আমি পদ্মজা পর্ব ৪+৫+৬

আমি পদ্মজা পর্ব ৪+৫+৬
ইলমা বেহরোজ

দিনটাকে পদ্মজার অলক্ষুণে মনে হচ্ছে। সকালে উঠে দেখল, লাল মুরগিটার একটা বাচ্চা নেই। নিশ্চয় শিয়ালের কারবার। রাতে মুরগি খোপের দরজা লাগানো হয়নি। আর এখন আবিষ্কার করল, দেয়াল ঘড়িটার কাঁটা ঘুরছে না। ঘড়িটা রাজধানী থেকে হানি খালামণি দিয়েছিলেন। গ্রামে খুব কম লোকই হাত ঘড়ি পরে। দেয়াল ঘড়ি হাতেগুণা দুই-তিনজনের বাড়িতে আছে। পদ্মজা সূর্যের দিকে তাকিয়ে সময়ের আন্দাজ করার চেষ্টা করল। পূর্ণা, প্রেমা দুপুরে খেয়েই ঘুম দিয়েছে। পদ্মজা মায়ের রুমে উঁকি দিল। হেমলতা মনোযোগ দিয়ে সেলাই মেশিনে কাপড় সেলাই করছেন। আটপাড়ায় একমাত্র হেমলতাই সেলাই কাজ করেন। প্রতিটি ঘরের কারো না কারো পরনে তার সেলাই করা কাপড় আছেই।

‘লুকিয়ে দেখছিস কেন? ঘরে আয়।’
হেমলতার কথায় পদ্মজা লজ্জা পেল।
‘না আম্মা। কাজ আছে। ‘
‘পানি দিয়ে যা।’
হেমলতা জগ বাড়িয়ে দেন। পদ্মজা জগ হাতে নিয়ে বলল, ‘আম্মা,ছদকা কোন মুরগিটা দেব?’
হেমলতা গতকাল স্বপ্নে দেখেছেন বাড়িতে আগুন লেগেছে। তাই তিনি ছদকা দিবেন বলে মনস্থির করেছেন। সকালেই পদ্মজাকে মনের কথা জানালেন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ সাদা মোরগটা দিয়ে দিস। মুন্না কি আসছে?’
‘না। প্রতিদিন বিকেলবেলা তো পানি নিতে আসে। কিছুক্ষণ পরই আসবে।’
হেমলতা আর কথা বাড়ালেন না। পদ্মজা কলপাড় থেকে পানি নিয়ে আসে। আছরের আযানের সাথে সাথে মুন্না আসল। গ্রামে সচ্ছল পরিবার নেই বললেই চলে। হাতে গোনা কয়েকটা পরিবারে সচ্ছলতা আছে। হেমলতার পরিবারটা টিকে আছে, হেমলতার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং পরিশ্রমের জন্য। পুরো আটপাড়ায় টিউবওয়েল মাত্র পাঁচটা। পদ্মজাদের টিউবওয়েল থেকে পানি নিতে প্রতিদিন অনেকেই আসে। তার মধ্যে নিয়মিত একজন মুন্না। দশ বছরের একটা ছেলে। মা নেই। বাবা পঙ্গু। সদরে বসে ভিক্ষা করে। পদ্মজা মোরগ নিয়ে কলপাড়ে এসে দেখে মুন্না নেই। একটু সামনে হেঁটে এসে ঘাটে মুন্নাকে দেখতে পেল। ডাকল,’মুন্না।’

মুন্না ফিরে তাকায়। পদ্মজার হাতে সাদা মোরগ দেখে মুন্না খুব খুশি হয়। পদ্মজা না বললেও বুঝে যায়, ছদকা পাবে আজ। মুন্না এগিয়ে আসল। দাঁত কেলিয়ে হাসল।
‘হাসিস কেন? নে মোরগ। তোর আব্বাকে নিয়ে খাবি।’
মুন্না যে খুব খুশি হয় তা দেখেই বোঝা গেল। খুশিতে গদগদ হয়ে মোরগটাকে জড়িয়ে ধরল। পদ্মজার ঠোঁট দুটি নিজেদের শক্তিতে প্রশান্তির হাসিতে মেতে উঠল। কী সুন্দর মুন্নার হাসি! পদ্মজা বলল, ‘খুব খুশি?’

‘হ।’
‘দোয়া করবি আমরা যেন ভাল থাকি।’
‘করবাম আপা।’
‘আচার খাবি মুন্না?’
‘হ,খাইবাম।’
পদ্মজা আবার হাসল। মুন্না পেটুক। খাওয়ার কথা শুনলেই চোখ চকচক করে উঠে। পদ্মজা আচার নিয়ে আসে। মুন্নার সাথে বসে আরাম করে খায়। মুন্না একটু একটু করে খেতে খেতে বলল, ‘আপা, তুমি খুব ভালা।’
‘তাই?’

‘হ।বড় হইয়া তোমারে বিয়া করবাম আমি।’
পদ্মজা বিষম খেল। দ্রুত এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল কেউ শুনল নাকি। বিয়ে তার কাছে খুব লজ্জাজনক শব্দ। বিয়ে নামটা শুনলেই লজ্জায় লাল টুকটুকে হয়ে যায়। ফিসফিসিয়ে মুন্নাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘বিয়ের কথা কোথায় শিখলি?’
‘ আব্বা কইছে।’
‘ আর বলবি না এসব। যা,বাড়িত যা।’
পদ্মজা তড়িঘড়ি করে বাড়ির ভেতর চলে যায়।
রান্নাঘরে ঢুকে দেখল, হেমলতা রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সন্ধ্যার পর বিদ্যুৎ থাকে না। হারিকেন জ্বালিয়ে রান্না করতে হয়। প্রতিদিন ঘরে একটা হারিকেন আর রান্নাঘরে একটা হারিকেন জ্বালানো অনেক খরচের ব্যাপার। তাই তিনি বিকেলে রাতের রান্না সেড়ে ফেলেন।

‘আম্মা আমি রাঁধি?’
‘লাগবে না। সাহায্য কর শুধু।’
পদ্মজা চোখ ঘুরিয়ে দেখল, কী কাজ করা যায়। কোনো সাহায্যের প্রয়োজন নেই। হেমলতা নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, ‘ লাউ নিয়ে আয়।’
‘ছিড়ে আনব? না লাহাড়ি ঘরে আছে?’
‘লাহাড়ি ঘরে নাই।’
পদ্মজা মায়ের আদেশ পেয়ে যেন চাঁদ পেয়েছে। এমন ভাব ধরে দ্রুত ছুটে যায় লাউ আনতে। লাউ,বরবটি, ঢেঁড়স, কাঁকরোল, করলা, চিচিঙ্গা, পটল, ঝিঙা.. ইত্যাদি, ইত্যাদি সব রকমের সবজির মেলা বাড়ির চারপাশ ঘিরে। পদ্মজা সাবধানে ঘাসের উপর দিয়ে লাউ গাছের দিকে এগোয়। বর্ষাকাল হওয়াতে জোঁকের উপদ্রব বেড়েছে। জোঁকের ভয় অবশ্য নেই তার।

