আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ১৭

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ১৭
suraiya rafa

নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ চলমান। এই সময়ে বছরের সবচেয়ে শীতলতম সময় পার করছে পুরো রাশিয়া। দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টাই তাপমাত্রা ঝুলে আছে মাইনাসের কাটায়। সারাবেলা অবিরত তুষার পাতে জমাট বেধে পাথর খন্ডে রূপ নিয়েছে চারিদিক। মসৃণ পিচঢালা রাস্তা গুলো ঢাকা পরেছে কয়েক স্তর শ্বেত রঙা বরফ কুঁচির আড়ালে। প্রকৃতির এহেন বৈরী আচরণে জনজীবন ব্যাহত। ঠিক মতো রাস্তা চিনে পথ এগোনো মুশকিল, অথচ এমন বৈরী আবহাওয়ার মাঝেই দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে জঙ্গলের রাস্তা ধরে প্রাণপন ছুটছে ঈশানী। যদিও রাস্তা চেনার উপায় নেই, হাঁটু সমান বরফের মধ্যে দিয়ে কোনোমতে সামনের এগোনোর প্রচেষ্টা বলা যায়।

তবে এই বিস্তৃত জঙ্গলের শেষ কোথায় তা ঠিক জানা নেই ঈশানীর। এভাবে উদভ্রান্তের মতো ছুটতে থাকলে ধরা পরে যাওয়ার প্রবণতা প্রকট। এবার এরীশের হাতে ধরা পরে গেলে এ জীবনে আর রক্ষা নেই। সেই ভেবে শরীরের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে আরও দ্রুত এগোনোর প্রয়াসে পা চালায় ঈশানী। বোকাসোকা মেয়েটা প্রচন্ড ঠান্ডার মাঝে ছুটছে ঠিক’ই, কিন্তু আদৌও সামনে এগোচ্ছে নাকি একই জায়গাতে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে তা ঠিক বোধগম্য নয় ওর।
বরাবরের মতোই ওর মাত্রাতিরিক্ত আত্নবিশ্বাস আজ ওকে এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে। ভীত সন্ত্রস্ত মেয়েটা পালাতে চায়। এই পেন্ট হাউজ, এই খারাপ মানুষ গুলো, এই মাফিয়াদের কালো দুনিয়া সবকিছু থেকে অনেক দূরে চলে যেতে চায়।কিন্তু সেটা কি আদৌও ওর ভাগ্যে আছে? মাফিয়া বস এরীশ কি এতো সহজেই পালাতে দেবে নিজের শিকার কে?
তবে পেন্ট হাউজ থেকে পালিয়ে আসার জন্য ঈশানী নিজেও আজ কিছুটা বিশ্বাস ঘা’তকতা করেছে। সুযোগ নিয়েছে ফ্লোরা মেয়েটার আন্তরিকতার। কে জানে ঈশানী কে খুঁজে না পেলে এরীশ ঠিক কি শা’স্তি দেবে ফ্লোরাকে?
ফ্লোরা নিজেও নিশ্চয়ই এই মূহুর্তে উন্মাদের মতো চারিদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে ওকে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এই তো কিছুক্ষণ আগের ঘটনা। ফ্লোরা এসেছিল ঈশুর নিকট ক্ষমা চাইতে। শুভ্রাকে হারিয়ে গত তিনদিন ধরে ফ্লোরার মুখোমুখি হয় না ঈশানী। মেয়েটাকে দেখলেই কেমন মাফিয়াদের দোসর মনে হয় ওর চোখে। তখন অভিমান হয়, কান্না পায়। কিন্তু ঈশানী তো অন্তর্মুখী, সবার সামনে দুঃখ প্রকাশ কিংবা কেঁদে ভাসানোর স্বভাব ওর নেই। অগত্যা গত কয়েকদিন ধরে ঘরের চৌকাঠ মাড়ায় না ঈশু। আর না তো ফ্লোরা নিজে থেকে কখনো সাহস করে কথা বলতে আসে ওর সঙ্গে। কথা বলার ইচ্ছে হলেও, প্রগার অপরাধ বোধ ভেতর থেকে দমিয়ে দেয় ওকে।
গত তিনটা দিন ভীষণ মন খারাপের সাথে এভাবেই কাটে ওদের। এরমধ্যে এরীশ ও নেই পেন্টহাউজে। কোনো এক বিশেষ কাজে রাশিয়ার বাইরে গিয়েছে সে। ঈশুর সঙ্গে এমন মনমালিন্য ফ্লোরার আর সহ্য হচ্ছিল না মোটেই,অগত্যা ভেতরের সংকোচটুকু দমিয়ে আজ তিন দিনের মাথায় সকাল সকাল কড়া নেড়েছিল ঈশুর ঘরে।
দরজায় টোকা পড়লে ঈশানী দরজা খুলে দেয় নির্দ্বিধায়। ও নিজেও বোধ হয় মেয়েটার প্রতি অভিমান পুষে রাখতে চাইছিল না আর। ইতিমধ্যে ভেতরে প্রবেশ করার পরেও ফ্লোরা কথা এগোনোর জন্য আগ বাড়িয়ে বলে,

— আসবো ভেতরে?
ঈশানী বাকশূন্য, নিস্প্রভ ওর নীল চোখের মনি। অন্তর্মুখী স্বভাবটা যেন চট করেই হানা দিয়েছে ভেতরে। যার দরুন জিহ্বা নাড়ানো দুষ্কর। ঈশানী চুপ হয়ে আছে দেখে ফ্লোরা একাই ইতস্তত গলায় বলতে আরম্ভ করলো,
—- আসলে ঈশু তুমি যা ভাবছো তা নয়। মাফিয়াদের সঙ্গে জীবন কাটালেও, আমি মোটেও ওদের মতো নিষ্ঠুর নই। আর না তো ওরা আমাকে নিজেদের পাপ কাজের সঙ্গে জড়িত রাখে কখনো। আমি আসলে বুঝতে পারিনি পায়রাটা যে তোমার, তাহলে কখনোই আমি…
ফ্লোরাকে কথার মাঝে থামিয়ে দিলো ঈশানী। শুষ্ক অধরে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা টেনে বললো,

