আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ১৯
suraiya rafa
বিকেলের আবহাওয়া গুমোট।সুউচ্চ পেন্ট হাউজ জুড়ে পিনপতন নীরবতা বিরাজমান। হাসি কিংবা কান্না কোনোকিছুর রেশ না থাকায় চারিদিকে কেউ নেই কেউ গন্ধটা সুস্পষ্ট। লাউঞ্জটা ফাঁকা পরে আছে, ফ্লোরা মাত্রই এলো ছাঁদ বারান্দা থেকে, হাতে ঝুড়ি ভর্তি শুকনো কাপড়চোপড়। এমন তুষার ভরা দিনে একটু খানি রোদের ঝিলিক যেন অমৃত সম। ওইজন্যই তো হাটু সমান বরফের স্তূপ ডিঙিয়ে ছাঁদ বারান্দায় কাপড় নাড়তে গিয়েছিল মেয়েটা।
আর এখন শুকনো কাপড়ের ঝুড়ি সমেত সোজা এগিয়ে যাচ্ছে দোতলার করিডোর ধরে। সামনেই তুষারের ঘর, ফ্লোরা তাড়াহুড়ো পায়ে সেদিকেই এগুচ্ছিল। কোনো জরুরি দরকার আছে বোধ হয়। তাড়াতাড়ি অগ্রসর হওয়ার কারণে কখন যে রুমের দিকে এগিয়ে যাওয়ার বদলে উল্টো পাশের কংক্রিটের পিলারের দিকে চলে গিয়েছে সে দিকে কোনোরূপ লক্ষ্য করেনি ফ্লোরা। অগত্যা বেখেয়ালে এগিয়ে যেতে যেতে ওর তুলতলে দুধে আলতা কপালখানা পিলারের সঙ্গে ঠাস করে ধাক্কা লাগতে যাবে, ঠিক তার আগ মূহুর্তে পিঠ ছড়িয়ে নেমে আসা সোনালী চুলের চিকন বিনুনিটা শক্ত হাতে টেনে ধরলো কেউ। চুলের মাঝে হঠাৎ এহেন টান পড়ায় সামনে ধাক্কা খেলোনা ফ্লোরা।উল্টো মুখের আদলে বিরক্তির ভাব টেনে পেছন ঘুরলো তৎক্ষনাৎ।
তবে পেছনে ঘুরতে না ঘুরতেই হাওয়ায় উবে গেলো ওর সকল বিরক্তি। পাছে এসে ভর করলো একরাশ জড়তা।
তুষারকে দেখলে বরাবরই জড়তায় কুণ্ঠিত হয়ে পরে ফ্লোরা। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়।
মাত্রই এরীশের অফিস কক্ষ থেকে বেরিয়ে রুমের দিকে যাচ্ছিল তুষার। পরনে নেভি ব্লু শার্ট আর ব্রাউন ওয়েস্ট কোটের কম্বিনেশনে দেখতে সুদর্শন লাগছে তাকে। বাইরের পেজা তুলোর মতো শ্বেত রঙা তুষারের মতোই স্নিগ্ধ লাগছে তার তামাটে গড়নের শ্যামরঙা মুখমণ্ডল। সেই তখন থেকে ফ্লোরা জড়োসড়ো হয়ে নিম্ন মস্তকে পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে দেখে, পকেটে এক হাত গুঁজে থমথমে গলায় প্রশ্ন ছুড়লো তুষার,
—- সারাক্ষণ ঘাস ফড়িং এর মতো এমন নেচে-নেচে চলো কেন? এটা যে মাফিয়া পেন্টহাউজ সেই হুশ আছে?
