আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩
suraiya rafa

বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে, যতদূর চোখ যায়, বৃষ্টির তোড়ে ততদূর অবধি সামনের সকল দৃশ্যপট ধোঁয়াসা। বৃষ্টির মাঝেই বিশাল হাইওয়ে ধরে শাঁই শাইঁ করে হাওয়ার বেগে ছুটে যাচ্ছে, কাভার্ড ভ্যান আর লরির বহর। ক্যাফের এককোনে টেপরেকর্ডারে গান চালিয়ে রেখেছেন জয়া আন্টি, সেখানে কোনো এক নাম না জানা শিল্পী সুর তুলে গাইছেন,
“আকাশ এতো মেঘলা
যেও না’কো একলা
এখনই নামবেএএ অন্ধকার”

অথচ ঈশানী এই ঝড় বাদলের রাতেই বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিয়েছে। জয়া আন্টিকে বলে কয়ে রাজি করিয়ে রাত নয়টার মধ্যে ক্যাফে থেকে বের হওয়ার বন্দোবস্ত করেছে। রাত দশটায় চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশ্য লাস্ট ট্রেন ছেড়ে যাবে, কোনোমতে সেটা ধরতে পারলেই ঝামেলা শেষ।
যদিও এর আগে কখনো ট্রেনে করে বাড়ি ফেরা হয়নি ঈশানীর। কারন প্রত্যেকবারই জিসান গিয়ে বাসে তুলে দিয়ে এসেছে ওকে। কিন্তু এবারের বাড়ি যাওয়ার ব্যাপারটা জিসানের থেকে পুরোপুরি চেপে গিয়েছে ঈশানী, ওর মতে ব্যক্তিগত বিষয় গুলো বাইরের মানুষ যত কম জানবে ততই ভালো। অন্তর্মূখী স্বভাবের একটা মেয়ের ভাবনা এর থেকে বেশি আর কিইবা হতে পারে?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বাইরে সাহসীকতা, নির্ভীকতা দেখানো নীল চোখের ঈশানী, ভেতর ভেতর ভীষণ সরল আর ভীতু, যার দরুন এতো রাতে ট্রেনে চেপে একা বাড়ি ফেরার সাহস ওর হয়নি, মূলত নিঝুমের সঙ্গে আলাপ করেই দুজন মিলে ট্রেনে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল ওরা। তাছাড়া ঈশানীর বিয়ে যতই ঘরোয়া ভাবে হোক না কেন, নিঝুম ওর বিয়েতে যাবে না তা কি করে হয়? এমনিতেই ঈশানী মেয়েটার আপন জনের তালিকা শূন্য প্রায়, নিঝুমের ও না বলার মতো কোনো অপশন ছিল না, কিন্তু শেষ মূহুর্তে এসে একদম ঘেটে গিয়েছে সব টা।

হুট করেই বিকেল বেলা নিঝুম কল দিয়ে জানায় ও বাড়িতে যাচ্ছে, খুব জরুরি প্রয়োজন, নয়তো কিছুতেই ঈশানীকে একা ফেলে যেতো না, মোবাইলের মধ্যে দুঃখ ও প্রকাশ করেছে খুব, তার পাশাপাশি ঈশানীকে ভালো মতো বুঝিয়ে দিয়েছে কিভাবে কিভাবে গিয়ে ট্রেন ধরতে হবে। ঈশানী জানে নিঝুম অযুহাত দেওয়ার মতো মেয়ে নয়, তবুও ওর ভীত হৃদয়ে কিছুটা সংশয় আর আ’তঙ্ক জড়ো হয়েছে বটে। তবে সেই সংশয় কে কোনোরূপ পাত্তা দিলোনা ঈশানী বরং নিঝুমকে উদ্দেশ্য করে হাসি মুখে জবাব দিলো,

— সমস্যা নেই, তুই সাবধানে যাস,এমনিই বৃষ্টির রাত বুঝে শুনে গাড়িতে উঠিস, আমি ঠিক ট্রেন ধরে চলে যেতে পারবো।
ঈশানীর কথার প্রত্যুত্তরে নিঝুম যে মুখ ফুটে বলবে,
—-এতো রাতে বাড়ি যাওয়ার প্রয়োজন টা কি?
সেটারও উপায় নেই, কারণ আগামীকাল ঈশানীর আকদ।তাছাড়া ঈশানী দেরি করে ফেলেছে বলে রোকেয়া বেগম বেজায় চটে আছেন। ঈশানী মা কে শান্ত করার জন্য মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে বলেছে যে, ও গাড়িতেই আছে আরেকটু পরেই চলে আসবে।

