আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ১
suraiya rafa
— সুইট ডেমোন নাম শুনেছিস কখনো?
গতকাল রাতভর মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে এদিকটায়,তাও দিবালোকে সূর্যদয় হয়নি।চারিদিক কেমন গুমোট হয়ে আছে, যেন টোয়াইলাইট উপন্যাসের সেই মেঘের চাদরে ঢাকা বৃষ্টিস্নাত ছোট্ট শহর “ফর্ক”। পিচঢালা ভাঙাচোরা রাস্তার যত্রতত্র জমে আছে বৃষ্টির জল। জমে থাকা সেই তুচ্ছ নোংরা জল পায়ে মাড়িয়ে পথচারীরা গন্তব্যের দিকে হেঁটে চলেছে নির্বিগ্নে। সারারাত বৃষ্টি হওয়ার দরুন শহুরে রাস্তায় ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধটা বেশ সুস্পষ্ট। এই গন্ধটা নাকে এলে চারিদিকের সবকিছু আপনা-আপনি সতেজ মনে হয়।
লোকাল বাসের কর্নারের সিটটায় বসে কানে ফোন নিয়েই, ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাওয়া বৃষ্টিস্নাত যান্ত্রিক শহরটার দিকে চেয়ে চেয়ে লম্বা শ্বাস নিলো ঈশানী। আজ বহুদিন বাদে ওর মনটাও সতেজ লাগছে, যদিও বা অসহায় চোখে মুখের কোথাও সেই সতেজতার লেশমাত্র নেই। ভীত হরিণীর মতো নীল রঙা জ্বলজ্বলে চোখের মনি দুটো তখনও বাসের জানালা ভেদ করে বাইরেই নিবদ্ধ তার, এমন সময় হুট করেই উক্ত প্রশ্নটা করে বসে ফোনের অপর প্রান্তের মানুষটা।
আঠার মতো মানুষ গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছে লোকাল বাসে, প্রতিদিন সকালে কর্মস্থলে পৌঁছানোর এই কঠিন যু’দ্ধে কেউ কাউকে এক চুল ও ছাড় দিতে নারাজ তারা। বাসটা ঠেলাগাড়ির মতো ঢ্যাকঢ্যাক করে সামনে এগোচ্ছে, এমন একটা অসহনীয় বিরক্তিকর সময়ে ফোনের মধ্যে এই ধরনের গপ্পো জুড়ে দেওয়া কেবল জিসানের দ্বারাই সম্ভব। এর বাইরে গিয়ে যদি ভাবতে হয়, তাহলে হয়তো ছেলেটা ঈশানী কে বিরক্তিকর পরিস্থিতিতে সামান্য কম্ফোর্ট করার চেষ্টা চালাচ্ছে , ওই জন্যই এসব দার্শনিক কথাবার্তা বলা আর কি।
ঈশানী যে মেয়ে, বুক ফাটবে তবুও মুখ ফুটবে না ওর, দেখা গেলো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজের অসহায়ত্ব কাউকে প্রকাশ করতে না পেরে নিঃশব্দে কেঁদে ভাসাবে দু’চোখ। আর জিসান কখনোই চাইবে না ওই সুন্দর জ্বলজ্বলে নীলকান্তের মতো চোখ জোড়া বেয়ে একটা ফোটাও ক্ষুদ্র অশ্রুকনা ঝরে পরুক।
অনেকক্ষণ ধরে নিস্প্রভ চোখে বাইরে চেয়ে থাকলেও মাত্রই লোকাল বাসের ধাক্কায় ভ্রম ছুটে গেলো ঈশানীর। ও এপাশ থেকে একটু কাইকুই করে উঠতেই, ফোনের অপর প্রান্ত থেকে উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিসান বলে ওঠে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
—ঈশা, শুনতে পাচ্ছিস?
নিজেকে ঠিকঠাক করে শান্ত স্বরে জবাব দিলো ঈশা,
—- হ্যা শুনছি বল।
ঈশানীর কথার মধ্যে উষ্ণতার ছিটেফোঁটা নেই। কথাবার্তা তো দূরে থাক ও হাসলেও কেন যেন মনে হয় ভীষণ দুঃখী একটা মেয়ে জোর করে হাসার চেষ্টা করছে।মেয়েটা একটু বেশিই অন্তর্মুখী স্বভাবের। জিসানের অবশ্য গত ছয়মাসে অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। তাই ঈশানীর এমন নির্জীবতাকে পাছে হটিয়ে পুনরায় প্রশ্ন ছোড়ে জিসান,
—- বলছি যে সুইট ডেমোন এর নাম শুনেছিস কখনো?