— আমার অভ্যেস হয়ে গিয়েছে।
সরল ভঙ্গিমায় উত্তর দিলো ফ্লোরা।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
দু’ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেললো তুষার, মেয়েটাকে বিরস চোখে পরখ করে একই স্বরে বললো,
— মাফিয়া পেন্টহাউজ কোনো সাধারণ বাড়িঘর নয় ফ্লোরা। মন চাইলেই এখানে নিজ ইচ্ছেতে অসতর্ক হয়ে চলা যায়না। কারণ সবসময় তোমাকে প্রটেক্ট করার জন্য পেন্টহাউজে বসে থাকবো না আমি।
গোমড়া মুখো লোকটা হটাৎ এতো কথা কেন বলছে ভেবে পায়না ফ্লোরা। কেনই বা এতো জ্ঞান দিচ্ছে? বেখেয়ালে পিলারের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার জন্য? নাকি অন্য কিছু? ফ্লোরা ছোট্ট মাথায় ঢুকলো না এতো জটিলতা, তবুও সামনের মানুষটার অতিব কঠোর আওয়াজে শঙ্কিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ।
—এতোদিন ধরে মাফিয়াদের সঙ্গে থাকছো এটা নিশ্চয়ই ভালো করে জানো যে, যখন তখন তুমি, আমি, ইভেন আমরা সকলে মা’রা পরতে পারি। যেকোনো সময় শত্রুদের এক চালে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে এই পুরো পেন্টহাউজ। নিশ্চিন্তে দিনাতিপাত করার মতো কোনো স্বাভাবিক জীবন নয় এটা। বড় হয়েছো এখন। নিজের বেখেয়ালি আচরণ, আর ছেলেমানুষী গুলোকে সংযত করার সময় হয়েছে। আমি তোমাকে ম্যাচিউর দেখতে চাই, মাফিয়া প্যারাডাইসে কখনো ইনোসেন্সি জিয়িয়ে রাখতে নেই।
ফ্লোরা জানেনা তুষারের এই কাট কাট কথাগুলো কেন এতো যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওর হৃদয়ে এসে বিঁধলো। তুষার যা বলেছে একদম ঠিক বলেছে, তার একটা কথাও মিথ্যে নয়। তবুও বাদামি চোখ জোড়া জ্বলে যাচ্ছে ওর। এক্ষুনি জল উগড়ে এসে কোটর ভরে উঠবে বোধ হয়। সহসা দৃষ্টি সরিয়ে কণ্ঠনালীতে চিবুক ছোঁয়ালো চঞ্চল মেয়েটা।
ফ্লোরার নতজানু বিব্রত চেহারার পানে একপল নজর বুলিয়ে ফের প্রশ্ন ছুড়লো তুষার,
— তখন থেকে পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছো, কিছু বলতে চাও?
হ্যা না দু’দিকেই মাথা নাড়ায় ফ্লোরা। অতঃপর গলা খাদে নামিয়ে শীতল কন্ঠে বলে,
— গ্রামে যেতে হবে একবার। দাদীর জরুরি তলব। যদি একটু…
ফ্লোরা কথা সম্পূর্ণ করার আগেই তুষার ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে ওঠে,
— আগামীকাল দুবাই যাচ্ছি আমি, এখন তোমাকে নিয়ে যাওয়া পসিবল নয়। আমি ফিরে আসা অবধি ওয়েট করো, নিয়ে যাবো।
—ইয়াকুতিয়ায় ভীষণ শীত পরেছে এ বছর। দাদী ভালো নেই, যাওয়াটা জরুরি।
মিনমিনিয়ে কথা আওড়ালো ফ্লোরা। ওর কথার পাছে তুষার ফিচেল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— বেশ! আমি একজন বিশ্বস্ত গার্ডকে বলবো তোমায় নিয়ে যেতে। বাট ওয়ান কন্ডিশন।
কথার মাঝে থামলো তুষার,ফ্লোরা চকিতে দৃষ্টি ফেরালো তুষারের পানে, চট করেই শুধালো,
— কি শর্ত?
চোখমুখে চিরাচরিত গাম্ভীর্যতা ধরে রেখে রাশভারি আওয়াজে তুষার বললো,
— যেখানে খুশি যাও, তবে আমার জামা কাপড় রোদে শুকিয়ে আয়রন করে রেখে যাবে। ড্রেসিং রুমের সব জিনিস চোখের সামনে রাখবে। কোনদিন কোনটা পরবো সেগুলোও ম্যাচ করে সাজিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে দিয়ে যাবে । আর হ্যা…
আরও একবার ভ্রু কুঁচকালো ফ্লোরা, ঠোঁট উল্টে বললো,
— আবার কি?
