আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ১৬
suraiya rafa
সমগ্র লাউঞ্জ জুড়ে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে এখন। থেমে গিয়েছে একটু আগের হাসির কলরব। মাফিয়া বস টা পেন্টহাউজে ফিরে আসা মাত্রই বদলে গিয়েছে সকল দৃশ্যপট, সে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গিয়েছে খুশির ঝিলিক, আনন্দঘন মূহুর্ত সব । অজানা ভয়ে জর্জরিত হয়ে এককোণে চুপসে দাঁড়িয়ে আছে ঈশানী আর ফ্লোরা। মাফিয়া বসের কালো দুনিয়ায় কখনো এমন প্রাণোচ্ছল হাসির আওয়াজ শোভা পায়না। তাইতো এরীশ ফিরে আসার পর মূহুর্তেই নিস্তব্ধ মরিচীকার আড়ালে বিলীন হয়ে গিয়েছে হাসির ঝঙ্কার, যেন স্বকীয়তা ফিরে পেয়েছে তার পাপের রাজ্য।
সবকিছু থমথমে হয়ে আছে, তাও মনে হচ্ছে একটু আগের খিলখিল হাসির আওয়াজ এখনো বারি খেয়ে ক্রমাগত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে কালো পেইন্টিং এর চার দেওয়ালে । এরীশ বড়বড় পা ফেলে করিডোর ধরে সামনে এগুচ্ছে, কপালে তার দুশ্চিন্তার তীক্ষ্ণ ভাঁজ, চেহারায় স্পষ্ট ব্যতিগ্রস্ততা। কর্ণকূহর ছাপিয়ে মস্তিষ্ক অবধি প্রতিটি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন নিয়ন্ত্রণ হীন আজ। এরীশ বিরক্ত হয়,হাঁটার গতি ধীর করে ফের ঘাড় বাকিয়ে তাকায় লাউঞ্জের দিকে, ঈশানী মেয়েটা আড় চোখে এদিকেই চেয়ে আছে, সেই নীলাম্বর সরলতায় ঘেরা এক জোড়া ভীত সন্ত্রস্ত জ্বলজ্বলে নেত্রদ্বয়। যা দেখলে বারবার বেঈমান হয়ে ওঠে ওর হৃদয়টা, চৌম্বকীয় এক অদৃশ্য শক্তিবলে নিস্তেজ করে দেয় ভেতরের হিংস্র পাশবিক সত্তাটাকে। যা এরীশের মস্তিষ্ক ঘৃণা করে, প্রচন্ড ঘৃণা। এই মেয়েটাকে কখনোই নিজের কড়াপড়া পাথর হৃদয়ের নিয়ন্ত্রক হতে দেবে এরীশ, কিছুতেই না।
নাহ! আর নেওয়া যাচ্ছে না। কোনো এক অজানা কারণ বশত প্রচন্ড ক্ষুদ্ধতায় চোয়াল শক্ত করে গজরাতে গজরাতে অফিস রুমে ঢুকে যায় এরীশ। ভেতরে গিয়ে টিশার্টের উপরে পরিহিত ভেলভেটের হুডিটা শরীর থেকে একটানে খুলে ছুড়ে ফেলে দেয় সফেদ মেঝেতে। মন মস্তিষ্কের এহেন নিয়ন্ত্রণহীন ভাবনা মোটেই গ্রহন করতে পারছে না এরীশ। অগত্যাই রাগে কাঁপতে কাঁপতে কঠিন স্বরে দাঁতে দাঁত পিষে বলে ,
— একটা তুচ্ছ মেয়ের হাসি দেখে থমকে যাওয়া কখনো এরীশ ইউভানকে শোভা পায়না। গ্যাংস্টার এরীশ কখনো পবিত্রতায় আটকায় না। নেক্সট টাইম এরীশ ইউভানের মস্তিষ্কককে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে ওই মেয়েটাকে তার উপযুক্ত জায়গা বুঝিয়ে দেবো আমি।
এরীশের পৈশাচিক মস্তিষ্কটা তীব্র রাগে গজগজ করতে করতে ঈশানীর উপর ক্ষোভ ঝাড়লেও ওর নিয়ন্ত্রণহীন মনটা বিদ্রুপাত্তক হেসে উপহাস করে বললো,
— একটু আগে সেটাই করছিলি যেটা তুই প্রচন্ড ঘৃণা করিস। যে জিনিস গুলোর সাথে তোর এ জীবনে কখনো পরিচয় হয়নি, তোর মরিচীকার মতো অন্ধকার জীবনে যে গুলো নিছকই মূল্যহীন, সেই জিনিস গুলোতেই বারবার আটকে যাচ্ছিস তুই।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
— জাস্ট স্টপ ইট।
আবার সেই বিদ্রুপাত্তক নিয়ন্ত্রণহীন ভাবনায় দিশেহারা হয়ে নিজেকেই নিজে ধমকে উঠলো এরীশ। ক্রোধের তোপে ভলভল করে মাথায় রক্ত উঠে গেলো ওর। সুদর্শন অথচ হিংস্র ব্লাডিবিস্ট মাফিয়াটা পারছে না নিজের ভাবনাকে নিজেই গলা টিপে মে’রে ফেলতে।যার দরুন ক্ষুদ্ধতার চরম সীমানায় গিয়ে প্রচন্ড ক্রোধে অফিস রুমের সবকিছু দু’হাতে তছনছ করে দেয় এরীশ, অত্যন্ত দামী ডিজাইনার টি-পট, রেড ওয়াইনের বোতল, পি.সি, মনিটর, সেন্টার টেবিল, জানালার কাঁচ এমনকি ইলেকট্রনিক ডিভাইস সবকিছু উল্টে পাল্টে ফেলে সেগুলোকে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ঘু’ষি মে’রে ভাঙতে ভাঙতে হুংকার দিয়ে এরীশ বলে,
—- সব দোষ ওই মেয়েটার, সব দোষ ওর। আমি ওকে দু’চোখে দেখতে চাইনা, কোনোদিন না।
সেই তখন থেকে উপর তলায় ঝনঝন করে কাঁচ ভাঙার আওয়াজ ভেসে আসছে, প্রতি সেকেন্ড অন্তর ভূমিকম্পের মতো কম্পন দিয়ে উঠে এটা-ওটা ছুটে এসে অকস্মাৎ আঁচড়ে পরছে নিচ তলার লাউঞ্জে। কখনো ভাঙা কাচের টুকরো আবার কখনো আস্ত মনিটর। লাউঞ্জের এককোণে গুটিসুটি মে’রে দাঁড়িয়ে আছে ফ্লোরা আর ঈশানী, ভয়ের চোটে আত্মাটা যেন ঠোঁটের আগায় উঠে এসেছে তাদের। দোতলার এই বেগতিক লন্ডভন্ড তান্ডবের জন্য যে ঈশানী নিজেই দ্বায়ী, তা জানা নেই স্বয়ং ঈশানীর। তাইতো উপর তলার ধুমধাম ভাঙাচোরার আওয়াজ উপেক্ষা করে, জিভ দিয়ে নিজের শুষ্ক অধর ভিজিয়ে নিচু গলায় ফ্লোরাকে শুধালো,
— কি হয়েছে বলোতো?