লোকাল বাসের ঢ্যাকঢ্যাক আওয়াজ, মানুষের অসহনীয় কোলাহল, আর গিজগিজ করা পরিবেশ,সকল কিছুকে মূহুর্তেই দৃশ্যপট থেকে এক ধাক্কায় বের করে দিয়ে, জিসানের কথায় ভ্রু কুঁচকালো ঈশানী। শব্দটা আজই বোধ হয় প্রথম শুনলো ও। তাই কিছুটা ধাতস্থ হয়ে উল্টো প্রশ্ন করে বসলো জিসান কে, শুধালো,
— সুইট ডেমোন, সেটা আবার কি? কোনো ভ’য়ানক জন্তু জানোয়ার নয়তো?
ঈশানীর বোকা বোকা কথায় নিঃশব্দে হাসলো জিসান, মেয়েটা একটু বেশিই সরল, অথচ ভাবখানা এমন দেখায় যেন ও সবকিছু জেনে বসে আছে,সাহায্যের জন্য কাউকে প্রয়োজন নেই ওর। বাইরের জগতে নিজেকে স্ট্রং দেখাতে গিয়ে বারবার হোঁচট খায় মেয়েটা, তবুও কারও কাছে নিজের দূর্বলতা অপারগতা স্বীকার করেনা কখনোই। পাছে না আবার মানুষ ধরে ফেলে ও আসলে কঠোর নয়, বরং দূর্বল আর অন্তর্মুখী একটা মেয়ে ।
কারও সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস ওর ছোট্ট কলিজাতে নেই। কিন্তু জিসান তো সুকৌশলী আর বুদ্ধিমান, ঈশানীর কোল্ডনেস আর দূর্বলতা বের করে ফেলতে খুব বেশি সময় লাগেনি ওর।
সে যাই হোক, আপাতত ওই সব চিন্তা না করে ঈশানীর প্রশ্নের জবাব দিলো জিসান,মৃদু হেঁসে বললো,
— আরেহ না, এরা কোনো জন্তু জানোয়ার কিংবা আলাদা কোনো প্রানী নয়, এরা আমাদের মতোই মানুষ, আমাদের আশেপাশেই তাদের অবস্থান। তারা খুব করে মানুষ কে ম্যানিউপুলেট আর আকর্ষিত করতে পারে। কিন্তু দিন শেষে তাদের আসল রূপ হয় ডেমোন এর মতোই ভ’য়ানক আর কুৎসিত।
জিসানের কথা শেষ হতে না হতেই বাস এসে থামলো “চাঁদের হাসি” সাইনবোর্ড টাঙানো ক্যাফেটার ঠিক সামনে। মানুষের ঠেলাঠেলি সহ্য করে বাস থেকে নেমে যেতে যেতে ইশা বললো,
—- তোর ডাবল মিনিং কথার মানে আমি বুঝিনা জিসান, আমাকে এসব বলে লাভ ও নেই, কারন আমার জীবনে ওসব সুইট ডেমোন টেমোন আসার কোনো সম্ভাবনা নেই।
— কি করে বুঝলি সম্ভাবনা নেই?
কথা বলতে বলতেই বাস থেকে নেমে রাস্তার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে পরলো ঈশা। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে রাস্তার অপর পাশে ফুটন্ত তাজা ফুলের ইনডোর প্ল্যান্ট আর চাঁদের ডেকোরেশন দিয়ে সাজানো অত্যাধুনিক ক্যাফেটার দিকে দৃষ্টিপাত করে ও। ঠিক সেখানে ক্যাফের সামনে কানে এয়ারপড লাগিয়ে পকেটে হাত গুঁজে সটান দাড়িয়ে আছে জিসান। ওদের মাঝে প্রসস্থ হাইওয়ে রাস্তা, প্রতি সেকেন্ড অন্তর অন্তর সেখান দিয়ে চলাচল করে অসংখ্য দূরপাল্লার গাড়িঘোড়া। আর বারবারই গাড়ি যাতায়াতের ফলে বাতাসের ঝটকায় এলোমেলো হয়ে যায় ঈশানীর জামা কাপড় চুল সবকিছু। তবুও কেন যেন বেশ ভালো লাগছে এই দমকা হাওয়া, আজ সূর্যের তেজ নেই, মেঘের চাদরে ঢেকে আছে পুরো আকাশ, হয়তো তাই জন্য।
অন্যান্য সময় হলে হয়তো জিসানের আগ বাড়িয়ে করা প্রশ্নের কোনোরূপ উত্তরই দিতো না ঈশা। কিন্তু আজ দিলো, একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুকনো মুখে ঈশা জানালো,
— কারণ আমার পরিচিতদের খাতা শূন্য প্রায়। এই জীবনে হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ ছাড়া পুরো দুনিয়াটাই আমার কাছে অচেনা জিসান, আর না তো আমি আগ বাড়িয়ে চিনতে চাই কাউকে। কারণ আমার মনে হয়, মানুষকে যত চিনতে যাবো ততই জটিল হবে পৃথিবী, জীবনের সমীকরণ দিগুণ পোক্ত হয়ে উঠবে। আমি গণিতে বেশ কাঁচা, জীবনের এতো ধারালো সমীকরণ মেলানোর ধৈর্য আমার নেই, তার চেয়ে বরং নিজের জগতে একা থাকাটাই সবচেয়ে শ্রেয়। এখন তুই’ই বল আমায়, আমি যদি মানুষের সাথে মেশার আগ্রই না দেখাই, কোনোরূপ চেষ্টাই না করি, তাহলে সেই সুইট ডেমোন আমাকে ম্যানিউপুলেট করবে টা কিভাবে?
