আমি পদ্মজা পর্ব ৩১+৩২+৩৩+৩৪+৩৫

আমি পদ্মজা পর্ব ৩১+৩২+৩৩+৩৪+৩৫
ইলমা বেহরোজ

সকাল থেকে বাতাস বইছে। কাছাকাছি কোথাও বৃষ্টি হয়ে গেছে এমন আমেজ সেই বাতাসে। একটু শীতেল চারপাশ। গরু গাড়ি চড়ে পদ্মজা যাচ্ছে বাপের বাড়ি। পাশে আছে আমির এবং লাবণ্য। পদ্মজার পরনে সবুজ শাড়ি। ভারী সুতার কাজ। গা ভর্তি গহনা। এসব পরে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছে। কিন্তু ফরিনা বেগমের কড়া নিষেধ, কিছুতেই গহনা খোলা যাবে না। আমির পদ্মজার এক হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। ছেড়ে দিলেই যেন হারিয়ে যাবে। আমিরের এহেন পাগলামি পদ্মজাকে বেশ আনন্দ দিচ্ছে। সে চাপা স্বরে বলল, ‘কোথাও চলে যাচ্ছি না,আস্তে ধরুন।’
আমির চটপট করে নরম স্পর্শে পদ্মজার হাত ধরল। পদ্মজা বলল, ‘মনে আছে তো কি বলেছিলাম?’

‘কী?’
সঙ্গে সঙ্গে পদ্মজা হায় হায় করে উঠল, ‘ওমনি ভুলে গেছেন?’
আমির শূন্যে তাকিয়ে মনে করার চেষ্টা করল। সকালে ঘুম ভাঙার পর দেখল, পদ্মজা নতুন শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে। আমির মিষ্টি করে হেসে ডাকল, ‘এদিকে আসো।’
পদ্মজা ছোট ছোট করে পা ফেলে আমিরের পাশে দাঁড়ায়। আমির খপ করে পদ্মজার হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘কখন উঠেছো?’
‘যেভাবে টান দিলেন। ভয় পেয়েছি তো।’
‘এতো ভীতু?’
‘কখনোই না।’
‘তা অবশ্য ঠিক।’
‘উঠুন। আম্মা আপনাকে ডেকে নিয়ে যেতে বলেছেন।’
‘কেন? জরুরি দরকার নাকি?’
‘আমি জানি না। উঠুন আপনি।’
‘এই তুমি তো কম লজ্জা পাচ্ছো ।’
পদ্মজার মুখ লাল হয়ে উঠে। সে বিছানা থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়। মাথা নত করে বলল, ‘ আপনি লজ্জা দিতে খুব ভালোবাসেন।’
আমির হাসতে হাসতে বিছানা থেকে নামল। বলল, ‘ তোমার চেয়ে কম ভালোবাসি। আচ্ছা, তুমি কবে ভালোবাসবে বলো তো?’
পদ্মজা পূর্ণ-দৃষ্টিতে আমিরকে দেখল। আমির আবার হাসল। তারপর পদ্মজার দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘ যেদিন মনে হবে তুমিও আমাকে ভালোবাসো,বলবে কিন্তু। সেদিনটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হবে।’
পদ্মজা তখনও এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। আমির হাত নাড়িয়ে পদ্মজার পলক অস্থির করে বলল, ‘ কী ভাবছো?’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘কিছু না।’
‘কিছু বলবে?’
‘আজ ওই বাড়ি যাব আমরা।’
‘এটাই তো নিয়ম।’
‘আপনি একটু বেশরম।’
আমির চকিতে তাকাল। পদ্মজা ঠোঁট টিপে হেসে চোখ সরিয়ে নিল। আমির আমতাআমতা করে বলল, ‘তা..তাতে কী হয়েছে?’
‘কিছু না।’
‘কি বলতে চাও, বলো তো।’
‘বড়দের সামনে আমাকে নিয়ে এতো কথা বলবেন না। মানুষ কানাকানি করে। আপনাকে বেলাজা,বেশরম বলে।’
‘আমার বউ নিয়ে আমি কী করব, আমার ব্যাপার।’
‘কিন্তু আমাকে অস্বস্তি দেয়।’ পদ্মজা করুণ স্বরে বলল।
আমির নিভল, ‘ আচ্ছা,ঠিক আছে। নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করব।’
‘সত্যি? আমার আম্মার সামনে ভুলেও পদ্মজা, পদ্মজা করবেন না।’
‘ইশারা দিতেই চলে আসবে। তাহলে ডাকাডাকি করব না।’
পদ্মজা হাসল। আমির ইষৎ হতচকিত। বলল, ‘হাসছো কেন?’
‘এমনি। মনে রাখবেন কিন্তু।’
‘তুমিও মনে রাখবে।’

সকালের দৃশ্য থেকে বেরিয়ে আসে আমির। পদ্মজাকে বলল, ‘মনে আছে। তোমার অস্বস্তি হয় এমন কিছুই করব না।’
আমিরের কথায় পদ্মজা সন্তুষ্ট হয়। নিজেকে পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে। উত্তেজনায় কাঁপছেও। মা-বাবাকে দেখবে দুই দিন পর। দুই দিনে কী কিছু পাল্টেছে? পদ্মজা মনে মনে ভাবছে, ‘আম্মা বোধহর শুকিয়েছে। আমাকে ছাড়া আম্মা নিশ্চয় ভালো নেই।’
পদ্মজার খারাপ লাগা কাজ করতে থাকে। ছটফটানি মুহূর্তে বেড়ে গেল। আমির জানতে চাইল, ‘পদ্মজা, শরীর খারাপ করছে?’
‘না।’
‘অস্বাভাবিক লাগছে।’
‘আম্মাকে অনেকদিন পর দেখব।’
‘অনেকদিন কোথায়? দুই দিন মাত্র।’
‘অনেকদিন মনে হচ্ছে।’
‘এইতো চলে এসেছি। ওইযে দেখো, তোমাদের বাড়ির পথ।’
আমির আঙ্গুলে ইশারা করে। আমিরের ইশারা অনুসরণ করে পদ্মজা সেদিকে তাকাল। ওই তো তাদের বাড়ির সামনের পুকুর দেখা যাচ্ছে। আর কিছু সময়,এরপরই সে তার মাকে দেখবে। পদ্মজা অনুভব করে তার নিঃশ্বাসের গতি বেড়ে গেছে। হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে। সে আমিরের এক হাত শক্ত করে ধরে সেদিকে তাকিয়ে রইল।

হেমলতা নদীর ঘাটে মোর্শেদের সাথে কথা বলছেন। তিনি মোর্শেদকে বাজারে পাঠিয়েছিলেন। মোর্শেদ কিছু জিনিষ ভুলক্রমে আনেননি। তা নিয়েই আলোচনা চলছে। ঠিক আলোচনা নয়। হেমলতা বকছেন,মোর্শেদ নৌকায় বসে শুনছেন। তিনি কথা বলার সুযোগই পাচ্ছেন না। হেমলতা নিঃশ্বাস নিতে চুপ করেন। তখনি মোর্শেদ বললেন,’অহনি যাইতাছি। সব লইয়া হেরপর আইয়াম।’
‘এখন গিয়ে হবেটা কী বলো তো? হঠাৎ ওরা চলে আসবে।’
‘আমি যাইয়াম আর আইয়াম।’ বলতে বলতে মোর্শেদ নৌকা ভাসিয়ে দূরে চলে যান। হেমলতা ক্লান্তি ভরা দৃষ্টি নিয়ে স্বচ্ছ জলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। পূর্ণার চিৎকার ভেসে আসে কানে। তিনি চমকে ঘুরে তাকান। পূর্ণা, আপা আপা বলে চেঁচাচ্ছে বাড়িতে। হেমলতা বিড়বিড় করেন, ‘এসে গেছে আমার পদ্ম।’

তিনি ব্যস্ত পায়ে হেঁটে বাড়ির উঠোনে আসেন। সঙ্গে সঙ্গে ফুলের মতো সুন্দর মেয়েটা হামলে পড়ে বুকের উপর। আম্মা,আম্মা বলে জান ছেড়ে দেয়। হেমলতার এতো বেশি আনন্দ হচ্ছে যে, হাত দুটো তোলার শক্তি পাচ্ছেন না। চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। তিনি দুই হাতে শক্ত করে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরেন। শূন্য বুকটা চোখের পলকে পূর্ণ হয়ে উঠেছে। পদ্মজা নিশ্চয় বুঝে যাবে, দুই রাত তার আম্মা ঘুমায়নি। চোখদ্বয় নিশ্চিন্তে আরাম করতে পারেনি। বুঝতেই হবে পদ্মজাকে। পদ্মজা ঘন ঘন লম্বা করে নিঃশ্বাস টানছে। স্পষ্ট একটা ঘ্রাণ পাচ্ছে সে। মায়ের শরীরের ঘ্রাণ। পারলে যেন পুরো মাকেই এক নিঃশ্বাসে নিজের মধ্যে নিয়ে যেত সে।
হেমলতা পদ্মজার মাথায় আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বললেন, ‘আর কাঁদিস না। এই তো,আম্মা আছি তো।’
‘তোমাকে খুব মনে পড়েছে আম্মা।’
‘আমারও মনে পড়েছে।’ হেমলতার চোখের জল ঠোঁট গড়িয়ে গলা অবধি পৌঁছেছে। তিনি অশ্রুমিশ্রিত ঠোঁটে পদ্মজার কপালে চুমু দেন। আমির হেমলতার পা ছুঁয়ে সালাম করতে নেয়। হেমলতা ধরে ফেলেন। আমিরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, ‘লাগবে না বাবা।’

