আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ১৮

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ১৮
suraiya rafa

কেটে গিয়েছে বেশ কয়েকটা দিন। তুষার পাত এখনো কমেনি রাশিয়াতে। তিন মাস আগে এসেছে থেকে সেই এক তুষার পাত দেখতে দেখতে জীবনটা কেমন একঘেয়ে লাগছে ঈশানীর নিকট। একটু রোদ, একটু বৃষ্টি, একটু মেঘলা আকাশ দেখার জন্য হৃদয়টা আনচান করছে কেমন। এই ছোট্ট রুমটাতে ক্যালেন্ডার নেই, আর না তো পেন্ট হাউজে কোনো ইংলিশ ক্যালেন্ডার রয়েছে।অগত্যাই ডায়েরিতে লিখে লিখে দিন, সপ্তাহ, মাস হিসেব করে রাখে ঈশু। এখন মাঝরাত, রুমের ঝকঝকে আলো নিভিয়ে ছোট্ট একটা হ্যাজাক জ্বালিয়ে ডায়েরি আর কলম হাতে নিয়ে স্টাডি টেবিলে বসে আছে ঈশানী। হ্যাজাকের লালচে রোশনাই এ ঢলঢলে চেহারাখানা কি দারুণ লাগছে , বিষণ্ণ চেহারাতেও লাবণ্যতা আর স্নিগ্ধতা যেন উপচে পড়ছে তার।
সেদিন ওই বীভৎস ঘটনার পর থেকে আর কখনো পালানোর দুঃসাহস দেখাইনি ঈশানী। বলা যায় একপ্রকাশ আশাহত হয়ে অন্তর্মুখী মেয়েটা মেনে নিয়েছে নিজের দূর্বিষহ ভবিতব্য। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে এই বিশাল পেন্ট হাউজের বারো বাই বারো ফিটের ছোট্ট রুমটাতে।

আজ বহুদিন বাদে রাতে ডায়েরি লিখতে বসেছিল ঈশানী। সরু জানালার পর্দা ভেজিয়ে, আলো নিভিয়ে, একেবারে নিরিবিলি ঝিমঝিমে পরিবেশ তৈরি করে নিয়েছে নিজের জন্য। অতঃপর আঙুলের ফাঁকে কলম নাড়িয়ে লেখা শুরু করে মনের অযাচিত সকল ভাবাবেগ। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে যায় এক নাগাড়ে। অবশেষে একদম শেষ লাইনে এসে কি মনে করে যেন গুটিগুটি অক্ষরে লিখলো ঈশানী,
” চেরিব্লোসমের একটা সুন্দর বিকেল হোক আমার” স্বপ্ন পূরণের জন্য একটা নিজের মানুষ, আর এক মুঠো সতেজ খুশি…..
বোকা মেয়েটা এখনো খুশি হওয়ার স্বপ্ন দেখে, কি জানি কেন?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ঈশু লিখছিল,মাঝরাত্তিরে মনের সবটুকু আবেগ ঢেলে সাজাচ্ছিল ডায়েরির পাতায়। ঠিক এমন সময় উপর তলা থেকে আগত কিছু অযাচিত আওয়াজে কর্ণকূহর সচকিত হয়ে ওঠে ওর। আঙুলের ফাঁক থেকে কলম ছুটে যায় আচানক। ক্রমাগত একই আওয়াজ আর প্রতিধ্বনিতে রুম থেকে বেরিয়ে লাউঞ্জের দিকে পা বাড়ায় ঈশানী। ফ্লোরা রুম আঁটকে ঘুমুচ্ছে। ঈশানীর জানা মতে তুষার আর এরীশ পেন্ট হাউজে নেই, তাহলে এতো রাতে কিসের আওয়াজ হচ্ছে এমন? অগত্যা রহস্যময় এই আওয়াজের উৎস খুঁজতে ঈশানী একাই সিঁড়ি ডিঙিয়ে ছুটে যায় দোতলায়। ছোটার ফাঁকে করিডোরের মাঝে দাঁড়িয়ে এক পল চাইলো এরীশের অফিস রুমের দিকে। যেটা এখন গার্ডদের পাহারায়। তারমানে অফিস কক্ষে কেউ নেই। তাহলে আওয়াজ কোথা থেকে আসছে?

ঈশানী ভাবতে লাগলো। তৎক্ষনাৎ আবারও সেই ধুপধাপ আওয়াজ ভেসে এলো করিডোরের অন্যপাশ থেকে। ভয় করছে কিঞ্চিৎ, তবুও ধীর কদমে সেই আওয়াজ অনুসরণ করে এগিয়ে যায় ঈশানী। কারণ ও জানে এই মূর্তিমান গার্ডগুলো দেখতে নির্জীব হলে কি হবে, সময় মতো একেকটা জা’নোয়ারের চাইতেও বেশি হিং’স্র তারা। এগোতে এগোতে এক পর্যায়ে একটা বিশাল মাস্টার বেড রুমের সামনে এসে থমকালো ঈশা। এই রুমের ভেতর থেকেই আওয়াজ বেরিয়ে আসছে কিছুক্ষণ পরপর। কিন্তু এতো রাতে কে আওয়াজ করছে এমন? কিসেরই বা আওয়াজ এগুলো?
অন্তর্গহীনের জাগ্রত প্রশ্নের উত্তর খোঁজার প্রয়াসে কোনো কোনোকিছু না ভেবেই ভেতরের দিকে পা বাড়ায় ঈশানী। ঈশানী রুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বিনা আওয়াজে একেবারে মসৃণ ভেলভেটের ন্যায় লেগে গেলো দরজাটা। রুমের ভেতরে শুধুই কালোর সমাহার, অবশ্য এটা ঈশানীর কাছে নতুন কিছু নয়, এই পেন্ট হাউজটাই তো পুরোপুরি কালো। মরীচিকার মতো একটা তমশাচ্ছন্ন পাপের দুনিয়া।
গোলকধাঁধার মতো বিস্তৃত রুমটা ঘুরে দেখতে দেখতেই ঈশানী ভাবে,