ঈশানীর এতো এতো যুক্তির নিচে চাপা পড়ে পিষে গেলো জিসানের দার্শনিক চিন্তা ধারা। যার দরুন ও টপিকটা বদলে ফেললো তৎক্ষনাৎ, কথা ঘুরিয়ে শুধালো,
— রাস্তা পার হতে পারবি? নাকি আমি এগিয়ে আসবো।
জিসানের এই ধরনের গার্জিয়ানের মতো করে অধিকার দেখিয়ে বলা কর্থাবার্তা মোটেও পছন্দ নয় ঈশার।ওকে কেউ দূর্বল ভাবছে, ওর ভেতরের সত্তাটাকে টেনে হিঁচড়ে বের করতে চাইছে, এই বিষয়গুলো ভাবলেই, মস্তিষ্কের পারদে পারদে আন্দোলন করে ওঠে এক অন্য ঈশানী। যে অনেকটা রাগী আর কঠোর মনোভাবের মেয়ে। নিজের অসহায়ত্ব আর দূর্বলতা নিয়ে কথা বললে একটুতেই কেমন আত্মসম্মানে লেগে যায় ভেতরের ঈশানীর,ক্ষ্যাপাটে বাঘিনীর মতো তেতে উঠে মেজাজ খানা।
ভেতরটা তৎক্ষনাৎ মাত্রাতিরিক্ত ক্রোধে চিড়িবিড়িয়ে উঠলেও, বাইরের নরম তনু সত্তাটা সামলে নেয় সেসব, চোখে মুখে কিছুটা থমথমে ভাব করে জিসানের মুখের উপরই কথা ছুড়ে মা’রে ঈশা,
— তোকে অনেকবার বলেছি জিসান, আমি ছোট বাচ্চা নই, নিজের খেয়াল নিজে রাখতে পারি আমি। তুই আমাকে যতটা বোকা আর দূর্বল মনে করিস আমি ততটাও দূর্বল নই। পরিবারকে ফেলে এই চিটাগং শহরে গত ছয়মাস ধরে একা একাই আছি, যেভাবেই হোক টিকে তো আছি। আর ভবিষ্যতেও নিজের খেয়াল নিজেই রাখতে পারবো আমি, এখন ফোন রাখ।
একনাগাড়ে কথা শেষ করে নিজেই কলটা কেটে দিলো ঈশা, অতঃপর খুব ভয়ে ভয়ে সামনে পা বাড়ালো রাস্তা পার হওয়ার উদ্দেশ্যে।
প্রতিদিনই এই হাইওয়ে রাস্তাটা পার হতে গিয়ে কলিজার পানি শুকিয়ে যায় ঈশার। কাজে যেতে লেইট ও হয় শুধু এই কারনেই। তবুও বুকের মাঝে অদম্য সাহস জুগিয়ে, কলিজা হাতে নিয়ে প্রতিদিনই এই কাজ করে ঈশা।
কিন্তু বিধিবাম ও যে সত্যিই দুনিয়ার চোখে, দূর্বল আর বোকা প্রকৃতির, সেই প্রমান সরূপ একটা প্রাইভেট কার হুট করেই ঈশানীর শরীরে রাস্তায় জমে থাকা লিটার খানিক ময়লা পানি ছিটকে দিয়ে শাঁই শাঁই করে চলে গেলো চোখের পলকে। ময়লা পানি শরীরে পরার সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুখ কুঁচকে গেলো ঈশার। একটা বিরক্তিকর দিনের সূচনা বোধ হয় এমন করেই হয়। শরীরে এটে থাকা লং টপস ডেনিম প্লাজো ওড়না সবকিছুই নোংরা হয়ে গিয়েছে মূহুর্তেই। ঈশার এমন নাজেহাল অবস্থা দেখে না চাইতেই ঠোঁটের আগায় একটুকরো হাসি খেলে গেলো জিসানের, মনেমনে বললো,
—- কি দরকার আমার সামনে এমন স্ট্রং সাজার? তুই যে ভীত হরিণী সেটা আমি ভালো করেই জানি, বুঝতেও পারি। কারণ তোর ভেতরের দূর্বলতা আর ভীতি সন্ত্রস্ততা মুখে স্বীকার না করলেও , তোর মাদকের মতো নীলচে-কালো চোখের মনি দুটোই তার স্পষ্টতা ধরে রাখে।
