আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ১৫
suraiya rafa
মস্কোতে তুষার পাত হচ্ছে অবিরত, বাইরের প্রকৃতি বরফের আস্তরণে ঢাকা পরে ধারণ করেছে শ্বেত বকের মতোই ধবধবে সাদা বর্ণ । প্রচন্ড ঠান্ডায় জনজীবন ব্যাহত হওয়ার উপক্রম। অথচ বছরের এই সময় গুলোতেই মাফিয়ারা থাকে সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। মাফিয়াদের আন্ডারগ্রাউন্ড ক্লাব গুলোতে চলতে থাকে ড্রাগ আর অ’স্ত্রের রমরমা ব্যবসা।
যদিও এই মূহুর্তে ক্লাবে উপস্থিত নেই এরীশ, গত কালকের টমেটো প্রিন্সের ঘটনার জের ধরে তার মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পরেছে বিশ্বাস ঘাতকতার জলন্ত এক তীব্র অগ্নুৎপাত। যে গার্ড গুলো কাল টমেটো প্রিন্স আর তার দল-বল কে পেন্ট হাউজে ঢুকতে দিয়েছে তাদের কি এতো সহজে ছেড়ে দেবে এরীশ? কখনোই না।
এরীশের টপ ফ্লোরের পেন্ট হাউজ আর নিচের বেজমেন্ট ব্যতিরেকে ভবনের নিচের অংশ পুরোটাই স্টাফ এবং গার্ড’সদের জন্য বরাদ্দ। আপাতত এই মূহুর্তে স্টাফ কোয়ার্টারের লাউঞ্জে বসে আছে এরীশ।
একটা বড়সড় ডিভানে গা ছড়িয়ে বসে পা’দুটো আড়াআড়ি করে তুলে রেখেছে সামনের সেন্টার টেবিলের উপর। সেন্টার টেবিলটা ভীষণ দামী আর নান্দনিক। পৃথিবীর সবচেয়ে এক্সপেন্সিভ কাঁচ দিয়ে বানানো হয়েছে এটা, ভেঙে গেলে বিশাল লস।তাতেও বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই মাফিয়া বস টার।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
শুধুমাত্র এরীশ কেন এই মূহুর্তে নতজানু হয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ড’সদের কারোর ই কোনোরূপ নজর নেই ওসব টেবিল ফেবিলের দিকে। তারা তো স্রেফ নিজেদের জীবনের শঙ্কায় উদগ্রীব। কোনো মতে এ যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গেলে হয়। এরীশের পাশেই পেছনে দু’হাত রেখে সটান দাড়িয়ে আছে তুষার,ওর মুখমন্ডল বরাবরের মতোই সাবলীল। চোখ মুখ জুড়ে গাঢ় হয়েছে ভয়াবহ নির্জীবতা, যেন বিচলিত হওয়ার মতো কিছুই ঘটছে না আশেপাশে।
বেশ অনেকক্ষন ধরে নিরবতা বিরাজ করছে পুরো লাউঞ্জ জুড়ে। গার্ডদের মুখমন্ডল ঘর্মাক্ত, এই কনকনে ঠান্ডার মাঝেও নিঃশব্দে দরদরিয়ে ঘামছে তারা। এই মূহুর্তে আওয়াজ তো দূরে থাক স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাস নিতেও প্রচন্ড বেগ পেতে হচ্ছে তাদের। প্রবল আতঙ্কে রুহুটা গলায় উঠে এসেছে যেন। অবশেষে সকলের ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে নিরবতা ভাঙলো এরীশ,
হাতে থাকা রিভলবার টার সাহায্যে খানিক কপাল চুলকে গাল দিয়ে জিভ ঠেলে রাশভারি আওয়াজে সে বললো,
— কাল সন্ধ্যায় যে ক’জন পেন্ট হাউজের সুরক্ষার দায়িত্বে ছিলে তারা সামনে এসো, রাইট নাও।
নিস্তব্ধতার মাঝে এরীশের কর্কষ হুকুম যেন এক অজানা আতঙ্ক ছড়িয়ে দিলো সকলের মন মস্তিষ্কে। কয়েকজন গার্ড’স শুষ্ক ঢোক গিলে একে অপরের দিকে তাকিয়ে চোখাচোখি করছে শুধু। তাদের চোখের চাওনী লক্ষ্য করে ঠোঁট বাকিয়ে বিদ্রুপাত্তক হাসলো এরীশ, অতঃপর চোখের মাঝে ক্রোধ টেনে হুংকার দিয়ে বলে উঠলো,
— ডোন্ট ওয়েস্ট মাই ভ্যালিউয়েবল টাইম বা’স্টার্ড।
এরীশের মারাত্মক হুংকারে পুরো লাউঞ্জ কেঁপে উঠলো এবার। মূহুর্তেই হাঁটু ভেঙে ধপ করে একযোগে মেঝেতে বসে পরলো লাউঞ্জে উপস্থিত সকল গার্ড’স। ওদের মধ্যে একজন গার্ড হৃদয়ে খানিকটা সাহস সঞ্চার করে ভয় জর্জরিত গলায় রাশিয়ান ভাষায় ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে উঠলো,
—- আমাদের দোষ নেই বস, টমেটো প্রিন্স…
— ডোন্ট গিভ এনি ফাকিং এক্সকিউজ।
এরীশের কাট কাট আদেশে জিহ্বার আগায় আটকে থাকা বাকি কথাটুকু বিনাবাক্যে গলাধঃকরণ করে নিলো লোকটা।
লোকটার দিকে থেকে চোখ ঘুরিয়ে তুষারের পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো এরীশ। যে এখনো একই ভাবে জীবন্তমূর্তির ন্যায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ওর পাশে, মূর্তিমান তুষারের দিকে তাকিয়ে সাবলীল কন্ঠে এরীশ শুধালো,
— সব কিছু রেডি?