আমির বিনীত কণ্ঠে বলল, ‘ ভালো আছেন আম্মা?’
‘ভালো আছি। তুমি ভালো আছো তো? আমার মেয়েটা কান্নাকাটি করে জ্বালিয়েছে খুব?’
‘ভালো আছি আম্মা। একটু-আধটু তো জ্বালিয়েছেই।’ কথা শেষ করে আমির আড়চোখে পদ্মজার দিকে তাকাল। পদ্মজা ফোঁপাচ্ছে। হেমলতা অনেকক্ষণ চেষ্টা করে পদ্মজাকে নিয়ন্ত্রণে আনেন। বাড়িতে মনজুরা,হানি সহ হানির শ্বশুরবাড়ির অনেকেই ছিল। তারা আগামীকাল ঢাকা ফিরবে। জামাই স্বাগতমের বিশাল আয়োজন করা হয়েছে। পূর্ণা পদ্মজা, লাবণ্যকে টেনে নিয়ে যায় ঘরে। হানির স্বামী আমিরকে নিয়ে গল্পের আসর জমান।আমির আসার সময় গরু গাড়ি ভরে বাজার করে নিয়ে এসেছে। হেমলতা সেসব গুছাচ্ছেন। তিনি বার বার করে মজিদ মাতব্বরকে বলে দিয়েছিলেন, ফের যাত্রায় বাজার না পাঠাতে। তবুও পাঠিয়েছেন। ফেলে তো দেওয়া যায় না।

রাতের খাবার শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ। পূর্ণাকে আমির ছোট আপা ডাকে। শালির চোখে একদমই দেখছে না। তেমন রসিকতাও করছে না। আমিরের ব্যবহারে পূর্ণা ধীরে ধীরে আমিরকে বোন জামাই হিসেবে পছন্দ করছে। না হোক নায়কের মতো সুন্দর। মন তো ভালো। হানির বড় ছেলে,লাবণ্য,আমির আর পূর্ণা লুডু খেলছে। পদ্মজা কিছুক্ষণ খেলে উঠে চলে এসেছে। হেমলতা,মোর্শেদ বারান্দার বেঞ্চিতে বসে ছিলেন। পদ্মজা দরজার পাশে এসে দাঁড়াল। মোর্শেদ দেখতে পেয়ে ডাকলেন, ‘ কী রে মা? আয়।’
পদ্মজাকে দুজনের মাঝখানে বসিয়ে দিলেন। তারপর প্রশ্ন করলেন, ‘ হউরবাড়ির মানুষেরা ভালা তো?’
পদ্মজা নতজানু হয়ে জবাব দিল, ‘সবাই ভালো।’
‘একটু আধটু সমস্যা থাকবেই,মানিয়ে নিস। জয় করে নিস। সব কিছুই অর্জন করে নিতে হয়।’ বললেন হেমলতা। পদ্মজা হেমলতার দিকে তাকিতে মৃদু করে হাসলো। হেমলতা আবার বলেন, ‘তোর শ্বাশুড়ি একটু কঠিন তাই না? চিন্তা করিস না। যা বলে করবি। পছন্দ-অপছন্দ জানবি। সেই মতো কাজ করবি। দেখবি, ঠিক মাথায় তুলে রেখেছে।’
‘আচ্ছা, আম্মা।’ বলল পদ্মজা।
‘সব শ্বাশুড়ি ভালো হয় না লতা। আমার শ্বাশুড়িরে আজীবন তেল দিলাম। কোনো পরিবর্তন হয়েছে? হয়নি।’ বললেন হানি। তিনি ঘর থেকে সব শুনছিলেন। কথা না বলে পারলেন না।
হেমলতা এক হাতে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরেন। তারপর হানির উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমার পদ্মর কপাল এতো খারাপ নিশ্চয় হবে না।’

‘পদ্মর অবস্থা আমার মতো হয়েছে যদি শুনি,পদ্মকে তুলে নিয়ে যাব আমার কাছে। তুই মিলিয়ে নিস।’
‘আহ! থামো তো আপা। আমির, লাবণ্য শুনবে। কী ভাববে?’
হানি আর কিছু বললেন না। চারজন মানুষ নিশ্চুপ বসে রইল অনেকক্ষণ। একসময় হেমলতা রান্নাঘরের দিকে যান। রান্নাঘর গুছানো হয়নি। মোর্শেদ নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ান। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে। হানি পদ্মজার পাশে বসেন। বললেন, ‘শোন মা, শ্বাশুড়িরে বেশি তেল দিতে গিয়ে নিজের জীবন নষ্ট করবি না। তোর মায়ের অনেক জ্ঞান,অভিজ্ঞতা মানি। কিন্তু লতার শ্বাশুড়ি নিয়ে সংসার করতে হয়নি। তাই সে জানে না। আমি জানি শ্বাশুড়িরা কেমন কালসাপ হয়। এরা সেবা নিবে দিনরাত। বেলাশেষে ভুলে যাবে। নিজের কথা আগে ভাববি। শ্বাশুড়ি ভুল বললে জবাব দিবি সাথে সাথে। নিজের জায়গাটা বুঝে নিবি। পড়াশোনা থামাবি না। পড়বি আর আরামে থাকবি। আমরা বান্দি পাঠাইনি। সাক্ষাৎ পরী পাঠাইছি। শুনছি, আমিরের টাকাপয়সা, জমিজমা অনেক আছে। তাহলে তোর আর চিন্তা কীসের? জামাই হাতে রাখবি। তাহলে পুরো সংসার তোর হাতে। আমার কপালে এসব ঠেকেনি। বিয়ের পর থেকে শ্বশুরবাড়ির মানুষের মন রাখতে রাখতে কখন বুড়ি হয়ে গেছি বুঝিনি। বুঝছিস তো?’

পদ্মজা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল, ‘ মেজো আপা আসে নাই কেন? বিয়ে কবে আপার?’
‘ওর তো পরীক্ষা সামনে। পড়াশোনা শেষ করুক। এরপর বিয়ে দেব।’
‘বিয়ে না ঠিক হওয়ার কথা ছিল। হয়নি?’
‘কবে?’ বললেন হানি। পদ্মজা হানির প্রশ্নে খুব বেশি অবাক হলো। কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল, ‘ আম্মা না কয়দিন আগে তোমাদের বাড়ি গেল। বড় আপার বিয়ে ঠিক করতে।’
হানি হা হয়ে তাকিয়ে রইলেন পদ্মজার দিকে। তিনি কিছুই বুঝছেন না। তার মেয়ের বিয়ে আবার কবে ঠিক হওয়ার কথা ছিল? পদ্মজা বিয়ে করে কী আবোলতাবোল বকছে! তিনি বললেন, ‘কী বলিস?’
হানির সহজ সরল মুখখানার দিকে পদ্মজা একদৃষ্টে চেয়ে রইল। সে ভাবছে, ‘আম্মা রাজধানীতে তাহলে কেন গিয়েছিল? মিথ্যে কেন বলেছে? সেদিন রাজধানীতে গিয়েছিল বলেই, এতো বড় অঘটন ঘটেছিল। না! অঘটন ভাগ্যেই লেখা ছিল। কিন্তু মিথ্যে কেন বলল আম্মা?’

মাদিনী নদীর বুকে কুন্দ ফুলের মতো জোনাকি ফুটে রয়েছে। পদ্মজা তা এক মনে চেয়ে দেখছে। রাত অনেকটা। আমির ঘুমাচ্ছে। তিন দিনে আমিরের সাথে পূর্ণা-প্রেমার খুব ভাব হয়েছে। সারাক্ষণ আড্ডা,লুডু খেলা। পদ্মজা যত দেখছে তত আমিরের প্রেমে পড়ছে। আমিরের ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে পদ্মজার মনে পড়ল, আগামীকাল ফিরে যেতে হবে শ্বশুরবাড়ি। মা-বাবা,ভাই-বোন সবাইকে ছেড়ে আবার চলে যেতে হবে। ভাবতেই মন খারাপ হয়ে আসে। মন ভালো করতে চলে আসে নদীর ঘাটে। জোনাকিদের কুরুক্ষেত্র দেখতে দেখতে কেটে যায় অনেকক্ষণ। আঁধার ভেদ করে একটা আলোর ছোঁয়া লাগে চারপাশে। এসময় কে এলো? পদ্মজা ঘাড় ঘুরে তাকাল। মাকে দেখে একগাল হাসল। হেমলতা হারিকেন হাতে নিয়ে এগিয়ে আসেন। কিঞ্চিৎ রাগ নিয়ে বললেন, ‘এতো রাতে একা ঘাটে এসেছিস কেন? মার খাসনি অনেকদিন। বিয়ে হয়েছে বলে আমি মারব না নাকি?’

