আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ১৪

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ১৪
suraiya rafa

চেতনা ফিরে এলে ধীরে ধীরে চোখ খুলে তমশাচ্ছন্ন সরু এক বেজমেন্টের মেঝেতে নিজের আবিষ্কার করে ঈশানী। ওর চোখের দৃষ্টি এখনো ঘোলাটে, মাথাটা ভীষণ ব্যথায় টনটন করছে যেন। তখন ধাক্কা লেগে ব্যথা পাওয়ার দরুন নাকের ডগা র’ক্তিম হয়ে ফুলে আছে। বেজমেন্টের ময়লা মেঝেতে পরে পাতলা ফিনফিনে সাদা ফ্রকটায় ধুলোবালি লেগে একাকার।
নিজেকে এহেন নাজেহাল অবস্থায় এই ভূতুরে বেজমেন্টে আবিষ্কার করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ঈশানী। চোখের দৃশ্যপট খানিক স্পষ্ট হতেই ভাবতে শুরু করে তখন কি হয়েছিল ওর সাথে ?
খানিকক্ষন চোখ বন্ধ করে টাউন সেন্টারে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো আরও একবার মস্তিষ্কে পুনরাবৃত্তি ঘটাতেই অকস্মাৎ আঁতকে উঠে চোখ খুলে ফেলে ঈশানী, শুষ্ক ঢোক গিলে কাঁপা জর্জরিত কন্ঠে বিড়বিড়ায়,

— এএরীশ, এরীশ ছিল ওটা, কিন্তু তারপর?
তারপর যে কি হয়েছিল সেসব কিছুই মনে নেই ওর। তবে এখন এই মূহুর্তে তিমিরে ঢাকা নিস্তব্ধ এই কালো ঘুটঘুটে বেজমেন্টে নিজেকে আবিষ্কার করে ঈশানী এতোটুকু ঠিকই আন্দাজ করতে পেরেছে যে মাফিয়াদের পাপের দুনিয়া থেকে ওর মুক্তি মেলেনি, আর এটাও নিশ্চিত মুক্তি যেহেতু মেলেনি সেহেতু ওর কপালে বেজায় দুঃখ রয়েছে।
এবার আর এরীশ কিছুতেই ছেড়ে দেবে না ওকে, ঈশানী জানে এরীশ একটা অত্যাচারী, ওকে নিশ্চয়ই আরও কঠিন কোনো শাস্তি দেবে সে। যদি আবারও পালানোর স্পর্ধা দেখানোর অপরাধে ওই নোংরা অপবিত্র জায়গাটাতে পাঠিয়ে দিতে উদ্যত হয়, তখন কি হবে? কি করেই বা নিজেকে রক্ষা করবে ঈশানী?
— নাহহহহ!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বিষন্ন মনের অন্ধকার ভাবনা থেকে আচানক ছিটকে বেড়িয়ে এলো ঈশা। সেই সাথে নিজের অজান্তেই ভেতর থেকে উগড়ে দিলো ব্যথাতুর এক আত্মচিৎকার। শুনশান নিস্তব্ধ এই অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজের তীক্ষ্ণ গলার আওয়াজে নিজেই কেমন শিউড়ে উঠলো ও।
এতোক্ষণ ধরে মনের অযাচিত ভাবনায় বুদ হয়ে থাকলেও, ধীরে ধীরে চারিদিকের পরিবেশ অবলোকন করে কেমন গাঁ হাত পা ছমছম করতে শুরু করেছে ঈশানীর। এক পর্যায়ে উপায়ন্তর না পেয়ে মস্তিষ্কের ভয় আর শরীর মনের তীব্র ব্যথায় জর্জরিত হয়ে বদ্ধ ঘরের এককোণে জড়োসড়ো হয়ে হাত পা গুটিয়ে বসে, দু’হাটুতে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে উপর ওয়ালাকে ডাকে ঈশানী। অতিব সুন্দর দেখতে নীলচে মণির সেই অক্ষিজুগল ভিজে ওঠে তার অশ্রুশিক্ত নোনাজলে।
কাঁদতে কাঁদতেই মেয়েটা আহত কন্ঠে বিড়বিড়ায়,

— এ আমি কোথায় এসে ফেঁসে গেলাম? কেন ই বা আমাকে সবসময় নিজের বোকামির মাশুল এভাবে চোকাতে হয় ? এরীশের মতো মানুষ কে না জেনে ভালোবাসা কি এতোটাই অন্যায় ছিল? যে সেই অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করতে গিয়ে গোটা জীবনটাই বিসর্জন দিতে হলো আমার? তারমানে তো মুক্তি নয় এই বন্দী জীবনে আটকে থাকতে থাকতেই মৃ’ত্যু হবে এই দেহের। কখনোই বোধ হয় আর পালাতে পারবোনা আমি?
আপন মনের ভাবনায় বুক ভেঙে ডুকরে কেঁদে ওঠে ঈশানী। বদ্ধ ঘরে একটা ফোটা জলের টুপটাপ আওয়াজ পর্যন্ত নেই, অথচ পুরো বেজমেন্ট জুড়েই ক্ষণে ক্ষণে প্রতিধ্বনির ঝঙ্কার তুলছে সরলতার বোবা কান্নার ব্যথাতুর আওয়াজ। চারিদিক নিস্তব্ধ বলেই ঈশানীর মৃদু কান্নার আওয়াজ সোজা গিয়ে আঁচড়ে পরছে কংক্রিটের ভারী দেওয়ালে। যদিওবা তাতে কোনোরূপ হেলদোল
নেই মেয়েটার।

