আমি পদ্মজা পর্ব ২১+২২+২৩+২৪+২৫

আমি পদ্মজা পর্ব ২১+২২+২৩+২৪+২৫
ইলমা বেহরোজ

সারা বাড়ির সব কাজ শেষ করে, হেমলতা ক্লান্ত পায়ে হেঁটে ঘরে আসেন। মোর্শেদ সবেমাত্র শুয়েছেন। হেমলতা বিছানার এক পাশে কাত হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করেন। মোর্শেদ হেমলতার দিকে ফিরে ধীরকণ্ঠে বলেন,’ধানের মিলটা পাইয়া যাইতাছি।’
মোর্শেদের গলা দূর্বল হলেও খুশিতে চোখ চকচক করছে। হেমলতা মৃদু হেসে বলেন,’মাতব্বর কী যৌতুক দিচ্ছেন?’
মোর্শেদ হেসে বলেন,’ সে কইতে পারো। সে আমারে কী কইছে জানো?’
‘কী?’
‘কইলো, শুনো মোর্শেদ…আইচ্ছা আগে শুনো আমি কিন্তু শহুরে ভাষায় কইতে পারুম না। আমি আমার গ্রামের ভাষায় কইতাছি।’

হেমলতা মোর্শেদের কথা বলার ভঙ্গি দেখে আওয়াজ করেই হাসলেন। বললেন,’আচ্ছা,যেভাবে ইচ্ছে বলো।’
মোর্শেদ খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার করে বললেন,’কইলো,শুনো মোর্শেদ তোমার এই মোড়ল বাড়ি হইতাছে একটা বিল। যে বিলে একটাই পদ্ম ফুল আছে। এই পদ্ম ফুলডার জন্যই এই বিলটা এতো সুন্দর। আর আমি সেই পদ্ম ফুলডারে তুইললা নিয়া যাইতাছি। এই বিলে পদ্ম ফুলডার চেয়ে দামি সুন্দর আর কিছু নাই। তাই আমার আর কিছু লাগব না। বিনিময়ে আমি এই খালি বিলডারে ধানের মিল দিয়ে দিলাম। বুঝলা লতা? মাতব্বর মানুষটা সাক্ষাৎ ফেরেশতা। মন দয়ার সাগর।’
‘হুম।’ হেমলতা বললেন,ছোট করে। পুনরায় বললেন,’একটা কথা।’
মোর্শেদ জিজ্ঞাসু ইশারা করেন ভ্রু উঁচিয়ে। হেমলতা উঠে বসেন। বলেন,’লিখনকে মনে আছে? সে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল তোমাকে?’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মোর্শেদ লেশমাত্র অবাক হলেন না। দায়সারাভাবে বললেন,’এতদিনে জানলা? আমি মনে করছি কবেই জাইননা ফালাইছো।’
‘আমি তো আর সবজান্তা নই। আমাকে বলোনি কেন?’
‘বইললা কি হইতো? ছেড়ি বিয়া দিতা? আর ছেড়াডা নায়ক। কত ছেড়ির লগে ঘষাঘষি করে। ছেড়িগুলাও নষ্টা। নষ্টাদের সাথে চলে এই ছেড়ায়।’
‘মুখ খারাপ করো না। ছেলেটার মধ্যে আমি তেমন কিছু দেখিনি। তুমি আমাকে জানাতে পারতে। নিশ্চিন্তে ছেলেটা সুপাত্র। বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে, সে মা বাবা নিয়ে আসলে আমি ফিরিয়ে দিতাম না। থাক…এসব কথা। এখন বলেও লাভ নেই। পদ্মজার মন স্থির আছে। পরিস্থিতি, ভাগ্য সেখানে নিয়ে যাচ্ছে,সেখানেই গা ভাসিয়ে চলুক। ঘুমাও এখন। ভোরে উঠে গোলাপ ভাইয়ের বাড়িতে যাবা। কত কাজ বাকি! বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে কী সামান্য কথা!’
হেমলতা একা কথা বলতে বলতে অন্যদিকে ঘুরে শুয়ে পড়েন। কিছু সময়ের ব্যবধানে ঘুমিয়েও পড়লেন।

সকাল থেকে পূর্ণার দেখা নেই। পদ্মজা পূর্ণাকে খুঁজে বাড়ির পিছনে আসে। পূর্ণা সিঁড়িঘাটে বসে উদাস হয়ে কী যেন ভাবছে। পদ্মজা পা টিপে হেঁটে আসে। পূর্ণা বোনের উপস্থিতি টের পায়নি। পদ্মজা পূর্ণার পাশে বসে। তবুও পূর্ণা টের পেল না। পদ্মজা পূর্ণাকে ধাক্কা দিল। পূর্ণা চমকে তাকাল। বুকে ফুঁ দিয়ে বলল,’ভয় পাইছি।’
‘উদাস হয়ে কী ভাবছিস?’
‘কিছু না।’
‘আবার ওইসব ভাবছিস! কতবার না করলে শুনবি বল তো?’
পূর্ণা নতজানু হয়ে রইল। ক্ষণকাল পার হওয়ার পর ভেজা কণ্ঠে বলল,’নিজের ইচ্ছায় মনে করে কষ্ট পেতে আমার ইচ্ছে করে না আপা। মনে পড়ে যায়।’
‘চেষ্টা তো করবি। আর ভুলতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। এছাড়া অমানুষগুলো তাদের শাস্তি তো পেয়েছেই।’
পূর্ণা চোখের জল মুছে আগ্রহ নিয়ে বলল,’আম্মা তিন জনকে কী করে মারল আপা?’
‘জানি না।’
‘জিজ্ঞাসা করবা আম্মাকে?’
পদ্মজা ভাবল। এরপর বলল,’করব। আজ না অন্য একদিন।’
‘বিয়ে করে তো চলেই যাবা।”
পদ্মজা অভিমানী হয়ে তাকাল পূর্ণার দিকে। বলল,’আর কী আসব না? ফিরে যাত্রা আছে। আবার এমনিতেও আসব। কয়দিন পর পর।’
‘তাহলে কালাচাঁদের সাথে বিয়েটা সত্যিই হচ্ছে?’
‘তুই কী মিথ্যে ভাবছিস?’

পূর্ণা বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেলল। বলল,’লিখন ভাইয়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে।’
লিখন নামটা শুনে পদ্মজা অপ্রতিভ হয়ে উঠল। নিজেকে অপরাধী অপরাধী মনে হয়। তাই সে প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,’উনাকে পছন্দ না তাই কালা বলিস, ঠিক আছে। কিন্তু চাঁদ কেন বলিস বুঝলাম না।’
পূর্ণা আড়চোখে পদ্মজার দিকে তাকায়। এরপর যান্ত্রিক স্বরে বলল,’পাতিলের তলার মতো কালা হয়ে আমার চাঁদের মতো সুন্দর বোনকে বিয়ে করতেছে বলেই কালাচাঁদ ডাকি। নয়তো কালা পাতিল ডাকতাম। আবার দরদ দেখিয়ে বলিও না,উনি তো এতো কালা না। শ্যামলা।’ কথা শেষ করে পূর্ণা ঠোঁট বাঁকাল।
পদ্মজা শব্দ করে হাসতে শুরু করল। কিছুতেই হাসি থামছে না। পূর্ণা পদ্মজার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বলল,’তুমি খুব কঠিন আপা। খুব ধৈর্য্য তোমার,ঠিক আম্মার মতো।’
পদ্মজা হাসি থামিয়ে পূর্ণার দিকে তাকাল। সময়টা শুধু দুই বোনের। পদ্মজা মায়াবী স্বরে বলল,’আর তুই ঠিক আম্মার বাহ্যিক রূপের জোড়া পর্ব।’

প্রান্ত,প্রেমা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে নদীর ঘাটে। পদ্মজার উদ্দেশ্যে বলে,’বড় আপা দুলাভাই আসছে।’
আমির আসার খবর শুনেই বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে পদ্মজা নিজের ঘরে চলে গেল। এই লোকটা এতো বেহায়া আর নির্লজ্জ! গতকাল সকাল-বিকাল বাড়ির সামনে ঘুর ঘুর করেছে। সেই খবর পদ্মজা পেয়েছে। আজ একেবারে বাড়িতে! বিয়ের তো আর মাত্র তিন দিন বাকি। এতোটুকু সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রন করা কী সম্ভব নয়? পদ্মজা কপাল চাপড়ে বিড়বিড় করে,’এ কার সাথে বিয়ে হচ্ছে আল্লাহ।’
উঠানে হেমলতা ছিলেন। আমির বাড়ির ভেতর ঢুকেই হেমলতার পা ছুঁয়ে সালাম করল। এরপর নতজানু হয়ে বলল,’কেমন আছেন আম্মা?’
হেমলতার চক্ষু চড়কগাছ! আমিরের সাথে মগা এসেছে। মগার হাতে মাছের ব্যাগ, মাথায় ঝুড়ি। তাতে মশলাপাতি সাথে শাকসবজি। বিয়ের আগে এতো বাজার আবার আম্মাও ডাকা হচ্ছে। অপ্রত্যাশিত ব্যাপার স্যাপার! হেমলতা ঢোক গিলে ব্যাপারটা হজম করে নেন। ধীরেসুস্থে বলেন,’ভালো আছি। তুমি ভালো আছো? বাড়ির সবাই ভালো আছে?’
‘জি,জি। সবাই ভালো।’
আমির মগাকে ইশারা করল। মগা বারান্দায় মাছের ব্যাগ, মাথার ঝুড়ি রাখল। হেমলতা আমিরকে বললেন,’এতসব বিয়ের আগে আনার কী দরকার ছিল? পাগল ছেলে।’
আমির হেসে ইতস্ততভাবে নতজানু অবস্থায় বলল,’এমনি।’
‘যাও ঘরে গিয়ে বসো।’
‘আম্মা…’

হেমলতা চলে যেতে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়েন। আমির বলল,’আম্মা, ক্ষমা করবেন। সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতে হবে।’
‘কোনো দরকার কী ছিল?’
‘আ..আসলে আম্মা। পদ্মজার সাথে একটু কথা ছিল।’
আমির উসখুস করছে। খুব অস্থির। হাত,পা এদিকওদিক নাড়াচ্ছে। কিন্তু চোখ মাটিতে স্থির। হেমলতা আমিরকে ভাল করে পরখ করে নিয়ে বললেন,’ঘরে আছে নয়তো ঘাটে।’
অনুমতি পেয়ে ব্যস্ত পায়ে হেঁটে গেল আমির। হেমলতা আমিরের যাওয়ার পানে চেয়ে থেকে ভাবেন,ছেলেটার সাথে এখনও চোখাচোখি হয়নি। সবসময় মাথা নত করে রাখে। কিন্তু কথাবার্তায় মনে হলো,লাজুক নয় এই ছেলে। হয়তো গুরুজনদের সামনে মাথা নিচু করে রাখা ছোটবেলার স্বভাব। হেমলতা মুচকি হেসে লাহাড়ি ঘরের দিকে এগিয়ে যান।
পদ্মজার ঘরের শেষ প্রান্তে বারান্দা আছে। বারান্দা পেরোলেই বাড়ির পিছনের দরজা। আমির আসছে শুনে ঘর আর বারান্দার মাঝ বরাবর দরজায় পর্দা টানিয়ে দিল পদ্মজা। আমির ঘরের পাশে দাঁড়াল। পদ্মজা বারান্দার দিকে। পর্দার কাপড় পাতলা,মসৃণ। আমির স্পষ্ট পদ্মজার অবয়ব দেখতে পাচ্ছে। তিরতির করে বাতাস বইছে। সেই বাতাসে পদ্মজার কপালে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো উড়ছে অবাধ্য হয়ে। আমির ডাকল,’পদ্মজা?’