হেমলতার ধমকে পদ্মজা মেরুদণ্ড সোজা করে থতমত হয়ে দাঁড়াল। মা শেষ কবে মেরেছেন পদ্মজা মনে করতে পারছে না। তিনি যেভাবে বললেন মনে হলো, না জানি কত মেরেছেন। তাই সে ও ভয় পাওয়ার ভান ধরল।
‘যাচ্ছি ঘরে।’ পদ্মজার গলা।
‘কী জন্য এসেছিলি? ঘুম আসছে না?’ হেমলতার কণ্ঠটা নরম শুনাল।
‘কাল চলে যেতে হবে,তাই মন খারাপ হচ্ছিল।’
হেমলতা হারিকেন মাটিতে রাখেন। তারপর দুহাতে পদ্মজাকে বুকে টেনে নেন। পদ্মজার কান্নারা বাঁধন ছেঁড়া হলো। মায়ের বুকে মুখ চেপে পিঠটা বারংবার ফুলে ফুলে উঠতে লাগল। কিছুক্ষণ এভাবেই পার হলো।
‘এতো সহজে কাঁদিস কেন? মা-বাবার কাছে সারাজীবন মেয়েরা থাকে না মা।’
‘তুমি সাথে চলো।’
‘পাগল মেয়ে! বলে কী! কান্না থেমেছে?’
পদ্মজা দুহাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখের জল মুছে বলল, ‘হু।’
‘আমির তো ঘুমে। তুইও ঘুমিয়ে পর গিয়ে।’
পদ্মজা মাথা নাড়াল। দুই কদম এগিয়ে আবার চটজলদি পিছিয়ে আসে। মাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি ঘুমাবে না আম্মা?’
‘ঘুমাব, চল।’
‘আম্মা?’

হেমলতা হারিকেন হাতে নিয়ে পদ্মজার চোখের দিকে তাকালেন। পদ্মজা বলল, ‘ তোমার জীবনের সবটা আমাকে বলেছো। কিছু আড়ালে থাকলে সেটাও বলো আম্মা।’
‘কেন মনে হলো, আরো কিছু আছে?’ হেমলতার কণ্ঠটা অন্যরকম শুনাল।
‘মনে হয়নি। এমনি বলে রাখলাম।’
পদ্মজা নতজানু হয়ে নিজের নখ খুঁটাচ্ছে। হেমলতা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কেটে যায় অনেকটা সময়। তিনি ঢোক গিলে গলা ভেজান। তারপর বললেন, ‘তাই হবে।’
পদ্মজা খুশিতে তাকাল। নিশ্চয় এখন সব বলবেন আম্মা। হানি খালামনির বাড়ির কথা বলে সেদিন কোথায় গিয়েছিলেন? এখনই জানা যাবে। হেমলতা আশায় পানি ঢেলে দিলেন,’এখন ঘুমাতে যা। অনেক রাত হয়েছে।’
পদ্মজার চোখমুখের উজ্জ্বলতা নিভে গেল। মা কাঙ্ক্ষিত প্রসঙ্গটি কেন এড়িয়ে যাচ্ছেন? পদ্মজা সরাসরি জিজ্ঞাসা করার অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারছে না। জড়তা ঘিরে রেখেছে তাকে। মা সবসময় নিজ থেকে সব বলেন। নিশ্চয় কোনো কারণে এই বিষয়ে চুপ আছেন। পদ্মজা মনে মনে নিজেকে স্বান্তনা দিল, ‘একদিন আম্মা বলবে। অবশ্যই বলবে।’

কালো মেঘে ঢাকা আকাশ। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। লাহাড়ি ঘরের বারান্দায় হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছেন হেমলতা। সন্ধ্যার আযান পড়বে। চারপাশে এক মায়াবী ঘনছায়া। মন বিষাদময়। পদ্মজা দুপুরে মোড়ল বাড়ি ছেড়েছে। বিদায় মুহূর্তটা একটুও স্বস্তির ছিল না। মেয়েটা এতো কাঁদতে পারে! তবে হেমলতার চোখ শুকনো ছিল। মায়ের চোখ শুকনো দেখে কি পদ্মজা কষ্ট পেয়েছিল? কে জানে! হেমলতা বারান্দা ছেড়ে উঠতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন শক্তির অবস্থান শূন্যে। তিনি আবার বসে পড়েন। হেসে ফেললেন। পদ্মজা ছাড়া এতো দূর্বল তিনি! এটা ভাবতে অবশ্য ভালো লাগে। হেমলতা আকাশের দিকে তাকান। চোখ দুটি জ্বলছে। জলভরা চোখ নিয়ে আবার হাসলেন। কী যন্ত্রণাময় সেই হাসি! মাটিতে হাতের ভর ফেলে উঠে দাঁড়ান তিনি। এলোমেলো পায়ে লাহাড়ি ঘর ছাড়েন। উঠোনে এসে থমকে দাঁড়ান। বাড়ির গেইট খোলা ছিল।পাতলা অন্ধকার ভেদ করে একটি নারী অবয়ব এগিয়ে আসছে বাড়ির দিকে। হেমলতা নারী ছায়াটির স্পষ্ট মুখ দেখার জন্য অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকেন। গেইটের কাছাকাছি আসতেই হেমলতা আন্দাজ করতে পারেন কে এই নারী! তিনি মৃদু হেসে এগিয়ে যান।

‘অনেক দেরি করলেন আসতে।’
বাসন্তী উঠোনে পা রেখে বললেন, ‘ আপনি আমাকে চিনেন?’
হেমলতা জবাব না দিয়ে বাসন্তীর ব্যাগ নিতে হাত বাড়ালেন। বাসন্তী ব্যাগ আড়াল করে ফেললেন। তিনি খুব অবাক হচ্ছেন। মনে যত সাহস নিয়ে এসেছিলেন সব ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। হেমলতা বললেন, ‘আপনি এই বাড়িতে নির্দ্বিধায় থাকতে পারেন। আমি বা আমার সন্তানদের পক্ষ থেকে আপত্তি নেই।’
‘আ…আপনি আমাকে চিনলেন কীভাবে?’
‘সে যেভাবেই চিনি। জেনে কী লাভ আছে? আপনি প্রথম দিনই একা আসতে পারতেন। লোকজন না নিয়ে।’
বাসন্তীর এবার ভয় করছে। শরীর দিয়ে ঘাম ছুটছে। একটা মানুষ সতিন দেখে এতো স্বাভাবিক কী করে হতে পারে? তিনি তো ভেবেছিলেন যুদ্ধ করে স্বামীর বাড়িতে বাঁচতে হবে। বাসন্তীর ধবধবে সাদা চামড়া লাল বর্ণ ধারণ করে। হেমলতার কথা,দৃষ্টি এতো ধারালো মনে হচ্ছে তার! হেমলতা বাসন্তীকে চুপ দেখে বললেন, ‘আপনি বিব্রত হবেন না। এটা আপনারও সংসার। আসুন।’

হেমলতা আগে আগে এগিয়ে যান। বারান্দা অবধি এসে পিছনে ফিরে দেখেন, বাসন্তী ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। হেমলতা কথা বলার জন্য প্রস্তুত হোন,তখনই একটা পুরুষালি হুংকার ভেসে এলো, ‘তুমি এইহানে আইছো কেন?’
মোর্শেদের কণ্ঠ শুনে বাসন্তী কেঁপে উঠলেন। মোর্শেদকে এড়িয়ে একজন বনেদি লোকের প্রতি ক্ষণিকের জন্য আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন তিনি। এরপর থেকেই মোর্শেদ এবং তার সম্পর্কে ফাটল ধরে। মোর্শেদ ত্যাগ করে তাকে। কিন্তু তিনি এক সময় বুঝতে পারেন, কোনটা ভুল কোনটা সঠিক। সংসারের প্রতি টান অনুভব করে,ফিরে আসতে চান। মোর্শেদ জায়গা দিলেন না। ততদিনে মোর্শেদ দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা উপলব্ধি করে ফেলন। মোহ ছেড়ে ফিরে আসেন হেমলতার কাছে। নিজের সন্তানদের কাছে।
‘বাইর হইয়া যাও কইতাছি। বাইর হও আমার বাড়ি থাইকা।’
মোর্শেদ বাসন্তীকে ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে যেতে বলেন। বাসন্তী হুমড়ি খেয়ে পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নেন। চোখ গরম করে মোর্শেদের দিকে তাকান। বললেন, ‘এইটা আমারও ছংছার। আমি যাব না।’
‘বাসন্তী ভালাই ভালাই কইতাছি,যাও এন থাইকা। নইলে তোমার লাশ ফালায়া দিয়াম আমি।’
বাসন্তী কিছু কঠিন কথা শোনাতে গিয়েও শুনালেন না। হেমলতা উঠোনে নেমে আসেন, ‘যখন বিয়ে করেছো তখন হুঁশ ছিল না। এখন সংসার দিতে আপত্তি?’