তৎক্ষনাৎ প্রত্যুত্তর করলো তুষার,
— ইয়েস।
— তাহলে আর দেরী কিসের? বোজো অনেকদিন স্ন্যাক্সের স্বাদ গ্রহন করেনা, আজকে না হয় একটু ভুঁড়ি ভোজ করুক।
রিভলবার টা আঙুলের ডগায় ঘোরাতে ঘোরাতে গম্ভীর আওয়াজে কৌশলী আদেশ করলো এরীশ। ওর কথার আগামাথা ঘুনাক্ষরেও কিছু বুঝে উঠতে পারলো না অপ’রাধী গার্ড’স গুলো। ওদিকে এরীশের আদেশ পাওয়া মাত্রই তুষার অন্য গার্ড’সদের চোখের ইশারা দিয়ে বললো,
— নিয়ে যাও।
সঙ্গে সঙ্গে কতগুলো পালোয়ানের মতো দেখতে নিগ্রো গার্ড’স এগিয়ে এসে ফাঁ’সির আসামিদের মতোই হাত পা বেঁধে একটা কালো কাপড়ে আবৃত করে ফেললো গার্ড’স গুলোর মুখমন্ডল। অতঃপর মাথায় ব’ন্দুক ঠেকিয়ে সবগুলোকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগলো বেজমেন্টের দিকে। মূহুর্তেই হাহাকার, চিৎকার আর প্রাণে বাঁচার তীব্র আকুতিতে হইহই করে উঠলো পুরো স্টাফ কোয়ার্টার।সে সব ব্যথাতুর আওয়াজ কর্ণগহ্বর ছাপিয়ে হৃদয় অবধি পৌঁছালো না এরীশের। কি করেই বা পৌছাবে? ও তো একটা হৃদয়হীন জানোয়ার । পৃথিবীতে কারোর কান্নাকাটি, হাহাকার, এমনকি নিগূঢ় আত্ম চিৎকার কোনোকিছুই বিচলিত করে দিতে পারে না এরীশকে। একমাত্র ঈশানী ছাড়া।
কোন এক অজানা কারণে ওই মেয়েটার কান্না দেখলে পুরো দুনিয়া ধ্বং’স করে দিতে ইচ্ছে করে এরীশের, মাথা ঠিক থাকে না একদম । কি অদ্ভুত এক বিরক্তিকর অনুভূতি।
আবারও সেই ঈশানী, মেয়েটা অদৃশ্য বলয়ের মতো চোখের সামনে না থেকেও মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে সারাটাক্ষণ। এরীশ বিরক্ত হয়, সাবলীল মুখশ্রী , সুডৌল ললাটদেশ সবকিছু কুঁচকে যায় হঠাৎ । অগত্যা বাইরের চ্যাঁচামেচি আর মস্তিষ্কের ভাবনা দু’টোই এড়াতে দু’কানে এয়ারপড গুঁজে ডিভানে মাথা এলিয়ে দিয়ে অক্ষিপল্লব বন্ধ করে নেয় নির্বিগ্নে।
ওদিকে বেজমন্টের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় ওই নিগ্রো দানবীয় গার্ড’স গুলোর মধ্যে একজন পেছনে ঘুরে তুষারের উদ্দেশ্য জিজ্ঞেস করলো,
— কোন সেলে রাখবো বস?
তুষার ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হৃদয়ের দূষিত বাতাস টুকু আলগোছে বের করে দিয়ে তীর্যক অথচ মসৃণ কন্ঠে বললো,
— অফকোর্স ট’র্চার সেলে।
লাউঞ্জ ত্যাগ করে এলিভেটরের মাধ্যমে সোজা বেজমেন্টে চলে যায় গার্ড’স গুলো। ওরা চলে গেলে তুষার দৃষ্টিপাত করে এরীশের দিকে, নির্জীব শান্ত গলায় আধশোয়া এরীশকে উদ্দেশ্য করে বলে,
— আপনি কখনোই গার্ড’সদের ট’র্চার সেলে পাঠাতেন না, কিন্তু আজ হঠাৎ।
এরীশ চোখ দুটো বন্ধ রেখেই গমগমে আওয়াজে বললো,
—- পাইথন প্যারাডাইসে বিশ্বাস ঘাতকের কোনো স্থান নেই তুষার। কাল আমি পেন্ট হাউজে উপস্থিত না থাকলে কি হতে পারতো ভেবে দেখেছো একবারও ?