‘হু?’
‘কেমন আছো?’
‘ভালো। আপনি?’
‘ভালো।’
বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা! পদ্মজা বলল,’কী বলবেন বলুন।’
‘মায়াভরা চোখগুলো দেখার সৌভাগ্য কী হবে?’
আমিরের কণ্ঠে আকুতি! তৃষ্ণা! পদ্মজার অস্বস্তি হচ্ছে। বেহায়া মানুষ বড়ই বিপদজনক। সে পালানোর জন্য পা বাড়াতেই আমির হই হই করে উঠল,’কসম লাগে পালাবে না।’
পদ্মজা মাথার ওড়না টেনে নিয়ে বলল,’দরকারি কথা থাকলে বলে চলে যান।’
‘তাড়িয়ে দিচ্ছো?’
‘ছিঃ না।’

‘তোমায় না দেখলে আজ আর প্রাণে বাঁচবো না। রাতেই ইন্না লিল্লাহ…’
‘রসিকতা করবেন না। কাউকে না দেখে কেউ মরে না।’
‘পদ্মবতীর রূপ যে পুরুষ একবার দেখেছে সে যদি বার বার না দেখার আগ্রহ দেখায় তাহলে সে কোনো জাতেরই পুরুষ না। একবার দেখা দাও। কসম লাগে…’
‘বার বার কসম দিয়ে ঠিক করছেন না।’
‘আচ্ছা,কসম আর কসম দেব না। একবার দেখা দাও।’
পদ্মজার দুই ঠোঁট হা হয়ে গেল। কী বলে মানুষটা! কসম করেই বলছে আর কসম দিবে না। আমির ধৈর্য্যহারা হয়ে বলল,’পদ্মবতী অনুরোধ রাখো…’
‘এভাবে বলবেন না। নিজেকে ছোট লাগে।’
‘পর্দা সরাব?’
পদ্মজা ঘামছে। বাতাসে অস্বস্তি। নিঃশ্বাসে অস্বস্তি। তবুও সায় দিল। আমির পর্দা সরিয়ে খুব কাছে পদ্মজাকে দেখতে পেল। কালো রঙের সালোয়ার কামিজ পরা পদ্মবতী। কপাল অবধি টেনে রাখা ঘোমটা। পদ্মজা চোখ তুলে তাকাতেই আমির বলল,’জীবন ধন্য।’

পদ্মজা হাসি সামলাতে পারল না। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হাসল। আমির বলল,’এ মুখ প্রতিদিন ভোরে দেখব। আর প্রতিদিনই জীবন ধন্য হবে। এমন কপাল কয়জনের হয়।’
পদ্মজা কিছু বলল না। আমির আবেগে আপ্লুত হয়ে বলল,’আমার ইচ্ছে হচ্ছে তোমার হাতে খুন হয়ে যাই।’
পদ্মজা চমকে উঠল। আশ্চর্য হয়ে বলল,’আপনি পাগল।’
আমির কণ্ঠ খাদে নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,’তোমার উপস্থিতি আমার নিঃশ্বাসের তীব্রতা কতটা বাড়িয়ে দিয়েছে টের পাচ্ছো?’
পদ্মজা দূরে সরে গেল। মনে মনে বলল,’উফ! আল্লাহ আমি পাগল হয়ে যাব। এ কার পাল্লায় পড়লাম। জ্ঞানবুদ্ধি,লাজলজ্জা কিছু নেই।’
আর মুখে আমিরকে বলল,’পেয়েছি। এবার আসি।’
আমিরকে কিছু বলতে না দিয়ে পদ্মজা বারান্দা ছাড়ল। বাড়ির পিছনে মগাকে পেল।মগার পথ আটকে বলল,’মগা ভাই।’
মগা সবগুলো দাঁত বের করে হাসল। বলল,’জ্বে ভাবিজান।’
মগার মুখে ভাবি ডাক শুনে পদ্মজা বিরক্ত হলো। কিন্তু প্রকাশ করল না। বিরক্তি লুকিয়ে বলল,’লিখন শাহর কথা আপনি উনাকে বলেছেন?’
‘উনিটা কে?’
‘আপনার আমির ভাই।’
‘জ্বে ভাবিজান।’

মগার অকপট স্বীকারোক্তি! পদ্মজা এ নিয়ে আর কথা বাড়াল না। মগাকে পাশ কেটে চলে গেল। মগা দৌড়ে এসে পদ্মজার পথ রোধ করে দাঁড়াল। ফিসফিসিয়ে গোপন তথ্য দিল। আগামী দুই দিনের মধ্যে লিখন শাহ আসছে। তার বাবা মাকে নিয়ে। খবরটা মগা গত সপ্তাহ পেয়েছে। পদ্মজার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। ঢোক গিলে নিজেকে আশ্বস্ত করে নিল। সে তো কথা দেয়নি বিয়ে করার। আর না কখনো চিঠি দিয়েছে। লিখন শাহ নিরাশ হলে এটা তার দোষ নয়,লিখন শাহর ভাগ্য। তবুও পদ্মজার খারাপ লাগছে। অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। জীবনে আবার কী কিছু ঘটতে চলেছে? বুক ধড়ফড়,ধড়ফড় করছে। পদ্মজা ঘাটের সিঁড়িতে বসে রইল ঝিম মেরে।
মোড়ল বাড়ির আনাচেকানাচে আত্মীয়স্বজনদের কোলাহল। পদ্মজা বিছানার এক কোণে চুপটি করে বসে আছে। ঘরে দুষ্টু রমণী আছে কয়েকজন। নিজেদের মধ্যে রসিকতা করছে। উচ্চস্বরে হাসছে। অথচ এরাই বিপদের সময় পাশে ছিল না। ভীষণ গরম পড়েছে। পদ্মজার পরনে সুতার কাজ করা সুতি শাড়ি। গরমে শুধু ঘামছে না। বমি পাচ্ছে। প্রেমা পদ্মজার পাশে বসে ছিল। পদ্মজা প্রেমাকে ফিসফিসিয়ে বলল,’এই বনু? আম্মাকে গিয়ে বলবি লেবুর শরবত দিতে?’
প্রেমা মাথা নাড়িয়ে চলে গেল শরবত আনতে। হেমলতা রান্নাঘরে ছিলেন। প্রেমা লেবুর শরবতের কথা বললে তিনি বললেন,’তুই যা আমি নিয়ে যাচ্ছি।’

লেবু গাছ থেকে সবেমাত্র ছিঁড়ে আনা পাকা লেবুর শরবত বানিয়ে পদ্মজার ঘরের দিকে এগোলেন তিনি। গিয়ে দেখলেন পদ্মজা বিছানার এক পাশে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। উসখুস করছে। ঘরভর্তি অন্যান্য মানুষে।তিনি সবার উদ্দেশ্যে বলেন,’সবাই অন্য ঘরে যাও। পদ্মজাকে একা ছাড়ো।’
হেমলতার এমন আদেশে অনেকের রাগ হলেও বেরিয়ে গেল। তিনি দরজা বন্ধ করে শরবতের গ্লাস পদ্মজার হাতে তুলে দিয়ে বলেন,’সব সময় মুখ বন্ধ রাখা ভালো না। যারা বিপদে পাশে থাকে না তাদের জন্য বিন্দুমাত্র অসুবিধার মুখোমুখি হবি না। গরমে তো শেষ হয়ে যাচ্ছিস। জানালার পাশটাও অন্যরা ভরাট করে রেখেছিল। ভালো করেই সরতে বলতি।’
পদ্মজা মায়ের কথার জবাব না দিয়ে এক নিঃশ্বাসে লেবুর শরবত শেষ করল। এবার একটু আরাম লাগছে। আলনার কাপড় গুলো অগোছালো। সকালেই তো ঠিক ছিল। নিশ্চয় মেয়েগুলির কাজ। হেমলতা আলনার কাপড় ঠিক করতে করতে জিজ্ঞাসা করলেন ,’কী নিয়ে এত চিন্তা করছিস?’
পদ্মজা কিছু না বলে বিছানায় আঙ্গুল দিয়ে আঁকিবুঁকি করতে থাকল। পদ্মজার অস্বাভাবিকতা দেখে হেমলতা কপাল কুঁচকালেন।

‘বলবি তো?’
পদ্মজা বিচলিত হয়ে বলল,’আম্মা উনি বোধহয় আজ আসবেন।’
‘উনি? উনি কে? আমির?’
‘না আম্মা। লিখন শাহ যে,উনি।’
হেমলতা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন,’কপালে যা আছে তাই তো হবে। ভাবিস না। আমি আছি,সব সামলে নেব। লিখনকে আমি বুঝাব।’
হেমলতার কথা শেষ হতেই,পদ্মজা ভেজা কণ্ঠে বলল,’উনি খুব কষ্ট পাবেন আম্মা।’
হেমলতা অবাক হয়ে তাকান পদ্মজার দিকে। পদ্মজা এতো ব্যকুল কেন হচ্ছে? তিনি কী পদ্মজার অনুভূতি চিনতে ভুল করছেন?নাকি শুধুমাত্র কারো মন ভাঙবে ভেবে,পদ্মজার এতো ব্যাকুলতা!হেমলতা দোটানায় পড়ে যান। পদ্মজার জীবনে এ কেমন টানাপোড়ন! এই মুহূর্তে পদ্মজাকে বুঝে উঠতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। ওদিকে হানি ডাকছে। হেমলতার বড় বোন হানি,গতকাল ঢাকা থেকে গ্রামে এসেছে। ছেলেমেয়ে নিয়ে এসেছে। হেমলতা দরজার দিকে পা বাড়ান। তার আগে বলে গেলেন,’আমার নোংরা অতীত শুনাব আজ। বাকি সিদ্ধান্ত তোর। যা চাইবি তাই হবে। মনে রাখিস,যা চাইবি তাই পাবি।’
পদ্মজা কিছু বলার আগে হেমলতা চলে গেলেন। পদ্মজার বুকের ভেতর অপ্রতিরোধ্য তুফান শুরু হয়। মায়ের অতীত জানার জন্য কত অপেক্ষা করেছে সে। আজ যখন সেই সুযোগ এলো,তার ভয় হচ্ছে খুব। কেন হচ্ছে জানে না। কিন্তু হচ্ছে। হাত,পায়ের রগে রগে শিরশির অনুভূতি।

ভ্যানগাড়িতে চড়ে অলন্দপুরের আটপাড়ায় ঢুকল লিখন শাহ। সাথে বাবা-মা এবং বোন। বাবা শব্দর আলী, মা ফাতিমা বেগম। বোন লিলি। শব্দর আলী চশমার গ্লাস দিয়ে গ্রামের ক্ষেত দেখছেন। আর বার বার বলছেন,’এই তো আমার দেশ। এই তো আমার বাংলাদেশ।’
ফাতিমা ভীষণ বিরক্ত ভ্যানে চড়ে। উনার ইচ্ছে ছিল কোনো মন্ত্রীর মেয়েকে ঘরের বউ করে আনবেন। আর ছেলের নাকি মেয়ে পছন্দ হয়েছে গ্রামে। ছেলের জেদের কাছে হেরে আসতেই হলো।
লিখনের পরনে ছাইরঙা শার্ট। চোখে সানগ্লাস। উত্তেজনায় তার হাত পা কাঁপছে রীতিমতো। এমন একটা দিন নেই, যেদিন পদ্মজার কথা ভেবে শুরু হয়নি। এমন একটা রাত নেই, যে রাতে পদ্মজাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা হয়নি। মাঝের সময়ের ব্যবধানে পদ্মজাকে খুব বেশি ভালবেসে ফেলেছে সে। স্বপ্নে কোমরে আঁচল গুঁজে ঘরের কাজ করা পদ্মজাকে দেখতে পায়। কখনো বা অপরূপ সুন্দরী পদ্মজাকে ঘুমের ঘোরে ঠিক বিছানার পাশে শাড়ি পরা অবস্থায় দেখতে পায়।