‘তুমি জানো না লতা,এই মহিলা কত্তডা খারাপ। এই মহিলা লোভী। লোভখোরের বাচ্চা। মাদারির বাচ্চা।’
‘কী সব বলছো? মুখ সামলাও।’
মোর্শেদের কপালের রগ দপদপ করছে। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এসেছে। বাসন্তীকে পিটাতে হাত নিশপিশ করছে। তবুও হেমলতার কথায় তিনি থামেন। কিন্তু তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলেন বাসন্তীর দিকে। হেমলতা বললেন, ‘আপনি ঘরে যান। এই ঘর আপনারও। উনার কথা মনে নিবেন না।’
‘আমার ঘরে এই মহিলায় ঢুকলে খারাপি হইয়া যাইবো।’
হেমলতা মোর্শেদের চোখের দিকে তাকান। ইশারায় কিছু একটা বলেন। এরপর বাসন্তীকে বললেন,’ আপনি যান। সদর ঘরের ভেতরের দরজার বাম দিকে যে ঘরটা সেখানেই যান। দেখিয়ে দিতে হবে?’
বাসন্তী কিছু না বলে গটগট আওয়াজ তুলে বারান্দা পেরিয়ে সদর ঘরে ঢুকেন। হাত-পা কাঁপছে তার। হেমলতার ব্যবহার স্বাভাবিক হলেও অস্বাভাবিক ঠেকছে। সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে ফেরার জন্য জ্বরে বিছানায় পড়েন। গত কয়দিন জ্বরে এতোই নেতিয়ে গিয়েছিলেন যে,উঠার শক্তিও ছিল না। শরীরটা একটু চাঙ্গা হতেই আবার আসেন। এতো সহজে সব পেয়ে যাবেন জানলে, জ্বর নিয়েই চলে আসতেন। মোর্শেদ অসহায় চোখে তাকালেন হেমলতার দিকে। বললেন, ‘কেন এমনডা করলা? আমি এর সাথে থাকতে পারবাম না।’

‘ঠান্ডা হও তুমি। তুমি কিছুই জানো না, যেদিন আমরা ঢাকা থেকে ফিরি সেদিন উনি এসেছিলেন। লোকজন নিয়ে এসেছিলেন। এরপরই আমার মেয়েদের জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। পরিস্থিতি হাতের নাগালে চলে যাওয়াতে উনি সেদিন ফিরে গিয়েছিলেন। বিয়ের দিন বেয়াই সব বললেন। বেয়াইয়ের কাছে কামরুল মিয়া অভিযোগ করেন। বেয়াই কামরুল ভাইকে বলেন, ব্যাপারটা এখন ছড়াছড়ি না করতে। এতে উনার সম্মান নষ্ট হবে। যে বাড়িতে ছেলের বিয়ে দিচ্ছেন সেই বাড়ির কর্তার প্রথম বউ আছে,বউ আবার একজন পরনারীর মেয়ে। অধিকার নিতে লোকজন নিয়ে বৈঠক বসাবে এসব সত্যিই অসম্মানজনক। তিনি আমাকে অনুরোধ করেছেন, ব্যাপারটা যেন নিজেদের মধ্যে মিটিয়ে নেই। আর বাসন্তী আপার তো দোষ নেই। সবচেয়ে বড় কথা,আমার সংসারের হাল ধরার জন্য একজন দরকার। খুব দরকার।’ হেমলতার শেষ কথাগুলো করুণ শুনাল। মোর্শেদ বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন। বাসন্তী এতো কিছু করেছে ভাবতে পারছেন না। মোর্শেদ কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললেন, ‘তারে আমি মানতে পারতাছি না। বুঝায়া শুনায়া বাইর কইরা দেও।’
‘তুমি আমার কথাগুলো শুনো, থাকতে দাও উনাকে। ক্ষমা করে দাও। আমি জানি না সে কী করেছে। যাই করুক,ক্ষমা করে দাও।’

মোর্শেদের মাথায় খুন চেপেছে। তিনি কী করবেন, কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। ক্রোধে-আক্রোশে ফুলতে ফুলতে বাড়ির পিছনে চলে যান। নৌকা নিয়ে বের হবেন। রাতে বোধহয় ফিরবেন না আজ। আযান পড়ছে। বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। হেমলতা ব্যস্ত পায়ে হেঁটে আসেন বারান্দায়। গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। বুক মুচড়ে একটা কান্না ছিটকে এলো গলায়,সেইসঙ্গে চোখ ছাপিয়ে জল। কোন নারী সতিন মানতে পারে? বাধ্য হয়ে মানতে হচ্ছে। ভাগ্য বাধ্য করছে। নয়তো তিনি এতো উদার নন। কখনোই অন্যকে নিজের সংসারের ভাগ দিতেন না। সেই প্রথম থেকে মনে পুষে রেখেছেন, কখনো মোর্শেদের স্ত্রী এই সংসার চাইলে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেবেন। যার জন্য তিনি একাকীত্বে ধুঁকেছেন,যার জন্য মোর্শেদের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন,যার জন্য মোর্শেদের মার খেয়েছেন তাকে কখনোই এতো সহজে সুখ দিতেন না। কখনোই না। হেমলতার শরীরে কাঁটা ফুটছে। তিনি কোনমতে কান্নাটাকে গিলতে চাইলেন। বাসন্তীর গলা কানে এলো, ‘আপনি কাঁদতাছেন? ‘
হেমলতা চমকে তাকান। লজ্জায় চোখের জল মুছার সাহস পাননি। চোখে জল নিয়েই হাসলেন। বাসন্তী হতবাক! কী অসাধারণ নারী! কত অদ্ভুত সে। বাসন্তী প্রসঙ্গ পাল্টে জানতে চাইলেন, ‘ ছেলেমেয়েরা কই?’

‘বড় মেয়েটার বিয়ে হয়েছে। শ্বশুরবাড়িতে আছে। আজই ফের যাত্রা শেষ করে শ্বশুর বাড়ি গেল। মেজো,আর ছোটটা তাদের নানাবাড়ি গেছে। বড়টার জন্য কান্নাকাটি করছিল তাই আম্মা নিয়ে গেছে।’
‘ঘরে একটা ছোটু ছেড়া ঘুমাচ্ছে। কে ছে?’
‘প্রান্ত। আমারই ছেলে।’
‘ছুনছিলাম তিন মেয়ে ছুধু।’
হেমলতা আর কথা বাড়ালেন না। রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন,’আপনি কলপাড়ে যান। কাপড় পাল্টে নেন। আমি খাবার বাড়ছি।’
____________
পদ্মজা মুখ ভার করে বসে আছে। রাতের খাবারের সময় ফরিনা বেগম খুব কথা শুনিয়েছেন। কঠিন স্বরে বলেছেন, ‘বাপের বাড়ির আহ্লাদ মিটায়া আইছোনি তে? আর কোনোদিন যাইতে কইবা না। এইডাই তোমার বাপের বাড়ি,স্বামীর বাড়ি। আর তোমার ভাই বইনদের কইবা সবসময় আনাগোনা না করতে। বাড়ির কাছে বইলা সবসময় আইতে হইবো এইডা কথা না। চোক্ষে লাগে।’
পদ্মজা বুঝতে পারছে না, তার ভাই বোন তো শুধু বৌভাতের দিন এসেছে। দাওয়াতের আমন্ত্রণ রক্ষার্থে। এজন্য এভাবে কেন বলতে হবে। কান্না পাচ্ছে খুব। আম্মার কথা মনে পড়ছে। পূর্ণা কী করছে? আসতে তো নিষেধ দিয়ে দিল। তাহলে কীভাবে দেখা হবে? আমির ঘরে ঢুকতেই পদ্মজা দ্রুত চোখের জল মুছল। পদ্মজার ফ্যাকাসে মুখ দেখে আমির প্রশ্ন করল, ‘আম্মা কিছু বলছে?’

‘না,না।’
‘তাহলে কাঁদছো কেন?’
‘আম্মার কথা মনে পড়ছে।’
‘যেতে চাও? চলো।’
‘ওমা কী কথা! এতো রাতে। আর দুপুরেই না আসলাম।’
‘তাহলে মন খারাপ করো না। আমরা আবার যাব। কয়দিনের মধ্যে।’
বাইরে অনেক হাওয়া বইছে। পদ্মজা জানালা লাগাতে গেল। তখন একটা চিৎকার শুনতে পেল। আমির তা লক্ষ করে বলল, ‘বড় ভাবির চিৎকার। রুম্পা ভাবি। পাগলের মতো আচরণ তার। পাগলই বলে সবাই।’
পদ্মজা কৌতূহল নিয়ে আমিরের সামনে এসে দাঁড়াল,’আপনার মনে হয় কেউ ভয় পেয়ে মানসিক ভারসাম্য হারাতে পারে?’
‘অসম্ভবের কী আছে?’
‘আমার কাছে খটকা লাগছে। উনার সাথে অন্য কিছু হয়েছে?’
‘আমিতো এতটুকুই জানি।’ আমির চিন্তিত হয়ে বলল।
পদ্মজা বলল, ‘আপনি উনার সাথে দেখা করাবেন আমার?’
‘আঘাত করবে তোমাকে।’
‘বাঁধাই তো থাকে। অনুরোধ করছি।’

পদ্মজাকে হাতজোড় করে অনুরোধ করতে দেখে আমির সায় দিল, ‘আচ্ছা ভোরে নিয়ে যাব। তখন সবাই ঘুমে থাকে।’
‘জানেন, আপনাদের এই বাড়িটা রহস্যজনক। কোনো গোলমাল আছে।’
‘সত্যি নাকি? আমার তেমন কিছু মনে হয় না।’
‘আপনি কয়দিনের জন্য আসেন গ্রামে। আর এসব সবাই বুঝে না।’
‘ওরে আমার বুঝদার। তবে জিন আছে শুনেছি। আমার এক ফুফু বাড়ির পিছনের পুকুরে ডুবে মরেছিলেন।’ আর চাচীরে মাঝে মাঝেই জিনে ধরে।’
‘সেকী!’
‘তবে আমি বিশ্বাস করি না এসব। তুমি বিশ্বাস করো?’
‘না। আচ্ছা…’
পদ্মজা কথা শেষ করতে পারল না। আমির পদ্মজাকে টেনে বিছানায় নিয়ে আসে। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বলল,’আর কথা না। ঘুমাও।’
”আমি ভর্তা হয়ে যাচ্ছি।’
‘এইযে আস্তে ধরলাম।’
‘শুনুন না?’
‘কী?’
‘আমি পড়তে চাই।’
‘পড়বে।’
‘আম্মাকে অসন্তুষ্ট রেখে জোর করে পড়তে মন মানবে না।’
‘আম্মাকে রাজি করাবো।’