—- এতোগুলা দিন ধরে এখানে আছি, এই রুমটা কখনো চোখে পরলো না কেন? কে থাকে এখানে?
পরক্ষনেই ঠোঁট উল্টে নিজেকে নিজে বোঝালো ও,
— অবশ্য আমিতো এদিকে আসিই নি কখনো। চোখে পরবেই বা কেমন করে? কিন্তু কে আছে এখানে?
ঈশানী এক জায়গাতে দাঁড়িয়ে ঘুরে দেখছিল চারিপাশ। ঠিক তখনই ওর কৌতুহলী চোখ আটকায় বেড সাইড দেওয়ালের বিশাল পেন্টিং টাতে। দেওয়াল জোড়া অঙ্কিত বিশাল এক ভয়ানক পাইথনের চিত্র দেখে মূহুর্তেই চোখমুখ কুঁচকে এলো ওর। চিত্র তো নয় যেন জ্যান্ত এক মানুষ খে’কো সরীসৃপ। সেভাবেই কালো চিকচিকে চোখ দুটো মেলে তাকিয়ে আছে ওর পানে। যা দেখা মাত্রই অজানা শিহরণে শীতল ঠান্ডা স্রোত নেমে গেলো ঈশুর মেরুদণ্ড বেয়ে। সেদিকে এক পল ভয়ার্ত নজরে বুলিয়ে ঈশু তাড়াহুড়ো করে ফিরে যাবে, তার আগেই ওর ধ্যান ফিরে এলো পুনরায় সেই অযাচিত আওয়াজে।

আওয়াজ পেয়ে ঘুরে দাঁড়ালো ঈশানী। দেখলো রুমের মাঝেই আরেকটা রুম। ওদিকটায় আলো জ্বলছে, তাই অহেতুক ভয় না পেয়ে এগিয়ে গেলো আলোর সূত্র ধরে। হাট করে খোলা দরজার এক কোণে দাঁড়িয়ে কুণ্ঠিত নজরে ভেতরে উঁকি দিতেই থমকে গেলো ঈশানী। চোখদুটো নিস্প্রভ হয়ে সামনের দৃশ্যে আটকে গেলো আপনাআপনি। অজান্তেই ফাঁকা হয়ে এলো অধর জুগল, ফাঁকা হয়ে যাওয়া সেই হকচকানো ওষ্ঠাধর নাড়িয়ে একা একাই বিড়বিড়ালো মেয়েটা,
— তারমানে এটা এরীশের রুম?
মাস্টার বেডরুমের সঙ্গে যুক্ত জিম রুমটাতে একাই এরীশ। হাতে লেদারের গ্লাভস লাগিয়ে সেই তখন থেকে পাঞ্চিং ব্যগটায় ক্রমাগত পাঞ্চ করে যাচ্ছে সে। বেখেয়ালে রুমের দরজা খুলে রাখায় মাঝরাতে ওর পাঞ্চিং এর আওয়াজই এতোক্ষণ ধরে ধুপধাপ রহস্যময়ী শব্দে মুখরিত করে দিয়েছিল পুরো পেন্ট হাউজের চার দেওয়াল।
মাঝরাতে যখন তখন জিম করার অভ্যেস রয়েছে এরীশের। তাই এহেন শব্দে গার্ড’সরা উদগ্রীব না হলেও, বোকা মেয়েটা কৌতুহলী হয়ে ঠিকই ঘুরতে ঘুরতে চলছে এসেছে বাঘের গুহায়। হয়তো ও নিজেও অনুমান করেনি যে বাঘটা পেন্ট হাউজেই রয়েছে। কিন্তু এবার কি হবে?

শুষ্ক একটা ঢোক গিলে জিভের ডগা দিয়ে অধর ভিজিয়ে নিলো ঈশানী। অতঃপর আড় চোখে পুনরায় দেখে নিলো এরীশের অবস্থান। পরনে একটা কালো স্যান্ডো গেঞ্জি আর কার্গো প্যান্ট। ট্যাটু করা উন্মুক্ত পেশিবহুল হাতটা পুরোপুরি দৃশ্যমান, হাত ছাপিয়ে ঈশুর নজর গেলো পুরুষালি সুডৌল শরীরের দিকে। স্কিনি স্যান্ডো গেঞ্জি ভেদ করে তার জিম করা পোক্ত শরীরের প্রতিটি ভাজ আকর্ষনীয় লাগছে ভীষণ। তারচেয়েও বেশি আকর্ষনীয় লাগছে সামনের এই দৃশ্যটা। পাঞ্চ করার সময় তার প্রতিক্রিয়া, তার ঘর্মাক্ত মুখভঙ্গিমা, দাঁতের ডগা দিয়ে বারবার অধর কামড়ে ধরা সবকিছুই অপার্থিব। বরাবরের মতোই এবারও ঈশুর মনের কিনারে একটাই প্রশ্ন উঁকি দিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত,

— উঁনি কি আসলেই একটা দয়ামায়াহীন নির্দয় মাফিয়া। নাকি শোবিজ দুনিয়ার কোনো নাম করা সুপারস্টার?
পাঞ্চিং এর এক পর্যায়ে কোনো কিছুর ইঙ্গিত না দিয়ে হুট করেই রুমের দরজায় চোখ রাখলো এরীশ। এরীশের হঠাৎ চাউনীতে তরাগ করে ধড়ফড়িয়ে উঠলো ঈশানীর হৃদয়টা। তৎক্ষনাৎ দরজার আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে নিজের দম আটকে দাড়িয়ে পড়লো ঈশানী। মনেমনে ঈশ্বর কে ডেকে একটাই প্রার্থনা করতে লাগলো, যেন কিছুতেই এদিকে চলে না আসে এরীশ । নয়তো আজ আরও একবার নিজের সর্বনাশের মুখোমুখি হতে হবে ওকে।
ঈশানীর প্রার্থনা কাজে দিলো হয়তো। এরীশ জিম রুম থেকে বেরিয়েছে ঠিকই,কিন্তু ঈশুর ধারে কাছেও আসেনি সে। উল্টো সোজা ঢুকে গিয়েছি ওয়াশরুমে। এরীশ ওয়াশরুমে ঢুকতেই হাফ ছাড়ে ঈশানী, সহসা তাড়াহুড়ো কেটে পড়ার ধান্দায় চারিদিকে একবার সর্তক নজর বুলিয়ে সোজা এগিয়ে যায় দরজার কাছে। কিন্তু সেখানেই ঘটলো আসল বিপত্তি। রুমটা ছিল ফিঙ্গার লক। মানে এরীশের ফিঙ্গার প্রিন্ট ছাড়া এই দরজা কিছুতেই খুলবে না। কিছুতেই না, মানে কিছুতেই না।