হেমলতা পদ্মজার যাওয়া পানে ঝিম মেরে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। মেয়েটাকে দেখলে তার মন বিষণ্নতায় ভরে উঠে। পদ্মজার চুল দেখলে মনে হয়, এই সুন্দর ঘন কালো রেশমী চুল পদ্মজার একেকটা কাল রাত। পদ্মজার ছিমছাম গড়নের দুধে আলতা দেহের অবয়ব দেখলে মনে হয়, এই দেহ পদ্মজার যন্ত্রণা। এই দেহ ধ্বংস হবে। পদ্মজার ওষ্ঠদ্বয়ের নিম্নে স্থির হয়ে থাকা কালো সূক্ষ্ম তিল দেখলে মনে হয়, এই তিল পদ্মজার এক জীবনের কান্নার কারণ। হেমলতা পদ্মজার রূপের বাহার নিতে পারেন না। কেন কৃষ্ণকলির ঘরে ভুবন মোহিনী রূপসীর জন্ম হলো! জন্ম,মৃত্যু, বিয়ে কারো হাতে থাকে না। যদি থাকতো, হেমলতা মোর্শেদকে বিয়ে করতেন না এবং পদ্মজার মতো রূপসীর জন্ম দিতেন না। আল্লাহর কাছে,রূপসী মেয়ে ভুলেও চাইতেন না। হেমলতার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

আজ শুক্রবার। স্কুল নেই। ফজরের নামায পড়ে তিন বোন পড়তে বসেছে। প্রেমা নামায পড়তে চায় না। ঘুমাতে চায়। হেমলতার মারের ভয়ে নামায পড়ে। সে ঝিমুচ্ছে আর পড়ছে। তা দেখে পদ্মজা আর পূর্ণা ঠোঁট টিপে হাসছে। হেমলতা বিরক্ত হোন। প্রেমার তো পড়া হচ্ছেই না। সেই সাথে পদ্মজা, পূর্ণার মনোযোগ নষ্ট হচ্ছে। তিনি কর্কশ কণ্ঠে ধমকে উঠলেন, ‘প্রেমা,ঘুমাচ্ছিস কেন? ঠিক হয়ে পড়।’
প্রেমা সচকিত হলো। চট করে চোখ খুলে, ভয়ে তাড়াতাড়ি পড়া শুরু করল। হেমলতা কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক গলায় বললেন, ‘পড়তে হবে না। ঘরে গিয়ে ঘুমা।’

প্রেমা একটু অবাক হয়। পরেই খুশি হয়ে ছুটে যায় ঘরে। পূর্ণা মুখ ভার করে ফেলল। তার ও তো পড়তে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু, মা কখনো তাকে ছাড় দেন না। হয়তো ছোটবেলা ছাড় দিতেন। মনে নেই। সে আবার খুব দ্রুত সব ভুলে যায়। ব্রেন ভাল প্রেমার। যা পড়ে মনে থাকে। পূর্ণা খুব দ্রুত ভুলে যায়। পদ্মজার সবকিছুই স্বাভাবিক। শুধু রূপ বাদে।
সূর্য উঠার সাথে সাথে মোর্শেদ বাড়িতে ঢুকেন। হাতে ঝাকি জাল আর বড়শি। কাঁধে পাটের ব্যাগ ঝুলানো। ভোরে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। মোর্শেদ বাড়ি ফিরলে পূর্ণা আর প্রেমা সবচেয়ে বেশি খুশি হয়। মাছ খেতে পারে অনেক। অর্থের জন্য হেমলতা খুব কম মাছ আনেন। মোর্শেদ বাড়িতে যতদিন থাকেন ততদিন মাছের অভাব হয় না। মোর্শেদ বলার পূর্বেই পূর্ণা ও প্রেমা গামলা নিয়ে ছুটে আসে উঠানে। মোর্শেদ কাঁধের ব্যাগ উল্টে ধরেন গামলার উপর। পুঁটি, ট্যাংড়া, পাবদা,চিংড়ি মাছের ছড়াছড়ি। হেমলতা ভারী খুশি হোন। পদ্মজা লতা দিয়ে চিংড়ি খেতে খুব পছন্দ করে। আর প্রেমা, পূর্ণা পছন্দ করে পাবদা মাছের ভুনা। মেয়েগুলো খুব খুশি হয়েছে মাছ দেখে। তিনি জানেন, মোর্শেদ বাড়ি থেকে বের হতেই পদ্মজা ছুটে যাবে বাড়ির পিছনে লতা আনতে।

‘হুনো, লতা। আমার আম্মারারে পাবদা ভুনা কইরা দিবা। সবজি টবজি দিয়া রাঁনবা না।’
‘আব্বা,আপনি বাড়িতে থাকবেন? তাইলে তো প্রতিদিনই মাছ খেতে পারি।’
মোর্শেদ আড়চোখে পদ্মজাকে একবার দেখে তীক্ষ্ণ চোখে হেমলতার দিকে তাকান। এরপর পূর্ণাকে জবাব দিলেন, ‘কোনোরহম অশান্তি না হইলে তো থাকবামই।’
গামছা নিয়ে তিনি কলপাড়ে চলে যান। পদ্মজার মুখটা ছোট হয়ে যায়। প্রতিবার বাড়ি ছাড়ার পূর্বে মোর্শেদ পদ্মজাকে রাগে কটুকথা শোনান। তখন, হেমলতা মোর্শেদকে শাসান। ফলস্বরূপ মোর্শেদ বাড়ি ছাড়েন।
‘মোর্শেদ নাকি? বাড়ি ফিরলা কোনদিন?’

মোর্শেদ গোসল সেড়ে রোদ পোহাচ্ছিলেন। সকালের মিষ্টি রোদ। ঘাড় ঘুরিয়ে রশিদ ঘটককে দেখে হাসলেন।
‘আরে মিয়া চাচা। আহেন, আহেন। পূর্ণারে চেয়ার আইননা দে। খবর কী?’
পূর্ণা চেয়ার এনে দিল। রশিদ এক দলা থুথু উঠানে ফেলে চেয়ারে বসলেন আরাম করে। প্রেমাকে উঠানে খেলতে দেখে ফরমায়েশ দিলেন, ‘এই মাইয়া যা পানি লইয়া আয়। অনেকক্ষণ ধইরা দমডা আটকাইয়া আছে।’
প্রেমা পানি নিয়ে আসে। রশিদ পানি খেয়ে মোর্শেদকে বললেন, ‘খবর তো ভালাই। বাবা ছেড়িডারে কী বিয়া দিবা না?’
‘দুই বছর যাক। পড়তাছে যহন,মেট্রিকটা পাশ করুক। কী কন?’
‘মেজোডা না। বড়ডা। তোমার বউ তো মরিচের লাহান। কোনোবায়ও রাজি অয় না। তুমি বোঝাওছেন। পাত্র খাঁটি হীরা। বাপ-দাদার জমিদারি আছে। ‘