ক্যাফেতে ফিরে, ওয়াশরুমে ঢুকে হাতমুখ আর জামাটা কোনোমতে পরিস্কার করে বেরিয়ে এসে খাকি কাপড়ের এ্যাপ্রোন টা গলায় ঝুলিয়ে কোমড়ের পেছন থেকে বেঁধে নিলো ঈশা। তারপর রেশমের মতো খোলা চুল গুলোকে একটা ক্ল্যাচারের সাহায্যে বেঁধে দ্রুত চলে গেলো কফি মেকারের কাছে।
ততক্ষণে জিসান ও এ্যাপ্রোন পরে সবগুলো কফির অর্ডার টুকে নিয়ে কাগজটা দ্রুত হস্তে এগিয়ে দিলো ঈশার নিকট। আর এখান থেকেই সূচনা হয় আরেকটি ব্যস্ত দিনের।
পতেঙ্গা সি-বিচ থেকে মাত্র মিনিট পাঁচেকের দূরত্বে অবস্থিত “চাঁদের হাসি” নামক এই ক্যাফেতে গত ছ’মাস ধরে চাকরি করছে ঈশানী। জিসান আগে থেকেই পার্ট টাইম করতো, এখন ও পার্ট টাইমই করে। কিন্তু ঈশানীর ডিউটি চলতে থাকে সকাল থেকে রাত অবধি।
ঈশানীর মতো অন্তর্মুখী আর চুপচাপ স্বভাবের মেয়ের সাথে জিসান নামক বাঁচাল ছেলেটার বন্ধুত্ব যে কি করে তৈরি হলো সেটা এক প্রকার রহস্যই বলা চলে। অবশ্য এই বন্ধুত্বের পেছনে শতভাগ অবদান শুধুই জিসানের, ঈশানীর অবদান শূন্যের কোঠায়।
আপনা আপনি মনের টান তৈরি না হলে সহজে কারও সাথে মিশতে পারেনা ও,যার দরুন, নিজের চারিদিকে তৈরি করে রাখে অদৃশ্য এক শক্ত প্রাচীর। কিন্তু মন যদি কাউকে সেই অদৃশ্য গণ্ডী পার হাওয়ার জন্য একবার সায় জানিয়ে দেয়, তবে শত চেষ্টা করেও তারউপর অনীহা তৈরি করতে পারেনা ঈশা। ওর স্বভাবটাই এমন। ভেতরের সত্তাটা কখন যে কার জন্য কোমল হয়ে খোলস ছাড়িয়ে এক নিমিষে বেরিয়ে আসে তা নিজেও খুব একটা ঠাওর করতে পারেনা ঈশানী।
প্রথম দিকে সে-ই অদৃশ্য গণ্ডীতে বাঁধা প্রাপ্ত হয়ে জিসান ও ধারে কাছে ঘেঁষতে পারেনি ওর। জিসান জানেনা ঈশানীর এমন অন্তর্মুখী আর ভীত হওয়ার কারণ। তবে এই স্বভাবের কারণে যে মেয়েটা সবার অপছন্দের তালিকার শীর্ষে সেটা ও ভালো মতোই বুঝতে পারে। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এতো এতো মানুষের অপছন্দের শীর্ষ ব্যক্তিটি হয়েও ঈশানীর কিছুতেই কিছু যায় আসেনা খুব একটা।
কিন্তু এতোকিছু কে ছাপিয়ে সবার অপছন্দকে গ্রাহ্য না করে জিসান ঠিকই সেই অদৃশ্য গণ্ডী পার হয়ে দূরত্ব ঘুচিয়েছিল নীল চোখের এই অদ্ভুত মেয়েটার সঙ্গে। ভেতরে ভেতরে নরম স্বভাবের ভীত মেয়েটাকে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন কাজে সাহায্য করা থেকে শুরু করে, সবসময় ছায়ার মতো ওর পাশে থেকে ঈশানীকে নিজের কাঠিন্যতার শক্ত খোলস থেকে বের করে বন্ধুত্বের কোঠায় নিয়ে আসা এতোটাও সহজ ছিল না জিসানের জন্য।
যদিও এখনো অনেকটা রহস্য ভেদ করা বাকিই পরে আছে, তবে ঈশা যে জিসান কে নিজের বন্ধু তালিকায় ঠায় দিয়েছে সেটা জিসান উপলব্ধি করতে পারে বেশ ভালোমতোই। ভয়টাও অবশ্য সেখানেই, মেয়েটা উপরে উপরে কঠিন হলেও, ভেতরে নরম কাঁদামাটি,মনটা একদম সরল।এই রহস্যময় নিষ্ঠুর পৃথিবীতে একা চলতে গিয়ে, যদি সত্যিই মুখোশের আড়ালে থাকা সুইট ডেমোন নামক কোনো কুৎসিত শয়’তানের পাল্লায় পরে নিজের সর্বস্ব হারিয়ে ফেলে ঈশা? তখন কি হবে? শুধু মাত্র এই একটা বিষয় নিয়ে ভয় হয় জিসানের, বড্ড ভয়।