কল্পনার পদ্মজাকে নিয়ে সে সংসার পেতেছে। এবার হয়তো সত্যি হতে চলেছে। লিখন আনমনে হেসে উঠল। মনে পড়ে যায় পদ্মজাকে প্রথম দেখার কথা। সঙ্গে,সঙ্গে বুকের মধ্যে অদ্ভুত ঝড় শুরু হয়। কী মায়াবী, কি স্নিগ্ধ একটা মুখ। তার চেয়েও সুন্দর পদ্মজার ভয় পাওয়া। লজ্জায় পালানোর চেষ্টা। পর পুরুষের ভয়ে আতঙ্কে থাকা। লিখন আওয়াজ করে হেসে উঠল। ফাতিমা,শব্দর অবাক হয়ে তাকালেন। লিলির এসবে খেয়াল নেই। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছে। লিখন মা-বাবাকে এভাবে থাকাতে দেখে,খুক খুক করে কাশল। এরপর বলল,’সুন্দর না গ্রামটা? বুঝছো আব্বু, এই গ্রামটাই এতো সুন্দর যে আবার আরেকটা সিনেমার জন্য আসতে হবে আগামী বছর।’
শব্দর আলী প্রবল আনন্দের সাথে বলেন,’সে ঠিক বলেছিস। মন জুড়িয়ে যাচ্ছে দেখে। চারিদিকে গাছপালা,নদী। রাস্তাঘাটও খুব সুন্দর। এখানে একটা বাড়ি বানালে কেমন হয়?’
লিখন গোপনে দীর্ঘশ্বাস লুকালো। তার বাবা যখন যেখানে যায় সেখানেই বাড়ি বানানোর স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু বানানো আর হয় না।

ফাতিমা বিরক্ত গলায় বললেন,’তা আমরা উঠছি কার বাড়ি? তোর পছন্দ করা মেয়ের বাড়ি নাকি অন্য কোথাও?’
মায়ের চোখেমুখে বিরক্তি দেখে লিখনের হাসি পেল। বলল,’তোমাকে রাগলে এতো ভালো লাগে আম্মু।’
ফাতিমা আড়চোখে ছেলের দিকে তাকান। প্রশংসা শুনতে তিনি বেশ পছন্দ করেন। লিখনের মুখে প্রশংসা শুনে একটু নিভলেন।
‘হয়েছে, আর কতক্ষণ? ‘
‘পাঁচ মিনিট। অলন্দপুরের মাতব্বর বড় মনের মানুষ। আমাকে নিজের সন্তানের দৃষ্টিতে দেখেন। যতদিন ছিলাম প্রতিদিন খোঁজ নিয়েছেন। নিজের একজন লোককে আমার সহায়ক হিসেবেও দিয়েছিলেন! উনার বাড়িতেই উঠব।’
লিলি চোখমুখ বিকৃত করে বলল,’অন্যের বাড়িতে উঠব! উফ।’

‘মারব ধরে। অন্যের বাড়ি তোর কাছে,আমার কাছে না। মজিদ চাচার বউ ফরিনা চাচি এতো ভাল রাঁধেন। আমাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছেন। উনার একটাই ছেলে। ঢাকায় পড়ছে,ব্যবসা সামলাচ্ছে। তার সাথে অবশ্য সাক্ষাৎ হয়নি। কিন্তু ফরিনা চাচি সারাক্ষণ ছেলে,ছেলে করতেন। আমাকে পেয়ে ছেলের সব ভালবাসা ঢেলে দিয়েছিলেন। তাই ওই বাড়ি আমার কাছে আপন না লাগুক,পরও লাগে না। আর বিশাল বাড়ি। উনারা বিব্রত হবেন না। তিন-চার দিনেরই তো ব্যাপার।’
লিখনের এতো বড় বক্তব্যের পাছে কেউ কিছু বলার মতো পেল না।
হাওলাদার বাড়ির সামনে এসে ভ্যান থামে। বাড়ির চারপাশ সাজানো দেখে লিখন বেশ অবাক হলো। লিলি চারপাশ দেখতে দেখতে বলল,’দাদাভাই, তুমি বিয়ে করতে এসেছো এই খবর উনারা পেয়েছেন বোধহয়। তাই এতো আয়োজন।’
লিখন লিলির মাথায় গাট্টা মেরে বলল,’বাড়িতে দুটো মেয়ে আছে। তাদের কারো বিয়ে হবে হয়তো। চল।’

ইটের বড় প্রাচীর চারদিকে। মাঝে বড় গেইট। প্রাচীরের উচ্চতা ১৫ ফুট। আর গেইটের উচ্চতা বারো ফুট। গেইটের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল দুজন লোক। দুজনই লিখনকে চিনে। তাই লিখনকে বাড়ির ভেতর ঢুকতে দিল। গেইট পার হলেই খোলা জায়গায়। প্রচুর গাছপালা। বেশি সুপারি গাছ এবং তালগাছ। সবকিছু সুন্দর! দুই মিনিট হাঁটার পর রঙ করা টিনের একটা বড় ঘর। তার সামনে সিঁড়ি। সিঁড়ির দু’পাশে সিমেন্টের তৈরি বসার বেঞ্চি। এই ঘরটাকে গ্রামে আলগ ঘর বলা হয়,কেউ কেউ আলগা ঘর বলে থাকে। অতিথিরা এসে বিশ্রাম করে। রাত্রিযাপন করে।ভেতরে ইট সিমেন্টের তৈরি দু’তালা অন্দরমহল। আলগ ঘরের বারান্দায় বসে ছিলেন মজিদ মাতব্বর,ফরিনা, রিদওয়ান। লিখনকে দূর থেকে দেখতে পেয়ে উনারা অবাক হোন। সেই সাথে খুশিও। শহরের চারজন মানুষ হেঁটে আসছে। সর্বাঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়া। দেখতেও ভালো লাগে। লিখন বারান্দায় পা রাখতেই মজিদ মাতব্বর হেসে বলেন,’আজকের দিনটা সত্যি খুব সুন্দর।’

লিখন হাসল। ফরিনা এবং মজিদ মাতব্বরকে সালাম করে বলল,’এই হচ্ছেন আমার বাবা- মা আর বোন। আর আম্মু,আব্বু উনি হচ্ছেন মজিদ চাচা। আর ইনি ফরিনা চাচি। আর ওইযে বড় বড় গোঁফদাড়িওয়ালা উনি হচ্ছেন রিদওয়ান ভাইয়া। এই বাড়িরই আরেক ছেলে।’
মজিদ মাতব্বর একজনকে ডেকে বলেন,চেয়ার দিয়ে যেতে। আর অন্দরমহলে খবর পাঠাতে মেহমান এসেছে। তাৎক্ষণিক চেয়ার ও ঠান্ডা শরবত চলে আসে। পরিচিয় পর্ব শেষ হতেই লিখন প্রশ্ন করল,’বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান চলছে নাকি?’
‘সে চলছে। আমার ছেলেটার বিয়ে। একমাত্র ছেলে।’
লিখন হাসে। চোখ পড়ে আলগ ঘরের ডান পাশে। কয়েকটা মেয়ে উঁকি দিয়ে তাকে দেখছে। লিখন আনমনে হেসে উঠল। কোনো মেয়ে যখন তাকে দেখে খুব তৃপ্তিদায়ক অনুভূতি হয়। নায়ক কী এমনি এমনি হওয়া। শব্দর আলী জিজ্ঞাসা করলেন,’তাই নাকি? তাহলে তো ঠিক সময়েই এসেছি। আমরাও একমাত্র ছেলের বিয়ের প্রস্তাব নিয়েই এই গ্রামে এসেছি।’
মজিদ মাতব্বর আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন,’মেয়ে কে? কার মেয়ে? আমাকে বলুন। এখুনি বিয়ে করতে চাইলে এখুনি হবে।’

শব্দর আলী লিখনকে প্রশ্ন করেন,’মেয়ের পরিচয় বল।’
লিখন কথা বলার পূর্বেই ফরিনা গেইটের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন,’এই তো আমার ছেড়ায় আইয়া পড়ছে। আমির এইহানে আয়। দেইখা যা কারা আইছে।’
ফরিনার দৃষ্টি অনুসরণ করে সবাই পিছনে তাকাল। আমির চুল ঠিক করতে করতে এগিয়ে আসছে। হাঁটার গতিতে বোঝা যাচ্ছে,বেশ চঞ্চল একটা ছেলে। আমির ঘেমে একাকার। কয়েক ফুটের দূরত্ব থাকা অবস্থায় লিখনকে দেখেই আমির চিনে ফেলল। মগার কাছে লিখনের বর্ণনা শুনেছে। এছাড়া লিখন একজন নামকরা অভিনেতা। তার অভিনীত ছায়াছবি সে দেখেছে। আমির হাঁটার গতি কমিয়ে এগিয়ে এলো। লিখন উঠে দাঁড়াল। হেসে আমিরের সাথে করমর্দন করল। এরপর বলল,’আমি লিখন শাহ।’

আমির বলল,’আমির হাওলাদার। বসুন আপনি।’
লিখন নিজ স্থানে বসল। আমির একটু দূরত্ব রেখে দূরে বসল। মজিদ মাতব্বর আমিরকে লক্ষ্য করে বললেন,’কোথায় থাকিস সারাদিন। বলেছিলাম না,লিখন শাহ এসেছিল? এইযে ইনি।’
আমির শুষ্কমুখে বলল,’চিনি আমি। উনার অনেক কাজ(ছবি) আমার দেখা।’
শব্দর আলী,ফাতিমা,লিলি,লিখন সবাই হাসল। কেউ চিনে বললে আনন্দ হবারই কথা। রিদওয়ান আমিরকে বলল,’ জানিস আমির,লিখন বিয়ে করতে গ্রামে আসছে।’
আমির কিছু বলল না। ফরিনা জানতে চান,’পাত্রী কে? কইলা না তো?’
লিখন বুক ভরা ভালোবাসা নিয়ে বলল,’পদ্মজা। মোড়ল বাড়ির বড় মেয়ে।’

লিখনের কথা শুনে মুহূর্তে হাওলাদার বাড়ির সব মানুষের মুখ কালো হয়ে গেল।আলগ ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েগুলির কোলাহল থেমে গেল। চারিদিক স্তব্ধ, শান্ত। লিখন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কী হলো সবার! লিখন মা-বাবার সাথে চাওয়াচাওয়ি করল। মজিদ মাতব্বর শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,’তার সাথে তোমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল?’
মজিদ মাতব্বরের কথা বলার ধরণ পাল্টে যাওয়াতে লিখন আহত হলো। বলল,’না। এখন প্রস্তাব দিতে চাই।’
‘পদ্মজার সাথেই পরশু আমিরের বিয়ে।’
লিখন চকিতে চোখ তুলে তাকাল। বুক পোড়ার মতো অসহনীয় যন্ত্রনা কামড়ে ধরে সর্বাঙ্গে। হাড়ে হাড়ে বরফের ন্যায় ঠান্ডা কিছু ছুটতে থাকে। এখুনি যেন সব রগ ছিঁড়ে রক্ত বেরিয়ে আসবে।
ফাতিমা করুণ চোখে লিখনের দিকে তাকান। চোখে চোখ পড়তেই লিখন হাসার চেষ্টা করল। তার দৃষ্টি এলোমেলো। কী বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। আমির চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ‘আব্বা আসছি’ বলে জায়গা ত্যাগ করে। শব্দর আলী মজিদ মাতব্বরকে প্রশ্ন করলেন,’মজা করছেন?’