খানিকক্ষণ টানাটানি আর জোরজবরদস্তি করে অবশেষে ঈশানী যখন বুঝতে পারে এই কাহিনী,সঙ্গে সঙ্গে কলিজার সব পানি শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় ওর ভেতরটা। তপ্তশ্বাস ছেড়ে চকিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে ভয়াতুর দৃষ্টি মেলে তাকায় পুরো রুমের দিকে। এই কালো রুম, দেওয়ালের পাইথন পেইন্টিং, ওয়াশরুম থেকে আগত শীতল পানির ঝপঝপ আওয়াজ সবকিছুই যেন একযোগে বিদ্রুপ করে হাসছে ওকে দেখে।সকল আওয়াজ ছাপিয়ে শুধু একটা কথাই ক্রমাগত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ঈশুর কর্ণকূহরে,
— বোকা ঈশানী, সব সময় নিজেকে আত্নবিশ্বাসী প্রমান করতে গিয়ে ফেঁসে যায় মেয়েটা। বেচারি!
কুণ্ঠায় এককোণে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। বিভ্রান্তি আর অস্থিরতায় মস্তিষ্ক নিশ্চল। ঠিক তখনই ওয়াশরুমের ভেতর থেকে ভেসে আসে এরীশের রাশভারি আওয়াজ,
— তুষার! টাওয়াল টা এগিয়ে দাও তো।
এরীশের আওয়াজ পেয়ে অস্থিরতার চরম শিওরে পৌঁছে গেলো ঈশানী। ভেতরের শঙ্কাকে পাছে হটিয়ে দুশ্চিন্তারা ভর করলো অযাচিত মস্তিষ্কে। এই রুম থেকে আপাতত বের হওয়ার উপায় নেই তা জানা সত্ত্বেও দুএকবার স্বহস্তে ধাক্কা দিলো মেটালিক দরজাটায়। অহেতুক ধাক্কায় সেটি খোলা তো দূরে থাক, উল্টো ব্যথা পেলো ঈশানী।

— তুষার, ক্যান ইউ হেয়ার মি?টাওয়াল টা দাও
পুনরায় ভেসে এলো এরীশের রাশভারি কন্ঠস্বর। যা শোনা মাত্রই দরজা থেকে চোখ সরিয়ে চোরা চোখে ঘুরে তাকায় ঈশানী। পেছনে ঘুরে ওয়াশরুমের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই ও দেখলো দরজার ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়েছে এরীশ। আরেকবার ডাক দিলো বলে। আর তারপর হয়তো সোজা বেড়িয়ে আসবে ওয়াশরুম থেকে। তখন কি হবে?
অন্তহীন ভাবনায় পিলে চমকে গেলো ঈশানীর। ও আর কিছু না ভেবেই গলার স্কার্ফটা দিয়ে ভালো মতো মুখ ঢেকে বেড থেকে তোয়ালেটা নিয়ে সোজা এগিয়ে গেলো ওয়াশরুমের কাছে। কাঁচের দরজার ফাঁক গলিয়ে হাত বাড়িয়ে রেখেছে এরীশ , এককোণে কোনোমতে আঁটোসাটো করে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস আঁটকে কম্পিত হস্তে এরীশের হাতের দিকে তোয়ালেটা এগিয়ে দিলো ও ।তৎক্ষনাৎ তোয়ালের বদলে ঈশুর নরম হাতটা কব্জিবন্দি করে নেয় মাফিয়া বস।
অতঃপর চোখের পলকে হ্যাঁচকা টানে নিয়ে যায় ভেতরে। ঈশানী কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওকে ঘুরিয়ে নিজের বাহুবদ্ধ করে অন্যহাতে থাকা ধারালো চা’কুটা অকস্মাৎ চেপে ধরে ওর গলায়।

সরু কণ্ঠনালীর ঠিক নিচে ছুঁই ছুঁই করছে একটা চকচকে ধারালো চা’কু। যা দেখা মাত্রই শরীরের রক্ত ঠান্ডা গেলো ঈশানীর।মাত্রাতিরিক্ত আতঙ্কে জর্জরিত হয়ে শ্বাস নিতে ভুলে গিয়েছে মেয়েটা। ওদিকে শাওয়ার থেকে নিঃশব্দে বেড়িয়ে আসা শীতল জলের স্রোতে ভিজে একাকার ওর সর্বাঙ্গ। পানিতে ভিজে সফেদ রঙা ফিনফিনে পাতলা ফ্রকটা ইতিমধ্যে আয়নায় পরিনত হয়েছে। পাতলা ফ্রকের আস্তর ভেদ করে মেয়েটার গমরঙা কোমল ত্বক স্পষ্ট দৃশ্যমান। যদিও এরীশ কিংবা ঈশানী কারোর ই খেয়াল নেই সেদিকে। এই মূহুর্তে কঠিন কোনো শা’স্তির ভয়ে নীল হয়ে আছে ঈশানীর সমগ্র মুখমণ্ডল। এরীশ নিজের হাতের অবস্থান অনড় রেখেই অত্যন্ত কুটিল স্বরে বলে ওঠে,

— ঠিকই ধরেছিলাম। রুমে কেউ একজন ঢুকে পড়েছে। এরীশ ইউভানের সিক্স সেন্স কখনো ভুল হতে পারে না।
এরীশের কথাগুলো কর্ণকূহর ভেদ করতেই চকিতে ঘাড় ঘোরায় ঈশানী। স্ব অবস্থানে থেকেই চোখ রাখে পিয়ার্সিং করা ধূসর বাদামী একজোড়া অনুভূতিহীন শূন্য চোখে। শাওয়ারের পানি এসে একই তালে ভিজিয়ে দিচ্ছে দু’জনকে। স্নিগ্ধ জলের স্পর্শে এরীশের সিগারেট পোড়া কালচে বাদামি অধর জুগল আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। তবে অধর তলার ওই নির্লিপ্ত তিলকের কাছে সেই উজ্জ্বলতা নিতান্তই ফিকে লাগছে।