— আমি বুঝতে পেরেছি ফ্লোরা, তুমি কখনোই এটা ইচ্ছে করে করোনি। আর না তো সেদিন তোমার সঙ্গে ওভাবে কথা বলা উচিৎ হয়েছে আমার। আমি নিজেও ভীষণ লজ্জিত।
অন্তর্মুখী মেয়েটাকে অবাক করে দিয়ে তৎক্ষনাৎ ওকে জড়িয়ে ধরে ফ্লোরা। ওর কান্ডে বিস্ময়ে ‘থ’ হয়ে যায় ঈশানী। এর আগে কোনো দিনও কেউ এভাবে জড়িয়ে ধরেনি কেউ ওকে। ঈশানী বেশ সংকুচিত, সেই সঙ্গে পুলকিত ও বটে। ফ্লোরা আলতো হাতে ঈশানীকে জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলে ওঠে,
— সত্যি বলছো? তুমি আর রাগ করে নেই? ধীর গতিতে নিজের একহাত আলতো করে ফ্লোরার পিঠে ছোঁয়ালো ঈশানী। অতঃপর ওকে আস্বস্ত করে বললো,
— একদম রাগ করে নেই বিশ্বাস করো। তুমি প্লিজ আর এভাবে অনুশোচনা করোনা, আমার খারাপ লাগে।
মেয়েটা সত্যিই সরল আর পবিত্র। নির্দ্বিধায় যে কাউকে ক্ষমা করে দেওয়ার মতো এক বিশাল সমুদ্রের ন্যায় উদ্দাম হৃদয় আছে তার। সেই ভেবে নিদারুণ খুশিতে ফ্লোরা হুট করেই বলে ওঠে,

— আজ পেন্ট হাউজে কেউ নেই। স্নো ফল দেখতে যাবে?এটা আমাকে ক্ষমা করে দেওয়ার রিওয়ার্ড বলতে পারো।
ফ্লোরার কথায় মলিন হাসলো ঈশানী, অবিশ্বাসের স্বরে বললো,
— আমাকে ওরা পেন্ট হাউজের বাইরে যেতে দেবে ভেবেছো? তাছাড়া এরীশ…
ঈশানীর কথার ফাঁকে হাত ঢুকিয়ে ফ্লোরা বলে,
— এরীশ তো নেই। তাছাড়া আমি তুষারকে ফ্যাক্স পাঠিয়ে অনুমতি চেয়ে নেবো। আর দূরে তো কোথাও যাবোনা, পেন্ট হাউজ এরিয়ার মধ্যেই থাকবো।
প্রথমে দ্বিধাবোধ করলেও এরীশের পেন্টহাউজে না থাকার খবরটাতে চমকালো ঈশানী। কোনো এক অজানা কারণে আচানক খুশিতে ঝিলিক দিয়ে উঠলো ওর দু’চোখ। বুকের ভেতরে জড়ো হলো মুক্তি পাওয়ার এক প্রবল আকাঙ্ক্ষা। নাজুক মেয়েটা ভেতরে ভেতরে কিয়ৎক্ষন ভাবলো কিছু একটা। অতঃপর চট করেই সন্দিহান গলায় ফ্লোরাকে বললো,
— সত্যি বলছো বাইরে নিয়ে যেতে পারবে?মিথ্যে আশা দিও না কিন্তু।
ফ্লোরা অক্ষিপল ছেড়ে ঈশু কে আস্বস্ত করে বললো,
— পারবোরে বাবা, পারবো।

সেই যে ফ্লোরার সঙ্গে পেন্ট হাউজের বাইরে পা রাখার সুযোগ পেয়েছে, সেটাকেই কাজে লাগিয়ে এই মূহুর্তে পালানোর প্রাণপন চেষ্টা চালাচ্ছে ঈশানী। তুষারের অনুমতি ছিল বলে গার্ড’সরা তখন কিছুই বলেনি ওদের। কিন্তু এতোক্ষণে হয়তো ঈশানীর পালিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে ব্যতিগ্রস্থ হয়ে পরেছে তারা-ও। অনেকক্ষণ ধরে দৌড়ানোর কারণে ঈশানী দূর্বল, সেই সঙ্গে ভীষণ আতঙ্কিত। যত দ্রুত সম্ভব দিনের আলো থাকতে থাকতে এরীশ ইউভানের রেসট্রিক্টটেড এলাকা ত্যাগ করতে হবে ওকে । কিন্তু এই বরফের চাদরে ঢাকা মৃ’ত নির্জীব জঙ্গলের শেষই বা কোথায়?
দিশেহারা মস্তিষ্ক আর গন্তব্যহীন পথ ধরে ক্লান্ত পায়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল ঈশানী। ওর পরনের ওভার কোট টা এক স্তর বরফ জমে পুরু হয়ে গিয়েছে প্রায়, এভাবে বাইরে থাকলে যখন তখন হাইপোথার্মিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রকট।তবুও সেসবে তোয়াক্কা না করে উদভ্রান্তের মতোই ছুটছে মেয়েটা।

এভাবেই একটা পর্যায়ে এসে অকস্মাৎ নিজের নরম বাহুতে গ্লাভস পরিহিত একটা শক্ত হাতের হ্যাঁচকা টান অনুভব করতেই হন্যে হয়ে ছোটা পা দু’টো অকস্মাৎ থমকে গেলো ঈশানীর। ধরা পরে যাওয়ার প্রবল আতঙ্কে গলা শুকিয়ে কাঠ। পালানোর কায়দা নেই, অগত্যা সেখানেই দাঁড়িয়ে পরে শুষ্ক একটা ঢোক গিলে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে পেছনে ঘুরে তাকালো ঈশানী।দেখলো একটা কালো আলখাল্লা পরিহিত রাশিয়ান লোক। ঈশানীর যতটুকু মনে পরে তাতে এই লোক এরীশ কিংবা তার পেন্ট হাউজের কেউ নয়।

