আমি পদ্মজা সিজন ২ পর্ব ৫৬+৫৭+৫৮+৫৯+৬০

আমি পদ্মজা সিজন ২ পর্ব ৫৬+৫৭+৫৮+৫৯+৬০
ইলমা বেহরোজ

সুষ্ঠুভাবে হেমলতার মৃত্যুবার্ষিকীর মিলাদ সম্পন্ন হয়। বিকেলে মোড়ল পরিবারের সদস্যরা একসাথে আটপাড়ার মসজিদের সামনে এসে দাঁড়ায়। সাথে বৃদ্ধা মনজুরা এবং হিমেল রয়েছে। মসজিদের কবরস্থানে পাশাপাশি শুয়ে আছেন মোর্শেদ,হেমলতা ও পারিজা। কবরের কাছে আসা নিষেধ বলে মেয়েরা দূর থেকে দুই চোখ ভরে তিনটি কবর দেখছে এবং চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছে। মৃত্যুর এতোগুলি বছর পেরিয়ে গেছে তবুও কবরের সামনে এসে দাঁড়ালে বুকে এতো কষ্ট হয়! কাছের মানুষের মৃত্যু হচ্ছে ভয়ানক বিষের নাম। এই বিষ যারা পান করেছে তারাই জানে কষ্টের মাত্রা। পূর্ণা ছিঁচকাঁদুনে। সে চোখের জলে স্নান করছে। পদ্মজা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে কবরগুলোর দিকে। মা নামক মমতাময়ী মানুষটার ছায়ার অভাববোধ প্রতিটি পদক্ষেপে সহ্য করতে হয় । কত ভালোবাসতেন তিনি। মাথার উপর তার ছায়া ছাড়া নিঃশ্বাস নেওয়া দায় ছিল। আর আজ এতো বছর ধরে পদ্মজা দিব্যি এই মানুষটাকে ছাড়াই বেঁচে আছে। জন্মদাতা পিতা ছোট থেকে অনেক লাঞ্ছনা-বঞ্চনা করেছে। কত আকুল হয়ে থাকত পদ্মজা, পিতার ভালোবাসা পেতে। যখন ভালোবাসা পেল বেশিদিন পৃথিবীতে রইলেন না । মা মরা মেয়েদের রেখে নিজেও পাড়ি জমালেন ওপারে। তারপর পদ্মজার কোল আলো করে এলো কন্যা পারিজা। পিতা-মাতার মৃত্যুর শোক কিছুটা হলেও লাঘব হয়। কিন্তু এই সুখও বেশিদিন টিকেনি। খুব কম আয়ুকাল নিয়েই জন্মেছিল পারিজা। পদ্মজাকে আঁধারের গহীনে ছুঁড়ে ফেলে এক এক করে চলে যায় সুখতারারা। পদ্মজা বেশিক্ষণ দীর্ঘশ্বাসের ঘূর্ণি বুকের ভেতর চেপে রাখতে পারেনি। সে মুখ এক হাতে চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে। বাসন্তী পদ্মজার মাথাটা পরম যত্নে নিজের কাঁধে রাখেন। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,’কেঁদো না মা। একদিন দেখা হবে। হাশরের ময়দানে।’

সময় তার নিজের গতিতে চলে। কারো জন্য থেমে থাকে না। কেটে যায় আরো তিনটা দিন। এর মাঝে পূর্ণা মৃদুলের সাথে শুটিং দেখতে গিয়েছে একবার। গ্রামের পথে দুজন হেসেখেলে কথা বলেছে। এতেই কানাঘুষা শুরু হয়েছে। এদিকে আমিরের ভীষণ জ্বর। শুকিয়ে গেছে অনেক। ভেতরে ভেতরে কী যেন ভাবে সারাক্ষণ। খাওয়া দাওয়াও কমে গেছে। সবসময় চিন্তিত থাকে। বাড়িতে বেশিক্ষণ থাকে না। এদিকওদিক ঘুরে বেড়ায়। এখন শুয়ে আছে বারান্দার ঘরে। পদ্মজা কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। আমিরের চোখ দুটি বন্ধ। পদ্মজা আদুরে গলায় ডাকল,’শুনছেন?’
আমির চোখ বন্ধ রেখেই বলল,’হু?’
‘কী এতো ভাবেন?’
আমির চোখ খুলে পদ্মজার দিকে তাকাল। তার চোখ দুটি ভয়ংকর লাল। রাতে না ঘুমানোর ফল। সে পদ্মজাকে পাল্টা প্রশ্ন করল,’কী ভাবব?’
‘জানি না। কিছু তো ভাবেনই। চোখ দুটি তার প্রমাণ। আপনি কোনো কিছু নিয়ে কি ভীতিগ্রস্ত?’
আমির বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। বলল,’তেমন কিছু না।’
‘যেমন,কিছুই হউক। বলুন না আমাকে।’
‘আমাদের ঢাকা ফেরা উচিত।’
‘হঠাৎ? ‘
‘জানি না কিছু। আমার প্রায় মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে আজেবাজে স্বপ্ন দেখে। তোমাকে হারাতে পারব না আমি।’
‘আমার কিছু হবে না। আমি কারো কোনো ক্ষতি করিনি যে-
পদ্মজা থেমে গেল। সে তো একজনকে খুন করেছে! পদ্মজার দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে আসে। আমির পদ্মজার দিকে চেয়ে বলল,’তুমি কী করে কাউকে খুন করতে পারলে! আমি ভাবতেই পারি না। এরপর থেকেই ভয়টা বেড়ে গেছে। আমার খুব চিন্তা হয়। ঘুম হয় না। রাত জেগে পাহারা দেই কেউ যেন আমার পদ্মবতীকে ছুঁতে না পারে।’
পদ্মজার দুই চোখ জলে ভরে উঠে। বলে,’প্রথম তো বিশ্বাস করেননি,এটাই ভালো ছিল। এখন তো বিশ্বাস করে চিন্তায় পড়ে গেছেন। আর অসুস্থ হয়েও পড়েছেন।’
‘আমি ভেবেছিলাম,স্বপ্ন দেখেছো। তাই ঘুম থেকে উঠে আবোলতাবোল বলছো। তারপর সুস্থ-স্বাভাবিক ভাবেও যখন বললে,অবিশ্বাস কী করে করি?’
‘এতো ভালোবাসতে নেই। আমার কপালে সয় না।’
‘ভালোবাসতে না করছো?’
‘মোটেও না। মাত্রা কমাতে বলছি।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

পাশেই অজয়বাবুর আম বাগান। সাঁ সাঁ করে শীতল হাওয়া বইছে। পাখির ডাকও শোনা যাচ্ছে। পূর্ণা মৃদুলের চেয়ে পাঁচ-ছয় হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তার মস্তক নত। ওড়না বেসামাল হয়ে উড়ছে। মগাকে দিয়ে পূর্ণাকে ডেকে এনেছে মৃদুল। আসার পর থেকেই ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে আছে পূর্ণা। দাঁত দিয়ে নখ কাটছে। মৃদুল নিরবতা ভেঙে বলল,
‘আমি আগামীকাল বাড়িত যাইতেছি।’
পূর্ণা চকিতে তাকাল। রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে প্রশ্ন করল,’কেন?’
মৃদুল মুচকি হেসে বলল,’নিজের বাড়িত কেন যায় মানুষ? এইহানে তো বেড়াইতে আইছিলাম।’
‘ওহ।’
পূর্ণা মৃদুলের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে দৃষ্টিপাত করে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কান্না পাচ্ছে তার। মৃদুল এক ধ্যানে পূর্ণার দিকে চেয়ে থাকল। তারপর বলল,’অন্যদিকে চাইয়া রইছো কেন? এদিকে চাও।’
পূর্ণা বাধ্যের মতো মৃদুলের কথা শুনে। তার দুইচোখে জল টলমল করছে। পূর্ণার মেঘাচ্ছন্ন দুটি চোখ দেখে মৃদুলের ভীষণ কষ্ট অনুভব হয়। সে কেমন একটা ঘোর নিয়ে জানতে চাইল,’চলে যাব,শুইনা কষ্ট হইতাছে?’
পূর্ণা আবারও দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। অভিমানী স্বরে বলল,’মোটেও না। চলে যান।’
‘দুইদিন পরই আসতাছি।’
পূর্ণার চোখেমুখে হাসির ছটা খেলে যায়। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দুই কদম এগিয়ে এসে বলল,’সত্যি?’
‘সত্যি। এবার হাত ধরি?’
মৃদুলের বেশরম আবদারে পূর্ণা লজ্জা পেল। সে দুই কদম পিছিয়ে যায়। দুই হাত পিছনে লুকিয়ে ঠোঁটে হাসি রেখে বলল,’বাড়ি থেকে আসার পর।’
পূর্ণা দৌড়ে পালায়। মৃদুল পিছনে ডাকে,’এই কই যাও।’
চঞ্চল পূর্ণা না থেমে ফিরে তাকায়। তার লম্বাকেশ হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে উড়ছে। সে মিষ্টি করে হেসে জবাব দিল,’বাড়ি যাই। আপনি সাবধানে যাবেন। জলদি ফিরবেন।’
মৃদুল তার গোলাপি ঠোঁট দাঁত দিয়ে চেপে ধরে হেসে মাথা চুলকাল। কী অপূর্ব দেখাচ্ছে গ্রামের চঞ্চল শ্যামবর্ণের মেয়েটিকে। হাওয়ার তালে মেঠো পথ ধরে ছুটে যাচ্ছে বাড়ির দিকে। চুল আর ওড়না দুটোই হাওয়ার ছন্দে সুর তুলে যেন উড়ছে।

সকাল সকাল মগা এসে খবর দিল,রানি মদনের মাথায় আঘাত করেছে। মদন এখন হাসপাতালে ভর্তি। খলিল হাওলাদার রানিকে মেরে আধমরা করে একটা ঘরে বন্দি করে রেখেছেন। এ কথা শুনে পদ্মজা অস্থির হয়ে পড়ে। খলিল হাওলাদার এতোই জঘন্য যে, পদ্মজার মনে হয় এই মানুষটা নিজের মেয়েকে যেকোনো মুহূর্তে খুন করে ফেলতে পারে। পদ্মজা আমিরকে চাপ দেয়,ওই বাড়িতে নিয়ে যেতে। নয়তো সে একাই চলে যাবে। একপ্রকার জোর করেই আমিরকে নিয়ে আসে হাওলাদার বাড়িতে।হাওলাদার বাড়ির পরিবেশ থমথমে, নির্জন। সবসময়ই এমন থাকে। এ আর নতুন কি! অন্দরমহলে ঢুকতেই আমিনা আমিরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আকুতি-মিনতি করে বলে,’বাপ,আমার মেয়েরে আমার কাছে আইননা দেও। নাইলে,ওর কাছে আমারে লইয়া যাও। তোমার দুইডা পায়ে ধরি।’
আমির আমিনাকে মেঝে থেকে তুলে আশ্বাস দেয়,’আমি দেখছি। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
আমির খলিলের ঘরের দিকে যায়। ফরিনা এসে বিস্তারিত বললেন,’রাইতের বেলা মদনের চিল্লানি হুনি। দৌড়ে সবাই আইয়া দেহি মদন পইড়া আছে। মাথা দিয়া কী যে রক্ত বাইর হইতাছে। আর রানির হাতে এত্ত বড় একটা ইট। ছেড়িডারে দেইখা মনে হইতাছিল,ছেড়িডার উপরে জ্বীনে আছর করছে। আরেকটু অইলে এতিম ছেড়াডা মইরা যাইত। বাবুর বাপ আর রিদওয়ান মেইলা তাড়াতাড়ি হাসপাতাল লইয়া গেছে। আর এইহানদে তোমার চাচা শ্বশুরে রানিরে মাইরা ভর্তা কইরা লাইছে। নাক মুখ দিয়া রক্ত ছুটছে। তবুও থামে নাই। আমরা অনেক চেষ্টা করছিলাম তোমার চাচাশ্বশুরের হাত থাইকা বাঁচাইতে,পারি নাই। আলোডা কি যে কান্দা কানছে! এহন ঘুমাইতাছে।”
আমির চাবি নিয়ে আসে। আমিনা সাথে যেতে চাইলে আমির বলল,’আমি আর পদ্ম যাচ্ছি। রানিরে নিচে নিয়ে আসি। পদ্ম আসো।’

