আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২
suraiya rafa

বাংলার বর্ষপঞ্জিকাতে এখন আষাঢ় মাস চলমান, চারিদিকে বর্ষার ঘনঘটা,গ্রামগঞ্জ হাওড় বাওড় সব ডুবে আছে বন্যার পানিতে। সাগরের পানি বানভাসি হয়ে ফুলেফেঁপে থৈ থৈ করছে বেলাভূমি। শহুরে যান্ত্রিক জীবনে বর্ষার প্রভাব খুব একটা চোখে না পরলেও, গ্রাম কিংবা মফস্বল এলাকা গুলোতে মারাত্মক প্রভাব ফেলে সকলের প্রিয় ঋতু বর্ষা।
ঈশানীদের বাড়িটা মফস্বলে, সমুদ্র সৈকত থেকে বেশ অনেকটা কাছে হওয়ায়, বাড়ির পিচ ঢালা সরু রাস্তা আর ঘাস আবৃত ছোট্ট লনেও জল জমে গিয়েছে । চারিদিক কর্দমাক্ত, হয়তো বিকেলের দিকে রোদ উঠলে শুকিয়ে যাবে সব। কিন্তু এই মূহুর্তে সকাল সকাল বাড়িতে ফিরে কাঁদা মাটি পেরিয়ে ঘর অবধি পৌঁছাতে বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে ঈশানীর। কোনো মতে সালোয়ার ধরে সাবধানে পা টেনে টেনে ঘরের দুয়ারে পা রাখতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন ঈশানীর মা রোকেয়া প্রাচী ।

একহাতে সরু লাটি তার, চোখে মুখে ভীষণ রুষ্টতা, দেখেই বোঝা যাচ্ছে ক্ষেপে আছেন তিনি। ভেতরের ঘর থেকে ঈশানীর ছোট বোন ঊষার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে, খানিকক্ষন আগে যে ঊষার উপর দিয়েই এক ভয়াবহ টর্নেডো বয়ে গিয়েছে, তা আর বুঝতে বাকি নেই ঈশানীর।
ঘরের দুয়ারে ঈশানীকে দেখতে পেয়ে, হাতের লাঠিটা কয়েক হাত দূরে ছু’ড়ে মে’রে ওর দিকে দ্রুত কদমে এগিয়ে আসেন রোকেয়া প্রাচী । ঈশানী তখনও সালোয়ারে ছিটে আসা কাঁদামাটি গুলো হাতের সাহায্যে ঝাড়াতে ব্যস্ত, ঠিক সে সময় মেয়ের উদ্দেশ্যে ক্ষুব্ধ আওয়াজে কথা ছোড়েন রোকেয়া,
— এখন আসার সময় হলো?তোকে গত সপ্তাহে বাড়ি আসতে বলিনি?
মায়ের কথার তোড়ে জামা কাপড়ে হাত চালানো বন্ধ হয়ে গেলো ঈশানীর, ও চোখ তুলে মায়ের মমতাহীন চোখে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শান্ত সাবলীল গলায় বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—- জয়া আন্টি আমাকে বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেয়না মা। মাস শেষে যে টাকা টা তোমাকে পাঠাই, তার বিনিময়ে আমাকে ফুল টাইম ডিউটি করতে হয়, যখন তখন চাইলেই তো আর আসতে পারিনা।
রোকেয়া প্রাচী স্বল্প শিক্ষিত মহিলা, তবে ঈশানীর মা হিসেবে বয়স তুলনা মূলক কম। যদিও বা বৃদ্ধ না হতেই সংসারের ভারে বয়সের ছাপ স্পষ্টত হয়ছে তার চেহারার ভাঁজে। গমরঙা রাজহংসীর মতো গায়ের রঙ সেই কবেই হারিয়ে গিয়েছে রোদে পুড়ে যাওয়া তামাটে বর্ণের আড়ালে। তবে ঈশানী যেহেতু তরুণী থেকে সবে সবে যুবতী বয়সে পদার্পন করেছে, তাই এখন রোকেয়া বেগমের বয়সের ভারে হারিয়ে যাওয়া সেই গমরঙা গায়ের রঙটাও সর্বাঙ্গে ধারণ করে বসে আছে ঈশানী। মেয়েটা দিনকে দিন সুন্দরী হচ্ছে,ঢলঢলে পান পাতার মতো কোমল চেহারা থেকে লাবন্যতা আর মিষ্টতা যেন উপচে পরছে তার।