ঈশানী তাকে পেন্ট হাউজে দেখেনি ঠিকই, তবুও লোকটার এই অনাকাঙ্ক্ষিত দর্শনে আস্বস্ত হতে পারলো না ও।যদি এই লোকটা এরীশের গুপ্তচর হয় তখন? ভয়ে কুন্ঠিত হয়ে লোকটার থেকে নিজের হাতটা ছাড়ানোর জন্য অহেতুক জোরজবরদস্তি করতে লাগলো ঈশানী। লোকটা ছাড়লো না ওকে বরং সরু বাহুটা কব্জিবন্দি রেখেই রুশ ভাষায়
বোঝাতে লাগলে কিছু একটা। লোকটা স্থির হয়ে কথা বলছে, দেখে মনে হচ্ছে সে ঈশুকে ধাতস্থ করতে চাইছে কিছুটা। কিন্তু এতেও অস্থিরতা কমলো না ঈশানীর,নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা অবিরত রেখেই কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে ওঠে,
— হাত ধরেছেন কেন? কি চাই? ছাড়ুন!
লোকটা হাতের বাঁধন দৃঢ় করে স্থবির কন্ঠে আরও কিছু বললো। যা কোনোকিছুই বোধগম্য হলোনা ঈশানীর। অস্থিরতা বেড়ে গেলো ওর মাঝে। ভেতরের নাজুক,শঙ্কিত সত্তাটা বেড়িয়ে আসতে চাইছে যেন।মেকি আত্নবিশ্বাসটুকু মিলিয়ে যাচ্ছে অনর্গল ঝরতে থাকা অশ্রুকণার আড়ালে। ঠিক এমন সময় ঈশানী খেয়াল করলো একটু দূরেই বরফে ঢাকা ক্রীসমাস গাছের আড়াল থেকে ক্যামেরার সাহায্যে ওর ছবি ধারণ করছে কেউ। গাছের আড়ালে দাঁড়ানো লোকটাকে দেখে কান্নারত অবস্থাতেই থমকে গেলো ঈশু। ভেতর ভেতর নতুন করে বি’পদে পড়ার আশঙ্কায় নীল হয়ে উঠলো ওর মসৃণ ফর্সা মুখ মণ্ডল ।বুকের ভেতর ক্রমশ বেড়ে ওঠা উচাটন উত্তেজনায় তৎক্ষনাৎ ভ্রুকুঞ্চিত করে ঝাঁঝালো গলায় চ্যাঁচিয়ে উঠলো ও ,
— কে আপনি?এভাবে ছবি কেন তুলছেন?
ঈশানীর কথায় কোনোরূপ কর্ণপাত করে না লোকটা। উল্টো কুটিল হেসে ফের ক্যামেরাতে হাত চালায় তড়িৎ বেগে। যেন কোনো কিছুর জন্য বড্ড তাড়া তাদের।ক্রমাগতিত একাধিক ফ্ল্যাশের আলোয় হকচকিয়ে উঠে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয় ঈশানী। চোখ দু’টো বন্ধ রেখেই ঠোঁট ভেঙে কেঁদে ওঠে মেয়েটা, কাঁদতে কাঁদতে নতুন উদ্যমে নিজেকে ছাড়ানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে আকুল স্বরে বলে,
— যেতে দিন দয়াকরে । কেন আটকে রেখেছেন আমায়? আপনাদের তো আমি চিনিও না। তাহলে আমার পেছনে কেন পরে আছেন?কি ক্ষতি করেছি বলুন?
কথার শেষে ফের ক্রন্দনরত ব্যথাতুর আওয়াজ বেড়িয়ে এলো ওর কন্ঠনালী ভেদ করে।
ওর ভেজা নরম চোখ দুটো তখনও বন্ধই ছিল। কোনোকিছু আঁচ করার সুযোগ ছিল না মোটেই, ঠিক এমতাবস্থায় কয়েক ন্যানো সেকেন্ডের মাঝে হুট করেই এক বিকট গগন বিদারি আওয়াজে কেঁপে উঠলো বিস্তৃত গোটা জঙ্গল। অকস্মাৎ আওয়াজে লাফিয়ে উঠে তরাগ করে চোখ খুলে ফেললো ঈশানী। সঙ্গে সঙ্গে ঝপাৎ করে ওর মুখের উপর আঁচড়ে পরে এক খাবলা তাজা র’ক্ত।

মুখের উপর র’ক্তের উৎকট গন্ধ। চোখের কার্নিশ বেয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পরছে সেগুলো। সামনের দৃশ্যপট পুরোপুরি র’ক্ত রঞ্জিত । অগত্যা হাতের সাহায্যে চোখটা পরিষ্কার করে সামনে দৃষ্টিপাত করে ঈশানী।
অবিশ্বাস্য নজরে সামনে তাকাতেই বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে পরে ওর নেত্রদ্বয়। স্নিগ্ধ বরফে ঢাকা ধবধবে সাদা জমিনে এমন র’ক্তের বন্যা দেখে শরীর শিউরে উঠতে না উঠতেই মুখের উপর দু’হাত চেপে ধরে চোখ দু’টো বড়বড় করে সামনের লোকটার দিকে চাইলো ঈশু। দেখলো এতোক্ষণ যাবত ওর বাহু ধরে রাখা রাশিয়ান লোকটার হাতের বাঁধন ঢিলে হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে । স্থির, শূন্য চোখ দু’টো খোলা রাখা অবস্থাতেই বিনাবাক্যে ধীরে ধীরে সম্মুখে ঢলে পরছে মানুষটা । দেখে মনে হচ্ছে কথা বলার শক্তি সে অনেক আগেই হারিয়েছে, সেই সাথে শ্বাসপ্রশ্বাস টুকুও।
ঈশানী আরেকটু ভালোভাবে খেয়াল করতেই দেখলো লোকটার মাথার অগ্রভাগ থেকে জলরাশির ন্যায় গলগলিয়ে বেড়িয়ে আসছে ভীষণ তাজা র’ক্ত স্রোত। যা দেখে মূহুর্তেই আঁতকে ওঠে ঈশানী। এ কেমন দুনিয়া? কত সহজেই না জলজ্যান্ত মানুষটা চোখের সামনে নিথর এক মৃ’তদেহে পরিনত হলো। এসব নৃ’শংস’তার সঙ্গে মোটেই পরিচিত নয় ও, তারউপর সদ্যমৃ’ত লোকটা মূর্তির ন্যায় সোজা ঢলে পরছে ওর দিকে , এক্ষুণি সরে না দাঁড়ালে হয়তো ওর গায়ে এসেই আঁচড়ে পরবে রক্তাক্ত শরীরটা। ভয়ের চোটে শরীরের র’ক্ত হীম হয়ে এলো ওর। তৎক্ষনাৎ চিৎকার করে দু’হাতের ধাক্কায় দূরে সরিয়ে দিলো আলখাল্লা পরিহিত মৃ’ত লোকটাকে।। লোকটা দৃশ্যপটের আড়াল হতে না হতেই ঈশানীর অক্ষিপটে ভেসে উঠলো আরেক ভয়াতুর দৃশ্য। সামনে ওর থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে ওর আসন্ন বি’পদ, স্বয়ং এরীশ ইউভান।

