আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব ২৬
ইয়াসমিন খন্দকার
ঈশিতার জ্ঞান ফিরলে সে নিজেকে আবিস্কার করে কোন এক হাসপাতালে। জ্ঞান ফিরতেই সে উঠে বসার চেষ্টা করে। এমন সময় একজন নার্স এসে বলে,”আরে কি করছেন..উঠবেন না। আপনার শারীরিক অবস্থা বেশি ভালো না, আপনার বিশ্রামের প্রয়োজন।”
ঈশিতা পিটপিট করে চেয়ে থাকে চারিপাশটায়। যায়গাটা তার অচেনা। ঈশিতা মনে করার চেষ্টা করল সর্বশেষ সে কোথায় ছিল৷ তখনই মনে পড়ে গেলো নিজের এক আত্মঘা*তী সিদ্ধান্তের কথা। ঈশিতার এবার ভীষণ রাগ হলো নিজের উপর। নিজের প্রতি
বিতৃষ্ণা জাগল। কেন এমন একটা পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছিল সে? কাদের জন্য, যারা তাকে সামান্যতম বিশ্বাস পর্যন্ত করে না।
একজন ডাক্তার রুমে প্রবেশ করলেন। তিনি এসেই ঈশিতার কাছে এসে বললেন,”আপনি ঠিক আছেন এখন?”
ঈশিতা বলল,”জ্বি, ঠিক আছি।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“এই অবস্থায় তো আপনার অনেক বেশি বিশ্রামের প্রয়োজন। আর আপনি এভাবে রাস্তা ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন!”
ঈশিতা কিছু বুঝতে না পেরে বলে,”মানে কি বলতে চাইছেন টা কি আপনি?!”
ডাক্তার বলে উঠলেন,”আপনি মা হতে চলেছেন।”
ঈশিতা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইল ডাক্তারের দিকে। এ তিনি কি কথা শোনালেন! ঈশিতা বিমূঢ় হয়ে গেল। কথা বলার শব্দই হারিয়ে ফেলল। নিজের পেটে হাত বুলিয়ে বলল,”এ আমায় কি খবর শোনালেন আপনি!”
“কেন? আপনি খুশি হন নি?”
ঈশিতার ভেতর থেকে কোন অনুভূতির প্রকাশ ঘটছে না। যেন অনুভূতিহীন পাথর সে। মা হওয়া একটা মেয়ের কাছে সৌভাগ্য, সুখের খবর। ঈশিতারও এখন সুখী হবার কথা। কিন্তু সে পারছে না সুখী হতে। কারণ বর্তমানে সে যেই সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তাতে তার কাছে মুখ্য বিষয় হচ্ছে নিজেকে এই জীবনযুদ্ধে টিকিয়ে রাখা। সেই সময় এক নতুন প্রাণকে সে এই সংসার সমরাঙ্গনে কিভাবে সামলাবে?! তার বাবা কি তাকে স্বীকৃতি দেবে। এমন কথা মাথায় আসতেই ঈশিতার মনে পড়ে গেল আয়ুশের বলা কিছু তিক্ত কথা। ঈশিতা বলে উঠল,”আমার সন্তানের কারো স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই। যে আমাকে বিশ্বাসই করে না, তার কাছে আমি আমার সন্তানের পিতৃত্বের দাবি নিয়ে যাবো না। প্রয়োজনে আমি একা হাতে আমার সন্তানকে মানুষ করবো। তবুও আমি কারো মুখাপেক্ষী হবো না,কারোই না। যেখানে বিশ্বাস নেই, সেখানে কোন সম্পর্কের মূল্যও নেই।”
আয়ুশ তার প্রিয় বন্ধু রাসেলের সাথে ফোনে কথা বলছিল। রাসেল আয়ুশকে বলছিল,”বারবার কেন একই ভুল করিস তুই আয়ুশ? কেন আবার ভাবিকে ভুল বুঝলি? গতবার কি তোর শিক্ষা হয়নি?!”