মোর্শেদ আড়চোখে হেমলতা এবং পদ্মজার উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলেন। নেই তারা। তিনি জানেন, পদ্মজার উপর কোনোরকম জোরজবরদস্তি তিনি করতে পারবেন না। হেমলতা তা হতে দিবেন না। এসব তো আর বাইরের মানুষের সামনে বলা যায় না। মোর্শেদ রশিদ ঘটককে নরম গলায় বললেন, ‘থাকুক না পড়ুক। মায়ে যহন চায় ছেড়ি পড়ুক। তাইলে পড়ুক৷’

রশিদ নিরাশ হলেন। ভেবেছিলেন, মোর্শেদ রাজি হবে। তিনি মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে ছিলেন। এরপর বড় অসুখে পড়লেন। তাই মোর্শেদ বাড়ি ফিরেছে শুনেও আসতে পারেননি। আজ একটু আরামবোধ হতেই ছুটে এসেছেন অনেক আশা নিয়ে। কিন্তু মোর্শেদের জবানবন্দিতে তিনি আশাহত হলেন। কটমটে গলায় বললেন, ‘যুবতী ঘরে রাহন ভালা না। যহন বংশে কালি পড়ব তহন বুঝবা। হুনো মোর্শেদ, এই বয়সী মাইয়াদের স্বভাব চরিত্র বেশিদিন ভালা থাহে না৷ পাপ কাম এদের চারপাশে ঘুরঘুর কর। বেলা থাকতে জামাই ধরাইয়া দেওন লাগে। বুঝছোনি? তোমার বউরে বোঝাও।’
রশিদ, পাত্রের অনেক প্রশংসা করলেন। জমিজমা, বাড়িঘর সবকিছুর বাড়াবাড়ি রকমের বর্ণনা দিলেন।
ফলে,মোর্শেদের মস্তিষ্ক কাজ করা শুরু করল। রশিদ ঘটক যেতেই তিনি হেমলতার পাশে গিয়ে বসেন। ইনিয়েবিনিয়ে পদ্মজার বিয়ের কথা তুলেন। হেমলতা সাফ নাকচ করে দেন। তিনি শান্তকণ্ঠে বুঝিয়ে দেন, পদ্মজার বিয়ে তিনি দিচ্ছেন না। আর মোর্শেদকে পদ্মজার ব্যাপারে নাক গলাতে না করেছেন। শেষ কথাটা বেশ কঠিন করেই বলেন, ‘আগে বাপ হও। পরে বাপের কাজ করতে আসবা।’
মোর্শেদের তিরিক্ষি মেজাজ। তিনি রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। রগে রগে রাগ টগবগ করছে। পদ্মজাকে বারান্দায় দেখে তিনি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন, ‘ছেড়ি যহন রূপ দিয়া নটি হইব। তহন আমার ঠ্যাংও পাইবা না। এই ছেড়ি মজা বুঝাইবো। ‘

পদ্মজার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। হেমলতা রান্নাঘর থেকে বের হলেন মোর্শেদকে কিছু কঠিন কথা শোনাতে। পদ্মজা তখন দৌড়ে আসে। হেমলতার হাতে ধরে রান্নাঘরের ভেতরে নিয়ে যায়। মোর্শেদ যতক্ষণ বাড়িতে থাকে তারও খুব ভাল লাগে। পূর্ণা,প্রেমা কত খুশি হয়। বাড়িটা পরিপূর্ণ লাগে। সে চায় না তার বাবা ঝগড়া করে রাগ নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাক। হেমলতা রাগে এক ঝটকায় মেয়ের হাত সরিয়ে দেন। তার সহ্য হয় না মোর্শেদকে। মানুষের কথা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া বদমেজাজি একজন মানুষ মোর্শেদ। ভালটা কখনো বুঝে না। মানুষের কথায় নাচে। সারাক্ষণ মস্তিষ্কে একটা বাক্যেরই পূজা করে, ‘মানুষ কী বলবে? ‘

মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। মাথার উপর বৃষ্টি নিয়ে মোর্শেদ বাড়ি ফেরেন। মুখ দেখে বোঝা গেল, তিনি খুব খুশি। হেমলতাকে ডেকে বললেন, ‘এক মাসের লাইগগা ঘরটা ছাইড়া লাহাড়ি ঘরে উইঠঠা পড়।’
‘কীসের দরকারের জন্য?’
‘শুটিং করার লাইগগা মাতব্বর বাড়ির যারা আইছে, তারার বুলি আমরার বাড়ি পছন্দ অইছে। বিরাট অংকের টেকা দিব কইছে। আমিও কথা দিয়া আইছি। কাইলই উঠতে কইয়া আইছি।’
হেমলতা বিরক্ত হতে গিয়েও পারলেন না। সত্যি অর্থের খুব দরকার। পদ্মজার সামনে মেট্রিক পরীক্ষা। কত খরচ। কলেজে পড়াতে ঢাকা পাঠাতে হবে। তিনি মোর্শেদকে বললেন, ‘টাকার ব্যাপারটা নিয়ে আমার সাথে আলোচনা করতে বলবা। নয়তো জায়গা হবে না।’

‘আরে..বলামনে। এখন সব গুছাইয়ালাও ।’
পূর্ণা আড়াল থেকে সবটা শুনেছে। সাত দিন হয়েছে লিখন শাহ আর চিত্রা দেবী এই গ্রামে এসেছে। অথচ, সে দেখতে পারল না। হেমলতা যেতে অনুমতি দেননি। পূর্ণা নামাযের দোয়ায় খুব অনুনয় করেছে আল্লাহকে। যেন লিখন শাহ আর চিত্রা দেবীকে স্বচক্ষে দেখতে পারে। আর এখন শুনলো, তাদের বাড়িতেই নাকি আসছে ওরা! পূর্ণার মনে হচ্ছে সে খুশিতে মরে যাচ্ছে।

‘এই মগা? আমাকে এক কাপ চা দাও তো।’
মগা ঝড়ের গতিতে চা নিয়ে আসে। লিখন চিত্রার পাশের চেয়ারটায় বসল। এরপর মগাকে বলল, ‘দারুণ চা করো তো তুমি।’

মগা কাচুমাচু হয়ে হাসল। ভাবে বোঝা গেল, প্রশংসা শুনে সে ভীষণ লজ্জা পেয়েছে। চিত্রা মগার ভাবভঙ্গি দেখে হেসে উঠল। চিত্রা হাসলে মগা মুগ্ধ হয়ে দেখে। মাতব্বর বাড়ির কামলা সে। চিত্রনায়ক লিখন শাহ এবং চিত্র নায়িকা চিত্রা দেবীর সেবা করার দায়িত্ব মগাকে দেয়া হয়েছে। মগা এতে ভীষণ খুশি। চিত্রার সুন্দর মুখশ্রীর সামনে সবসময় থাকতে পারবে ভেবে। চিত্রা বলল, ‘তোমার ভাইয়ের নাম জানি কী বলছিলে?’
চার ফুট উচ্চতার মগা উৎসাহ নিয়ে জবাব দিল, ‘মদন।’
চিত্রার হাসি পায়। অনেক কষ্টে চেপে রাখল। মগা,মদন কারো নাম হয়?