ঈশানী তাকিয়ে আছে, ওর চোখের কোণে বহুল আতঙ্কের ছাপ। ওদিকে গাঢ় নীল অক্ষি জুগলের দর্শন পেতে না পেতেই কয়েক ন্যানো সেকেন্ডের মাঝে চোখের রং বদলে গেলো এরীশের। মুখটা স্কার্ফের আড়ালে ঢাকা দিলেও এরীশের আর বুঝতে বাকি নেই এই নীল চোখের মালিক আসলে কে? এই সেই চোখ যা দেখলে এরীশের মতো মানুষের কড়াপড়া হৃদয়টাও গতি হারায় নিমিষেই।বিচক্ষণ, সর্বগ্রাসী,নির্দয় মাফিয়াটাও লক্ষ্যচ্যুত হয় বারবার। পাপী মাফিয়া বস টার দুনিয়া থমকে এই মহাসমুদ্রের মতো গাঢ় পবিত্র চোখের মাঝে। না চাইতেও ভেতরের পৈশাচিক সত্তাটা হার মেনে নেয় বারবার। ঠিক এখন এই মূহুর্তের মতো।সরলতার গাঢ় নীল চোখের মাঝে আটকে গিয়ে কখন যে ধারালো চা’কুটা হাত ফস্কে নিচে পরে গিয়েছে সে কথা জানেনা স্বয়ং এরীশ। চা’কু পরে যাওয়ার ঝনঝন আওয়াজে নড়েচড়ে ওঠে ঈশানী। এরীশের হাত থেকে বেরোনোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে গলার আওয়াজ খাদে নামিয়ে ঠোঁট নাড়ায় ভীত মেয়েটা,

— দয়াকরে ছেড়ে দিন। ভুল হয়ে গিয়েছে।
এরীশ ছাড়লো না ওকে। উল্টো ঈশুর তুলতুলে নরম হাতদুটোকে উপরে তুলে নিজের বলিষ্ঠ হাতে মুঠোবন্দি করে কাচের দেওয়ালের সঙ্গে আচানক চেপে ধরে ওর লতানো শীর্ণকায় শরীরটাকে। মায়াজালের ন্যায় বিস্তৃত দম আটকে আসা চোখ দুটোতে দৃষ্টি ফেলে তীক্ষ্ণ চোয়ালের পেশি গুলো আরও খানিকটা শক্ত করে গমগমে আওয়াজে এরীশ বলে,
— এখানে কেন এসেছো?
— প…পথ ভুলে।প্লিজ এবারের মতো ছেড়ে দিন।
ভীষণ কুণ্ঠায় আওয়াজ বের হচ্ছে না ঈশুর কণ্ঠনালী ভেদ করে। জলের স্রোতে কাক ভেজা হয়ে গিয়েছে শরীর। তারউপর এরীশের এহেন আশ্চর্য রকম শক্ত হাতের বাঁধন। সবমিলিয়ে অন্তঃকরণ নিভু নিভু করছে ঈশানীর। এক্ষুণি রুহুটা বেড়িয়ে গেলো বলে। ঈশানীর ভয়ার্ত চাউনীতে কোনোরূপ ভাবান্তর দেখা গেলোনা এরীশের মাঝে। ও উল্টো মেয়েটার দূর্বল শরীরটায় কঠিন ঝাঁকুনি দিয়ে বিরক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

— ইচ্ছে করছে খেয়ে ফেলি?
এরীশের এরূপ কথায় তরাগ চোখ তুলে চাইলো ঈশানী, জড়ানো গলায় ঠোঁট নাড়িয়ে শুধালো,
— খেয়ে ফেলবেন মানে? কা..কাকে?
— তোমার আত্নাটাকে। আজকাল বড্ড পোড়াচ্ছো আমায়। এটা অসহ্য লাগছে, তুমিও কি ম্যানিউপুলেশন জানো নাকি?
এরীশের কন্ঠস্বর দৃঢ় শোনালো। ওদিকে ওর কথার জের ধরে ঈশানী না চাইতেও ভ্রু বাঁকিয়ে বলে উঠলো,
— কিহ!
— কতবার বলেছি আমাকে এই ইনোসেন্ট ব্লু আইস দেখাবে না।এটা যন্ত্রনাদায়ক।
— কিহ!
এরীশের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা বাক্যে হতবিহ্বল কন্ঠে পরপর একই প্রশ্ন আওড়ালো ঈশানী। এরই মাঝে ওর মুখের স্কার্ফটা একটানে সরিয়ে ওর চুপসে যাওয়া এইটুকুনি মুখের পানে চেয়ে দাঁতে দাঁত পিষলো এরীশ ।কি জানি কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে ভিতরে, তার জের ধরেই মাফিয়া বস টা গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,
— আমার সামনে আসবে না একদম। নিজের এই মুখটাকে আমার চোখের আড়াল করে রাখবে সবসময়।
এরীশের কথার পাছে নাক ফোলালো ঈশানী। তীব্র রাগে তিরতির করে কেঁপে উঠলো ওর ছোট্ট নাকের ডগা। যা দৃষ্টি এড়ালো না স্বয়ং এরীশের। অগত্যা রাগের তোপে খেইর হারিয়ে এরীশের মুখের উপর ঈশু বললো,

— আপনার সামনে কোনোদিন আসবোনা বলেই তো পালাতে চেয়েছি বারবার। সেই সুযোগ দিয়েছেন একবারও? যতবার পালাতে গিয়েছি ঠিক ততবারই ধরে এনে আটকে রেখেছেন এই ন’রকের মতো কালো পেন্ট হাউজে।
— পেন্ট হাউজের বাইরের দুনিয়াটা নরকের চাইতেও বেশি কালো।
কথাটা বলে নির্জীব,শূন্য, মায়াহীন দৃষ্টিফেলে পবিত্র মেয়েটার মায়াভরা ঢলঢলে মুখখানা এক নজর পর্যবেক্ষন করে এরীশ। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে ওর দিকে সামান্য ঝুঁকে থাকার কারণে এরীশের চিবুক ছোঁয়া শীতল জলের স্রোত অনায়াসে গড়িয়ে পড়ছে ঈশানীর সমগ্র মুখমন্ডলে। এহেন জোর গতির জলের স্রোতে মেয়েটা তাকাতে পারছে না ঠিক মতো। ওর নাজেহাল অবস্থা দেখতে ভালোই লাগছে। তাইতো ওকে আরেকটু খানি জ্বালাতন করতে গ্রীবা নামিয়ে আরও খানিকটা ঝুঁকে দাঁড়ালো এরীশ। এবার দু’জনার মাঝে কয়েক ন্যানো সেন্টিমিটারের দূরত্ব মাত্র। শরীর ছুঁই ছুঁই করছে। লজ্জা আর ভয়ে জর্জরিত হয়ে মাথা নামিয়ে কুঁকড়ে দাড়িয়ে আছে ঈশানী। ভেজার কারণে ওর সম্ভ্রমের অবস্থা বেগতিক, সেদিকে এক নজর দৃষ্টিপাত করে অকস্মাৎ হাতের বাঁধন ঢিলে করে দিলো এরীশ। এরীশের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুকের উপর আড়াআড়ি করে হাত রেখে তাড়াহুড়ো পায়ে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ায় ঈশানী। এরীশ আর বাঁধা দিলো না ওকে, ভীত মেয়েটার মাথার উপর নিজের শুকনো টাওয়ালটা ছুড়ে মে’রে গমগমে আওয়াজে বললো,

