আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব ১৯
ইয়াসমিন খন্দকার
ঈশিতা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার সামনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে। ইনি আর কেউ নন তোফায়েল আহমেদ। তামিমের মামা এবং টিনার বাবা। তাকে দেখামাত্রই ঈশিতা তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,”আঙ্কেল আপনি?”
“হ্যাঁ, আমি। কিছু জরুরি কাজে দেশে এসেছিলাম। ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করে যাই। কিন্তু এখানে এসে যা শুনলাম…”
ঈশিতা বললো,”আমি আপনাকে অনেকবার কল দিয়েছিলাম আঙ্কেল। ম্যাসেজও করেছি।”
“হ্যাঁ, দেখেছি। আসলে আমি একটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছিলাম। ফোনেও নেটওয়ার্ক ছিল না। তাই এতদিন তোমার ম্যাসেজ বা কল আমার নজরে আসে নি। কিন্তু যখনই আমি তোমার ম্যাসেজটা দেখেছি তখনই ছুটে এসেছি। আমি ভাবতেও পারছি না,আমার মেয়ে টিনা কিভাবে এমন করতে পারলো। ও কিভাবে ফাসালো তোমায়?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আয়ুশ অবাক। কি বলছেন এই লোক? জাহানারা বেগম আয়ুশের উদ্দ্যেশ্যে বললেন,”তোফায়েল আহমেদ আমাদের আসল সত্যিটা বলেছেন। তোকে যেই ভিডিওটা টিনা পাঠিয়েছে সেটা কোন আসল ভিডিও নয়৷ সেটা একটা ড্রামা ছিল যেখানে তামিম ও ঈশিতা অভিনয় করেছিল। আর ছবিগুলোও অধিকাংশ এডিট করা। ওনার স্ত্রী ওনার মেয়ের মুখ থেকে সব সত্য বের করে এনেছেন।”
আয়ুশের অবাক হওয়ার পাল্লা বাড়লো। তোফায়েল আহমেদ ফোন দিলেন তার স্ত্রীকে। তার স্ত্রী ফোন রিসিভ করেই স্বীয় কন্যা টিনাকে বললেন,”তোর সব অপকর্ম সবার সামনে স্বীকার কর। আজ শুধুমাত্র তোর জন্য একটা মেয়ের সংসার ভেঙে যেতে বসেছে।”
টিনা কাঁদতে কাঁদতে বলল,”হ্যাঁ, আমিই সব করেছি। সব নাটক আমি সাজিয়েছি। সবকিছুই আমার কারসাজি। তামিম ব্রো ও ঈশিতার মাঝে এমন কোন সম্পর্ক নেই।”
ঈশিতা রেগে বললো,”তুমি আমার সাথে এমন কেন করলে টিনা? কি শত্রুতা ছিল আমার সাথে তোমার?”
টিনা মনে মনে ভাবলো,”যদি এখন আমি সবাইকে তামিম ব্রোর কথাটা বলে দেই তাহলে তামিম ব্রো কখনো নাহিদকে পেতে আমায় সাহায্য করবে না। এজন্য আমায় এখন সত্যটা গোপন রাখতেই হবে। অন্য কিছু একটা বলতে হবে।”
এই ভাবনা থেকেই টিনা বললো,”আমার ঈশিতাকে খুব হিংসা হতো। ও আমাদের সম্পর্কে কেউ না হয়েও আমার মা-বাবার এত প্রিয় ছিল, মা-বাবাও ওর সাথে আমার তুলনা টানত কারণ ওর মেডিকেলের রেজাল্ট আমার থেকে অনেক ভালো। এছাড়া ঈশিতা দেখতেও আমার থেকে অনেক সুন্দরী। এসব নিয়েই ওর প্রতি আমার রাগ ছিল।”
টিনার কোন কথাই যুক্তিযুক্ত লাগলো না আয়ুশ বা ঈশিতা কারো কাছেই। আয়ুশ ধমকে বলে উঠলো,”আমার মনে হয় আপনি কিছু লুকাতে চাইছেন। শুধুমাত্র এই সব সাধারণ কারণে আপনি কেন ঈশিতার সাথে আমার সম্পর্ক ভাঙতে চাইবেন। নিশ্চয়ই এর পেছনে কোন বড় কারণ আছে। সত্যটা বলুন।”
ঈশিতাও বললো,”হ্যাঁ, তুমি ভুল বলছ টিনা। আমার কাছেও এটা বিশ্বাসযোগ্য না।”
“এর পেছনে তামিমের হাত নেই তো?”