দিন কি রাত, সকাল না কি বিকেল আঁধারে ঢাকা বেজমেন্টে সেটুকু সময়ের তারতম্যটাও বুঝে ওঠা দ্বায়। সামনের দিকে কয়েক হাত ব্যতিরেখে বাকি পুরো দুনিয়াটাই যেন ছেঁয়ে আছে ঘুটঘুটে অন্ধকারে। অথচ এসবে বিন্দুমাত্র আগ্রহ না দেখিয়ে এরীশের কাছ থেকে পাওয়া অজানা কোনো কঠোর শা’স্তির ভয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা হাঁটুতে মুখ গুঁজে কেঁদে ভাসাচ্ছে ঈশানী।

এভাবেই ঠিক কতক্ষণ সময় অতিবাহিত হয়ে যায় জানা নেই ওর। তবে এসবের এক পর্যায়ে হুট করেই একফালি উষ্ণ সোনালী সূর্য কীরণের নিয়ন আলো সমস্ত শরীর জুড়ে ঠিকরে পড়তেই আচমকা মাথা তুলে সামনে দৃষ্টিপাত করে ঈশু।
অনেকক্ষণ ধরে আঁধারে থাকার দরুন চোখ দুটোতে আলোক রশ্মির ঝলকানি এসে আঁচড়ে পরার সঙ্গে সঙ্গে আপন গতিতে খিঁচে বন্ধ হয়ে গেলো নেত্রপল্লব জোড়া।
পরক্ষণেই আবার কয়েকবার পলক ছেড়ে চোখ কচলে ধীরে ধীরে নিজেকে ধাতস্থ করে ঈশানী, আজ বহুদিন বাদে একটু খানি সূর্য উঠেছে বোধ হয়। তবে এই মূহুর্তে সূর্যের উষ্ণ অভ্যর্থনাকে আলিঙ্গন করার সময় নেই, কারণ সূর্য কীরণের সাথে তাল মিলিয়ে ওর নিকট এগিয়ে এসেছে আরও একজন।
তার কঠোর পদধ্বনির আওয়াজ,পুরুষালী ক্লোনের মাতাল মাতাল সুঘ্রাণ, আর শক্তপোক্ত ধারালো চিবুকখানা ঈশানীর হৃদয়ে কাঁপন ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

অথচ অতি আত্নবিশ্বাসী মেয়েটা এবারও ভুল করে বসলো সবসময়ের মতোই। এরীশকে এগিয়ে আসতে দেখেও চোখে মুখে মিথ্যে আত্ন অহংকার ধরে রেখে জিদের বশে নাক ফোলাতে শুরু করে ঈশানী, ওর এখন একটাই প্রতীজ্ঞা এরীশের কাছে কিছুতেই নিজের দূর্বলতা ধরা দেওয়া যাবেনা, কখনোই না।
কিন্তু সেটা কি আদৌও সম্ভব? এরীশ যে ধূর্ত মানব,সে তো বহু আগেই ধরে ফেলেছে ভেতর থেকে ঈশানী যে একটা ভীতু আর ভঙ্গুর প্রকৃতির মেয়ে । নিজের সতীত্ব রক্ষার প্রশ্ন উঠলে এক নিমিষেই গতি হারায় মেয়েটা, টানাপোড়েনে উবে যায় তার আত্নবিশ্বাসের মেকি দেয়াল। এরীশ অবশ্য মনে মনে ভালোই আনন্দ পায় একটু বেশিই বোকা আর অতিব সরল এই মেয়েটার কর্মকান্ডে।

কিন্তু এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে ভীষণ রেগে আছে এরীশ, বারবার এই একরত্তি মেয়েটা ওকে টেক্কা দিতে চাইছে, চোখে ধূলো দিয়ে পালানোর দুঃসাহস দেখাচ্ছে, বুঝিয়ে দিতে চাইছে এরীশের অপারগতা।
অথচ রাশিয়ার মতো দেশে দাঁড়িয়ে মাফিয়া টেরোরিস্ট এরীশ ইউভানের নজর থেকে পালিয়ে ফেরা যে আদৌও সম্ভব নয় সেটা বোধ হয় এখনো বুঝতে পারেনি মেয়েটা।
বেজমেন্টের ভারী পাল্লার দরজা ভেদ করে ধীর পায়ে ভেতরে এগিয়ে এসে একহাঁটু ভাজ করে এরীশ বসে পরে ঈশানী মুখোমুখি হয়ে। ঈশানী গুটিসুটি মে’রে ভয়ে সিটিয়ে আছে, তবে চোখে মুখে ধরে রাখা মিথ্যে গাম্ভীর্যটা এখনো দৃশ্যমান। এরীশ ওর মুখের দিকে সামান্য ঝুঁকে এসে গলা খাদে নামিয়ে হাস্কি আওয়াজে বলে,
—- পালাতে নিষেধ করেছিলাম তোমাকে, তবুও বারবার পালিয়ে যাওয়ার স্পর্ধা দেখাচ্ছো, অন্তরে ভয় নেই?
ভয় তো দূরের কথা এরীশের অনুভূতিহীন ধূসর বাদামী চোখ দুটোতে এক ঝলক নজর বুলিয়ে ফের ঝাঁঝিয়ে উঠলো ঈশানী,