এদিকে বৃষ্টি যে থামার কোনো নাম গন্ধই নিচ্ছে না। ক্ষনে ক্ষনে দিগুণ তালে বেড়ে যাচ্ছে বর্ষন।
গ্লাস ক্লিনার আর তোয়ালে দিয়ে ক্যাফের কাঁচের দেওয়াল গুলো পরিস্কার করতে করতেই বাইরের রাস্তার দিকে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে ঈশানী, একটু পর বের হতে হবে ওকে, সকালে কাজে আসার সময়ই ব্যাগ গুছিয়ে এখানে এসেছে, অথচ এই রাতের বেলাতে কি বৃষ্টিটাই না শুরু হলো।
—ইশশ, আজ যে কি কি দূর্ভোগ আছে কপালে তা কেবল উপর ওয়ালাই ভালো জানেন।
বিজলির আলোয় বিশাল হাইওয়ে রাস্তাটা একঝলক পরখ করে নিজ মনেই অস্ফুটে বিড়বিড়ালো ঈশানী।
অতঃপর হাতের জিনিস গুলো রেখে, এ্যাপ্রোন খুলে, একে একে সব কাজ গুছিয়ে একটা ছাতা মাথায় নিয়ে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে পরলো ও। উদ্দেশ্য চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন।

ঈশানী যখন স্টেশনে এসে পৌঁছায় তখনও তীব্র বারিধারায় ভেসে যাচ্ছে চারিপাশ। পরনের জামা কাপড় প্রায় অর্ধেক ভিজে গিয়েছে, রেলস্টেশন টা একদমই অপরিচিত ঈশানীর নিকট।
তার উপর রাতের বেলা ল্যাম পোস্টের আলোয় ভালো করে দেখাও যাচ্ছে না কোনোকিছু ,কাউন্টারে একটা মানুষ ও নেই যাকে ও গিয়ে জিজ্ঞেস করবে যে কক্সবাজারের ট্রেন আদতে কোনটা?
চারপাশটা বড্ড নিরিবিলি,শুধুমাত্র বৃষ্টির রিমঝিম আওয়াজ ব্যাতীত আর কোনো আওয়াজই নেই এখানে। এহেন জনমানবহীন পরিবেশে গাঁ ছমছম করছে ঈশানীর। নিজের হাত ঘরিটার দিকে একনজর চোখ বুলিয়ে ঈশানী সিদ্ধান্ত নেয় ও প্লাটফর্মে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকবে, এখানে এমন বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে ট্রেন খোঁজার তো কোনো মানে হয়না,তাইনা?

সেই উদ্দেশ্যেই কয়েক কদম পিছু হেঁটেছিল ঈশানী, ঠিক তখনই গলা কাঁপিয়ে বেজে ওঠে কোনো এক যাত্রীবাহী ট্রেনের হুইসেল। হুইসেলের বিকট শব্দে পেছনে চাইলো ঈশানী, দেখলো ওর কাছের ট্রেনটাই যাত্রা শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, বৃষ্টির মাঝেও কোথা থেকে যেনো ছুটে এসে তাড়াহুড়ো করে ট্রেনে উঠে যাচ্ছে মানুষ। এমতাবস্থায় উপায়ন্তর না পেয়ে ঈশানী বহু কসরত করে একটু খানি গলার আওয়াজ বের করলো,ট্রেনের উদ্দেশ্যে ছুটতে থাকা একজন যাত্রীকে পিছু ডেকে শুধালো,

— আচ্ছা এটা কি কক্সবাজারের ট্রেন?
তুমুল বর্ষনের মাঝে ঈশানীর এমন ক্ষীণ আওয়াজ লোকটা আদৌও শুনেছে কি না সন্দেহ, তবে সে দৌড়ে যেতে যেতেই উত্তর দিলো,
— হ্যা হ্যা জলদি আসুন, টাইম হয়ে গিয়েছে।
লোকটা হ্যা বলেছে, তাই এবার কিছুটা আশ্বস্ত হলো ঈশানী, বুকের উপর থেকে যেন শক্ত পোক্ত একটা পাথর নেমে গেলো ওর, সেরকমই একটা লম্বা শ্বাস টেনে বৃষ্টির পানি পায়ে মাড়িয়ে ব্যাগ সমেত তাড়াহুড়ো করে ট্রেনে উঠে গেলো ঈশানী।
বোকা ঈশানী তখনও অন্ধকারের মাঝে এটা খেয়াল করলো না যে আন্তঃনগর ট্রেনের গায়ে গুটিগুটি অক্ষরে লেখা “চট্টগ্রাম টু খাগড়াছড়ি”।

তবে ট্রেনে উঠতেই ঈশানী যতক্ষনে পরিষ্কার বৈদ্যুতিক বাল্বের আলোয় ভেতরে ট্রেনের গায়ের লেখা গুলো খেয়াল করলো, ততক্ষনে ট্রেনটা ধীরে ধীরে চলতে শুরু করে দিয়েছে। ট্রেনটা কক্সবাজার না খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে, ব্যাপারটা বুঝে আসতেই বাইরে রাতের আঁধারে আকাশ ভেঙে বাজ পরার চেয়েও দিগুণ জোরে যেন বাজ পরলো ঈশানীর মাথায়।
নিদারুণ এক আ’তঙ্কে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলো মেয়েটা। নিজেকে সাহসী প্রমান করতে গিয়ে আরেকদফা বোকামি করে ফেলেছে ও। নিজের বোকামি, আর অপরিনামদর্শীতার ফলস্বরূপ এখন এই মূহুর্তে চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাপিয়ে পড়ে ম’রে যেতে ইচ্ছে করছে ঈশানীর। কিন্তু তার জন্যেও তো গোটা একটা সাহসী হৃদয় প্রয়োজন, যেটা আপাতত নেই ঈশানীর।