পদ্মজা ছুটে যায় আমিরের পিছু পিছু। ঘরের দরজা খুলে ঘরে ঢুকতেই রানি তাকায়। রুম্পা যে ঘরে ছিল সেই ঘরেই তাকে রাখা হয়েছে। রানি কাঁদছিল। দরজা খোলার শব্দ শুনে থেমে যায়। বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে। চোখমুখের রক্ত শুকিয়ে গেছে। আমির,পদ্মজাকে দেখে রানি দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। কাউকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে না। সে নিজের জীবন নিয়ে সুখী না। পৃথিবীর সব কষ্ট যেন তার বুকে। এসব মারধোর আর গায়ে লাগে না। বাপের কথায় বাড়ির কামলা বিয়ে করল। এটা তার জন্য কতোটা অপমানের কেউ বুঝবে না। সে শুধু মানুষ ভেবেই বাড়ির কামলাকে স্বামী মানতে পারেনি। এতোটা উদার সে নয়। সে মানে সে ভালো না। বাপের জোরাজুরিতে নাতনিও দিল। তারপর থেকেই মদন পেয়ে বসে। কারণেঅকারণে তাকে ছুঁতে চায়। মদনের একেকটা ছোঁয়া রানির জন্য কতোটা বেদনাদায়ক তাও কেউ জানবে না। গতকাল রাতে মদন জোরদবস্তি করেছিল তাই রানি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।
খালি ড্রামের নিচে থাকা ইট নিয়ে চোখ বন্ধ করে মদনের মাথায় আঘাত করে। এতে সে এখন মোটেও অনুতপ্ত না। পদ্মজা রানির মনের অবস্থা একটু হলেও বুঝতে পারছে। মেয়েটা হাসিখুশি থাকার জন্য বাচ্চাদের সাথে কাবাডি,গোল্লাছুট, কানামাছি কত কী খেলে! তবুও সুখী হতে পারে না। পদ্মজা সাবধানে রানির পাশে এসে বসল। বলল,’খুব মেরেছে?’
রানি পদ্মজার দিকে তাকিয়ে তীব্র কটাক্ষ করে বলল,’তুমি জাইননা কী করবা? মলম লাগাইয়া দেওন ছাড়া আর কী করনের আছে?’
আমির কিছু বলতে উদ্যত হয়। পদ্মজা আটকে দেয়। সে চমৎকার করে হেসে রানিকে বলল,’মলম লাগানোর মানুষই বা কয়জনের ভাগ্যে জুটে আপা?’
রানির দৃষ্টি শীতল হয়ে আসে। এই মেয়েটার সাথে রাগ দেখানো যায় না।
পদ্মজার মাঝে অদ্ভুত কিছু আছে। যা রাগ দমন করতে পারে। রানি বলল,’আমি…আমি ভালা নাই পদ্মজা। আমি একটু আরাম চাই। সুখ চাই। আর কষ্টের বোঝা টানতে পারতাছি না।’ রানির কথার ধরণ এলোমেলো। সে অন্য এক জগতে আছে। বন্দি পাখির মতো ছটফট করছে। মুক্তির আশায় ডানা ঝাঁপটাচ্ছে। পদ্মজার খুব মায়া হয়। ভীষণ অসহায় লাগে। ভালোবাসার মানুষ জীবনে এসে আবার হারিয়ে গিয়ে এভাবেই জীবন এলোমেলো করে দেয়। এতো যাতনা কেন প্রেমে? যার শূন্যতা আজও শান্তি দিল না রানিকে। প্রতিনিয়ত কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। রানির ভেতরটা যে একেবারে শূন্য। সে পিরিতের যন্ত্রনায় আজও কাতর! আচ্ছা,যদি রানিকে তার উপযুক্ত কোনো ছেলের সাথে বিয়ে দেয়া হতো তবে কী সে তার ভালোবাসাকে ভুলতে পেরে একটু সুখী হতে পারত?

আমির,পদ্মজা ধরে ধরে রানিকে নিচ তলায় নিয়ে আসে। সবাই কত কী প্রশ্ন করে। রানি নিশ্চুপ। কারোর কোনো কথার উত্তর দেয়নি। সবাই যত্ন আত্তি করে। আমিনা খাইয়ে দেন। পুরো দিন রানি বিছানায় শুয়ে থাকে। আমিনা সারাদিন চেষ্টা করেছেন রানি যাতে কথা বলে। কিন্তু রানি যেন পণ করেছে,কথা না বলার। অন্যদিকে মদন ভালো আছে। কয়দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হবে। সেলাই লেগেছে। গঞ্জের হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল এরপর সেখান থেকে শহরে। এ খবর ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামে। রানিকে সবাই অনেক খারাপ কথা বলছে। অভিশাপ দিচ্ছে। অনেকে বাড়ি বয়ে এসে কটু কথা বলে গেছে। বাড়ির কেউ নিষেধ করেনি। রানি চুপ করে শুনেছে। বাড়ির অবস্থার কথা ভেবে আমির মোড়ল বাড়িতে ফেরার কথা বলেনি। দিনশেষে রাত আসে। সুন্দর পৃথিবীকে জাপটে ধরে ঘোর অন্ধকার। সেই অন্ধকারে হারিয়ে যায় রানি। সকালে চিঠি পাওয়া যায়। তাতে লেখা- “আমার আলোরে দেইখা রাইখো তোমরা।”
ঘন কুয়াশা বেয়ে শীতের বিকেল নেমেছে ধীরে ধীরে। পদ্মজা আলোকে বুকের সাথে মিশিয়ে দু’তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখের দৃষ্টি বাড়ির গেইটের দিকে। বাড়ির সব পুরুষেরা সকালে বেরিয়েছে রানির খোঁজে। এখনও ফেরেনি। যে নিজের ইচ্ছায় হারিয়ে যায় তাকে কী আর খুঁজে পাওয়া যায়? তবুও পদ্মজা চাইছে,রানিকে যেন অক্ষত অবস্থায় ফিরে পাওয়া যায়। আলো সারাদিন মায়ের জন্য কেঁদেছে। মায়ের আদরের জন্য ছটফট করেছে। আলোর অস্থিরতা দেখে পদ্মজার দুই ঠোঁট কেঁপেছে। জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করেছে মায়ের মতো আদর করার। কিন্তু সে তো আলোর মা না, আলোর মায়ের গন্ধ তার গায়ে নেই। রানি মা হয়ে কী করে পারল আলোকে ছেড়ে যেতে? পৃথিবীর সব মা একরকম হয় না। সব মা সন্তানের জন্য ত্যাগ করতে জানে না। দুঃখ আপন করে নিতে জানে না। পদ্মজা আলোর কপালে চুমু দিল। মেয়েটা চুপ করে আছে। চারিদিক কুয়াশায় ধোঁয়া ধোঁয়া । দিন ডুবিডুবি ৷ স্তব্ধ হয়ে আছে সময়। এক তলা থেকে আমিনার বিলাপ শোনা যাচ্ছে। তিনি এতো কাঁদতে পারেন! পদ্মজা ঘুরে দাঁড়াল ঘরে যেতে। তখনই সামনে পড়লেন ফরিনা। পদ্মজা হাসার চেষ্টা করে বলল,’আম্মা,আপনি!’

‘আলো ঘুমাইছে?’
‘না,জেগে আছে।’ পদ্মজা আলোর কপালে আবার চুমু দিল।
ফরিনা বললেন,’রানিরে কি পাওন যাইব?’
‘জানি না আম্মা।’ পদ্মজার নির্বিকার স্বর।
‘আলমগীর রুম্পারে লইয়া কই গেছে জানো তুমি? ওরা ভালো আছে তো?’
‘আপনাকে সেদিনই বলেছি আম্মা,জানি না আমি।’
ফরিনা আর প্রশ্ন করলেন না। তিনি নারিকেল গাছের দিকে চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। পদ্মজা সেকেন্ড কয়েক সময় নিয়ে ফরিনাকে দেখে। ফরিনা আগের মতো ছটফটে নেই। নিশ্চুপ হয়ে গেছেন। আগে মনে হতো তিনি মনে মনে কোনো কঠিন কষ্ট পুঁতে রেখেছেন কিন্তু এমন কোনো শক্তি আছে যার জন্য তিনি হাসতে পারেন,বেঁচে আছেন। আর এখন দেখে মনে হচ্ছে,সেই শক্তিটা নষ্ট হয়ে গেছে! জীবনের আশার আলো ডুবে গেছে। কথাগুলো ভেবে পদ্মজা চমকে উঠে! সে তো আনমনে নিজের অজান্তে এসব ভেবেছে! কিন্তু সত্যিই কি এমন কিছু হয়েছে? পদ্মজা আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করল,’ আম্মা,আপনি আমাকে কিছু বলতে চান?’
ফরিনা তাকান। পদ্মজা তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে রইল ফরিনার দিকে। ফরিনা ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। হঠাৎ যেন পাহাড়ের শক্ত মাটির দেয়াল ভেঙে ঝর্ণধারার বাঁধ ভেঙে গেল। পদ্মজা খুব অবাক হয়। ফরিনা আঁচলে মুখ চেপে ধরেন। পদ্মজার উৎকণ্ঠা, ‘আম্মা, আম্মা আপনি কাঁদছেন কেন? কী হয়েছে? বলুন না আমাকে। কী বলতে চান আমাকে?’
আচমকা ফরিনার কান্নার শব্দে আলো ভয় পেয়ে যায়। সে জোরে জোরে কাঁদতে থাকে। পদ্মজা আলোকে শান্ত করার চেষ্টা করে। বারান্দায় পায়চারি করে আদুরে কণ্ঠে বলে,’মা,কাঁদে না,কাঁদে না। কিছু হয়নি তো। মামি আছি তো।’
আলো জান ছেড়ে কাঁদছে। কান্না থামাচ্ছে না। বেশ অনেক্ষণ পর আলো কান্না থামায়। সাথে সাথে পদ্মজা ফরিনার দিকে এগিয়ে আসল। প্রশ্ন করল,’বলুন আম্মা। কী বলতে চান আমাকে?’

‘কিচ্চু না।’ বলেই তড়িঘড়ি করে দোতলা থেকে নেমে যান তিনি। পদ্মজা আশাহত হয়ে অনেকবার ডাকে,তিনি শুনেননি। পদ্মজা বিরক্তি নিয়ে বাইরে তাকায়। দেখতে পায় মজিদ হাওলাদারকে। তিনি আলগ ঘর পেরিয়ে অন্দরমহলের দিকে আসছেন। খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছেন। পায়ে ব্যথা পেয়েছে নাকি! পদ্মজা নিচ তলায় যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। তখনই মাথায় আসে,’কোনোভাবে কী আব্বাকে দেখে আম্মা ভয় পেল? আর উত্তর না দিয়ে চলে গেল?’
পদ্মজা মিলিয়ে ফেলে উত্তর। এমনটাই হয়েছে। ঘরের গোপন খবরই দিতে চেয়েছিলেন ফরিনা। কিন্তু ঘরের মানুষ দেখে আর দিতে পারলেন না। আচ্ছা, তিনি এমন হাউমাউ করে কেন কাঁদলেন? পদ্মজার কপালের চামড়া কুঁচকে যায়।
পদ্মজা মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ায়। আলোর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে ভাবে পিছনের সব অদ্ভুত ঘটনা। রুম্পা পাগলের অভিনয় করত,তাকে ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছিল অথচ বাড়ির কেউ এতে ভ্রুক্ষেপ করতো না। রুম্পা দিনের পর দিন না খেয়ে ছিল। পদ্মজা যতটুকু বুঝেছে ফরিনা খুব ভালোবাসেন রুম্পাকে, তাহলে তিনি কেন খাবার নিয়ে যেতেন না? রুম্পার ঘরে লতিফা চোখ রাখে। রুম্পা লতিফাকে দেখে ভয় পেয়েছিল। যেদিনই সে জানতে পারে রুম্পা পাগল না, সেদিন রাতেই বাবলু নামের কালো লোকটি রুম্পাকে মারতে চেয়েছিল। এতসব কার নির্দেশে হচ্ছে? কে এই বাড়ির আদেশদাতা? আর আলমগীরই কী করে জানল রুম্পা খুন হতে চলেছে? তারপর একটা খুন হলো অথচ ভোর হওয়ার আগেই সেই লাশ উধাও হয়ে গেল। কেউ খুনির খোঁজ করল না! তারপর রুম্পা বা আলমগীরের কথা রানি আর ফরিনা ছাড়া কেউ জিজ্ঞাসাও করল না! এই বাড়ির মানুষ যেন জীবিত থেকেও মৃত। কী চলছে আড়ালে! তারপর আলমগীর তাকে একটা চাবি দিল। চাবিটা কীসের? রুম্পা বলেছিল,উত্তরে জঙ্গলে,ধ রক্ত। এই কথার মানেই বা কী?