আয়ুশ শান্ত স্বরে বলে,”আমি ঈশিতাকে ভুল বুঝিনি। আমি জানি, ও কোন ভুল করতে পারে না, এসব কিছু তামিমের ষড়যন্ত্র সে ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত!”
“তাহলে তুই কেন ভাবিকে সমর্থন করলি না?”
আয়ুশ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”করিনি এর কারণ আছে। তামিম সবার সামনে ঈশিতার চরিত্রের দিকে আঙুল তুলেছে। আমি যদি ঈশিতাকে বিশ্বাস করতাম তাও আর পাঁচটা লোক ঈশিতার চরিত্রের দিকে আঙুল তুলতো। তাই আমি চেয়েছি, সবার সামনে তামিমের সব ষড়যন্ত্র বের করে আনতে। আর এজন্য তামিমকে এটা বিশ্বাস করানো জরুরি ছিল যে,আমি ঈশিতাকে ভুল বুঝেছি। সেজন্যই আমি সবার সামনে এমন প্রিটেন্ড করেছি যে আমি ওকে বিশ্বাস করি না। তামিম এখন নিশ্চয়ই আত্মতুষ্টিতে ভুগছে। ভাবছে ওর উদ্দ্যেশ্যে ও সফল। আমি এই সুযোগ কাজে লাগিয়েই ওর পর্দাফাঁস করবো।”
রাসেল প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,”ও তাই বল। আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম। ভেবেছিলাম তুই বুঝি আবার ভাবিকে ভুল বুঝলি।”
“এখন শান্তি পাওয়ার সময় নেই রাসেল। আমি ভেবেছিলাম, সবার আড়ালে ঈশিতাকে সব কথা জানিয়ে দেব যে আমি ওকে ভুল বুঝিনি এবং নিজের সব পরিকল্পনার কথাও জানাবো। কিন্তু এদিকে একটা ব্লান্ডার হয়ে গেছে। আমি ঈশিতাকে কিছু জানানোর পূর্বেই মা ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।”
রাসেল ভয়ার্ত স্বরে বলে,”সেকি! ভাবি কোথায় এখন?”
“জানি না রে, দোস্ত। আমি বিগত কয়েক ঘন্টা ধরে সম্ভাব্য সব জায়গায় ওকে খুঁজে চলেছি। কিন্তু ওর কোন সন্ধান পাচ্ছি না। জানি না, ও কোথায় চলে গেছে। আমার ভীষণ ভয় হচ্ছে।”
উদাস স্বরে বলে আয়ুশ।
রাসেল একজন পুলিশ অফিসার। তাই সে আয়ুশকে ভরসা দিয়ে বলে,”তুই একদম চিন্তা করিস না,আমি আসছি। যত দ্রুত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা দুজনে মিলে ভাবিকে খুঁজে বের করবো।”
“তুই ছাড়া এখন আমার আর ভরসা করার মতো কেউ নেই, রাসেল। তাই তো আমি অসহায় হয়ে তোকে বললাম।”
“একদম ঠিক করেছিস। আমি শীঘ্রই আসছি।”
ঐশী বাসর ঘরে বসে নাহিদের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। এই নতুন ঠিকানায় তার প্রথম রাত অন্যরকম এক অনুভূতিতে ভাসিয়ে দিচ্ছে। যতদূর সে দেখেছে এই পরিবারের লোকগুলো কেউ খারাপ না। সবাই ঐশীর সাথে বেশ ভালো ব্যবহার করেছে। ঐশী সবার ব্যবহারে যথেষ্ট সন্তুষ্ট। আর নাহিদ! সে তো ঐশীর প্রতি যথেষ্ট দায়িত্বশীল আচরণ করেছে। ঐশীর মনে যেন নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। দাদির বলা কথা গুলো মনে পড়ে যাচ্ছে। তাহলে কি সত্যি এবার তার জীবনে সুখের আগমন ঘটতে চলেছে!