তাই ও পারলো না সে সব করতে, উল্টো ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে ফোন লাগালো নিঝুমের নাম্বারে। বৃষ্টির মাঝে নেটওয়ার্কের সমস্যা নাকি অন্য কোনো কারন জানা নেই ঈশানীর, কিন্তু নিঝুমের নাম্বারটা বন্ধ বলছে বারবার , এবার সত্যি কান্না পাঁচ্ছে ওর। বিরক্তিরা যেন জেঁকে ধরেছে সর্বাঙ্গ, এবার আর উপায়ন্তর না পেয়ে জিসান কে কল দিলো ঈশানী। এক-দু’বার রিং হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওপাশ থেকে হ্যালো বললো জিসান।
ওপাশ থেকে চেনা পরিচিত জিসানের কন্ঠস্বর শোনা মাত্রই, নিজের সেই চিরাচরিত খেইর হারিয়ে, কাঁদো কাঁদো গলায় ঈশানী বলে ওঠে,

—- আমি ফেঁসে গিয়েছি জিসান।
ঈশানীর এমন শঙ্কাগ্রস্থ আওয়াজ শুনতে পেয়ে, উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো জিসান, তাড়াহুড়ো করে শুধালো,
—- কি হয়েছে তোর?
নিজেকে সংবরণ করার চেষ্টা চালিয়ে দ্বিধাগ্রস্থ কন্ঠে ঈশানী বলে,
— আমি ভুল করে খাগড়াছড়ির ট্রেনে উঠে পরেছি, আর এখন ট্রেনটা চলতে শুরু করে দিয়েছে।আমি কি করবো কিচ্ছু বুঝতে পারছি না,সব এলোমেলো লাগছে আমার।
ঈশানীর কথা শুনে জিসানের তো মাথায় হাত, এই মেয়েটা নিজেকে ভাবেটা কি? ও কিছুটা ক্ষুদ্ধস্বরে ঈশানীকে বললো,

— তুই হঠাৎ বাস রেখে ট্রেনে উঠতে গেলি কোন শখে? গেলি তো গেলি আমাকে কেন জানালি না? আমাকে এতোটাই অপছন্দ করিস যে তুই এই বৃষ্টির মাঝে বাড়িতে যাচ্ছিস, সেটাও আমাকে একটাবার জানানোর প্রয়োজন বোধ করলি না? সত্যি করে বলতো, তুই কি আদৌও আমাকে বন্ধু ভাবিস ঈশা?
এমন একটা শ্বাসরুদ্ধকর প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জিসানের এসব ছেলেমানুষী প্রশ্ন, বন্ধুত্বের সমীকরণ, ভাবা না ভাবা, ব্যাপারগুলো বড়ই অসহনীয় ঠেকলো ঈশানীর নিকট, তাই আর কোন কিছু না বলেই আস্তে করে কলটা কেটে দিয়ে মোবাইলটা বন্ধ করে ফেললো ঈশানী।

—এই ঘটনা মা জানলে নি’র্ঘাত বাড়িতে লঙ্কা কান্ড বাঁধিয়ে বসবে, যে করেই হোক সকালের মধ্যে বাড়ি ফিরতেই হবে আমাকে।
নিজেকে নিজে হাজারটা দোষারোপ করতে করতে ঈশানী ঠিক করলো এখানে দাঁড়িয়ে থেকে তো আর লাভ নেই, তাই ও গিয়ে সিটে বসবে। ট্রেনটা খাগড়াছড়িই তো যাচ্ছে, দেশের বাইরে তো আর যাচ্ছে না?এতো ঘাবড়ানোর কিছুই নেই।
সেই ভেবে যেই না কিঞ্চিৎ পিছু ঘুরলো ঈশানী, তৎক্ষনাৎ চলন্ত ট্রেনের হাল্কা ধাক্কায় একটা কালো হুডি পরিহিত লোকের শক্ত চওড়া,বলিষ্ঠ বুকের উপর তনু পিঠ গিয়ে ঠেকলো ঈশানীর।
লোকটা ওকে সামলালো না, আর নাতো নিজের যায়গা থেকে এক চুল পরিমাণ নড়লো। উল্টো আকস্মিক কান্ডে তাড়াহুড়ো করে নিজেই নিজেকে সামলালো ঈশানী, লোকটার উপর থেকে নিজেকে সরিয়ে, পেছন ঘুরে দেখলো লোকটা ওর খুব কাছে দাঁড়িয়ে, এতোটা কাছাকাছি সাধারণত কোনো অপরিচিত মানুষের দাঁড়ানোর কথা নয়, তবে সেসব ভাবনা মস্তিষ্ক ছুঁতে পারলো না ঈশানীর,উল্টো এই কালো হুডি, কালো মাস্ক আর কালো বেসবল ক্যাপ পরিহিত লোকটাকে চেনাচেনা ঠেকলো ওর মস্তিষ্কে।