মজিদ মাতব্বর শব্দর আলীর চোখের দিকে সরাসরি চোখ রেখে জবাব দিলেন,’প্রথম পরিচয়ে মজা করার মতো মানুষ আমি নই ভাইসাহেব।’
লিলি এক হাত লিখনের পিঠের উপর রাখল।ডাকল,’ভাইয়া।’
লিখন লিলির হাতটা মুঠোয় নিয়ে ঢোক গিলল। বলল,’বিয়ে হবে না তো কী? বলেছি যখন দেখাবোই।’
‘ভাইয়া তোর চোখে জল।’
লিখন দ্রুত হাতের উল্টোপাশ দিয়ে চোখের জল মুছল। পরিবেশ থম মেরে গেছে। কেউ কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছে না। লিলি অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তার ভাইয়ার দিকে। পদ্মজা নামের মেয়েটাকে নিয়ে কত গল্প শুনেছে সে। মেয়েটা তার বয়সী শুনে লিলি খুব হেসেছিল। তার ভাইয়া এতো ছোট মেয়ের প্রেমে পড়েছে! দিনগুলো কত যে সুন্দর ছিল! মেট্রিক পরীক্ষার সময় বার বার খোঁজ নিয়েছে কবে শেষ হবে পরীক্ষা। যেদিন শেষ হলো সেদিন থেকেই শুটিং শুরু হলো। কথা ছিল এক সপ্তাহ পর থেকে শুরু হবে। কিছু জরুরি কারণে আগে শুরু হয়ে গেল। তাই আসতে কয়েকদিন দেরি হলো। মজিদ মাতব্বর স্তব্ধতা কাটিয়ে বললেন,’বিয়েটা একটা দূর্ঘটনার জন্য খুব দ্রুত ঠিক হয়েছে।’
লিখন উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,’কী দূর্ঘটনা?’

ফরিনা সন্দিহান গলায় বললেন,’তার আগে তুমি কও তো, পদ্মজার লগে কী তোমার প্রেম-ট্রেম আছিল?’
লিখন ফরিনার প্রশ্নে বিব্রতবোধ করল। ধীরকণ্ঠে জবাব দিল,’না। শুধু আমার পক্ষ থেকেই।’
লিখনের উত্তরে ফরিনা সন্তুষ্ট হলেন। শব্দর আলী কী দূর্ঘটনা ঘটেছিল জানতে চাইলেন। মজিদ মাতব্বর সময় নিয়ে ধীরে ধীরে সব বলেন। সব শুনে লিখন আশার আলো দেখতে পায়। ভাবে, এরকম একটা ঘটনা ঘটেছে তাই অন্য কেউ পদ্মজাকে বিয়ে করবে না। এমনটা ভেবেই হয়তো পদ্মজার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সে যদি এখুনি বিয়ে করতে রাজি থাকে। তাকে ফিরিয়ে না দিতেও পারে। আর পদ্মজা কী বিন্দুমাত্র ভালোবাসে না তাকে? বাসে, নিশ্চয় বাসে। লিখন নিজেকে নিজে স্বান্তনা দেয়। শব্দর আলী আফসোস নিয়ে বললেন,’কী আর করার! পরিস্থিতি হাতের বাইরে।’

‘আপনারা কিন্তু বিয়ে শেষ করে তবেই যাবেন।’ বললেন মজিদ মাতব্বর।
ফাতিমা মতামত জানালেন দৃঢ়ভাবে,’না, না আজই চলে যাব। এই গ্রামে আর এক মুহূর্ত না।’
শব্দর আলী মৃদু করে ধমকে বললেন,’কী বলছো? কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা। এখন ট্রেন পাবে কোথায়? কাল ভোরে নাহয় চলে যাব।’
রিদওয়ান অনুরোধ করে বলল,’বিয়েটা শেষ হওয়া অবধি থেকে যান। দেখুন, মেহমান হয়ে এসেই অপ্রত্যাশিত খবর শুনলেন। এজন্য খারাপ লাগছে। কিন্তু কিছু তো করার নেই। মেয়েটা জলে ভাসবে বিয়েটা না হলে।’

লিখন সঙ্গে,সঙ্গে প্রতিবাদ করে বলল,’পদ্মজাকে ফেলনা ভাবছেন কেন? কেউ অপবাদ দিলেই কী সে পঁচে যায়?’
রিদওয়ান কিছু বলতে গেলে মজিদ মাতব্বর কড়া চোখে তাকিয়ে থামতে বললেন। এরপর শিখাকে ডেকে বলেন,’উনাদের ঘরে নিয়ে যাও। আর আপনারা না করবেন না। আমি আপনাদের অবস্থা বুঝতে পারছি। বিয়ে অবধি না থাকুন। রাতটা থেকে যান।’
বাধ্য হয়ে ফাতিমা থাকতে রাজি হলেন। তিনি রাগে ফোঁসফোঁস করছেন। সব রাগ পড়েছে হাওলাদার বাড়ির উপর। মনে মনে এই বাড়ির বিনাশ চাইছেন তিনি। মেয়েটাকে তুলে নিয়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। লিখন তার চোখের মণি। নয়তো কী গ্রামের মেয়ে নিতে আসতেন! আর সেই ছেলের মন এভাবে ভাঙল! ঘরে ঢুকেই চোখের চশমা ছুঁড়ে ফেলেন বিছানায়। কটমট করে শব্দর আলীকে বললেন,’তোমার না এক বন্ধু আছে মেজর। তাকে কল করে বলো মেয়েটাকে তুলে এনে লিখনের সাথে বিয়ে দিতে। আমার ছেলেকে হারতে দেখতে পারব না।’

‘আহ! চুপ করো তো। সব জায়গায় ক্ষমতা চলে না। পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করো।’
‘কিসের পরিস্থিতি? তুমি জানো, তোমার ছেলের ব্যাক্তিগত ডায়রিতে আগে শুধু আমার নাম ছিল। সেখানে এখন বেশিরভাগ পদ্মজা নামটা লিখা। কতটা পাগল এই মেয়ের জন্য। এখন মেয়েটাকে ছেড়ে শহরে চলে গেলে,ছেলের দেবদাস রূপ দেখতে হবে। আর আমি তা পারব না।’
শব্দর আলী পায়ের মোজা খুলতে খুলতে বিরক্তি নিয়ে বললেন,’তোমার যা ইচ্ছে করো। আমি পারব না। ক্লান্ত আমি। শান্তি দাও।’
ফাতিমা কড়া কিছু কথা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। লিলি ঘরে ঢুকেছে। লিখন আসেনি। আমেনা লিলিকে বললেন,’লিখন কোথায়?’
‘কী জানি! ভাইয়া ব্যাগটা আমার হাতে দিয়ে বেরিয়ে গেল।’
রোদের কঠিন রূপ শীতল হয়ে এসেছে। মৃদু বাতাস বইছে। তবুও লিখন ঘামছে। সে পদ্মজাদের বাড়ি যাচ্ছে। আতঙ্কে ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। মাথায় শুধু কয়টা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে,’আমি কী পাগলামি করছি? এতো আয়োজন ভেঙ্গে কী আমার হাতে তুলে দিবেন পদ্মজাকে? পদ্মজা আমাকে দেখলে কী কাঁদবে? ভালোবাসেনি একটুও? মায়া নিশ্চয় জমেছে?’ লিখন আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আল্লাহর কাছে অনুরোধ করে,’আল্লাহ, সব যেন ভালো হয়।’

পূর্ণা বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে আছে। বাড়ির পিছনে গীত গাইছে অনেকে। সাথে তাল মিলিয়ে দুই বুড়ি নাচ করছে। পুরো বাড়ি সাজানো হচ্ছে রঙিন কাগজ দিয়ে। উঠানের এক কোণে লাল বড় গরু বাঁধা। বিয়ে উপলক্ষে জবাই করা হবে। চারিদিকের এতো আনন্দ পূর্ণার মন ছুঁতে পারছে না। প্রথমত, সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত! কিছুতেই স্থির হতে পারছে না। দ্বিতীয়ত, পদ্মজার জন্য লিখন শাহ ছাড়া অন্য কাউকে তার পছন্দ হচ্ছে না। সব মিলিয়ে সে বিরক্ত। চোখ ছোট করে বাচ্চাদের খেলা দেখছে। হুট করে চোখে ভাসে লিখনকে। পূর্ণা দ্রুত চোখ কচলে আবার তাকাল। সত্যি তাই। খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ে সে। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যায় পদ্মজার ঘরে। পদ্মজার কানে কান গিয়ে বলে,’লিখন ভাই আসছে। তুমি কিন্তু পালিয়ে যাবে আপা। এই বিয়ে কিছুতেই করবে না।’

কথা শেষ করে খুশিতে আবার ছুটে যায় বারান্দায়। এমন দিনে লিখনের উপস্থিতি পদ্মজাকে অপ্রস্তুত করে তুলে। গলা শুকিয়ে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। লিখন বাড়িতে ঢুকে অবাক হয়ে সব দেখে। কত আয়োজন! কত মানুষ! তার স্বপ্নের রানি পদ্মজার বিয়ে। কিন্তু তার সাথে না। ভাবতেই, লিখনের বুক ছ্যাঁত করে উঠল। মেয়েরা খুব আগ্রহ নিয়ে সুদর্শন লিখনকে দেখছে। লিখন পূর্ণাকে বারান্দায় দেখে এগিয়ে আসল। প্রশ্ন করল,’কেমন আছো পূর্ণা?’
পূর্ণা খুশিতে উচ্চকণ্ঠে জবাব দেয়,’ভালো,খুব ভালো। ভাইয়া আপনি…’
পূর্ণা থেমে গেল। অনেকে তার উচ্চ গলার স্বর শুনে তাকিয়ে আছে। তাই পূর্ণা চুপসে গেল। আস্তে আস্তে বলল,’এতো দেরিতে আসলেন কেন? আপার তো বিয়ে। আপনি আপাকে নিয়ে পালিয়ে যান।’
পূর্ণার এহেন কথায় লিখন হাসে। আদুরে কণ্ঠে জানতে চাইল,’আন্টি কোথায়?’
পূর্ণা ঝটপট করে বলল,’আপনি আসুন ঘরে। আমি আম্মাকে নিয়ে আসছি।’
লিখনকে সদর ঘরে বসিয়ে পূর্ণা ছুটে গেল রান্নাঘরে। হেমলতা রান্না করছিলেন। পাশে অনেকে আছে। পূর্ণা ইশারায় বাইরে আসতে বলে। হেমলতা হাত ধুয়ে বেরিয়ে আসেন। পূর্ণা ফিসফিসিয়ে বলে,’লিখন ভাই আসছে।’

‘কোথায়? বসতে দিয়েছিস?’
‘হ্যাঁ, দিছি। তুমি আসো।’
হেমলতা ব্যস্ত পায়ে হেঁটে সদর ঘরে আসেন। এসে দেখেন দুজন বয়স্ক মহিলা অনবরত লিখনকে প্রশ্ন করে যাচ্ছে। সে কই থেকে এসেছে? এই বাড়ির কী হয়? পদ্মজার মতো চোখ কেন? পদ্মজার আসল বাপের ছেলে নাকি। এমন আরো যুক্তিহীন কথাবার্তা। হেমলতা সবাইকে উপেক্ষা করে লিখনকে বললেন,’লিখন তুমি আমার সাথে আমার ঘরে আসো।’
লিখন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। হেমলতার পিছু পিছু চলে যায়। অনেকের নজরে তা আসে। একজন আরেকজনকের সাথে আলোচনা করতে থাকে লিখন শাহকে নিয়ে। সবাই ভেবে নিয়েছে পদ্মজা যার সন্তান এই ছেলেও তার সন্তান। এজন্যই সবার মাঝ থেকে তুলে নিয়েছে। নয়তো তো কথায় কথায় ধরা পড়ে যাবে। লিখনকে মোড়ায় বসতে দিলেন হেমলতা।

লিখন কীভাবে কী শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছে না। হেমলতা শুরু করলেন,’আমি জানি তুমি কী বলবে। তোমার দুইটা চিঠি আমি পড়েছি।’
লিখন চমকে তাকাল। আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। হেমলতা বলেন,’দেখো লিখন,পরিস্থিতি আর হাতে নেই। অন্য সময় হলে আমি পদ্মজাকে তোমার হাতে তুলে দিতাম। তুমি নম্র-ভদ্র বুদ্ধিমান ছেলে। কমতি নেই কিছুতেই। কিন্তু এখন তা সম্ভব নয়। তবুও পদ্মজা তোমাকে নিজের মুখে যদি চায় আমি তাৎক্ষণিক তাকে তোমার হাতে তুলে দেব। কিন্তু সে চাইবে না। কারণ,সে তোমাকে ভালোবাসে না। আমার কথাগুলো শুনে কষ্ট পেয়ো না। আমি সরাসরি কথা বলি। পদ্মজার দৃষ্টি,অনুভূতি আমার চেনা। সে তোমাকে ভালোবাসেনি কখনো। তোমার মন ভাঙবে ভেবে মায়া হচ্ছে। কষ্ট পাচ্ছে। তুমি বাড়ি ফিরে যাও। কষ্ট হবে ভেবেই বলছি ফিরে যাও।’
লিখন কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকে। চোখের দৃষ্টি রাখা মাটিতে। বলল,’আন্টি মেয়ের ভালোবাসা দেখছেন, অন্যের সন্তানেরটা দেখবেন না?’