কিন্তু এতো সুন্দরী হয়ে লাভটা কি হলো? সেই তো সকলের আশা আকাঙ্খাতে এক বালতি জল ঢেলে দিয়ে পৃথিবীতে জন্মালো অদ্ভুত দেখতে একজোড়া গাঢ় নীল চোখ নিয়ে। কোনো ব্রিটিশ আমেরিকান হলে তাও মানা যেত, কিন্তু সাধারণ এক বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরে জন্মানো মেয়ের চোখের মনির রঙ যদি এমন গাঢ় নীল হয়, তাহলে মানুষ তো খিল্লী ওড়াবেই। ছোট বেলা থেকেই সাপের বাচ্চা, কালনাগিনী, জিনে ধরা, ভূতে ধরা এসব শুনতে শুনতে বড় হয়ে উঠেছে ঈশানী, শুধু কি তাই? চোখের রঙের জন্য জন্ম পরিচয় নিয়ে পর্যন্ত প্রশ্ন তুলতে দ্বিধা বোধ করেনি মহল্লার মানুষ। আর তুলবেই নাই-বা কেন? ঈশানীর চৌদ্দ গোষ্ঠীতেও এমন অদ্ভুত গাঢ় নীল চোখের দেখা মেলেনি কোথাও। অথচ মাঝখান থেকে মেয়েটার এমন সর্বনাশ হলো।
সর্বনাশ? হ্যা, রোকেয়া প্রাচী তো সেটাই মনে করেন, শুধু মাত্র এই নীল চোখের জন্য ভালো ভালো ঘর থেকে বিয়ের সম্মন্ধ এসেও আবার মুখ ফিরিয়ে চলে যায় তারা। যেন মেয়েটা নিজেই নিজের চোখ দুটোকে ঘষে মেজে নীল বানিয়েছে, সব দোষ ওর। বিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না, পাত্র পক্ষরা দেখতে এসেও এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, তো এটা সর্বনাশ নয়তো আর কি?
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই মুখের আদলে কাঠিন্যতা ভর করলো রোকেয়ার। তিনি মেয়ের পানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,

—- আমাকে কাজ দেখাচ্ছিস? মাস শেষে বাড়িতে দুটো টাকা দিস বলে মায়ের মুখে মুখে এভাবে তর্ক করছিস? এতো বছর ধরে লালন পালন করে এই শিখিয়েছি তোকে আমি?
বাঙালি মায়েদের সেই এক ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল, ঈশানী এগুলো তে অভ্যস্ত, মাতৃত্বের অধিকার খাটিয়ে কি করে কাজ হাসিল করে নিতে হয়, সেটা বেশ ভালো করেই জানে তার মা।ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়, তাই মায়ের হাজারটা অভিযোগ শোনার জন্য, ও আর দাঁড়িয়ে রইলো না সেখানে,বরং মা’কে উপেক্ষা করে পা বাড়ালো নিজের রুমে।
ঈশানী যখন চুপচাপ চলেই যাচ্ছিল, ঠিক তখনই রোকেয়া বেগম পিছু ডেকে বলেন।

— নিজের ঘরে গিয়ে দরজায় খিল দাও আর যা’ই করো, বিকেলে ছেলের বাড়ির লোক আসছে, তখন যাতে আমার একবারও ডাকাডাকি করতে না হয়।
মায়ের কথা শুনে ঈশানী হতাশায় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
—-মা আবারও?
রোকেয়া প্রাচী কপালে তীক্ষ্ণ ভাঁজ টেনে শাসনের স্বরে বলেন,

—- আবারও মানে? বিয়েটা যে হচ্ছে না সে খেয়াল আছে? তাছাড়া আমি খোজ নিয়ে দেখেছি ছেলেটা অত্যন্ত ভদ্র এবং সুদর্শন।আমি যেহেতু বলেছি, তার মানে এখানেই তোর বিয়ে হবে, আর একটাও বাড়তি কথা বলবি না।
মায়ের কথার পাছে ঈশানীর অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করলো, জোর গলায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে হলো,
— প্রত্যেক বার আমাকে এভাবে জোকার কেন সাজাও মা? সেই তো সবাই আমাকে দেখে নানান কথা বলবে, মুখ ফিরিয়ে চলে যাবে। আমার আত্মসম্মান টাকে বারবার এভাবে ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া কি খুব প্রয়োজন?
অথচ মুখ ফুটে ঠোঁট নাড়িয়ে একটা কথাও বললো না ঈশানী। উল্টো অপারগ শুকনো চেহারা নিয়ে আস্তে করে চলে গেলো নিজের রুমে।

পুরনো আমলের ছোট্ট দোতলা বাড়ি ঈশানীদের। বাড়ির ভেতরের দিকটার কাজ সম্পূর্ণ হলেও, বাইরের গাদানো ইটের সারি দিয়ে তৈরি করা দেওয়ালে বালু সিমেন্টের আস্তর পরেনি আজ অবধি,যার দরুন অযত্নে থেকে থেকে অসম্পূর্ণ রয়ে যাওয়া ইট কাঠের দেওয়ালে দীর্ঘ দিনের শ্যাওলা জমে একেবারে ভুতুড়ে বাড়িতে পরিনত হয়েছে পুরোনো আমলের এই দোতলা বাড়িটি।
ঈশানীর বাবা নেই, বহু আগেই ইহকাল ত্যাগ করেছেন তিনি। বাড়িতে রোকেয়া বেগম, ছোট বোন ঊষা আর ঈশানীর বৃদ্ধা নানী ই বসবাস করেন। আয়ের উৎস বলতে বাবার রেখে যাওয়া ছোট অংকের পেনশন, আর ঈশানীর রোজগার, এছাড়া মামা মামীরা সবসময় খোঁজ খবর রাখেন বলে বাড়তি কোনো পুরুষের প্রয়োজন হয় না ওদের।