গলার স্বরে কিঞ্চিৎ আকুলতা ঢেলে জবাব দিলো তুষার,
— ফিরে এসে সব জামাকাপড় যাতে ঠিকঠাক কাবার্ডের মাঝে গোছানো পাই। অগোছালো,মাত্রাহীনতা আমার একদম পছন্দ নয় ফ্লোরা।
ফুঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অসহায় কণ্ঠে ফ্লোরা বললো,
— আপনি তো দু’দিন পরেই ফিরেই আসবেন, তাহলে?
লম্বাটে পুরুষালী গ্রীবাটা খানিক নিচু করে,গম্ভীর গলায় জবাব দিলো তুষার,
— তাহলে তুমিও তার আগেই ফিরবে।
সন্ধ্যা নেমেছে দৃশ্যপটে, সেইসাথে বেড়েছে তুষারপাত। ছাঁদ বারান্দার ফায়ারপ্লেসটাতে আগুন জ্বলছে আজ। সেথা থেকে ভেসে আসছে কাঠকয়লা পু’ড়ে যাওয়ার খুটখাট আওয়াজ। বরফের দেশে এহেন আগুনের উত্তাপ যেন মিহি রোদের হাতছানি। ফায়ারপ্লেসের কারণে ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে না খুব একটা। তাও গায়ে পশমি কোট আর মাথায় বেনী টুপি চড়িয়ে ছাদ বারান্দার কার্নিশ ঘেঁষে বসে আছে ঈশানী আর ফ্লোরা।
সন্ধ্যা আকাশে সুখ তাঁরার উপস্থিতি নেই, আর না আছে কোনোরূপ চাদের আলো। ধুতরা ফুলের মতো অর্ণগল নেমে আসা তুলতুলে স্নো ফলের কারণে খালি চোখে পুরো আকাশটাকে সর্গীয় লাগছে তবুও । এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে ঈশানী। শুভ্র বরফের আস্তরে ঢেকে গিয়েছে ওর সমস্ত শরীর । আগামীকাল খুব ভোরে গ্রামে চলে যাবে ফ্লোরা। মেয়েটা চলে গেলে এই মৃত্যুপুরির ন্যায় মাফিয়া পেন্টহাউজে পুরোপুরি একা হয়ে যাবে ঈশানী, সেই ভেবেই ক্রমশ হৃদয়টা চুপসে এইটুকুনি হয়ে যাচ্ছে ওর। ঈশানীর মন খারাপের কারণ জানে ফ্লোরা, ওই জন্যই রাতের বেলা খোলা আকাশের নিচে স্নো ফল দেখতে নিয়ে আসা ওকে।অথচ মেয়েটার শুকনো মুখে মলিনতার ছাপ এখনো সুস্পষ্ট। এইসব টুকরো বরফ কণার আনন্দ বোধ হয় ঈশুর হৃদয় ছুঁতে পারেনি একদম। সেই ভেবেই ঈশানীর কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে চমৎকার গলায় ফ্লোরা বলে ওঠে,
— এ্যাই ঈশু! ফায়ার ওয়ার্ক করি চলো।
ফ্লোরার কথায় ঘাড় ঘোরালো ঈশানী,কপাল বাঁকিয়ে অজ্ঞাত স্বরে শুধালো,
— ফায়ার ওয়ার্ক মানে আতশবাজির কথা বলছো?
জোরে জোরে হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো ফ্লোরা। বললো,
—চলোনা, ঠান্ডার মাঝে ফায়ারওয়ার্ক করতে ভীষণ মজা হবে। বেজমেন্টে সব আছে।
— মাফিয়া পেন্টহাউজে আবার আনন্দ করার আসবাব ও রয়েছে? হাস্যকর!