শুটিংয়ের মাঝে হুট করে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। তাই আপাতত শুটিং স্থগিত আছে। সবাই বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখছে। হাতে সবার রং চা । ডিরেক্টর আবুল জাহেদ দারুণ খিচুড়ি রান্না করেন। বৃষ্টি দেখেই তিনি রান্নাঘরে ঢুকেছেন।
‘ আচ্ছা, মগা এই বাড়ির দুইটা মেয়ে কোথায়? আসার পর একবার এসেছিল। এরপর তো আর এলো না।’
চিত্রা প্রশ্ন করল। মগা বলল, ‘ওই যে লাহাড়ি ঘর। ওইডাত আছে।’

‘লাহাড়ি ঘর মানে কি?’
মগার বদলে লিখন বলল, ‘ যে ঘরের অর্ধেক জুড়ে ধান রাখা হয়। আর অর্ধেক জায়গায় চৌকি থাকে কামলাদের জন্য ওই ঘরকে লাহাড়ি ঘর বলে এখানে। বোঝা গেছে?
চিত্রা চমৎকার করে হাসল।
‘ বোঝা গেছে। মগা, বৃষ্টি কমলে লাহাড়ি ঘরে যাব। ঠিক আছে?’
‘আইচ্ছা আপা।’

‘এই লিখন যাবা? ওইতো সামনেই। আলসেমি করো না।’
মগা হৈহৈ করে উঠল, ‘না না, বেঠা লইয়া যাওন যাইত না। বাড়ির মালিকের মানা আছে। ‘
লিখন মগার না করার ভাব দেখে ভীষণ অবাক হলো। চিত্রা প্রশ্ন করল, ‘মানা কেন?’
‘বাড়ির বড় ছেড়িডারে তো আপনেরা দেহেন নাই। আগুন সুন্দরী। এই লিখন ভাইয়ের লাহান বিলাই চোখা। ছেড়িডারে স্কুল ছাড়া আর কোনোহানো যাইতে দেয় না। বাড়ি দিবার আগে কইয়া রাখছে লাহাড়ি ঘরে বেঠামানুষ না যাইতে। এই ছেড়ি লইয়া বহুত্তা কিচ্ছা আছে।’

চিত্রা বেশ কৌতুহল বোধ করল। লিখন তীক্ষ্ণ ঘোলা চোখে লাহাড়ি ঘরের দিকে তাকাল। দেড় দিন হলো এখানে এসেছে। উঠানের শেষ মাথায় থাকা লাহাড়ি ঘরটা একবারো মনোযোগ দিয়ে দেখা হয়নি।
সামনের দরজাটা বন্ধ। দুটো ছোট মেয়ে এসেছিল ঘরটার ডান পাশ দিয়ে। ঘরটার ডানে-বামে পিছনে গাছপালা। বাড়িটা পুরনো হলেও দারুণ। তবে এই মুহূর্তে তাঁর অন্যকিছুর প্রতি তীব্র কৌতূহল কাজ করছে।

লাহাড়ি ঘর দু’ভাগ করা হয়েছে চাদর টানিয়ে। একপাশের চৌকিতে হেমলতা এবং মোর্শেদ থাকেন। অন্যপাশের চৌকি পদ্মজা,পূর্ণা ও প্রেমার দখলে। লাহাড়ি ঘরের পিছনের দরজা আপাতত প্রধান দরজা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পিছনে অনেক কচু গাছ ছিল। হেমলতা মোর্শেদকে নিয়ে জায়গা খালি করেছেন। এরপর সেখানে মাটির চুলা তৈরি করা হয়েছে। বড় সড়কে উঠার জন্য ঝোপঝাড় কেটে সরু করে পথ করা হয়েছে। এতে মোর্শেদের সাহায্য ছিল না। হেমলতা দুই মেয়েকে নিয়ে একাই করেছেন। শুটিং দলে অনেক পুরুষ। পদ্মজাকে ভুলেও তাদের সামনে দিয়ে আসা-যাওয়া করতে দেওয়া যাবে না । হেমলতার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে, পদ্মজার মুখ পুড়িয়ে দিতে। পরক্ষণেই নিজের উপর ঘৃণা চলে আসে। কী করে নিজের মেয়ের প্রতি এমন মনোভাব আসতে পারে? অথচ,পদ্মজার হাতে সূচ ফুটলে হেমলতার মনে হয় নিজের শরীরে আঘাত লেগেছে। কী জন্য এতো টান পদ্মজার প্রতি? ভেতরে ভেতরে হেমলতা এই প্রশ্নের উত্তর জানেন। শুধু প্রকাশ পায় না। না জানার ভান ধরে থাকেন।

‘ আম্মা? আজ আমি রাঁধি?’
পদ্মজার প্রতিদিনের প্রশ্ন! হেমলতা রাঁধতে দিবেন না জানা সত্ত্বেও পদ্মজা প্রতিদিন অনুরোধ করে। হেমলতা বিপদ-আপদ ছাড়া পদ্মজাকে রান্নাঘরে পাঠান না। সোনার শরীরে মাটির চুলার কালি লাগাতে হেমলতার মায়া লাগে। তিনি হাসেন। পদ্মজা মুগ্ধ হয়ে দেখে। হেমলতার বয়স ছয়ত্রিশ। শ্যামলা চেহারা। দাঁতগুলো ধবধবে সাদা। চোখের মণি অন্যদের তুলনার বড় আর গাঢ় কালো। চোখ দুটিকে গভীর পুকুর মনে হয়। ছিমছাম গড়ন। পূর্ণা যেনো মায়েরই কিশোরী শরীর। তবে তারা তিন বোনই মায়ের মতো চিকন আর লম্বা।