তুষার ভালো করেই জানে কাল এরীশ না থাকলে হয়তো ঈশানীকে তুলে নিয়ে যেতো ওরা। কারণ এটাই আপাতত ওদের মোক্ষম উদ্দেশ্য, এরীশ নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে একরত্তি মেয়েটাকে প্রটেক্ট করতে চাইছে বারবার , সেই মেয়ের মাঝে কিছু তো রহস্য আছেই। আপাতত সেই অজানা রহস্য উদঘাটনে মরিয়া ডেনিয়েল। তুষার ভাবলো কিয়ৎক্ষন, অতঃপর নিশ্চিত হওয়ার জন্য পুনরায় শুধালো,
—- আপনি কি মিস ব্লু আইড অ্যাঞ্জেলের প্রতি কোনো কারনে অবসেসড এরীশ?
তুষারের করা সুস্পষ্ট প্রশ্নটা বিষাক্ত তীরের ফলার মতোই এরীশের মস্তিষ্কে গিয়ে বিধলো হঠাৎ। ও চট করে উঠে দাঁড়ালো ডিভান ছেড়ে, তুষারের দৃষ্টি এড়িয়ে বাইরের অবিরাম পেজা তুলোর মতো তুষার পাতের দিকে গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে তুষারের প্রশ্নটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গম্ভীর গলায় বললো,
—- তুমি যা ভাবছো তেমন কিছুই নয় তুষার । আমার মাফিয়া প্যারাডাইসের দিকে যে হাত বাড়াবে,সে-ই মা’রা পড়বে। কারণ এরীশ ইউভান কাউকে সেকেন্ড চান্স দেয়না , কোনোদিন না ।
— অথচ মিস ব্লু আইড অ্যাঞ্জেল কে হাজারটা সেকেন্ড চান্স দিয়ে বসে আছেন আপনি এরীশ।
হতাশায় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, তুষার মনেমনে নির্লিপ্ত কন্ঠে কথাটা আওড়ালেও, ঠোঁট নাড়িয়ে মুখে বললো,
— আপনাকে ডিস্টার্ব লাগছে, আজকের মতো পেন্ট হাউজে গিয়ে রিল্যাক্স করুন, এদিক টা আমি সামলে নিচ্ছি।
ঈশানীর জ্বরটা পুরোপুরি সারেনি এখনো, কাল সারারাত তীব্র জ্বরে বেঘোরে বিলাপ করেছে মেয়েটা। ফ্লোরা ওর শিওরে বসে মাথায় জলপট্টি দিয়েছে সারাটাক্ষণ। ঈশানীর সাথে সাথে ফ্লোরাও ঘুমায়নি একদণ্ড। ভোর রাতের দিকে ঘাম দিয়ে জ্বরটা কমে এলে,স্বস্তিতে ঘুমিয়ে পরে ঈশানী। ফ্লোরা নিজেও একটু বিশ্রাম নেওয়ার প্রয়াসে চলে যায় নিজের রুমে।
আর এখন একটু বেলা ফুটতেই ঈশানীর জন্য গরম গরম স্যুপ বানানোর উদ্দেশ্যে কিচেনে এসে হাজির হয় ফ্লোরা। ব্যস্ত হাতে শুরু করে কাটাকাটির কাজ। ফ্লোরার মনোনিবেশ পুরোটাই স্যুপের হাঁড়িতে নিবদ্ধ, চামচ দিয়ে আলতো হাতে নেড়ে নেড়ে স্যুপের ঘনত্ব পরিমাপ করছে ফ্লোরা। ঠিক এমন সময় সদর দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে এরীশ, ওর চোখে মুখে স্পষ্ট ক্ষুদ্ধতা, দেখেই বোঝা যাচ্ছে বিশেষ কোনো কারণে বেজায় চটে আছে সে। লম্বা পা ফেলে হনহনিয়ে দোতলায় অফিস রুমের দিকে যেতে যেতে গম্ভীর গলায় ফ্লোরাকে আদেশ করে ও বললো,
— ব্ল্যাক স্প্রেসো উইথ আউট সুগার।
যাত্রা পথে কথাটা বলে হাওয়ার বেগে দোতলায় চলে গেলো এরীশ। ফ্লোরা হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে আবারও মন দিলো সুপে, ওকে উদাস লাগছে ভীষণ। এরীশ যখন গটগটিয়ে উপরে চলে যাচ্ছিল তখনই রুম থেকে বেড়িয়ে কিচেনে উপস্থিত হয় ঈশানী। এরীশের চড়া হুকুম শুনে ওর যাওয়ার দিকে এক পল চেয়ে মেয়েটা উদাসীন ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
—- চিনি ছাড়া স্প্রেসো, ইয়াক! এতোটা তেঁতো পানীয় কেউ কি করে পান করতে পারে? উনি কি আদৌও মানুষ?
ঈশানীর আওয়াজ পেয়ে ঘুরে তাকালো ফ্লোরা, উদ্বিগ্ন হয়ে ওর কপালে আলতো হাত রেখে জ্বরের অবস্থা পরিমাপ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
— জ্বরটা এখন একদম নেই, বুঝে শুনে ঠান্ডাটা লাগিও কেমন?