ঈশানীর কথাটা বিদ্রুপাত্তক শোনালো ভীষণ। তবে সে কথা গায়ে মাখলো না ফ্লোরা, বাঙালী মেয়েটার প্রতি অদম্য অধিকারবোধ খাটিয়ে বললো,
— করবে কিনা বলো? আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি।
ঠোঁট প্রসস্থ করে জোরপূর্বক হাসলো ঈশু, বললো,
— তুমি চাইলে আমার আর না করার উপায় আছে কোনো?
ঈশুর কথায় উৎকন্ঠায় লাফিয়ে উঠলো ফ্লোরা। তড়িঘড়ি করে জায়গা ছেড়ে উঠে যেতে যেতে গলার মাঝে উপচে পরা খুশি ধরে রেখে বললো,
—- তুমি একটু বসো, আমি এক্ষুনি গিয়ে ফায়ার ওয়ার্কের সরঞ্জাম গুলো নিয়ে আসছি।
ওকে যেতে দিলো না ঈশানী, হাত টেনে ধরে আগের জায়গায় বসিয়ে দিয়ে বললো,
— থাক কষ্ট করতে হবে না। আমিই গিয়ে নিয়ে আসছি।
ফ্লোরাকে সন্দিহান দেখালো । ঈশুর হাতটা খপ করে আঁকড়ে ধরে সেভাবেই চোখ ছোট ছোট করে শুধালো,
— পালাতে চাইছো?
তাচ্ছিল্য করে হাসলো ঈশানী, বললো,
— সুযোগ থাকলে ঠিকই পালাতাম। তবে দূর্ভাগ্য আমার। মাফিয়া বস আর এই নরকের মতো অন্ধকার কালো পেন্ট হাউজ দু’টোই আমার ভবিতব্য ।তারা পালাতে দিলে তো?
বিনাবাক্যে হাতের বাঁধন ঢিলে করলো ফ্লোরা। ঈশু ভেতরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে আরও একটাবার শুধালো,
—- এলিভেটর ধরে বেজমেন্টে যাবো তাইতো?
অপার্থিব আকাশ পানে দৃষ্টি মেলে উদাস গলায় জবাব দিলো ফ্লোরা,
— হ্যা ফাস্ট ফ্লোরের নিচের বেজমেন্টে।
উদাস হয়ে ছাঁদ বারান্দায় বসে ছিল ফ্লোরা। হাত মেলে এক আধটু বরফ ছোঁয়ার পায়তারা ও চালিয়েছে কিয়ৎক্ষন। এর মাঝেই আচমকা গগন কাঁপানো চিৎকার ভেসে এলো নিচ থেকে। চিৎকারের প্রতিধ্বনিতে হকচকিয়ে উঠলো ফ্লোরা। কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ রেখে অনুমান করলো আওয়াজটা কার? যখনই বুঝতে পারলো এটা ঈশুর গলা, তৎক্ষনাৎ কোনোরূপ সময় নষ্ট না করেই তড়িঘড়ি পায়ে নিচের দিকে ছুট লাগায় মেয়েটা। এই পেন্ট হাউজের নাড়িনক্ষত্র বেশ ভালো মতোই চেনা ওর। তাইতো সন্দেহের বশবর্তী হয়ে নিচ তলার বেজমেন্টে না গিয়ে সেকেন্ড ফ্লোরে যে কৃত্রিম বেজমেন্টটা রয়েছে এলিভেটরে হাত চালিয়ে সেখানেই ছুটে গেলো ও।
ব্যগ্র হস্তে বেজমেন্টের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে এক বীভৎস উৎকট গন্ধ এসে নাকের ডগায় হানা দেয় ফ্লোরার। সেসব কিছু উপেক্ষা করে সামনের দিকে দু’কদম পা বাড়াতেই আবছা আলোয় দেখতে পায় কান্নারত ঈশানীর মুখাবয়ব। কোনো এক অজানা কারণে মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে কাঁদছে মেয়েটা । কান্নার তোড়ে বারংবার কেঁপে উঠছে ওর ছোট্ট দূর্বল শরীরটা। খুব বেশি অনুমান করতে না পেরে ওর পাশে গিয়ে বসলো ফ্লোরা, কাঁধের উপর আলতো হাত ছুঁয়িয়ে শুধালো,
— কি হয়েছে ঈশু? হঠাৎ কাঁদছো কেন এমন করে?