ঈশানী কথাটা বলতে না বলতেই উপর থেকে একটা ভাঙা টি-পটের টুকরো এসে আচমকা আঘাত করলো ঈশুর কপালে,তৎক্ষনাৎ গলগল করে তাজা র’ক্তস্রোত বেরিয়ে এলো ওর কপাল কেটে।
প্রচন্ড ব্যথা পেয়ে চোখ দু’টো খিঁচে বন্ধ করে নিয়েছে ঈশা। ওর কপাল চুয়িয়ে টুপটুপ করে র’ক্ত গড়িয়ে পরছে দেখে ফ্লোরা তড়িঘড়ি করে হাত চেপে ধরে সেখানে, আস্তে করে ভয়ার্ত ঢোক গিলে আহত গলায় বলে,
— এটা কি হয়ে গেলো তোমার ঈশু? আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না এরীশ হঠাৎ এমন পাগলামি কেন করছে? ও তো কখনো এমন করে না।
নীল নীল চোখ দুটো মেলে টলটলে ব্যথাতুর চাহনীতে ঈশানী তাকায় এরীশের অফিস রুমের দিকে, ভঙ্গুর হৃদয়টা আলগোছে চেপে রেখে মনেমনে আওড়ায়,
— আপনি আমার জীবনের সেই অভিশপ্ত অধ্যায়,যে এক রাতের জন্য বাঁচাতে এসে, সারাজীবনটা পু’ড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছেন।
ঈশানী তাকিয়ে ছিল নিস্প্রভ। উপরের ভাঙাভাঙির আওয়াজ কিঞ্চিৎ কমে এসেছে এখন। ওর কপালের র’ক্ত খানিকটা শুকিয়ে এলে ফ্লোরা হাত সরিয়ে বললো,
—- তুমি এখানে একটু অপেক্ষা করো আমি এই সুযোগে ওদিকে গিয়ে ফাস্ট এইড বক্সটা খুঁজে নিয়ে আসি।
কথা শেষ করে সাবধানে সামনে পা বাড়ালে পেছন থেকে ওর ফিনফিনে হাঁটু সম ফ্রকটা টেনে ধরে ঈশানী। শরীরে টান অনুভব করে ফ্লোরা পেছনে ঘুরলে ঈশানী এক পল ছেড়ে আকুতির স্বরে বলে,
— যেও না, ভয় করছে। যদি আবার…
ফ্লোরা মৃদু হাসলো, যেন এতোক্ষণের তান্ডব কিছুই নয় ওর কাছে, এর থেকে ভয়াবহ দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত ও। সেভাবেই ঠোঁটের আগায় হাসি টুকু ধরে রেখে ঈশুকে আস্বস্ত করে বললো,
— কিচ্ছু হবেনা দাড়াও দেখছি।
এই বলে দু’কদম সামনে এগিয়ে দোতলার দিকে উঁকি ঝুঁকি দেয় ফ্লোরা,তৎক্ষনাৎ উপর থেকে ছিটকে পরে আরও একখানা আধভাঙ্গা কাচের বোতল। বোতলটা ফ্লোরার দিকে এগিয়ে আসছে ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই ফ্লোরা হকচকিয়ে যায়।
হুট করে ঠিক কি করবে বুঝে উঠতে না উঠতেই বাহুতে সজোরে টান অনুভব করলো ও। দু’বাহু শক্ত হাতে চেপে ধরে হ্যাঁচকা টানে ওকে অন্যপাশে নিয়ে দাঁড় করালো তুষার। অকস্মাৎ ঘটনায় আহাম্মক বনে গেলো ফ্লোরা, চকিতে ঘুরে তাকালো তুষারের পানে।
— ঠিক আছো?
ভাবলেশহীন গলায় ঠোঁট নাড়িয়ে ছোট্ট করে প্রশ্ন ছোড়ে তুষার।
— উমম? হু হু।
উত্তরে তাড়াহুড়ো করে হ্যা সূচক মাথা নাড়ায় ফ্লোরা। তুষার ওকে ছেড়ে দিয়ে পকেটে হাত গুঁজে সটান দাড়িয়ে র’ক্তাক্ত ঈশানী আর পারিপার্শ্বিক অবস্থা লক্ষ্য করে কপাল কুঁচকে স্পষ্ট স্বরে জিজ্ঞেস করে,
—- কি হয়েছে, ঘরের এই অবস্থা কেন?
উপর তলার অফিস কক্ষের দিকে আঙুল তুলে জড়ানো কন্ঠে ভাঙা ভাঙা শব্দ উচ্চারণ করলো ফ্লোরা,
— এ এ.. এরীশ!
এরীশের নামটা শোনা মাত্রই কপাল কুঁচকে এলো তুষারের,আশ্চর্য হয়ে বললো,
— এরীশ এসব করেছে মানে?