টুরিস্ট এরিয়ার পাশে অবস্থিত হওয়াতে চাঁদের হাসি নামক ক্যাফের কাস্টমারের অভাব হয়না কোনো কালেই। তবুও যদি প্রশংসা করে বলতে হয়, তো গত ছ’মাসে এই ক্যাফের কাস্টমারের সংখ্যা গুনে গুনে দিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, মালিকের ব্যাবসা লালে লাল। অবশ্য এমনটা হওয়ারই কথা, ঈশা মেয়েটা অসাধারণ কফি বানায় । একবার জিসান ঈশাকে বেশ কড়া গলায় জিজ্ঞেস করেছিল,
—- পড়াশোনা তো করিস না, তাহলে ভবিষ্যতে করবি টা কি?
ঈশা তখন মৃদু হেসে জবাব দিয়েছিল,
—- আমার তো বিগ প্ল্যান, জয়া আন্টির মতো এরকম একটা কফি হাউজ খুলবো, তারপর তোর আমার মতো কয়েকজন তুচ্ছ কর্মচারী রেখে, শুয়ে বসে আরামসে লাখ লাখ টাকা কামাবো।
পরে আবার নিজেই বলেছিল,
— হাস্যকর রাইট?
প্রত্যুত্তরে জিসান বলেছিল,
— মোটেই না, আমি আছিতো তোর পাশে।
ব্যাস, আ’গুনে ঘি ঢালার জন্য এটুকুই যথেষ্ট ছিল, জিসান কে যে ঈশার অপছন্দ তেমনটা নয়, কিন্তু ওর অতিরিক্ত অধিকার বোধ বরাবরই অন্য কিছুর ইঙ্গিত দেয় ঈশার মস্তিষ্কে, যেটা ঈশার একটুও পছন্দ নয়। ও চায় না নিজের দূর্বলতা দেখিয়ে জিসানের করুনা পেতে, আর নাতো বন্ধুত্বের বাইরে গিয়ে জিসানের সঙ্গে অন্য কোনো সম্পর্কে জড়াতে। কারন ঈশার মতে জীবনে চলার পথে সত্যিকারের বন্ধুত্বের বড্ড প্রয়োজন, যা ওর জীবনে খুব রেয়ার।
তাই গোটা জীবন তল্লাশী করে খুজে পাওয়া হাতে গোনা দু’একটা বন্ধুকে এভাবে হারাতে চায়না ঈশা। যদিও বা ঈশার বেশ সন্দেহ ,যেখানে ওর মতো চুপচাপ একগুয়ে স্বভাবের মেয়ের সাথে কেউ মিশতেই চায় না,সবাই কোল্ড নয়তো মূর্তি বলে মুখ ফিরিয়ে নেয়, সেখানে জিসান বন্ধুত্ব পাতানোর জন্য একেবারে হাত ধুয়ে লেগেছিল ঈশার পেছনে। ওই জন্যই হয়তো জিসানকে এখনও সেভাবে আপন কিংবা কাছের ভাবতে মনের মাঝে সংশয় কাজ করে ঈশার, তাইতো বন্ধু হয়েও জিসান আর ওর মাঝে মনের দূরত্ব অসীম। জিসান অবশ্য এটা মনে করেনা। জিসানের মতে ঈশা আমার বন্ধু তার মানে ওর উপর আমার অনেকটা অধিকার বোধ রয়েছে।
দুপুরের দিকে লাঞ্চ ব্রেক শেষ হতেই, ঈশা যখন নতুন উদ্যমে কফি বানাতে শুরু করে ঠিক তখনই জিসান এসে জানায়, ক্যাফের মালকিন জয়া আন্টি এসেছেন।