পদ্মজা খুশিতে গদগদ হয়ে উঠল। সে ও আমিরকে এক হাতে জড়িয়ে ধরল।
ফজরের আযান চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তেই পদ্মজা চোখ খুলে। বিছানা থেকে নামার জন্য উঠার চেষ্টা করল,পারল না। আমির দুই হাতে জাপটে ধরে রেখেছে। পদ্মজা আমিরকে মৃদু কণ্ঠে ডাকল, ‘এইযে, শুনছেন?’
আমির সাড়া দিল না। আবার ডাকল পদ্মজা। আমির ঘুমের ঘোরে কিছু একটা বিড়বিড় করে আবার ঘুমে তলিয়ে যায়। এবার পদ্মজা উঁচু স্বরে ডাকল, ‘আরে উঠুন না। ফজরের নামায পড়বেন। এই যে…’
আমির পিটপিট করে তাকায়। দুই হাতের বাঁধন আগলা করে দেয়। পদ্মজা আমিরকে ঠেলে দ্রুত উঠে বসে। বিছানা থেকে নামতে নামতে বলে,’অজু করতে আসুন। আপনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন আজ থেকে নামায পড়বেন।’
পদ্মজা কলপাড় থেকে অজু করে আসে। এসে দেখে আমির বালিশ জড়িয়ে ধরে আয়েশ করে ঘুমাচ্ছে। মৃদু হেসে কপাল চাপড়াল পদ্মজা। এরপর আমিরের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। আমিরের চুলে বিলি কেটে দিয়ে কোমল কণ্ঠে বলল, ‘উঠুন না। নামায পড়ে আবার ঘুমাবেন। মসজিদে যেতে হবে না। আমার সাথেই পড়ুন। এই যে, শুনছেন? এইযে, বাবু…”
পদ্মজা দ্রুত জিভ কাটল। মুখ ফসকে আমিরের ডাক নাম ধরে সে ডেকেছে। পদ্মজা সাবধানে পরখ করে দেখল,আমির শুনলো নাকি। না শুনেনি। পদ্মজা মনে মনে বলল,’ উফ! বাঁচা গেল।’
আরো এক দফা ডাকার পর আমির উঠে বসে। কাঁদোকাঁদো হয়ে বার বার অনুরোধ করে,’কাল থেকে পড়ব। আজ ঘুমাতে দাও।’

পদ্মজা শুনলো না। তার অনুনয়ের কাছে আমির হেরে গেল। বউ যদি সুন্দরী হয় তার অনুরোধ কী ফেলা যায়? আমির কলপাড় থেকে অজু করে আসে। দুজন পাশাপাশি দুই জায়নামাযে নামায সম্পন্ন করে।
নামায শেষ হতেই পদ্মজা বলল,’এবার চলুন।’
আমির টুপি বিছানার উপর রেখে জানতে চাইল,’কোথায়?’
‘এমনভাবে বলছেন,যেন জানেন না।’ একটু অভিনয় করেই বলল পদ্মজা।
আমিরের সত্যি কিছু মনে পড়ছে না। এখনো চোখে ঘুম ঘুম ভাব বলেই হয়তো। সে মনে করার চেষ্টা করল। মনে পড়তেই বলল, ‘ওহ! দাঁড়াও। চাবি নিয়ে আসছি।’
আমির বেরিয়ে গেল। পদ্মজা অপেক্ষা করতে থাকল। জানালার পাশে দাঁড়াতেই ভোরের স্নিগ্ধ বাতাসে সর্বাঙ্গ চাঙ্গা হয়ে উঠল। বাইরে সবেমাত্র ভোরের আলো ফুটেছে। পদ্মজা চমৎকার চাহনিতে দেখছে বাড়ির পিছনের জঙ্গল। কী সুন্দর সবকিছু! এতো এতো গাছ। অযত্নে গড়ে উঠা বন-জঙ্গল যেন একটু বেশি আকর্ষণীয় হয়।
প্রকৃতির রূপ দেখতে দেখতে আচমকা চোখে পড়ল রানিকে। রানির পরনে আকাশি রঙের সালোয়ার-কামিজ। সে জঙ্গলের ভেতরে যাচ্ছে। চোর চুরি করার সময় যেভাবে চারপাশ দেখে রানিও ঠিক সেভাবেই চারপাশ দেখে দেখে এগোচ্ছে। পদ্মজা নিঃশ্বাস বন্ধ করে পুরো দৃশ্যটা দেখল। রানি গভীর জঙ্গলের আড়ালে চলে যায়। তখনি আমির আসে,’পদ্মবতী? ‘
আমিরের ডাকে পদ্মজা মৃদু কেঁপে উঠল। আমির কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করল, ‘কিছু কী হয়েছে?’
‘না,কী হবে। চলুন আমরা যাই।’
পদ্মজা যে কোনো কথা এড়িয়ে গেছে তা বেশ বুঝতে পারল আমির। তবে প্রশ্ন করল না। পদ্মজা আমিরকে রানির কথা বলতে গিয়েও পারল না। সে ভাবছে, ‘আগে রানি আপাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। এখনি বলা ঠিক হবে না। উনি কী ভাবেন আবার।’

রুম্পার ঘরের দরজা খুলতেই ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ হয়। পদ্মজা ঘরে ঢুকে আগে জানালা খুলে দেয়। তারপর পালঙ্কের দিকে তাকাল। পালঙ্ক শূন্য। পদ্মজা আমিরের দিকে জিজ্ঞাসু হয়ে তাকায়। আমির ইশারা করে পালঙ্কের নিচে দেখতে। পদ্মজা ঝুঁকে পালঙ্কের নিচে তাকাল। কেউ একজন শুয়ে আছে। চুল দিয়ে মুখ ঢাকা। হাতে পায়ে বেড়ি বাঁধা।
আমির পদ্মজার পাশে বসে বলল,’উনিই রুম্পা ভাবি।’
‘উনাকে ডাকবেন একটু?’
‘রেগে যায় যদি?’
‘তবুও ডাকুন না।’
আমির লম্বা করে নিঃশ্বাস নিয়ে ডাকল, ‘ভাবি? ভাবি? শুনছেন ভাবি?”
রুম্পা নড়েচড়ে চোখ তুলে তাকায়। দুই হাত দূরে একটা ছেলে ও মেয়ে বসে আছে। তাদের মুখ স্পষ্ট নয়। আলো ভালো করে ঘরে ঢুকেনি। রুম্পা শান্ত চোখে চেয়ে রইল অনেকক্ষণ। পদ্মজা হাত বাড়িয়ে বলল,’আমার হাতে ধরে বেরিয়ে আসুন।’
রুম্পা বাঁধা দুই হাতে পদ্মজার হাত ধরার চেষ্টা করে,পারল না। পদ্মজা আরেকটু এগিয়ে যায়। রুম্পার দুই হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে আসে। রুম্পা কাছে আসতেই দুর্গন্ধে পদ্মজার বমি চলে আসে। গলা অবধি এসে বমি আটকে গেছে। না জানি কতদিন গোসল করেনি রুম্পা! দাত মাজেনি। এই বাড়ির কেউ কী একটু পরিষ্কার করে রাখতে পারে না রুম্পাকে? পস্রাবের গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ঘরেই পস্রাব-পায়খানা করে।

রুম্পা মলিন মুখে চেয়ে থাকে পদ্মজার দিকে। শান্ত,স্থির দৃষ্টি। আমির গর্ব করে রুম্পাকে বলল,’আমার বউ। বলছিলাম না, সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটা আমার বউ হবে। দেখিয়ে দিলাম তো?’
রুম্পা হাসে। ময়লাটে মলিন মুখের হাসি বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হাসি। অনেকদিন গোসল না করার কারণে চেহারা, হাত,পা ময়লাটে হয়ে গেছে। নখগুলো বড় বড়। নখের ভেতর ময়লার স্তূপ যেন। ঠোঁট ফেটে চৌচির। টলমল করা চোখ। দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুণি চোখ দিয়ে বর্ষণ বইবে। রুম্পা পদ্মজাকে শান্ত কণ্ঠে বলল,’এ তো ম্যালা সুন্দর ছেড়ি। তোমার নাম কিতা?’
পদ্মজা খুশিতে জবাব দিল,’উম্মে পদ্মজা।’
‘ছুডু ভাই,এতো সুন্দর ছেড়ি কই পাইলেন? এ…এ যে চান্দের লাকান মুখ।’
রুম্পার আরো কাছে এসে বসল পদ্মজা। দুর্গন্ধটা আর নাকে লাগছে না। মানুষটাকে তার বেশ লাগছে। রুম্পার চুল লম্বা। মাটিতে পাঁচ-ছয় ইঞ্চি চুল লুটিয়ে আছে। কুচকুচে কালো চুল। অনেকদিন চুল না ধোয়ার কারণে চুলগুলো জট লেগে আছে কিন্তু সৌন্দর্য এখনো রয়ে গেছে। যখন সুস্থ ছিল নিশ্চয় অনেক বেশি সুন্দর চুলের অধিকারিণী ছিল।
পদ্মজা বলল, ‘আমি আপনাকে তুমি বলি?’