— যেতে পারো।
এরীশের আদেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে বেড়িয়ে যেতে নিয়েও থমকালো ঈশানী। পেছনে না ঘুরেই রিনরিনে আওয়াজে বললো,
— দরজা তো বন্ধ। কিভাবে….
ঈশানীর কথা শেষ হতে না হতেই ভেজা শরীর নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এলো এরীশ। দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে কোনোরূপ জবাবদিহীতা ছাড়াই, ঈশানীর আঙুলটা টেনে ধরে ওর ফিঙ্গার প্রিন্ট সেট করে রাখলো দরজায়। অতঃপর রূঢ় স্বরে ঈশানীকে বললো,
— গো এহেইড।
এবারে ঈশুর হাতেই খুলে গেলো দরজাটা। দরজা খুলতে না খুলতেই এরীশের তোয়ালেটা গায়ে প্যাঁচিয়ে এক মূহুর্তের মাঝে ভেজা শরীরে ছুটে বেড়িয়ে গেলো ঈশানী। হঠাৎ করে নিজের রুমে ওর ফিঙ্গার লক কেন সেট করলো এরীশ? কেনইবা ওকে এতো সহজে ছেড়ে দিলো সে? এতোসব অজ্ঞাত প্রশ্ন ঘুরলো না ঈশানীর সরল মস্তিষ্কে। আপাতত এই ভয়ানক ভুতুড়ে রুম থেকে বের হওয়ার আনন্দে আত্নহারা ওর হৃদয়টা।

ল্যানটার্ন আর ফেইরী লাইটের চোখ ধাঁধানো আলোক রশ্মিতে ঝলসে যাচ্ছে চারিপাশ। ভেতর থেকে ভেসে আসছে মন মাতানো রাশিয়ান গানের অচেনা কিছু সুর। বার কাউন্টারের ওদিকে মদ্যপ নারী পুরুষের উপচে পরা ভীড়। সেদিকে অবশ্য দৃষ্টি দিলোনা এরীশ। পরনের ওভার কোটটা খুলে তুষারের হাতে ধরিয়ে দিয়ে, মুখের মাস্কটা সরিয়ে এলিভেটর ধরে সোজা চলে গেলো হোটেলের সিক্রেট কামরায়।
ভেতরে থমথমে নিরবতা বিরাজমান। সেভেন স্টার এই বিশাল কামরার হলের মাঝ বরাবর অবস্থিত কাউচে বসে রেড ওয়াইনে চুমুক দিচ্ছে ড্রাগন হান্টার গ্রুপের গড ফাদার ডেনিয়েল হ্যারিসন। তার পাশের কাউচে বসে একমনে ফোন স্ক্রল করছে টমেটো পিন্স খ্যাত ড্রা’গ ডিলার এ্যালেক্স জেভ।

ঠিক তখনই ওদের মাঝে উপস্থিত হয় এরীশ আর তুষার। এরীশকে দেখা মাত্রই জোকার হাসিতে আপন ঠোঁট প্রসস্ত করে ব্যস্থ ভঙ্গিতে ওকে অভ্যর্থনা জানাতে উৎসুক হয়ে উঠলো টমেটো প্রিন্স।
আজকের এই সিক্রেট মিটিং এর উদ্যোক্তা মূলত এ্যালেক্স নিজেই। ও চাইছে কোনো না কোনো ভাবে এরীশ আর ডেনিয়েলের মাঝে শখ্যতা তৈরি করতে। দুই মাফিয়া গ্রুপের সন্ধিতে মাঝখান থেকে লাভবান হবে স্বয়ং এ্যালেক্স। এরা দুজন মিলে গেলেই ওর টমেটো সসের ব্যাবসা রমরমা। সে যাই হোক আপাতত এরীশ আর ডেনিয়েলের কথোপকথনের পালা। সামনে এগিয়ে গিয়ে ডেনিয়েলের মুখোমুখি কাঁউচের উপর পায়ে পা তুলে গা ছড়িয়ে বসলো এরীশ । এ্যালেক্স জোরপূর্বক হেসে এরীশের মাঝের গুমোট ভাব ভাঙতে বেশ উৎসুক কন্ঠে বললো,
— ওহো রীশস্কা! তুমি যে সত্যিই আমার ইনভাইটেশনে এখানে আসবে, সেটা আমি ভাবতেও পারিনি। আফটার অল ইউ আর পাইথন লিডার।
ডেলিয়েলের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে এরীশ বললো,

— তুমি তো এটাও বলোনি যে, আমি ছাড়া আরও একজন ইনভাইটেড এখানে। তাহলে অন্তত রিভলবারটা ঠিকঠাক লোড করে নিয়ে আসতাম।
এ্যালেক্স মানাতে চাইলো ওকে, চোখের পাতায় কয়েক পল ছেড়ে বললো,
— আহা রীসস্কা, এখানে সমঝোতার কথা হচ্ছে। তুমি কেন অযথা এসব ব’ন্দুক টন্দুক টেনে কথা বলছো?
— আমি এসেছি, কারণ ডিল টা আমার সাথেই হচ্ছে মিস্টার এরীশ। আমি তোমাকে এমন কিছু অফার করতে চাইছি, যেটা তুমি সারা পৃথিবী খুঁজলেও পাবেনা।
এতোক্ষণে মুখ খুললো ডেনিয়েল। লোকটা এরীশের চেয়ে বয়সে বড়, তবে নির্মেদ পেট আর শরীর চর্চার মাধ্যমে তৈরি করা কৃত্রিম পেশীতে তার বয়স ঠিকঠাক অনুমান করা দুষ্কর। ওর ঠোঁটের আগায় লেপ্টে থাকা কুটিল হাসিটার দিকে এক পল চেয়ে স্পষ্ট গলায় এরীশ বললো,
— প্যাঁচানো কথা শোনার সময় নেই। সরাসরি ডিলে আসুন।
ঠোঁট উল্টালো ডেনিয়েল, কিঞ্চিৎ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,