জিসানের মুখে কথাটা শুনে বেশ খুশি হলো ঈশা, জয়া আন্টির সঙ্গে কি দরকারি কথা আছে বলে জিসানকে কফি মেকারের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে, তাড়াহুড়ো করে সামনে ক্যাশ কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যায় ও। জয়া আন্টি তখন মুখের লালায় আঙ্গুল ভিজিয়ে টাকা গোনায় খুব মনোযোগী। দেখতে শুনতে ভীষণ সুন্দরী, দুধে আলতা রাঙা ষাটোর্ধ এই জয়া আন্টি ভারী মিশুক মহিলা, ক্যাফের প্রত্যেকটা কর্মচারীর সঙ্গে তার ভাব গলায় গলায়, অথচ গত ছ’মাসে ঈশার সঙ্গে প্রয়োজনের বাইরে একটা কথাও হয়নি তার। কি করেই বা হবে? মেয়েটা ভারী চুপচাপ।
ক্যাফেতে ঢুকে সারাদিনে একটা কথা বলে কিনা সন্দেহ, যার দরুন জয়া আন্টির খুব একটা পছন্দ নয় ঈশাকে। পছন্দ হওয়ার কথাও নয়, ক্যাফের মতো একটা যায়গায় সুন্দর হাসি দিয়ে মন ভুলানো কথার জোয়ারে কাস্টমারদের মন জয় করতে না পারলে সে আবার কেমন ধারা কর্মচারী? নির্ঘাত মেয়েটার হাতের কফি মারাত্মক সুস্বাদু, নয়তো একে বহু আগেই কাজ থেকে ছাটাই করে দিতেন তিনি।
সে যাই হোক, আপাতত কিছু বলতে চায় মেয়েটা সেটাই শোনার পালা, ঈশাকে দেখতে পেয়ে টাকা গোনা বন্ধ করলেন জয়া আন্টি। নিজের মোটা ফ্রেমের চশমার উপর দিয়ে ভ্রু কুঁচকে খানিকটা বিরক্তিকর সুরে ঈশাকে শুধালেন,
— কিছু বলবে?
হ্যা সূচক মাথায় নাড়ায় ঈশা। জয়া আন্টি পুনরায় নিজের কাজে মনোযোগ দিয়ে বলেন,
—- বলে ফেলো।
কয়েক দফা ঢোক গিলে জিভ দিয়ে শুস্ক অধর ভিজিয়ে, ঈশা বলে ওঠে,
—- আসলে আন্টি মা জরুরি তলব করেছে, কাল একটু বাড়ি যেতে হবে।
—- তোমার বাড়ি যেন কোথায়?
—- জ্বি কক্সবাজার।
জয়া আন্টি বুঝদার দের মতো মাথা দোলালেন, অতঃপর গম্ভীর গলায় বললেন,
— গত একমাসে কতগুলো ছুটি নিলে সে খেয়াল আছে?
তীব্র সংকোচে থমথমে হয়ে গেলো ঈশার মুখ, তবুও গলার মাঝে অনেকটা শক্তি জুগিয়ে বললো,
—- তখন খুব অসুস্থ ছিলাম আন্টি, জ্বর হয়েছিল, আর এখন তো বাড়ি যাবো।
ঈশার কথার পাছে জয়া আন্টি আরও কিছু বলবে তার আগেই ওপাশ থেকে জিসান ছুটে এসে বললো,
—- হ্যা আন্টি আমি জানি, ঈশার জ্বর ছিল।
জিসানের কথায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন জয়া আন্টি। প্রত্যেকবারই কোনো না কোনো ঝামেলা থেকে এই মেয়েটাকে বাঁচানোর জন্য উঠে পরে লাগে জিসান। ব্যাপারটা মোটেই পছন্দ নয় ভদ্রমহিলার, কিন্তু কিছু বলতেও পারেন না তিনি, কারন জিসান ছেলেটা তার অত্যন্ত স্নেহের। জিসানের আকুতি ভরা মুখের দিক থেকে চোখ সরিয়ে জয়া আন্টি থমথমে গলায় বললেন,
—- ঠিকাছে যেতে পারো, তবে জলদি ফিরে এসো।
ঈশা মৃদু হেসে ঘাড়টা সামান্য কাত করে জানায়,
— ঠিকাছে আন্টি।
কথা শেষ করে ঈশা আর জিসান সেখান থেকে প্রস্থান করলে, জিভ দিয়ে আঙুলের ডগা ভিজিয়ে নতুন উদ্যমে টাকা গুনতে আরম্ভ করেন জয়া আন্টি।
ঈশা ভেতরে চলে যায়, জিসান ওর পেছন পেছন যেতে যেতে শুধালো,
— হঠাৎ বাড়িতে কেন যাচ্ছিস?