ছোট্ট সংসার, খেয়ে পড়ে বেশ ভালোই দিন চলে যায়, অযথা দুঃখের হাতছানি নেই বললেই চলে।অথচ ঈশানীর হৃদয় মন জুড়ে অভিমানের পাহাড়, দুঃখ রা যেন ওর চিরকালের সঙ্গী। ছোট বেলা থেকে মানসিক য’ন্ত্রনা সয়ে সয়ে অভস্ত্য ঈশানী,যার ফলস্বরূপ এখন চাইলেও আর খুশি থাকাটা ভেতর থেকে আসে না, কেন যেন ঠোঁট হাসলেও হৃদয়টা হাসে না আর।
ঈশানীর সবচেয়ে বেশি অভিমান মায়ের প্রতি। সেই অভিমানের অবশ্য যথেষ্ট কারন রয়েছে,ঈশানীর মতে ওর মা ওকে ভালোবাসে না, কোনোদিন বাসেও নি। ভালোবাসলে কি আর ছোট্ট ঈশানীকে একা ফেলে ওভাবে চলে যেতে পারতো?
ভাবনার এই পর্যায়ে এসে নিজেকে সংবরণ করলো ঈশানী, মনে মনে ভাবলো থাক সেসব কথা। এখন ফ্রেশ হয়ে একটু ঘুমানো দরকার, সকাল সকাল জার্নি করে বড্ড ক্লান্ত শরীর টা।

সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়েছে অথচ এখনো রুম থেকে বের হয়নি ঈশানী। ওদিকে ভাত খাওয়ার সময় হয়ে গেলো। ঈশানীর নানী লাঠি ভর করে ডাইনিং এ এসে ঊষাকে শুধালেন,
— মাইয়াটা আজকাও আসে নাই?
ঊষা খাবারের লোকমা মুখে তুলতে তুলতে বললো,
—- এসেছে নানী, আপু রুমেই আছে।
ঊষার কথায় বৃদ্ধা বোধ হয় সন্তুষ্ট হলেন, তিনিও খুব করে চাইছেন এই সুন্দরী যুবতী নাতনিকে বিয়ে দিয়ে তার মেয়েটার কাঁধ হালকা করতে। কিন্তু বিধিবাম, এতো সুন্দরী হওয়া সত্বেও পাত্রপক্ষের মন কাড়তে সক্ষম হয়নি তার নাতনি।
ঈশানীর নানীর অবশ্য উপর ওয়ালায় খুব ভক্তি, তিনি বিশ্বাস করেন, উপর ওয়ালা যার সাথে তার নাতনির ভাগ্য বেধে দিয়েছেন, সে হয়তো এখনো এসে পৌঁছায় নি, ওই জন্যই বিয়েটা হচ্ছে না। যখন সে চলে আসবে, তখন উপরওয়ালার ইচ্ছায়, বিয়েটাও পূর্বাভাস বিহীন ঝড়ের মতোই সম্পন্ন হয়ে যাবে। কেউ আটকাতে পারবে না কেউ না।

— ও বুড়ি কি ভাবছো?
ঊষার কথায় ধ্যান ভাঙে নানীর। তিনি বুঝে পাননা এইটুকুনি দের ইঞ্চি মেয়ের কথাবার্তার ছিঁড়ি এতো খারাপ কেন?কই ঈশানী তো এমন না। নিশ্চয়ই বাপের গোষ্ঠীর মতো হয়েছে মেয়েটা, একেবারে ধেরে বজ্জাত।
ঊষা খাচ্ছে আর নানীর কুঁচকে যাওয়া গম্ভীর চোখমুখের দিকে তাকিয়ে কুটকুটিয়ে হাসছে, দেখে মনে হচ্ছে নানীকে ক্ষেপিয়ে বেশ আনন্দই পেয়েছে সে।
— বজ্জাত ছেমরি, দাঁতাল গো লাহান না হাইঁসা খাওন খা, আমার লগে মস্কারা করতে আইলে লাঠি দিয়া ঠ্যাং ভাইঙা দিমু ।
ছোট্ট নাতনিকে একরাশ বকাঝকা দিয়ে তেলে বেগুনে জ্বলতে জ্বলতে ডাইনিং ত্যাগ করেন ঈশানীর নানী। উদ্দেশ্য বড় নাতনি টাকে খেতে ডাকা।
ওদিকে খাবার চিবুতে চিবুতে ভেঙচি কেটে ঊষা বলে,
—- বুড়ির তেজ কমেনি এখনো, কথা তো না, যেন মুখ থেকে বের হওয়া আগুনের বারুদ।