এরকমই তো একজোড়া নির্জীব, অনুভূতিহীন, শূন্য চোখ সেদিন রাতে দেখেছিল ও। সেদিন অন্ধকারে খেয়াল করা হয়নি, লোকটার এক ভ্রু তে পিয়ার্সিং করানো। সেখানে জলজল করছে ছোট্ট একটা মেটালিক রিং। ঈশানী টিভিতে দেখেছে সাধারণত রকস্টার কিংবা ব্যান্ড তারকারা এইসব স্টাইল করে থাকে। তাহলে কি এই মাস্ক পরিহিত লোকটাও কোনো বড়সড় রকস্টার? লোকটার দিকে তাকিয়ে, অদ্ভুত এই প্রশ্নটা খেলে গেলো ঈশানীর অযাচিত মনে, কিন্তু ও মুখে বললো,

—- আপনি সে না? ওই যে সেদিন ক্যাফের সামনে…..
বাক্যটা সম্পূর্ণ করতে পারলো না ঈশানী, তার আগেই একেবারে হুট করে, ঈশানী সহ পুরো ট্রেন শুদ্ধ সবাইকে চমকে দিয়ে নিজের একহাত উঁচিয়ে অকস্মাৎ ট্রেনের চেইন টেনে ধরলো লোকটা। সঙ্গে সঙ্গে ওই অবস্থাতেই থেমে গেলো পুরো ট্রেন। স্টেশন থেকে ছেড়ে হয়তো মিনিট পাঁচেক চলেছিল, তার মধ্যেই এই কাহিনী।

হুট করে ট্রেন থেমে যাওয়াতে যাত্রী সকলের মাঝে হইহই শোরগোল পরে গেলো। চেইন কে টেনেছে সেই খবরদারি করতে, কোথা থেকে যেন ছুটে এলেন ট্রেন মাস্টার, তিনি মাস্ক পরিহিত লোকটাকে উদ্দেশ্য করে খেঁকিয়ে উঠে কিছু বলবেন, তার আগেই লোকটা ঘুরে মুখোমুখি হয়ে দাড়ালো ট্রেন মাস্টারের দিকে, লোকটার চাহনিতে একঝলক নজর বুলিয়ে,কি ভেবে যেন তৎক্ষনাৎ চুপসে গেলেন ট্রেন মাস্টার। আর কিছু না বলেই মুখ কাচুমাচু করে তাড়াহুড়ো পায়ে যায়গা ত্যাগ করেন তিনি। ভাবটা এমন যেন, খবরদারি করতে আসাটা তার বিরাট বড় অন্যায় হয়ে গিয়েছে।
ট্রেন মাস্টার চলে গেলে, হুডি পরিহিত লোকটা নিজেও ট্রেন থেকে আস্তে করে নেমে পরে। এখন বৃষ্টি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। মুষলধারার বর্ষন কমে গিয়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরছে বাইরে, এদিকে সেই তখন থেকে লোকটাকে অদ্ভুত নজরে পরখ করছে ঈশানী, আর মনেমনে ভাবছে,

—- এখানে হচ্ছে টা কি? চেইন টেনে পুরো ট্রেন থামিয়ে দিলো, অথচ ট্রেন মাস্টার অবধি কিছু বললো না,কে ইনি?আসলেই কি কোনো সেলিব্রিটি?
ঈশানীর ভাবনার সুতো ছিড়ে যায়, লোকটার আরেক দফা অদ্ভুত কর্মকান্ডে। কোনোকিছুর ইঙ্গিত না দিয়ে, একেবারে হঠাৎ করেই ঈশানীর হাত টেনে ধরে ওকে ট্রেন থেকে নামিয়ে আনলো লোকটা। আচানক এই কান্ডে হকচকিয়ে উঠলো ঈশানী। আ’তঙ্ক আর আত্নমর্যাদার বশবর্তী হয়ে মেয়েটা চেঁচিয়ে উঠলো তৎক্ষনাৎ,
— কে আপনি?অনুমতি ছাড়া হাত ধরেছেন কেন এভাবে?
ঈশানীর এমন ঝাঁজালো আওয়াজের প্রত্যুত্তর করলো না লোকটা, তবে ল্যামপোস্টের আলোয় হঠাৎ করে পাল্টে যাওয়া চোখের ভয়ঙ্কর রঙ আর ভাষা দুটোই আত্মায় কাঁপন ধরিয়ে দিলো ঈশানীর, যেন অনুভূতিহীন ওই ডমিনেটিং শূন্য চোখ জোড়া ওর গলা চেপে ধরে ক্ষুব্ধস্বরে বলে উঠলো ,