—- আমি পালাবো ই, যতবার ধরে আনবেন তাতবার পালাবো। কারণ এটা কোনো থাকার জায়গাই নয়, এই পাপের দুনিয়াটা আপনার মতো জানোয়ারদের জন্য থাকার জায়গা হতে পারে , কিন্তু আমার মতো সাধারণ মানুষের জন্য এই জায়গাটা নরকের মতোই অশান্তিদ্বায়ক।
ঈশানীর ঝাঁঝালো কথার বিপরীতে আচমকা ওর চিবুক টা শক্ত হাতে চেপে ধরে এরীশ, আগ্নেয়গিরির দাবানলের মতো র’ক্তিম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁতে দাঁত পিষে কঠিন স্বরে বলে,
—- এভাবে তেজ দেখিয়ে কথা বলা মোটেই টলারেট করিনা আমি, তুমি কি এখনো বুঝতে পারো নি আমার সঙ্গে লাগতে আসলে আমি ঠিক কি হাল করতে পারি তোমার? নাকি আবার নতুন করে বুঝিয়ে দিতে হবে সবটা?
— আপনি একটা অ’ত্যাচারী, কোনোদিন ক্ষমা করবো না আমি আপনাকে,ঘৃণা করি আমি আপনার অহংকার কে,এসব মিথ্যে ক্ষমতা প্রতিপত্তি কতৃত্ব সবকিছুকে ঘৃণা করি আমি। আপনার এই পাপের দুনিয়া থেকে আমি মুক্ত হবোই আর যেদিন হবো সেদিন আপনি আমার কাছে হেরে যাবেন এরীশ ইউভান। আর আপনার বিপরীতে জিতে যাবো আমি।
একটা সরল সহজ, বোকা বাঙালি মেয়ের কাছে হেরে যাবে আপনার অহংকার, দুমড়ে মুচড়ে যাবে আপনার পাষণ্ড হৃদয়, সহ্য হবে তো সেদিন?

ঈশানীর বলা তীরের ফলার মতো ধারালো কথাগুলো এরীশের অহংকারী হৃদয়ে সামান্যও কি চিড় ধরাতে সক্ষম হয়নি? হয়েছিল বোধ হয়। এই মেয়েটা যা বলেছে তার প্রতিটি কথায়ই দিবালোকের মতো সত্য এবং স্পষ্ট। এরীশ তো আসলেই একটা হৃদয়হীন জানোয়ার।
তবুও কেন যেন ঈশানীর মুখ থেকে বের হওয়া এই তীক্ষ্ণ কঠোর সত্যি কথাগুলো নির্বিগ্নে গ্রহন করতে পারলো না এরীশ, উল্টো মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে রাগের হলকা দিগুণ তোরে ছড়িয়ে পরলো তার । যার বহিঃপ্রকাশ ঘটলো হাতের মাধ্যমে, আজ আবারও নিজের বলিষ্ঠ পুরুষালী হাত দিয়ে ঈশানীকে চ’ড় মা’রতে উদ্যত হলো এরীশ।
এরীশ কে আঘাত করার জন্য উদ্যত হতে দেখা মাত্রই আরও খানিকটা জড়সড়ো হয়ে চোখদুটো খিঁচিয়ে বন্ধ করে নিলো ঈশানী।

মিয়িয়ে যাওয়া একফালি সোনালী সূর্য কীরণ তখন ঠিকরে পড়ছে ঈশানীর সুশ্রী মুখ মন্ডলে, ফুঁপিয়ে কান্নার তোড়ে বুজে যাওয়া অক্ষি পল্লব থেকে গড়িয়ে পরছে নোনা জলের চিকন স্রোত। সূর্যের আলোয় অশ্রুভেজা কপোল খানা চিকচিক করে দ্যুতি ছড়াচ্ছে এরীশের শূন্য চোখে।
পাতলা ফিনফিনে গোলাপী অধরটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে রেখেছে নিদারুণ শঙ্কায়,অথচ ওকে এই চেহারায় অসহায় নয় বরং আবেদনময়ী লাগছে এরীশের নিকট।

মেয়েটার অসম্ভব মায়াবী চেহারার পুঙ্খানুপুঙ্খ গভীর নজরে পরখ করতে গিয়েই অকস্মাৎ হাতের গতি থেমে গেলো এরীশের।উল্টো ব্যতিগ্রস্থ হয়ে আরেকটু গভীর নজরে চোখ বোলালো ঈশানীর পুতুলের মতো ঢলঢলে মুখ খানায়।
মেয়েটা চোখ খিঁচে বন্ধ করে রেখেছে, তাতেই ভেতরের হিংস্র সত্তাটা দপ করে নিভে গিয়েছে এরীশের। যদি ওই মহাসমুদ্রের মতো গভীর টলটলে নীল চোখ জোড়া খুলে রাখতো তাহলে? তাহলে হয়তো চোখের সামনে থমকে যেতো পুরো দুনিয়া, দ্বিতীয় বারের মতো গতি হারাতো এরীশের নিষ্ঠুর পাষাণ বক্ষপিঞ্জর । মেঘমুক্ত আকাশে ঝরঝর করে নেমে আসা এক পশলা বৃষ্টিতে ভিজে যেতো বরফ খন্ডের ন্যায় শীতল হৃদয়টা। এরীশ কি তা আদৌও সহ্য করতে পারতো? ও যে পাপী, এতো পবিত্রতা কি করেই বা সহ্য করবে ওর কলুষিত আত্নাটা?