রুম্পা দাঁত বের করে হেসে মাথা নাড়াল। পদ্মজা হেসে বলল,’কিছু বলবেন?’
রুম্পা হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে থাকে পদ্মজার দিকে। কোনো জবাব দেয় না। সেকেন্ড কয়েক পর রুম্পার চোখের দৃষ্টি এদিক-ওদিক ছুটতে থাকে। হাসি মিলিয়ে মুখ মলিন হয়ে আসে। পদ্মজা অবাক হয়ে রুম্পার পরিবর্তন দেখে। আকস্মিক পদ্মজাকে আক্রমণ করে বসল রুম্পা। খামচে ধরে পদ্মজার পা। আমির লাফিয়ে উঠে। রুম্পার হাত থেকে পদ্মজাকে ছুটাতে চেষ্টা করে। রুম্পা পা ছেড়ে পদ্মজার শাড়ি কামড়ে ধরে। মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করতে থাকে। আমির ধমকে বলে,’ভাবি ছাড়ো বলছি। পদ্মজা তোমার ক্ষতি করতে আসেনি। ভাবি ছাড়ো।’
পদ্মজা স্তব্ধ হয়ে দেখছে। তার চোখেমুখে কোনো ভয়ভীতি নেই। কী যেন খুঁজছে রুম্পার মধ্যে। খুঁজে কূলকিনারা পাচ্ছে না। রুম্পা শাড়ি ছেড়ে দিতেই পদ্মজা একটু পিছিয়ে যায়। দরজায় চোখ পড়ে। দেখতে পায়, কেউ একজন সরে গিয়েছে। কী আশ্চর্য! হুট করেই পদ্মজার বুক কাঁপতে থাকে। নূরজাহান নিজ ঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন। এসেই বলেন, ‘তালা খুলছে কেডায়? বাবু, নতুন বউরে নিয়া এইহানে আইছোস কেন?’
আমির দ্রুত রুম্পার কাছ থেকে সরে আসে। নূরজাহানকে কৈফিয়ত দেয়, ‘ভাবলাম, বাড়ির সবাইকে পদ্মজা দেখেছে। রুম্পা ভাবিকেও দেখুক। ভাবতে পারিনি ভাবি এমন কাজ করবে। ভাবি তো এখন আরো বেশি বিগড়ে গেছে দাদু।’
‘তুই আমারে কইয়া আইবি না? তোর চিল্লানি হুইননা আমার কইলজাডা উইড়া গেছিলো। বউ তোমারে দুঃখ দিছে এই ছেড়ি?’
পদ্মজা বলল, ‘না,না। কিছু করেনি আমার।’

আমির চেঁচিয়ে উঠল, ‘কী বলছো? কিছু করেনি মানে? হাত দেখি?’
আমির পদ্মজার দুই হাত টেনে নিয়ে দেখে। বাম হাতে নখের জখম। আমির ব্যথিত স্বরে বলল, ‘ইশ! কতোটা আঘাত পেয়েছো। ঘরে চলো। দাদু এই নাও চাবি। তালা মেরে দিও।’
আমির পদ্মজাকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে যায়। বেরোবার আগ মুহূর্তে পদ্মজা রুম্পার দিকে তাকাল। দেখতে পেল, রুম্পা আড়চোখে তাকে দেখছে। সে চোখে স্নেহমমতা! একটু হাসিও লেগে ছিল। পদ্মজার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল।
ঘরে এসে আমিরকে বলল, ‘উনার যত্ন কেউ নেয় না কেন?’
‘দেখোনি কী রকম করল? এই ভয়েই কেউ যায় না। শুরুতে তোমাকে দেখে যদি রেগে যেতো তখনি তোমাকে নিয়ে চলে আসতাম। সবাইকে ভাবি তুই করে বলে। তোমাকে তুমি বলে সম্বোধন করতে দেখে ভাবলাম, বোধহয় তোমাকে পছন্দ হয়েছে। তাই আঘাতও করবে না। কিন্তু ধারণা ভুল হলো।’
‘আপনি অকারণে চাপ নিচ্ছেন। নখের দাগ বসেছে শুধু।’
‘রক্ত চলে এসেছে।’
‘এইটুকু ব্যাপার না।’
আমির তুলা দিয়ে পদ্মজার হাতের রক্ত মুছে দিল। তারপর বলল, ‘আর ওইদিকে পা দিবে না।’
‘আম্মার কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে।’
‘লাবণ্যকে ঘুম থেকে তুলছে। লাবণ্য ফজরে উঠতেই চায় না।’ আমির হেসে বলল।
‘আমি যাই।’
‘কোথায়?’

‘আম্মা,সকাল সকাল রান্নাঘরে যেতে বলেছিলেন।’
‘তুমি রান্না করবে কেন?’
‘অনুরোধ এমন করবেন না, আমি আমার বাড়িতেও রান্না করেছি। টুকটাক কাজ করেছি। এখন না গেলে,আম্মা রেগে যাবেন। রাগানো ঠিক হবে না।’
‘এসব ভালো লাগে না পদ্মজা।’
‘আমি আসছি।’
পদ্মজা ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে যায়। আমিরকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে।
বাইরে বিকেলের সোনালি রোদ, মন মাতানো বাতাস। লম্বা বারান্দা পেরিয়ে নূরজাহানের ঘরের দিকে যাচ্ছে পদ্মজা। বাতাসের দমকায় সামনের কিছু চুল অবাধ্য হয়ে উড়ছে। এতে সে খুব বিরক্ত বোধ করছে। এক হাতে দই অন্য হাতে পিঠা। চুল সরাতেও পারছে না। তখন কোথেকে উড়ে আসে আমির। এক আঙুলে উড়ন্ত চুলগুলো পদ্মজার কানে গুঁজে দিয়ে আবার উড়ে চলে যায়। পদ্মজা চমৎকার করে হাসে। আমিরের যাওয়া দেখে,মনে মনে বলল, ‘চমৎকার মানুষ।’
নূরজাহানের ঘরের সামনে এসে দেখল দরজা ভিজানো। পদ্মজা অনুমতি না নিয়ে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে গেল। তার চক্ষু চড়কগাছ। পালঙ্কে ভুরি ভুরি সোনার অলংকার। জ্বলজ্বল করছে। চোখ ধাঁধানো দৃশ্য। পদ্মজাকে দেখে নূরজাহান অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন।

তা পদ্মজার চোখে পড়েছে। নূরজাহান ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলেন, ‘তুমি এই নে কেরে আইছো? আমি কইছি আইতে?’
নূরজাহানের ধমকে থতমত খেয়ে গেল পদ্মজা। দইয়ের মগ ও পিঠার থালা টেবিলের উপর রেখে বলল, ‘আম্মা বললেন দই,পিঠা দিয়ে যেতে।’
‘তোমার হউরি কইলেই হইবো? আমি কইছি? আমারে না কইয়া আমার ঘরে আওন মানা হেইডা তোমার হউরি জানে না?’
‘মাফ করবেন।’ মাথা নত করে বলল পদ্মজা।
‘যাও। বাড়াইয়া যাও।’
পদ্মজা বেরিয়ে গেল। দরজার বাইরে এসে থমকে দাঁড়ায়। ছোট কারণে এতো ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া কেন দেখালেন তিনি? পদ্মজার মাথায় ঢুকছে না। পদ্মজা আনমনে হেঁটে নিজের ঘরে চলে আসে। সে ভাবছে। এই বাড়িতে আসার পর থেকে কী কী হয়েছে সব ভাবছে। প্রথম রাতে কেউ একজন তার ঘরে এসেছিল। নোংরা স্পর্শ করেছে। সেটা যে আমির নয় সে শত ভাগ নিশ্চিত। এরপর ভোরে রানিকে দেখল চোরের মতো বাড়ির পিছনের জঙ্গলে ঢুকতে। তারপর রুম্পা ভাবির সাথে দেখা হয়। তিনি শুরুতে স্বাভাবিক ছিলেন। শেষে গিয়ে পাগলামি শুরু করেন। দরজার ওপাশে কেউ ছিল। পদ্মজা ভ্রুকুটি করে মুখে ‘চ’ কারান্ত শব্দ করল। সব ঝাপসা।

ফরিনা বলেছিলেন, দই,পিঠা দিয়েই রান্নাঘরে যেতে। পদ্মজা বেমালুম সে কথা ভুলে গিয়েছে। যখন মনে পড়ল অনেক সময় কেটে গিয়েছে। সে দ্রুত আঁচল টেনে মাথা ঘুরে ছুটে যায় রান্নাঘরের দিকে। এসে দেখে ফরিনা এবং আমিনা মাছ কাটছেন। পদ্মজা পা টিপে টিপে রান্নাঘরে ঢুকে। ভয়ে বুক কাঁপছে। কখন না কঠিন কথা শোনানো শুরু করে দেন।
‘অহন আওনের সময় হইছে তোমার? আছিলা কই?’ বললেন ফরিনা।
‘ঘরে।’ নতজানু হয়ে বলল পদ্মজা।
‘আমির তো বাইরে বাড়াইয়া গেছে অনেকক্ষণ হইলো। তুমি ঘরে কি করতাছিলা? স্বামী বাড়িত থাকলে ঘরে থাহন লাগে। নাইলে বউদের শোভা পায় খালি রান্ধাঘরে।’
চুলার চেয়ে কিছুটা দূরত্বে কয়েকটা বেগুন রাখা। এখানে আসার পর থেকে সে দেখছে প্রতিদিন বেগুন ভাজা করা হয়। পদ্মজা দা নিয়ে বসে বেগুন হাতে নিল। ফরিনা বলেন, ‘বেগুন লইছো কেরে?’
‘আজ ভাজবেন না?’

