আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব ২৫
ইয়াসমিন খন্দকার
ঈশিতা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আয়ুশের পানে। সবাই যখন তাকে নিয়ে নানারকম নোংরা কথা বলছে আয়ুশ তখন একদম চুপ। ইতিমধ্যেই জাহানারা বেগম, আলতাফ তালুকদারও সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। জাহানারা বেগমও ঈশিতার দিকে ঘৃণাভরা চোখে তাকিয়ে। ঈশিতা আয়ুশের কাছে গিয়ে বলে,”আপনি আমায় বিশ্বাস করুন প্লিজ। এর আগেও তো আমাকে একবার ফাসানো হয়েছিল৷ এবারও হয়তো…”
তখনই তামিম বলে ওঠে,”তুমি আবারও আগের মতো নাটক কেন করছ জান? এর আগে তো আমি মামাকে দিয়ে মিথ্যা নাটক করে সব ম্যানেজ করলাম। কারণ তোমার নাকি এই পরিবার থেকে সাহায্য দরকার। সেটা নিশ্চয়ই পেয়ে গেছ। তাহলে এখন এসব নাটক কিসের?”
“এইসব মিথ্যা।”
তামিম বলে,”এখনই প্রমাণ হবে মিথ্যা না সত্য।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বলেই সে নিজের মামাকে কল করে। তিনি ফোনটা রিসিভ করতেই তামিম লাউড স্পিকারে দেয়। তিনি বলেন,”কি ব্যাপার ভাতিজা এতদিন পর আবার কল দিলে কেন? সেদিন তো তোমার কথায় আমি তালুকদার পরিবারের সামনে গিয়ে মিথ্যা অভিনয় করলাম। আর কিন্তু এসব করতে পারবো না। আমার বয়স হয়েছে..এখন কোথায় একটু ধর্মকর্মে মন দেব তা না তোমার আর ঈশিতার পাল্লায় পড়ে এসব করতে হচ্ছে। তুমি ঈশিতাকে বলো তো তাড়াতাড়ি ডিভোর্স নিয়ে চলে আসতে। তাহলে আর এসব অভিনয়ের প্রয়োজন হবে না।”
ঈশিতা ফোন কেড়ে নিয়ে চেচিয়ে বলল,”এসব কি বলছেন আপনি আঙ্কেল?”
“যা সত্যি তাই তো বলছি ঈশিতা মা। তুমি এত রিয়্যাক্ট করছ কেন?”
জাহানারা বেগম এগিয়ে এসে ঈশিতাকে ঠাটিয়ে চ’ড় মে*রে বলেন,”শয়তান মেয়ে…তোকে বিশ্বাস করে আমরা আবারো ঠকলাম। তুই প্রমাণ করে দিলি কতটা নিচ তুই। আমার ছেলে তোর জন্য এত কিছু করল আর তুই ওকে এত বাজেভাবে ঠকালি। তোর কোনদিনও ভালো হবে না।”
ঈশিতা আয়ুশের কাছে যায়। তার হাত বলে,”এই দুনিয়ার সবাই আমাকে অবিশ্বাস করুক, আমার কিছু যায় আসে না৷ শুধু আপনি আমায় বিশ্বাস করুন।”
আয়ুশ ঈশিতার থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,”অনেক হয়েছে আর না। বারবার আমি তোমায় বিশ্বাস করে এভাবে ঠকতে পারব না। আমিও একটা মানুষ ঈশিতা..আমারো আবেগ, অনুভূতি বলে কিছু আছে। আমার সহ্যসীমা পার হয়ে গেছে সবকিছু। তুমি আমার সাথে আর এমন করো না। তুমি যদি আমার কাছে সুখ না পাও তাহলে যাও তামিমের কাছে। ওর কাছে গিয়ে সুখের সন্ধান করো। আমাকে আর দ্বিধায় রেখো না। আমি তোমার দ্বিধায় আর বাঁচতে পারবো না, বাঁচতে চাইওনা। আমার মুক্তি দরকার এসব থেকে মুক্তি।”
বলেই হনহন করে সেই স্থান ত্যাগ করে। ঈশিতা অনেক অনুনয় বিনয় করে তার পায়ে পর্যন্ত পড়তে যায় কিন্তু কোন লাভ হয়না। আলতাফ তালুকদার গম্ভীর সুরে বলেন,”এই মেয়ে অনেক নাটক হয়েছে আর না..তোমার জন্য আমাদের পরিবারের মান সম্মান একদম শেষ হয়ে গেছে। এতগুলো মানুষ আমাদের পরিবারের দিকে আঙ্গুল তুলে আমাদের সম্মানহানি করছে। বলছে যে, তালুকদার পরিবারের বউ দুশ্চরিত্রা। এত অপমান আমরা আর নিতে পারছি না। এবার আমার ছেলেটাকে, আমাদের পরিবারকে, আমাদের সবাইকে তুমি মুক্তি দাও।”
এরইমধ্যে কিছু মহিলা বলাবলি করছিল,”দেখো এই মেয়েকে..কতটা নির্লজ্জ ও..আমরা হলে তো এত অসম্মানের পর গলায় দ** দিয়েছে মরতাম। আর এ কেমন বিলজ্জের মতো দাঁড়িয়ে আছে।”
“আরে এসব মেয়েদের আবার লজ্জা বলে কিছু আছে? চরিত্রহীন মেয়ে। এত ভালো স্বামী থাকতে বাইরে সুখের খোঁজ করে।”
এসমস্ত কথা ঈশিতাকে একদম ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল। সে আর সইতে না পেরে কান চেপে ধরে। জাহানারা বেগম এগিয়ে এসে ঈশিতার হাত ধরে হিরহির করে টানতে টানতে নিয়ে যেতে থাকে। ঈশিতা বলতে থাকে,”আমায় বিশ্বাস করুন মা..আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত হয়েছে। দয়া করে আমায় বিশ্বাস করুন..”