জীবনে প্রথমবার কোনো মেয়ে কে এতোটা সুক্ষ্ম নজরে পরখ করলো এরীশ। কথা তো ছিল মেয়েটাকে তার আসল জায়গা বুঝিয়ে দেওয়ার, কিন্তু তেমন কিছুই করতে পারলো না, উল্টো নিজের মধ্যে থেকেও যেন কোথায় হারিয়ে গেলো সে। এই মেয়েটার মাঝে কিছু তো একটা আছে যা ওর মতো জানোয়ারকে ও বশ করে দিতে সক্ষম।
তবে কয়েক মূহুর্তের ব্যবধানে হুট করেই আবার এতোক্ষণ ধরে ভাবনার অনলে ডুবে যাওয়া হিংস্র সত্তাটা অকস্মাৎ আন্দোলন করে উঠলো মস্তিষ্কে, ফলস্বরূপ মূহুর্তেই চোখের রং পাল্টে গেলো এরীশের, তৎক্ষনাৎ মাথা থেকে ঈশানীর ভাবনা সরিয়ে গর্জে উঠলো সে,

—- তুমি এই পেন্ট হাউজ ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না, কোনো দিন না। আমি তোমাকে কখনোই জিততে দেবো না, নেভার। একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো বিচ, এরীশ কখনো হারে না, কোনোদিন না।
এরীশের গর্জনে চোখ বন্ধ রাখা অবস্থাতেই থরথর করে কেঁপে উঠলো ঈশানী। ওর শরীরের কাঁপন লক্ষ্য করে ভ্রু কুঁচকালো এরীশ,বাইরে থেকে নিজের কঠিন সত্তাটাকে ধরে রেখেই আরও একবার অনুভূতিহীন দৃষ্টি বোলালো মেয়েটার সর্বাঙ্গে,
এখনো একই ভাবে বসে আছে ঈশানী, মা’রের ভয়ে অন্য দিকে ঘাড় ঘোরানোর দরুন স্পষ্ট হয়েছে তার নারী দেহের সুক্ষ্ম কলার বোন গুলো,রাজহংসীর মতো গমরঙা ত্বকে আলোর বিচ্যুরণ যেন ঝিল ধরিয়ে দিচ্ছে এরীশের দু’চোখে, তবুও পলক ফেলছে না ও। উল্টো ভেতরের দাবিয়ে রাখা সহজ মনটা তাচ্ছিল্য করে হেসে বলে উঠলো ,
—- সত্যি তো এটাই, এই মেয়েটাকে বাঁচানোর জন্যই তুই আজ টাউন সেন্টারে গিয়েছিলি, ডেনিয়েলের স্টকার রা যাতে কিছুতেই ওর নাগাল না পায়, এমনকি মুখটাও যাতে দেখতে না পারে সে জন্যই তো একা ড্রাইভ করে ওকে পেন্ট হাউজ অব্দি নিয়ে এলি। তুই মেয়েটাকে বাঁচাতে চাইছিস, ওর পবিত্র সত্তাটাকে এভাবেই অক্ষত রাখতে চাইছিস। অথচ নিজের আত্ন অহংকার কে প্রাধান্য দিয়ে মেয়েটাকে অযথা কষ্ট দিতে পিছুপা হচ্ছিস না।
সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রোহ করে উঠলো ভেতরের পৈশাচিক মনটা,অন্য মনের কথায় ঘোর আপত্তি জানিয়ে বললো,

— মোটেই আমি ওকে বাঁচাতে চাইনি, আর না তো ওর পবিত্র সত্তা নষ্ট হয়ে গেলে আমার কোনো কিছু যায় আসে। আমিতো স্রেফ ডেনিয়েল কে হারাতে চাই। ডেনিয়েল ঈশানীকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চায়,আমি সেটা কিছুতেই হতে দেবোনা, আর এখানেই আমার জিত।
— ওকে যদি বিন্দুমাত্র কেয়ার ই না করিস, তাহলে নিজের কোলে তুলে সযত্নে কেন নিয়ে এলি এখানে ? ও যদি এতোটাই তুচ্ছ হবে তো তুষারের কাছে দিয়ে দিলেই হতো।
নিজ মনের গভীর প্রশ্নের কোনোরূপ উত্তর খুঁজে পায়না এরীশের রগচটা হিংস্র বদমেজাজি মস্তিষ্কটা, যার ফলে নিজেই নিজের উপর চরম বিরক্ত হয়ে রেগেমেগে ঈশানীকে ফেলে রেখেই বেজমেন্ট থেকে হনহন করে বেরিয়ে যায় এরীশ ।
ওদিকে এরীশ বেরিয়ে যেতেই চোখ জোড়া খুলে বন্ধ দরজার দিকে আহত দৃষ্টিপাত করে শরীরের ভার মেঝেতে ছেড়ে দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো ঈশানী।