— ওকে ফাইন।
ডেনিয়েল লোকটা যে ভীষণ চালাক তা বুঝতে বাকি নেই এরীশের। তাই আপাতত চুপচাপ বসে শুধু পর্যবেক্ষন করতে লাগলো ওর কর্মকান্ড। নিজের কথা শেষ করে একজন বিশ্বস্ত স্পাইকে ডেকে একটা বক্স আনিয়ে সেটা বাড়িয়ে দিলো এরীশের নিকট। এরীশ সেটা হাতে নেওয়ার সময় তুষার সেফটি চেক করে নিলো আগে। অতঃপর বক্সটা খুলে এগিয়ে দিলো এরীশের নিকট। বক্সটাকে ভালোমতো পর্যবেক্ষন করে এরীশ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো কিঞ্চিৎ। পরক্ষণেই নিজের বাজপাখির মতো সুক্ষ দৃষ্টি জুগল ডেনিয়েলের পানে নিবদ্ধ করে বললো,
— ব্লাড ডায়মন্ড?
— সন্দেহ আছে?
— আছে তো।
এরীশ বলতে বাঁকি তৎক্ষনাৎ চকচকে সুনিপুণ শ্বেত রঙা ডায়মন্ডটা বক্স থেকে তুলে আস্তে করে কাচের টেবিলের উপর রাখলো ডেনিয়েল। অতঃপর পকেট থেকে ছোট্ট সাইজের একটা ধারালো চা’কু বের করে নিজের হাতের মাঝ বরাবর ক্ষত করে র’ক্ত বের করে আনলো একটানে। সেই র’ক্তাক্ত হাতটা নিয়ে রাখলো ডায়মন্ডের উপর। হাত বেয়ে তাজা র’ক্তের দুএক ফোঁটা ডায়মন্ডের উপর গড়িয়ে পড়তেই স্বচ্ছ পানির মতো হীরক খন্ডটি মূহুর্তেই ধারণ করলো টকটকে লাল বর্ণ। অবিশ্বাস্য হলেও সবটা সকলের চোখের সামনেই ঘটেছে। তাজা র’ক্তের স্পর্শে ব্লাড ডায়মন্ড লাল বর্ণ ধারণ করে। পরে অবশ্য ধীরে ধীরে লাল বর্ণ মিলিয়ে যায় ঠিকই তবে এটাই ব্লাড ডায়মন্ডের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আর এরীশ সহ এখানে উপস্থিত সবাই ভালোমতোই জানে এটা।

— এবার বিশ্বাস হয়েছে নিশ্চয়ই?
টিশ্যু বক্স থেকে দুটো টিশ্যু নিয়ে হাতে চেপে ধরে পুনরায় ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন ছোড়ে ডেনিয়েল।
টকটকে লাল অপার্থিব রত্নখনিটার দিকে কিয়ৎক্ষন তাকিয়ে তপ্তশ্বাস ছাড়ে এরীশ। অতঃপর সাবলীল কন্ঠে বলে,
— ডিল টা তাহলে ব্লাড ডায়মন্ড নিয়ে?
ডেনিয়েল হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বলে,

— অফকোর্স, কিন্তু এর বিনিময়ে আমারও কিছু চাই।
পায়ের উপর পা তুলে বসলো এরীশ। রাশভারি আওয়াজে জিজ্ঞেস করলো,
— বেশ, বলে ফেলুন।
— ওই মেয়েটাকে আমার চাই।
সরল কপাল মূহুর্তেই কুঁচকে এরীশের। তীক্ষ্ণ ভাঁজে সংকুচিত হলো ভ্রু জুগল। চোখের দৃষ্টি স্থির রেখে কন্ঠে গম্ভীরতা টানলো এরীশ, বললো,
— সরি, কোন মেয়েটা?
— নীল চোখের মেয়েটা। ওর ছবি আছে আমার কাছে, চাইলে দেখাতে পারি। আর আমি ভালো করেই জানি কোনো এক বিশেষ কারণে মেয়েটাকে এখনো কোথাও পাঠাওনি তুমি।
— অন্যকিছু বলুন ওকে বেচবো না।
— কেন বেচবে না? আফটার অল শী ইজ ইউর প্রোপার্টি। ও যে তোমাকে ব্লাড ডায়মন্ড এনে দিতে পারে সেটা কি তুমি বুঝতে পারছো না?
অস্থির হয়ে উঠেছে ডেনিয়েল।ক্রোধ ঠ্যাকানোর পায়তারা করে এরীশকে শান্ত কন্ঠে বোঝাতে চাইলো লোকটা ।
তবে ইতিমধ্যে ডেনিয়েলের কথায় ফুঁসে উঠেছে এরীশ। চড়াৎ করে র’ক্ত উঠে গিয়েছে ওর স্থির মস্তিষ্কে। ভেতরে ক্রোধের দাবানল, তবুও সামনাসামনি স্থির থেকে দাঁতের মাঝে দাঁত পিষলো এরীশ। বললো,

—- সম্পদ আর সম্পত্তির পার্থক্যটা জানেন তো মি. হ্যারিসন? সম্পদ হলো সেই জিনিস যেটা নিজের মতো করে উপভোগ করা যায় ঠিকই কিন্তু কোনোদিন বিক্রি কিংবা অন্যের হস্তগত করা সম্ভব নয়। আর ওই মেয়েটা হলো আমার ব্যক্তিগত সম্পদ। ডিল ক্যান্সেল।
এক নাগাড়ে কথা শেষ করে উঠে দাড়ায় এরীশ। সামনের দিকে ফিরে, বেড়িয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে প্রশ্ন ছোড়ে ডেনিয়েল,
— মেয়েটা যে একান্তই তোমার সম্পদ তার প্রমান কোথায়? আমি যদি তুলে নিয়ে আসি ধরে রাখতে পারবে তো?
ফের ঘাড় ঘোরালো এরীশ, ডেনিয়েলের মুখের উপর একটা বিদ্রুপাত্তক হাসি ছুড়ে দিয়ে বললো,
— তুলে আনা তো দূরে থাক, সাহস থাকলে ওর ছাঁয়া স্পর্শ করে দেখাবেন মি. হ্যারিসন।