হাটার গতি থেমে গেলো ঈশার, বাড়িতে কেন যাচ্ছে সেটা তো ও নিজেও জানে না। মা নামক ব্যক্তিটি জরুরি তলব করেছে তাই যাচ্ছে, এর বাইরে তো কিছুই জানা নেই ওর। মায়ের সাথে কথা বাড়িয়ে জানার যে খুব একটা ইচ্ছে রয়েছে তেমনটাও নয়। কারণ ওর মা তো সবার মায়ের মতো মমতাময়ী নয়।
ঈষা অবশ্য মনে করে দোষটা ওর নিজেরই। ওর ভাগ্য খারাপ বলেই তো উপর ওয়ালা ওর কপালে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসার মতন কাউকে জুটিয়ে দেয় নি। যে চোখ বন্ধ করে পুরো দুনিয়া উজাড় করা ভালোবাসা সব ঈশাকেই উগরে দেবে। যে দুনিয়ার জন্য ঈশাকে নয়, বরং ঈশার জন্য দুনিয়া তছনছ করে দেবে। কিন্তু আপসোস জন্মদাত্রী মায়ের কাছ থেকেও নিঃস্বার্থ দুনিয়া উজাড় করা ভালোবাসা পায়নি ঈশা। কারণ ওর দুর্ভাগ্য উপরওয়ালা ওকে একজন স্বার্থপর মা দান করেছেন। ভেতরে ভেতরে মায়ের উপর এক আকাশসম রাগ আর অভিমান পুষে রাখলেও বাইরে সেটা প্রকাশ করার ক্ষমতা কিংবা সাহস কোনোটাই নেই ঈশার। অগত্যাই ওর জীবনে মায়ের কথাই হলো শেষ কথা।
—- কি হলো কিছু বল?
জিসানের প্রশ্নে ধ্যান ভাঙে ঈশার। তবে জিসানকে উত্তর দেওয়ার কোনোরূপ প্রয়োজন বোধ করলো না ও, উল্টো তেজ দেখিয়ে বললো,
—- তোকে কতবার বলেছি আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলাবি না জিসান। নিজের ভালো মন্দ নিজেই খেয়াল রাখতে পারি আমি। আমাকে বাচ্চাদের মতো ট্রিট করা বন্ধ কর।
—- আশ্চর্য রেগে গেলি কেন হঠাৎ?
ঈশানী এ্যাপ্রোন খুলে নিজের টোট ব্যাগটা গুছিয়ে নিতে নিতে বললো,
—- জয়া আন্টির সামনে আমার হয়ে ওকালতি করবি না কখনো আর, তোর এসব অধিকার বোধ আমার বাড়াবাড়ি মনে হয়। আমার মতে বন্ধুদের এতোটাও লিমিট ক্রস করা উচিত নয়।
জিসান ভ্রু কুঁচকে কিছুটা বিরক্তির স্বরে বললো,
— আমি হেল্প না করলে তুইতো ছুটিই পেতি না, তবুও এভাবে বলছিস?
হাতের ঘরিটাতে একঝলক পরখ করে, ব্যাগ সমেত ক্যাফে থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে ঈশা বলে,
— ছুটি না পেলে নাই, কিন্তু আমাকে দূর্বল ভেবে একদম করুনা দেখাতে আসবি না আর।
—- আরে ভাই আমি তোকে করুনা কেন দেখাতে যাবো? আজিব!
—- তাহলে কিসের এতো অধিকার বোধ তোর?
ঈশার করা ঝাঁজালো প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে হুট করে বালুঝড় থেমে যাওয়ার মতোই থেমে গেলো জিসান। সত্যিই তো কিসের এতো অধিকার বোধ ওর? ও আসলে কি চায় এই ইন্ট্রোভার্ট মেয়েটার কাছ থেকে? ঈশার মতো মেয়ের মাঝে নিজের প্রতি ভালোবাসার উষ্ণতা খুঁজে পাওয়া নিছকই স্বপ্ন মাত্র, তাহলে মেয়েটার প্রতি কেনো এতো উতলা জিসান? আদতে কি চায় ও?
