বলে ডাকবেনা। আয়ুশ, তোকে এই দুশ্চরিত্রা মেয়ের সাথে সংসার করতে হবে না। তুই একে ডিভোর্স দে।”
আয়ুশ এসে ঈশিতার হাত শক্ত করে ধরে বলে,”হ্যাঁ, মা। এবার তাই করবো।”
ঈশিতা হাত ঝটকা দিয়ে সরিয়ে বলে,”আমি আপনাকে ডিভোর্স দিবো না। আমাকে একটা সুযোগ দিন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার।”
আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব ১৬
“আর কত সুযোগ দেব তোমায়? ৫ বছর যথেষ্ট সুযোগ দিয়েছি আমার জীবন নষ্ট করার আর নয়।”
“আমাকে শুধু ৭২ ঘন্টা সময় দিন। এই ৭২ ঘন্টার মধ্যে আমি প্রমাণ করে ছাড়বো আমি কোন অন্যায় করিনি। এটা ঈশিতার চ্যালেঞ্জ।”