‘জাফর আর হের বউ তো গেলোই গা। এহন কার লাইগা করাম? আর কেউ খায় না বেগুন।’
পদ্মজা বেগুন রেখে দিল। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল, ‘কী করব?’
ফরিনা চোখমুখ কুঁচকে মাছ কাটছেন। যেন পদ্মজার উপস্থিতি তিনি নিতে পারছেন না। পদ্মজার প্রশ্নের জবাব অনেকক্ষণ পর কাঠ কাঠ গলায় দিলেন, ‘ঘরে গিয়া বইয়া থাহো।’
পদ্মজার চোখ দুটি ছলছল করে উঠে। ঢোক গিলে বলল, ‘আর হবে না।’
‘তোমারে কইছে না এইহান থাইকা যাইতে? যাও না কেরে? যতদিন আমরা আছি তোমরা বউরা রান্ধাঘরের দায়িত্ব লইতে আইবা না।” আমিনার কণ্ঠে বিদ্রুপ।
পদ্মজা আমিনার কথায় অবাক হয়ে গেল। সে কখন দায়িত্ব নিতে এলো? ফরিনা আমিনার কথা শুনে চোখ গরম করে তাকালেন। বললেন, ‘আমার ছেড়ার বউরে আমি মারব,কাটব,বকব। তোমরা কোনোদিন হের লগে উঁচু গলায় কথা কইবা না। বউ তুমি ঘরে যাও।’

পদ্মজার সামনে এভাবে অপমানিত হয়ে আমিনা স্তব্ধ হয়ে যান। তিনি সেই শুরু থেকে ফরিনাকে ভয় পান। তাই আর টুঁ শব্দ করলেন না। পদ্মজা ফরিনার দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। কী যেন দেখতে পেল। মনে হচ্ছে এই মানুষটারও দুই রূপ আছে। এই বাড়ির প্রায় সবাইকে তার মুখোশধারী মনে হচ্ছে। কেউ ভালো কিন্তু খারাপের অভিনয় করে। আর কেউ আসলে শয়তান কিন্তু ভালোর অভিনয় করে। কিন্তু কেন? কীসের এতো ছলনা!
‘খাড়াইয়া আছো কেন? যাও ঘরে যাও।’
‘গিয়ে কী করব? কোনো সাহায্য লাগলে বলুন না আম্মা।’
‘তোমারে যাইতে কইছি। যাও তুমি।’
পদ্মজা আর কথা বাড়াল না। ধীর পায়ে জায়গা ত্যাগ করল। এদিক-ওদিক হেঁটে ভাবতে থাকে,কার ঘরে যাবে। লাবণ্যের কথা মনে হতেই লাবণ্যের ঘরের দিকে এগোল সে। লাবণ্য বিকেলে টিভি দেখে। নিশ্চয়ই এখন টিভি দেখছে। লাবণ্যের ঘরে ঢুকেই লিখন শাহর কণ্ঠ শুনতে পেল পদ্মজা। টিভির দিকে তাকাল। দেখল,ছায়াছবি চলছে। লিখন শাহর ছায়াছবি। পদ্মজা ঘুরে দাঁড়ায় চলে যেতে। লাবণ্য ডাকল, ‘ওই ছেমড়ি যাস কই? এইদিকে আয়।’
পদ্মজা ঘরে ঢুকে, লাবণ্যর পাশে পালঙ্কে বসল। লাবণ্য দুই হাতে পদ্মজার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘সারাদিন দাভাইয়ের সাথে থাকস কেন? আমার ঘরে একবার উঁকি দিতে পারস না?’

‘তোর দাভাই আমাকে না ছাড়লে আমি কী করব?’
‘ঘুষি মেরে সরাইয়া দিবি।’
‘হ্যাঁ, এরপর আমাকে তুলে আছাড় মারবে।’
‘দাভাইকে ডরাস?’
‘একটুও না।’
‘সত্যি?’
‘মিথ্যে বলব কেন?’
‘একদিন রাগ দেখলে এরপর ঠিকই ডরাইবি।’
‘আমি রাগতেই দেব না।’
লাবণ্য হাসে। এরপর টিভির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘লিখন শাহর মতো মানুষরে ফিরাইয়া দেওনের সাহস খালি তোরই আছে। আমার জীবনেও হইতো না।’

পদ্মজা কিছু বলল না। লাবণ্যই বলে যাচ্ছে, ‘এই ছবিটা আমি এহন নিয়া ছয়বার দেখছি। লিখন শাহ তার নায়িকারে অনেক পছন্দ করে। কিন্তু নায়িকা পছন্দ করে অন্য জনরে। অন্য জনরে বিয়া করে। বিয়ার অনেক বছর পর লিখন শাহর প্রেমে পড়ে নায়িকা। ততদিনে দেরি হয়ে যায়। লিখন শাহ মরে যায়। এই হইলো কাহিনি। আইচ্ছা পদ্মজা, যদি এমন তোর সাথেও হয়?’
পদ্মজা আঁতকে উঠে বলল, ‘যাহ কী বলছিস! বিয়ের আগে ভাবতাম যার সাথে বিয়ে হবে তাকেই মানব। কিন্তু এখন আমার তোর ভাইকেই দরকার।’
‘ওরেএ! লাইলি হয়ে যাইতাছস। যাহ,আমিও মজা করছি। আমি কেন চাইব আমার ভাইয়ের বউ অন্যজনরে পছন্দ করুক। লিখন শাহ আমার। শয়নে স্বপনে তার লগে আমি সংসার পাতি। ‘
পদ্মজা হাসল। লাবণ্যর পিঠ চাপড়ে বলল, ‘আব্বারে বল,লিখন শাহকে ধরে এনে তোর গলায় ঝুলিয়ে দিবে।’
‘বিয়া এমনেও দিয়া দিব। কয়দিন পর মেট্রিকের ফল দিব। আমি তো ফেইল করামই। দেহিস।’
‘কিছু হবে না। পাশ করবি। রানি আপা কই?’

‘কী জানি কই বইয়া রইছে। চুপ থাক এহন। টিভি দেখ। দেখ, কেমনে কানতাছে লিখন শাহ। এই জায়গাটা আমি যতবার দেহি আমার কাঁনদন আইসা পরে।’ বলতে বলতে লাবণ্য কেঁদে দিল। ওড়নার আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছল।
পদ্মজা টিভির দিকে মনোযোগ সহকারে তাকাল। দৃশ্যে চলছে, লিখন শাহ ঠোঁট কামড়ে কাঁদছে। ঘোলা চোখ দুটি আরো ঘোলা হয়ে উঠেছে। ঘরের জিনিসপত্র ভাংচুর করছে। তার মা,বোন,ছোট ভাই ভয়ে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। এক টুকরো কাচ ঢুকে পড়ে লিখন শাহর পায়ে। আর্তনাদ করে ফ্লোরে বসে পড়ে। তার মা দৌড়ে আসে। পাগলামি থামাতে বলে। লিখন শাহ আর্তনাদ করে শুধু বলছে, ‘তুলির বিয়ে হয়ে যাচ্ছে আম্মা। আমি কী নিয়ে বাঁচব। কেন তুলি আমাকে ভালোবাসলো না। আমি তো সত্যি ভালোবেসে ছিলাম।’

পদ্মজা বাকিটা শুনল না। মনোযোগ সরিয়ে নিল। তার কানে বাজছে, ‘পদ্মজার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে আম্মা। আমি কী নিয়ে বাঁচব? কেন পদ্মজা আমাকে ভালোবাসলো না। আমি তো সত্যি ভালোবেসেছিলাম।’
পদ্মজার চোখের কার্নিশে অশ্রু জমে। সে অশ্রু আড়াল করে লাবণ্যকে বলল, ‘তুই দেখ। আমি যাই।’
লাবণ্যের কানে পদ্মজার কথা ঢুকল না। সে টিভি দেখছে আর ঠোঁট ভেঙে কাঁদছে। পদ্মজা আর কিছু বলল না। উঠে দাঁড়ায় চলে যেতে। দরজার সামনে আমিরকে দেখতে পেল। তার বুক ধক করে উঠল। পরে মনে হলো, সে তো কোনো অপরাধ করেনি। তাহলে এতো আশ্চর্য হওয়ার কী আছে। আমির কাগজে মোড়ানো কিছু একটা এগিয়ে দিল। বলল, ‘ঘরেও পেলাম না। রান্নাঘরেও না। তাই মনে হলো লাবণ্যর ঘরেই আছো। টিভি দেখছিলে নাকি?’
বাসন্তী গাঢ় করে ঠোঁটে লিপস্টিক দিচ্ছেন। প্রেমা,প্রান্ত বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখছে। তারা দুজন বাসন্তীকে মেনে নিয়েছে। বাসন্তীর কথাবার্তা, চালচলন আলাদা। যা ছোট দুটি মনকে আনন্দ দেয়। আগ্রহভরে বাসন্তীর কথা শুনে তারা। লিপস্টিক লাগানো শেষ হলে বাসন্তী প্রেমাকে বলল, ‘তুমি লাগাইবা?’