সন্ধ্যা তিমিরে মুড়িয়ে গিয়েছে স্নিগ্ধ বরফে ঢাকা গহীন জঙ্গল, আশপাশের বিশালাকৃতির পাইন গাছ গুলোর আড়াল থেকে ভেসে আসছে সাদা নেকড়েদের গাঁ ছমছমে হাউলিং।
সাধারণ কোনো মানুষ হয়তো নেকড়ে জাতির এই বিকট ভয়াতুর গর্জন শুনলে ভয়ের তোপে শিউরে উঠবে, অথচ এই গহীন জঙ্গলের মাঝে অবস্থিত বিশাল পেন্ট হাউজে বসবাসরত রুশ কন্যা ফ্লোরার মাঝে কোনোরূপ হেলদোল নেই তাতে, ও নির্বিগ্নে কাচ আবৃত বারান্দায় দাড়িয়ে নিস্প্রভ চোখে তাকিয়ে আছে গহীন জঙ্গলের পানে ।
কোনো এক অজানা কারনে ওর মনটা আজ ভালো নেই,বিষন্নতায় ছেঁয়ে গেছে হৃদয়, ওইজন্যই হয়তো এই উদাসীনতা।
ফ্লোরা যখন গালে হাত দিয়ে বিষন্ন মনে অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রকৃতি দেখায় মশগুল, তখনই ঠকঠক পদধ্বনিতে অফিস রুম থেকে বেরিয়ে লাউঞ্জে এগিয়ে আসে এরীশ, এরীশের উপস্থিতি টের পেয়ে সচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে পরলো ফ্লোরা, দ্রুত বারান্দা থেকে বেরিয়ে এগিয়ে গেলো এরীশের নিকট,মাথানত রেখে সংকুচিত গলায় শুধালো,

— ককফি দেবো এরীশ?
এরীশের চোখ দুটো তখন ও মোবাইল স্ক্রিনে নিবদ্ধ, ও সেভাবেই গমগমে আওয়াজে জবাব দিলো,
— নো নিড।
কথা শেষ করে এরীশ আনমনে মোবাইল স্ক্রল করতে করতে মেইন ডোরের দিকে পা বাড়ালে পুনরায় ডেকে ওঠে ফ্লোরা, কিছুটা ইতস্তত গলায় বলে,
—- ইয়ে মানে, ঈশু কি?
ফ্লোরার মুখে ঈশানীর ছোট্ট নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে চট করে মাথা তুলে চাইলো এরীশ, ঘাড় ঘুরিয়ে ফ্লোরার পানে দৃষ্টিপাত করে গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— তুষার কোথায়?
—- আজ ফেরেনি।

ফ্লোরার জবাব শুনে নিজের অজান্তেই ফোনটা মুঠোয় রেখে শক্ত করে হাত মুষ্টি বদ্ধ করে নিলো এরীশ। হঠাৎ করেই তীক্ষ্ণ কঠিন রূপ ধারণ করেছে তার ব্লেডের মতো ধারালো চোয়াল। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোনো এক অজানা কারন বশত ভেতরে ভেতরে ফুঁসে উঠেছে এরীশ। এক পর্যায়ে ভেতরের সেই নির্জীব ভাবনার ইতি টেনে ফ্লোরাকে কোনোরূপ প্রত্যুত্তর না করেই বড় বড় পা ফেলে পেন্ট হাউজ থেকে বেরিয়ে গেলো এরীশ।
এরপর এলিভেটরের সাহায্যে সোজা বেজমেন্টের সামনে গিয়ে থামলো ও। শক্ত লোহার দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে কারও গোঙানির আওয়াজে সচকিত হয়ে উঠলো এরীশের কর্ণগহ্বর। এরীশ জানে এটা ঈশানী, তাই এতো সেতো না ভেবে ঈশুর নিকট এগিয়ে সকালের মতোই হাটু ভেঙে বসে পরলো ঈশানীর মুখোমুখি হয়ে। তবে সকালের সেই নাক ফোলানো মেকি তেজের ক্ষুদ্রাংশ ও এখন আর অবশিষ্ট নেই ঈশানীর মাঝে, হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে শুয়ে গোঙাচ্ছে শুধু মেয়েটা। দিন দুনিয়ার আর কোনো হুশ নেই তার।

ওর এহেন বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে ফাঁকা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, নিজের খরখরে আঙুলের সাহায্যে ঈশুর অশ্রু ভেজা টকটকে র’ক্তরাঙা চেহারায় লেপ্টে থাকা এলেমেলো চুলগুলোকে একসাইডে সরিয়ে হিসহিসিয়ে এরীশ বলে,
— আগেই সর্তক করেছিলাম তোমায়,আমার সঙ্গে লাগতে এসো না। তুমি ভেতর থেকে যতটা না সরল বাইরে থেকে ঠিক ততটাই জেদি। তোমার এই জেদি মনোভাব আজ তোমাকে এই জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে সেটা কি বুঝতে পারোনা?

কথা শেষ করে আর ফুরসত দিলোনা এরীশ, হাত বাড়িয়ে ওর লতানো কোমর টা আঁকড়ে ধরে জ্বরে পু’ড়তে থাকা মেয়েটাকে নিজ কোলে তুলে নিলো সন্তর্পনে। ঈশাকে কোলে তুলে এরীশ দাঁড়িয়ে পরতেই আবারও কয়েকটা এলোমেলো ঝুরো চুল এসে আঁচড়ে পরলো ঈশানীর চোখে মুখে।
এরীশ কি ভেবে যেন এবার মুখের সাহায্যে ফুঁ দিয়ে চুলগুলো জায়গা থেকে সরালো, অতঃপর ঈশু সমেত বেজমেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে যেতে যেতে ঈশানীর পরিশ্রান্ত ফ্যাকাসে মুখের পানে চেয়ে ঠোঁট বাকিয়ে হাস্কি স্বরে বিড়বিড়ালো,
—- দিস ইজ থার্ড টাইম। এরীশ ইউভান কে বারবার লক্ষ্যচ্যুত করছো তুমি সিল্যি গার্ল,ইউ ডোন্ট ইভেন নো, হাউ লাকি ইউ আর।