প্রকৃতিতে অপার তুষার পাত এখনো বহমান। পেজা তুলোর মতো শুভ্র তুষার পাতের মাঝেই কালো কোট পরিহিত স্নিগ্ধ মানবের ধারালো চেহারাটা আচমকা ভেসে উঠলো ঈশানীর চোখে। যার পায়ের কাছে লকলকে কুটিল চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, বরফের কুচির সঙ্গে মিলেমিশে যাওয়া ধবধবে সাদা বোজো। আপাতত হিংস্র প্রাণীটির দু’চোখ ঈশুর পায়ের কাছে পরে থাকা নির্জীব র’ক্তাক্ত শরীরটার দিকে নিবদ্ধ। দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি হয়তো হাওয়ার বেগে ঝাপিয়ে পড়ে ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে লোকটাকে।
ঈশানী এক পল চাইলো বোজোর পানে অতঃপর দৃষ্টি সরিয়ে আতঙ্কিত নজরে পরখ করে এরীশ কে। হাতে রিভলবার নিয়ে এদিকেই এগিয়ে আসছে সে। গলার মাঝে কোনো তরল অবশিষ্ট নেই আর, এই মূহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় আর শঙ্কিত মানবী বোধ হয় ঈশানী।
এরীশ সময় দিলোনা ভাববার, বোজোর থেকেও দ্রুত বেগে এগিয়ে এসে থাবা বসালো ঈশুর কণ্ঠনালীতে। কড়াপড়া খরখরে হাতে ওর নরম কণ্ঠনালিটা চেপে ধরে রাগে গর্জন করে উঠলো সে,
—- কি মনে হয় আমি বাদে রাশিয়ান সবাই খুব ভালো মানুষ? এরীশের পেন্টহাউজ থেকে পালানোর স্পর্ধা হয় কি করে তোমার?

মূহুর্তেই মুখের মাঝে র’ক্তের নোনতা স্বাদ অনুভব করে ঈশানী। নীল রঙা অসহায় চোখ দুটো কোটর ছাড়িয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন।শ্বাসপ্রশ্বাসে বাঁধা প্রাপ্ত হওয়ায় ক্রন্দনরত ফ্যাকাশে ঠোঁট দু’টো ফাঁকা হয়ে গিয়েছে আপনাআপনি। এরীশ ছাড়েনা ঈশুকে, বরং হাতের বাঁধনে কোনোরূপ পরিবর্তন না এনেই অন্যহাতে ট্রিগার প্রেস করে গু’লি বসিয়ে ঝাঁঝরা করে দেয় গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা স্পাইটার বক্ষস্থল।
বিভীষিকায় পরিনত হয়েছে ঈশানীর মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। এতোক্ষণে তুষার আর ফ্লোরাও এসে হাজির হয়েছে সেখানে। বোজো গন্ধ শুঁকে এগিয়েছিল বলে এরীশ খুব তাড়াতাড়ি খোঁজ পেয়েছে ঈশানীর। কিন্তু তুষার আর ফ্লোরাকে বরফের চাদরে ঢাকা জঙ্গলের মাঝে এই জায়গাটা খুঁজে পেতে বেগ পোহাতে হয়েছে বেশ। ওরা বেশ খানিকটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে হ’ত্যাযজ্ঞের থেকে। সামনের বীভৎস পরিস্থিতি লক্ষ্য করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ফ্লোরার দিকে চাইলো তুষার। মেয়েটা জড়োসড়ো হয়ে মাথা নুয়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওর পাশেই। সেদিকে ভ্রুকুঁচকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে তুষার বলে,

— আমার পেছন পেছন এতদূর আসতে নিষেধ করেছিলাম না? এখন এসব দেখতে ভালো লাগছে?
— ক্ষমা করে দিন না?
মুখ কাঁচুমাচু করে অত্যন্ত নিচু স্বরে বাক্যটুকু উচ্চারণ করে ফ্লোরা।
— ক্ষমা! কিসের ক্ষমা? এতো বড় একটা অন্যায় করে এখন আবার ক্ষমা চাইতে এসেছো?
—হুঁ।
ছোট্ট করে হুঁ উচ্চারণ করে উপর নিচ মাথা নাড়ালো ফ্লোরা।
তুষার রাগান্বিত হলো। মেয়েটা এতো ছেলেমানুষ কেন? এতোদিন ধরে মাফিয়াদের সঙ্গে থেকেও একটু চালাকচতুর হতে পারলো এই বোকা ফ্লোরা। সেই ভেবে বিরক্তিকর আওয়াজ বেড়িয়ে এলো তুষারের মুখ থেকে। সে দাঁত কটমট করে বললো,