পদ্মজা দ্রুত দুই চোখ বন্ধ করে ফেলল। তার মাথা ব্যথা করছে। কপালের রগ দপদপ করছে। রানির নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারটা পুরোপুরি মাথা থেকে বেরিয়ে যায়। সে গাঢ় রহস্যের টানে উন্মাদ হয়ে উঠে। বাড়িতে খলিল,রিদওয়ান নেই। এই সুযোগে জঙ্গলে তাকে যেতেই হবে। পরিবেশে অস্পষ্টতা ক্রমে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ল ৷ বিকেল সন্ধ্যাকে ম্লান আলোয় জড়িয়ে ধরল ৷ সন্ধ্যার আযান পড়ছে। পদ্মজা নিচ তলায় এসে আলোকে লতিফার কাছে দিয়ে নিজ ঘরে যায়। নামায আদায় করে নেয়। তারপর আলোকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল। মজিদ পায়ে ব্যথা পেয়েছেন। তিনি ঘরে শুয়ে আছেন। ফরিনাও ঘরে। বাড়ির বাকি পুরুষরা তখনও ফিরেনি। আমিনা সদর দরজায় বসে আছেন। চুল এলোমেলো। কপালে এক হাত রেখে বাইরে তাকিয়ে রানির অপেক্ষায় প্রহর গুণছেন। মানুষটার অনেক দোষক্রুটি আছে ঠিক। তবে মেয়ের জন্য পাগল! বাড়ির আরেক কাজের মেয়ে রিনু আলোর সাথে শুয়ে আছে। আলো একা ঘরে কীভাবে থাকবে,তাই পদ্মজাই রিনুকে আলোর সাথে থাকতে বলেছে। লতিফা রান্নাঘরে রান্না করছে। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। মানবতাবোধ থেকেও অন্তত রানির নিখোঁজ হবার শোকে কাতর হওয়া উচিত। কিন্তু পদ্মজা কাতর হতে পারছে না। তাকে চুম্বকের মতো কিছু টানছে উল্টোদিক থেকে। পদ্মজা শক্ত করে খোঁপা বাঁধে। শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে, গায়ে জড়িয়ে নেয় শাল। হাতে নেয় টর্চ আর ছুরি। তারপর অন্দরমহলের দ্বিতীয় দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। এক নিঃশ্বাসে ছুটে আসে জঙ্গলের সামনে। হাঁপাতে থাকে। চোখের সামনে ঘন জঙ্গল। পিছনে কয়েক হাত দূরে অন্দরমহল। হাড় হিম করা ঠান্ডা। পদ্মজার ঠোঁট কাঁপতে থাকে।

এই জায়গায় সে অনেকবার এসেছে,কিন্তু পা রাখতে পারেনি জঙ্গলে। কেউ না কেউ বা কোনো না কোনো ঘটনা তাকে বাগড়া দিয়েছেই। আজ কিছুতেই সে পিছিয়ে যাবে না। তার স্নায়ু উত্তেজিত হয়ে আছে। জঙ্গলের ঘাসে পা রাখতেই একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়। গায়ের লোমকূপ দাঁড়িয়ে পড়ে। আরো কয়েক পা এগোতেই গা হিম করা অদ্ভুত সরসর শব্দ ভেসে আসে। পদ্মজার একটু একটু ভয় করছে। গাঢ় অন্ধকারে,এমন গভীর জঙ্গলে সে একা! শীতের বাতাসে গাছের পাতাগুলো শব্দ তুলছে আর পদ্মজা উৎকর্ণ হয়ে উঠছে। ভয়-ভীতি নিয়েই সে এগোতে থাকে। চারিদিকে ঘাস। সরু একটা পথে ঘাস নেই। মানে এই পথ দিয়ে মানুষ হাঁটাচলা করে। পদ্মজা সেই পথ ধরেই এগোতে থাকে। সে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারপাশ দেখছে। বড় বড় গাছ দেখে মনে হচ্ছে কোনো অশরীরী দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মজা মনে মনে আয়াতুল কুরসি পড়ে বুকে ফুঁ দেয়।
একটা সময় পথ শেষ হয়ে যায়। পদ্মজা টর্চের আলোতে পথ খোঁজে। যেদিকেই তাকায় সেদিকেই বুনো লতাপাতা। যারা এখানে আসে তারা কী এখানেই থেমে যায়? পদ্মজা ভেবে পায় না। মাথার উপর ডানা ঝাপটানোর শব্দ শোনা যায়। পদ্মজার বুক ধক করে উঠল। সে টর্চ ধরল মাথার উপর। দুটো পাখি উড়ে যায়। এরপর চোখে ভেসে উঠে চন্দ্র তারকাহীন ম্লান আকাশ।পদ্মজা লম্বা করে নিঃশ্বাস নিল। সে কি না কি ভেবেছিল! পদ্মজা সূক্ষ্ম-তীক্ষ্ণ চোখে চারপাশ দেখল। রুম্পা কী বলেছিল মনে পড়তেই সে উত্তরে তাকাল। বেশিদূর চোখ গেল না। ঝোপঝাড়ে ঢাকা চারপাশ। পদ্মজা মুখে অস্ফুট বিরক্তিকর শব্দ করল।
নিজে নিজে বিড়বিড় করে,’ধুর! কোনদিকে যাব এবার।’

ছটফট করতে থাকে পদ্মজা। তার হাত থেকে ছুরি পড়ে যায়। ছুরি তোলার জন্য নত হয় সে। ছুরির সাথে সাথে তার হাতে ঘাস উঠে আসে। পদ্মজা অবাক হয়। কেন যেন মনে হলো,এই বুনো ঘাসের শেকড় মাটির নিচে ছিল না। পদ্মজা উত্তর দিকের আরো কতগুলো ঘাস এক হাতে তোলার চেষ্টা করল। সাথে সাথে হাতে উঠে আসে। সত্যি শেকড় নেই মাটির নিচে! কেউ বা কারা পথের চিহ্ন আড়াল করতে নতুন তাজা ঘাস দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে পথ। পথ লুকোতে কি প্রায়ই এমন করা হয়? তাহলে তো বেশ পরিশ্রম করে! পদ্মজার উত্তেজনা বেড়ে যায়। সে উত্তর দিকের পথ ধরে এগোতে থাকে। হাঁটে প্রায় দশ মিনিট। এই মুহূর্তে সে চলে এসেছে জঙ্গলের মাঝে।
সামনে ঘন ঝোপঝাড়। পরিত্যক্ত ভাব চারিদিকে। ভূতুড়ে পরিবেশ। থেকে থেকে পেঁচা ডাকছে কাছে কোথাও। পদ্মজা বিপদ মাথায় নিয়ে ঝোপঝাড় দুই হাতে সরিয়ে অজানা গন্তব্যে হাঁটতে থাকে। কাঁটা লাগে মুখে। চামড়া ছিঁড়ে যায়। পদ্মজা ব্যথায় ‘মা’ বলে আর্তনাদ করে উঠল। কিন্তু ব্যথা নিয়ে পড়ে থাকেনি। সে এগোতে থাকে। ঝোপঝাড় ছেড়ে বড় বড় গাছপালার মাঝে আসতেই পদ্মজার মনে হয় তার পিছনে কেউ আছে! সে চট করে ঘুরে দাঁড়াল। কেউ নেই! সে মনের ভুল ভেবে সামনে হাঁটে। কিন্তু আবার মনে হয়,পিছনে কেউ আছে। পদ্মজা থমকে দাঁড়ায়। ঘুরে তাকায়। তার মনটা আনচান, আনচান করছে। কু গাইছে। কেমন ভয়ও করছে। এই গভীর জঙ্গলে সে একা। কিছুক্ষণ আগে সন্ধ্যা হলো। কিন্তু এখানে মনে হচ্ছে গভীর রাত। কোনো অঘটন ঘটে গেলে কেউ জানবে না। পদ্মজার রগে রগে শিরশিরে অনুভব হয়। ভয়টা বেড়ে গেছে। ভেঙে পড়ছে সে! রাত যেন শক্তি, সাহসিকতা চুষে নিতে পারে। পদ্মজা আল্লাহকে স্বরণ করে। হেমলতাকে স্বরণ করে। চোখ বুজে হেমলতার অগ্নিমুখ ভাবে। তিনি যেভাবে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতেন সেভাবে পদ্মজা তাকায়। কান খাড়া করে চারপাশে যত জীব,প্রাণী আছে সবকিছুর উপস্থিতি টের পাওয়ার চেষ্টা করে। কাছে কোথাও অদ্ভুত এক জীব ডাকছে। নিশাচর পাখিদের তীক্ষ্ণ ডাকও শোনা যাচ্ছে। ঝিঁঝিঁপোকারা এক স্বরে ডাকছে। সাঁ,সাঁ বাতাস বইছে। এ সবকিছুকে ছাড়িয়ে একটা মানুষের গাঢ় নিঃশ্বাস তীক্ষ্ণভাবে কানে ঠেকে। খুব কাছে,পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে! নিঃশ্বাস নিচ্ছে। পদ্মজার হাত দুটো শক্ত হয়ে যায়। অদ্ভুত এক শক্তিতে কেঁপে উঠে সে। চোখের পলকে দুই পা পিছিয়ে লোকটিকে না দেখেই ছুরি দিয়ে আঘাত করে। লোকটি ‘আহ’ করে উঠে। পদ্মজা চোখ খুলে ভালো করে দেখে,মুখটি অন্ধকারের জন্য অস্পষ্ট। তবে কণ্ঠটি পরিচিত মনে হলো। পদ্মজার ছুরির আঘাত লোকটির হাতে লেগেছে। পদ্মজা রাগী কিন্তু কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করে, ‘কে আপনি?’

লোকটি ক্ষুধার্ত বাঘের মতো ছুটে এসে পদ্মজার গলা চেপে ধরে। পদ্মজা আকস্মিক ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। লোকটি এতো জোরে গলা চেপে ধরেছে যে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। মাথার উপর আরো ক’টি পাখি ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে যায়। একটা বলিষ্ঠ হাত গাঢ় অন্ধকারে অপরূপ সুন্দরী এক মেয়ের গলা টিপে ধরে রেখেছে। সুন্দরী মেয়েটি ছটফট করছে! লোকটির মুখ অন্ধকারে ঢাকা। ভয়ংকর দৃশ্য! পদ্মজা তার হাতের ছুরিটা শক্ত করে ধরে লোকটির পেটে ক্যাঁচ করে টান মারে। লোকটি আর্তনাদ করে সরে যায়। হাঁটুগেড়ে মাটিতে বসে পড়ে। পদ্মজা আবারও আঘাত করার জন্য এগোয়। লোকটি ফুলে ফেঁপে উঠে দাঁড়ায়। যেন নতুন উদ্যমে শক্তি পেয়েছে। লোকটি ঝাঁপিয়ে পড়ে পদ্মজার উপর। নখের আঁচড় বসায় হাতে। কেড়ে নেয় ছুরি। পদ্মজা ছুরি ছাড়া এমন হিংস্র পুরুষের শক্তির সামনে খুবই নগণ্য। যেভাবেই হউক এর হাত থেকে বাঁচতে হবে। পদ্মজা টর্চ দিয়ে লোকটির মাথায় বারি মারে। লোকটি টাল সামলাতে না পেরে পিছিয়ে যায়। পদ্মজা উলটোদিকে দৌড়াতে থাকে। পিছনে ধাওয়া করে আগন্তুক। দুইবার ছুরির আঘাত,একবার মাথায় টর্চের বারি খাওয়ার পরও আগন্তুক লুটিয়ে পড়েনি মাটিতে। নিশ্চিন্তে সে এই রহস্যের পাক্কা খেলোয়ার। পদ্মজার শাল পরে যায় গা থেকে। তার খোঁপা খুলে রাতের মাতাল হাওয়ায় চুল উড়তে থাকে। ঝোপঝাড়ে মাঝে উদ্ভ্রান্তের মতো সে দৌড়াচ্ছে। কানে আসছে বাতাসের শব্দ! সাঁ,সাঁ,সাঁ! দুই হাতে শাড়ি ধরে রেখেছে গোড়ালির উপর। যেন শাড়িতে পা বেঁধে পড়ে না যায়। জুতা ছিঁড়ে পড়ে থাকে জঙ্গলে। কাঁটা কাঁটায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় পদ্মজার পা। রক্ত বের হয় গলগল করে। তবুও সে থামল না। সে এত সহজে মরতে চায় না। এই গল্পের শেষ অবধি যেতে হলে তাকে বাঁচতেই হবে।

রাতের আঁধার কেটে ভোরের আলোর মাধ্যমে শুরু হয়েছে আরেকটি নতুন দিন। পূর্ণা ও মগা মেঠোপথ ধরে হাওলাদার বাড়ি যাচ্ছে। মাথার উপর আকাশ আলো করা তেজবিহীন সূর্য। পূর্ণার পায়ের গতি চঞ্চল। সে অস্থির হয়ে আছে। পাশেই কৃষকের ফসলি জমি ছেয়ে গেছে সবুজের সমারোহে। ফসলি জমির সবুজ আর ঘাস, গাছ-পালার ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দু সকালের প্রকৃতিতে এক অপরূপ সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। অথচ সেই সৌন্দর্য পূর্ণাকে ছুঁতে পারছে না। অন্যবেলা হলে সে শিশিরভেজা ঘাসে গা এলিয়ে দিত। কোনো এক অদ্ভুত কারণে ঠান্ডার মধ্যেও তার শিশিরে ভিজতে ভালো লাগে। এখন সেই মন মেজাজ নেই। মগা কিছুক্ষণ আগে তাকে খবর দিয়েছে, গতকাল রাতে পদ্মজা আহত অবস্থায় জঙ্গল থেকে ফিরেছে। প্রেমা ঘরে পড়ছিল। বাসন্তী রান্নাঘরে। তাই তারা শুনতে পায়নি। পূর্ণা রোদে বসে সকালের খাবার খাচ্ছিল। যখন মগার কাছ থেকে এই খবর শুনল, খাবার রেখে মগাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