চিবুক গলায় ঠেকিয়ে ধীর গতিতে মাথা নাড়ালো ফ্লোরা। তুষার আর কথার পুনরাবৃত্তি করলো না কোনো, মাথার হুডিটা খুলে দ্রুত কদমে এগিয়ে গেলো অফিস কক্ষের দিকে।
করিডোর ছাড়িয়ে রুমের সামনে আসতেই তুষার দেখলো মস্ত বড় কালো কাঠের নান্দনিক দরজাটা হাট করে খোলা, আশেপাশে গার্ড’সদের উপস্থিতি নেই। এরীশের আগমনে তারা হয়তো জায়গা ত্যাগ করেছে বহু আগে। আশ্চর্য হওয়ার কোনো বিষয় নয় এটা। সহসা এগিয়ে গিয়ে রুমের মাঝে পা বাড়ালো তুষার। সাজানো গোছানো বিস্তৃত অফিস রুমটা ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে আছে, ইলেকট্রনিক ডিভাইস গুলো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে যত্রতত্র।
মাফিয়ারা সাধারণত যোগাযোগের কাজে সমসাময়িক মাধ্যম গুলো এড়িয়ে চলে সবসময়। হয় অতি পুরোনো দিনের এনালগ ডিভাইস গুলো ব্যবহার করে, নয়তো শেয়ার মার্কেট থেকে বিতারিত বহুল ক্ষমতাসম্পন্ন অত্যাধুনিক ডিভাইস গুলো দিয়ে সমগ্র ই-কমার্সের দখলদারি নিয়ে রাখে। সেই সব কাজে নজর রাখার জন্যই বেশ কিছু ফ্যাক্স মেশিন আর মনিটর সেট করা ছিল এই রুমে।
আপাতত সেগুলো একটাও অক্ষত অবস্থাতাতে নেই। এরীশ ইউভানের রাগের সম্মুখীন হয়ে জীবন হারিয়েছে অনেক আগেই । সমস্ত ঘর লন্ডভন্ড, জিনিস পত্রের যা-তা অবস্থা, তার চেয়েও বেশি খারাপ অবস্থা রুমের মাঝে কাচের দেওয়ালটার। দেওয়ালটা ভেঙে চৌচির,তার ঠিক মাঝ বরাবর লেগে আছে টকটকে তাজা র”ক্ত। স্পষ্ট র”ক্তের ছাপ দেখা মাত্রই রুমের চারিদিকে দৃষ্টিপাত করে তুষার খুঁজতে লাগলো এরীশকে। ডানে-বামে সচকিত নজর বুলিয়ে পেছনে ঘাড় ঘোরাতেই দেখতে পেলো কাঙ্ক্ষিত সেই মুখ ।
দরজার কাছের কাউচ চেয়ারটায় শরীর ছেড়ে দিয়ে বসে আছে এরীশ। আগাগোড়া বিধ্বস্ত সে, উরুর উপর নির্বিগ্নে ফেলে রাখা ডান হাতটা থেকে চুয়িয়ে চুয়িয়ে পরছে টকটকে তাজা লাল র’ক্ত। সেই কাটা হাতটার দিকেই ধ্যান মগ্ন হয়ে তাকিয়ে আছে এরীশ, যেন এই রক্ত গুলো খুবই আকর্ষনীয় কোনো বস্তু, যা ও অবলীলায় দেখতে পাচ্ছে।
এরীশের এহেন উদ্ভ্রান্ত অবস্থা খানিকক্ষণ অবলোকন করে তুষার নিরেট কন্ঠে শুধালো,
—কি এমন দোষ করেছিল কাচের দেওয়ালটা? যার জন্য এভাবে পাঞ্চ মে’রেছেন?
র’ক্তাক্ত হাতের দিক থেকে চোখ সরালো এরীশ, তুষারের দিকে এক পল চেয়ে পুনরায় চোখ ঘুরিয়ে কাউচে মাথা এলিয়ে দিয়ে ক্লান্তস্বরে বললো,
— এরীশ কাউকে কৈফিয়ত দেয়না তুষার।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো তুষার। এটাই হওয়ার ছিল। ও জানতো এরীশ এমন কিছুই বলবে, তাই আশাহত হয়ে শান্তস্বরে বলে উঠলো,
— র’ক্ত ঝড়ছে ব্যান্ডেজ কি আমি করে দেবো?
তুষার বাক্যটুকু উচ্চারণ করা মাত্রই চকিতে মাথা তুলে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে ওর দিকে চাইলো এরীশ। ওর সন্দিহান চোখের ভাষা বুঝলো তুষার, অগত্যা তৎক্ষনাৎ গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
— এহেম এহেম, না মানে তাহলে কি ফ্লোরাকে ডেকে দেবো?
— প্রয়োজন নেই।
— তাহলে কি মিস ব্লু..
তুষার বাক্যটুকু শেষ করার আগেই তরাগ করে ক্রোধান্বিত হয়ে উঠলো এরীশ,তুষারের মুখের উপর গর্জন করে বললো,
—- জাস্ট কিপ ইওর মাউথ শাট তুষার ! আমার সামনে ওর নাম উচ্চারণ করবে না একদম।
কিয়ৎক্ষন জহুরি চোখে পরখ করে এতোক্ষণে তুষারের বোধগম্য হলো এতোসব পাগলামির পেছনে মূল হেতু তাহলে ওই একজন’ই। যার জন্য নিজের অজান্তেই বারবার লক্ষ্যচ্যুত হয় এরীশ ইউভান। এই মেয়েটা এরীশের আশেপাশে বেশিদিন থাকলে ঠিক কোনো না কোনো অঘটন বাঁধিয়ে বসবে সে। হতেও পারে ক্ষোভের বশে bravta এর নিয়ম কানুনকে একহাত দেখিয়ে একটা সাধারণ মেয়ের জন্য ডেনিয়েল কে শেষমেশ খু’ন’ই করে বসলো এরীশ ।
কারণ এর আগে এরীশ কে কখনো এভাবে বারবার লক্ষ্যচ্যুত হতে দেখেনি তুষার। ঈশানীই একমাত্র মেয়ে যে কিনা সোনার ডিম পারা হাঁস হওয়া সত্ত্বেও এরীশের মতো একটা হৃদয়হীন মানুষের কাছে এতোগুলো দিন ধরে সুরক্ষিত রয়েছে। কিন্তু আজ নয়তো কাল প্রতিশোধ পরায়ণ ডেনিয়েল ঈশানীকে ঠিকই তুলে নিয়ে গিয়ে চড়া দামে বেঁচে দেবে। নিশ্চয়ই সেটা এতো সহজে বর্দাস্ত করবে না এরীশ । তখন কি হবে? এরীশই বা ঠিক কি কি করবে এই মেয়েটার জন্য?