— চ্যালেঞ্জ একসেপ্টেড।
হাসির জোয়ারে ঠোঁট বাঁকিয়ে ডেনিয়েল কথাটা বললেও, এরীশ আর চাইলো না সেদিকে। লম্বা পা ফেলে বেড়িয়ে গেলো হোটেল রুম থেকে। এরীশ দ্রুত পা চালাচ্ছিল, সঙ্গে তুষারও। ঠিক তখনই রুম থেকে বেড়িয়ে ছুটতে ছুটতে করিডোরের মাঝে ওদের পথ আটকায় এ্যালেক্স। সামনে দাড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বিরক্ত গলায় বলে,
— কি বাড়াবাড়ি শুরু করেছো তুমি রীশস্কা?
— এক্সকিউজ মি!কোনটা বাড়াবাড়ি?
— একটা তুচ্ছ মেয়ের জন্য বারবার ব্লাড ডায়মন্ডের অফার হাতছাড়া করছো, ডেনিয়েলের মতো বি’ষধর গোখরাকে খেপিয়ে দিচ্ছো, এটা বাড়াবাড়ি নয়?
এ্যালেক্সের এতো কথার পাছে ভাবলেশহীন কন্ঠে এরীশ বললো,

— ইট’স টোটালি মাই চয়েজ। রাস্তা ছাড়ো।
রাস্তা ছাড়লো না এ্যালেক্স, উল্টো জোর গলায় বললো,
— আই নো দ্যাট। কিন্তু তুমি যে একটা মেয়েকে নিজের দূর্বলতা বানিয়ে ফেলেছো সেটা কি এখনো বুঝতে পারছো না? না কি বুঝতে চাইছো না? এই দূর্বলতা তোমার পাইথন প্যারাডাইস, তোমার মাফিয়া সাম্রাজ্য, এমনকি তোমার জীবন সবকিছুকে ঠিক কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে সেটা একবারও ভেবে দেখেছো কি?
এ্যালেক্সের প্রতিটি কথা তীরের ফলার মতো গিয়ে বিধলো এরীশের মস্তিষ্কে। প্রতিটি কথার জোরালো প্রতিধ্বনিতে ভেতরে জলোচ্ছ্বাস বয়ে যাচ্ছে ওর। আগ্নেয়গিরির দাবানলের মতোই জলন্ত অ’ঙ্গারে ঝলসে যাচ্ছে বক্ষস্থল। তবুও বাইরে থেকে নিজের শক্তপোক্ত স্থির দৃষ্টি অটুট রেখে চোয়াল শক্ত করে জবাব দিলো এরীশ,
— তোমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। এরীশ ইউভান কারোর প্রতি দূর্বল নয়। এখন পথ ছাড়ো নয়তো আজকের পর থেকে জ্ঞানের বানী বিলানোর জন্য এই চেহারাটাই অ’ক্ষত থাকবে না তোমার ।
ঢকাত করে শুষ্ক ঢোক গিলে তৎক্ষনাৎ সরে দাঁড়ায় এ্যালেক্স। এ্যালেক্স সরে যেতেই বাতাসের বেগে হনহনিয়ে জায়গা ত্যাগ করে চলে যায় এরীশ।

সন্ধ্যা তিমিরের পর্দা টেনে একটু আগেই মিলিয়ে গেলো দিনের শেষ প্রহরের নিয়ন আলোক রশ্মিটুকু। সারাদিন অল্প অল্প তুষারপাতের ফলে বরফের মসৃণ চাদরে ঢাকা পরেছে প্রকৃতি। কাচের দেওয়াল গুলোতে শিশির বিন্দুর ন্যায় জমে আছে গলিত বরফ কণা। ঈশানী আর ফ্লোরা কিচেনেই ছিল।টুকটাক কথা নিয়ে হাসাহাসি করছিল ওরা। তখনই মেইন গেট খুলে পেন্ট হাউজে প্রবেশ করে এরীশ। ওর চেহারায় ক্ষুব্ধতা স্পষ্ট। এরীশ লাউঞ্জে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে থেমে যায় হাসির রোল। এরীশের অগ্নিমূর্তি দৃশ্যগত হতেই ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে কাউন্টারের এককোণে দাঁড়িয়ে পরে ঈশানী আর ফ্লোরা। আজ আর সোজা উপরে গেলো না এরীশ, উল্টো মাঝপথে দাঁড়িয়ে লাউঞ্জের এদিক ওদিক নজর বুলিয়ে খুজতে লাগলো ঈশানীকে। এক পর্যায়ে ওর উদ্ভ্রান্ত চোখ দুটো দেখা পেলো সরলতার । কিচেন কাউন্টারের এককোণে চুপসে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। চোখমুখে ভেসে উঠেছে স্পষ্ট আতঙ্ক। সেসবের ধার ধারলো না এরীশ, এগিয়ে গিয়ে শক্ত হাতে কব্জি চেপে ধরলো ওর। আচানক ঘটনায় চোখ তুলে এরীশের পানে চাইলো ঈশানী। ওর চেহারার স্পষ্ট কাঠিন্যতা উপলব্ধি করে কান্না ভেজা কন্ঠে কাকুতির স্বরে বলে উঠলো,

— কি ব্যাপার, কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? কি ভুল করেছি আমি?
ঈশানীর কথায় কোনোরূপ জবাব দেয়না এরীশ। উল্টো ওকে টানতে টানতে নিয়ে যায় দোতলার অফিস কক্ষের স্টোর রুমে। রুমটা ছিল অন্ধকার আর ভীষণ ঠান্ডা। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইলেকট্রনিক জিনিসের ধ্বং’সস্তুপ। তারমাঝেই টেনে হিঁচড়ে ঈশানীকে নিয়ে এলো এরীশ। মেয়েটার পরনে কোনোরূপ গরম কাপড় নেই। তাও সেদিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল দিলোনা এরীশ। ও একটানে ঈশুর গলার ওড়নাটা কেড়ে নিয়ে রাগের তোপে গজরাতে গজরাতে একটা ভাঙা স্ট্যান্ডের হেডবোর্ডের সঙ্গে হাতদুটো ওড়না দিয়ে বেধে দিলো ঈশানীর। নি’ষ্ঠুর লোকটার কান্ডে তৎক্ষনাৎ চ্যাঁচিয়ে উঠলো ক্রন্দনরত মেয়েটা, কাঁদতে কাঁদতে দিশেহারা হয়ে বললো,