কুয়াশা ঢাকা পথে উত্তরে হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে পূর্ণা হাওলাদার বাড়ি আসে। এক ছুটে পদ্মজার ঘরে যায়। পদ্মজা ঘুমে। শিয়রে ফরিনা বসে আছেন। পূর্ণা করুণস্বরে জানতে চাইল,’ও খালাম্মা,আপার কী হয়েছে?’
ফরিনা ইশারায় শান্ত হতে বললেন। তারপর মুখে ধীরেসুস্থে রাতের ঘটনা খুলে বললেন। গতকাল এশার আযানের সময় পদ্মজা কোথা থেকে দৌড়ে সদর ঘরে এসে লুটিয়ে পড়ে। পা থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছিল। অনেকগুলো কাঁটা ফুঁটে ছিল। শ্বাস নিচ্ছিল ঘন ঘন। গালের চামড়ারও একই অবস্থা। ফরিনা,লতিফা,আমিনা,রিনু পদ্মজাকে দেখে চমকে যায়। আমিনা দূরে দাঁড়িয়ে থাকলেও,বাকি তিনজন পদ্মজাকে ধরে ঘরে নিয়ে আসে। পদ্মজা পানি খেতে চায়। পানি খাওয়ার পর বলে,সে জঙ্গলে গিয়েছিল। জঙ্গলের কথা শুনে উপস্থিত দুজন কাজের মেয়ে ও ফরিনার মুখ পাংশুটে হয়ে যায়। তারা আর প্রশ্ন করেনি। যেন বুঝে গিয়েছে কি হয়েছিল! কাঁটা বের করতে গিয়ে আরো রক্তক্ষরণ হয়েছে। পদ্মজা যন্ত্রনায় ঠোঁট কামড়ে শুয়েছিল। চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়েছে। ব্যান্ডেজ করা খুব দরকার ছিল। কাটাছেঁড়ার প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পর্কে ফরিনার ধারণা নেই। তাই তিনি মজিদ হাওলাদরকে গিয়ে বলেন। এই বাড়িতে প্রায়ই মারামারি, কাটাকাটি চলে। তাই মজিদ হাওলাদারের কাছে ব্যান্ডেজ,স্যাভলনসহ বিভিন্ন জিনিসপাতি রয়েছে। তিনি প্রাথমিক চিকিৎসার জিনিসপাতি নিয়ে আসেন। তারপর পদ্মজার পা ভালো করে পরিষ্কার করিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেন।

পূর্ণা পদ্মজার পায়ের কাছে বসে হাহাকার করে বলল,’আমার আপা এতো কষ্ট পেয়েছে!’
পূর্ণার চোখ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। সে ফরিনার কাছে জানতে চায়,’ভাইয়া কোথায়?’
তাৎক্ষণিক ফরিনার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। তিনি মিনমিনে গলায় বললেন,’জানি না।’
পূর্ণা অবাক স্বরে বলল,’ভাইয়া জানে না আপার কথা? রাতে দেখেনি?’
‘বাবু তো বাড়িত আহেই নাই। রানিরে যে খুঁজতে গেল আর আইছে না।’
‘রানি আপারে পাওয়া যায়নি?’
‘না।’
‘আচ্ছা-
পদ্মজা শরীর নাড়াচ্ছে দেখে পূর্ণা কথা থামিয়ে দিল। সে পদ্মজার পেটের কাছে এসে বসল। বলল,’আপা।’
পদ্মজা পিটপিট করে চোখ খুলে। জানালা দিয়ে সূর্যের আলো টুপ করে পদ্মজার চোখেমুখে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পদ্মজা দ্রুত চোখ বুজে ফেলল। তারপর আবার ধীরে ধীরে চোখ খুলল। পূর্ণাকে দেখে অবাক হয়। উঠে বসতে চাইলে অনুভব করে পায়ে অনেক ব্যথা। সে পায়ের দিকে চেয়ে আরও অবাক হলো। পায়ে ব্যান্ডেজ এলো কী করে! মনে করার চেষ্টা করল। মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,’রাতে এক ছুটে অন্দরমহলে চলে আসি। ভুলেও পিছনে ফিরে তাকাইনি। সদর ঘর থেকে আম্মা ঘরে নিয়ে আসেন। আব্বা ব্যান্ডেজ করে দেন। আম্মা খাইয়ে দেন। অনেক রাত হয়। উনি তখনও ফিরেননি। তাই চিন্তা হয়। আম্মাকে জিজ্ঞাসা করলে আম্মা বলছিলেন,চলে আসবে। তারপর কি হয়েছিল মনে নেই। ঘুমিয়ে পড়ি বোধহয়।’
পদ্মজা ভাবনা থেকে বেরিয়ে সর্বপ্রথমে ফরিনাকে প্রশ্ন করল,’উনি ফিরেছেন?’
‘না।’

পদ্মজা কী বলবে বুঝতে পারছে না। সে অনেক্ষণ পর বলল,’চাচা আর রিদওয়ান ভাই ফিরেছে?’
‘আইছে তো। তোমার চাচা এহন কই জানি না। রিদওয়ান হের ঘরেই আছে।’
‘তাহলে আপনার ছেলে কোথায় আম্মা?’ পদ্মজা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। পূর্ণা পদ্মজার এক হাতে চেপে ধরে অনুরোধ করে,’আপা,শান্ত হও। খালাম্মা, রিদওয়ান ভাই আর ছোট চাচা কিছু বলেনি ভাইয়ার ব্যাপারে? আপনি জিজ্ঞাসা করেননি?’
ফরিনা নির্বিকার স্বরে বললেন,’আমি হেরার লগে কথা কই না।’
‘আপনার ছেলের জন্য আপনার চিন্তা হচ্ছে না? রাতে বাড়ি ফেরেনি। আপনি তো মা না-কি?’ পদ্মজার গলা কাঁপছে। তার বুকের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। আমিরের কিছু হলে সে মাঝ সমুদ্রে পড়বে। হেমলতার পর এই একটা মানুষকেই সে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে,ভালোবাসে। ফরিনা নিশ্চুপ। তিনি পদ্মজার কথা পাত্তা দিচ্ছেন না। পদ্মজার পা ব্যথায় টনটন করে উঠে। শীতের সময় কাটাছেঁড়া খুব যন্ত্রনার। যে যন্ত্রনায় পূর্ণা এখনও ভুগছে। সেদিন কাঁধে আঘাত পেল। আজও শুকায়নি ভালো করে। কিছুর ছোঁয়া লাগলেই ব্যথা করে। পূর্ণা পদ্মজাকে অনুরোধ করে বলল,’আপা,এমন করো না। ভাইয়া চলে আসবে। রানি আপাকে খুঁজতে গেছে। এজন্যই আসতে পারেনি।’
‘রানি আপার বাপ-ভাই তো চলে আসছে।’
‘তুমি তো জানোই আপা,রানি আপার বাপ-ভাই কেমন। রানি আপার জন্য মায়া শুধু ভাইয়ার। তাই ভাইয়া রানি আপারে ছাড়া আসতে পারছে না।’

পূর্ণার কথাগুলো যুক্তিগত হলেও পদ্মজার মন মানছে না। গোলমাল তো আছেই। পদ্মজা পূর্ণাকে এক হাতে সরিয়ে বিছানা থেকে নামার জন্য এক পা মেঝেতে রাখে। সঙ্গে সঙ্গে পুরো শরীরে একটা সূক্ষ্ম তীব্র ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে। পদ্মজা আর্তনাদ করে শুয়ে পড়ে। ফরিনা ও পূর্ণা আঁতকে উঠল। পদ্মজাকে জোর করে শুইয়ে দিল। কিন্তু পদ্মজা নাছোড়বান্দা, সে তার স্বামীর খবর যতক্ষণ না পাবে শান্ত হবে না। ফরিনা আশ্বস্ত করে বললেন,’ওরা বাবুর ক্ষতি করব না। বাবুর কাছে ওদের অনেক কিছু পাওনের আছে। কাগজে-কলমে এই বাড়িডার মালিক বাবু।’
পদ্মজা তীর্যকভাবে তাকাল। বলল,’আপনি সব জানেন তাই না?’
পূর্ণা ফোড়ন কাটে,’কী জানবে?’
পূর্ণার উত্তর না দিয়ে পদ্মজা ফরিনাকে প্রশ্ন করল,’বলুন আম্মা।’
ফরিনা আড়চোখে দরজার দিকে তাকালেন। ফরিনার দৃষ্টি অনুসরণ করে পদ্মজা,পূর্ণাও তাকাল। কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। শাড়ি দেখে মনে হচ্ছে,লতিফা। পূর্ণা ডাকতে উদ্যত হয়। পদ্মজা পূর্ণার হাত ধরে ফেলে। ইশারা করে চুপ থাকতে। তারপর ফরিনাকে প্রশ্ন করে,’তাহলে আপনি নিশ্চিত ওরা উনার ক্ষতি করবে না?’
‘জানে মারব না।’

এ কথা শুনে পদ্মজা হকচকিয়ে যায়। সে উৎকর্ণ হয়ে বলল,’এ কথা কেন বলছেন?’
ফরিনা আবার নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। পদ্মজার মাথার রগ রাগে দপদপ করছে। এই বাড়ির মানুষগুলোর মনের ভাবনার কিনারা এতো জটিল! কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না। একেকবার একেকজনের একেক রূপ।
পদ্মজাকে সারাদিন এটা-ওটা বলে বিছানায় রাখা হয়। ফরিনা সারাদিন পদ্মজার খেয়াল নিলেন। পদ্মজা সারাক্ষণ ‘উনি,উনি’ করে গেছে। ফরিনা কোনো জবাবই দিলেন না। আর দরজার ওপাশে সারাক্ষণ লতিফা ছিল। পূর্ণা অনেকবার লতিফাকে ধরেছে। তখন লতিফা হেসে বলেছে, পদ্ম আপা কেমন আছে, দেখতে আইছিলাম।’ পূর্ণা কঠিনস্বরে অনেকবার নিষেধ করেছে,যেন আর না আসে। তবুও লতিফা এসেছে। পদ্মজা পূর্ণাকে নিষেধ করার পর পূর্ণা স্থির হয়। বিকেল হয়ে যায় তবুও আমিরের দেখা নেই। এদিকে পদ্মজা বিছানায় বসে ইশারায় ফজরের নামায কাযা করেছে। দুপুরের, আছরের নামাযও বসে বসে ইশারায় করেছে। (অসুস্থ মানুষ অজু ছাড়া কোন উপায়ে নিজেকে পবিত্র করে নামায পড়তে পারে,নামায শিক্ষা ঘাঁটলেই পাবেন।) ফরিনা দুপুরে না করেছিলেন,’এতো কষ্ট কইরা নামাযের কী দরহার! কইরো না। আল্লাহ মাফ করব এমনিতে।’
পদ্মজা তখন মিষ্টি করে হেসে জবাব দিয়েছিল,’যতক্ষণ হুঁশজ্ঞান আছে নামায ছাড়ার পথ নেই আম্মা। আল্লাহ তায়ালা অসুস্থ মানুষকে ইশারায় নামায পড়ারও পথ দিয়েছেন। এটা কেন দিয়েছেন? নামায বাধ্যতামূলক বলে। ইসলামে নামাযের গুরুত্ব অনেক বেশি আম্মা।’

ফরিনা এই কথার উপরে কিছু বলতে পারেননি। পদ্মজা ধর্মকর্ম নিয়ে খুব জানে। পদ্মজার কাছ থেকে তিনি অনেক কিছু শিখেছেন। ধর্মের কথা বলার সময় পদ্মজা অন্য সবকিছু ভুলে যায়। তাই পুরোটা দুপুর তিনি পদ্মজাকে ইসলাম ধর্মের খুঁটিনাটি নিয়ে প্রশ্ন করেই গেছেন। বিকেলবেলা পূর্ণা জানাল,সে আজ এই বাড়িতে থাকবে। পদ্মজা এ কথা শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। সে জোরাজুরি করে পূর্ণাকে মোড়ল বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। এই বাড়ি মোটেও সুবিধার না। সে ঝুঁকি নিতে চায় না। পূর্ণা চলে যাওয়ার আগে পদ্মজা কিছু সূরার নাম বলে দেয়। একটা দুই লাইনের সূরা শিখিয়ে দেয়। যেন পড়ে ঘুমায়। তাহলে বিপদ হবে না।
পূর্ণা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আযান পড়ে সন্ধ্যার। পূর্বের নিয়মেই নামায পড়ে পদ্মজা। ফরিনা পদ্মজার ঘর ছাড়েন। রান্নাঘরে যান। পদ্মজা নামায শেষ করে বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বুজে। আমিরের জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে। দুইদিন কেটে যাচ্ছে আমিরের দেখা নেই। পদ্মজার মনের অবস্থা করুণ। বার বার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে। প্রহর গুণছে এই বুঝি মানুষটা চলে এলো। পদ্মবতী, পদ্মবতী বলে একাকার করে দিল ঘর। কিন্তু আসে না। পদ্মজার বুকের বাম পাশে চিনচিন ব্যথা বেড়েই চলেছে। গতকাল রাতে আক্রমণ করা লোকটিকে সে তখন চিনতে পারেনি। কিন্তু এখন আন্দাজ করতে পারছে। তবে আমিরের শূন্যতা তাকে পোড়াচ্ছে খুব। সে এমন ছটফটানি নিয়ে আর থাকতে পারছে না। আহত পা মাটিতে রাখে। ভর দিতেই আবার সেই তীব্র ব্যথা। কিন্তু এর চেয়েও গভীর ব্যথা আমিরের দেখা না পাওয়া। পদ্মজার দুই পায়ের পাতার এক পাশ অক্ষত। সে ওই এক পাশ দ্বারা মাটিতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে এক তলায় যায়। সোজা চলে আসে রিদওয়ানের ঘরে। দরজা একটু খোলা ছিল। পদ্মজা একবার ভাবল,কড়া নেড়ে ঘরে ঢুকবে। কী মনে করে যেন,আর কড়া নাড়ল না। সোজা দরজায় ধাক্কা মারে। তখনই রিদওয়ান চমকে ঘুরে তাকায়। পদ্মজাকে দেখে তাড়াতাড়ি শার্ট পরতে উদ্যত হয়। পদ্মকা মুচকি হেসে বলল,’শার্ট পরে লাভ নেই। চোখে পড়ে গেছে।’