— কে বলেছিল ঈশানীকে নিয়ে বের হতে? আমি বলেছিলাম? না কি তুমি আমাকে একবারও জানিয়েছিলে যে তোমার সঙ্গে এই ঝামেলার বস্তাও বের হবে? আগের বার যখন চোখে ধূলো দিয়ে পালিয়ে গেছিলো তখনও শিক্ষা হয়নি? বোকা মেয়ে একটা।
তুষারের কথার প্রত্যুত্তর না করে নাক টানলো ফ্লোরা। হাতের পিঠ দিয়ে অক্ষি কোণে জমে থাকা তপ্ত জলটুকু মুছে নিলো আলগোছে। অতঃপর ঈশানী আর এরীশের দিকে দৃষ্টিপাত করে মিনমিনিয়ে বললো,
— এরীশ কে থামান দয়াকরে। ঈশুকে মে’রে ফেলবে তো।
ফ্লোরার ইশারা অনুসরণ করে তুষার এক পল সামনে দৃষ্টিপাত করে নির্বিকার কন্ঠে বললো,
— আই থিংক এরীশ অনেক ধৈর্য ধারণ করছে।
সরল কপাল নিমিষেই বেঁকে গেলো ফ্লোরার, সে উদ্ভট আওয়াজ করে বললো,
— মানে?
— এই যে দেখতে পাচ্ছো এরীশ মিস ব্লু আইড এ্যাঞ্জেলের গলা চে’পে ধরে গজরাচ্ছে। কিন্তু ওর জায়গায় অন্য কেউ হলে এরীশ এমন কিছুই করতো না।
— কি করতো তাহলে?
কলিজা হাতে নিয়ে ভয়ার্ত আওয়াজে প্রশ্ন ছুড়লো ফ্লোরা।
ক্রুর হাসিতে ঠোঁট বাঁকালো তুষার। ঠোঁট জুড়ে হাসি বিস্তৃত হলেও, চোখ দুটোতে রহস্যের কপটতা ধরে রেখে তুষার জবাব দিলো,
— সোজা মাটিতে গেড়ে দিতো।

— বারবার করে সর্তক করেছিলাম তোমায়, এরীশ ইউভানের সঙ্গে লাগতে এসোনা। আমাকে চ্যালেঞ্জ করে পালানোর দুঃসাহস দেখিও না। কিন্তু তোমার শিক্ষা হয়নি। এতোবার নিষেধ করার পরেও আমার নাকের ডগা দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলে তুমি। কি ভেবেছিলে পাইথন লিডার কে টেক্কা দেওয়া এতোই সহজ?
ঈশানী কথা বলতে পারছে না। কণ্ঠনালির প্রচণ্ড চাপে ঠোঁটের আগায় এসে আঁটকে আছে রূহুটা।তীব্র যাতনায় সমগ্র মুখমণ্ডল রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে ওর। চোখ দিয়ে অনর্গল ঝরে পড়ছে ব্যথাতুর নোনাজল।
সেসবে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করেই এরীশ বললো,

— বলেছিলাম আমি হার্টলেস। বিশ্বাস হয়নি তাইনা? এবার থেকে ঠিকই বিশ্বাস হবে। পাইথন লিডারকে চ্যালেঞ্জ করার ফল কতটা ভয়াবহ যন্ত্রনা বয়ে আনবে তোমার জীবনে, সেটা এবার হাড়েহাড়ে টের পাবে তুমি।
ঈশানী ম’রে যাচ্ছে। দম আটকে এসেছে ওর। এবারের মতো বাঁচতে চায় শুধু । অগত্যা এরীশের হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর প্রয়াসে অস্থির হয়ে এলোমেলো কদমে পিছিয়ে যায় দূর্বল মেয়েটা । এরীশের চোখের মাঝে ক্রোধের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, সেও লম্বা পা ফেলে এগোতে শুরু করে সমান তালে।
এভাবে পেছাতে গিয়ে একপর্যায়ে ঈশানীর পায়ে এসে আটকায় স্যাঁতসেতে কোনো এক অজ্ঞাত বস্তু। এরীশের হাতের বাঁধনে আবদ্ধ থেকে আড় চোখে সেদিকে এক পল নজর বোলায় ভীত মেয়েটা।এক মূহুর্ত, মাত্র মূহুর্তের জন্য নিচে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে চোখের রং পাল্টে গেলো ওর। গা ঘিনঘিনে ভয়ানক এক দৃশ্যপট চোখের সামনে ভেসে উঠতেই আতঙ্কের শেষ সীমানা ছাড়িয়ে দু’হাতে শক্ত করে এরীশের ওভার কোটটা খামচে ধরে অকস্মাৎ গলা ছেড়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো ঈশানী ।

ঈশানীর চিৎকারের আওয়াজে ভ্রম কাটে এরীশের। সে তৎক্ষনাৎ ঈশানীর গলা থেকে হাত সরিয়ে দৃষ্টিপাত করে নিচের দিকে। তীক্ষ্ণ চোখ দু’টো ছোট ছোট করে পায়ের কাছে তাকাতেই দেখতে পায়, একটু আগের সেই রুশ লোকটার ম’রদেহটা ছিন্নভিন্ন করে খুবলে খেয়ে একেবারে না’ড়িভু’ড়ি বের করে ফেলেছে বোজো।
এহেন বীভৎস দৃশ্য দ্বিতীয়বার দেখার সাহস হলোনা ঈশানীর। প্রথমবারেই গগন কাঁপানো চিৎকার দিয়ে গরগর করে বমির জোয়ারে ভাসিয়ে দেয় এরীশের সমস্ত শরীর। মেয়েটার এরূপ মাত্রাতিরিক্ত সাহস দেখে এরীশের মস্তিষ্কটা চড়াৎ করে উঠলো ফের। ঝাঁঝালো মেজাজের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে পুনরায় ঈশুকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই চেতনা হারিয়ে শীর্ণকায় শরীরের সমগ্র ভর ছেড়ে শূন্যে লুটিয়ে পড়ে ঈশানী। বরাবরের মতো মাটি স্পর্শ করার আগেই ওর দূর্বল শরীরটাকে বাহুবদ্ধ করে নেয় এরীশ। এরীশের হাতের উপর গা ছেড়ে পরে আছে ঈশানী। রেশমের মতো ঝুরঝুরে চুলগুলো অগোছালো হয়ে লেপ্টে আছে ওর সমগ্র মুখমণ্ডলে। মুখের সাহায্যে ফুঁ দিয়ে বিনাবাক্যে ওর চুলগুলোকে আলগোছে সরিয়ে দেয় এরীশ। পরক্ষণেই মেয়েটার শুকনো চেতনাহীন ফ্যাকাশে মুখের দিকে অনিমেষ চেয়ে হাস্কিস্বরে বলে ওঠে,
—- বারবার নিজের এই সরল মুখটা দেখিয়ে কি প্রমান করতে চাইছো?