“চুপ..একদম চুপ..তোকে আমি আর কখনোই বিশ্বাস করবো না। তোকে বিশ্বাস করার বদৌলতে আজ আমাদের এত কিছু সহ্য করতে হচ্ছে। তোর জন্য সবার সামনে আমরা ছোট হয়ে গেলাম কিন্তু আর না..এবার তুই এই বাড়ি থেকে বের হ।”
বলেই দরজার কাছে নিয়ে গিয়ে ঈশিতাকে জোরে ধাক্কা দেয়। ঐশী মেঝেতে পড়ে মাথায় আঘাত পায়। কাঁদতে কাঁদতে আয়ুশকে ডাকতে থাকে কিন্তু আয়ুশ কোন সাড়া দেয় না।
ঈশিতা সেখানেই বসে থাকে। এমন সময় কেউ এসে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। ঈশিতা চোখ তুলে তামিমকে দেখে ঘৃণায় থুথু ছিটায় তার দিকে। তামিম থুথু মুছে ফেলে হেসে বলে,”যতই আমার মুখে থুতু ছিটাও না কেন..আমি ছাড়া এখন তোমাকে সাহায্য করার মতো আর কেউ নেই ঈশিতা।”
“তোমার দিকে তাকাতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে। আমার নিজের প্রতিও ঘৃণা হচ্ছে এটা ভেবে যে একসময় আমি তোমার মতো ঘৃণ্য মানুষকে ভালোবাসতাম। তুমি আমার সংসারটা একদম তছনছ করে দিলে। দেখবে কোনদিনও তোমার ভালো হবে না। একদিন সব সত্যি সামনে আসবেই।”
“এত অপমানের পরেও কি তুমি আয়ুশের কাছে ফিরে যাবে? তাহলে আমি কি দোষ করলাম? সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশ্বাসটাই আসল। কিন্তু তোমার স্বামী তো তোমাকে বিশ্বাসটাই করে না।”
“করতে হবে না বিশ্বাস। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আয়ুশ আমায় ছেড়ে দিয়েছে জন্য আমি তোমার কাছে যাব। তুমি তো আয়ুশের থেকেও জঘন্য। আর আয়ুশ আজ যা করল তাতে আমি আর কখনোই ওর কাছে ফিরতে চাই না। কিন্তু তবুও তোমার এই কদর্য মুখোশ আমি সবার সামনে আনতে চাই। যাতে সবাইকে বোঝাতে পারি যে, আমি দুশ্চরিত্রা নই।”
বলেই ঈশিতা হাটা শুরু করে। তামিম তার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,”কোথায় আর যাবে? সেই তো শেষে আমার কাছেই ফিরতে হবে।”
ঈশিতা হাটতে হাটতে অনেক দূরে আসে, তার কানে সবার করা গঞ্জনা বাজছিল। মাঝরাস্তায় এসে নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয়। ঈশিতার মাথায় হঠাৎ অদ্ভুত চিন্তা আসে। বিপদের সময় শয়তান আমাদের বেশি বেশি ধোকা দেয়। এক্ষেত্রেও তাই হলো। ঈশিতা স্বগোতক্তি করে বলল,”কি হবে নিজেকে আর নির্দোষ প্রমাণ করে? আমার আপনজন বলতে আমি যাদের জানতাম তারা কেউই তো আমায় বিশ্বাস করে না। আজ সবার চোখে আমি চরিত্রহীন। কি হবে এই জীবন রেখে?”
এমন ভাবনা থেকে ঈশিতা এগিয়ে যেতে থাকে। সামনে একটা খরস্রোতা নদী। ঈশিতা ভাবল আজ এই নদীতে ঝাপ দিয়ে নিজেকে শেষ করে দেবে। কিন্তু নদীর কাছে যাওয়ার পূর্বেই তার মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। ঈশিতা এদিক ওদিক তাকায়। কেউ নেই আশেপাশে। ঈশিতা হঠাৎ করেই জ্ঞান হারিয়ে সেখানে পড়ে যায়।
আয়ুশ নিজের কক্ষে এসে সমানে ঈশিতার কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছিল। ঈশিতাকে তো ভালোবাসত সে, তাকে বিশ্বাসও করতে চায়। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে অবিশ্বাস করতে বাধ্য করে। আয়ুশের ভীষণ অস্থির লাগছিল তাই সে রুম থেকে বের হয়ে আসে। এসেই জাহানারা বেগমের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”ঈশিতা কোথায় মা?”
জাহানারা বেগম রেগে বলেন,”খবরদার আমার সামনে ঐ পাপী, দুরাচারী মেয়ের নাম নিবি মা। ওকে আমি বের করে দিয়েছি এই বাডি থেকে।”
“সেকি! এত রাতে ও কোথায় যাবে?”
“যেখানে খুশি যাকে তাতে তোর কি? ও মেয়ে মরুক বাঁচুক তাতে আমাদের আর কিছু নেই।”
“কিন্তু..”
“এতকিছুর পরেও তুই কিন্তু বলছিস!”
আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব ২৪
আয়ুশ আর কিছু বলে না। মনে মনে ভাবলো,”মা তো ঠিকই বলছে..যে আমার কথা ভাবে নি তার কথা আমি কেন ভাববো। ওর সাথে যা খুশি হোক তাতে আমার কিছু আসে যায়না।”
নিজের মনকে এসব বলে শান্তনা দিতে চাইলেও সে ব্যর্থ হয়। অবচেতন মন ঈশিতার চিন্তায় ব্যকুল হয়ে যায়। চমৎকার এক দ্বিধায় পড়ে যায় তার মন।