—- ঈশু, আরে ওই ঈশু, খাওন খাইতি না? দুপুর তো যাইতাছে গা, আরেকটু পরে পোলার বাড়ির লোক আইয়া পরবো তো।
নানীর চেঁচামেচির তোপে পরে ঘুমটা আর গাঢ় হলোনা ঈশানীর, অগত্যা করনীয় কিছু না পেয়ে তাড়াহুড়ো পায়ে এগিয়ে এসে দরজা খোলে সে।
ওকে দেখতে পেয়ে নানী ঘাড় ঘুরিয়ে ধীরে পায়ে পিছু হাঁটতে হাঁটতে বললেন,
— আয় আয় খাইতে আয়।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গায়ে ওড়না চড়িয়ে, নানীর পেছন পেছন ই বেরিয়ে এলো ঈশানী। খাবার টেবিলে এসে বসতেই চোখ গেলো ছোট্ট বোন ঊষার দিকে। যদিও বা ঊষা ঈশানীর আপন বোন নয়, তবে যেহেতু সহোদরা, তাই ঈষানী ওকে আপন বোনের মতোই স্নেহ করে,অধিকার খাটিয়ে শাসন ও করে অনেক সময়। ঊষার ক্ষেত্রে ও তাই, বড় আপুকে সে ভীষণ ভালোবাসে, আপুর চুপচাপ স্বভাবের কারনে একটু একটু ভয় ও পায় অবশ্য ।
তবে ওরা একই পিতার সন্তান নয়, সেটা ওদের মাঝের আন্তরিকতার জোয়ারে বহু আগেই চাপা পড়ে গিয়েছে। নিজের প্লেটে খাবার নিতে নিতে ঊষার দিকে তাকিয়ে গভীর গলায় ঈশানী শুধালো,

— তোর না ক্লাস টেস্টের রেজাল্ট বেরিয়েছে? পাস করেছিস তো?
বড় আপুর কথায় জবাব দেয় না ঊষা, চুপচাপ মুখ কাঁচুমাচু করে বসে রয় মাথা নুয়িয়ে।
ওপাশ থেকে তিরস্কার করে নানী বলে ওঠে,
— ফেল করছে তোমার বোইনে।
নানীর কথা শুনে ঈশানী অবাক হয় না, প্রত্যুত্তর করে হ্যা বা না কিছু বলেও না, এইটুকু মেয়ে ক্লাস টেস্টে ফেইল করেছে এটা নিশ্চয়ই কোনো বড় অ’পরাধ নয়। ঠিক মতো গাইড করলে নিশ্চয়ই পরের বার ভালো করবে।
তবে ঈশানীর ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে রোকেয়া প্রাচী বলে ওঠেন,
— বড় টার একটা ব্যাবস্থা করি, তারপর এটাকেও ধরবো।
মা কিসের ইঙ্গিত দিয়েছেন ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই, তৎক্ষনাৎ প্রতিবাদ করে ওঠে ঈশানী,
—- কিসব বলছো মা তুমি? ঊষার বয়স মাত্র এগারো বছর।
গলার আওয়াজ ক্ষীণ অথচ কথার পারদে প্রতিবাদী ঝঙ্কার।
মেয়ের কথা কানে তুললেন না রোকেয়া , খাবার খেতে খেতে তিনি বললেন,

—- ঊষার কথা তোর না ভাবলেও চলবে, নিজের একটা ব্যাবস্থা হয় কিনা সেটা নিয়ে ভাব।
যদিও বা ঈশানী জানেনা বিয়ে হওয়ার সঙ্গে ব্যাবস্থা হওয়ার সম্পর্কটা ঠিক কোথায়? রিজিকের মালিক তো উপর ওয়ালা, তাহলে ওকে কেন বোঝা মনে করা হচ্ছে এই পরিবারে? প্রত্যেকটা মধ্যবিত্ত পরিবারেই কি এটা হয়ে থাকে? জানা নেই ঈশানীর।

তবে ওর সাথে শুরু থেকেই এটা হয়ে এসেছে, ইন্টারমিডিয়েট পাশ দেওয়ার পরে ভার্সিটিতে আর পড়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি ঈশানীর, কারণ তখন থেকেই পড়াশোনা বন্ধ করে ঈশানীকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পরে লেগেছিল রোকেয়া প্রাচী । তারপর যখন অনেক চেষ্টা করেও মেয়ের বিয়েটা হচ্ছিল না, তখন মহল্লার মানুষের কথা থেকে বাঁচতে নিজ উদ্যেগে ঈশানীকে কাজের সন্ধানে চিটাগংও তিনিই পাঠান। জয়া আন্টির ক্যাফেতে ঈশানীর চাকরিটা মায়ের সুপারিশেই হয়েছিল, কারণ জয়া আন্টি ছিলেন রোকেয়ার পূর্ব পরিচিত।
এই যে মায়ের কথামতো পড়াশোনা বাদ দিতে হয়েছে, তার হাতের পুতুল হয়ে জীবন পার করতে হচ্ছে, তাতে কি ঈশানীর একটুও আপসোস হয়না? হয়তো, খুব আপসোস হয়,ঈশানীর ও তো নিঝুমের মতো পড়াশোনা করতে ইচ্ছে করে, নিঝুম ও তো মধ্যবিত্ত পরিবারেরই মেয়ে, কই ওকে তো কেউ পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য জোরজবরদস্তি করেনা। ওকে তো ক’দিন বাদে বাদে পাত্র পক্ষের সামনে নিজেকে জাহির করার জন্য বাড়ি ফিরতে হয়না।