ভাবতে ভাবতে অজানা শঙ্কায় থমথমে হয়ে গেলো তুষারের মুখমন্ডল। সে ঠোঁট কামড়ে ডুবে যেতে লাগলো নিদারুণ অযাচিত ভাবনায়।
— কিছু ভাবছো?
এরীশের ডাকে ভ্রম কেটে গেলো তুষারের, সে নিজের সত্তায় ফিরে এসে দু’বার হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে গমগমে স্বরে বললো,
— আপনাকে একবার ক্লাবে যেতে হবে এরীশ।ইট’স আর্জেন্ট।
জিভ দিয়ে গাল ঠেলে কিছু একটা ভেবে কয়েক সেকেন্ডের মাঝে উঠে দাঁড়ালো এরীশ। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাচের টুকরো গুলো পায়ে মা’রিয়ে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে । সুবিশাল ডেস্কের উপর লাগোয়া কাচটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে, এরীশ সে’সবে তোয়াক্কা না করে হাত বাড়িয়ে ড্রয়ার খুলে একটা এ্যালকোহলের বোতল বের করে মুখ দিয়ে টেনেটুনে সেটার ছিপি খুলে পুরো বোতল ভর্তি পানীয়টুকু ঢেলে দেয় নিজের র’ক্তাক্ত হাতের উপর।ক্ষতস্থানে এ্যালকোহল লাগার সঙ্গে সঙ্গে জলন্ত অঙ্গারের ন্যায় ঝলসে উঠলো হাতটা। এহেন দৃশ্য দেখে চোখমুখ খিঁচিয়ে ফেললো তুষার। তুষারের শঙ্কিত চাউনী দেখে ফিচেল হেসে এরীশ বললো,
— তুমি না গ্যাংস্টার? এইটুকুতেই শঙ্কিত হচ্ছো?
তৎক্ষনাৎ চোখের দৃষ্টির পরিবর্তন ঘটালো তুষার, চোখ মুখ স্থির করে বললো,
—-হ্যা গ্যাংস্টার। তাই বলে নিজেকে এভাবে হাসতে হাসতে যন্ত্রনায় ডুবিয়ে দেওয়ার মতো এতটাও ক্রুয়েল আমি নই।
তুষারের কথায় কোনোরূপ প্রত্যুত্তর করলো না এরীশ, ঠোঁটের আগায় ফিচেল হাসিটুকু অবহ্যত রেখেই বাম হাতের সাহায্যে এবরো থেবরো করে বেঁধে ফেললো ব্যান্ডেজ টা। অতঃপর ব্যন্ডেজ করা হাতটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে মনেমনে উপহাসের স্বরে বললো,
— এটা মোটেই যন্ত্রনাদায়ক ছিল না তুষার ।এর চেয়ে ও বেশি যন্ত্রনা হচ্ছে অন্য কোথাও।
— তাহলে যাওয়া যাক?
তুষারের কন্ঠস্বর কর্ণগহ্বর ছুঁতেই নিজের পৈশাচিক সত্তায় ফিরে এলো এরীশ। অফিস রুমের ক্লজেট থেকে একটা ব্ল্যাক ওভার কোট আর বাকেট হ্যাট বের করে গায়ে চড়িয়ে নিলো সেগুলো । অতঃপর জিভ দিয়ে গাল ঠেলে নিজের পিয়ার্সিং করানো ভ্রু টা দু’আঙুলের সাহায্যে খানিক চুলকে তুষারের উদ্দেশ্য প্রশ্ন ছুড়লো সে ।
— সবাই রেডি তো?
হ্যা সূচক মাথায় তুষার, এরীশ কোমড়ের খাঁজে দু’টো রিভলবার আর একটা লোকেশন ট্র্যাকার গুঁজে নিয়ে অফিস রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে তুষারকে আদেশ করে বললো,
— লেট’স গো।
এতোক্ষণ ধরে এতোকিছু করে নিজের সঙ্গে নিজেই অবিরত দাঙ্গা, দামামা চালিয়ে, মন মস্তিককে হাজারটা নিয়ন্ত্রক বেড়িতে আবদ্ধ করে, অবশেষে লাউঞ্জে পা রাখতে না রাখতেই আবারও সেই পুতুলের মতো ঢলঢলে সুশ্রী সরল মুখটা চোখের সামনে এসে হানা দিলো এরীশের।
শুধু কি হানা দিয়েছে? একেবারে চঞ্চলা হরিণীর মতো তিরিং বিরিং করে লাফিয়ে এসে সোজা বুকের উপর হামলে পরেছে।
লাউঞ্জে আপাতত কারোর’ই উপস্থিতি নেই। ফ্লোরা নিজের রুমে শুয়ে। তুষার এখনো অফিস কক্ষেই রয়েছে। অথচ এরই মাঝে ঘটে গেলো অঘটন। পুরুষালী ক্লোনের মাস্কি সুঘ্রাণটা নাক ছাপিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠে ছিটকে এরীশের থেকে দূরত্ব বাড়ায় ঈশানী। হাতের দিকে তাকালে দেখতে পায়, হাতের মাঝে গমের দানা গুলো অনুপস্থিত। মেঝেতে পরে আছে দু’একটা, তাহলে বাকি গুলো কোথায়?