‘আচ্ছা,আজ তুই রাঁধবি।’
পদ্মজা ভাবেনি অনুমতি পাবে। আদুরে উল্লাসে প্রশ্ন করে, ‘সত্যি আম্মা?’
‘যা, জলদি। আছরের আজান কবে পড়েছে!’
পদ্মজা রান্নার প্রস্তুতি নিতে থাকে। পূর্ণা আর প্রেমা হিজল গাছের নিচে পাটি বিছিয়ে লুডু খেলছে। প্রেমা বাটপারি করে। এ নিয়ে কিছুকক্ষণ পর পর তাদের মাঝে তর্ক হচ্ছে। সকালে বৃষ্টি হয়েছে। রান্না করতে গিয়ে পদ্মজা ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ পেল। কী সুন্দর অনুভূতি!
মোর্শেদ পদ্মজাকে রাঁধতে দেখে কপাল কুঁচকে ফেললেন।
ঘরে ঢুকে হেমলতাকে মেজাজ দেখিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, ‘এই ছেড়ি রাঁন্ধে ক্যান? ‘
হেমলতা নির্লিপ্তভাবে জবাব দেন, ‘আমি বলেছি।’
‘কতদিন কইছি এই ছেড়ির হাতের রাঁন্ধন আমারে না খাওয়াইতে?’
মোর্শেদের কঠিন স্বর পদ্মজার কানে আসে। মুহূর্তে খুশিটুকু ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায়। সে জানে এখন ঝগড়া শুরু হবে। তার আম্মা, আব্বার অনুচিত কথাবার্তা মাটিতে পড়তে দেন না। তার আগেই জবাব ছুঁড়ে দেন।

‘খেতে ইচ্ছে না হলে খাবা না। ‘
‘রাইতবেলা না খাইয়া থাকবাম আমি?’
‘খাবার রেখেও যদি না খেতে চাও সেটা তোমার সমস্যা। আমি বা আমার মেয়ে কেউই না করিনি। ‘
মোর্শেদ কিছু নোংরা কথা শোনাতে প্রস্তুত হোন। হেমলতা সেলাই মেশিন রেখে উঠে দাঁড়ান। তিনি যেন বুঝে গিয়েছেন মোর্শেদ কী বলবেন। আঙ্গুল তুলে শাসিয়ে মোর্শেদকে বললেন, ‘একটা নোংরা কথা উচ্চারণ করলে আমি আজ তোমাকে ছাড় দেব না। পদ্ম তোমার মেয়ে। আল্লাহ সইবে না। নিজের মেয়ে সম্পর্কে এতো নোংরা কথা কোনো বাবা বলে না।’

মোর্শেদ নোংরা কথাগুলো হজম করে নিলেন। তবে কিড়মিড় করে বললেন, ‘পদ্ম আমার ছেড়ি না।’
‘পদ্ম তোমার মেয়ে। আর,একটা কথাও না। বাড়িতে অনেক মানুষ। নিজের বিকৃত রূপ লুকিয়ে রাখ।’
মোর্শেদ দমে যান। চৌকিতে বসে বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়েন। চোখের দৃষ্টি অস্থির। পদ্মজার জন্মের পর থেকেই হেমলতার রূপ পাল্টে গেছে। কিছুতেই এই নারীর সাথে পারা যায় না। অথচ, একসময় কত মেরেছেন হেমলতাকে। হেমলতার পিঠে,উরুতে, ঘাড়ে এখনো মারের দাগ আছে। সময় কোন যাদুবলে হেমলতাকে পাল্টে দিল, জানা নেই মোর্শেদের।

রাতের একটা শুট করে সবাই বিশ্রাম নিচ্ছিল। চিত্রা তখন কথায় কথায় জানাল, ‘লাহাড়ি ঘরে গিয়েছিলাম। মগা যে মেয়েটার কথা বলেছিল তাকে দেখতে। ‘
চিত্রার কথায় লিখন আগ্রহ পেলো না। চিত্রা কখনো কোনো মেয়ের প্রশংসা করে না। খুঁত খোঁজে বের করতে ভালো জানে। নিজেকে খুঁতহীন সেরা সুন্দরী মনে করে।
‘মেয়েটার নাম পদ্মজা।মগা, পুরো নাম জানি কী?’
চিত্রা মগার সাথে কথা বললে, মগা খুব লজ্জা পায়। এখনো পেল। লাজুক ভঙ্গিতে জবাব দিল, ‘উম্মে পদ্মজা।’
‘ওহ হ্যাঁ। উম্মে পদ্মজা।’

চিত্রার পাশ থেকে সেলিনা পারভীন প্রশ্ন করলেন,’কী নিয়ে আলাপ হচ্ছে?’
সেলিনা পারভীন চলমান চলচ্চিত্রে চিত্রার মায়ের অভিনয় করছেন। চিত্রা বলল, ‘এই বাড়ির মালিক যিনি উনার বড় মেয়ের কথা বলছি। এমন সুন্দর মুখ আমি দু’টি দেখিনি। মেয়েটার মুখ দেখলেই বুকের ভেতর নিকষিত, বিশুদ্ধ ভালো লাগার জন্ম হবে। এতো শ্রী ভগবান দিয়েছেন মেয়েটাকে।’
লিখন সহ উপস্থিত সবাই অবাক হলো। চিত্রার মুখে কোনো মেয়ের প্রশংসা! অবিশ্বাস্য! সবাইকে অবাক হয়ে তাকাতে দেখে চিত্রা বিব্রতবোধ করল। গলার জোর বাড়িয়ে বলল, ‘সত্যি বলছি! সন্ন্যাসী ছাড়া কোনো পুরুষ এই মেয়েকে উপেক্ষা করতে পারবে না।’

পদ্মজাকে নিয়ে বেশখানিকক্ষণ আলোচনা চলল। আগ্রহ বেশি লিখনের ছিল। যখন শুনলো পদ্মজার ষোল বছর সে দমে গেল। ছোট মেয়ে! হয়তো এমন বয়সী বেশিরভাগ মেয়েরা স্বামীর ঘরে থাকে। তবুও লিখনের পদ্মজাকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। তার একটা বোন আছে, ষোল বছরের। এখনো দুই বেণি করে স্কুলে যায়। কত ছোট দেখতে! লিখন আনমনে হেসে উঠল।

হিজল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে পদ্মজা। রাতের জোনাকি পোকা চারিদিকে। পদ্মজা প্রায় রাতে মুগ্ধ হয়ে দেখে জোনাকি পোকাদের। মনে হয় দল বেঁধে হারিকেন নিয়ে নাচছে তারা। তবে, এই মুহূর্তে রাতের এই সৌন্দর্য পদ্মজার মনে ঢুকতে পারছে না। পদ্মজা ঠোঁট কামড়ে কাঁদছে। চোখ দু’টো জ্বলছে খুব। মোর্শেদ রান্না খারাপ হওয়ার অজুহাতে থালা ভর্তি ভাত,তরকারি ছুঁড়ে ফেলেছে পদ্মজার মুখে। চোখে ঝোল পড়েছে। তা নিয়ে হেমলতার সেকী রাগ! মোর্শেদ অবশ্য চুপ ছিলেন। তিনি তো রাগ মিটিয়েই ফেলেছেন। আর তর্ক করে কী হবে?