রিদওয়ান ফিরে দাঁড়াল। লম্বা করে হেসে শার্ট পরল। তারপর বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল,’বুদ্ধিমতী। তো দেখতে এসেছো কেমন আছি?
ভালো নেই। ছুরি এবং ছুরির মালিক দুজনেরই তেজ বেশি ছিল।’
পদ্মজা তিরষ্কার করে হাসল। দুই কদম এগিয়ে এসে বলল,’পাগলের প্রলাপ! আন্দাজ ঠিক হবে ভাবিনি। এবার বলুন,উনি কোথায়?’
রিদওয়ান ভ্রু দুটি বাঁকিয়ে বলল,’আমির?’
পদ্মজা জবাব দিল না। রিদওয়ান বলল,’আমি জানব কী করে,তোমার জামাই কোথায়?’
‘জানেন না?’ পদ্মজার কড়া প্রশ্ন।
রিদওয়ান উত্তরে হাসল। সে আলমারি থেকে একটা ছুরি বের করে দেখল। তারপর শীতল স্বরে প্রশ্ন করল,’ তোমার ছুরিটার নাম কী? কোন দেশ থেকে এনে দিয়েছে আমির?’
‘ফুটপাত থেকে কেনা। ছুরির ধার থাকলেই চলে। অভিজ্ঞ হতে হয় আক্রমণকারীর হাত। তাই ছুরির নাম না খুঁজে নিজের হাতটাকে অভিজ্ঞ করুন।’ পদ্মজার সূক্ষ্ম অপমান বুঝতে রিদওয়ানের অসুবিধা হয় না। সে আলমারির কপাট লাগিয়ে এগিয়ে আসে। বলে,’ব্যঙ্গ করছ?’
পদ্মজা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল রিদওয়ানের দিকে। তারপর বলল,’ কী আছে জঙ্গলে?’
‘তা জেনে তুমি কী করবে?’
‘কোন অপরাধ চলছে?’
‘তোমাকে জানতে হবে না।’

‘তখনও তো মারতে এসেছিলেন। এখন তো কাছে আছি,আক্রমণ করছেন না কেন?’
রিদওয়ান হাসল। পদ্মজার পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। পদ্মজার ঘাড়ে ফুঁ দেয়। সঙ্গে,সঙ্গে পদ্মজা দূরে সরে যায়। হুমকি দিয়ে বলে,’নোংরামি করার সাহস করবেন না। তখনের আঘাতগুলো ভুলে যাবেন না। আমি আমাকে রক্ষা করতে জানি।’
‘এজন্যই পালিয়ে এসেছিলে?’
‘পদ্মজা ক্ষণকালের জন্য পালিয়েছে। যা ই থাকুক আমি খুঁজে বের করবই। আর ধ্বংসও করব আমি।’
‘দেখো,পদ্মজা তুমি আর এসব ঘেঁটো না। সুখে আছো সুখে থাকো। পরিণতি খারাপ হবে। ভালো করে বলছি,ঢাকা ফিরে যাও। এমুখো আর তাকিও না।’
‘ভয় পাচ্ছেন?’
‘কাকে? তোমাকে?’ রিদওয়ান সশব্দে হাসল। রিদওয়ানের হাসি পদ্মজার গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে। রিদওয়ান হাসতে হাসতে বলল,’ তোমাকে ভয় পাবে রিদওয়ান?’
‘উনি কোথায় সত্যি জানেন না?’
‘না,জানি না। ‘
‘আমি কিন্তু-
‘কী করবে? খুন করবে?’ রিদওয়ান কিড়মিড় করে এগিয়ে আসে। পিছন থেকে পদ্মজার দুই হাত মুচড়ে ধরে বলল,’ভালো করে বলছি,আর গভীরে যেও না। এককালে তোমাকে বিয়ে করার কথা ভেবেছিলাম বলে বলছি, আর গভীরে যেও না। তোমার করুণ দশা আমিও আটকাতে পারব না।’
‘ছাড়ুন আমাকে।’

‘ছাড়ব না।’ রিদওয়ান পদ্মজার কাঁধে ঠোঁট ছোঁয়াতেই পদ্মজার সারা শরীর রি রি করে উঠে। মাথা দিয়ে পিছনে থাকা রিদওয়ানের মুখে আঘাত করে। রিদওয়ান কিছুটা পিছিয়ে যায়। নাকে ভীষণ ব্যথা পেয়েছে। সে কিড়মিড় করে হিংস্র জন্তুর মতো তাকায়। বলিষ্ট,মোটাসোটা শরীরটাকে হারানো যেকোনো মেয়ের জন্য অসাধ্য। পদ্মজা নিজেকে রক্ষা করার জন্য টেবিল থেকে জগ নেয় হাতে। রিদওয়ান বলে,’তুমি বাড়াবাড়ি করছো পদ্মজা।’
‘উনি যদি জানতে পারে আপনি আমার সাথে এই অসভ্যতামি করেছেন, আপনার দেহে প্রাণ থাকবে না।’
রিদওয়ান ফিক করে হেসে দিল। যেন মাত্রই পদ্মজা মজার কথা বলল। রিদওয়ান হাসি ঠোঁটে রেখে বলল,’আগে তো ও নিজেকে বাঁচাক। তারপর আমাকে প্রাণে মারবে।’
রিদওয়ানের এই কথাটি যেন বজ্রপাত ঘটায়। পদ্মজা চিৎকার করে জানতে চায়,’কোথায় রেখেছেন উনাকে? কী করেছেন উনার সাথে?’
‘ঘরে যাও পদ্মজা।’
‘আপনি বলুন,উনি কোথায়।’
‘যাও ঘরে।’
‘বলুন আপনি।’
‘পদ্মজা-

পদ্মজা জগ ছুঁড়ে মারে রিদওয়ানের দিকে। রিদওয়ান সরে দাঁড়ায়। জগ স্টিলের থালাবাসনের উপর পড়ে। বিকট শব্দ হয়। সেই শব্দ শুনে খলিল ছুটে আসেন। ছুটে আসেন মজিদ। আসেনি একজন মহিলাও।
পদ্মজা বিছানার উপর ছুরি দেখে দ্রুত হাতে তুলে নেয়। সে তার নিজস্ব কৌশল ব্যবহার করে রিদওয়ানকে আঘাত করতে উদ্যত হয়। রিদওয়ান ছুরি সহ পদ্মজার হাত ধরে ফেলে। তারপর ফিসফিসিয়ে বলে,’ তোমার তিন বছরের ছুরি চালানোর অভিজ্ঞতা আর আমার বিশ বছরের পেশা। পেরে উঠতে পারবে না।’
পদ্মজার হাত থেকে খলিল ছুরি টেনে নেয়। পদ্মজা হিংস্র বাঘিনী হয়ে উঠে। আমিরের শোকে তার মাথা কাজ করছে না। দুই দিন হয়ে গেল আমিরের দেখা নেই। সারা শরীরে ব্যথা। তার নিজেকে উন্মাদ মনে হচ্ছে। সে রাগে রিদওয়ানের গলা চেপে ধরে। রিদওয়ান পদ্মজার হাত থেকে ছোটার চেষ্টা করে। পদ্মজাকে নানাভাবে আঘাত করে। পদ্মজা কিছুতেই ছাড়ে না। তার শরীরের শক্তি যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। আমির তার জীবনে কতোটা মূল্যবান তা কেউ জানে না। আমিরের জন্য সে সবকিছু করতে পারে। খলিল এক হাতে পদ্মজার চুল মুঠ করে ধরে,অন্য হাতে পদ্মজার গাল চেপে ধরে বলে,’বে*র ছেড়ি,আমার ছেড়ারে ছাড়।’
তাও পদ্মজা ছাড়ে না। মজিদ এগিয়ে আসে। পদ্মজাকে টেনে সরায়। পদ্মজার শরীর কাঁপছে। সে চিৎকার করে বলছে,’উনার কিছু হলে আমি কাউকে ছাড়ব না। মেরে ফেলব। মেরে ফেলব একদম।’
রিদওয়ান ছাড়া পেয়ে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়। তারপরই তেড়ে এসে পদ্মজার গালে থাপ্পড় বসায়। পদ্মজার গালের ক্ষত থাপ্পড়ের ভার নিতে পারেনি। চামড়া অনেক বেশি ছিঁড়ে যায়। পদ্মজার দুই হাত মজিদ ধরে রেখেছেন। পদ্মজা মজিদকে খেয়াল করেনি। সে চেঁচিয়ে ফরিনাকে ডাকে,’আম্মা,আম্মা আপনি কোথায়? আম্মা ওরা আপনার ছেলেকে মেরে ফেলবে। আম্মা…’
ফরিনা আসেন না। খলিল হুংকার ছাড়েন,’এই খা*কির ছেড়ির আগুন বেশি গত্রে। ছেঁইড়া দে রিদু।’

পদ্মজার কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। সে মুখভর্তি থুথু ছুঁড়ে দেয় খলিলের মুখের উপর। তাৎক্ষণিক রিদওয়ান পদ্মজার শাড়ির আঁচল দিয়ে পদ্মজারই গলা পেঁচিয়ে ধরে কিড়মিড় করে বলল,’এই মা*র ঝি, তোরে অনেক্ষণ ধরে বোঝাচ্ছিলাম। ভালো কথা কান দিয়ে ঢুকে না? মায়ের মতো হইছস? তোর মারেও মেরে দিতাম। যদি নিজে থেকে না মরতো।’
পদ্মজার চোখ উল্টে যাচ্ছে। মজিদ রিদওয়ানকে বলে,’রিদওয়ান ওরে ছেড়ে দে। মরে যাবে।’
রিদওয়ান তাও ছাড়ে না। খলিল রিদওয়ানকে জোরে ধাক্কা দিয়ে সরালেন। পদ্মজার শরীরের সব শক্তি শেষ। সে কাশতে কাশতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। চোখ বুজে আসে। কল্পনায় ভেসে উঠে,আমিরের শ্যামবর্ণের মায়াময় মুখ। আর মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে ডাকে, আম্মা। তারপরই জ্ঞান হারায়। তিনজন পুরুষের মাঝে লুটিয়ে পড়ে আছে পদ্মজা। বুকে শাড়ি নেই। খয়েরি রঙের ব্লাউজ পরা। গলায় লাল দাগ। মুখে নখের আঁচড়। গালে চেপে ধরার দাগ। চামড়া ছিঁড়ে যাওয়ার রক্ত। ফর্সা দুই হাত শক্ত করে চেপে ধরার দাগ জ্বলজ্বল করে ভেসে আছে। চুল কয়টা ছিঁড়ে পড়ে আছে আশেপাশে। পায়ের সাদা ব্যান্ডেজ আবার লাল হয়ে উঠেছে। আগুন সুন্দরী পদ্মজার খুঁতহীন রূপে খুঁতের মেলা বসে গেছে! জানালা দিয়ে আসা উত্তরে হাওয়ায় হুঁশহারা পদ্মজার রক্ত ধীরে ধীরে শুকাতে থাকে। কেউ নেই তাকে বুকে আগলে ধরার জন্য। পদ্মজার অবস্থা দেখে যেন ঘরের দেয়ালগুলোও গুমরে গুমরে কাঁদছে।
মাথার উপর সূর্য নিয়ে কলসি কাঁখে পূর্ণা আজিদের বাড়িতে ঢুকে। পাতলা ছিপছিপে গড়ন অথচ কাঁখে পিতলের প্রকাণ্ড কলসি! খালি কলসির ভারেই একটু বাঁকা হয়ে পড়েছে সে। পানিভর্তি কলসি নিয়ে কী করে বাড়ি ফিরবে কে জানে! সকাল থেকে তাদের টিওবওয়েলে সমস্যা। পানি আসছে না। সকালে বাসন্তী আজিদের বাড়ি থেকে পানি নিয়েছেন। এখন আবার আসতে চেয়েছিলেন,পূর্ণা আসতে দিল না। সে নিজে দায়িত্ব নিয়ে এসেছে। বাসন্তী অনেকবার বলেছেন,’এইটুকু শরীর নিয়ে পারবি না।’