অথচ ঈশানীকে এমন অনেক কাজ করতে হয়, যা ওর ইচ্ছের একেবারে পরিপন্থী। ফেমিনিস্টদের ভাষায় এটাকে ট’র্চার বললে ভুল হবেনা অবশ্য। অথচ ঈশানী মেয়েটা ফেমিনিস্টদের মতো প্রতিবাদ করেনা, প্রতিবাদ যে কি করে করতে হয় সেটাই ভুলে গিয়েছে হয়তো, কারণ ছোট বেলা থেকে ওকে কড়া শাসনে রেখে এভাবেই তৈরি করা হয়েছে, তোতাপাখির মতো একটাই বুলি গেলানো হয়েছে,যে,
“এই পরিবারে মায়ের কথাই শেষ কথা।”
একই রুমের মধ্যে বসবাস করেও নিঝুম আর ঈশানীর গল্পটা ঠিক কতটা আলাদা,কতটা বিপরীত। সেই ভেবেই ভাত সাজানো প্লেটের দিকে তাকিয়ে মনেমনে নিজেকেই নিজে তাচ্ছিল্য করে কিছুক্ষন হাসলো ঈশানী।

বর্ষাকালে যেখানে সূর্যই ওঠেটা ঠিক মতো, যেখানে সূর্যাস্ত তো বিলাসিতা মাত্র। তবুও দুপুর বেলার সেই ফকফকে উজ্জ্বলতা হারিয়ে গিয়ে কিছুটা কালো হয়ে এসেছে ধরনী। বোধ হয় সন্ধ্যা গড়িয়ে এলে বৃষ্টি হবে আবারও। এই কালো গোধূলির মাঝেই পাত্র পক্ষের বাড়ি থেকে লোক এসেছে ঈশানীকে দেখতে। অনেক বেশি লোকজন নয়, হাতে গোনা কয়েকজনই এসেছেন, তারমধ্যে ছেলের মা ও রয়েছেন।
আলাপচারিতা আর কুশল বিনিময়ের পর্ব শেষ হলে
রোকেয়া প্রাচী নিজেই সাথে করে নিয়ে আসেন ঈশানীকে। আলাদা কোনো সাজসজ্জা নেই ওর মাঝে, শাড়িটা অবধি পড়েনি। ভিন্নতা যদি লক্ষ করতে হয়, তাহলে মাথায় একফালি ঘোমটা টেনেছে শুধু।
মেয়েকে নিয়ে এসে সবার সামনে বসিয়ে দিয়ে, ছেলের মায়ের দিকে তাকিয়ে রোকেয়া প্রাচী কিছুটা ইতস্তত গলায় শুধালেন,

— সেকি আপা, মাহিন আসেনি?
মায়ের এটুকু কথাতেই ঈশানী বুঝলো, যার জন্য ওকে দেখতে আসা হয়েছে তার নাম মাহিন। আচ্ছা শুধুই কি মাহিন? আগে পরে কিছু নেই?নিজের অজান্তেই এই অদ্ভুত প্রশ্নটা খেলে গেলো ঈশানীর মস্তিষ্কে।
ওর এই অগভীর ভাবনার সুতো ছিঁড়লো মাহিনের মায়ের কথায়, তিনি মৃদু হেসে রোকেয়া প্রাচীকে আস্বস্ত করে বললেন,

—- মাহিন একটু জরুরি কাজে ঢাকায় গিয়েছে আপা, তাই এখানে আসতে পারেনি, তবে আমরা ওর পুরোপুরি সম্মতি নিয়েই এখানে এসেছি।
যদিও মাহিনের মামুনির কথাগুলো খানিকটা গলায় আটকে আসছিল, তবুও তার কথায় ধাতস্থ হলেন রোকেয়া প্রাচী । হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
—- বুঝতে পেরেছি আপা।
মাহিনের মামুনি এবার ঈশানীকে ডেকে উঠলেন,
—-ঈশানী, আমাদের দিকে একটু তাকাও মা।
কোনোরূপ কপটতা অবলম্বন না করেই আস্তে করে তাকালো ঈশানী, সঙ্গে সঙ্গে পাশ থেকে ভূত দেখার মতোই আঁতকে উঠলেন মাহিনের ফুপি। তিনি বিচলিত কন্ঠে বললেন,