— আওয়াজ একদম নিচে।
লোকটা তেমন করেই নিজের চোখ দুটো অন্য দিকে ঘুরিয়ে আঙুল উঁচিয়ে কিছু একটা দেখালো ঈশানীকে। লোকটার আঙুলের ইশারা অনুস্বরণ করে পেছনে তাকাতেই ঈশানী দেখতে পেলো অদূরে কক্সবাজারের ট্রেনটা হুইসেল বাজিয়ে যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

তারমানে কক্সবাজারের ট্রেনের সময় ডিলে হওয়ার কারনে এখনো ছাড়েনি? ব্যাপারটা বুঝে আসতেই চোখ জোড়া খুশিতে চিকচিক করে ওঠে ঈশানীর, স্বস্তিতে ক্লান্তি যেন ঝরঝরিয়ে নেমে আসে পুরো শরীর জুড়ে। ইচ্ছেতো করছে চিন্তামুক্ত হওয়ার খুশিতে হাউমাউ করে কেঁদে উঠতে, কিন্তু তার সময় কোথায়? ট্রেন তো ছেড়ে দিলো বলে।
যার দরুন, ঈশানী আর একমূহুর্ত ও দেরি না করে ছুট লাগালো স্টেশনের দিকে। ছুটতে ছুটতেই ঘাড় ঘুরিয়ে একঝলক চাইলো পেছনের দিকে, হয়তো সেই কালো মাস্ক আর হুডি পরিহিত লোকটাকে ধন্যবাদ জানানোর উদ্দেশ্যে। কিন্তু না, ল্যামপোস্টের নিয়ন আলোতে অচেনা লোকটার দর্শন আর পাওয়া গেলো না। যেন রাতের আঁধারের সঙ্গে মিলেমিশে মরিচীকার মতোই উবে গিয়েছে সে।
এদিকে ছুটতে ছুটতেই হুট করে একটা অজানা কৌতুহল এসে একেবারে ছক্কা হাঁকানোর মতোই,মস্তিষ্কে এসে বিট করলো ঈশানীর, অত্যাধিক আশ্চর্য মনেমনে বললো,
— আমি যে ভুল ট্রেনে উঠেছিলাম, সেটা উনি কি করে বুঝলো আশ্চর্য, তারমানে কি উনি আমার ফোনে বলা সব কথা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনেছে? কিন্তু কেন?

একরাশ ঝামেলা, বি’পদ আর প্রতিকূল আবহাওয়া মাথায় নিয়ে ঈশানী যখন বাড়িতে ফিরলো তখন প্রায় মাঝরাত। বৃষ্টি এখন পুরোপুরি থেমে গিয়েছে, তবে আকাশে চাঁদের দেখা নেই, বুনো মহিষের পালের মতোই বর্ষার আকাশ কালো হয়ে আছে। মাঝরাত হওয়াতে চারিদিকের পরিবেশ ভীষণ নিরবিলি,ব্যঙ আর ঝিঁঝি পোকার আওয়াজ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না আপাতত।
বাড়ির উঠোনে টিমটিমিয়ে জ্বলতে থাকা বৈদ্যুতিক আলোর রোশনাই এ চারিদিকে চোখ বোলালো ঈশানী, বাড়িটা সবসময়ের মতোই ভুতুড়ে বেশে নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে, দেখে কে বলবে কাল যে এ বাড়ির মেয়ের বিয়ে? তবে ভেতরে যে সবাই ঈশানীর প্রতিক্ষাতেই পথ চেয়ে বসে আছে তাতে ভুল নেই। কারণ কাল তো ওকে বিয়ে দিয়ে নিজেদের কাঁধ হালকা করতে হবে।

“বিবাহ উপযুক্ত মেয়েরা পরিবারের বোঝা স্বরূপ ”
এতোদিন ধরে লোকমুখে শুনে আসা প্রচলিত এই বাক্যটার সারমর্ম আজ উপলব্ধি করতে পেরে আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ঈশানী। বুকের ভেতরটা ভারী ভারী লাগছে খুব, হুট করেই মস্তিষ্কে ভর করেছে অজানা অস্বস্তি, তবুও সে সবে কিঞ্চিৎ পাত্তা না দিয়ে , ধীরে ধীরে ঘরের দিকে পা বাড়ালো ও।

ভেতরে ঢুকতেই দেখা মিললো মামা মামী, মামাতো ভাই বোন সহ টুকটাক কাছের আত্নীয় স্বজন সবার। কোনোকালেই হইহট্টগোল, মানুষের গিজগিজ পছন্দ নয় ঈশানীর। কাজের সূত্রে চিটাগং থাকায় এখন না চাইতেও কিছুটা সহ্য করতে হয়, তবে বাড়িতে এলে সেটুকু ও আর সহ্য হয়না ওর।
যেহেতু নিচ তলার লিভিং এ বসে আগামী কালকের আকদ নিয়ে সবাই আলোচনায় ব্যস্ত ছিল, তাই এই ফাঁকে চুপচাপ সকলের দৃষ্টির আড়ালেই নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায় ঈশানী। তবে রোকেয়া প্রাচী চালাক মহিলা, তিনি ঈশানীকে ঠিকই খেয়াল করেছেন, খেয়াল করার সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকেই ডেকে উঠলেন তিনি,
— এতো দেরি হলো কেন ফিরতে? আর এভাবে ভিজেছিস কি করে?