গত দশমিনিট ধরে একই যায়গাতে এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে জিসান, আর ঈশা? সে তো সেই কখন বেরিয়ে গিয়েছে ক্যাফে থেকে।
—- কিরে হঠাৎ জামা কাপড় গোছাচ্ছিস যে? কোথাও যাচ্ছিস?
নিঝুমের প্রশ্নে ঘাড় ঘোরালো ঈশা। দেখলো পড়ার টেবিলে বসে বসে মনোযোগ দিয়ে এসাইনমেন্ট করছে নিঝুম। তার ফাঁকেই কথাটা বলেছে মাত্র। “নিঝুম” ঈশার একমাত্র রুমমেট, আর একমাত্র কাছের মানুষ। যার কাছে কোনোদিনও ঈশাকে শক্ত খোলসে মুড়িয়ে থাকতে হয়না। বরং ঈশার কম্ফোর্ট জোন হলো নিঝুম। মেয়েটা বেশ মেধাবী, চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে ইংলিশ বিষয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে সে। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় সারাদিন ভার্সিটি, টিউশন এই নিয়েই জীবন চলে যাচ্ছে তার। তবে হাজার ব্যস্ততার মাঝেও নিজের অন্তর্মুখী বেষ্টফ্রেন্ডের ভালোমন্দ খেয়াল রাখতে কখনোই ভোলে না সে। ঈশা নিঝুমের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বললো,
— খেয়েছিস তুই?
ঈশার কথায় এসাইনমেন্ট থেকে চোখ সরিয়ে ঈশার দিকে তাকিয়ে প্রসস্থ হাসলো নিঝুম, মনেমনে ভাবলো,
— মেয়েটা প্রচন্ড উষ্ণ হৃদয়ের, কিন্তু সবাইকে প্রকাশ করতে পারেনা, কি অদ্ভুত!
অতঃপর মন থেকে বেরিয়ে মুখ ফুটে জবাব দিলো নিঝুম,
—- হ্যা খেয়েছি, কিন্তু কোথায় যাচ্ছিস বললি নাতো?
ঈশা নিজের সিঙ্গেল বেডটাতে পদ্মাসন হয়ে বসে বললো,
— মা তলব করেছে, কাল যেতে হবে।
ঈশার কথা শুনে একপ্রকার ঝটকা খেলো নিঝুম, তরিঘরি করে ঘুরে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন গলায় বলে উঠলো,
— আন্টি ডেকে পাঠিয়েছে তার মানে ভেজাল আছে, আবার হয়তো তোকে ছেলের বাড়ির লোকের সামনে সং সেজে বসতে হবে।
ঈশা মাছি তাড়ানোর মতো করে হাত নাড়িয়ে বললো,
— ধুর চিন্তা নেই, আমার এই অদ্ভুত নীল রঙের চোখের মনি দেখে কেউ আমাকে পছন্দ করবে ভেবেছিস? সবাই বলবে সাপের বাচ্চা।
কথা শেষ করে জোরপূর্বক হাসলো ঈশা। কিন্তু নিঝুম ওর কথার তীব্র প্রতিবাদ করে বললো,
— মোটেই না, তোকে তো এই নীল চোখে একটু বেশিই আকর্ষনীয় দেখায়, কি সুন্দর জ্বলজ্বলে চোখ তোর, পুরাই হলিউড হিরোইন। আমার তো মনে হয় তোর এই নীল চোখের জন্যই সবার আগে জিজু তোর প্রেমে পড়বে।
ঈশা মৃদু হেসে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুতে শুতে নিঝুম কে বললো,
— হয়েছে, আর জ্ঞান দিতে হবে না, আমি ভালো করেই জানি এই চোখ আমার জন্য অভি’শাপ, এই চোখ দেখে নাকি আবার কেউ প্রেমে পরবে, হাস্যকর।
নিঝুম কটমটিয়ে বললো,
— তুই একটু বেশিই জানিস। এই চোখ তোর আশির্বাদ, বলে দিলাম আমি।
ঈশানী টেবিল ল্যাম্পটা নিভিয়ে দিয়ে, চোখ বুজতে বুজতে বললো,
— আশির্বাদ নাকি অভি’শাপ, সেটা কালই বোঝা যাবে। তোকে আপডেট জানাবো, এখন প্লিজ ঘুমাতে দে।