পূর্ণা অহংকার করে বলেছে,’আমি পারি না এমন কিছু নেই। তুমি ঘরে যাও তো।’
আজিদের বাড়ির সামনে পুকুর আছে। সেখানে নতুন ঘাট বাঁধানো হয়েছে। ঘাটে গোসল করছে আজিদের বউ আসমানি। মাসেক ছয় আগেই বিয়ে হলো। আসমানির সাথে পূর্ণার অনেকবার কথা হয়েছে।
পূর্ণা আসমানিকে দেখেনি। আসমানি পূর্ণাকে দেখে ডাকল,’কি গো পূর্ণা! ফেইরাও চাইলা না। ভাবিরে চোক্ষে পড়ে নাই?’
পূর্ণা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। অপরাধী কণ্ঠে বলল,’খেয়াল করিনি ভাবি।’
‘পানি নিতে আইছো?’
‘হুম,আমাদের টিউবওয়েল-
‘শুনছি খালাম্মার কাছে। একটু বইসো। আমি ডুব দিয়া আইতাছি।’
‘আচ্ছা ভাবি।’
পূর্ণা মুখে আচ্ছা বললেও সে মনে মনে পরিকল্পনা করে পানি নিয়ে অন্য পথ দিয়ে বাড়িতে চলে যাবে। আসমানি একবার কথার ঝুড়ি নিয়ে বসলে, কথা ফুরোয়ই না। পূর্ণা আড্ডাবাজি খুব পছন্দ করে। কিন্তু এখন তার তাড়া আছে। তাড়াতাড়ি ফেরা চাই। দুপুর হয়ে গেছে। পদ্মজাকে এখনও দেখতে যেতে পারেনি সে। গতকাল বিকেলে যে দেখে এলো,তারপর আর খোঁজ মিলেনি। চিন্তায় সারারাত ঘুম হয়নি পূর্ণার। আজিদের বাড়ির অঙ্গন শূন্য, ঘরের বাইরে কেউ নেই। পূর্ণা সোজা কলপাড়ে চলে আসে। দ্রুত কল চেপে কলসি পানি ভর্তি করে। তারপর কলসি কাঁখে তুলতে গিয়ে হয় সমস্যা। কিছুতেই তুলতে পারছে না। আসমানি গামছা দিয়ে চুল মুছতে মুছতে এগিয়ে আসে। ফর্সা, সুন্দর একটা মুখ। নতুন বউ,নতুন বউ ছাপটা যেন এখনও মুখে লেগে আছে। আসমানি কাছে এসে হেসে বলল,’এত বড় কলসি নিবা কেমনে? খালাম্মারে পাঠাইতা।’

‘তুমি একটু সাহায্য করো।’
‘কী কও? আমি লইয়া যামু কলসি?’
‘আমি কি তা বলছি ভাবি! কাঁখে তুলতে সাহায্য করো।’
আসমানি ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলল,’ওহ! বাড়ির বউ তো শরম লজ্জার ডরেই বাইর হই না। নয়তো বাড়ি অবধি দিয়া আইতাম।’
‘বাড়ি থেকে বের হতেই লজ্জা, ভাসুরের সাথে শুতে লজ্জা নাই!’
পূর্ণা কটাক্ষ করে বলল। ঠোঁটে তিরস্কার করা হাসি। আসমানির চোখমুখের রঙ পাল্টে যায়। ফর্সা মুখ লাল হয়ে উঠে। চোখ ছাপিয়ে জল নামে। ক্ষণমুহূর্ত পূর্ণার দিকে চেয়ে থাকে আসমানি। তারপর এদিক ওদিক দেখে পূর্ণার এক হাত চেপে ধরে চাপা স্বরে বলল,’কী কইরা জানছো?’
পূর্ণা এক ঝটকায় আসমানির হাত সরিয়ে দিল। বলল,’তোমার সাথে দেখা করার জন্য এসেই জানালা দিয়ে এই নোংরামি দেখেছি। আজিদ ভাই মাটির মানুষ। কত ভালো উনি। উনাকে কেন ঠকাচ্ছো ভাবি?’
আসমানি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার হাত দুটি অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে। চোখ থেকে জলের ধারা নেমেছে। পূর্ণার দেখে মায়া হয়। সে কণ্ঠ নরম করে বলল,’ কাউকে বলিনি আমি। বারো-তেরো দিন যখন চেপে রাখতে পারছি, সারাজীবন পারব। ভালো হয়ে যাও ভাবি। আজিদ ভাইকে ঠকিও না। পাপ করো না।’
আসমানি অশ্রুরুদ্ধকর কণ্ঠে বলল,’আমারে খারাপ ভাইবো না।’

পূর্ণা কিছু বলল না। খারাপ কাজ করার পরও কী করে খারাপ না ভেবে থাকা যায়! সে আসমানিকে অগ্রাহ্য করে কলসি তোলার চেষ্টা চালালো। আসমানি দ্রুত পায়ে কলপাড় ছাড়ে। পূর্ণা কলসি কাঁখে তুলতে সক্ষম হয়। কিন্তু ভার খুব বেশি। এখনই কোমর মচকে যাবে বোধহয়। পূর্ণা কলপাড় ছাড়তেই সামনে এসে দাঁড়ায় আসমানি। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে, এক নিঃশ্বাসে বলল,’কাউরে কইয়ো না পূর্ণা। আমারে তোমার ভাই আর ঘরে রাখব না। আমি চাই নাই এমন করতে। শফিক ভাই তো আমগোর থানার পুলিশ মানুষ। আমার ছোডু বইনডা এক মাস ধইরা হারায়া গেছে। অনেক খুঁজছি পাই নাই। পুলিশ দিয়া খোঁজানোর ক্ষেমতা আমার বাপের নাই। শফিক ভাইরে কইছিলাম,তহন উনি কইছে,উনার সাথে-
আসমানি ফোঁপাতে থাকে। চোখের জলে সমুদ্র বয়ে যাবে এক্ষুণি। পূর্ণা খুব অবাক হয়। একটা মানুষ কতোটা নিকৃষ্ট হলে এভাবে ছোট ভাইয়ের বউয়ের বিপদে সাহায্য করার নামে এমন কুৎসিত শর্ত রাখতে পারে? পূর্ণার রাগ হয় খুব। আসমানিকে আশ্বাস দিয়ে পূর্ণা বলল,’ভাবি কেঁদো না। যে মানুষ এমন শর্ত দিতে পারে সে কখনোই কাউকে সাহায্য করতে পারে না। উনি তোমার বোনকে খুঁজবে না। কিন্তু আশা দেখিয়ে ভোগ ঠিকই করবে। আর সুযোগ দিও না। দোয়া করো শুধু,তোমার বোন যেন ফিরে আসে।’
আসমানি শাড়ির আঁচল দিয়ে দুই চোখ মুছে বলল,’জানো পূর্ণা,আমি আমার বইনরে ছাড়া একটা দিনও থাকতে পারতাম না।’
‘তোমার সাথে তো এক মাসে আরো দুইবার দেখা হয়েছে। কখনো তো বললে না,তোমার বোনকে পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘আম্মা কইছে,ছেড়ি মানুষ হারায়া গেলেও কেউরে কইতে নাই। মানুষ ভাববো ছেড়া নিয়ে পলাইছে।’
‘আচ্ছা ভাবি,আমি আসি আজ। কাল এসে সব শুনব। অনেক কথা বলব।’
আসমানি ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল। পূর্ণা ধীর পায়ে আজিদের বাড়ির উঠোন ছাড়ে। পথে উঠতেই দেখা হয় আজিদের মার সাথে। নাম মালেহা বানু।সাথে আবার পাশের বাড়ির বৃদ্ধা জয়তুনি বেগম রয়েছেন। বৃদ্ধার মাজা বয়সের ভারে ঈষৎ ভেঙ্গে শরীর সামনে ঝুঁকে পড়েছে। পূর্ণাকে দেখে মালেহা বললেন,’কি রে ছেড়ি, পানি নিতে আইছিলি?’

‘জি,খালা।’
‘কলসির ভারে দেহি সাপের লাহান বাঁইকা গেছস লো!’ বললেন জয়তুনি বেগম।
পূর্ণার সত্যি খুব কষ্ট হচ্ছে। সে কলসি নামাল। প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিল। মালেহা বললেন,’বিয়েশাদী কি করবি না? তোর বইনে না আইছে বিয়া দিব?’
‘দিবে মনে হয়।’
‘তোর লগে হাওলাদার বাড়ির কোন ছেড়ার নাকি ঢলাঢলি চলে?’ বললেন জয়তুনি বেগম। কথা বলার ভঙ্গিটা দৃষ্টিকটু ছিল। পূর্ণার গা জ্বলে উঠে। রেগে যায়। বলে,’আপনাকে কে বলেছে?’
‘এইসব কিচ্ছা বাতাসে ছড়ে। এমন আর করিছ না পূণ্ণা। গায়ের রঙডা ময়লা,বয়সও বেশি আবার তো আরেক কিচ্ছাও আছে। কয়েক বছর আগে বেইজ্জতি হইছিলি গ্রামবাসীর হাতে। এহন আবার এমন কিচ্ছা কইরা বেড়াইলে কেউ বিয়া করব না। এহন দেখ তোর বইনে কোনো ল্যাংড়া, লুলা দেইখা বিয়া দিতে পারেনি।’ বললেন মালেহা।
পূর্ণার মাথার আগে মুখ চলে বেশি। সে কিছু কড়া কথা শোনাতে উদ্যত হয়। তার পূর্বেই একটা প্রিয় পুরুষ কণ্ঠ ধেয়ে আসে,’পূর্ণারে কে বিয়া করব না করব সেটা তো আপনেরে দেখতে কয় নাই কেউ।’
পূর্ণা না তাকিয়েই চিনে যায় কণ্ঠটির মালিককে। বুকের বাঁ পাঁজর ছ্যাঁত করে উঠল। উপস্থিত তিনজন একসাথে ঘুরে তাকায়। কিছুটা দূরে মৃদুল দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় গামছা বাঁধা। পরনে কালো শার্ট আর নীল লুঙি। রোদের আলোয় গায়ের ফর্সা রঙটা চিকচিক করছে। কী সুন্দর! পূর্ণা হেসে আবার চোখ ঘুরিয়ে নিল। মৃদুল মালেহাকে উদ্দেশ্য করে আবার বলল,’নিজের চরকায় তেল দেন। পূর্ণার গায়ের রঙ ময়লা আর আপনের কি পরিষ্কার? নিজের রঙডা আগে দেখেন।’

‘এই ছেড়া তুমি কই থাইকা আইছো? বাপের নাম কিতা?’ বললেন মালেহা।
‘কেন? পছন্দ হইছে? ছেড়ি আছে? বিয়া দিবেন? ছেড়ির গায়ের রঙ পরিষ্কার তো?’
মালেহা বানু হকচকিয়ে গেলেন। এ কেমন জাতের ছেলে! কেমন ফটফট করে! মৃদুল যেন বিরাট রসিকতা করেছে,এমনভাবে হাসল পূর্ণা। মৃদুল কলসি কাঁধে তুলে নিল। পূর্ণাকে আদেশের স্বরে বলল,’হাসি থামায়া,হাঁটো।’
মালেহা বানু ও জয়তুনি বেগমকে অবাক করে মৃদুল, পূর্ণা চলে যায়। কিছুটা দূর এসে পূর্ণা প্রথম মুখ খুলল,’কখন এসেছেন?’
‘কিছুক্ষণ আগে। মুখটা শুকনা দেখাইতাছে কেন?’
‘আপাকে দেখেছেন আপনি?’
‘না। অন্দরমহলে ঢুকি নাই।’
পূর্ণা চুপ হয়ে যায়। মৃদুল বলল,’এতো ভার কলসি নিতে পারছো?’
‘কষ্ট হয়েছে।’
‘তো নিতে গেলা কেন?’
পূর্ণা আবার চুপ হয়ে গেল। মৃদুল দাঁড়িয়ে পড়ে। আর এক মিনিট হাঁটলেই মোড়ল বাড়ি। সে পূর্ণার মুখের দিকে চোখ রেখে বলল,’খুশি হও নাই?’
‘কী জন্য?’ পূর্ণা অবাক হয়ে জানতে চাইল।
‘এইযে আইয়া পড়ছি।’