ঐশীর এহেন ভাবনার মাঝেই রুমে প্রবেশ করে নাহিদ। ঐশীর বুক কেপে ওঠে। এক অজানা শিহরণ অনুভূত হয়। নাহিদকে ভীষণ চিন্তিত লাগছিল। তামিম, ঐশীর ঘটনাটা সে শুনেছে। এটা শোনার পর থেকে তার মন খচখচ করছে।
নাহিদ চিন্তিত ভঙিতে ঐশীর পাশে এসে বসে। ঐশী মাথা নামিয়ে ছিল। অনেকক্ষণ নাহিদ চুপ থাকায় ঐশী মাথা তুলে নাহিদের দিকে তাকায়। নাহিদকে ভীষণ চিন্তিত লাগছিল। ঐশী নাহিদের চিন্তিত মুখভঙ্গি দেখে বলে,”আপনি ঠিক আছেন তো?”
নাহিদ ঐশীকে এখনই এসব বলে তাদের জীবনের এই সুন্দর মুহুর্ত নষ্ট করতে চায় না। তাই ব্যাপারটা চেপে যায়। কন্ঠে মাদকতা মিশিয়ে বলে,”না,আমি একদম ঠিক নেই। পাশে এত সুন্দরী বউ থাকলে কি ঠিক থাকা যায়?”
ঐশীর খানিক লজ্জা লাগলো। নাহিদ ঐশীর লাজুক মুখশ্রী স্পর্শ করতেই কেপে উঠলো তার বদন। চোখ বন্ধ করতেই আয়ুশের কথা মনে পড়লো। ঐশী নিজেক ধিক্কার দিয়ে বললো,”আমি এখনো অন্য কারো বিয়ে করা বউ। ঐ পুরুষ এখন আমার কাছে নিষিদ্ধ। হে আল্লাহ, তুমি আমার মন থেকে ওনাকে চিরতরে মুছে দাও। যাতে আমি জীবনটা নতুন উদ্যমে শুরু করতে পারি।”
নাহিদ নিজের বুকপকেট থেকে একটি সোনার আংটি বের করে ঐশীর অনামিকা আঙুলে পড়িয়ে দেয়। ঐশী নাহিদের পানে চায়। নাহিদ মৃদু হেসে বলে,”আজ থেকে আমাদের নতুন জীবনের সূচনা হলো। আমি জানি, তোমার কিছু অতীত ছিল। যা হয়তো সুখকর নয়। আমি কখনো সেই অতীত সম্পর্কে জানতে চাইবো না। আমি তোমাকে নিয়ে এক সুন্দর বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন দেখি। আমার এই স্বপ্নপূরণে তোমায় পাশে পাবো তো?”
ঐশী নিশ্চুপ। সে বুঝে উঠতে পারে না এই অবস্থায় ঠিক কি বলা উচিৎ। তাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো নাহিদের পানে। নাহিদ ঐশীর কপালে আলতো পরশ একে দিলো। ঐশী আবারো কেপে উঠলো। নাহিদ ধীরে ধীরে ঐশীর আরো কাছে আসতে লাগল। ঐশী কোন বাধা দিলো না। বরং নাহিদের সাথে তাল মেলাতে লাগলো। অতীতকে ভোলার প্রয়াসে যুক্ত হলো ঐশী। জীবনে একজনকে ভুলতে আরেকজনের সঙ্গ প্রয়োজন। আজ নাহিদের মধ্যে যেন সেই সঙ্গই খুঁজে পেল।
আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব ২৫
আদর ভরা এক রাত্রী শেষে ঐশীকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নাহিদ বললো,”তোমার এই বিয়েতে মত ছিল না আমি জানি তবে দেখো এই বিয়েটাই তোমার জীবনে সবথেকে বড় মঙ্গলময় কিছু নিয়ে আসবে।”
ঐশী প্রতিত্তোরে বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না। তবে সেও চায় নাহিদের বলা প্রত্যেকটা কথা যেন শতভাগ সত্য হয়।