পেন্ট হাউজে ফিরে এসে ঈশানীকে ওর বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে,তাড়াহুড়ো পায়ে বেড়িয়ে যেতে অগ্রসর হয় এরীশ।ঠিক তখনই জ্বরের ঘোরে বুদ হয়ে থাকা অবচেতন ঈশানী টেনে ধরে এরীশের কনু আঙ্গুল। হঠাৎ আঙুলের ভাঁজে নরম হাতের পিছুটানে ভ্রু কুঞ্চিত করে ঘাড় ঘোরালো এরীশ। দেখলো, চোখ বন্ধ রেখেই ওর আঙুল টেনে ধরে কি যেন বিড়বিড় করছে ঈশানী, তার চেয়েও বেশি উদ্বেগের বিষয় হলো প্রচন্ড জ্বরের তাপে ঝলসে যাচ্ছে মেয়েটার শরীর।
এতোসব বোঝার মতো ছেলে এরীশ নয়,দরদ দেখানো ওর ধাঁচে নেই। কিন্তু এই যে ঈশানীর আঙুল টেনে ধরা, এটা বোধ হয় এই জীবনে প্রথমবার উপলব্ধি করলো ও । একটা নরম তুলতুলে কচি হাত ওর শুষ্ক খরখরে আঙুলটা নিজের অজান্তেই শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আছে, খানিকক্ষন ঈশানীর ফ্যাকাসে মুখটার দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে থেকে অকস্মাৎ গমগমে আওয়াজে এরীশ বলে ওঠে,

— কি চাই?
জ্বরের ঘোরেই আলতো ঠোঁট নাড়িয়ে জবাব দেয় ঈশানী,
— দয়া করে এটা করবেন না অরন্য, আমি ওই নোংরা জায়গায় কিছুতেই যাবোনা, আপনার কাছে মিনতি করছি আমাকে ওখানে পাঠাবেন না,আমি যে পবিত্র।
কথা বলতে বলতেই ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে ওঠে ঈশানী, এরীশ ওর হাতটা ছাড়িয়ে,হাত দুটো পকেটে পুরে সটান দাড়িয়ে জবাব দিলো,
— কোথাও যাওনি তুমি, কেউ তোমাকে কোথাও পাঠাচ্ছে না। তুমি এখনো পবিত্রই রয়েছো,জাস্ট লাইক দ্যা ফার্স্ট ডে।
কথা শেষ করে আর এক মূহুর্তের জন্যে ও পিছু ফিরে তাকায় না এরীশ, সোজা গটগটিয়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। ওদিকে ঈশানীর রুমের বাইরে পা রাখতেই কোথা থেকে যেন ছুটে আসে বোজো, ও বোধ হয় আশেপাশে এরীশের শরীরের গন্ধ পেয়েছে, তাই গার্ডদের ফাঁকি দিয়ে দৌড়ে চলে এসেছে এখানে।
বোজো কাছে এলে ওর লোমশ শরীরে আহ্লাদী হাত বুলিয়ে দেয় এরীশ, মালিকের আদর পেয়ে আনন্দিত হয়ে বোজো হাউলিং করতে নিলে ওকে হুট করেই থামিয়ে দিয়ে , ঈশানীর ঘরে আড় চোখে নজর বুলিয়ে মুখের উপর আঙুল ঠেকিয়ে বোজো কে সাবধানতার ইঙ্গিত প্রদান করে এরীশ বলে ওঠে,

—- হুশশশশ!
এরীশের হুকুমে থেমে যায় বোজো,এরপর আদেশ করা মাত্রই দু’জন পালোয়ান মত লোক এসে গলায় শিকল পড়িয়ে টেনেটুনে নিয়ে যায় বোজো কে।
কিন্তু একটা জিনিস বেশ কিছুক্ষন ধরেই লক্ষ্য করেছে এরীশ, কেন যেন বোজোর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল বোজো ভেতরে যেতে চায় না, ক্রমাগত নাক টেনে কিছু একটা শোঁকার চেষ্টা করছিল সেই তখন থেকে , যেন চেনা পেন্ট হাউজে অচেনা কারো গন্ধ পেয়েই তার এই অস্থিরতা। বোজো সাধারন কোনো প্রাণী নয়, ও একটা হাইব্রিড জাতের সাদা নেকড়ে, ওর ঘ্রান শক্তি অত্যন্ত প্রখর। অপরিচিত ঘ্রানে সবসময়ই এমন অদ্ভুত পাগলাটে আচরণ করে বোজো, আজও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এই কড়া সিকিউরিটি ভেদ করে পেন্ট হাউজের ভেতরে ঢোকার মতো দুঃসাহস কেই-বা দেখাতে আসবে? তার কি জীবনের মায়া নেই নাকি?
খানিকক্ষণ একধ্যানে তাকিয়ে থেকে বোজোর সন্দিহান কর্মকান্ড লক্ষ্য করে চোখ ছোট ছোট করে ফেললো এরীশ। ইদানীং ডেনিয়েলের স্পাইদের উৎপাত বেড়েছে, তারা সর্বক্ষন মুখিয়ে থাকে ঈশানীর সন্ধানে,আজ আবার বোজোর এহেন অদ্ভুত আচরণ,