‘অন্যের অনেক সন্তানই আমার মেয়েকে ভালবাসে। সবার কথা ভাবা কী সম্ভব?’
হেমলতার কথায় ভীষণ আহত হয় লিখন। তার মনে হচ্ছে সে কঠিন পাথরের সাথে কথা বলছে। দুই চোখ জ্বলছে ভীষণ। এখুনি কান্নারা ঠেলেঠুলে বেরিয়ে আসবে। ছেলে হয়ে কাঁদা ভীষণ লজ্জার ব্যাপার। লিখন নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল। হেমলতা কঠিন স্বরে বললেন,’তুমি পদ্মজার রূপের প্রেমে পড়েছো লিখন।’

লিখন সঙ্গে সঙ্গে চোখ তুলে তাকায়। বলে,’আন্টি ক্ষমা করবেন কিছু কথা বলি। পৃথিবীতে যে কয়টা সফল প্রেমের গল্প আছে তার মধ্যে ৯৯ ভাগ সৌন্দর্যের টান দিয়ে শুরু হয়। এরপর আস্তে আস্তে ভালোবাসা গভীর হয়। মানুষটাকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে,মানুষটাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে গিয়ে ভালোবাসাটা আকাশ ছুঁয়ে ফেলে। সময়ের ব্যবধানে সে মানুষটা শিরা উপশিরায় বিরাজ শুরু করে। তখন তার অন্যান্য গুণ চোখে ভাসে। ভালবাসা আরো বাড়ে। কারো কারো তো দোষও ভালো লেগে যায়। তখন অবস্থা এরকম হয় যে, রূপ নষ্ট হয়ে গেলেও মানুষটাকে আমার চাই। এজন্যই বুড়ো বয়সেও কুঁচকে যাওয়া মানুষটাকেও ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। অথচ শুরুটা হয় সৌন্দর্য দিয়ে। আন্টি,আমি পদ্মজার রূপে মুগ্ধ হয়ে ছিলাম এটা সত্যি। কিন্তু গত কয়েক মাসে সারাক্ষণ পদ্মজাকে ভাবতে গিয়ে আমি সত্যি সত্যি পদ্মজাকে ভালোবেসে ফেলেছি। পদ্মজার রূপ আগুনে ঝলসে গেলেও এমন করেই বাসবো। প্লীজ আন্টি কথাগুলো শুটিংয়ের ডায়লগ ভেবে উড়িয়ে দিবেন না। বাস্তব জীবনে মুখস্থ ডায়লগ আমি আওড়াই না।’

লিখনের কণ্ঠ গম্ভীর কিন্তু চোখে জল ছলছল করছে। হেমলতা স্তব্ধ হয়ে যান। কী জবাব দিবেন? ভালোবাসার বিরুদ্ধে কোন শক্তি কাজে লাগে? আদৌ কী ভালবাসার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যায়? তিনি সময় নেন। এরপর বলেন,’আমার পদ্মজা তোমার কাছে খুব ভাল থাকতো লিখন। কিন্তু কিছু সমস্যা সমাজে আছে। যার মুখোমুখি আমি হয়েছি। জেনেশুনে আমার মেয়েকে সেসবের মুখোমুখি কি করে হতে দেই?’
লিখন হাতজোড় করে বলল,’প্লীজ আন্টি!’

হেমলতা একদৃষ্টে লিখনের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। এমন তো কখনো হয় না। পদ্মজার জন্মের পর সিদ্ধান্তহীনতায় তিনি কখনো ভুগেননি। যেকোনো একটাই বেছে নিয়েছেন। আর তাতেই মঙ্গল হয়েছে। এবার কেন এমন হচ্ছে? কেন তিনি নিজের অবস্থান থেকে সরে যাচ্ছেন। পদ্মজার জীবন নিয়ে তিনি যেন মাঝ নদীতে ভেসে আছেন। চারদিকে স্রোত। মাঝি নেই,বৈঠা নেই। আমির না লিখন? কার কাছে ভাল থাকবে পদ্মজা? হেমলতার শরীর ভীষণ খারাপ লাগছে। তিনি দূর্বল কণ্ঠে বলেন,’এতো বুঝো যখন নিজেকেও সামলাতে পারবে। বাড়ি ফিরে যাও।’
‘আন্টি,আমার বেঁচে থাকতে কষ্ট হবে।’

‘পদ্মজার সাথে যা হয়েছে তবুও সে বেঁচে আছে। আর তুমি এইটুকু মানিয়ে নিতে পারবে না?’
লিখন আর কথা খুঁজে পেল না। আহত মন নিয়ে উঠে দাঁড়াল। হেমলতা দাঁড়াতে বললেন। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, তবুও হেঁটে এগিয়ে আসেন। লিখনের সামনে এসে দাঁড়ান। বললেন,’নিজেকে শক্ত রেখো। অনেক দূর চলা বাকি। কারো জন্য কারো জীবন থেমে থাকে না। ভাগ্যে যা থাকে তাই হয়। সব যেহেতু আয়োজন হয়ে গেছে আর ভেবে লাভ নেই। তবে, কবুল বলার আগেও যদি পদ্মজা বলে, তার তোমাকেই চাই। আমি সব ভেঙেচুরে পদ্মজাকে নিয়ে ছুটে যাব তোমার বাড়ি। আমি আমার মেয়েটাকে ভীষণ ভালোবাসি বাবা। এই মেয়েটার সুখের জন্য আমি স্বার্থপর হয়েছি। অন্যের সন্তানের কষ্ট চোখে ভেসেও, ভাসছে না। আমাকে ক্ষমা করে দিও।’

হেমলতার চোখে জলের ভীর। লিখন ভীষণ অবাক হয়ে দেখে এই কঠিন মানুষটাকে। হেমলতা নিজের দূর্বলতা, নিজের কান্না কেন দেখাল লিখনকে? লিখন জবাব খুঁজে পেল না। শুধু এইটুকু বুঝতে পারল হেমলতার কাছে জীবন মানে পদ্মজা। লিখন ভাঙা গলায় ‘আসি’ বলে চলে গেল। হেমলতা সব কাজ ভুলে গুটিসুটি মেরে বিছানায় শুয়ে পড়েন। চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা জল বেরিয়ে আসে। মনের শক্তি কমে গেছে। দূর্বল হয়ে পড়েছেন তিনি। নিজের উপর বিশ্বাস, আস্থা পাচ্ছেন না। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা খুঁজে পাচ্ছেন না।
বারান্দার গ্রিলে হাত রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে পদ্মজা।
তার পরনে শাড়ি রয়ে গেছে। আকাশের বুকে থালার মতো একখান চাঁদ। চাঁদের আলোয় চারদিক ঝিকমিক করছে। চারপাশ থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। খুব সুন্দর দৃশ্য।

‘পদ্ম…’
পদ্মজা কেঁপে উঠে,পিছনে ফিরে তাকাল। মোর্শেদকে দেখতে পেয়ে গোপনে হাঁফ ছাড়ল । মোর্শেদ বললেন,’তোর মায়ে কী আর উঠে নাই?’
‘না,আব্বা।’
মোর্শেদ চিন্তিত ভঙ্গিতে কিছু ভাবলেন। তারপর বলেন,’তুই হজাগ ক্যান? যা ঘরে গিয়া ঘুমা। আমি ঘাটে যাইতাছি।’
‘আচ্ছা,আব্বা।’
মোর্শেদের যাওয়ার পানে পদ্মজা তাকিয়ে রইল। সে কী যেন ভাবছে কিন্তু কী ভাবছে ধরতে পারছে না। কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাকে উদাসীনতা কেটে গেল। শাড়ির আঁচল টেনে সাবধানে হেঁটে সদর ঘরে ঢুকল। সদর ঘরে পাটি বিছিয়ে দূর দূরান্ত থেকে আসা আত্মীয়রা ঘুমাচ্ছে। তাদের ডিঙিয়ে পদ্মজা হেমলতার ঘরে আসে। হেমলতা ঘুমাচ্ছেন বেঘোরে। শুনেছিল,লিখন শাহ কে নিয়ে তার মা নিজ ঘরে এসেছিলেন। এরপর কী হলো কে জানে! সন্ধ্যার পর পূর্ণা গিয়ে জানাল,আম্মা ঘুমাচ্ছে। হেমলতা কখনো সন্ধ্যা সময় ঘুমান না। তাই পদ্মজা ঘোমটা টেনে হেমলতার ঘরে ছুটে আসে। হেমলতাকে এত শান্তিতে ঘুমাতে কখনো দেখেনি পদ্মজা। তাই আর ডাকেনি। কেউ ডাকতে আসলে, তাড়িয়ে দিয়েছে। ঘুমাচ্ছে যখন ঘুমাক না। এখন মধ্য রাত। পদ্মজা হেমলতার মুখের সামনে মাটিতে বসে।

একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। গলা কাঁপছে তার। শ্বশুর বাড়ি কীভাবে থাকবে সে! মাকে ছাড়া দুইদিন থাকতে গিয়ে এতো বড় ঝড় বয়ে গেল। আর এখন সারাজীবনের জন্য মায়ের ছায়া ছেড়ে দিতে হবে। এই মুখটা না দেখলে তার দিন কাটে না। এই মানুষটার আদুরে,শাসন ছাড়া দিন সম্পূর্ণ হয় না। পদ্মজা বিছানায় মাথা ঠুকে ফুঁপিয়ে উঠল। অস্ফুট করে ডাকল,’আম্মা।’
সঙ্গে সঙ্গে হেমলতা চোখ খুলেন। পদ্মজা খেয়াল করল না। সে কাঁদতে কাঁদতে চাপা স্বরে বলছে,’তোমাকে ছাড়া কেমনে থাকব আম্মা! বিয়ে করাটা কী খুব দরকার ছিল।’
‘ছিল।’
পদ্মজা চমকে উঠে মাথা তুলল। গলার স্বর আগের অবস্থানে রেখে বলল,’কেন আম্মা?’
‘সব জানতে নেই মা।’
পদ্মজা মাথা নত করে নাক টানে। হেমলতা বললেন,’বিয়ে হতেই হবে। বর বদল হলে সমস্যা নেই। তোর কী আর কাউকে পছন্দ?’

হেমলতার প্রশ্নে পদ্মজা বিব্রত হয়ে উঠল। হেমলতাও প্রশ্নটা করতে গিয়ে অস্বস্থি বোধ করেন। পদ্মজা মাথা দুই পাশে নাড়িয়ে জানাল, তার আলাদা করে কাউকে পছন্দ নেই। হেমলতা উঠে বসেন। চুল খোঁপা করতে করতে প্রশ্ন করেন,’রাত কী খুব হয়েছে? মানুষের সাড়া নেই।’
‘মাঝ রাত।’
‘আর তুই জেগে থেকে কাঁদছিস?’ হেমলতা বললেন। মৃদু ধমকের স্বরে।
পদ্মজা নিরুত্তর। হেমলতা জানালার বাইরে চেয়ে দেখলেন,চাঁদের আলোয় চারিদিক উজ্জ্বল। চাঁদের আলো গলে ঘরের মেঝেতে পড়ছে। জ্যোৎস্না রাত। তিনি বিছানা থেকে নামতে নামতে পদ্মজাকে তাড়া দেন,’শাড়ি পাল্টে সালোয়ার-কামিজ পরে নে।’
‘কেন আম্মা?’
‘যা বলছি কর।’
পদ্মজা ঘরে গিয়ে শাড়ি পাল্টে নিল। উঠানে এসে দেখে,হেমলতার হাতে বৈঠা। পদ্মজা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,’আম্মা,তুমি নৌকা চালাবা?’