আয়ুশের প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় টিনা। বলে ওঠে,”না, না, তামিম ব্রোর কোন হাত নেই এখানে। তামিম ভাই তো জানেও না আমার এসব চক্রান্তের ব্যাপারে।”
ঈশিতাও বলে,”হ্যাঁ, তামিম ভাইয়া এমন মানুষ নয়। উনি আমাকে নিজেদের বোনের মতো দেখেন। উনি কত সাহায্য করেছেন আমায়। উনি এতোটা নিচে নামতে পারেন না। আমার মনে হয় অন্য কোন কারণ আছে যেটা টিনা বলতে চাইছে না।”
তোফায়েল আহমেদ বলেন,”এই টিনা তুই আসল সত্যিটা বল?”
টিনার কাছে এখন আর কোন উপায় ছিল না। তাই সে বানিয়ে বলতে থাকে,”ঈশিতা যখন প্রথম আমায় মিস্টার আয়ুশের ছবি দেখায় তখন আমি ওনার ছবি দেখেই ওনাকে পছন্দ করে ফেলি। ওদের এত মাখো মাখো প্রেম তাই আমার সহ্য হতো না। আমার উদ্দ্যেশ্য ছিল,এভাবে ওদের সংসারটা ভেঙে তারপর আয়ুশের খারাপ সময়ে ওর পাশে থেকে ওর মনে জায়গা করে নেওয়া।”
টিনার মা তাকে ঠাস করে একটা থাপ্প*ড় দিয়ে বলে,”ছি! তুই এত নিচ।”
টিনার কাঁদতে কাঁদতে হেচকি উঠে যায়। তোফায়েল আহমেদ বলেন,”আমার তরফ থেকেও ওকে একটা থা*প্পড় দাও। আর বাকিটা আমি লন্ডনে ফিরে গিয়ে দেখছি।”
বলেই তিনি ফোন রেখে দেন।
জাহানারা বেগম ঈশিতার কাছে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,”আমি তোমার কাছে হাত জোর করে ক্ষমা চাইছি ঈশিতা। আমাদের তোমাকে এভাবে ভুল বোঝা উচিৎ হয়নি। আমাদের সবটা যাচাই করা উচিৎ ছিল। তুমি প্লিজ এসব মনে রেখো না”
ঈশিতা জাহানারা বেগমের হাত ধরে বলে,”ছি! ছি! মা, এসব আপনি কি বলছেন? আমি আপনাকে কোন দোষ দেব না। যেখানে আসল মানুষটাই আমাকে বিশ্বাস করেনি সেখানে আপনার কি দোষ?”