ফ্লোরার কথা শুনে আন্তরিকতায় ঠোঁট প্রসারিত করলো ঈশানী, অতঃপর ওর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে কৃতজ্ঞতা জড়ানো কন্ঠে বললো,
— কাল রাতের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ ফ্লোরা।
— সত্যিই ধন্যবাদ দিতে চাও?
চোখ ছোট ছোট করে শুধালো ফ্লোরা। ঈশানী ফিক করে হেসে জবাব দিলো,
— সন্দেহ আছে?
তৎক্ষনাৎ মুখের সামনে কফির মগটা ধরে ঠোঁট উল্টালো ফ্লোরা, ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আদুরে স্বরে বলে উঠলো,
— এটা এরীশের অফিস রুমে রেখে এসো না প্লিজ, চিন্তা নেই দেখা না-ও হতে পারে, কারণ এরীশ এ সময় নিজের কক্ষে থাকে। আর যদি দেখা হয়ে যায় তাহলে..
ফ্লোরা কথা শেষ করার আগেই ঈশানী চোখ ছোট ছোট করে সন্দিহান গলায় বললো,
— তুমি কি কোনো কারণে ভয় পাচ্ছো ফ্লোরা?
নিম্ন চাউনীতে উপর নিচ হ্যা সূচক মাথা দোলালো ফ্লোরা। বললো,
— ও রেগে আছে বোধ হয়।
ঈশানী নতুন উদ্যমে শুধালো,
— তুমি এরীশকে ভয় পাও?
— তুষারকে আরও বেশি।
মিনমিনিয়ে কথাটা বলে ফ্লোরা। ঈশানী আর কথা বাড়ায় না, ফ্লোরার হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে ধীর কদমে এগিয়ে যায় এরীশের অফিস কক্ষের দিকে।
এতোক্ষণ ধরে ফ্লোরার সামনে নিজের মেকি আত্নবিশ্বাস টুকু অহর্নিশ ধরে রাখলেও, সিঁড়ি ডিঙিয়ে দোতলার করিডোরে পা রাখতে না রাখতেই ভেতরের সব আত্নবিশ্বাস যেন কর্পূরের ন্যায় উবে গেলো কোথাও। বুকের ভেতর জমে থাকা নিদারুণ আতঙ্ক আর দ্বিধাগ্রস্থতাটুকু এক পাশে সরিয়ে ভীত হরিণীর ন্যায় কুণ্ঠিত কদমে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো মেয়েটা।
কক্ষের সামনে এসে কয়েকবার শুষ্ক ঢোক গিলে মনেমনে ঈশানী বলে,
— কফিটা রেখে আসার’ই তো ব্যাপার, কিচ্ছু হবেনা। জানোয়ারটা রুমের মধ্যে না থাকলেই হলো।
মনেমনে হাজারটা শান্তিবাণি আউড়ে নিজেকেই নিজে খানিকটা ধাতস্থ করে কাঁপা হাতে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে ঈশানী। তবে ভেতরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে আচমকা থমকে গেলো ওর দু’পা, চোখের সামনে অনাকাঙ্ক্ষিত এক দৃশ্য দেখে অজান্তেই দুমড়ে মুচড়ে উঠলো ভেতরের তনু হৃদয়টা।
হৃদয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঠকঠক করে কম্পিত হলো হাতের মুঠোয় রাখা নিশ্চল কফি মগটাও। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের একটা অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্যপট মানস্পটে আটকে গেলো ভীষণ জোড়ালো ভূমিকায়। একবার, শুধুমাত্র একটা বার সামনে তাকিয়েছিল ঈশা। ঠিক তখনই অক্ষি জুগল থমকে গেলো সামনের সেই অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্যের মাঝে।
অফিস কক্ষের চেয়ারে নির্বিগ্নে মাথা এলিয়ে দিয়ে গা ছড়িয়ে বসে ছিল এরীশ। ভীষন আয়েশে চোখ দুটো করে রেখেছিল বন্ধ। এরীশের সামনেই হাঁটু গেড়ে বসে ওর নেভি ব্লু রঙা সিল্কি শার্টের বোতাম গুলো একে একে খুলে ফেলছিল অতিব সুন্দরী এক আবেদনময়ী রুশ তরুণী। মেয়েটার হাতদুটো অবলীলায় পরে ছিল এরীশের ঢেউ খেলানো বলিষ্ঠ পুরুষালী বুকের উপর।