বিষয়টা নিয়ে তুষারের সঙ্গে আলাপ করতে হবে, সেই ভেবেই চিন্তিত মস্তিষ্কে করিডোর ছাড়িয়ে লাউঞ্জের দিকে পা বাড়ায় এরীশ।
করিডোর পার হয়ে লাউঞ্জে এসে এক পা দিয়েছে কি দেয় নি, তার আগেই চারিদিক থেকে শ খানিক বন্দু’কের নল এসে জড়ো হলো এরীশের মাথায়। সবাই যখন চারিদিক থেকে এরীশকে ঘিরে ধরেছে ঠিক তখনই টমেটো প্রিন্স খ্যাত এ্যালেক্স এগিয়ে এসে কপাল বরাবর রি’ভলবার তাক করলো এরীশের। এরীশকে এভাবে অকস্মাৎ ঘায়েল করতে পেরে খিকখিক করে কুটিল হাসে এ্যালেক্ট, হাসতে হাসতেই বলে,
— হ্যান্ড’স আপ,মি. পাইথন লিডার।
এরীশের চোখে মুখে বিরক্তি, ওর ভাব ভঙ্গিমা দেখে মনে হচ্ছে ওর সামনে কোনো জোকার দাঁড়িয়ে রিয়েলিটি শো দেখাচ্ছে, অগত্যা চারিদিকের তাক করানো লোড করা বন্দুক গুলোর দিকে এক নজর চোখ বুলিয়ে চোয়াল শক্ত করে এরীশ বলে,

— আমার পেন্ট হাউজে ঢুকে এসব জোকার গিরি করার সাহস হলো কি করে তোমার?
এ্যালেক্সের হাসি উবে গেলো তৎক্ষনাৎ, নিজের শীতল চক্ষু মূহুর্তেই অঙ্গার বানিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠলো এ্যালেক্স,বললো,
—- মেয়েটাকে ডেনিয়েলের হাতে তুলে না দিয়ে তুমি আমার সঙ্গে বেঈমানী করেছো এরীশ। উল্টো একজন বিশ্বস্ত গার্ডকে মে’রে আমার মিত্র ডেনিয়েল কে আমার শত্রু বানিয়ে দিয়েছো, এতো সহজে তোমায় আমি ছেড়ে দেবো ভেবেছো?কোথায় ওই মেয়েটা? ও কে তো তুমি বিক্রি করার জন্যই নিয়ে এসেছো, তাহলে এখন পুতুল বানিয়ে ঘর বন্দী করে রাখার কি মানে…
— জাস্ট কিপ ইওর ভয়েস লো, সামওয়ান ইম্পরট্যান্ট ইজ স্লিপিং ইনসাইড, আর একবার গলার আওয়াজ বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তোমার জিভ টেনে ছিড়ে ফেলবো আমি এ্যালেক্স।
এ্যালেক্সের শেষ বাক্যটা জিভের আগায় পৌঁছানোর আগেই দাঁতে দাঁত পিষে হুংকার দিয়ে ওঠে এরীশ।
— সামওয়ান! হু ইজ সামওয়ান? নিশ্চয়ই ওই নীল চোখের সুন্দরী মেয়েটা, যার জন্য তুমি ব্লাড ডায়মন্ড পর্যন্ত হাত ছাড়া করতে দ্বিধা করোনি, আর ইউ ফাকিং ক্রেজি রীশস্কা?
টমেটো প্রিন্সের কথার পাছে, এরীশ নিরেট কন্ঠে বলে,

— এরীশ ইউভান কাউকে কৈফিয়ত দেয়না।
— আজ না হয় কাল ডেনিয়েল ঠিকই মেয়েটাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে, তখন কি করবে তুমি?
— আমি এরীশ একবার যখন বলেছি ওকে আমি দেবো না, তখন চোখের দেখা তো দূরে থাক, ডেনিয়েলের ছায়াটাও ওর শরীর স্পর্শ করতে পারবে না কোনোদিন ।
কন্ঠে ক্রোধ উপচে পড়ছে এরীশের, একটা ঘুমন্ত সিংহ কে জাগ্রত করার ফলাফল ঠিক কোন পর্যায়ের ভয়াবহ হতে পারে সেই ঘটনা আঁচ করতে পেরে শুষ্ক ঢোক গেলে এ্যালেক্স, এরীশের কপালে তাক করে রাখা রিভলবার টা এতোক্ষণে নামিয়ে শান্ত অথচ ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলে,

—- তুমি ব্যাপারটাকে পার্সনালি নিয়ে নিচ্ছো এরীশ , একটা সাধারণ মেয়েকে ধীরে ধীরে নিজের দূর্বলতা বানিয়ে ফেলছো, সেটা কি আদৌও আন্দাজ করতে পারছো তুমি ?
এ্যালেক্সের কথায় তাচ্ছিল্য করে হাসলো এরীশ, ঠোঁটের ক্রুর হাসিটা ধরে রেখেই বললো,
—- কাউকে দূর্বলতা বানাতে হলে হৃদয় থাকতে হয় এ্যালেক্স, আর আমিতো হার্টলেস।