ফলস্বরূপ গমের সন্ধানে ধীরে ধীরে চোখ তুলে ভয়ার্ত চাউনীতে এরীশের দিকে লক্ষ্য করে ঈশানী। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ের চোটে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে ওর। চোখ দুটো শূন্যে উঠে যায় মূহুর্তেই। এরীশের কালো কোটের অবস্থা দেখে গলা শুকিয়ে এসেছে ঈশুর, তেজি মাফিয়া বস টার এ কি হাল করলো ও?
পুরো শরীরে তার গমের দানার ছড়াছড়ি। দু’একটা তো কোট ফোট ভেদ করে টিশার্টের মধ্যে চলে গিয়েছে একদম । নিজের কর্মকান্ডে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে ঈশুর। মাফিয়া বসের স্টাইলিশ জামা কাপড়কে এহেন গমের ফ্যাক্টরী বানিয়ে দেওয়ার পেছনে একমাত্র দায়ভার ওর।
এইতো খানিকক্ষণ আগের ঘটনা। লুকিয়ে চুরিয়ে পেন্ট হাউজে আশ্রয় দেওয়া অতিব সুন্দরী পায়রাটাকে সবার আড়ালে নিজের ঘরেই যত্ন সহকারে আগলে রেখেছে ঈশানী। কেউ যাতে দেখতে না পায় সে জন্য সারাক্ষণ ঘরের দুয়ার ভিজিয়ে রাখে ও। তিন বেলা খাবার ও সে চুরি করেই খাওয়ায় পায়রাটাকে।
আজকেও তার ব্যতিক্রম নয়। একটু আগের ঘটে যাওয়া তান্ডব লীলার সমাপ্তি ঘটলে, তুষারের হুকুমে স্টাফ কোয়ার্টার থেকে সার্ভেন্টরা এসে ঝকঝকে তকতকে করে দিয়ে যায় সমগ্র লাউঞ্জ, কিচেন কাউন্টার, বার কাউন্টার সবকিছু।
এই ফাঁকে খাবার আনার উদ্দেশ্যে ঈশানীও একটু উঁকি ঝুঁকি দেয় চারিদিকে। ফ্লোরা কাপড় ধুয়ে ক্লান্ত শরীরে বিশ্রাম করছে নিজের রুমে। পরিচ্ছন্নতার কাজ শেষ হলে সার্ভেন্টরাও পেন্ট হাউজ ছেড়ে বেরিয়ে যায় একে একে। সবাই চলে যাওয়ায় পুরো লাউঞ্জ ফাঁকা পরে আছে এখন। সেই সুযোগটাই কাজে লাগায় ঈশানী। এরীশ পেন্ট হাউজেই আছে, তা জানা সত্ত্বেও দৃঢ় মনোবল নিয়ে আলতো পায়ে নিঃশব্দে ছুটে যায় কিচেনের দিকে। তাড়াহুড়ো করে অপটু হাতে মুঠোভর্তি করে তুলে নেয় গমের দানা। অতঃপর পুনরায় ছুট লাগায় নিজের ঘরের দিকে।
দু’হাত ভর্তি করে গমের দানা নিয়ে এদিক ওদিক চেয়ে বেখেয়ালে ছুটে আসার সময়ই ঘটে বিপত্তি। দুপ্রান্তের দু’জন মানুষ কাছাকাছি এসে থমকে যায় নিঃশব্দে। দ্বিতীয়বারের মতো দূ’র্ঘটনা বশত এরীশের সুডৌল পুরুষালী বুকের মাঝে হুমড়ি খেয়ে মুখ দাবায় ঈশানী। কয়েক সেকেন্ড, মাত্র সেকেন্ডের সংঘর্ষ। পরক্ষনেই ভয়, ঘৃণা, আশঙ্কা, সবকিছুর সংমিশ্রণে তরিৎ গতিতে এরীশের বুক থেকে ছিটকে দূরে সরে যায় ঈশানী। বিভ্রান্ত হয়ে মাথায় নুয়িয়ে নেয় বিনাবাক্যে।
ওদিকে ঈশানীর কর্মকান্ডে হুশ নেই এরীশের। ওর পিয়ার্সিং করানো শূন্য অনুভূতিহীন নিস্তেজ চোখ দুটো শুধুমাত্র ঈশানীর ব্যান্ডেজ করা কপালের মাঝেই নিবদ্ধ।
এরীশের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি জুগলে কোনোরূপ নজর দিলোনা ঈশানী। বরং ডানে-বামে না তাকিয়ে দিশেহারা হয়ে দু’হাতে মাফিয়া বস টার কোট পরিষ্কারে উদ্যত হয় মেয়েটা। তার চোখে মুখে বিভ্রান্তি, হাতের গতিতে তীব্র সংকোচ। তাও এই মূহুর্তে দিশেহারা মস্তিষ্ক। নিজ শরীরে মেয়েলী হাতের আলতো স্পর্শ অনুভব করার সঙ্গে সঙ্গে তীক্ষ্ণ নজরে চেয়ে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন ছোড়ে এরীশ ,
— পালাচ্ছিলে নাকি?
এরীশের পুরুষালী কন্ঠস্বর কানে ভেসে আসতেই সম্বিত ফিরে এলো ঈশানীর। নিজের কাজে শঙ্কিত হয়ে তাড়াহুড়ো করে দু’কদম পিছিয়ে গেলো সে। কুন্ঠিত হয়ে মস্তক নামিয়ে এদিক ওদিক না সূচক মাথা নাড়ালো একবার ।
এরীশের একটু খানি কথায় ঈশানীর ধনুকের মতো সুশ্রী বাঁকানো শরীরটা মূহুর্তেই নাজুক হয়ে কুঁকড়ে গেলো যেন । যা দৃষ্টি এড়ালো না স্বয়ং এরীশের। তবে এখনো ওর নিস্প্রভ চোখদুটো আঁটকে আছে ঈশানীর ব্যান্ডেজ করা কপালে।
— কপালে কি হয়েছে?
