আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব ২২
ইয়াসমিন খন্দকার
তালুকদার বাড়িতে যেন আজ লঙ্কাকাণ্ড শুরু হয়ে গেছে। জাহানারা বেগম কিছুতেই তার ভাই-ভাবির অপমান মানতে পারছেন না। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে তিনি ঐশীকে নিয়ে নানা অশ্রাব্য কথা বলতে লাগলেন। গুলশেনারা বেগম এসব সইতে না পেরে বললেন,”দোহাই লাগে বৌমা, তুমি এবার চুপ যাও। বাপ-মা হারা এতিম পঙ্গু মেয়েটা এমনিতেই ছোটবেলা থেকে অনেক কষ্ট সহ্য করে বড় হয়েছে। কখনো মা-বাবার ভালোবাসা পায়নি, আলতাফ নিজের কাজে ব্যস্ত আর তুমি শুধু ওকে দায়িত্ব ভেবে যা করার করেছ। আজ মেয়েটা এত খোটা দিচ্ছ কেন? কি করেছে ও? তোমার ভাই-ভাবিকে ধাক্কা দিয়ে তো বের করেনি। শুধু বলেছে সে তাদের ছেলেকে বিয়ে করতে পারবে না। এটা কি আমার নাতনীর অনেক বড় দোষ হয়ে গেছে?”
“আপনি তো নিজের নাতনির দোষ দেখবেন না। সব দোষ তো আমারই এখন।”
আলতাফ তালুকদার রাগী সুরে বলেন,”আহ, জাহানারা। এসব ঝামেলা বন্ধ করো এবার। যা হবার হয়ে গেছে।”
আয়ুশও নিজের বাবার তালে তাল মিলিয়ে বলে,”হ্যাঁ, মা। বাবা ঠিকই বলছে। তুমি আর এসব নিয়ে ঝামেলা করো না প্লিজ। ঐশীর ইচ্ছে হয়নি ঐশী বিয়েটা করে নি। এ নিয়ে এত কথা হচ্ছে কেন?”
জাহানারা বেগম আজ নিজের মধ্যে নেই। তিনি বলে ওঠেন,”ঐ কালনাগিনী মেয়ের বিয়ে করার ইচ্ছা হবে কেন? ওর নজর তো পড়েছে আমার ছেলের উপর। তোর আর ঈশিতার সংসার নষ্ট করার জন্য এ বাড়িতে পড়ে আছে।”
“বড় আম্মু!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ড্রয়িংরুমে এসে নিজের নামে এসব কথা শুনে ঐশী স্তব্ধ হয়ে যায়। জাহানারা বেগমের মনে এত বিষ তাকে নিয়ে। এদিকে ঐশীকে দেখে জাহানারা বেগমের রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। তখনকার দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠল। আরো বড় একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললেন তিনি। রাগের মাথায় ঐশীর কাছে গিয়ে ঠাটিয়ে চ*ড় মা**রেন ঐশীকে। জাহানারা বেগমের এই কাণ্ডে সবাই হতবিহ্বল। তবু তিনি থামবার পাত্র নন। ঐশীর চুলের মুঠি ধরে বলেন,”ডাই**নি একটা। তুই জন্ম নেবার পর থেকে আমাদের সংসারে একটার পর একটা অশান্তি হয়েছে। তুই আমাদের সাজানো গোছানো সংসারটা শেষ করে দিয়েছিস। নিজের বাবা-মাকে খেয়ে তোর শান্তি হয়নি এখন আমাদের সবার মাথা খেতে চাস।”
ঐশীর চোখ দিয়ে ছপছপ করে জল পড়ছিল। ঈশিতা আর আয়ুশ এসে ঐশীকে তার থেকে রক্ষা করে। আলতাফ তালুকদার আর নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারেন না। সবার সামনে জাহানারা বেগমের গায়ে হাত তোলেন। ৩৫ বছরের সংসার জীবনে এই প্রথম তিনি নিজের স্ত্রীর গায়ে হাত তুললেন। হুংকার দিয়ে বললেন,”মুখ সামলে কথা বলো জাহানারা। তুমি ভুলে যেও না এই বাড়িটা আমার। আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমার ভাইয়ের মেয়ের ব্যাপারে তুমি কোন সাহসে এমন জঘন্য কথা বলছ?”
জাহানারা বেগমের মাথা এমনিই ঠিক ছিল না। ছেলের সামনে স্বামীর হাতে মা*র খেয়ে আর তিনি নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। চেচিয়ে বলে উঠলেন,”হ্যাঁ, এখন তো তুমি আমার গায়েই হাত তুলবে। সত্য কথা বলে ফেলেছি যে। এতদিন চুপ ছিলাম তাই ভালো ছিলাম, আজ মুখ খুলতেই আমি খারাপ। ঠিক আছে, তুমি থাকো নিজের ভাইয়ের মেয়েকে নিয়ে। আজ আমার গায়ে হাত তুলে তো তুমি প্রমাণ করে দিলে যে আমার থেকে ঐশীর মূল্য তোমার কাছে বেশি। আমি আর থাকবো না তোমার সংসারে।”
বলেই তিনি দৌড়ে নিজের রুমের দিকে গেলেন। জামা-কাপড় গুছিয়ে বাইরে চলে এলেন। তাকে দেখেই ঈশিতা ছুটে গিয়ে বললেন,”এসব আপনি কি শুরু করে দিয়েছেন মা? এসবের মানে হয় কোন?”