অকস্মাৎ দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে এটুকু দেখা মাত্রই তরাগ করে চোখ নামিয়ে নিলো ঈশানী। চোখের সামনে এহেন দৃশ্য দেখে অজানা যাতনায় বিদীর্ণ হলো ওর ভেতরটা। হাত পা কাঁপছে, না জানি এরীশ ওকে কি করবে এখন। তবে তার চেয়েও বেশি যেটা হচ্ছে তা হলো কষ্ট, অজ্ঞাত কষ্টে ভেতরটা নীল হয়ে উঠেছে যেন। কারণ এতটুকুতেই আর বুঝতে বাকি নেই ঈশার , যে এই মূহুর্তে এখানে ঠিক কি হতে যাচ্ছিল। এরীশ হয়তো এই সুন্দরী রুশ মেয়েটার সঙ্গে অন্তরঙ্গ সময় কাটাতো এক্ষুনি, কিন্তু ঈশানীর আগমন বরাবরের মতোই বদলে দিলো দৃশ্যপট।
ঈশানী ভেতরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে ওকে দেখতে পেয়ে এক ধাক্কায় এরীশ নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিলো মেয়েটাকে। অযাচিত রুশ মেয়েটা হুমড়ি খেয়ে পরে গেলো মেঝেতে। সেদিকে বিন্দুমাত্র পরোয়া না করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঈশানীর দিকে বিরক্তিকর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এরীশ।যেন এক্ষুনি দু’চোখ দিয়ে ভস্ম করে দেবে ওকে।
তবে ঈশানী আর দাঁড়ায় না এক মূহুর্তও কোনোমতে কাঁপা হস্তে কেবিনেটের উপর মগটা রেখে দৌড়ে বেরিয়ে যায় অফিস রুম থেকে।
ঈশানী চলে গিয়েছে সেই কখন, এখনো করিডোরের দিকে নিশ্চল নয়নে চেয়ে আছে এরীশ। মূলত এরীশকে একটু “মি টাইম” দেওয়ার উদ্দেশ্যে তুষারই পাঠিয়েছিল সুন্দরী এই রুশ মেয়েটাকে। কিন্তু ঈশানীর ওই নীল জলরাশির মতো চোখ দুটো দেখার সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্ক এলোমেলো হয়ে গেলো এরীশের। অহেতুক রাগ হতে লাগলো রুশ মেয়েটার উপর। মেয়েটার আবেদনময়ী আলতো স্পর্শে বিরক্তিতে চিড়বিড়িয়ে উঠলো ভেতরটা,সহসা ওর বিরক্তিকর স্পর্শ সহ্য করতে না পেরে মেয়েটাকে চোখের সামনে ধাক্কা মে’রে ফেলে দিলো এরীশ।
খানিকক্ষণ বাদে চড়াৎ করে ওঠা মস্তিষ্কটা কিঞ্চিৎ শান্ত হলে নিজ হাতে শার্টের বোতাম গুলো লাগাতে উদ্যত হয় এরীশ, তখনই রুশ মেয়েটা পুনরায় কাঁধে হাত রাখলো ওর। মেয়েটার চোখে মুখে প্রবল আতঙ্কের ছাঁপ, তবুও পেমেন্টের আশায় সে সাহস করে ডাকলো এরীশকে,কন্ঠে আকুলতা টেনে বললো,
— লেট’স কন্টিনিউ স্যার।
এরীশ তৎক্ষনাৎ নিজের কাঁধ থেকে
এক ঝটকায় সরিয়ে দিলো মেয়েটার হাত,দু’আঙুলে কপাল স্লাইড করতে করতে গমগমে স্বরে বললো,
—- গেট লস্ট।
এরীশের কথায় চলে গেলো না মেয়েটা বরং ওর শরীরে হাত দেওয়ার জন্য উদ্যত হলো পুনরায় ।যার পূর্বাভাস আঁচ করতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে কোমড়ের খাঁজ থেকে রিভলবার বের করে মেয়েটার মুখের মধ্যে রিভলবারের নলটা অকস্মাৎ ঢুকিয়ে দেয় এরীশ।
এরীশের কান্ডে আত্না শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো রুশ মেয়েটার, ভয়ের চোটে চোখ দুটো বেরিয়ে আসতে চাইলো কোটর ছাড়িয়ে। মৃ’ত্যু ভয়ে জর্জরিত হয়ে মেয়েটা হাউমাউ কেঁদে ওঠে, বহু কষ্টে গলার আওয়াজ বের করে বলতে চায় কিছু। কিন্তু রিভলবারের কারণে সে আওয়াজ স্পষ্ট নয়, অগত্যা হাত জোর করে ইশারা ইঙ্গিতে এবারের মতো এরীশের নিকট নিজের প্রাণ ভিক্ষা চাইলো সে।
এরীশ নির্দয়,মেয়েটার এসব কান্নাকাটিতে ওর যায় আসেনা কিছুই। ও এক’ই ভাবে রিভলবারের নলটা দিয়ে মেয়েটার মুখ চেপে ধরে দাঁতে দাঁত পিষলো, ক্রোধান্বিত আওয়াজে বললো,
— আর এক সেকেন্ড ও যদি আমার চোখের সামনে থেকেছো, তাহলে ভেতরের লোড করা সবকটা গু’লি নিঃশ্বাস তোলার আগেই পেটে চালান হয়ে যাবে তোমার । এ্যাম আই ক্লিয়ার বিচ?