মসৃণ হাস্কিস্বরে প্রশ্ন করলো এরীশ।
ঈশানীর নিকট এরীশের দ্বিতীয় প্রশ্নটা ছিল অপ্রত্যাশিত। নিষ্ঠুর মানুষটার মুখে এহেন অপ্রত্যাশিত বাক্য শুনে আচানক চোখ তুলে মানুষটার চোখের পানে চাইলো ঈশু। তার তীক্ষ্ণ পুরুষালী চোয়াল,থুতনির মাঝ বরাবর অবস্থিত কালো কুচকুচে তিল, সবকিছুতে নজর বোলালো এক পল। মনেমনে ভাবলো,
— মানুষটা তো ঠিকই আছে তাহলে হঠাৎ…
আশ্চর্য ঈশু, ভীষণ আশ্চর্য, কারণ শেষ কবে এরীশ ওর সঙ্গে এমন স্বাভাবিক আওয়াজে কথা বলেছিল ঠিক মনে নেই ওর। তার চেয়েও বড় কথা এরীশ কখনো ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করার পাত্র নয়। কার কি এলো গেলো সে’সবে তার কখনোই কিছু যায় আসেনা।
—- কিছু জিজ্ঞেস করেছি তোমায়?
শান্ত অথচ প্রচন্ত জোড়ালো গলার স্বর। ঈশানী বাইরের আত্মবিশ্বাসী ভাবটা ধরে রাখতে পারলো না আর, আরোষ্ঠ কন্ঠে বলে উঠলো,
—ক..কিছু হয় নি।
ভ্রু কুঁচকালো এরীশ,কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
— কিছু না হলে ব্যান্ডেজ কেন?
এরীশের তীর্যক প্রশ্নে ঘাবড়ে গিয়ে শুষ্ক ঢোক গেলে ঈশানী, কি উত্তর দিলে এই মূহুর্তে জানোয়ারটার দ্বিতীয় পদক্ষেপের হাত থেকে বেঁচে যাবে ভাবতে লাগলো কিয়ৎক্ষন। এরীশ তখনও সুক্ষ্ম নজরে তাকিয়ে ছিল ওর পানে। খানিকক্ষন চুপ থেকে জড়ানো কন্ঠে ঈশানী বলে উঠলো,
— আপনি তখন ওই কাচের টুকরো টা…
বাকি কথাটুকু আর শেষ করতে পারলো ঈশু, তার আগেই ওদের মাঝে হাজির হলো তুষার। তার পড়নে ব্ল্যাক ডেনিম আর ব্ল্যাক কার্গো প্যান্ট হাতে রিভলবার।যা দেখা মাত্রই চোখ বড়বড় যায় ঈশানীর।
সামনে এগিয়ে এসে এরীশ আর ঈশুকে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ টানলো তুষার। ব্যগ্র কন্ঠে বলে উঠলো,
— ইজ এভরিথিং ওকে?
তুষারের আগমন কে কাজে লাগিয়ে এরীশের দৃষ্টি এড়িয়ে ধীর পায়ে নিজের রুমে চলে যায় ঈশানী। ওদিকে অর্ধেক কথা শুনলেও এরীশের আর বুঝতে নেই যে , ঈশানীর এই কপালের ব্যান্ডেজের পেছনে দ্বায়ী ও নিজেই।
— শীট!
সরলতায় জড়ানো নাজুক মেয়েটার যাওয়ার পানে তাকিয়ে একটা ক্ষুদ্র বিরক্তিকর শব্দ বেড়িয়ে এলো এরীশের লাগামহীন বক্ষভেদ করে।
রৌদ্রজ্জল ঝলমলে সকাল। মস্কোতে শেষ কবে এমন চকচকে রোদ উঠেছিল তা ঠিকঠাক মনে পরছে না ঈশানীর। মনে পরবেই বা কেমন করে মেয়েটা বন্দী হয়ে আছে এখানে। প্রতিনিয়ত জীবন অতিবাহিত করছে নিদারুণ আশঙ্কায়। এই বুঝি স্বাভাবিক জীবনের আলোক রশ্মিটুকু কেড়ে নিয়ে কোনো এক নরকীয় মরিচীকায় ধাক্কা মে’রে ফেলে দেয় এরীশ নাম নির্দয় লোকটা। সূর্যরশ্মি দেখার সময় কোথায়?
তবে ইদানীং দিন গুলো ভালোই যাচ্ছিল ঈশুর, ফ্লোরার পাশাপাশি আরও একজন বন্ধু জুটেছে ওর। সে হলো শুভ্রাপাখি। শ্বেত রঙা সুন্দরী পায়রাটার নাম ঠিক করেছে ঈশানী। দেখতে ধবধবে সাদা বলে নাম দিয়েছে শুভ্রা। আজকাল আর আগের মতো বসে বসে ডায়েরি লেখেনা ঈশানী, রুমে একা হলেই গল্প জুড়ে দেয় শুভ্রাপাখির সাথে । ওর ঠোঁটের আগায় গমের দানা তুলে দিতে দিতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
—- নিয়ম ভেঙে কত কিছুইনা হয়। তাইনা শুভ্রাপাখি?নিয়ম ভেঙে রোদের মাঝে বৃষ্টি হয়,নিয়ম ভেঙে দিনের বেলায় চাঁদ উদয় হয়, আমার মতো বাঙালি মেয়ের চোখের রং ও নিয়ম ভেঙে গাঢ় নীল হয়। অথচ দিন শেষে নিয়ম ভেঙে আমার আপনজন কেউ হলোনা। নিজের অপারগতা, কুন্ঠা,ক্ষয়িষ্ণু অন্তর্মুখী স্বভাব সবকিছুর জন্য আজ বিপর্যস্ত আমি। আচ্ছা, মা,নানী, ঊষা ওরা কি আমায় মনে করে কখনো? কখনো কি ভাবে আমি আদৌও বেঁচে আছি নাকি ম’রে গেছি?