আচমকা মায়ের প্রশ্ন শুনে থমকে গেলো ঈশানীর পদধ্বনি, এতোটা ধকল সামলে বাড়িতে ফিরে, এরকম হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছে করছিল না বলেই তো পা টিপেটিপে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ঈশানী। এখন আর কিছু করার নেই, মা যেহেতু প্রশ্ন করেই ফেলেছে, সুতরাং উত্তর ওকে দিতেই হবে, এখানে মুখ বুঁজে থাকার কোনো অপশন নেই, তাই সহসা পেছনে ঘুরে মৃদু আওয়াজে জবাব দিলো ঈশানী, বললো,
—- বৃষ্টির কারনে ট্রেন ডিলে হওয়াতে আসতে দেরি, আর ভিজেও গিয়েছি বৃষ্টিতেই।
— তাহলে ফোন বন্ধ কেন করেছিস?

এবার মায়ের প্রশ্নটা পুরোপুরি এরিয়ে গেলো ঈশানী, কারন ফোনটা তো সেই শ্বাসরুদ্ধকর মূহুর্তে জিসানের উপর বিরক্ত হয়ে বন্ধ করে রেখেছিল ও,নয়তো ওই সময় হাজারটা কল করে করে ব্যাপারটাকে আরও বিগড়ে দিতো ছেলেটা, তখন অযথা প্যানিক করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকতো না ঈশানীর। খানিকক্ষণ চুপ থেকে নিজের এলোমেলো ভাবনা গুলোকে সাজিয়ে, সেগুলোকে সাইডে সরিয়ে ঈশানী ক্লান্তস্বরে বলে ওঠে,
— মাথাটা খুব ধরেছে মা, জার্নি করে এসে ক্লান্ত লাগছে খুব। তোমার যা প্রশ্ন করার কালকের জন্য জমিয়ে রাখো, আমি উত্তর দিয়ে দেবো। এখন দয়া করে রুমে যেতে দাও, ভালো লাগছে না আর।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গটগটিয়ে রুমে চলে যায় ঈশানী। মেয়ের এহেন শান্তস্বর অথচ বিগড়ে থাকা মেজাজের পারদ অনুমান করতে পেরে রোকেয়া প্রাচীও আর দ্বিতীয় প্রশ্নটি করার সাহস দেখালেন না, বরং চুপচাপ রুমে যেতে দিলেন ওকে।

রুমে ফিরে ঈশানী যখন হাতমুখ ধুয়ে বের হয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঠিক সে সময়ে ওর কক্ষে আগমন ঘটে ঊষার, ঈশানী যখন ব্যস্ত হাতে বিছানা পরিস্কার করছিল, তখনই মুঠিবদ্ধ করে রাখা একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি দেখিয়ে ঊষা বলে ওঠে,
—দেখতো আপু কি নিয়ে এসেছি!
ঊষার কন্ঠে উচ্ছ্বাসের জোয়ার, তবে তাতে চমকালো না ঈশানী, বরং সাবলীল গলায় ঊষাকে শুধালো,
— কি এনেছিস?
— দুলাভাই এর ছবি নিয়ে এসেছি।
ঊষা”দুলাভাই” শব্দটা উচ্চারন করতেই ঈশানীর বোধগম্য হলো, রাত পোহালেই যার সাথে ওর বিয়ে, যার হাত ধরে গোটা একটা জীবন পার করে দিতে হবে ঈশানীকে, এই মূহুর্তে সেই মানুষটার কথাই বলছে ঊষা।
বাক্যের মাথায়, হাতের ছবিটার দিকে তাকিয়ে আবারও উচ্ছ্বাস করতে দেখা গেলো ঊষাকে। অথচ ঈশানী নির্বিকার গলায় জবাব দিলো,

— তোর দুলাভাই তুই দেখ, যাতো এখন ঘুমাবো।
ঈশানীর প্রত্যাখানে দমলো না ঊষা , বরং ছবিটার দিকে গভীর দৃষ্টিপাত করে দাঁত কেলিয়ে বলে উঠলো,
—- মা ঠিকই বলেছে আপু, দুলাভাই দেখতে রাজপুত্রের মতোই সুদর্শন, এরকম সুন্দর জামাই আমাদের মহল্লায় আর দুটো নেই।
ঊষার কথা শেষ হতেই ছোঁ মে’রে ওর হাত থেকে ছবিটা নিয়ে নেয় ঈশানী, অতঃপর সেটাকে ওড়ানার আড়ালে ঢুকিয়ে, ঊষাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
— যা তো এখন, তোর বকবক শোনার টাইম নেই, ঘুমাবো আমি।
—- সে না’হয় যাবো, কিন্তু ছবিটা তো দে, মা চাইবে তো আবার।
ঊষার কথায় কান দিলোনা ঈশানী, বরং ওকে এক প্রকার ঠেলেঠুলে রুম থেকে বের করে দিতে দিতে ঈশানী বলে,
— পরে নিয়ে নিস, এখন যা।