হাতের মাঝে টর্চ ছিল ঈশানীর। ফ্লোরার কথার প্রত্যুত্তরে ক্রন্দনরত অবস্থায় মুঠোবন্দি আলোক রশ্মিটুকু সামনে তাক করালো ঈশু। অন্ধকার ঘরটার চারিপাশে ঝুরোঝুরো মৃদু আলোর প্রতিফলন ঘটতেই ফ্লোরা দেখতে পায় শুকিয়ে যাওয়া র’ক্তের ছোপ ছোপ দাগে ঈষৎ বেগুনি হয়ে আছে পুরো মেঝেটা।র’ক্তের দাগ খুব বেশি পুরোনো নয়,আজ কিংবা গতকালের হবে হয়তো। যার দরুন উৎকট গন্ধে ভরে আছে সমস্ত ঘর। টর্চের আলো যতদূর যায় ততোদূর অবধি র’ক্তে মাখামাখি, ঠিক তার এককোণে চোখ পরতেই আঁতকে ওঠে স্বয়ং ফ্লোরা। আতঙ্কে শিউরে উঠে দু’হাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে শরীরের ফিনফিনে পাতলা ফ্রকটা।
কয়েকবার অক্ষিপল ছেড়ে দ্বিতীয়বারের মতো দৃষ্টি বোলাতেই ফের দেখতে পেলো, মানুষের চামড়া সহ ছেড়া চুলের অংশবিশেষ পরে আছে ওখানে । সেই সাথে উপড়ে ফেলা হাত পায়ের তরতাজা নখ। যদিও মাফিয়াদের নৃ’শংসতা দেখে অভ্যস্ত ফ্লোরা তবুও এসব জিনিস দৃষ্টি গোচর হতেই কেমন গা গুলিয়ে উঠলো ওর । পেটের নাড়িভুড়ি দলা পাকিয়ে উগড়ে আসতে চাইছে যেন। ওদিকে ঈশানী মেয়েটা লুটিয়ে পড়ে কাঁদছে। ওর কান্না দেখে নিজের শারীরিক অস্বস্তি ভুলে গেলো ফ্লোরা, পুনরায় পিছিয়ে এসে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো ঈশানীকে। বললো,
— এ্যাই মেয়ে! এমন আহত স্বরে কাঁদছো কেন? আমারও তো কান্না পাচ্ছে, দয়াকরে কান্না থামাও। উপরতলার বেজমেন্টে কেন এসেছো তুমি?
এবারে কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিলো ঈশানী, বললো,
— এগুলো কি ছিল ফ্লোরা? এতোটা নৃ’শংস, এতোটা নিষ্ঠুর মানুষ কি করে হতে পারে? ও কি আদৌও মানুষ, নাকি অ’ত্যাচারী একটা জানোয়ার? আর আমাকে দেখো? না জেনে না শুনে এই লোকটার জন্য পাগল হয়ে কি কি করে ফেললাম। দু’হাতে নিজের সাবলীল জীবনটাকে একেবারে দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দিলাম। এখন আমি নিঃশ্ব। না আছে কোনো ভবিষ্যত আর না তো বর্তমান।
কথা শেষ করে অনর্গল কান্নার জোয়ারে ভেঙে পড়ে ঈশানী।
এতোদিন এসব কাহিনী না জানলেও, আজকে কিছুটা হলেও ঘটনা আঁচ করতে পেরেছে ফ্লোরা। তারমানে নদীর মতো শান্ত, উদ্দেশ্যহীন নীলাম্বরি মেয়েটাকে ম্যানিউপুলেট করেছিল এরীশ। কোনো না কোনো ভাবে বারবার তার সামনে গিয়ে, রহস্যের মতো আবছা ধরা দিয়ে, তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে সরল মনটা জয় করে নিয়েছে প্রথমে। আর তারপর ফিরে এসেছে চিরাচরিত ব্লাডিবিস্ট রূপে।