—- একি তোমার চোখের মনি এমন নীল কেন? কি লাগিয়েছো চোখে? আ…
ভদ্রমহিলা আরও কিছু বলার আগেই, তার কথা মাঝপথে আটকে দিয়ে মাহিনের মা কিঞ্চিৎ ধমকে উঠলেন তাকে,
— আহ! চুপ করবে তুমি?
অতঃপর ঈশানীর দিকে দৃষ্টিপাত করে মিষ্টি হেসে তিনি বলেন,
— তুমি খুব সুন্দর ঈশানী মা, তোমার চোখ দুটোও অসম্ভব সুন্দর। আমি মুগ্ধ হয়েছি তোমার চোখের সৌন্দর্য দেখে। সত্যিই উপরওয়ালার সৃষ্টি অতুলনীয়। আর আমি এও জানি, আমার মাহিন তোমার এই চোখ দুটো দেখে আমার মতোই মুগ্ধ হবে।
জীবনে প্রথমবার, ফর দ্য ফার্স্ট টাইম, ঈশানী নিজের ভেতরে নিজেকে নিয়ে এক সুপ্ত আত্মবিশ্বাস অনুভব করলো,হুট করেই সকল জরতা ঝরঝরিয়ে পরে গিয়ে মনের মাঝে এক অযাচিত প্রশ্ন উঁকি দিলো ওর,
— সত্যিই আমার চোখ দেখে কেউ মুগ্ধ হবে? আমার প্রেমে পরে যাবে? তাহলে কি নিঝুমই ঠিক বলেছিল? এই নীল চোখ আমার জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ?

এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না ঈশানীর ভঙ্গুর হৃদয়। ছোট বেলা থেকে আত্মবিশ্বাস ভেঙে যেতে যেতে এখন এরকম প্রশংসা কিংবা কারোও উপদেশ পেলে সেটাকে নিছকই করুনা মনে হয় ঈশানীর। কিন্তু সামনে যে মাহিনের মা নামক ভদ্রমহিলা বসে আছেন, তিনি তো আর করুনা দেখানোর মতো কেউ নন। তাহলে কি উনি সত্যিই কথাই বলেছেন?
ঈশানীর মন গহীনে দানাবাঁধা হাজারটা অযাচিত প্রশ্নের একত্রে উত্তর দেওয়ার মতোই নিজের ব্যাগ থেকে সোনার চেইন বের করে ওর গলায় পরিয়ে দিলেন মাহিনের মা। পরমূহুর্তেই রোকেয়া প্রাচীর দিকে তাকিয়ে সম্মোহনী হাসি দিয়ে তিনি বলেন,

—- আপনার মেয়েকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে আপা, তাই আমানত করে রেখে গেলাম।
জবাবে মাহিনের মাকে একগাল হাসি উপহার দিয়ে, জলদি চোখের ইশারায় ঈশানীকে পায়ে হাত দিয়ে সম্মান করার নির্দেশ দিলেন রোকেয়া প্রাচী ।ঈশানী মায়ের কথামতো শুকনো মুখে তাই করলো একে একে সকলকে। আর এভাবেই ক্ষনিকের মধ্যে একজন অচেনা, অদেখা পুরুষের বাগদত্তায় রূপান্তরিত হলো ঈশানী।
অবশেষে রাতের বেলা খাওয়া দাওয়া করে, এই সপ্তাহের শেষের দিকে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে ঈশানীদের বাড়ি থেকে বিদায় নিয়েছিল মাহিনের পরিবার।

সেবার জয়া আন্টির ঝাড়ি আর ফোন কলের অত্যাচারে, বাগদানের পরের দিনই তাড়াহুড়ো করে চিটাগং ফিরে এসেছিল ঈশানী। ফেরার আগে মাকে কথা দিয়ে এসেছে, যে করেই হোক বিয়ের আগের দিন যথা সময়ে বাড়ি পৌঁছাবে সে।
এদিকে পতেঙ্গা ফিরতেই জয়া আন্টির সেকি রাগ, সপ্তাহ বাদে আবার বাড়িতে যাবে শুনে তো ঈশানীকে তক্ষনি কাজ থেকে বের করে দেয়, পরে অবশ্য জিসান বুঝিয়ে শুনিয়ে ঠান্ডা করেছিল জয়া আন্টিকে। বলেছিল,
—- আমি কথা বলবো ঈশানীর সঙ্গে তুমি রাগ করোনা আন্টি।

জিসানের কথায় আস্বস্ত হয়ে তখনকার মতো নিজেকে সংবরণ করেছিলেন জয়া আন্টি।
ওদিকে জিসান যখন আগ বাড়িয়ে ঈশানীর কাছে জানতে যায়, দু’দিন আগেই ফিরলো এখন আবার সপ্তাহ শেষে কেন বাড়িতে যেতে হবে? সে প্রশ্নের কোনোরূপ জবাব দেয় নি ঈশানী। বরং এরিয়ে গিয়েছে কৌশলে। অতঃপর জিসান যখন পার্ট টাইম শেষে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে গিয়েছে, তখন ঈশানী নিজে গিয়ে জয়া আন্টিকে অনুরোধের স্বরে বলেছে যে, আগামী একসপ্তাহ ও ওভার টাইম করতে চায়, রাত দশটার যায়গায় বারোটা হলেও সমস্যা নেই, ও পারবে। কিন্তু তার বিনিময়ে কোনোরূপ কৈফিয়ত ছাড়াই ছুটি চায় ঈশানী।