এরীশের কথায় জোরে জোরে মাথা ঝাঁকায় ক্রন্দনরত মেয়েটা।
— জাস্ট গেট লস্ট।
মেয়েটার মুখ থেকে রিভলবার সরিয়ে হুংকার দিয়ে উঠলো এরীশ, তৎক্ষনাৎ মাফিয়া বস টার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে কোনো মতে প্রাণ নিয়ে ছুটে পালালো অতিব সুন্দরী সেই রুশ তরুনি।
মেয়েটা অফিস রুম ত্যাগ করলে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধপ করে কাউচ চেয়ারে বসে পরে এরীশ। থমথমে মুখে হাত বাড়িয়ে কেবিনেট থেকে তুলে নেয় কফির মগটা, তেঁতো কফিটা ঠান্ডা হওয়ার দরুন স্বাদটা বিস্বাদে পরিনত হয়ে গিয়েছে পুরোপুরি। কাউচে গাঁ এলিয়ে দিয়ে আপাতত সেই বিশ্রী স্বাদের কফিটা’ই চোখ বন্ধ করে উপভোগ করায় ব্যস্ত এরীশ।
* চোখ খিঁচে দৌড়াতে দৌড়াতে একপর্যায়ে ঈশানী গিয়ে পৌছাল খোলা ছাঁদ বারান্দায়। বাইরে আজ রোদ উঠেছে বেশ। সূর্যের মৃদু রশ্মিতে গলতে শুরু করেছে পায়ের নিচের কঠিন বরফের আস্তর। এতোক্ষণ ধরে ছুটে আসার দরুন হাঁপাচ্ছে ঈশা, আজ বহুদিন বাদে একটুখানি খোলা আকাশ দেখলো ও, মনটা তাও বিষন্ন।
খানিকক্ষণ আগের দৃশ্যটা ক্রমাগত ভেসে উঠছে মানস্পটে। এরীশের মতো একটা নির্দয় মাফিয়া বসের জন্য কষ্ট হওয়ার কথা ছিলনা কোনো কালেই , এরীশ ওর অত্যাচারী, ঈশানীর এই করুন পরিনতির পেছনে একমাত্র দায়ী এরীশ ইউভান। তবুও ওই অপ্রীতিকর দৃশ্যটুকু দেখার পর থেকে হৃদয়ের কোথাও একটা পুড়ছে খুব। বুকের ভেতরে রয়ে যাওয়া এই সুপ্ত ভেজা ভঙ্গুর অনুভূতি গুলো ঘৃণা করে ঈশানী। বড্ড ঘৃণা করে। কারণ সেই প্রথমদিন থেকে এই অবাধ্য অনুভূতিরা’ই ওর ভেঙে যাওয়ার একমাত্র কারণ।
সহসা ভেতরের অযাচিত কষ্ট গুলো একপাশে সরিয়ে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে ছাঁদ বারান্দার কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়ালো ঈশু। শীতের সকালে পিঠ পিছলে যাওয়া কোমল রোদটুকু স্বর্গের মতোই আরামদায়ক ঠেকছে শরীরে । অদূরে কোনো এক ধর্মশালা থেকে ঢং ঢং করে ভেসে আসছে গীর্জার প্রতিধ্বনি। তার পাশেই নাম না জানা পাখির কিচিরমিচির কলরব। হুট করেই আজ সকালটা ভীষণ পবিত্র আর স্নিগ্ধ ঠেকছে ঈশানীর নিকট। চোখ বুঁজে নাক টেনে স্নিগ্ধ সতেজ বাতাসটুকু ভেতরে পুরে একাই বিড়বিড়ালো ও,
—- এতো এতো পবিত্রতা আর স্নিগ্ধতার মাঝে আমি এক অন্ধকারাচ্ছন্ন পাপের দুনিয়ায় আটকা পরে আছি। যেখানে না আছে মুক্তি আর না আছে মৃ’ত্যু।
উপহাসের সুরে কথাটা বলতে গিয়ে’ই গলা ধরে এলো ঈশানীর। কান্নারা একযোগে দলা পাঁকিয়ে বিদ্রোহ করে উঠলো কন্ঠনালীতে। অবশেষে না চাইতেও বুকের ভেতরে বইতে থাকা প্রবল জলোচ্ছ্বাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে দু’ফোঁটা অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ে সরলতার গাঢ় নীল চোখের কার্নিশ বেয়ে।
ঠিক সে’সময় কোথা থেকে যেন একটা ধবধবে সাদা পায়রা উড়ে এসে ঠায় নিলো ঈশানীর সরু কাঁধের উপর। অগত্যা অতিথির আগমনে কান্নাকাটিতে লাগাম টানলো ঈশানী। কাঁধ থেকে এনে আলগোছে দু’হাতে আগলে ধরলো পায়রাটি কে। আশেপাশের কোনো চার্চ থেকে পালিয়ে এসেছে বোধ হয়, শ্বেতরঙা অপ্সরার ন্যায় পায়রাটাকে মুখের সামনে ধরে ওর কপালে কপাল ঘষে আদুরে গলায় ঈশু বললো,
—- এই ঠান্ডার মাঝে পালিয়ে আসার আর জায়গা পেলিনা? এটা অহংকারী এরীশের পাপের রাজত্ব, এখানে ভুল করেও কেউ আসে বোকা মেয়ে? চল তোকে খাবার দিই।