টনটনে মাথা ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে ঠিক যেই মূহুর্তে চোখ খোলে ঈশানী,তখন সকাল ছাপিয়ে সন্ধ্যা রাত। চেতনা ফিরে আসা মাত্রই কাঁচের দেওয়াল ভেদ করে বাইরের অবিরাম তুষারপাতে দৃষ্টি বোলালো মেয়েটা।কিয়ৎক্ষন সেদিকে নজর বুলিয়ে ঈশু বুঝলো, ও ইতিমধ্যে এরীশের সেই চিরাচরিত পেন্ট হাউজে রয়েছে। এটাই বোধহয় ভবিতব্য। দীর্ঘশ্বাসের সাহায্যে ভেতরের আহত বাতাসটুকু বের করে দিয়ে চোখ ঘোরায় ঈশানী। সামান্য নড়াচড়া করে উঠে বসার চেষ্টা চালালে চট করে কেউ একজন বাঁধা প্রদান করে আদুরে শাসনে বলে,
—প্লিজ, ডোন্ট গেট আপ।
লোকটার গমগমে আওয়াজ অপরিচিত ঠেকলো ঈশুর কানে। সহসা চোখ উঁচিয়ে সামনে দৃষ্টিপাত করতেই দেখলো, একজন চশমা পরিহিত মাঝ বয়সী রুশ লোক যত্ন সহকারে স্যালাইন খুলছে ওর বাহু থেকে । লোকটাকে ডাক্তার মনে হচ্ছে। কিন্তু এই পেন্ট হাউজে ওর জন্য কেইবা ডাক্তারের ব্যবস্থা করবে? এটাতো অসম্ভব। সন্দেহের বশবর্তী হয়ে ঈশানী নড়চড়ে বসতে চায় ফের। তখনই কোথা থেকে যেন ফ্লোরা এগিয়ে এসে দু’বাহু ধরে শান্ত করে ঈশানীকে। মিষ্টি হেসে ওকে আস্বস্ত করে বলে,

— এখন কেমন লাগছে ঈশু?
ফ্লোরার এই নিষ্পাপ সম্মোহনী হাসিতে মনটা বিষণ্ন হয়ে পরে ঈশানীর।মনে পরে যায় মুক্তির লোভে নিজের করা একাধিক কপটতার কথা। তবুও মেয়েটা এতো স্বাভাবিক কি করে আছে?
— কি হলো? তুমি কি এখনো অসুস্থ বোধ করছো ঈশু?
ফ্লোরার মৃদু আওয়াজে ভ্রম কাটে ঈশানীর। চারিদিক অবলোকন করে ও দেখতে পায় সবকিছু স্বাভাবিক শান্ত। এক ফোঁটা র’ক্তের চিহ্ন নেই কোথাও। এমনকি ওর পরনের জামা কাপড় গুলো ও অত্যন্ত পরিপাটি।
চারিদিকে বিষণ্ণ নজর বুলিয়ে জিহ্বা দিয়ে নিজের শুষ্ক অধর ভিজিয়ে পাশে দাঁড়ানো মাঝ বয়সী লোকটাকে ইশারা করে মৃদুস্বরে ঈশানী জিজ্ঞেস করে,
—- উনি কে ফ্লোরা?
ঈশানীর পাশে বসে ওর হাতের মাঝে হাত রেখে ফ্লোরা জানায়,
—- উনি ডক্টর মাতভেই। এরীশের পার্সনাল সার্জন।
— পার্সনাল সার্জন?
প্রশ্নটা করার সময় ভ্রু কুঞ্চন করে ফেললো ঈশানী।
হ্যা সূচক মাথা নাড়ায় ফ্লোরা। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উদাস কন্ঠে বলে,
— প্রত্যেক এক দু’মাস পরপরই কোনো না কোনো কারণে সার্জারীর প্রয়োজন পরে এরীশের। ওই জন্যই তো বুলেটের আঘাতের অভাব নেই ওর শরীরে।
ফ্লোরার কথায়,ঈশানী এবার কৌতূহলী কন্ঠে শুধালো,

— কিন্তু এরীশের পার্সনাল সার্জন এখানে কেন?
— কেন আবার তোমাকে ট্রিটমেন্ট করার জন্য।
— কিন্তু কে ডেকে পাঠিয়েছে ওনাকে।
ঈশানীর শেষ প্রশ্নে ফ্লোরা কাঁধ ঝাকিয়ে ঠোঁট উল্টে অজ্ঞাত স্বরে বললো,
— সেটাতো জানিনা।
ফ্লোরার কথার পাছে আগ বাড়িয়ে আরও কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলো ঈশানী। তবে ওকে আর কোনোরূপ কথা বলার ফুরসত না দিয়েই দরজার কাছ থেকে একজন গার্ড ডেকে উঠলো সশব্দে।জানালো,
— অফিস রুমে যেতে হবে, এরীশ ডাকছে তোমায়।
গার্ডের কথায় শঙ্কিত হয়ে শুষ্ক ঢোক গিললো ঈশানী। মনেমনে ভাবতে লাগলো,
— এবার তাহলে কি হবে?

নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে চারিপাশ। অফিস রুমের ডেস্কে বসে একমনে কপালে আঙুল স্লাইড করছে এরীশ। ওর চোখের দৃষ্টি নিস্প্রভ, দাঁতের সাহায্যে অধর কামড়ে রেখেছে অহেতুক। দেখে মনে হচ্ছে বিশেষ কিছু নিয়ে চিন্তায় মশগুল মাফিয়া বস টা। ঠিক এমন সময় ভেজিয়ে রাখা দরজা ঠেলে অফিস কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করে তুষার। হাতে থাকা আই প্যাড টা এরীশের দিকে স-গতিতে বাড়িয়ে দিয়ে পুনরায় স্থির হয়ে দাঁড়ালো সে।
উদাসীন ভঙ্গিতে আইপ্যাডটা স্ক্রল করতে করতেই প্রশ্ন ছুড়লো এরীশ ,
— ডক্টর মাতভেই এসেছে?
তুষার হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে জানায়,
— এসেছে।
এরীশ এবার সোজা হয়ে পিঠ টানটান করে বসলো চেয়ারে। আই প্যাডটাতে সুক্ষ্ম নজর বুলিয়ে জিভ দিয়ে গাল ঠেলে রাশভারি আওয়াজে বললো,
— লা’শ দু’টোকে পেয়েছো?
পুনরায় মাথায় নাড়িয়ে হ্যা জানায় তুষার,পরক্ষনেই চিন্তিত স্বরে বলে,

— লা’শ দু’টোকে পাওয়া গেলেও। ক্যামেরাটার খোঁজ পাওয়া যায়নি। মনে হচ্ছে কেউ ইচ্ছে করে সরিয়ে ফেলেছে।
হাতের আঙুল গুলো নির্বিগ্নে টেবিলের উপর নাড়াতে নাড়াতে এরীশ বললো,
— ইট ওয়াজ আ ট্র্যাপ।
— আই আলসো থিংক দ্যাট।
— বাই দ্যা ওয়ে, এরা দু’জন কারা ছিল?আর জঙ্গলেই বা কি করছিল?
, নাক টেনে বুক ভর্তি বাতাস পুরে নিলো তুষার। অতঃপর এরীশের প্রশ্নের প্রত্যুত্তর করে বললো,
— এখানেও ট্র্যাপ। দু’জনার মধ্যে একজন ডেনিয়েলের সিক্রেট স্পাই ছিল ঠিকই, কিন্তু আরেকজনের পরিচয় এখন প্রযন্ত আইডেন্টিফাই করা যায়নি।
— দ্রুত করো। আই ওয়ান্ট অল অফ দেম ইন মাই বেজমেন্ট।
এরীশের কন্ঠে ভয়াবহ ক্ষুদ্ধতা। তুষার একটু আগ বাড়িয়ে তীর্যক ভ্রু উঁচিয়ে বললো,

— ওদের অপরাধ?
— কৈফিয়ত চাইছো?
চোখ ছোট ছোট করে তীক্ষ্ণ নজরে তাকালো এরীশ।
ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে, ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বেড়িয়ে যেতে যেতে তুষার বলে,
— ওফ! ভুলে গিয়েছিলাম এরীশ ইউভান তো আবার কাউকে কৈফিয়ত দেয়না।
তুষারের কথায় না চাইতেও কয়েক সেকেন্ডের জন্য ঠোঁট কামড়ে ফিচেল হাসলো এরীশ।
অফিস কক্ষ থেকে বেড়িয়ে যেতে নিয়েও ফের ঘুরে এলো তুষার। হাতের সাহায্যে কপালে লেপ্টে থাকা ঘন চুল গুলোকে ব্যাকব্রাশ করে এরীশকে উদ্দেশ্য করে গভীর স্বরে বলে ওঠে,
—- মেয়েটাকে সেদিন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বাট শী ইজ সো এক্সপেন্সিভ। দুবাই শেখ দের মনের রানী।
তুষারের কথায় উপহাস করে চোখ উল্টালো এরীশ। কোনোরূপ দ্বিধাবোধ না করেই নির্বিকার গলায় বললো,

— সো হোয়াট?
এরীশের কথায় চক্ষু কপালে উঠে গেলো তুষারের। এতো এক্সপেন্সিভ মেয়েটাকে অহেতুক বিদেয় করে বলছে, সো হোয়াট?
সেই তখন থেকে তুষার বিনাবাক্যে চেয়ে আছে দেখে,কন্ঠে নিদারুণ গাম্ভীর্যতা টেনে এরীশ বলে,
— লিসেন, স্বস্তা জিনিসে টাচ করতে ভালো লাগেনা আমার। বড্ড ইরেটেটিং ফিল হয়। নেক্সট টাইম আর এসব পাঠি ও না।
— তাহলে কি আরও এক্সপেন্সিভ…
— নেভার!
বাক্যটুকু জিহ্বা থেকে বেরিয়ে আসার আগেই মুখের উপর হুংকার দিয়ে তুষার কে পুরোপুরি থামিয়ে দেয় এরীশ।
— তাহলে এক্সপেন্সিভ বলতে কি বোঝাতে চাইছেন?
— কিছুনা, ইউ ক্যান লিভ নাও।
তুষার আর কিইবা করবে। মনেমনে নিজের বসকে চরম আনরোমান্টিক উপাধিতে ভূষিত করে উদাস পায়ে বেরিয়ে যায় অফিস কক্ষ ছেড়ে।