জয়া আন্টি ব্যবসায়ী মানুষ। কি করলে সবচেয়ে বেশি লাভ হবে সেই দিক বিবেচনা করেই সবসময় সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ঈশানীর ক্ষেত্রে ও তাই করলেন। যেহেতু যায়গাটা টুরিস্ট এরিয়া, তাই এখানে রাতের বেলাতেও কাস্টমারের অভাব নেই কোনো। ঈশানীকে খাঁটিয়ে যদি কিছু বাড়তি ইনকাম করা যায় তাহলে ক্ষতিটা কোথায়?মনেমনে দারুন এক মতলব এঁটে, খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে জয়া আন্টির মন মস্তিষ্ক।
তবে ভেতরের মাত্রাতিরিক্ত খুশিকে দমিয়ে , চোখে মুখে কৃত্রিম গাম্ভীর্য ধরে রেখে সহসাই উত্তর দিলেন তিনি, বললেন,
— ঠিকাছে তাই হবে, আগামী একসপ্তাহ তুমি রাত বারোটা পর্যন্ত ওভার টাইম করবে, বিনিময়ে পরের একসপ্তাহ বিনা কৈফিয়তে তোমার ছুটি।

অবশেষে জয়া আন্টির শর্ত পূরন করতে গত পাঁচ দিন যাবত একটানা নয়টা টু বারোটা ক্যাফেতে ডিউটি করছে ঈশানী। গত পাঁচ দিনে দু’দিন মাত্র বাসায় ফিরতে পেরেছিল ও। বাকি তিন দিন গাড়ি না পেয়ে ক্যাফেতেই রাত কাটিয়ে দিয়েছে।
রাত জেগে কাস্টমার দের জন্য কফি বানানো আবার সার্ভ করা, গত এক সপ্তাহ ধরে একা হাতে কাজগুলো করতে করতে হাঁপিয়ে উঠছে মেয়েটা, তবে হাল ছাড়েনি। জিসান জানলে অবশ্য ঠিকই কোনো না কোনো ছুতোয় ঈশানীকে সাহায্য করার জন্য থেকে যেত ক্যাফেতে, কিন্তু ঈশানী সেই পথটাই খোলা রাখেনি। জয়া আন্টিকে অনুরোধ করে বলে দিয়েছে যাতে কিছুতেই ওভার টাইমের ব্যাপারটা না জানে জিসান । কারন আর যা’ই হোক, নিজের প্রয়োজনে অন্যকে খাটানোর মতো মানসিকতা কিংবা ইচ্ছে কোনোটাই নেই ঈশানীর।

রাত সারে বারোটা নাগাদ ক্যাফের দরজা জানালা গুলো ভালো মতো লক করে আজ পঞ্চম দিনের মতো নিজের ওভার টাইম ডিউটির ইতি টেনেছে ঈশানী। বাকি আছে শুধু একদিন, কাল জয়া আন্টিকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাত নয়টার মধ্যে বেরিয়ে, বাস কিংবা ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরতে পারলেই হলো। ব্যাস সকল ঝামেলার অবসান।
নিজের জড়ো হওয়া ভাবনায় নিজেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো ঈশানী ,অতঃপর গ্লাসের এপাশ থেকে আরও একবার সুক্ষ দৃষ্টিতে ক্যাফের ভেতরটা পরখ করে নিলো ও।
ঠিক এমন সময়, হুট করে, একদম হুট করেই, নিজের একহাত চেপে ধরে ক্যাফের সামনে কাচের দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঠাস করে বসে পরলো একটা লোক।

পুরো ফুটপাত তখন নিস্তব্ধতায় ছেঁয়ে আছে, চারপাশে মানুষের পদচারণার আওয়াজ পর্যন্ত নেই। অদূরে ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকছে শুধু , সেই সাথে কিছু পরার বিকট শব্দও হচ্ছে। কিন্তু কিসের শব্দ হচ্ছে তা আর কান পেতে শোনার মতো অবস্থায় নেই ঈশানী। কারন একটু আগের ঘটে যাওয়া আকস্মিক ঘটনায় এখনো থরথর করে কাপছে ওর তনু শরীরটা। হুট করে এমন একটা সময়ে, এভাবে একটা অচেনা লোকের আবির্ভাব ঈশানীর কলিজা কাঁপিয়ে দিয়েছে। চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণ ভয় পেয়েছে মেয়েটা, তবুও
ভেতরে অনেকটা সাহস সঞ্চার করে কাঁপতে কাঁপতেই শুষ্ক একটা ঢোক গিলে লোকটার পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ঈশানী।

দেখলো, কালো হুডি, কালো ব্যাগি প্যান্ট, কালো মাস্ক,আর কালো ক্যাপ, মোট কথা আগাগোড়া কালো দিয়ে মোড়ানো একটা লোক। এতো রাতে এমন একটা লোককে এভাবে হুট করে ক্যাফের সামনে বসে পরতে দেখে, যে কেউ ভয়ে আঁতকে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। লোকটা নিজের বাম হাত দিয়ে ডান হাতটা চেপে ধরে মাথা নুইয়ে বসে আছে তখন থেকে।
রাস্তায় মূর্তিমান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যামপোস্টের আলোয় ঈশানী আরেকটু ভালো করে লক্ষ্য করতেই বুঝলো, লোকটার ডান হাত থেকে অনর্গল র’ক্ত ঝড়ে পরছে। তা দেখে আ’তঙ্কে আপনা আপনি মুখের উপর হাত চলে গেলো ঈশানীর, নিজের অজান্তেই মুখ ফুটে ঈশানী বলে উঠলো,