“যেই সংসারে আমার কোন মূল্য নেই সেখানে আমি থাকবো না। তুমি আমার ছেলেটাকে দেখে রেখো ঈশিতা, ঐ কালনাগিনী যেন আমার ছেলের কাছে ঘেষতে না পারে।”
বলেই তিনি হনহন করে বেরিয়ে যেতে লাগলেন। গুলশেনারা বেগম তার পথ আটকে বললেন,”এসব কি ছেলেমানুষি শুরু করে দিয়েছ বৌমা? এই বয়সে এসে তুমি কিনা সংসার ত্যাগ করবে? এসব তোমায় মানায় না। এই সংসার তো তোমারই।”
“সেটা আপনার ছেলে আজ বেশ ভালো ভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছে আম্মা। আর আপনি এখন আমায় আটকাচ্ছেন কেন? যখন আপনার ছেলে আমার গায়ে হাত তুলল তখন তো প্রতিবাদ করলেন না।”
আয়ুশ এগিয়ে এসে রাগী কন্ঠে বললো,”এটা কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে মা। একটা সামান্য বিষয়কে কেন্দ্র করে এসব কি শুরু করে দিয়েছ তোমরা?”
“এসব তোর কাছে সামান্য বিষয় মনে হয়? এই মেয়েটার জন্য তোর বাবা আমার গায়ে হাত তুলেছে। বিবাহিত জীবনে এর আগে কোনদিন সে এমনটা করে নি।”
ঐশী এবার এগিয়ে এসে বললো,”তোমার কোথাও যাওয়ার দরকার নেই বড় আম্মু। আমাকে নিয়েই তো যত সমস্যা, আমিই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।”
গুলশেনারা বেগম বললেন,”এসব কি বলছিস তুই? এবাড়ি ছেড়ে কোথায় যাবি তুই?”
আলতাফ তালুকদার হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন,”ঐশীকে কোথাও যেতে হবে না। জাহানারা তোমার যদি ইচ্ছা হয় তাহলে তুমি এখনই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাও। আমার পূর্ণ অনুমতি আছে। আর কেউ ওকে আটকাবে না এটা আমার নির্দেষ।”
জাহানারা বেগম ব্যথিত হলেন। গুলশেনারা বেগম বলে উঠলেন,”এসব তুই কি বলছিস আলতাফ? রাগের মাথায় এমন আজেবাজে কথা বলিস না। এতে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হবে।”
“আমি যা বলছি একদম ভেবে চিন্তেই বলছি আম্মা।”
জাহানারা বেগম আর দাঁড়ালেন না। ব্যাগপত্র সব কিছু নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। আয়ুশ হতাশ চোখে সবটা দেখলো। একে একে সবাই স্থান ত্যাগ করলো। আলতাফ তালুকদার নিজের রুমের দিকে গেলেন এবং গুলশেনারা বেগম গেলেন তাকে বোঝাতে। আয়ুশ বাড়ি থেকে বের হয়ে নিজের মায়ের পেছনে গেল তাকে বোঝাতে। দাঁড়িয়ে রইলো একা ঐশী আর ঈশিতা।
ঈশিতা ঐশীর কাছে এসে বলে,”এবার তুমি শান্তি পেয়েছ তো?”
ঐশী হতাশ সুরে বলে,”মানে?! আমি কেন এসবে শান্তি পাবো?”
“এটাই তো চেয়েছিলে তুমি যে, বাড়িতে একটা অশান্তি হোক। নাহলে তুমি নাহিদ ভাইয়ার পরিবারের লোকের সাথে এমন ব্যবহার করলে? তুমি কি বুঝতে পারো নি এর ফলে এমন কিছু হবে? নিজের পরিবারের সম্মানের কথা তো একবার ভাবতে।”
ঐশী বলে উঠল,”তুমি নিজেও তো পরিবারের সম্মানের কথা না ভেবে বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে গেছিলে। আর এখন তুমি আমায় জ্ঞান দিচ্ছ?”
ঈশিতা একটু থেমে বলে,”আমার পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল।”
“পরিস্থিতি ভিন্ন বলে কিছু হয়না ঈশিতা। নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কোন কিছু মেনে নেওয়া যায় না। তুমি পেরেছিলে আয়ুশ ভাইয়াকে সহজে মেনে নিতে?”
ঈশিতা আবারো চুপ। ঐশী মলিন হেসে বলে,”যদি মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কোন কিছু মানার ক্ষমতা আমাদের থাকতো তাহলে জীবনটা অনেক সহজ হয়ে যেত৷ তবে এমনটা হবার নয়।”
ঈশিতা এবার একটু নরম সুরে বলে,”কিন্তু এখন সবটা তোমার হাতে আছে। তুমি দয়া করে এই বিয়েতে রাজি হয়ে যাও। তাহলেই দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। তাহলে মাও আবার বাড়িতে ফিরে আসবে।”
“আমি কোন পুতুল নই ঐশী, আমি একজন রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। আমার উপর এভাবে জোর করে কিছু চাপিয়ে দেয়া যাবে না।”
আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব ২১
“নাহিদ ভাইয়া ছেলে হিসেবে খারাপ নয়। ও তোমাকে অনেক ভালোবাসে। অনেক বছর থেকে। তোমাকে ছাড়া সে বাঁচবে না।”
“ভালোবাসলেই যে তাকে পেতে হবে এমন কোন কথা নেই। আমিও তো একজনকে ভালোবেসে তাকে পাইনি। তো, আমি কি মরে গেছি? বাস্তবতা এমনই ঈশিতা। তুমি প্লিজ আমাকে আর এনিয়ে কিছু বলো না। প্রয়োজনে আমি এই বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়ে হলেও বড় আম্মুকে ফিরিয়ে আনব। কিন্তু নাহিদকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না।”
বলেই ঐশী ক্রাচে ভড় দিয়ে স্থান ত্যাগ করে।