তুষার অফিস রুম ত্যাগ করতে না করতেই, অন্যপাশ থেকে ঈশানীকে টেনেহিঁচড়ে অফিস কক্ষে এনে হাজির করে একজন গার্ড। ঈশানী আসতে চাইছিল না বলে ওর বাহু ধরে টানতে টানতে নিয়ে এসেছে গার্ড টা। এমনকি এই মূহুর্তে এরীশের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ও শক্ত হাতে ঈশুর বাহু চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে সে। যেন কোনো দ’ণ্ডপ্রাপ্ত আ’সামিকে ধরে নিয়ে এসেছে কাঠগড়ায়।
ব্যথাতুর দৃষ্টিতে এরীশের পানে এক পল চাইলো ঈশানী। ওর নীলাম্বর অসহায় চোখ দু’টো অবলোকন করে মূহুর্তেই ব্যথা করে উঠলো এরীশের খরখরে উত্তপ্ত হৃদয়টা।একই সঙ্গে চড়াও হওয়া ক্রোধে ভলভলিয়ে উঠলো মস্তিষ্ক। তৎক্ষনাৎ ঈশানীর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে গার্ডটার উদ্দেশ্যে চোয়াল শক্ত করে এরীশ বলে ওঠে,

— টাচ করতে নিষেধ করেছিলাম।
আঁতকে উঠে সঙ্গে সঙ্গে ঈশানীর বাহু ছেড়ে দেয় গার্ডটা। মাথা নামিয়ে কুর্নিশ জানিয়ে থমথমে মুখে বলে,
— আসলে বস, উনি আসতে চাইছিল না। তাই আর কি…
— রুলস ইজ রুলস। আসতে না চাইলে পা’য়ে ধরে অনুনয় করে আনবে । তবুও টাচ করা যাবেনা। নাও গেট লস্ট।
পুনরায় বেশ কয়েকবার ভয়ার্ত নজরে এরীশকে কুর্নিশ জানিয়ে, তাড়াহুড়ো পায়ে কক্ষ ত্যাগ করলো লোকটা।
ওদিকে এরীশের কথায় হতবিহ্বল ঈশানী। একটু আগে এসব কি বললো লোকটা? আদৌও নিজের সেন্স থেকে বলেছে নাকি নেশার ঘোরে ভুলভাল বকছে? আচ্ছা জ্বর টর হয়নি তো ওনার?
হাজারটা ভাবনায় বিভোর ঈশানী। ঠিক এমন সময় ওর ঘোর কেটে গেলো এরীশের কর্কশ আওয়াজে,
— আই থিংক, তুমি ওই জায়গাটা তে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছো।চেয়েছিলাম পাঠাবো না, এখন মনে হচ্ছে হচ্ছে ওটাই তোমার জন্য বেস্ট অপশন।
— নাহ!
অকস্মাৎ শিউরে উঠলো ঈশানী। দিশেহারা গলায় শব্দটুকু উচ্চারণ করে, হাঁটু ভেঙে ধপ করে মেঝেতে বসে দু’হাত জোর করে ক্ষমা চাইলো এরীশের কাছে ।
এবারে সশব্দে চেয়ার ছেড়ে ঈশানীর নিকট এগিয়ে এলো এরীশ। একহাঁটু ভর করে ওর মুখোমুখি হয়ে বসে, ঈশুর জোর করা হাত দু’টো চেপে ধরে নিজ হাতে। অতঃপর কিঞ্চিৎ ঘাড় বাকিয়ে সরল মেয়েটার ক্রন্দনরত মুখের পানে চেয়ে দাঁতে দাঁত পিষে হিসহিসিয়ে বলে,

— কতবার বলেছি আমার সামনে এই ইনোসেন্ট ব্লু আইস দেখিয়ে কোনো লাভ হবে না। বিকজ আ’ম হার্টলেস।
— জানি।
ঈশানীর মুখে এই জানি শব্দটা কেন যেন মোটেই ভালো লাগলো না এরীশের। ভেতরের পৈশাচিক সত্তাটা হল্লা করে উঠলো মূহুর্তেই,তাকে প্রাধান্য দিয়ে শক্ত গলায় এরীশ বললো,
— জেনে থাকলে পালিয়েছো কোন সাহসে? আমার সঙ্গে লাগতে আসতে বারণ করিনি?
ঈশানী ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো,
— আমিতো লাগতে আসিনি, মুক্তি চেয়েছি শুধু।
— সেটা এই জীবনে পাবেনা। এরীশ ইউভানের হাত থেকে মুক্তি নেই তোমার।
— চ্যালেঞ্জ করছেন?
এতোকিছুর পরেও মেয়েটার জিদ কমেনি একরত্তি। অগত্যাই ওর হাত দুটো উপরে কাউচের সঙ্গে চেপে ধরে ক্ষুদ্ধস্বরে এরীশ বলে ,
— করছি, চ্যালেঞ্জ করছি। মুক্তি তো দূরে থাক এরীশ ইউভানের চোখের আড়াল পর্যন্ত হতে পারবে না তুমি কোনোদিন।
কথা শেষ করে এক ঝটকায় ঈশানীকে দূরে ঠেলে দিয়ে, লম্বা পা ফেলে অফিস রুম ত্যাগ করে এরীশ।

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ১৬

বেজমেন্টের ট’র্চার সেল থেকে ভেসে আসছে হৃদয় বি’দারক বীভৎস চিৎকার। যদিও বেজমেন্টেটা পুরোপুরি সাউণ্ড প্রুফ। তবুও বিরক্ত হয়ে কানে এয়ারপড গুঁজলো এরীশ। দু’ঠোঁটের ফাঁকে ধরালো সিগারেটের জ’লন্ত শলাকা। সেভাবেই পকেটে হাত গুঁজে এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলো ভেন্টিলেটর থেকে আগত এক ফালি নিয়ন আলোক রশ্মির দিকে।
একটু আগের সেই গার্ডটার আঙুলের নখ গুলো তুলে নেওয়া হচ্ছে বেজায় নৃ’শংস ভাবে। তার চিৎকারের আওয়াজেই আপাতত কাঁপছে পুরো বেজমেন্টে। চিৎকারের এক পর্যায়ে লোকটা হাঁপাতে হাঁপাতে অস্পষ্ট আওয়াজে বললো,
— কি অন্যায় করেছি আমি?
ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে ধোঁয়ার কুন্ডলি ছেড়ে নির্বিকার কন্ঠে বিড়বিড়ালো এরীশ,
— এরীশ কাউকে কৈফিয়ত দেয়না।

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ১৮