কথাটা অভিমানী সুরে আয়ুশের উদ্দ্যেশ্যেই বললো। আয়ুশ তখনো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। জাহানারা বেগম বুঝলেন এখন দুজনকে একটু স্পেস দেওয়া উচিৎ। তাই তিনি তোফায়েল আহমেদকে বললেন,”ভাইয়া, আপনি আসুন। আজ লাঞ্চটা আমাদের এখানেই করুন।”
তোফায়েল আহমেদ ভদ্রতাসূচক হেসে ঈশিতার উদ্দ্যেশ্যে বললেন,”টিনা তোমার সাথে যা যা করেছে সবকিছুর জন্য আমি হাতজোড় করে ক্ষমা যাচ্ছি।”
ঈশিতা বলে উঠলো,”ছি! ছি! আঙ্কেল। আপনি কেন ক্ষমা চাচ্ছেন? আমার তো আপনাকে ধন্যবাদ জানানো উচিত। আপনি আমার জন্য তো কম করেন নি। আজ আমি আপনার জন্যই নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করতে পারলাম। নাহলে তো আমার সংসারটাই ভেঙে যেতে বসেছিল।”
আলতাফ তালুকদার, গুলশেনারা বেগম, ঐশী সবাই একদম চুপ হয়ে গেছে। সব সত্যটা জানার পর তারা নিজেদের কাছেই ছোট হয়ে গেছে। ঐশী সবার উদ্দ্যেশ্যেই বললো,”আমাদের সবার উচিৎ ঈশিতার কাছে ক্ষমা চাওয়া। বিনা অপরাধে ওকে আমরা কোন কিছু যাচাই না করেই কত কথা শুনিয়েছি।”
আলতাফ তালুকদার বলেন,”আমাদের কি দোষ ছিল? সব প্রমাণ তো ওর বিরুদ্ধে ছিল।”
গুলশেনারা বেগমও ঐশীর সুরেই বলেন,”ও ঠিকই বলেছে আলতাফ। যাই হোক না কেন,আমরা অন্যায় করেছি। আর ক্ষমা চাইলে কেউ ছোট হয় না।”
ঐশীর ভীষণ খারাপ লাগছিল। ভীষণ অপরাধভোগে ভুগছিল ঈশিতাকে এত জঘন্য কথা বলার জন্য। নিজের কাছে আজ সে নিজে ভীষণ ছোট হয়ে গেছে।
ঈশিতা চুপচাপ বসে আছে বিছানায়। আয়ুশ কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছে না। আজ ঈশিতার কাছে অনেক ছোট হয়ে গেছে সে। আগে কখনো কারো কাছে এত ছোট হতে হয়নি।
দীর্ঘ সময় চুপ থেকে আয়ুশ ঈশিতার কাছে এসে বলে,”আমি সব কিছুর জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি ঈশিতা।”
“ক্ষমা চেয়ে কি হবে? আমাকে যে অপমান করেছেন..এই ৩ দিন আমার উপর দিয়ে যে ঝড় গেল তা কি ফিরে আসবে?”
“ঈশিতা…”
“ব্যস, অনেক হয়েছে। একটা সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশ্বাসটাই বড়। বলা যায়, বিশ্বাসই সম্পর্কের ভীত। সে ভীত নড়বড়ে হলে সম্পর্ক ঠিক থাকে না। আপনি যদি আমার উপর বিশ্বাসই রাখতে না পারেন তাহলে আমি কিসের ভিত্তিতে এই সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখব?”
আয়ুশ নিশ্চুপ। ঈশিতা বলে,”কিন্তু আমি এই সম্পর্কটা ভাঙতে চাই না। আমি চাই,আপনার সাথে সংসার করতে। কিন্তু এত কিছুর পর এত সহজে আপনার সাথে মানিয়ে নিতে পারব না। তাই, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি..”
“কি সিদ্ধান্ত?”
আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব ১৮
“মানিয়ে নেয়ার জন্য সময় লাগবে। একটু সময় দেবেন আমাকে?”
“পাঁচ বছর কি কম ছিল যে তোমার আরো সময় চাই?”
“বেশ, তাহলে আর সময় দিতে হবে না। আজ থেকে আপনি আমার উপর স্বামীর অধিকার স্থাপন করতে পারেন।”
আয়ুশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,”এটা সঠিক সময় নয়। আমি তোমাকে ২ দিন আরো সময় দিলাম। আমি চাই সব ভুলে আবার নতুন করে শুরু করতে।”