পূর্ণা চোখ নামিয়ে ফেলে। মুচকি হাসে। চোখেমুখে লজ্জা ফুটে উঠে। মৃদুলও হাসল। সে যা বোঝার বুঝে যায়। আশেপাশে অনেক গাছপালা। বড় একটা গাছের ছায়ায় তারা দাঁড়িয়ে আছে। গ্রামের কেউ দেখে ফেলবে,এই ভয় দুজনের কারোর মধ্যে নেই। পূর্ণার পরনের কাপড়খানি ভেজা। কলসি থেকে পানি পড়েছে বোধহয়। কিছু অংশ পেট ও এক পাশের কোমড়ের সাথে কাপড় লেপ্টে আছে। মাথায় ঘোমটা নেই। গাছের পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে এক ঝলক রোদ পূর্ণার মুখ ঘেঁসে কাঁধ ছুঁয়ে মাটিতে পড়ে। সবকিছু মৃদুলের খেয়ালে চলে আসে। সে চমৎকার করে পূর্ণাকে বলল,’ঘোমটা দিয়ে পথে হাঁটবা। বুঝছো ডাগরিনী?’
পূর্ণা ঠোঁটে হাসি রেখেই বাধ্যের মতো হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। তারপর চট করে ঘোমটা টেনে নিল। মৃদুলের ডাগরিনী শব্দটা তার মন কাঁপিয়ে তুলেছে। খুশিতে উড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। ডাগরিনী বলেছে মানে,তার চোখ দুটি ডাগর,ডাগর যা মৃদুলের ভালো লেগেছে! তার প্রশংসা করেছে!
দুপুরের খাওয়াদাওয়া সম্পন্ন করে পূর্ণা তৈরি হয় হাওলাদার বাড়ি যাওয়ার জন্য। সাথে তৈরি হয় বাসন্তী, প্রেমা ও প্রান্ত। তখন মগা আসে। পূর্ণার হাতে চিঠি দিয়ে বলে,’তোমার বইনে দিছে।’
চিঠি হাতে নিয়ে পূর্ণা মনে মনে ভয় পেল। আপা চিঠি কেন পাঠাবে? অজানা আশঙ্কায় পূর্ণার বুক ধুকপুক করতে থাকে। মগা চলে যায়। পূর্ণা চিঠি খুলে-
আদরের বোন,

তুই আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসিস আমি জানি। আমার সব কথাও মানিস। মাঝে মাঝে ফাঁকিবাজিও করিস তবে এখন আমি তোকে যা করতে বলব একদম অমান্য করবি না। এটা আমার অনুরোধ।
যতদিন না আমি আসছি বা চিঠি লিখছি একদম এই বাড়িতে আসবি না। কেউ যদি বলে,আমি পাঠিয়েছি তোকে আনতে। তাও আসবি না। চোখ-কান খোলা রাখবি। প্রেমাকে দেখে রাখবি। আমি ভালো আছি। পায়ে একটু আরাম পেয়েছি। একদম চিন্তা করবি না। আমি খুব দ্রুত আসব। কেন নিষেধ করেছি আসতে তা নিয়ে মাথা ঘামাস না। আমি একদিন তোকে সব বলব। এখন আমার কথাটা রাখ। এমুখো হস না। আমি ভালো আছি। আবার ভাবিস না,আমি কোনো বিপদে আছি। শুনবি কিন্তু আমার কথা। আমার কথা অমান্য করলে আমার সঙ্গ আর পাবি না,মনে রাখবি। খাওয়াদাওয়া করবি ঠিকমতো। নামায পড়বি। ঘরের কাজকর্মে হাত লাগাবি।
ইতি
তোর আপা।
লেখাগুলো এলোমেলো, অগোছালো। মনে হচ্ছে,তাড়াহুড়ো করে লিখেছে অথবা অনেক কষ্টে একেকটা অক্ষর লিখেছে। কপালে ছড়িয়ে থাকা এক গাছি চুল কানে গুঁজে পূর্ণা আবার চিঠিটা পড়ল। পড়ার পর এতটুকু নিশ্চিত হয়েছে,তার বোন ভালো নেই। বড় বিপদে আছে।

ঘুম ভাঙতেই পদ্মজা হকচকিয়ে যায়। চোখের সামনে সব কালো। কালো রঙ ব্যাতীত কিছু নেই। ঘোর অন্ধকার। কিছু দেখা যাচ্ছে না। পদ্মজা চোখ কচলে আবার তাকায়। না,কিছুই পরিবর্তন হয়নি! সবকিছু কালো। বিকেলে সে বৈঠকখানার সোফায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিল। তারপর নিজের অজান্তে ঘুমিয়ে পড়ে। আর ঘুম ভাঙতেই দেখছে সব অন্ধকার! পদ্মজা অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ায় দেয়ালের সুইচ। তখন সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসে একটা আলো। আলোয় ভেসে উঠে আমিরের মুখ। পদ্মজা দেয়াল থেকে হাত সরিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। আমির পদ্মজার চেয়ে দুই হাত দূরে এসে দাঁড়াল। তার দৃষ্টি আবেগপ্রবণ। পদ্মজার হৃদস্পন্দন থমকে যায়। কাচুমাচু হয়ে প্রশ্ন করল,’আপনি সব বাতি নিভিয়েছেন?’
আমির জবাব না দিয়ে হাতে থাকা সুন্দর কাচের হারিকেনটি পাশে রাখল। তারপরই পদ্মজা কিছু বুঝে উঠার আগে পদ্মজাকে কোলে তুলে নিল। পদ্মজা আমতাআমতা করে শুধু বলতে পারল,’এ…এ…ই কি…কি?’
আমির তাদের নিজস্ব ঘরে নিয়ে আসে পদ্মজাকে। পদ্মজা ঘর দেখে অবাক হয়। ঘরের চারিদিকে অদ্ভুত সুন্দর কাচের ছোট হারিকেন। আর মাঝে এক ঝুড়ি পদ্মফুল! সময়টা শরৎকাল। দিনের বেলা শরতের সাদা মেঘ নীল আকাশে পাল তুলে, ছবির মতো ঝকঝকে সুন্দর করে তুলে আকাশ। কমে এসেছে যখন তখন বৃষ্টির জ্বালাতন। সময় বিল ঝিল ঝাপিয়ে শাপলা আর পদ্ম ফোটার। এতো পদ্ম ফুল দেখে মনে হচ্ছে বড় এক বিলের সব পদ্ম ফুল তুলে নিয়ে এসেছে আমির। পদ্মজা প্রশ্ন করার পূর্বে আমির পিছন থেকে দুই হাতে পদ্মজার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল,’মনে আছে,প্রথম রাতে বলেছিলাম একদিন পদ্ম ফুল দিয়ে আমার পদ্মাবতীকে সাজাব! সময়টা নিয়ে এসেছি। দেখো তাকিয়ে।’
পদ্মজা ঝুড়ি ভর্তি পদ্ম ফুলগুলোর দিকে তাকায়। তার চোখ দুটি জলে ছলছল করে উঠে। ঘাড় ঘুরিয়ে আমিরের দিকে চেয়ে আবেগমাখা কণ্ঠে বলল,’সে কথাটাও মনে রেখেছেন!’

উত্তরে আমির হেসেছিল। প্রথম রাতের চেয়ে কোনো অংশে কম সুন্দর ছিল না সেই রাত। পদ্মজা সেজেছিল পদ্ম ফুল দিয়ে। স্বামী যত্ন করে সাজিয়েছিল। সময়টাকে আরো সুন্দর করে তুলতে প্রকৃতি দিয়েছিল মৃদু শীতল বাতাস।
জানালা দিয়ে প্রবেশ করা বাতাসের দাপটে পদ্মজার ঘুম ছুটে যায়। সে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। হাত বাড়িয়ে আমিরকে খোঁজে। নেই,বিছানা খালি! আবার সে পুরনো দিনের আরেকটি সুন্দর মুহূর্ত স্বপ্নে দেখেছে। তার চোখ দুটি জলে ভরে উঠে। আজ পাঁচ দিন আমির নেই। তার কাছে তার স্বামী নেই। কোনো এক অজানা জায়গায় বন্দি হয়ে আছে। পদ্মজা এক হাতের উল্টোপাশ দিয়ে চোখের জল মুছল। বালিশের উপর থাকা আমিরের শার্টটা হাতে নিয়ে চুমু খেল। তার চোখ দুটি আবার ভিজে উঠে। সেদিন রিদওয়ান, খলিল,মজিদ দ্বারা আহত হওয়ার পর তাকে ওখান থেকে কে এনেছে সে জানে না। চোখ খুলে ফরিনাকে দেখেছিল। তিনি ডুকরে কাঁদছেন আর চোখের জল মুছছেন। লতিফাকে জিজ্ঞাসা করে পদ্মজা জানতে পারে,সময়টা দুপুর । সর্বাঙ্গে তখন বিষধর ব্যথা। উঠার শক্তিটুকু নেই। গলায় ব্যথা একটু বেশি ছিল। প্রথমে তার মাথায় আসে আমিরের কথা। রাতের ঘটনা মনে পড়তেই বুঝে যায়,এভাবে সে এদের সাথে পারবে না। তাকে তার মায়ের মতো শান্ত হতে হবে। সময়-সুযোগ বুঝে কাজ করতে হবে। ফরিনা আদর করে খাইয়ে দেন। তিনি পদ্মজার উপর করা নির্মম অত্যাচার আটকাতে পারেননি বলে
বারবার ক্ষমাও চেয়েছেন। তিনি নাকি চেষ্টা করেছিলেন। কীরকম চেষ্টা করেছেন সেটা বলেননি। পদ্মজা জিজ্ঞাসাও করেনি। এরপর পদ্মজা কাঁপা হাতে পূর্ণাকে চিঠি লিখে,ফরিনার হাতে দেয়। তিনি যেন মগাকে দিয়ে দেন।

তারপরের দিনগুলো চুপচাপ কাটিয়ে দেয় পদ্মজা। আমিরের শোকে ভেতরে ভেতরে ঝড় বইলেও সামনে সে নিশ্চুপ থেকেছে। সুস্থ হওয়াটা আসল। নয়তো কাজের কাজ কিছুই হবে না। উল্টো নর্দমার কীটগুলোর হাতে মরতে হবে। আমিরের জন্য দোয়ায় দুই হাত তুলে অঝোরে কেঁদেছে,যেন আমির ভালো থাকে। আর তার কাছে ফিরে আসে। খুব মনে পড়ে মানুষটাকে! হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে পদ্মজার। পদ্মজা আমিরের শার্ট বুকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। ফরিনা এসে দাঁড়ান দরজার সামনে। কেউ একজন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে খেয়াল হতেই,পদ্মজা হাতের উলটোপাশ দিয়ে চোখের জল মুছে তাকাল। ফরিনা ঘরে প্রবেশ করেন। গায়ে সাদা-খয়েরি মিশ্রণের শাল। পদ্মজা আমিরের শার্ট বালিশের উপর রেখে বলল,’আছরের আযান পড়েছে আম্মা?’
মৃদুল অন্দরমহলের সদর দরজায় দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছে। তাকে মদন কিছুতেই অন্দরমহলে ঢুকতে দিচ্ছে না। গত চারদিন ধরে সে চেষ্টা করছে অন্দরমহলে ঢোকার। গত তিন দিন ভুড়িওয়ালা একজন ঢুকতে দিত না। এখন দিচ্ছে না মদন। মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে সে মৃদুলের সাথে তর্ক করছে। মৃদুল বলছে,’দুলাভাই ঢুকতে দেন কইতাছি। সমস্যাটা কিতা ঢুকলে? সেটাই তো বুঝতাছি না।’
‘দেহো মৃদুল মিয়া এইডা আমার কথা না। মজিদ চাচার কথা। উনি কইছে বাড়ির ভিতরে নতুন কেউরে ঢুকতে না দিতে।’
‘আমি তো আত্মীয় নাকি? আমার সাথে এমন করা হইতাছে কেন? আগে তো ঠিকই ঢুকতে দিত। এহন দেয় না কেন?’
‘হেইডা তো আমি জানি না।’
‘সরেন কইতাছি। নইলে ওইযে গাছের মোড়াডা ওইডা দিয়ে আবার মাথাডা ফাডায়া দিব। একবার মারছে আপাই এহন আমি মারাম।’

‘হেইডাই করো,তবুও আমি চাচার কথা অমান্য করতে পারতাম না।’
‘আমার কিন্তু কইলাম, রাগ উঠতাছে। মাটির তলায় গাইরালামু।’
‘মিয়া ভাই তুমি আমারে যা ইচ্ছা কইরালাও। আমি-
মৃদুলের মাথা বরাবরই চড়া! হুট করে খুন করার মতো রাগ চেপে যায় মাথায়। সে মদনের গলা চেপে ধরে। মদন কাশতে থাকল। আলো কান্না শুরু করে। আলোর কান্না শুনে খলিল বেরিয়ে আসেন ঘর থেকে। সদর দরজার সামনে এমন দৃশ্য দেখে তিনি দৌড়ে আসেন। মৃদুলকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেন। হুংকার ছাড়েন,’তোমার এতো সাহস কেমনে হইছে? আমার জামাইয়ের গলা চাইপা ধরো!’
মৃদুলের নাক লাল হয়ে গেছে রাগে। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। রাগী মেজাজ নিয়েই দুই হাত দিয়ে চুল ঠিক করতে করতে বলল,’ আপনার জামাই আমারে ভেতরে ঢুকতে দেয় না।’
‘তুমি মেহমান মানুষ, আলগ ঘরে থাকবা। এইহানে কী দরকার?’
‘এই নিয়ম কবে করছেন আপনেরা? আগের বার যখন ছিলাম তহন তো ঠিকই ঢুকতে দিছেন।’
‘এহন আর ঢুহন যাইব না। এইডা অন্দরমহল। বাড়ির বউ-ছেড়িদের জায়গা।’
‘সত্যি কইরা কন তো,বাড়ির ভিতর কী চলে?’