‘পদ্ম?’
পদ্মজা তাকাল। হেমলতা ভেজা কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, ‘খুব জ্বলছেরে মা?’
পদ্মজা জবাব দিতে পারল না। ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠল। মা ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ নেই তার। মায়ের আদর ছাড়া কারো আদর পাওয়া হয়নি। সবাই তার দোষ খোঁজে। হেমলতার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরোল। পদ্মজা ছিঁচকাঁদুনে। ছোট থেকেই কাঁদছে। তবুও জল ফুরোয় না। মন শক্ত হয় না। এমন হলে তো চলবে না! পদ্মজার কান্নার বেগ বাড়ল। হেমলতা সদ্য কাটা বড় গাছের বাকী অংশে বসলেন। চুপ করে পদ্মজার ফোঁপানো শুনছেন। পদ্মজা শান্ত হয়ে মায়ের পাশে বসল। তার মাথা নত। হেমলতা উদাস গলায় বললেন,’এভাবে চলবে না পদ্ম।

পদ্মজা তাকাল। হেমলতা বললেন,’শোন পদ্ম, কেউ আঘাত করলে কাঁদতে নেই। কারণ মানুষ আঘাত করে কাঁদানোর জন্যই। আর যখন উদ্দেশ্য সফল হয় তখন তারা শান্তি পায়। যে আঘাত করল তাকে কেন শান্তি দিবি? শক্ত থাকবি। বুঝিয়ে দিবি তুই এতো দূর্বল নয়। যারে তারে পাত্তা দিস না। হাজার কষ্টেও কাঁদবি না। কান্না সাময়িক সময়ের জন্য মন হালকা করে। পুরোপুরি নয়। যে তোকে আঘাত করবে তাকে তুই তোর চাল-চলন দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিবি। তখন তার মুখটা দেখে তোর যে শান্তিটা হবে সেটা কান্না করার পর হবে না। এই শান্তি স্থায়ী!’
হেমলতার কথা পদ্মজার উপর প্রভাব ফেলল না। সে করুণ স্বরে বলল, ‘কিন্তু আব্বার ব্যবহার আমার সহ্য হয় না আম্মা। আমার সাথে কেন এমন করে আব্বা?’

‘তাকে কখনো সামনাসামনি আব্বা ডাকার সুযোগ পেয়েছিস? পাসনি! তবুও কেন আব্বা, আব্বা করিস?
তাকে তুই পাত্তা দিবি না।’
‘তুমি খুব কঠিন আম্মা।’
‘তোকেও হতে হবে।’
‘আব্বা কেন এমন করে আম্মা? আমিকি আব্বার মেয়ে না? আব্বা কেন বার বার বলেন, আমি তার মেয়ে না।’
হেমলতা চোখ সরিয়ে নেন। পদ্মজা জানে এই জবাব সে পাবে না। দাঁতে দাঁত চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে। হেমলতা এক হাত পদ্মজার মাথায় রাখেন।

‘কাঁদিস না আর। মায়ের রং না হয় পাসনি। মায়ের মতো শক্ত হওয়ার তো চেষ্টা করতেই পারিস।’
পদ্মজা নির্লজ্জ হয়ে আবার প্রশ্ন করল, ‘আম্মা, আমি কি আব্বার মেয়ে না? বলো না আম্মা।’
পদ্মজার চোখ বেয়ে জল পড়ছে। খুব মায়া লাগছে হেমলতার। বুক ভারী হয়ে আসছে। তিনি আবেগ লুকিয়ে কণ্ঠ কঠিন করার চেষ্টা করলেন, ‘মার খাবি পদ্ম। কতবার বলব, তুই আমার আর তোর আব্বার মেয়ে। ‘
‘কি নাম আমার আব্বার?’

কী শান্ত কণ্ঠ পদ্মজার! হেমলতা চমকান তবে প্রকাশ করলেন না। মেয়েদের সামনে তিনি কখনো দূর্বল
হতে চান ন। পদ্মজার দিকে ঝুঁকে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললেন, ‘তোর আব্বার নাম মোর্শেদ মোড়ল।’
পদ্মজা হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মাকে খুব বিরক্ত লাগছে এখন। খুব কঠিন করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, ‘ যাও এখান থেকে। আমার কাছে আর আসবা না। কখনো না। ‘

কিন্তু সে এমন ব্যবহার বাস্তবে কখনো পারবে না। কখনো না। রাতের বাতাসে ভেসে আসছে হাসনাহেনা ফুলের ঘ্রাণ। আকাশে থালার মতো চাঁদ। ঝিরিঝিরি মোলায়েম বাতাস চারিদিকে। পদ্মজার চোখের জল শুকিয়ে গেল। হেমলতা ঝিম মেরে বসে আছেন। একসময় নিস্তব্ধতা কাটিয়ে একটা অসহায় কণ্ঠ ভেসে আসল।
‘মায়েরা তাদের জীবনের গোপন গল্প সন্তানদের বলতে পারে নারে পদ্ম।’
পদ্মজা তাকাল। হেমলতা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছেন। পদ্মজার কান্না পেল। মানুষটাকে এতো নরম রূপে মানায় না। পদ্মজা আশ্বস্ত করে বলল, ‘আমি আর কখনো জানতে চাইব না আম্মা।’

শুটিং দলের একজনও বাড়িতে নেই। সবাই স্কুলে মাঠে গিয়েছে। কয়দিন ধরে নদীর ঘাটে যেতে না পেরে তৃষ্ণার্থ হয়ে উঠেছে পদ্মজা। এই সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না। হেমলতার অনুমতি নিয়ে সে ঘাটে চলে আসল। ঘাটের সিঁড়িতে বসল। কয়েক সেকেন্ড পর টের পেল, গান বাজছে কোথাও। গানের সুর অনুসরণ করে কয়টা সিঁড়ি নেমে আসে। ঘাটের বাম পাশে বাঁধা নৌকায় একজন পুরুষ বসে আছে। হাতে রেডিও। গানের উৎস তাহলে এখানেই। পদ্মজা বিব্রতবোধ করল। উল্টো দিকে ঘুরে ব্যস্ত পায়ে লাহাড়ি ঘরে চলে আসে। পদ্মজা এতো দ্রুত ফিরাতে হেমলতা প্রশ্ন করেন, ‘কেউ ছিল?’