যদিও একটা জিনিস আজও ভেবে পায়না ফ্লোরা, এরীশ কেন এখনো পেন্টহাউজে আটকে রেখেছে ঈশানীকে? এটা কি স্রেফ আটকে রাখা নাকি মাফিয়া বসের বিশেষ কোনো চাল? সেবার ক্লাবে পাঠানোর কথা ছিল ঈশুকে, সেই সিদ্ধান্তটাও শেষ মূহুর্তে এসে একেবারে আচানক মত বদলে ফেলেছিল এরীশ। রেগে গিয়েছিল ওই গার্ডটার উপর যে কিনা আঘাত করেছিল ঈশানীর কপালে। এসবের পেছনে কারণ কি থাকতে পারে? ঈশু ওভাবে কাকুতি মিনতি করেছিল বলে? কিন্তু মাফিয়া বস তো কারোর কাকুতি মিনতির ধার ধারেনা। অবিশ্বাসের তোড়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে না সূচক মাথা নাড়ালো ফ্লোরা।
তখনই আবারও ভেসে এলো ক্রন্দনরত ঈশানীর ব্যথাতুর আওয়াজ,
— এমন একটা অ’ত্যাচারী, পাপী, লোককে কি করে ভালো বাসলাম আমি? কি করে?
দু’হাতে চুল খামচে ধরে তেজি কন্ঠে বিড়বিড়ায় ক্রন্দনরত ঈশানী। ওর উদভ্রান্তের মতো কর্মকান্ড দৃষ্টিগোচর হতেই ধ্যান ভাঙে ফ্লোরার। ভাবনা থেকে বেরিয়ে তৎক্ষনাৎ ঈশানীর শরীরে হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করার চেষ্টা চালায় ফ্লোরা, উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে,
— এতোটা উতলা হয়ো না ঈশু, সব ঠিক হয়ে যাবে সব।
— কিচ্ছু ঠিক হবেনা আর,কিচ্ছু না। নিজের কাজে বিব্রত আমি, ভীষণ বিব্রত।
— কেন বিব্রত হচ্ছো? অন্যায় তো কিছু করোনি, ভালোই তো বেসেছিলে, এটা কি অন্যায়?
— একশো বার অন্যায়, ওই জা’নোয়ারটাকে ভালোবাসা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অন্যায়।
— এরীশ শুরু থেকে কখনোই এমন ছিল না ঈশু। মানুষ কোনোদিন পাপী হয়ে জন্মায় না। এই দুনিয়া আর দুনিয়ার কিছু নামধারী মানুষরূপি দুষ্কৃতকারীরা তাদের পাপী হতে বাধ্য করে।
ফ্লোরার শেষ কথাতে থমকালো ঈশানী, অবিরাম কান্নার তোড়ে কিঞ্চিৎ ভাটি টেনে অবিশ্বাস্য চাউনী নিক্ষেপ করলো রুশ মেয়েটার পানে।
ঈশানীর জ্বলজ্বলে নীল চোখে চোখ রেখে হ্যা সূচক মাথায় নাড়ায় ফ্লোরা। ধাতস্থ কন্ঠে বলে,
— সত্যি বলছি,এরীশ ইউভানের শুরুটা কোনোকালেই এতো নৃ’শংস ছিল না। আর না তো এরীশের হৃদয়টা এমন পাথরের মতো নির্জীব ছিল।
— কি বলতে চাইছো?
কান্নাকাটি পুরোপুরি থেমে গেলো ঈশুর। আলতো হাতে ওর চোখের জল মুছিয়ে দিলো ফ্লোরা, নিরেট কন্ঠে বললো,
আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ১৮
— বহু বছর আগে মায়ের কাছে শুনেছিলাম। তুমি শুনতে চাইলে বলবো।
ফ্লোরার কথার কোনোরূপ প্রত্যুত্তর না করেই নিজ হাতে বাদবাকি চোখের জলটুকু মুছে নেত্রদ্বয়ে পলক ছাড়লো ঈশু। যার অর্থ
— হ্যা শুনবো।