নিজের মনের অযাচিত ভাবনায় ডুবে ছিল ঈশা, ঠিক এমন সময় বাইরে থেকে কড়া নাড়ে ফ্লোরা। দরজায় বার কয়েক টোকা দিয়ে শুধায়,
— ঈশু, একটু সাহায্য করবে প্লিজ?
ফ্লোরার ডাকে ঈশানী বেড়িয়ে এলে ওর দিকে এক বালতি ভেজা কাপড় এগিয়ে ঠোঁট উল্টালো ফ্লোরা,মিষ্ট গলায় বললো,
— রোদ উঠেছে, কাপড় গুলো একটু ছাঁদ বারান্দায় নেড়ে দিয়ে আসবে ঈশু? আসলে এরীশ আর তুষার আজ পেন্ট হাউজে লাঞ্চ সারবে তাই রান্না বসিয়েছি,নয়তো আমিই যেতাম।
ফ্লোরার কথায় ভ্রু কুঁচকালো ঈশানী, হতবাক হয়ে বলে উঠলো ,
—- পেন্ট হাউজের ছাঁদ বারান্দায় কে কাপড় শুকায় ফ্লোরা? তাছাড়া গার্ড’সরা দেখে ফেললে আমি শেষ। তুমি বরং সবগুলোকে ড্রায়ারে ঢুকিয়ে দাও।
ঈশানীর ভয়ার্ত চেহারা দেখে হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর মতো করে ভাবলেশহীন গলায় ফ্লোরা বললো,
—- আরে ধূর কেউ দেখবে না।
পরক্ষণেই ঠোঁট ফুলিয়ে গদোগদো স্বরে বলে,
— তুষার আবার রোদে শুকানো কাপড় ছাড়া একদম পড়েনা।
— দাও দাও, আর বলতে হবে না নিয়ে যাচ্ছি। এই তুষারের দেখছি অনেক ঢং, এমন বরফের দেশেও নাকি রোদে শুকানো জামা
কাপড় চাই তার। অদ্ভুত!
কাপড় সমেত ছাঁদ বারান্দার দিকে যেতে যেতে মেকি রাগ দেখিয়ে বিড়বিড়ালো ঈশানী।
যাওয়ার সময় ভুল করেই খোলা রেখে গেলো রুমের দরজাটা।
কাপড় গুলো রোদে মেলে দিয়ে, খানিকক্ষণ একা একাই রোদ পুহিয়ে বেশ সময় করে নিচে ফিরলো ঈশানী। নিচে ফিরেই সবার আগে চলে গেলো নিজের বারো বাই বারো ফিটের ছোট্ট রুমটাতে।
রুমে এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে সবার আগে খুঁজতে শুরু করলো শুভ্রাপাখি কে, কিন্তু কোথাও নেই সে। উড়ে গেলো না তো আবার? সেই ভয়ে তটস্থ হলো ঈশানী। কিছুক্ষন ভেবে পুনরায় খুঁজতে লাগলো রুমের আনাচে কানাচে। ছোট্ট রুম লুকিয়ে থাকার জায়গা ক্ষীণ, তবুও সব জায়গায় তন্নতন্ন করে খুঁজলো ঈশানী। কোথাও নেই পায়রাটা। অবশেষে খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে খাটের উপর বসে পরে ঈশানী। মনেমনে নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,
— তখন দরজা খোলা রেখে গিয়েছিলাম, তাই নিশ্চয়ই উড়ে গিয়েছে।
আকাশের পাখি আকাশে উড়ে গিয়েছে। তার তো আর বন্দী থাকার কথা নয়। সেই ভেবে নিজের খারাপ লাগাটুকু আড়াল করে শুকনো মুখে নিঃশব্দে বসে থাকে ঈশানী।তখনই কোথা থেকে যেন এক বাটি স্যুপ নিয়ে হাজির হয় ফ্লোরা। গরম গরম সেই ধোঁয়া ওঠা স্যুপের বাটিটা ঈশুর পানে এগিয়ে দিয়ে বলে,
— ঈশু, টেস্ট করে দেখোতো একবার কেমন হয়েছে? মাত্রই বানালাম, আমি নিশ্চিত খুবই সুস্বাদু হবে এটা।
ফ্লোরার আন্তরিকতা উপেক্ষা করার সাধ্য নেই ঈশানীর, তবুও মেয়েটা মলিন হেসে জানালো,
— এখন খেতে ইচ্ছে করছে না ফ্লোরা, রেখে দাও পরে খেয়ে নেবো।
ফ্লোরা নাছোড়বান্দা, সে তাদের দেশের বহুবছরের ঐতিহ্যবাহী স্যুপ ঈশানীকে দিয়ে টেস্ট করাবেই করাবে। অগত্যাই ভীষণ জোরাজোরি করে ফ্লোরা বললো,
— এভাবে বললে শুনছি না, তোমাকে টেস্ট করতেই হবে নাও তো হা করো।
ফ্লোরার জোরাজোরিতে হা করে ঈশানী, এক চামচ স্যুপ ওর মুখে পুরে দিয়ে ফ্লোরা ভ্রু উঁচিয়ে শুধালো,
— কেমন?
ঈশানী খেতে খেতে বলে,
— বেশ ভালোই, কিসের স্যুপ এটা?
ফ্লোরা একগাল হেসে জানায়,
— কবুতরের। একদম টাটকা কবুতর ছিল। কোথা থেকে যেন উড়ে এসে লাউঞ্জে বসেছিল, আমি ধরে নিয়ে স্যুপ বানিয়ে ফেললাম। মজা হয়েছে না?
ফ্লোরার কথা শুনে চোখ কপালে উঠে গেলো ঈশুর। ও তৎক্ষনাৎ খাবারের বাকি অংশ মুখ থেকে ছুড়ে ফেলে চ্যাঁচিয়ে উঠলো ফ্লোরার উপর,
— এটা তুমি কি করলে ফ্লোরা? আমার শুভ্রাপাখি কে রান্না করে এভাবে খেয়ে ফেললে?
— কিহ!