— কি করেছি আমি? কেন বেঁধেছেন এভাবে? এখানে খুব ঠান্ডা, আমার শীত করছে ছেড়ে দিন দয়া করে।
ঈশানীর কথা যেন শুনেও শুনলো না এরীশ। ও নিজের মতো করে ঈশুর হাতদুটোকে বেধে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝেই ওকে রেখে বিনাবাক্যে বেড়িয়ে গেলো স্টোর রুম থেকে। এরীশের যাওয়ার পানে চেয়ে এখনো এক নাগারে চ্যাঁচাচ্ছে ঈশানী। আকুতি মিনতি করে বারবার শুধু একটা কথাই বলে যাচ্ছে ও,
—- অরণ্য যাবেন না দয়াকরে। অন্ধকারে ভয় করে আমার। এখানে অনেক ঠান্ডা আমিতো ম’রে যাবো। দয়া করুন, কেন এমন অহেতুক শা’স্তি দিচ্ছেন, কি ক্ষতি করেছি আপনার?
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পাছে ফেলে আসা ক্রন্দনরত ঈশানীর আকুতিভরা কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে, আহত কন্ঠে বিড়বিড়ায় এরীশ,
— কিছুই করোনি তুমি। আর না তো আমি তোমাকে শা’স্তি দিচ্ছি। আমি তো স্রেফ নিজেকে নিজে শাস্তি দিচ্ছি। তোমার প্রতি দূর্বল না হওয়ার জন্য। নিজের ভেতরটাকে একটুখানি শান্তি দেওয়ার জন্য।

রাত জাগা শৃগাল আর নেকড়ে শাবকের হাউলিং এ জানান দিয়ে যায় এখন মাঝরাত্তির। সেই সন্ধ্যারাতে ঈশুকে ওভাবে অন্ধকার স্টোর রুমে আটকে রেখে কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিল না এরীশ। অগত্যা তখনই তুষারকে আদেশ করে ঈশানীকে মুক্ত করে দিতে। আর এখন এই মূহুর্তে পাইথন লিডার এরীশ ইউভান নিজের ঘুম বিসর্জন দিয়ে নিচ তলার বারো বাই বারো ফিটের ছোট্ট কামরার সামনে সটান দাঁড়িয়ে। তার নিস্প্রভ অক্ষি জুগল রুমের ভেতরে নিবদ্ধ। সেথায় এক অপরূপা সুন্দরী ঘুমিয়ে। এলোমেলো তার ঘুমের ভঙ্গিমা, তারচেয়েও অবাক করা বিষয় মেয়েটা চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা এলিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। অথচ একটু নড়লেই মাথাটা টেবিল থেকে পরে ঘুম ছুটে যাবে এমন অবস্থা। চোখের কোণে জলকণা জমে আছে এখনো, হয়তো কেঁদেছিল খুব।
ঘড়ির কাঁটায় টিকটিক আওয়াজ তুলে সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা নিঃশব্দে অতিবাহিত হয় সেভাবেই। তবুও চোখ জুড়ায় না এরীশের। মাফিয়া বসের হৃদয়ে বইতে থাকা উত্তাল জলোচ্ছ্বাসেরা ক্লান্ত হয়না মোটেই। অবশেষে উপায়ন্তর না পেয়ে ডক্টর মাতভেই এর নাম্বারে কল দিলো এরীশ। বুকের বাম পাশটায় অযাচিত হাত বুলিয়ে বলে উঠলো,

— ডক্টর, আই থিংক আই নিড আ হার্ট সার্জারী।
এরীশের কথায় পুরোপুরি তন্দ্রাভাব কেটে গেলো ডক্টরের। তিনি হকচকিয়ে উঠে বললেন,
— হোয়াট হ্যাপেন্ড রীশস্কা?
— আই ডোন্ট নো অ্যাক্সুয়ালি। সামটাইমস মাই হার্ট বার্নস লাইক হেল। অর সামটাইমস ইট বিটস সো ফাস্ট।
ডক্টর মাতভেই এর জানা মতে এরীশের কোনো হৃদ’রোগের সমস্যা নেই। তাই সন্দেহের বশে তিনি হুট করেই কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করে বসলেন,
— ডিড ইউ ফল ইন লাভ অর সামথিং?
ডক্টর মাতভেই এর কথাটা পুরোপুরি শুনলো না এরীশ। তার আগেই ছুটে গেলো ঘুমের ঘোরে নড়েচড়ে ওঠা ঈশানীকে পরে যাওয়ার হাত থেকে সামলাতে। অসাবধনায় টেবিল থেকে পরেই যাচ্ছিল ওর মাথাটা, ঠিক তখনই হাত বাড়িয়ে ওর নরম তুলতুলে গালের অগ্রভাগ হাতের তালুতে তুলে নেয় এরীশ । সেভাবেই ওর মাথাটা আলগোছে সামলে রেখে, ঘুমন্ত মেয়েটার আদুরে মুখের পানে চেয়ে হিসহিসিয়ে বিড়বিড়ায় নির্ঘুম মাফিয়া বস ,

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ১৭

— সফ্ট এ্যান্ড ইনোসেন্ট।
কোনো এক নামহীন জগতের আকাশ বাতাস ছাপিয়ে হৃদ গহীনে হানা দেয় তখন অযাচিত কিছু গানের লাইন,
” যদি একটি বারও পারতো
সব চিন্তা ভুলে আসতে
আমি সব হারাতাম তাকে পেতে হায়….
কবে পায়ের শেকল খুলবে
আর প্রেমের পর্দা উড়বে
আমি চেয়ে থাকি সেই দিনের সীমানায়….
বোঝেনা সে বোঝেনা…
বোঝেনা সে বোঝেনা…..

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ১৯