‘পূর্ণারে নেব? নেওয়া উচিত। যা ওকে ডেকে নিয়ে আয়। প্রান্ত,প্রেমা যেন টের না পায়।’
পদ্মজা অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। হেমলতা তাড়া দেন,’যাবি তো।’
পদ্মজা হন্তদন্ত হয়ে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যে পূর্ণাকে নিয়ে ফিরল। পূর্ণা ঘুমে ঢুলছে। হেমলতা ঘাটে এসে দেখেন মোর্শেদ নৌকায় বসে বিড়ি ফুঁকছেন।
‘নৌকা ছাড়ো।’
মোর্শেদ দুই মেয়ে আর বউকে দেখে হকচকিয়ে গিয়েছেন। তার মধ্যে হেমলতা যেভাবে বললেন,নৌকা ছাড়ো, আরো ভড়কে গেলেন। চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করলেন,’ক্যান? কিতা অইছে?’
মোর্শেদের জবাব না দিয়ে পদ্মজা,পূর্ণাকে নিয়ে হেমলতা নৌকায় উঠে পড়েন। স্থির হয়ে বসেন। বৈঠা মোর্শেদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলেন,’জ্যোৎস্না রাতের নৌকা ভ্রমণে বের হয়েছি আমরা। তুমি এখন আমাদের মাঝি।’
হেমলতা থামেন। এরপর আঞ্চলিক ভাষায় বললেন,’লও মাঝি বৈঠা লও। ছাড়ো তোমার নৌকা। যত সিকি চাইবা তুমি ততই পাইবা।’

একসাথে চারটা দুঃখী মানুষ হেসে উঠে। মোর্শেদ বৈঠা হাতে নিয়ে নৌকা ছাড়েন। হুট করেই যেন অনুভব করছেন, যুবক কালের রক্ত শরীরে টগবগ করছে। এইতো তার সংসার, এইতো তার আনন্দ।
রাতের নির্মল বাতাস। মাদিনী নদীর স্বচ্ছ জলে চাঁদের প্রতিচ্ছবি। কচুরিপানারা ভেসে যাচ্ছে। সবকিছু সুন্দর মুগ্ধকর। পূর্ণার বুকের ভারটা খুব হালকা লাগছে। পদ্মজা প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়। রগে রগে শান্তি ঢুকে পড়ে। আল্লাহ তায়ালা যেন প্রকৃতির সৌন্দর্যে যেকোনো দুঃখী মানুষকে সুখী অনুভব করানোর মন্ত্র ঢেলে দিয়েছেন।
‘মোর্শেদ নাকি গো?’
হিন্দুপাড়া থেকে কেউ একজন চেঁচিয়ে ডাকল। মোর্শেদ এক হাত তুলে জবাব দিলেন,’হ দাদা আমি।’
‘রাইতের বেলা যাইতাছ কই?’
‘মেয়ে-বউ লইয়া জ্যোৎস্না পোহাইতে বাইর হইছি দাদা।’
‘তোমাদেরই দিন মিয়া।’

মোর্শেদ আর কিছু বললেন না। হাসলেন। ওপাশ থেকেও আর কারো কথা শোনা গেল না। নৌকা আটপাড়া ছেড়ে হাওড়ে ঢুকে পড়েছে। সাঁ,সাঁ করে বাতাস বইছে। গায়ের কাপড় উড়ছে। হেমলতা দুই মেয়ের মাঝে এসে বসেন। তিনি চাদর নিয়ে এসেছেন। দুই মেয়েকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে চাদরে ঢেকে দেন। বাতাসে চাদর উড়ে আরো আওয়াজ তুলছে। চাঁদটা একদম মাথার উপর। তাদের সাথে সাথে ঘুরছে! মোর্শেদ মনের সুখে গান ধরেন-
লোকে বলে বলেরে
ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার
কি ঘর বানাইমু আমি শূণ্যেরও মাঝার।।
ভালা কইরা ঘর বানাইয়া
কয়দিন থাকমু আর
আমি কয়দিন থাকমু আর
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি
পাকনা চুল আমার।
লোকে বলে ও বলেরে
ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার।।

পাকনা চুল আমার বলতেই পূর্ণা ফিক করে হেসে ফেলল। পদ্মজাকে ফিসফিসিয়ে বলল,’আব্বা বোধহয় এখনো জোয়ান থাকতে চায়।’
পদ্মজা হেসে চাপা স্বরে বলে,’চুপ থাক। আব্বা কী সুন্দর গায়।’
মোর্শেদ গেয়ে যাচ্ছেন-
এ ভাবিয়া হাসন রাজা
হায়রে,ঘর-দুয়ার না বান্ধে
কোথায় নিয়া রাখব আল্লায়
কোথায় নিয়া রাখব আল্লায়
তাই ভাবিয়া কান্দে।।
লোকে বলে ও বলেরে
ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার।।
জানত যদি হাসন রাজা
হায়রে,বাঁচব কতদিন
বানাইত দালান-কোঠা
করিয়া রঙিন।।
লোকে বলে ও বলেরে
ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার।।

মোর্শেদ থামেন। তিন মা-মেয়ে একসাথে হাতের তালি দিল। হাতের তালিতে চারপাশ মুখরিত হয়ে উঠল। এতো সুন্দর সময়! এতো সুন্দর রাত বার বার ফিরে আসুক। মোর্শেদ হা করে তাকিয়ে থাকেন সামনে থাকা তিনটা মানুষের দিকে। তাদের চোখেমুখে খুশি ঝিলিক মারছে। অথচ,তিনি জানেন একেকজন কতোটা দুঃখী। মোর্শেদ ঢোক গিলে লুকায়িত এক সত্যের কষ্ট লুকিয়ে যান। হেমলতা আর তিনি ছাড়া এই কলিজা ছেঁড়া কষ্ট কেউ জানে না। মোর্শেদ হেসে বললেন,
‘এই অভাগা মাঝিরে কী আপনারা আপনাদের মাঝে জায়গা দিবেন?’
মোর্শেদের কণ্ঠে শুদ্ধ ভাষায় মিষ্টি আবদার শুনে পদ্মজা পুলকিত হয়ে উঠল। ইশ! আজ সব কিছু কত সুন্দর! পূর্ণা বলে,’দেব। এক শর্তে, নৌকা চালানোর বিনিময়ে সিকি যদি না নেন।’

মোর্শেদ মেয়ের রসিকতা দেখে হা হা করে হাসেন। সেই হাসি বার বার প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে কানে। তিনি বৈঠা রেখে এগিয়ে আসেন। হেমলতার সামনে বসেন। নৌকা নিজের মতো যেদিকে ইচ্ছে ছুটে চলছে। মোর্শেদ হেমলতাকে বলেন,’দুইডা ছেড়িরে খালি তুমি ধইরা রাখবা? ছাড়তো এইবার। আয়রে তোরা আমারে ধারে আইয়া ব।’
পদ্মজা অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকায়। হেমলতা যেতে বলেন। পদ্মজা মোর্শেদের ডান পাশে বসে,আর পূর্ণা বাম পাশে। মোর্শেদ পূর্ণাকে এক হাতে, পদ্মজাকে আরেক হাতে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠেন। অপরাধী স্বরে বলেন,’আমি বাপ হইয়া পারি নাই আমার ছেড়িদের বেইজ্জতির হাত থাইকা রক্ষা করতে। আমারে মাফ কইরা দিস তোরা।’

মোর্শেদ কখনো এতো আদর করে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরেননি। এই প্রথম ধরেছেন। আবার কাঁদছেন। পদ্মজার কোমল,নরম মন ব্যথিত হয়ে চোখ বেয়ে জল রূপে বেরিয়ে আসে। হেমলতা মোর্শেদের পায়ের কাছে বসেন। মোর্শেদের হাঁটুতে মাথা রেখে, দুই মেয়ের হাত চেপে ধরে রাখেন। কেটে যায় অনেক মুহূর্ত। নৌকা হাওড়ের পানির স্রোতে একবার এদিক তো আরেকবার ওদিক যাচ্ছে। বাতাসে চার জনের চোখের জল শুকিয়ে ত্বকের সাথে মিশে গেছে। নিস্তব্ধতা ভেঙে পদ্মজা বলল,’জানো আম্মা, আজ আমি বুঝলাম, জীবনে সুখ বা দুঃখ কোনোটাই চিরস্থায়ী নয়। দুঃখে মর্মাহত না হয়ে সুখের সময়টা তৈরি করে নিতে হয়। তাহলেই জীবনে সুখকর মুহূর্ত আসে। আবার সুখ সর্বক্ষণ সাথে থাকে না। দুনিয়ার লীলাখেলার শর্তে দুঃখ বার বার ফিরে আসে।’
হেমলতা পদ্মজার দিকে না তাকিয়ে,পদ্মজার ডান হাতে চুমু দেন। চাঁদটা অর্ধেক হয়ে এসেছে। খুব তাড়াতাড়ি আকাশে মিলিয়ে যাবে।

হাওরে বিশাল জলরাশি। কখনো ঢেউয়ে উথাল-পাতাল, আবার কখনো মৃদু বাতাসে জলের ওপর চাঁদের প্রতিচ্ছবির খেলা। নৌকা বাজারের দিকে যাওয়ার পথ ধরেছে। তাই মোর্শেদ নিস্তব্ধ বৈঠক ভেঙে বৈঠা নিয়ে বসেন। নৌকা নিয়ন্ত্রণে এনে রাধাপুর হাওড়ের দিকে যেতে থাকেন। ওড়নার ঘোমটার আড়ালে কখন খোঁপা খুলে গেছে পদ্মজা খেয়াল করেনি। হেমলতা খেয়াল করেন পদ্মজার চুল হাওড়ের জলে ডুবে আছে। তিনি মৃদু স্বরে পদ্মজাকে বললেন,’চুল ভিজে যাচ্ছে পদ্ম।’
পদ্মজা দ্রুত সামলে নিল। খোঁপা করে ঘোমটা টেনে নিয়ে বলল,’কখন খুলে গেছে খেয়াল করিনি।’
অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। হেমলতা চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছেন এক মনে। পদ্মজা ডাকল,’আম্মা?’
হেমলতা অশ্রুভরা চোখে তাকালেন। পদ্মজা কিছু বলার আগে তিনি বললেন,’পূর্ণা গল্প শুনবি?’
পূর্ণা গল্প বলতে পাগল। সে গল্প শুনতে খুব ভালবাসে। খুশিতে বাকবাকুম হয়ে বলল,’শুনব।’

‘কষ্টের গল্প কিন্তু।’
‘গল্প হলেই হলো।’
হেমলতা হাসেন। পদ্মজা নড়েচড়ে বসে। সে আন্দাজ করতে পারছে তার মা কোন গল্প বলবে। হেমলতা দু’হাতে জল নিয়ে মুখ ধুয়ে নেন। এরপর একবার মোর্শেদের দিকে তাকিয়ে হাসেন। পিছন ঘুরে বসে প্রশ্ন করেন,’মুখ না দেখে গল্প শুনতে ভাল লাগবে?’
পূর্ণা মুখ গোমড়া করে না বলতে যাচ্ছিল। পদ্মজা এক হাতে খপ করে ধরে আটকে দিল। মাকে বলল,’সমস্যা নেই আম্মা। যেভাবে ইচ্ছে বলো।’