প্রেমা হেসে মাথা নাড়ায়। বাসন্তীর আরো কাছে ঘেঁষে বসে। বাসন্তী প্রেমার ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক গাঢ় করে ঘষে দিল। এরপর প্রান্তকে বলল, ‘তুমিও লাগাইবা আব্বা?’
‘জি।’ বলল প্রান্ত। প্রেমাকে লিপস্টিকে সুন্দর লাগছে। তাই তারও ইচ্ছে হচ্ছে।
বাসন্তী প্রান্তর ঠোঁটে লিপস্টিক দেওয়ার জন্য উঁবু হোন। পূর্ণা বেশ অনেকক্ষণ ধরে এসব নাটক দেখছে। এই মহিলাকে সে একটুও সহ্য করতে পারে না। এক তো সৎ মা। বাপের আরেক বউ। তার উপর এই বয়সে এসে এতো সাজগোজ করে। প্রান্তকে লিপস্টিক দিচ্ছে দেখে তার গা পিত্তি জ্বলে উঠল। ঘর থেকে দপদপ করে পা ফেলে ছুটে আসে। প্রান্তকে টেনে দাঁড় করিয়ে বলল, ‘হিজরা সাজার ইচ্ছে হচ্ছে কেন তোর? কতবার বলছি এই বজ্জাত মহিলার সাথে না ঘেঁষতে?’

বাসন্তী ভয় পান পূর্ণাকে। মেয়েটা খিটখিটে, বদমেজাজি। হেমলতা বলেছেন, সেদিনের দূর্ঘটনার পর থেকে পূর্ণা এমন হয়ে গেছে। হুটহাট রেগে যায়। কথা শুনে না। পদ্মজা যাওয়ার পর থেকে আরো বিগড়ে গেছে। এজন্য যথাসম্ভব পূর্ণাকে এড়িয়ে চলেন। তবুও এসে আক্রমণ করে বসে। গত দুই সপ্তাহে মেয়েটা অতিষ্ঠ করে তুলেছে জীবন। তিনি কাটা কাটা গলায় পূর্ণাকে বললেন, ‘এই ছিক্ষা পাইছো তুমি? গুরুজনদের সাথে এমনে কথা কও।’
‘আপনি চুপ থাকেন। খারাপ মহিলা। বুড়া হয়ে গেছে এখনও রঙ-ঢঙ করে।’
পূর্ণার কথা মাটিতে পড়ার আগে তীব্র থাপ্পড়ে সে মাটিতে উল্টে পড়ল। চোখের দৃষ্টি গরম করে ফিরে তাকায় সে, দেখার জন্য, কে মেরেছে তাকে! দেখল হেমলতাকে। হেমলতা অগ্নি চোখে তাকিয়ে আছেন। যেন চোখের দৃষ্টি দিয়ে পূর্ণাকে পুড়িয়ে ফেলবেন। পূর্ণার চোখ শিথিল হয়ে আসে। সে চোখ সরিয়ে নেয়। হেমলতা বললেন, “নিজেকে সংশোধন কর। এখনও সময় আছে।’

পূর্ণা নতজানু অবস্থায় বলল, ‘আমি এই মহিলাকে সহ্য করতে পারি না আম্মা।’
‘করতে হবে। উনার অধিকার আছে এই বাড়িতে।’
‘আমি খুন করব এই মহিলাকে।’ পূর্ণার রাগে শরীর কাঁপছে।
পূর্ণার অবস্থা দেখে হেমলতার দৃষ্টি গেল থমকে। পূর্ণা কেন এমন হলো? তিনি কী এক মেয়ের শূন্যতার শোক কাটাতে গিয়ে আরেক মেয়েকে সময় দিচ্ছেন না। বুঝিয়ে, শুনিয়ে পূর্ণাকে আবার আগের মতো করতে হবে। তিনি কণ্ঠ খাদে নামানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু এরপর পূর্ণা যা বলল তিনি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। পূর্ণা বাসন্তীকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘বেশ্যার মেয়ে বেশ্যাই হয়। আর বেশ্যার সাথে এক বাড়িতে থাকতে ঘৃণা করে আমার।’
হেমলতা ছুটে যান বাইরে। বাঁশের কঞ্চি নিয়ে ফিরে আসেন। বাসন্তী দ্রুত আগলে ধরেন পূর্ণাকে। হেমলতাকে অনুরোধ করেন, ‘এত বড় ছেড়িডারে মাইরো না। ছোট মানুছ। বুঝে না।’

‘আপা, আপনি সরেন। ও খুব বেড়ে গেছে।’
বাসন্তীর স্পর্শ পূর্ণার ভালো লাগছে না। সে ঠেলে সরিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে হেমলতা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে পূর্ণার পিঠে বারি মারলেন। পূর্ণা আর্তনাদ করে শুয়ে পড়ে। হেমলতা আবার মারার জন্য প্রস্তুত হোন, বাসন্তী পূর্ণাকে আগলে বসেন। অনুরোধ করেন, ‘যুবতি ছেড়িদের এমনে মারতে নাই। আর মাইরো না।’
প্রেমা,প্রান্ত ভয়ে গুটিয়ে গেছে। হেমলতার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। তিনি বাঁশের কঞ্চি ফেলে লাহাড়ি ঘরের দিকে যান। বারান্দায় বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। মনে মনে মোর্শেদের উপর ভীষণভাবে ক্ষেপে যান। মোর্শেদ চিৎকার করে করে বাসন্তীর সম্পর্কে সব বলেছে বলেই তো পূর্ণা জেনেছে। আর তাই এখন পূর্ণা কারো অতীত নিয়ে আঘাত করার সুযোগ পাচ্ছে। মোড়ল বাড়ির ছোট সংসারটা কেমন ওলটপালট হয়ে গেছে। হেমলতা আকাশের দিকে তাকিয়ে হা করে নিঃশ্বাস নেন। সব কষ্ট,যন্ত্রণা যদি উড়ে যেত। সব যদি আগের মতো হয়ে যেত। সব কঠিন মানুষেরাই কী জীবনের এক অংশে এসে এমন দূর্বল হয়ে পড়ে? কোনো দিশা খুঁজে পায় না?

আমি পদ্মজা পর্ব ২৬+২৭+২৮+২৯+৩০

আমির বিছানায় বসে উপন্যাসের বই পড়ছে। ছয়দিন পর পদ্মজার মেট্রিকের ফলাফল। এরপরই ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হবে। যদিও ফরিনা বেগম রাজি নন। কিন্তু আমির মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সে পদ্মজাকে রাজধানীতে নিবেই। পদ্মজার কথা মনে হতেই আমির বই রেখে গোসলখানার দরজার দিকে তাকাল। তার ঘরের সাথে আগে গোসলখানা ছিল না। পদ্মজার জন্য করা হয়েছে। সে বই রেখে সেদিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। তখনি পদ্মজা চিৎকার করে উঠল। তাই দ্রুত দৌড়ে গেল। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। পদ্মজা শাড়ি দিয়ে শরীর ঢেকে রেখেছে। কিছুটা কাঁপছে। আমির দ্রুত কাছে এসে বলল, ‘কী হয়েছে?’
‘ওখানে,ওখানে কে ছিল। আ…আমাকে দেখছিল।’
পদ্মজার ইঙ্গিত অনুসরণ করে আমির সেদিকে তাকাল। গোসলখানার ডান দেয়ালের একটা ইট সরানো। সকালে তো সরানো ছিল না! পদ্মজা কাঁদতে থাকল। কাপড় পাল্টাতে গিয়ে হঠাৎ চোখ পড়ে দেয়ালে। আর তখনই দুটি চোখ দেখতে পায়। সে তাকাতেই চোখ দুটি দ্রুত সরে যায়। পদ্মজার পিল চমকে উঠে। আমির পদ্মজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘শুকনো কাপড় পরে আসো। কেঁদো না।’

কথা শেষ করেই সে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার তাড়া দেখে মনে হলো, অজ্ঞাত আগন্তুককে আমির চিনে। পদ্মজা দ্রুত কাপড় পরে নিল। এরপর আমিরকে খুঁজতে থাকল। আমির সোজা রিদওয়ানের ঘরের দিকে যায়। রিদওয়ান পানি পান করছিল। আমির গিয়ে রিদওয়ানের বুকের শার্ট খামচে ধরে। চিৎকার করে বলল, ‘তোকে সাবধান করেছিলাম। দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছিলাম।’
‘শার্ট ছাড়।’
‘ছাড়ব না। কী করবি? তুই আমার বউয়ের দিকে কু-নজর দিবি আর আমি ছেড়ে দেব?’
‘প্রমাণ আছে তোর কাছে?’
‘কুত্তার বাচ্চা,প্রমাণ লাগবে? আমি জানি না?’
‘আমির মুখ সামলা। গালাগালি করবি না।’
‘করব। কী করবি তুই?’
‘আবার বলছি,শার্ট ছাড়।’
আমির ঘুষি মারে রিদওয়ানের নাকে। রিদওয়ান টাল সামলাতে না পেরে পালঙ্কের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। চিৎকার, চেঁচামিচি শুনে বাড়ির সবাই রিদওয়ানের ঘরে ছুটে আসে।

আমি পদ্মজা পর্ব ৩৬+৩৭+৩৮+৩৯+৪০