আদুরে আলাপন শেষে নীড় হারা অবলা পাখিটাকে সঙ্গে নিয়েই পেন্ট হাউজের ভেতরে চলে যায় ঈশানী।
গত বেশ কিছুদিন ধরেই পেন্ট হাউজে আনাগোনা নেই এরীশের। আর এরীশ পেন্ট হাউজে না থাকার মানে হলো সেই কটা দিন নির্দিষ্ট একটা গন্ডির মধ্যে থেকেই মুক্ত আকাশে ডানা ঝাপ্টানো পাখির ন্যায় আনন্দে উল্লাসে দিন কেটে যায় ঈশানী আর ফ্লোরার। খুশির দিনগুলোতে মন খারাপ ছুঁতে পারেনা ওদের। দুঃখ গুলো পাছে হটিয়ে নিগূঢ় উল্লাসে সর্বক্ষন মেতে থাকে দু’জন। আজ তেমনই একটা দিন। এরীশ তুষার কেউই পেন্ট হাউজে ফেরে না ইদানীং। নিশ্চয়ই কোনো মিশন ফিশনে আটকা পরেছে তারা।
ওদিকে আজ সকাল থেকেই বৃষ্টির গতিতে তুষারপাত হচ্ছে আকাশ ছাপিয়ে ।ভেলভেটের ন্যায় মসৃণ শুভ্র তুষারের আড়ালে ঢাকা পরেছে প্রকৃতি। অথচ এই বিরূপ আবহাওয়ার মাঝেই এক বালতি জামাকাপড় ভিজিয়ে উদাস মুখে বসে আছে ফ্লোরা, ওর চোখে মুখে আহাজারি সুস্পষ্ট। মেয়েটাকে এমন মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখে ঈশানী ভ্রু কুঁচকে বললো,
— এ্যাই মেয়ে,মাফিয়াদের সঙ্গে থাকতে থাকতে আক্কেল জ্ঞান কি সব সাবান ফেনার সাথে গুলে খেয়েছো নাকি?
— এভাবে কেন বলছো?
বিরস মুখে ঠোঁট উল্টালো ফ্লোরা।
— এভাবে বলবো না তো কিভাবে বলবো? ঘরে এতোগুলা ওয়াশিং মেশিন থাকতে তুমি বালতি ভরে কাপড় কেন ভিজিয়েছো ? এখন এগুলো কই শুকোতে দেবে শুনি ?
— তুষার হাতে পরিষ্কার করা জামা কাপড় ছাড়া একদম পড়েনা, ওইজন্যই তো।
— বুঝলাম।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে কথাটা বলে ঈশানী। কিন্তু এই সময় এমন মনমরা মলিন চেহারার ফ্লোরাকে দেখতে একদম ভালো লাগছে না ওর। তাই ওকে হাসানোর চেষ্টায় দুষ্টুমি করে ভেজানো কাপড় থেকে একটুখানি সাবান ফেনা নিয়ে লাগিয়ে দিলো ফ্লোরার নাকের ডগায়। এই একটুখানি দুষ্টুমিতে গা ভাসিয়ে ফ্লোরা নিজেও যে ঈশানীর সঙ্গে পাঙ্গা দিয়ে ফেনা মাখামাখি শুরু করে দেবে সেটা বোধ হয় কল্পনাতেও অনুমান করেনি ঈশু।যার ফলস্বরূপ কয়েকমূর্হুতের মাঝে পুরো লাউঞ্জ জুড়ে জলকেলি শুরু করে দিয়েছে ওরা দুজন। ওদের খিলখিল হাসির শব্দ আর অনর্গল ছোটাছুটিতে হুট করেই যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে বিস্তৃত জঙ্গলের মাঝে অবস্থিত মৃ’ত্যু পুরির ন্যায় নির্জীব এই মাফিয়া পেন্টহাউজ।
ক্লাব থেকে মাত্রই পেন্ট হাউজে ফিরেছে এরীশ। ইদানীং পাইথন প্যারাডাইসের বিভিন্ন বিজনেস ক্লাবে ডেনিয়েলের বেশকিছু স্পাই ঢুকে পড়েছে। কয়েকজন কে অবশ্য সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে গার্ড’সরা। তবে এরীশ এখনো চুপচাপ অনুসরণ করে যাচ্ছে তাদের। কারণ তাদের এবারের টার্গেট এরীশের প্যারাডাইস নয় বরং অন্যকিছু যার প্রেক্ষিতে এরীশ আর তুষার দু’জনই ডেনিয়েলের উদ্দেশ্য জানার জন্য কিছুদিন ধরেই ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে সনাক্তকৃত স্পাইদের আশেপাশে।
দু’দিন ধরে না ফিরলেও আজ হুট করেই পেন্ট হাউজে ফিরে এসেছে এরীশ। পরনে তার কালো হুডি আর কালো বেসবল ক্যাপ। মোট কথা আগাগোড়া কালো দিয়ে মোড়ানো তার শরীর। বাইরে থেকে ফেরার দরুন কালো হুডির যত্রতত্র জমে আছে পেজা তুলোর মতো শুভ্র বরফ কুঁচি। কালো কুচকুচে হুডির উপর ঝুরঝুরে বরফ কণাগুলো সফেদ হীরকের ন্যায় চিকচিক করছে ওর সমস্ত শরীরে।