পদ্মজা মাথা নাড়াল। হেমলতা চিন্তিত স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, ‘কিছু বলেছে? দেখতে কেমন?’
‘ না আম্মা, কিছু বলেনি। আমাকে দেখেনি। মাথার চুল ঝাঁকড়া। মুখ খেয়াল করিনি।’
‘এইটাই তো লিখন শাহ। নায়ক।’
পূর্ণা পুলকিত হয়ে বলল। হেমলতা আর কিছু বললেন না।

পূর্ণা সারাক্ষণ শুটিং দলটার আশেপাশে ঘুরঘুর করে। হেমলতা বিরক্ত হয়ে পূর্ণাকে কড়া নিষেধ দিয়েছেন, আর না যেতে। যদি যায় মার একটাও মাটিতে পড়বে না। পূর্ণা ভয় পেয়েছে। কিন্তু লিখন শাহ আর চিত্রা দেবী জুটিটা এতো ভাল লাগে তার যে শুটিং না দেখলে দম বন্ধ লাগে। তাই সে চুপিসারে টিনে একটা ছিদ্র করেছে। হেমলতা সেলাই মেশিন লাহাড়ি ঘরের পিছন বারান্দায় রেখেছেন। সারাক্ষণ সেখানেই থাকেন। সে সেময় পূর্ণা ছিদ্র দিয়ে উঁকি দেয়। শুটিং দেখে। পূর্ণাকে সবসময় দেখতে দেখে পদ্মজার আগ্রহ জাগল। সে উঁকি দিল।

ঝাকড়া চুলের মানুষটা একজন অতি সুন্দরী মেয়েকে কোলে তুলে নিয়েছে। দৃষ্টি মোহময়। প্রেমময় গানের সুরধ্বনি বাড়ি জুড়ে। ক্যামেরা ধরে রেখেছেন কেউ কেউ। গানের শুটিং বোধহয়! পদ্মজা অদ্ভুত অনুভূতি অনুভব করল। লজ্জা পেল। চোখ সরিয়ে নিল।

রাতে ঝড় এসেছিল। লাহাড়ি ঘরের পিছনে তৈরি পথ বন্ধ হয়ে গেছে গাছের ভাঙা ডালপালা দিয়ে। মোর্শেদ রাতে বাড়ি ফেরেননি। হেমলতার একার পক্ষে সম্ভব নয় পথ খালি করার। তাই পদ্মজা, পূর্ণা স্কুল থেকে বাড়ির সামনে দিয়ে ফিরছিল। উঠোনে শুটিং দলের সবাই ছিল। পদ্মজা মাথা নত হয়ে থেমে থেমে কাঁপতে থাকে। পথ শেষই হচ্ছে না। মাথায় ঘোমটা টানা। অনেকের নজরে পদ্মজা চলে আসল। মিলন নামে একজন পূর্ণাকে ডাকল, ‘এই পূর্ণা?’
পূর্ণা দাঁড়াল, সাথে পদ্মজা। পদ্মজা শুটিং দলটার দিকে তাকাচ্ছে না। মিলন পদ্মজার দিকে চোখ স্থির রেখে পূর্ণাকে প্রশ্ন করল, ‘পাশের মেয়েটা কে? প্রথম দেখছি।’

‘আমার বড় আপা।’
‘আপন?’
মিলন ভারী আশ্চর্য হয়ে বলল। দশ দিন হলো এখানে আসার। কখনো পূর্ণা,প্রেমা ছাড়া কোনো মেয়েকে চোখে পড়ল না। কণ্ঠও শোনা যায়নি। তাই বড় বোন বলাতে সে খুব অবাক হলো। পূর্ণা হেসে বলল, ‘হুম। আপন।’
মিলন বিড়বিড় করে বলল, ‘চেহারার তো মিল নেই।’
‘সবাই বলে।’
‘আচ্ছা,যাও।’
দু’বোন লাহাড়ি ঘরে চলে আসল। পদ্মজা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ভেতরটা এতো কাঁপছিল। অনেক মানুষের পা দেখেছে, চোখ তুলে মানুষগুলোর মুখ দেখার সাহস হয়নি। তবে, ইচ্ছে হয়েছিল চোখ তুলে তাকাতে!

বিকেলে হাজেরা আসল। সবুর মিয়ার স্ত্রী। সবুর দিনরাত গাঁজা খেয়ে পড়ে থাকে। বউ – বাচ্চাদের খোঁজ রাখে না। হাজেরা এর বাড়ি ওর বাড়ি এটা-ওটা চেয়ে নেয়। এরপর দুই বাচ্চা নিয়ে খায়। পদ্মজার খুব মায়া হয় হাজেরার প্রতি। হাজেরা আসতেই হেমলতা পদ্মজার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, ‘লাউ গাছে কয়টা লাউ দেখেছিস?’
‘নয়টা আম্মা।’
‘পূর্ণা কই? ওরে বল দুইটা লাউ হাজেরাকে দিয়ে দিতে। কাঁচামরিচও দিতে বলবি।’
পদ্মজার মুখে কালো আঁধার নেমে আসে। হেমলতা পদ্মজার মুখ দেখে বুঝতে পারেন, পূর্ণা বাড়িতে নেই।
‘টিভি দেখতে গেছে তাই না?’
পদ্মজাকে দ্বিধাগ্রস্ত হতে দেখা গেল। বিব্রতভাবে বলল,
‘আম্মা, আমাকে ব..বলে গেছে।’
‘তুই ওর অভিভাবক? একটু শরীরটা খারাপ লাগছে বলে শুয়েছি। ওমনি সুযোগ লুটে নিছে! ‘
‘আম্মা, আমার দোষ। পূর্ণারে কিছু বলো না।’

পদ্মজার ভেজা কণ্ঠ হেমলতার রাগ উড়িয়ে দিল। তিনি অন্য দিকে মুখ করে শুয়ে বললেন, ‘হাজেরারে নিয়ে যা। ঘোমটা টেনে যাবি। বেগুন বেশি হলে, কয়টা দিয়ে দিস।’
পদ্মজার মন ভরে গেল। তার মা এতো বেশি উদার! কখনো কাউকে ফিরিয়ে দেন না। সামর্থ্যের মধ্যে আরো বেশি কিছু দেওয়ার মতো থাকলে, তিনি কার্পণ্য করেন না। তবে, হাজেরার স্বভাব অভাবে নষ্ট হয়েছে। চুরি করার প্রবণতা আছে। তাই পদ্মজাকে যেতে বললেন।

উঠোনের এক কোণে এবং লাহাড়ি ঘরের ডান পাশে লাউয়ের মাচা। নয়টা লাউ ঝুলে রয়েছে। তরতাজা টাটকা সবুজ পাতা নজর কাড়ে। পদ্মজা বাড়ির দিকে তাকাল না। একটা লাউ হাজেরার হাতে দিয়ে বলল,’কি দিয়ে রাঁধবা?’
‘জানি না গো পদ্ম। গিয়া দেহি মাছ মিলানি যায়নি।’
‘তোমার ছেলেটার ঠান্ডা কমছে?’
পদ্মজা কাঁচামরিচ ছিঁড়ে হাজেরার আঁচল ভরে দিল। হাজেরা গুনগুন করে কাঁদছে আর বলছে, ‘ছেড়াডা সারাদিন মাডিত পইড়া থাহে একলা একলা। রাইত হইলে জ্বরে কাঁপে। দম ফালায়তে পারে না।’
‘ডাক্তার দেখাচ্ছ না কেন?’
‘টেহা লাগব না? কই পামু?’