ঊষা চলে গেলে রুমের দরজায় খিল দিয়ে ওড়নার আড়াল থেকে ছবিটা বের করলো ঈশানী, ছবিটা দেখতে গিয়ে ভীতি, সংকোচ,লজ্জা সব যেন একসাথে আঁকড়ে ধরলো ওকে। যেন ও একটা সামান্য ফটো নয় বরং গোটা একটা মানুষকে চোখ উঁচিয়ে দেখতে চলেছে, ঠিক তেমন করেই আস্তে ধীরে চোখ তুলে মাহিনের ছবির দিকে দৃষ্টিপাত করলো ঈশানী।
তবে সবার আগে ঈশানীর চোখ গেলো ছবির উপরে গুটিগুটি অক্ষরে লেখা, ” মাহিন বেনজামিন ” নামটার দিকে। অতঃপর দৃশ্যগত হলো সেই সুদর্শন যুবকের মুখ খানা। আর এক দেখাতেই ঈশানীর মনে হলো,
—ঊষা ভুল কিছু বলেনি লোকটা দেখতে অসম্ভব সুদর্শন। কিন্তু এই রাজপুত্রের মতো সুদর্শন পুরুষ কি সত্যিই আমার মতো নিশ্চুপ, বরফের মতো শীতল একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চায়?
একটা অদ্ভুত অনিশ্চয়তা ভলভলিয়ে ছড়িয়ে পরলো ঈশানীর সমগ্র মন মস্তিষ্ক জুড়ে, পরক্ষণেই আবার আত্নবিশ্বাসী মনটা বলতে লাগলো,

— বিয়েটা যেহেতু হচ্ছে, তাহলে নিশ্চয়ই ওনার অমতে হচ্ছে না কিছুই, উনি নিশ্চয়ই জেনে শুনেই আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছেন।
কথাটা ভেবেই নিজের অজান্তে লাজুক হাসলো ঈশানী। কে জানতো, ওর মতো বোকা সোকা চুপচাপ স্বভাবের মেয়েটার কপালে যে এমন রাজপুত্রের মতো সুদর্শন বর লেখা ছিল? এটা সত্যিই অভাবনীয় আর আর চমৎকার একটা অনুভূতি, যা এই প্রথমবারের মতো হৃদয়ে অনুভব করলো ঈশানী।
এখনো যেন নিজেই নিজেকে বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না ও, তাই তো মনের মাঝে হাজারও অদম্য আর অবিশ্বাস্য স্বপ্ন নিয়ে নিজের হবু বরের ছবিটা দেখতে দেখতেই এক সময় ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলো অন্তর্মূখী আর নরম হৃদয়ের ঈশানী।

সকাল বেলা জানালা গলিয়ে প্রবেশ করা সূর্যের তীর্যক আলোক রশ্মি চোখে মুখে আঁচড়ে পরতেই ঘুম ছুটে যায় ঈশানীর। কাল সারাদিন সারারাত এক নাগাড়ে বৃষ্টি হলেও আজ সকাল সকাল ভালোই রোদ উঠেছে সমগ্র ধরনী জুড়ে। তবে সূর্যের উত্তাপ দেখে মনে হচ্ছে বেলাও কম হয়নি, আজ তো ঈশানীর বিয়ে, অথচ কেউ এখনো ডাকলো না ওকে? ব্যাপারটা আশ্চর্য জনক। বাইরে তো মানুষের শোরগোল ও শোনা যাচ্ছেনা, অদ্ভুত!
তাই জলদি জলদি আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসে দেওয়াল ঘড়িতে একনজর চোখ বোলায় ঈশানী, ঘড়ির কাঁটায় সকাল এগারোটা বিশ বেজে গিয়েছে সেটা নজরে আসতেই এক ঝটকায় ভ্রম ছুটে গেলো ঈশানীর। ঘুমু ঘুমু ভাবটাও যেন দৌড়ে পালালো কোথাও।

আজকের মতো একটা দিনে এতো বেলা পর্যন্ত কিভাবে ঘুমালো ও? সেই ভেবেই আপাতত নীরবে কপাল চাপড়ালো ঈশানী। নিচে গেলে আজ মায়ের কড়া কথা শুনতে শুনতে নির্ঘাত কলিজা ঝালাপালা হয়ে যাবে। সেসব চিন্তা করে, তাড়াহুড়ো করে বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো ঈশানী, এরপর আলমারি থেকে একটা টকটকে লাল শিফনের শাড়ি খুঁজে বের করে সেটাকে গায়ে চড়িয়ে নিলো স্বযত্নে, সেই সাথে হাতে কানে পরে নিলো কিছু হালকা সোনার গহনা। যেহেতু শুধু ঘরোয়া আকদ হচ্ছে, তাই এতো বেশি সাজগোজ করার প্রয়োজন বোধ করলো না ঈশানী। কপালে একটা ছোট্ট কালো টিপ পরে নিলে শুধু।
অতঃপর সবশেষে, চিরুনি দিয়ে এলোমেলো চুলগুলো আঁচড়াতে যাবে, তখনই রুমের দরজায় ঠকঠক করে কড়া নাড়লেন রোকেয়া বেগম। মা নিশ্চয়ই ক্ষে’পে আছে, সেই ভেবে একপ্রকার তাড়াহুড়ো করে দরজা খুলে দিলে ঈশানী, দরজা খুলে মায়ের কথার হাত থেকে নিজেকে বাঁচানো জন্য, একা একাই বলতে আরম্ভ করলো,