সদর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে বড়বড় পা ফেলে হনহনিয়ে দোতলার দিকে এগুচ্ছিল এরীশ, ঠিক তখনই লাউঞ্জ থেকে ভেসে আসা অপার্থিব এক খিলখিল হাসির ঝঙ্কারে অকস্মাৎ মাঝপথে পা’দুটো থমকে যায় লম্বাটে লোকটার।
একটা সুমিষ্ট প্রাণচঞ্চল হাসির তরঙ্গে অভাবনীয় মাদকতা ছড়িয়ে পরে এরীশের কর্ণকূহুরে, যার দরুন নিজের অজান্তেই পুরোপুরি নিশ্চল হয়ে পরে ও। জীবনে প্রথমবার নিজের পেন্টহাউজে দাঁড়িয়ে এমন কিছুর মুখোমুখি হলো এরীশ। এমন মেয়েলী হাসির আওয়াজে কোনোরূপ ভাবান্তর হওয়ার কথা ছিল না ওর মাঝে, কিন্তু এই মূহুর্তে কিছুতেই এই প্রাণবন্ত হাসিটুকু উপেক্ষা করে সামনে এগুতে পারছে না এরীশ । কোনো এক অদৃশ্য মায়াজাল চলন্ত পা দু’টোকে নিদারুন শক্তিবলে করে রেখেছে স্থির আর অচল ।
সহসা সেখানে দাড়ানো অবস্থাতেই লাউঞ্জ থেকে ক্রমাগত ভেসে আসা হাসির আওয়াজ অনুসরণ করে তৎক্ষনাৎ এক ঝটকায় মাথার হুডিটা সরিয়ে পেছনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এরীশ। এই প্রথমবার ঈশানীকে এভাবে প্রাণ খুলে হাসতে দেখে কয়েক সেকেন্ডের মাঝে গতি হারায় ভেতরের অন্তঃকরণ।
মাথা থেকে হুডি খোলার সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরে লেগে থাকা ক্ষুদ্র বরফ কণাগুলো ঝরঝর করে ছড়িয়ে পরে সমগ্র মেঝেতে। তকতকে শ্বেত পাথরের মেঝেটা ভরে ওঠে নোংরা জলে। তাতে ও কোনোরূপ ভ্রুক্ষেপ নেই এরীশের। কারণ হুডি সরিয়ে পেছনে দৃষ্টিপাত করতেই এরীশ দেখতে পায় একটা অপরুপা নীল চোখের মেয়েকে। যে হাসছে, খিলখিলিয়ে হাসছে, তার হাসিতে মুখরিত হয়ে আছে সমগ্র পেন্টহাউজ। মেয়েটার ঢলঢলে আদুরে মুখমণ্ডল জুড়ে ফেনায় মাখামাখি, তবুও তার হাসির ঝঙ্কার যেন অতুলনীয় এক বাদকের বাজানো মাদকীয় বাজনা।
তার প্রানোচ্ছল হাসির রিমঝিম আওয়াজ যেন কর্ণকূহর ছাপিয়ে বহুবছর ধরে তালা লাগানো এরীশের হৃদগহীনে কড়া নেড় গেলো আচমকা । নিজের অজান্তেই সেই তখন থেকে নিস্প্রভ ক্লান্তিহীন চোখে মেয়েটার হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে অবাক দৃষ্টিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে এরীশ। ওর নিগূঢ় চাওনী দেখে মনে হচ্ছে, নীলাম্বরীর খিলখিল হাসির মাঝে এই মূহুর্তে পুরো দুনিয়া থমকে আছে ওর।
ফ্লোরার সঙ্গে দুষ্টুমির একপর্যায়ে ঈশানীর চোখ আঁটকে যায় সিঁড়ির সামনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিষ্ঠুর মানবের চোখে। অগত্যাই বিনা দ্বিধায় মিলন ঘটে দু’জোড়া অক্ষি জুগলের। ঈশানী খেয়াল করলো এরীশ ঘাড় বাঁকিয়ে অনুভূতিহীন চোখে ওর দিকেই একধ্যানে চেয়ে আছে শুধু । এরীশের এহেন অহেতুক নিস্প্রভ চাউনীতে ভড়কে যায় ঈশু,মূহুর্তেই মলিনতা ঘীরে ধরে নীলাম্বরির সমগ্র মুখমণ্ডল জুড়ে ।
ভীত স্বতন্ত্র আড় চোখে আরও একবার এরীশকে পরখ করে তাড়াহুড়ো করে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে ঘুরে দাড়ালো ঈশানী।
আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ১৪
ঈশানী ওপাশ ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে চোখের পলক ছাড়ে এরীশ। পরক্ষনেই ধ্যান ভেঙে নিজের চিরাচরিত সত্তায় ফিরে এসে সামনে ঘাড় ঘুরিয়ে তড়িঘড়ি করে লম্বা পা ফেলে সিঁড়ি ভেঙে সোজা এগিয়ে যায় দোতলার অফিস রুমের দিকে। যেতে যেতেই বুকের বাম পাশে হাত বুলিয়ে আনমনে বিরক্তির স্বরে বিড়বিড়ায় সে,
— শীট! এগেইন সামথিং ইজ বার্নিং ইন মাই চেস্ট।