‘তুমি,মাতব্বর বাড়িতে যেও। শুনছি, উনারা খুব দান-খয়রাত করেন।’
হাজেরা বাধ্যের মতো মাথা নাড়াল। বেগুন গাছ বাড়ির পিছনে। পদ্মজা বাড়ির পিছনে সাবধানে আসল। মনে মনে ভাবছে, হাজেরার ছেলে সুস্থই আছে। সকালে সে দেখেছে। হাজেরা মিথ্যা বলছে৷ মানুষের খুব অভাব পড়লে বুঝি এমনই হয়?
‘এতো সবজি আছে। টমেটো নেই? পাওয়া যাবে?’
পরিষ্কার সহজ গলায় বলা পুরুষালী কণ্ঠটি পদ্মজাকে মৃদু কাঁপিয়ে তুলল। ঘুরে তাকাল। লিখনকে দেখে বিব্রত বোধ করল। কারো সামনে নিজের অস্বস্তি প্রকাশ করা উচিত না। কথাটি হেমলতা বলেছেন। পদ্মজা হাসার চেষ্টা করল। জবাব দিল, ‘এই বর্ষাকালে টমেটো কোথায় পাবেন?’

‘বর্ষাকালে টমেটো চাষ হয় না?’
‘টমেটো শীতকালীন ফসল।’
‘গ্রীষ্ম,বর্ষাতেও তো পাওয়া যায়।’
পদ্মজা অস্বস্তি লুকিয়ে রাখতে পারছে না। স্কুলের শিক্ষক আর খুব আপন মানুষগুলো ছাড়া কোনো পর-পুরুষের সাথে তার কখনো কথা হয়নি। লিখনের সাথে কথা বলতে গিয়ে তার জবান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সে চুপচাপ বেগুন বুঝিয়ে দিল হাজেরাকে। লিখন বলল,
‘আমি তো গতবার বর্ষাকালে টমেটোর সালাদ তৈরি করেছি।’
‘হয়তো টমেটোর জাত আলাদা ছিল। সাধারণত আমাদের শীতকালেই টমেটো হয়।’
কথা শেষ করে দ্রুত লাহাড়ি ঘরে ফিরল সে। মনে হচ্ছে পর-পুরুষের সাথে কথা বলে ঘোর পাপ হয়ে গেছে।পাপ মোচন করতে হবে। ঘরে ঢুকে ঢকঢক করে দুই গ্লাস পানি খেল। হেমলতা ঘুমাচ্ছেন। নয়তো পদ্মজার মুখ দেখে নির্ঘাত বুঝে যেতেন, কিছু একটা ঘটেছে। পদ্মজা ভক্তি নিয়ে আল্লাহ তায়া’লার প্রতি শুকরিয়া আদায় করল।

হেমলতা সালোয়ার-কামিজ সেলাই করছিলেন। তখন বারান্দার সামনে একজন পুরুষ লোক এসে দাঁড়াল।
হেমলতা শাড়ির আঁচল মাথায় টেনে নেন। জিজ্ঞাসুকদৃষ্টি নিয়ে তাকান। লোকটি হেসে বলল, ‘আমি মিলন। শুটিং দলের। ‘
হেমলতা জোরপূর্বক হাসেন। আড়চোখে ঘরের দরজার দিকে তাকান। পদ্মজা ঘুমাচ্ছে।দরজাটা লাগানো উচিত।
‘কোনো দরকার?’
‘না,এমনি। দেখতে আসলাম। কতদিন হলো আপনাদের বাড়িতে উঠলাম। আর, এদিকটায়ই আসা হয়নি।’
হেমলতা প্যাঁচিয়ে কথা বলা পছন্দ করেন না। সরাসরি বলে উঠলেন, ‘এদিকে আসা নিষেধ। আপনাদের বলা হয়নি?’
মিলনের চোখেমুখে ছায়া নেমে আসে। সে অপমান বোধ করল। আমতা আমতা করে বলল, ‘ ইয়ে…আচ্ছা, আসছি।’
মিলন স্থান ত্যাগ করল। যাওয়ার পূর্বের তার তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি হেমলতার নজর এড়াতে পারল না। হেমলতা চোখ বুজে জীবনের হিসেব কষেন। এরপর ঘুমন্ত পদ্মজার দিকে তাকান।

আমি পদ্মজা পর্ব ১+২+৩

পূর্ণার চেয়ে পদ্মজার বেশি আগ্রহ শুটিং দেখায়। টিনের ছিদ্র আরো দু’টো করেছে। লিখন শাহকে দেখলে তাঁর মায়াময়, কোমল অনুভূতি হয়। এই অনুভূতির নাম সে জানে না। শুটিংয়ে লিখন শাহ কত ভালোবাসেন চিত্রা দেবীকে। পদ্মজার দেখতে খুব ভাল লাগে। পূর্ণা তেলের বোতল নিয়ে বলল, ‘আপা, তেল দিয়ে দাও না।’
‘সোনা বোন, একটু দাঁড়া।’
পদ্মজা ছিদ্র দিয়ে লিখন শাহর হাসি, কথা বলার ভঙ্গী দেখছে। লজ্জাও পাচ্ছে খুব। সময়টাকে থামিয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে।
‘এই,আপা। পরেও তো দেখতে পারবা। দিয়ে দাও না।’
‘আরেকটু। শুটিং শুরু হচ্ছে। একটু…”

পূর্ণার বিরক্তিতে রাগ হয় খুব। কিন্তু সে তার আপাকে কিছু বলবে না। তার সব ইচ্ছের সঙ্গী, সব গোপন কথার স্বাক্ষী তার আপা। সে তার আপাকে খুব ভালোবাসে। মাঝে মাঝে মনে হয়, মায়ের চেয়েও বেশি বোধহয় সে তার আপাকেই ভালোবাসে। বা হয়তো না। পদ্মজা মিটিমিটি হাসছে। পূর্ণা তেল রেখে ছিদ্র দিয়ে উঁকি দিল। নাহ! তাঁর এখন ভাল লাগছে না এসব দেখতে। চোখ সরিয়ে নিল।
‘কিরে পদ্ম? কী দেখছিস?’

হেমলতার কন্ঠ শুনে পদ্মজা চমকে উঠল। আরক্ত হয়ে উঠল। ডাকাতি করতে গিয়ে বাড়ির মালিকের কাছে ধরা পড়লে যেমন অনুভূতি হয় তেমন অনুভূতি হচ্ছে পদ্মজার। বা আরো ভয়ংকর অনুভূতি। হেমলতার দৃষ্টি টিনের ছিদ্রে গেল। সাথে সাথে পদ্মজা অনুভব করল, তাঁর পায়ের নিচের মাটি কাঁপছে৷ পূর্ণা ভয়ার্ত চোখে একবার মাকে একবার বোনকে দেখছে। ছিদ্রের গুরু তো সে!

আমি পদ্মজা পর্ব ৭+৮+৯+১০