হেমলতা বড় করে দম নিয়ে বলা শুরু করলেন,’আব্বার প্রথম স্ত্রী মারা যায় অল্প বয়সে। আব্বা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। একজন বুদ্ধিমান, উদার মনের মানুষ ছিলেন। আম্মাকে যৌতুকের জন্য ধাক্কা মেরে বের করে দিল তার প্রথম স্বামী। মুখে তালাক দিল। বাপের সংসারে এসে সমাজের তোপে পড়তে হয় আম্মাকে। আব্বার উদার মন অবলা,অসহায় আম্মাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন।তিনি আমার নানার কাছে প্রস্তাব রাখেন। নানা সানন্দে রাজি হয়ে যান। রাজি হবেনই না কেন? স্বামীর বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া বিবাহিত নারীকে কে ই বা বিয়ে করতে চায়? আম্মা,আব্বার বিয়ের বছর দেড়েক হতেই হানি আপার আগমন। তার দুই বছরের মাথায় আমার আগমন ঘটে।’
‘সেদিন নিশ্চয় গাছে গাছে ফুল ফুটেছে।’ পদ্মজা বলল,পুলকিত হয়ে।

হেমলতা ম্লান হাসেন। বলেন,’শুনেছি আমার গায়ের রং দেখে আম্মা নাক কুঁচকেছিলেন। আমার বয়স যখন তিন মাস আম্মার আগের স্বামী আম্মাকে ফিরিয়ে নিতে আসে। আব্বার তখন আর্থিক সমস্যা বেশি ছিল। দিনে দুই বেলা খাওয়া সম্ভব ছিল না। বিপদে পাশে থাকা আমার আব্বাকে ছেড়ে,দুই বছরের এক মেয়ে আর তিন মাসের এক মেয়েকে ছেড়ে স্বার্থপর মা পালিয়ে গেল প্রথম স্বামীর কাছে। আব্বা ছোট ছোট দুই মেয়েকে নিয়ে মাঝ নদীতে পড়েন। কিন্তু আল্লাহ সহায় ছিলেন। আব্বার ফুফু চলে আসেন আমাদের কাছে। আপা আর আমার দায়িত্ব নেন। হুট করেই আব্বার আর্থিক অবস্থা উন্নত হতে থাকে। গৃহস্থিতে রহমত ঝরে পড়ে। পাঁচ বছর পর আম্মা ফিরে আসেন। বিধ্বস্ত অবস্থা। ফর্সা মুখ মারের চোটে দাগে দাগে বিশ্রি হয়ে গেছে। শুধু একা আসেনি। দুই বছরের এক ছেলে নিয়ে ফিরেন। তখন আমাদের কুঁড়ে ঘরের বদলে বিশাল বাড়ি হয়েছে। আব্বা প্রথম মানেননি। আম্মা আব্বার পায়ে পড়ে কাঁদেন। ক্ষমা চান। আব্বা আবার আগের ভুল করেন। মেনে নেন আম্মাকে। আম্মার ছেলের নাম বিনোধ ছিল, আব্বা নতুন নাম দেন হানিফ। আম্মা আমাকে সহ্য করতে পারতেন না। আব্বার চোখের মণি ছিলাম। আব্বার আড়ালে আম্মার দ্বারা নির্যাতিত হতে থাকি। ছয় বছর হতেই স্কুলে ভর্তি করে দেন আব্বা। হানি আপা তখন স্কুলে পড়ে। আমি…”

‘থামলে কেন আম্মা?’ বলল পদ্মজা,অধৈর্য্য হয়ে।
হেমলতা ভ্রুকুটি করে বলেন,’আর বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না আম্মার ব্যাপারে। আম্মা অনুতপ্ত এখন। আফসোস করেন। কাঁদেন। বলতে ভাল লাগছে না।’
শীতল বাতাসে সবার শরীর কাঁটা দিচ্ছে। চাঁদটা ছোট হয়ে গেছে অনেক। মোর্শেদ এক ধ্যানে বৈঠা দিয়ে জল ঠেলে দিচ্ছেন দূরে নৌকা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন সামনে। হেমলতা আবার বলতে শুরু করেন,’মেট্রিক দেয়ার পর আম্মা পড়াতে চাইছিল না। আব্বার জন্য ঢাকার কলেজে পড়ার সুযোগ পাই। হোটেলে উঠি। আব্বা নিয়মিত টাকা পাঠাতেন। জানিস পদ্ম, কলেজে আমি সবার ছোট ছিলাম। সবাই হা করে তাকিয়ে থাকতো। শাড়ি পরতাম বলে একটু বড় লাগতো অবশ্য। সবসময় সুতি শাড়ি পরে বেণী বেঁধে রাখতাম। কারো সাথে মিশতাম না। ভয় পেতাম খুব। ভীষণ ভীতু ছিলাম। রিমঝিম নামে খ্রিষ্টান এক মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব হয়। মেয়েটা এতো সুন্দর ছিল দেখতে। ঠিক পদ্মজার মতো সুন্দর। চোখের মণি ছিল ঘোলা। তার নাকি শ্যামলা মানুষ ভাল লাগে তাই নিজে যেচে আমার সাথে বন্ধুত্ব করে। কয়েকদিনের ব্যবধানে আমরা খুব ঘণিষ্ঠ হয়ে পড়ি। ইংলিশে যাকে বলে,বেস্ট ফ্রেন্ড। রিমঝিমের সাথে মাঝে মাঝে ওর বড় ভাই আসতো। নাম ছিল যিশু। যিশু একদম রিমঝিমের আরেক রূপ।চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য ছিল দুই ভাই-বোনের। যিশু ভাইয়া বলে ডাকতাম তাকে। যিশু ভাইয়া মজা করে বলতেন,’ধর্ম এক হলে হেমলতাকেই বিয়ে করতাম।’ পূর্ণা,পদ্মজা খারাপ লাগছে শুনতে?’

‘না আম্মা।’ এক স্বরে বলল দুজন। পদ্মজা বলল,’পরে কী হয়েছে আম্মা?’
‘তখন অলন্দপুর থেকে দুই সপ্তাহ লাগতো রাজধানীতে চিঠি পৌঁছাতে। কলেজ ছুটির পথে হানি আপার চিঠি পাই। পাশে রিমঝিম ছিল। যিশু ভাইয়া সবেমাত্র এসেছেন রিমঝিমকে নিয়ে যেতে। চিঠি পড়ে জানতে পারি,আব্বা হাওড়ে গিয়েছিলেন মাছ ধরতে। আব্বার পাশের নৌকায় সুজন নামে এক ছেলে ছিল। আব্বার নৌকায় চেয়ে কয়েক হাত দূরে। তখন ভারী বর্ষণ হচ্ছিল। বজ্রপাত হচ্ছিল একটার পর একটা। একটা বজ্রপাত সুজনের উপর পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে সুজন ঝলসে যায়। আব্বা ছিটকে পড়েন জলে। দূর থেকে এক দল জেলে ঘটনাটি দেখতে পায়। তারা আব্বাকে তুলে নিয়ে যায় বাড়িতে। এরপর থেকেই আব্বা কানে শুনতে পায় না। ঠিক করে হাঁটতে পারে না। মস্তিষ্ক অচল হয়ে পড়ে। এই খবর শোনার পর হাউমাউ করে কান্না শুরু করি। যিশু ভাই সব শুনে,আমার কান্না দেখে বলেন,বিকেলের ট্রেনে অলন্দপুর নিয়ে যাবেন। আমি তখনও কাঁদছিলাম। একবার শুধু অলন্দপুর যেতে চাই। আব্বাকে দেখতে চাই। যদিও জানতাম,অনেকদিন হয়ে গেছে এই দূর্ঘটনার।

আটপাড়া পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে যায়। বাড়ি এসে দেখি সদর ঘরের দরজায় তালা মারা। কেউ নেই বাড়িতে। মুরগি আর গরু-ছাগল ছাড়া। বারান্দার ঘরে দরজা ছিল না। ঘরও বলা যায় না। শুধু একটা চৌকি ছিল। বড্ড ক্লান্ত ছিলাম। চৌকিতে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম ভাঙে আম্মার চেঁচামেচিতে। যিশু ভাই নিজের অজান্তে আমার পাশে কখন ঘুমিয়ে পড়েন বুঝেননি। তিনি আমার মতোই ক্লান্ত ছিলেন। আমার জন্মদাত্রী মা গ্রামবাসী ডেকে চেঁচাতে থাকেন। হাতেনাতে ধরার মতো অবস্থা ছিল। অবস্থা বেগতিক দেখে ভড়কে যাই। কিছু বলতে পারিনি। যিশু ভাই সবাইকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করে, কেউ বুঝেনি। তখন নিয়ম খুব কঠিন ছিল। যিশু ভাই খ্রিষ্টান শুনে সবাই আরো ক্ষেপে যায়। আব্বার সামনে আমাদের দুজনের মাথা ন্যাড়া করে দিল গ্রামবাসী। কোমর সমান চুল ছিল আমার। মাথা ন্যাড়া করতে গিয়ে মাথার চামড়া ছিঁড়ে ফেলে। রক্ত আসে গলগল করে।

আম্মার তখন হুঁশ আসে। আমাকে বাঁচাতে আসে,পারেনি। গায়ের রং কালো তার উপর রক্তাক্ত ন্যাড়া মাথা। কী যে বিশ্রি রূপ হয়েছিল। আমি আমার একমাত্র ভরসা আব্বাকে চিৎকার করে ডেকে কেঁদেছি। আব্বা শুনেনি। আমার দিকে হা করে শুধু তাকিয়েছিল। যিশু ভাইয়াকে অনেক মারধর করে। সেদিন রাতেই আহত যিশু ভাইয়াকে ছুঁড়ে ফেলে আসে নদীর পাড়ে। গরুর ঘরে গোবরের উপর বেঁধে রাখে আমাকে। দূরদূরান্তরের মানুষ দেখতে আসে। আমি তখন নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে নিজের মৃত্যু কামনা করেছি। একবার বাঁধনছাড়া হলে আত্মহত্যা করব ভাবি। হাত বাঁধা ছিল। দাঁত দিয়ে নিজের হাঁটুতে বোকার মতো কামড় দিতে থাকি একটার পর একটা, যাতে মরে যাই। যে ই দেখতে আসতো সেই বিশ্রি গালি দিয়ে যেত। কেউ কেউ লাথি দিয়েছে। রাধাপুরের হারুন রশীদ আছে না? উনার আব্বা তখন অলন্দপুরের মাতব্বর ছিলেন। উনার গোয়ালঘরেই বন্দি ছিলাম।।দুই দিন পর আমাকে ছাড়ে। ছাড়া পেয়েই ইচ্ছে হচ্ছিল, গলায় কলসি বেঁধে ছুটে গিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেই। কিন্তু পারিনি। শরীরে একটুও শক্তি ছিল না। দৌড়ে পালাতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ি গোয়ালঘরের বাইরে। ধারালো কিছু একটা ছিল মাটিতে। মাটিতে পড়তেই হাতের বাহু ছিঁড়ে গলগল রক্তের ধারা নামে। এই যে আমার বাহুর দাগটা। এটা সেদিনই হয়েছে।’

হেমলতা মেয়েদের দাগটা দেখানোর জন্য ঘুরে তাকান। দেখেন তার দুই মেয়ে মুখে হাত চেপে কাঁদছে। হেমলতা হাসার চেষ্টা করে বললেন,’তোরা মরাকান্না শুরু করেছিস কেন?’
হেমলতার কথা শেষ হতেই ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুই মেয়ে ছুটে আসে তার দিকে। নৌকা দুলে উঠে। হেমলতা চমকে গিয়ে দ্রুত নৌকা ধরেন। চিৎকার করে উঠেন,’আরে…’
কথা শেষ করতে পারেননি। তার পূর্বেই বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুই মেয়ে। জড়িয়ে ধরেই আম্মা আম্মা বলে কাঁদতে থাকে। দুই মেয়ে এতো শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে যে,হেমলতার মনে হচ্ছে এখুনি দম বেরিয়ে যাবে। থামার কোনো লক্ষণ নেই। হেমলতা দুজনের পিঠে হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দেন। কিছুতেই কিছু হয় না। তারা কেঁদে চলেছে। হেমলতা মোর্শেদের উদ্দেশ্যে বলেন,’নৌকা ঘুরাও। এদের আর কিছু বলব না। আর ঘুরব না।’