ফ্লোরা বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
— একদম কথা বলবে না, আমার শখের পায়রাটাকে রান্না করে এনে আবার আমাকেই আদর করে খাওয়াচ্ছো? কতটা নি’ষ্ঠুর তুমি মেয়ে?
— তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না, কি বলছো এসব?
যদিও ঈশানীর হঠাৎ রাগের কারণ ঠিক ধরতে পারছে না ফ্লোরা, তবুও ওর কন্ঠে অপরাধ বোধ সুস্পষ্ট।
কান্নার তোড়ে চোখের কোটর ভরে উঠেছে ঈশানীর। নীল রঙা জ্বলজ্বলে চোখ গুলোকে দেখে মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি বেদনার রং ধারণ করেছে তারা। শুভ্রাকে হারানোর নিগূঢ় কষ্টে মাথা ঠিক নেই ওর। তাইতো ফ্লোরার কথার প্রত্যুত্তরে আহত কন্ঠে মেয়েটাকে আরও কিছু কড়া কথা শোনালো ও,
—- বুঝতে হবেনা তোমার ফ্লোরা। আমিই ভুল বুঝেছিলাম। তোমাকে এই পেন্ট হাউজের সবার থেকে আলাদা মনে করেছিলাম। কিন্তু না, ওই হৃদয়হীন জানোয়ার গুলোর সঙ্গে থেকে থেকে তোমার হৃদয়টাও পাথর খন্ডে পরিনত হয়েছে। তুমিও একটা নির্দয় ফ্লোরা, সত্যিই নির্দয়।
এক নাগারে কথাগুলো বলে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায় ঈশানী। অতঃপর ছুটতে ছুটতে চলে যায় ছাঁদ বারান্দায়। এখানে সচরাচর কেউ থাকেনা, তাই এখানে এসেই হাঁটু ভেঙে বসে গলা ছেড়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো ঈশানী। ওর কান্নার আওয়াজ বড্ড ব্যথাতুর শোনাচ্ছে, সব দুঃখরা যেন একসাথে এসে জুড়ে বসেছে মন মস্তিষ্কে, তাইতো এমন অপারগ কান্না। কান্নারত কন্ঠে ভীষণ অভিমানে ঈশানী বলে,
— হারাতে হারাতে সব হারিয়ে ফেললাম, এবার আমি হারিয়ে গেলেই সমাপ্ত।
—- কে হারিয়েছে?
গমগমে পুরুষালী অজ্ঞাত আওয়াজে আচমকা থমকে যায় ঈশানী। শুষ্ক ঢোক গিলে এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে থাকে প্রশ্ন দাতা কে। পরক্ষণেই নেড়ে দেওয়া কাপড়ের আড়াল থেকে পুনরায় ভেসে এলো একই কন্ঠস্বর,
— এভাবে কাঁদছো কেন? কে হারিয়েছে?
শুকোতে দেওয়া কাপড়ের আড়াল থেকে কুন্ডলী পাকানো বাষ্পিত ধোঁয়া অনুসরণ করে কান্নাকাটি বাদ দিয়ে সেদিকে উঁকি দেয় ঈশানী। দেখতে পায় ওর সবচেয়ে অপছন্দের মানুষটার মুখাবয়ব। ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট নিয়ে ট্রাউজারের পকেটে হাত গুঁজে সামনের দিকে তাকিয়ে মূর্তিমান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এরীশ।
—- তাকিয়ে আছো কেন?
এরীশের কথার প্রত্যুত্তরে ঈশু নাক টেনে হিঁচকি তুলে বললো,
— আপনি কি করে বুঝলেন আমি তাঁকিয়ে আছি?
— সিক্স সেন্স।
সামনে তাকিয়েই উত্তর দেয় এরীশ। অতঃপর ঘাড় ঘুরিয়ে ঈশানীর দিকে দৃষ্টিপাত করে বলে,
— কাঁদছিলে কেন?
লোকটার কর্কশ আওয়াজে তিরতির করে নাকের ডগা ফুলে ওঠে ঈশানীর। সে এমন ভাব করছে যেন কান্নাকাটি করে মস্ত বড় অন্যায় করে ফেলেছে ঈশা। তবুও নাক টেনে নিজেক খানিকটা শক্ত করে জবাব দিলো ঈশানী,
— আপনার ফ্লোরা আমার শুভ্রাকে স্যুপ বানিয়ে খেয়ে ফেলেছে।
— শুভ্রা কে?
আবারও কর্কশ আওয়াজ ভেসে এলো ওপাশ থেকে।
—- আমার পায়রা পাখি।
ঈশানীর প্রত্যুত্তর শুনে ভ্রু কুঞ্চিত করে ফেললো এরীশ,তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো,
— সিরিয়াসলি? তুমি একটা কবুতরের জন্য কেঁদে ভাসাচ্ছিলে এতোক্ষণ ?
ঈশানীর মাথা ঠিক নেই, এই মূহুর্তে নির্দয় এরীশের কথাও সহ্য হলোনা ওর, চরাৎ করে ফুঁসে উঠলো মস্তিষ্কটা, ফলস্বরূপ মেয়েটা চটে গিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বললো,
আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ১৫
—- ভেতরে মায়া-দয়া থাকলে তো বুঝবেন কেন কাঁদছি? নিষ্ঠুর, পাষাণ, হৃদয়হীন লোক একটা।
কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো আউড়ে ছাঁদ বারান্দা ত্যাগ করে ঈশানী। ওদিকে ঈশানী যেতে না যেতেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো এরীশের। যদিওবা ঈশানীর কথাগুলো চিরন্তন সত্য। তবুও এই মেয়েটার মুখে এসব কথা মোটেই শুনতে চায় না এরীশ। ওর মুখে এসব শুনলেই তীব্র দহনে ভেতরটা চিড়িবিড়িয়ে ওঠে এরীশের। সেই জের ধরে দু’হাত মুঠি বদ্ধ করে রাগের তোপে এরীশ বলে,
—- তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলতে পারো না। একদমই পারো না ।