—- কে আপনি?কি হয়েছে?আপনার হাত দিয়ে তো পানির মতো তাজা র’ক্ত গড়িয়ে পরছে।
ঈশানীর মুখ থেকে বাক্য কটা বের হতেই আচমকা ঘাড় ঘুরিয়ে ওর নীলাম্বর চোখের দিকে দৃষ্টিপাত করলো লোকটা। রাতের বেলা মাস্ক পড়িহিত লোকটার হঠাৎ চাহনিতে ভয়ে অন্তর্আত্না সব কেঁপে উঠল ঈশানীর। কলিজাটা যেন খামচে ধরলো ভ’য়ানক কোনো নরপিশাচ। লোকটা পলক ফেলছে না, শুধু একধ্যানে তাকিয়ে আছে ঈশানীর পানে, মৃ’ত মানুষের মতোই নির্জীব সেই দৃষ্টি।
এহেন অবস্থায় একটু দূরে সরে গেলো ঈশানী, অতঃপর প্রথমে এক’কদম দু’কদম পা ফেলে, এরপর তাড়াহুড়ো করে একছুটে দৃশ্যপটের আড়াল হয়ে গেলো মেয়েটা।
ঈশানী কিছু না বলে এভাবে হুট করে ছুটে চলে গেলে,কালো মাস্কের আড়াল থেকেই রাশভারি আওয়াজে দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড়ালো লোকটা,

— ফা’কিং ব্রাউন পিপল।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, রাত থেকে দিন পাল্টে যাবার মতোই, ক্লাইমেক্স পাল্টে যায় কিছুক্ষণ পরেই। কারও ছুটে আসার আওয়াজে কিঞ্চিৎ মাথা তুলতেই লোকটা দেখতে পেলো, একটু আগের সেই মেয়েটা আবার ফিরে এসেছে তার নিকট।
প্রথমে ভয় পেয়ে পালালো, এখন আবার ছুটে এলো, কি অদ্ভুত!
ঈশানী ছুটে এসে লোকটার মুখোমুখি হয়ে বসে, হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,

— কোথাও কোনো ফার্মেসী খোলা পেলাম না,তাই গজ কিনতে পারিনি।
এরপর নিজের গলায় প্যাঁচানো হাফসিল্কের ওড়নাটা তাড়াহুড়ো করে খুলে, একটু ইতস্তত ভাবেই সেটা দিয়ে লোকটার ডান হাতটা বেধে দিতে দিতে বললো,
— আপাতত এটা পেঁচিয়ে রাখুন, র’ক্ত পড়া কমে যাবে আশা করি, তারপর কাল সকালে ডাক্তারকে দেখিয়ে মেডিসিন খেয়ে নেবেন, কেমন? এখন আমি আসছি।
একনাগাড়ে কথাগুলো শেষ করে তাড়াহুড়ো পায়ে যায়গা ত্যাগ করে ঈশানী।
ওদিকে আহত লোকটা এখনো অনুভূতিহীন শূন্য চোখে একধ্যানে চেয়ে আছে ঈশানীর যাওয়ার পানে।
এদিকে দ্রুত কদমে বাসায় ফেরার পায়তাড়া করছে ঈশানী, এখন ভালোয় ভালোয় একটা সিএনজি পেয়ে গেলেই হলো। এমনিতেই অদ্ভুত লোকটার পাল্লায় পড়ে কত দেড়ি হয়ে গেলো, সেই ভেবে আরও দ্রুত পা চালাতে শুরু করে ঈশানী।
ঠিক সেই সময়ে, কোথা থেকে যেন ছুটে এসে, ওর রাস্তা মারিয়ে দৌড়ে চলে যায় একটা কালো কুচকুচে নেউটে বিড়াল।

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ১

আচমকা ঘটনায় আরও একবার ঝটকা খেলো ঈশানী, বারংবার এমন ভ’য় পেয়ে পেয়ে মেয়েটার মাথা ঘুরে উঠছে, আজ হচ্ছেটা কি ওর সাথে? এই মাঝরাতে নির্জন রাস্তায় দাড়িয়ে হুট করেই মনটা কেমন কু গাইতে শুরু করে ঈশানীর। কোনো কালেই কু’সংস্কার, কু’প্রথা বিশ্বাস না করা মেয়েটা, আজ হঠাৎ মনে মনেই বলতে শুরু করে,
— নানী বলতো কালো বিড়াল রাস্তা কাটা একদম ভালো নয়। বিপদের লক্ষন। তার মানে কি আমার সাথেও ভবিষ্যতে খারাপ কিছু হতে চলেছে?

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