ওদিকে লাউঞ্জের এতোসব কাহিনী দেখে তুষার কে ডাকতে হুড়মুড়িয়ে দোতলায় চলে যায় ফ্লোরা, দোতলার করিডোর ধরে এগিয়ে গিয়ে তুষারের রুমের সামনে পা রাখা মাত্রই আচমকা পেশীবহুল শরীরের ধাক্কায় দু’কদম পিছিয়ে গিয়ে হকচকিয়ে ওঠে ফ্লোরা,ব্যথা পেয়ে ফুলে যাওয়া কপালটায় সামান্য হাত বুলিয়ে চোখ তুলে তাকাতেই দেখতে পায় তুষার দাঁড়িয়ে আছে সামনে। তারমানে ধাক্কাটা মাত্র তুষারের সঙ্গেই লেগেছে।
— কি হয়েছে, এভাবে ছুটছিলে কেন হঠাৎ? তোমার হাবভাব দেখে তো মনে হচ্ছে আমার কাছেই এসেছো, কিছু কি বলার ছিল?
সবসময়ের মতোই ঠান্ডা নদীর মতো গলার আওয়াজ তুষারের, তার শান্ত সাবলীল রূপ দেখে কে বলবে এই লোকটা একজন গ্যাংস্টার?
তুষারের কথার পাছে ফ্লোরা হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,

— প্রিন্স, টমেটো প্রিন্স এরীশের কপালে রিভলবার তাক করে রেখেছে।
ব্যাস কথাটা শোনা মাত্রই শান্ত চোখ দুটো ধূমকেতুর হলকার মতোই অকস্মাৎ জ্বলে উঠলো তুষারের, তৎক্ষনাৎ এদিক ওদিক ঘাড় ফুটিয়ে হাতের রিভলবারটা লোড করতে করতেই লাউঞ্জের দিকে এগিয়ে গেলো তুষার।
নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে একেবারে আচমকা ব’ন্দুক নিয়ে ঠেকালো এ্যালেক্সের ঘাড়ের মাঝখানে। ওর মুভমেন্ট গুলো এতোই দ্রুত আর প্রফেশনাল ছিল যে সবটা কেমন চোখের পলকে হয়ে গেলো, এ্যালেক্সের গার্ড’স রা সব চোখের সামনেই ছিল অথচ তাড়াও এই মূহুর্তে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
— হ্যান্ড’স আপ,এই পেন্ট হাউজে দাড়িয়ে পাইথন লিডারের কপালে রিভলবার তাক করার দুঃসাহস দেখানোর অপরাধে আপনার মস্তিষ্কটা এই মূহুর্তে ঝাঁজরা করে দেবো আমি এ্যালেক্স।
তুষারের ক্ষিপ্ততা দেখে ভয়ে এ্যালেক্সের শরীরের রক্ত ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার উপক্রম, ও শঙ্কিত কন্ঠে এরীশ কে ডেকে উঠলো তৎক্ষনাৎ,

— হেই রীশস্কা হেল্প মি, আমি তো শুধু তোমাকে ওয়ার্ন করতে এসেছিলাম ব্যাস এতোটুকুই।
এ্যালেক্সের কথার পাছে এরীশ কিছু বলবে তার আগেই ঢুলুঢুলু পায়ে লাউঞ্জে এসে হাজির হয় ঈশানী, ঈশানীর আগমন টের পেয়ে ওর দিকে র’ক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে এরীশ।
ওদিকে এরীশের এহেন চাহনীতে ভরকে গিয়ে আস্তে করে ফ্লোরার আড়ালে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরে ঈশানী। আড়ালে থেকেই ফোলা ফোলা নীল চোখ জোড়া বের উঁকি দেয় সামনের দিকে। ঈশানী উঁকি দিলে এ্যালেক্স ওর চোখে চোখ রেখে কৌতূহলি কন্ঠে বিড়বিড় করে বলে,
— এতো ইনোসেন্ট? কি করে সম্ভব, এই মেয়েটা এরীশের কাছে কি করেই বা সুরক্ষিত রয়েছে এতোগুলা দিন ?
পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে এরীশ কে উদ্দেশ্য করে বলে,
—- রীশস্কা, আর ইউ সিওর? তুমি সত্যিই এই ইনোসেন্ট মেয়েটাকে নিজের পাপের দুনিয়ায় সেফ রাখতে চাইছো, ইজ’ন্ট ইট ফানি?

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ১৩

এ্যালেক্সের কথায় কর্ণপাত করে এরীশও এবার ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলো পেছনে, ক্ষনিকের জন্য নিজের ধূসর বাদামী অনুভূতিশূন্য চোখ দুটো স্থাপন করলো সরলতার সমুদ্রের মতো গভীর নীল জ্বলজ্বলে চোখে। এ যেন খাঁ খাঁ মরুভূমির বুকে আঁকাবাকা স্বচ্ছ এক নীল নদ।
অগণিত পাপের স্তূপে ঢাকা পরে যাওয়া অন্ধকারাচ্ছন্ন কালো দুনিয়ার মাঝেই একটুকরোর জোনাকির আলোর মতোই মৃদু স্নিগ্ধ পবিত্র রোশনাই। চোখের দৃষ্টি অবিচল রেখেই অনিমেষ কন্ঠে বিড়বিড়ালো মাফিয়া বস,
—- ইনোসেন্ট বলেই দৃষ্টি ফেরাতে পারছি না, কিছুতেই পারছি না।

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ১৫