— রেডি হতে দেরি হয়ে গেলো, আসলে শাড়িটা ভালোভাবে পরতে পারছিলাম না।
—- আর রেডি হতে হবে না।
মায়ের মুখে এহেন কথা শুনে, অকস্মাৎ থেমে গেলো ঈশানীর চিরুনি চালানো হাত। ও চিরুনিটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে দিয়ে মায়ের থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো তৎক্ষনাৎ,
— কি হয়েছে মা?
রোকেয়া প্রাচী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,

— ওরা বিয়েটা ভে’ঙে দিয়েছে, আসলে মাহিন বেনজামিন একজন মডেল, দেশের বাইরে এ্যাংকরিং আর মডেলিং করাটা ওর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল, আর হঠাৎ করেই নাকি ক্যানাডা থেকে মডেলিং এর অফার চলে এসেছে, তাই কালকের ফ্লাইটেই ক্যানাডা চলে গিয়েছে মাহিন।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে রোকেয়া বেগমের কথাগুলো শুনে, ছোট্ট করে জবাব দিলো ঈশানী,

— ওহ আচ্ছা।
— আর কিছু জানার নেই তোর?
— না নেই। কিছু জানার ও নেই, কিছু বলার ও নেই।
ঈশানীর এরূপ জবাবদিহিতায়, আর কিছু বলার মতোন কথা খুঁজে পেলেন না রোকেয়া প্রাচী। বরং নিজেকে সামলে নেওয়ার জন্য ঈশানীকে একা ছেড়ে দিয়ে তৎক্ষনাৎ রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। মা চলে যেতেই ধাপ করে রুমের দরজাটা বন্ধ করে দিলো ঈশানী, অতঃপর গলার চেইনটা একটানে ছিড়ে ফেলে ছুঁড়ে মা’রলো মেঝেতে, সেই সাথে হাতের আর গলার গহনা গুলোও একে একে খুলে ছু’ড়ে ফেলে দিলো সব। অতঃপর নিজের সব সাজ নষ্ট করে আয়নার দিকে তাকিয়ে একা একাই বিড়বিড়ালো ঈশানী,

— আমার জানার আছে, আমার অনেক কিছু জানার আছে, কেন তুমি সবসময় আমার জীবনটা নিয়ে এমন পুতুল খেলা খেললে মা? কেন নিজের মেয়ে হয়েও আমি তোমার এতো দূরের হয়ে গেলাম? কেন আমার ভবিষ্যতের কথা না ভেবেই, একটা ছেলের মতামত ছাড়া তার সঙ্গে আমার জীবন জুড়ে দিতে যাচ্ছিলে তুমি?
আমি কি এতোটাই অযোগ্য? এতোটাই কোল্ড?এতোটাই ফেলনা? যে কেউ আমার মুখ না দেখেই, আমাকে বিয়ে না করেই চলে গেলো? এরচেয়ে অপ’মানের কি আর কিছু হয়? তার কি একটা বারের জন্য ও আমার মানসম্মানের কথা ভাবা উচিৎ ছিল না? ছিলোতো।
আসলে নিঝুম ভুল বলেছিল এই চোখ আমার আর্শিবাদ নয়,বরং অ’ভিশাপ। আর নাতো এই চোখের মায়ায় কেউ কোনোদিন আটকাবে। আমার উপরের নির্জীবতা, কঠোরতা,শীতল, অন্তর্মুখী অনুভূতিগুলো ভেদ করে কেউ কোনোদিন আমার উষ্ণ হৃদয়ের সন্ধান করতে যাবে না, কখনোই না। সেটা আমি এতোদিনে বেশ ভালো করেই বুঝে গিয়েছি।

আর নাতো আমার মতো অতিসাধারণ মেয়েকে কেউ নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসবে কখনো, যেই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আমি খুঁজে বেড়াই, সেই ভালোবাসা বোধ হয় পৃথিবীতে এখনো তৈরিই হয়নি। নয়তো মা কেন আমায় আমার মতো করে ভালোবাসেনা?

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২

আয়নার দিকে তাকিয়ে এক নিঃশ্বাসে নিজের সকল অভিযোগ উগরে দিয়ে,ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো ঈশানী,কাঁদতে কাঁদতে হাঁটু ভেঙে ধপ মেঝেতে বসে, তাতে মাথা ঠেকিয়ে ভাবতে শুরু করলো ও, মায়ের এই পরিবর্তন ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল? কেনই বা শুরু হয়েছিল?

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