পদ্মজা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে বলল,’আর কাঁদব না। পূর্ণা আর কাঁদিস না। কিন্তু তোমাকে জড়িয়ে রাখব।’
হেমলতা পদ্মজার মাথায় চুমু দিয়ে বললেন,’আমাদের এক ঘরে করে দেওয়া হলো। বাজারে ভেষজ উপায়ে আব্বার চিকিৎসা চলছিল। সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। কেউ আমার পরিবারের মুখও দেখতে চায় না। দেখলেই এটা ওটা ছুঁড়ে দিত। বলা হয়নি,সেদিন রাতে আব্বা,আম্মা,হানিফ মামার বাড়ি ছিল। মামার বাড়ির পাশের বাড়িতে ডাক্তার ছিল একজন। আব্বাকে দেখাতে গিয়েছিল। হানি আপার বিয়ে দেয়ার জন্য আম্মা উঠেপড়ে লাগে। তখন হিমেল আম্মার পেটে। সাত মাস চলে। আমার উপর আম্মার মার প্রতিদিন চলতেই থাকে। আমার জন্য পরিবারের এতো ক্ষতি হলো। হানিফ স্কুলে যেতে পারে না। সবাই দূর দূর করে। হানি আপার বিয়ে হয় না। আব্বার চিকিৎসা হয় না। বিপদ-আপদে কেউ পাশে আসে না। ওদিকে হিমেল আসার সময় ঘনিয়ে আসছে। কোনো দাত্রী আসেনি। আম্মা একা যুদ্ধ করে হিমেলকে জন্ম দিল। সব মিলিয়ে জীবনটা নরক হয়ে উঠে আমার। বছর দুয়েকের মধ্যে আব্বা কিছুটা সুস্থ হয় আল্লাহর রহমতে। হাঁটাচলা করতে পারেন। আগের মতো সবকিছু না বুঝলেও মোটামুটি বুঝতেন। হানি আপার বিয়ে ঠিক হলো। বনেদি ঘর থেকে প্রস্তাব আসে। শর্ত পাঁচ বিঘা জমি দিতে হবে। আমাদের জমি ছিল সাড়ে পাঁচ বিঘা। আম্মা পাঁচ বিঘা জমি দিয়েই হানি আপার বিয়ে দিলেন। সবকিছু স্বাভাবিক হয়। যদিও মাঝে মাঝে অনেকে কথা শুনিয়েছে। একসময় আমার বিয়ের প্রস্তাব আসে। তোদের আব্বার সাথে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যে জানতে পারি তোদের আব্বার দ্বিতীয় স্ত্রী আমি।’

শেষ কথাটা হেমলতা মোর্শেদের দিকে তাকিয়ে বলেন। মোর্শেদ চোখের দৃষ্টি সরিয়ে নত হন। পূর্ণা খুব অবাক হয়ে মোর্শেদের দিকে তাকাল। হেমলতা পূর্ণাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলেন,’আব্বাকে ভুল বুঝিস না মা। ভালোবাসার উপর কিছু নেই। ভালোবেসে লুকিয়ে বিয়ে করেছিল। কিন্তু আমাকে জানতে দেয়নি। একসময় বিরক্ত হয়ে অনেক মারধোর করে। ভীষণ বদমেজাজি আর জেদি ছিল তোদের আব্বা। জোর করে তোদের দাদা বিয়ে করিয়েছেন। তাই রাগ মেটাতো আমার উপর। আচ্ছা বাদ সেসব কথা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। জান বাঁচানোর তাগিদে মানুষ পালাতে থাকে। অলন্দপুরে পাকিস্তানি ক্যাম্প তৈরি হয়। শহর থেকে একটা দল আসে যারা যুদ্ধ করতে চায় তাদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে। তোদের আব্বা তার প্রথম স্ত্রীর কাছে বেশি থাকতো। আর তোর দুই চাচা যুদ্ধে চলে যায়। আমি একা ছিলাম খালি বাড়িতে। চারিদিকে অত্যাচার, জুলুম। ইচ্ছে করে দেশের জন্য কিছু করতে। মনে সাহস নিয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সাথে যোগাযোগ করি। তিনি কমান্ডার আবুল কালামের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেন।

প্রধান শিক্ষক গোপনে গ্রামের যুবক-যুবতীদের অনুপ্রেরণা দিতেন যুদ্ধের জন্য। এ খবর একসময় পাকিস্তানিরা পেয়ে গেল। তিনি শহিদ হলেন। ট্রেনিং-এ জয়েন করি। হয়ে উঠি একজন মুক্তিযোদ্ধা। প্রথম অপারেশনে আমরা সফল হই। অলন্দপুরের ক্যাম্প উড়িয়ে দেই। এরপর চলে যাই আরেক এলাকায়। হাতে রাইফেল নিয়ে পরবর্তী অপারেশনে নামি। তখন ধরা পড়ে যাই পাকিস্তানিদের হাতে। বন্দি করে কারাগারে। স্বচক্ষে দেখি ধর্ষণ,শারিরীক অত্যাচার। কী বর্বরতা তাদের! রড দিয়ে পিটিয়েছে। পিঠের দাগগুলো এখনো আছে। আরো কয়দিন থাকলে হয়তো আমিও ধর্ষণ হতাম। তার আগেই আবুল কালামের বুদ্ধির কাছে হেরে গেল তারা। ফেরার আগে চোখ বন্ধ করে এক নিঃশ্বাসে দুইজনকে ছুরি দিয়ে মৃত্যুর দোয়ারে পাঠিয়ে আসি। দেশ স্বাধীন হয়। চারিদিকে স্বাধীনতার উল্লাস। হাসপাতালে তখন ভর্তি আমি। আরো অনেকে ছিল। সেই হাসপাতালেই ভর্তি ছিল যিশু। সেও একজন মুক্তিযোদ্ধা। রিমঝিমের সাথে ফের দেখা হলো। এক মাস লাগলো সুস্থ হতে।

ফেরার সময় সাথে আসে রিমঝিম আর যিশু ভাইয়া। পথে বার বার করে বলি, তোমাদের মতো দেখতে যেন আমার একটা মেয়ে হয়। অলন্দপুরের বাজারে নামিয়ে দিয়ে ওরা আর আসেনি। ফের যদি গ্রামের লোক দেখে ফেলে। কিন্তু আশঙ্কাই ঠিক হলো। অনেকে যিশু ভাইয়ের সাথে আমাকে দেখে ফেলে। বাড়িতে ফিরে তোর আব্বাকে দেখি। তিন মাস পর জানতে পারি আমার পদ্ম আমার পেটে। মনে প্রাণে একটা সুন্দর মেয়ে চাইতে থাকি আল্লাহর কাছে। ঘুমালে স্বপ্ন দেখি রিমঝিমকে। আমার মন খুব চাইতো রিমঝিমের মতো সুন্দর মেয়ে। ঠিক তাই হলো। কিন্তু বদনাম রটে গেল। অনেকে বলে তারা যিশুর সাথে আমাকে দেখেছে। এতদিন যিশুর কাছে ছিলাম।।তারই সন্তান পদ্মজা। এজন্যই এত সুন্দর। আর এতো মিল। তোদের আব্বাও বিশ্বাস করল। আল্লাহ চাইলে সব পারে কেউ বিশ্বাস করল না। কিন্তু জানিস পদ্ম?

আমি পদ্মজা পর্ব ১৬+১৭+১৮+১৯+২০

তুই জন্মের পর থেকেই আমি অলৌকিক ভাবে খুব শক্ত আর কঠিন হয়ে পড়ি। কেউ কিছু বললে, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিয়ে দেই। তোর সম্পর্কে কেউ কিছু বলতে আসলে দা নিয়ে তেড়ে যাই। এ খবর ছড়িয়ে পড়ে সব জায়গায়। তার মধ্যে কমান্ডার আবুল কালাম আসেন অলন্দপুরে। গ্রামের অনেকে যুদ্ধে গিয়েছিল। আমি ছাড়া আর একজন ফিরেছিল। বদর উদ্দিন নাম। বদর উদ্দিন এবং আবুল কালামের কাছ থেকে গ্রামবাসী জানতে পারে আমিও যুদ্ধ করেছি। হেমলতা একজন মুক্তিযোদ্ধা। এ খবর শোনার পর থেকে সবাই মোটামুটি সমীহ করে চলতে থাকে। একটা শক্ত জায়গা দখল করে বাঁচতে থাকি। প্রতিটি ঘটনা আমাকে ভেতরে ভেতরে শক্ত করেছে। তুই জন্মের পর বুঝেছি, আমি অনেক কিছু পারি। একা চলতে পারি। ‘
কথা শেষ করে হেমলতা হাঁফ ছাড়েন। চাঁদ ডুবে গেছে অনেকক্ষণ আগে। কিছুক্ষণের মধ্যে ফজরের আযান পড়বে। পদ্মজা,পূর্ণা স্তব্ধ।

‘এই দুনিয়ায় বাঁচার দুটি পথ- চুপ থাকো, নয় প্রতিবাদ করো। কিন্তু আমার নিয়ম বলে, সামনে চুপ থেকে আড়ালে আবর্জনাটাকে ছুঁড়ে ফেলে দাও। যাতে এই আবর্জনার প্রভাবে আর কিছু না পঁচে।’
কী জানি কেন হেমলতার শেষ কথাগুলো পদ্মজার রগে রগে শিহরণ জাগায়। সে দূরে চোখ রেখে কিছু ভাবতে থাকে। মানুষের জীবনে কত গল্প! কত যন্ত্রনা! হেমলতা নৌকা ঘুরাতে বলেন। মোর্শেদ নৌকা ঘুরায়। বাড়ি ফিরতে হবে। আজ পদ্মজার গায়ে হলুদ। নৌকা চলছে ঢেউয়ের তালে তালে। আগের উত্তেজনাটা আর কাজ করছে না। একটা ইঞ্জিন ট্রলারের শব্দ পাওয়া যায়। চার জন চকিতে সেদিকে তাকায়। ট্রলারে একজন লোক। আরেকজন ট্রলারের ভেতর থেকে সাদা কাপড়ে মোড়ানো কিছু একটা নিয়ে বেরিয়ে আসে। আবছা আলোয় সাদা কাপড়ে মোড়ানো বস্তুটি দেখে পূর্ণার পিলে চমকে উঠল। মানুষ মরার পর সাদা কাপড়ে যেভাবে মোড়ানো হয়,ঠিক তেমন। পর পরই লোক দুটি মোড়ানো বস্তুটি ছুঁড়ে ফেলে পানিতে। মোর্শেদ চেঁচিয়ে উঠেন,’কে রে?’

লোক দুটি তাকায় বোধহয়। এরপর দ্রুত ট্রলারের ভেতর চলে যায়। মোর্শেদ বৈঠা দ্রুত চালিয়েও ধরতে পারল না। ট্রলারটি চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে গেল। যেখানে সাদা কাপড়ে মোড়ানো বস্তুটি ফেলা হয়েছে,সেখানে মোর্শেদের নৌকাটি পৌঁছাতেই হুট করে পদ্মজা ঝাঁপিয়ে পড়ে পানিতে। হেমলতা আকস্মিক ঘটনায় চমকে যান। আতঙ্ক নিয়ে ডাকেন,’পদ্ম…”
পদ্মজার দেখা নেই। তিনি নৌকা থেকে ঝাঁপ দিতে যাবেন তখনি পদ্মজা ভেসে উঠে। হাতে সাদা কাপড়ে মোড়ানো বস্তুটি। পদ্মজা মুখ তুলেই হেমলতাকে বলল,’আম্মা,আমি ঠিক ভেবেছি। এটা লাশ।’
পূর্ণা লাশ শুনেই কাঁপতে থাকে। অথচ পদ্মজা স্থির,ঠান্ডা।এই শেষ রাত্রিরে নদীর জলে ভেসে আছে দু’হাতে মৃত মানুষ জড়িয়ে ধরে!

আমি পদ্মজা পর্ব ২৬+২৭+২৮+২৯+৩০