খলিলের মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে,অসভ্য ছেলেটার কানের নিচে কয়টা দিয়ে দিতে। তিনি কটাক্ষ করে মৃদুলকে বললেন,’নিজের বাড়ি রাইখা এইহানে পইড়া রইছো কেন? মাইনষের অন্ন নষ্ট করতাছো। নিজের বাড়িত যাও।’
অপমানে মৃদুল বাকহীন হয়ে পড়ে! সে ক্ষণকাল কথা বলতে পারে না। তার আপন ফুফা এমন কথা বললো! ক্ষণমুহূর্ত পর সে জ্বলে উঠে বলল,’আপনের বাড়ির উপর থুথু মারি। আমি ব্যাঠা মিয়া বংশের ছেড়া। শত বিঘার মালিক আমি একাই। আপনের অন্নের ঠেকা পড়ে নাই আমার। আমার বাড়িত কামলাই আছে দশ-বারো জন। আমি কাইলই চইলা যাইয়াম বাড়িত।’
মৃদুলের আর এক মুহূর্তও এখানে দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে না। সে ঘুরে দাঁড়ায়। কাছেই একটা বিরাট পাতিল ছিল। কোনো কাজে হয়তো বের করা হয়েছে। সে পাতিলে জোরে লাথি মেরে হনহন করে চলে যায়। পূর্ণা তার বোনের খবর নিয়ে দিতে বলেছে বলেই,সে বার বার অন্দরমহলে ঢোকার চেষ্টা করেছে। নয়তো মৃদুলকে কেউ একবার কোনো ব্যপারে না করলে,সে দ্বিতীবারের মতো সেখানে ফিরেও তাকায় না।
পদ্মজার কথার জবাব দিলেন না ফরিনা। তিনি পদ্মজার পাশে গিয়ে বসলেন। পিছনে রিনু আসে। হাতে খাবারের প্লেট। তিনবেলা ফরিনাই খাইয়ে দিচ্ছেন। যত্ন নিচ্ছেন পদ্মজার। মায়ের চেয়ে কোনো অংশে কম করছেন না। তবুও এই মানুষটা কোন কারণে সেদিন তার চিৎকার শুনেও বাঁচাতে যায়নি? ফরিনা প্লেট হাতে নিতেই পদ্মজা বলল,’আমি এখন মোটামুটি ভালোই আছি আম্মা। আমি খেয়ে নিতে পারবো। হাঁটতেও তো পারি।’

পদ্মজার এক কথায় খাবারের প্লেট পদ্মজার হাতে তুলে দিলেন ফরিনা। আর রিনুকে চলে যেতে বললেন। পদ্মজা চুপচাপ খেয়ে নেয়। তার খেতে ইচ্ছে করে না একদমই। কিন্তু সামনের যুদ্ধটার জন্য তার খেতেই হবে। তাকে সুস্থ থাকতে হবে। সুস্থতা ছাড়া যুদ্ধে সফল হওয়া সম্ভব নয়। যতক্ষণ পদ্মজা খেল,ততক্ষণ ফরিনা পাশে বসে থাকলেন। খাওয়া শেষ হওয়ার পর পদ্মজা ফরিনাকে বলল,’আব্বাকে খুব ভয় পান আম্মা?’
ফরিনা স্বাভাবিকভাবেই জবাব দিলেন,’সব বউরাই স্বামীরে ডরায়।’
‘না,আপনি একটু বেশি ভয় পান। যমের মতো।’
‘কবিরাজের দেওয়া ঔষধডি খাও এহন।’
‘আপনি কথা এড়াচ্ছেন আম্মা। আচ্ছা,ঔষধ দেন আগে।’
ফরিনা আলমারি খুলে ঔষধ বের করলেন। তারপর এগিয়ে দিলেন পদ্মজার কাছে। পদ্মজা ঔষধ খেয়ে বলল,’কবিরাজ আনার অনুমতি ওরা দিয়েছিল ভেবে আমি অবাক হয়েছি আম্মা! ওরা কেন চায়? আমি সুস্থ থাকি?’
ফরিনা কিছু বললেন না। পদ্মজা ফরিনার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। মানুষটার আয়ু কী শেষের পথে? কেমন যেন মৃত, মৃত ছাপ মুখে। চোখ বুজলে মনে হবে,অনেক দিনের উপোষ করে মারা গিয়েছেন। পদ্মজার মায়া হয় মানুষটার জন্য। কোন দুঃখে তিনি ধুঁকে,ধুঁকে মরছেন! পদ্মজা বিছানা থেকে নেমে এসে ফরিনার সামনে দাঁড়াল। বলল,’আম্মা, আপনি আমাকে নিজের মেয়ে ভেবে একটা আবদার রাখবেন?’

‘তুমি তো আমার ছেড়িই।’
‘তাহলে আবদার রাখবেন?’
‘রাখাম।’ ফরিনার শুষ্ক চোখ। অথচ গলা ভেজা মনে হলো!
পদ্মজা বলল,’তাহলে আপনার সব গোপন কথা আমাকে বলুন। যা ভেবে ভেবে আপনি কষ্ট পান।’
ফরিনা দুই হাতে পদ্মজার দুই হাত মুঠোয় নিয়ে চুমু খান। এক ফোঁটা চোখের জল পড়ে পদ্মজার হাতে। মমতাময়ী স্পর্শ! পদ্মজার শরীরের
লোম খাড়া হয়ে যায়। ফরিনা বললেন,’তার আগে কও আমি সব কওয়ার পর তোমারে যা করতে কইয়াম তাই করবা তুমি।’
পদ্মজা অপলক নয়নে ফরিনার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কি করতে বলবেন তিনি? যদি সে সেটা করতে না পারে! সম্ভব না হয়! পদ্মজা বলল,’আপনি যা বলবেন আমাকে তার সাথে যদি যা করতে বলাটা মানানসই হয়,যুক্তিগত হয়। আমি তাই করব আম্মা।’

ফরিনা চোখের জল মুছেন। তারপর বললেন,’আমি বাবুর বাপরে দেইখা আইতাছি। তুমি শুইয়া থাকো।’
কথা শেষ করেই ফরিনা দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যান। পদ্মজার মাঝে উত্তেজনা কাজ করছে। সে জানে না সে কী শুনতে চলেছে,তবে সেটা কোনো সাধারণ ঘটনা বা কথা হবে না এটা নিশ্চিত। সে ঘরে পায়চারি করতে করতে জানালার ধারে আসে। দেখতে পায় রিদওয়ানকে। হাতে একটা পলিথিন নিয়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসছে। এই জঙ্গলের মাঝেই তো আছে তালাবন্ধ রহস্যজাল। যার চাবি বোধহয় তার কাছে আছে। আলমগীরের দেয়া চাবিটাকে পদ্মজার কোনো তালাবন্ধ রহস্যজালের চাবি মনে হয়! রিদওয়ান গত দিনগুলোতে তিন-চার বার তাকে দেখতে এসেছে। কিন্তু কিছু বলেনি। রিদওয়ানের মতিগতি বোঝা যায় না। অদ্ভুত সে। রিদওয়ানকে দেখলে পদ্মজার শরীর রাগে কাঁপে।
বেশ কিছুক্ষণ পর পায়ের শব্দ আসে কানে। শব্দটা শুনে মনে হচ্ছে পুরুষের পায়ের শব্দ। পদ্মজা দ্রুত এসে বিছানার এক কোণে বসে। যে কোণে ছুরি রাখা আছে। ঘরে প্রবেশ করে রিদওয়ান। পদ্মজাকে দেখেই লম্বা করে হেসে বলল,’তারপর বলো কেমন আছো?’
পদ্মজার থেকে জবাব না পেয়ে রিদওয়ান আবার প্রশ্ন করল,’সুস্থ আছো তো?’
পদ্মজা সাড়া দিল না। রিদওয়ান চেয়ার টেনে বসল। বলল,’তোমাকে এত চুপচাপ দেখে অবাক হচ্ছি। কী পরিকল্পনা করছো বলোতো?’
পদ্মজা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। বলল,’কাপুরুষ বোধহয় আপনার মতো মানুষকেই বলা হয়।’
রিদওয়ানের ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে যায়। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। তারপর হুট করেই হেসে দিল। বলল,’ কাপুরুষের কী করেছি?’

আমি পদ্মজা সিজন ২ পর্ব ৫১+৫২+৫৩+৫৪+৫৫

‘স্বামীর অবর্তমানে তার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছেন। আবার সেই স্ত্রী অসুস্থ ছিল। এমন তো কাপুরুষরাই করে।’
‘এতো কথা না বলে চুপচাপ যা বলি শুনো। আমির আমাদের ব্যপারে অনেক নাক গলিয়েছে। অনেক সমস্যা করেছে। তবুও আমরা আমিরকে এক শর্তে ফিরিয়ে দেব। যদি তুমি সেই শর্ত মানো।’
‘কী শর্ত?’
‘তুমি আমিরকে নিয়ে ঢাকা চলে যাবে। কখনো অলন্দপুরে ফিরবে না।’
‘যদি না মানি?’
‘অবুঝের মতো প্রশ্ন করতে বলিনি। শর্ত দিয়েছি,মানা না মানা তোমার ব্যপার।’
‘আপনারা আমাকে ভয় পাচ্ছেন কেন?’
রিদওয়ান হাসল। পদ্মজা বলল,’সেদিন মেরে আধমরা করেছেন। এবার একদম মেরে দিন। তাহলেই আপনাদের সমস্যা শেষ। বেহুদা, আমাদের মুক্তি দিয়ে ভেজাল কেন বাড়াচ্ছেন? ঢাকা ফিরে গিয়ে পুলিশ নিয়েও তো আসতে পারি।’
রিদওয়ান বিরক্তিতে ‘চ’ সূচক উচ্চারণ করল। বলল,’তোমাকে মারা যাবে না।’
‘আমাকে দিয়ে আপনাদের কী কাজ হবে যে মারা যাবে না?’
‘এতো প্রশ্ন কেন করছো?’
‘মনে আসছে তাই।’

রিদওয়ান রাগে উত্তেজিত হয়ে পড়ছে,’তুমি শর্তে রাজি নাকি না?’
‘আগে বলুন,কার কাজে আমি লাগব? কার খাতিরে আমাকে মারা যাবে না?’
‘তুমি শর্তে রাজি নাকি সেটা বলো। এইযে আমার পাঞ্জাবিতে তাজা লাল দাগটা দেখছো এটা কিন্তু রক্তের। আর রক্তটা আমিরের।’
পদ্মজার চোখ দুটি জ্বলে উঠে। এমনিতেই এই হিংস্র মানুষটার হাসি,কথা তার গা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তার উপর তার স্বামীর রক্ত দেখাচ্ছে রিদওয়ান। পদ্মজা উঁচু গলায় প্রশ্ন করল,’উনাকে জঙ্গলেই রেখেছেন তাই না?’
‘শর্তে রাজি তুমি?’
‘না।’
‘তোমাকে তো আমি-

রিদওয়ান রেগে তেড়ে আসে। পদ্মজা পাশের টেবিল থেকে ঔষধের কাচের বোতলটা নিয়ে রিদওয়ানের মাথায় আঘাত করে। রিদওয়ান আকস্মিক আক্রমণে বিছানায় পড়ে যায়। পদ্মজা দ্রুততার সাথে ছুরি হাতে নেয়। রিদওয়ান বিছানায় পড়ার দুই সেকেন্ডের মধ্যে তার পিঠে ছুরি দিয়ে হেঁচকা টান মারে। রিদওয়ান আর্তনাদ করে উঠল। পাঞ্জাবি ছিঁড়ে ছুরির আঘাত শরীরের মাংস অবধি চলে গিয়েছে। সুযোগ পদ্মজার হাতের মুঠোয়। সে এই সুযোগ হারাবে না। এতদিন সে এদের মানুষ ভেবে এসেছে। অথচ,এরা মানুষরূপী শয়তান। আর শয়তানকে বুঝেশুনে নয়, ইচ্ছামত আঘাত করা উচিত। পদ্মজা দ্রুত কাঠের চেয়ার তুলে নেয় হাতে। শরীরের সব শক্তি দিয়ে বারি মারে রিদওয়ানের মাথায়। রিদওয়ানের কানের পাশ দিয়ে রক্তের ধারা নামে। নিস্তেজ হয়ে পড়ে তার শরীর। পদ্মজা হিংস্র বাঘিনীর মতো হাঁপাতে থাকে। মিনিট দুয়েক পর শাড়ির আঁচল মেঝে থেকে তুলে বুকে জরিয়ে নেয়। হুট করেই যেন শান্ত সমুদ্র গর্জন তুলে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে চারপাশ।

আমি পদ্মজা সিজন ২ পর্ব ৬১+৬২+৬৩+৬৪+৬৫