আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২০
suraiya rafa
নিরবিচ্ছিন্ন ধূসর গোধূলি। সূর্যের লালচে আভা মিলিয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। পেন্ট হাউজের চিরাচরিত একঘেয়ে দৃশ্যপটে কিছুটা ভিন্নতা টেনেছে আজ গার্ড’স দের অনুপস্থিতি। সকাল থেকেই একের পর গাড়ির বহর বেড়িয়েছে ভবন থেকে। স্টাফ কোয়ার্টার ও ফাঁকা প্রায়। সারাদিনের সরগরম চিত্র বেলকনিতে দাঁড়িয়ে একা একাই পরখ করেছে ঈশানী। মাফিয়াদের ব্যাপার স্যাপার খুব একটা মাথায় না ঢুকলেও এতটুকু ঠিকই আঁচ করতে পেরেছে, পেন্ট হাউজ আজ সুরক্ষা মুক্ত।
গার্ড’সদের অধিকাংশই টেরিটোরিতে উপস্থিত নেই। সারাদিনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা গুলোকে মস্তিষ্কে সাজিয়ে সেই বিকেল থেকেই ধ্যান মগ্ন মেয়েটা, মনে হয় কিছু একটা চলছে ওর মাথায়। আজ আর নিজের রুমে নয়, রান্নার নাম করে কিচেন কাউন্টারে বসে বসেই এক আধবার সুক্ষ্ম নজর বুলিয়েছে এরীশের অফিস কক্ষের দরজায়, সেখানেও আজ দেহরক্ষী গার্ডগুলো অনুপস্থিত।
— কি ব্যাপার! কোথায় গেলো সব?
সসপ্যানে কাঠের খুন্তি নাড়াতে নাড়াতে একাই বিড়বিড়ালো ঈশানী।
মেয়েটা ব্যতিগ্রস্থ। রান্নার নাম করে সেই তখন থেকে স্যুপের হাঁড়িতে একের পর এক মশলা দিয়েই যাচ্ছে, তো দিয়েই যাচ্ছে। একপর্যায়ে কেবিনেটের সকল কৌটা হাতরাতে হাতরাতে ওর হাতের মুঠোয় ধরা দিলো কুটকুটে খয়েরী রঙের পানীয় ভর্তি একটা ছোট্ট শিশি। যার গায়ের গুটিগুটি ইংরেজি লেখা গুলো দেখা মাত্রই অকস্মাৎ নীলাম্বর নেত্রদ্বয় পুলকে চিকচিক করে ওঠে ঠুনকো হৃদয়ের প্রবল আত্নবিশ্বাসী মেয়েটার।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
ভর সন্ধ্যাবেলা দরজা ভেজিয়ে অফিস কক্ষে বসে আছে এরীশ। বাজপাখির মতো তীক্ষ্ণ শীতল চোখ দু’টো তার আই প্যাডে নিবদ্ধ। চকচকে স্ক্রিনে ভেসে আছে সেদিনের সেই অজ্ঞাত স্পাই দু’টোর প্রতিবিম্ভ। যারা অতি কৌশলে নিজেদের আত্ন পরিচয় গোপন করে ছবি তুলে নিয়েছে ঈশানীর। ছবি গুলো ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। বাঙালী মেয়েটা টক অফ দ্যা আন্ডারওয়ার্ল্ড এ পরিনত হয়েছে আজকাল। কারণ টা অবশ্য এরীশ নিজেই, ও মেয়েটাকে যেতে দিলে হয়তো মাফিয়া গ্রুপ গুলোর এতোটা নজরে আসা তো দূরে থাক, একটা সাধারণ স্লাটের দিকে তারা ফিরেও তাকাতো না কোনোদিন । কিন্তু একটা সাধারণ মেয়ের সুরক্ষা কবজ যদি হয় স্বয়ং এরীশ ইউভান , তবে অন্য মাফিয়াদের কুটিল নজর আর হিংস্র থাবার সম্মুখীন হওয়াটা তো অস্বাভাবিক কিছুই নয়। মাফিয়ারা টের পেয়েছে এই মেয়েটা দামী, ব্লাড ডায়মন্ডের চেয়েও বেশি দামী। কিন্তু এই দামের পেছনে রহস্যটা কি? সেটাই আপাতত সকলের কৌতুহল।
যে মেয়েটাকে খারাপ ভাবে ভেঙে ফেলার উদ্দেশ্যে এই রাশিয়ান পেন্টহাউজে নিয়ে আসা, আজ তাকেই বারবার সুরক্ষা দিতে ব্যতিগ্রস্থ এরীশ। ও ভেবে পায়না কেন এমন হচ্ছে। হৃদয়টা লাগামহীন, অত্যন্ত পৈশাচিক বেপরোয়া মস্তিষ্কটাকে বারংবার হারিয়ে দিচ্ছে এই অনুভূতিহীন নির্জীব হৃদয়। কি আছে এই নীলাম্বরির মাঝে? আহামরি তো কিছু নয়, তবুও উদভ্রান্ত হৃদয়টাকে দমিয়ে রাখা দুস্কর। মেয়েটা মস্তিষ্কের চিন্তার পারদ ছাপিয়ে হৃদয়ে ঢুকে যেতে চাইছে এক অনিরাময় ব্যাধি হয়ে । এরীশ হাজার বার অস্বীকার করুক, হিংস্রতা আর নিষ্ঠুরতার স্তূপে দমিয়ে রাখুক অপারগতা। কিন্তু সত্যি তো এটাই যে মেকি জেদ দেখানো ওই একরত্তি মেয়েটার জন্য আজকাল কিছু একটা অনুভূত হয় হৃদয়ে। হাজার বার নিজেকে নিজে দূর্বলতাহীন পাথর মানব দাবি করার পরেও সরলতা জড়ানো একজোড়া নীল চোখের মায়ার জোয়ারে আকস্মিক থমকে যায় ওর পুরো দুনিয়া।
সুকৌশলী নেত্রপল্লব আইপ্যাডে নিবদ্ধ থাকলেও, মস্তিষ্ক জুড়ে সরলতার সুক্ষ্ম বিচরণ। বিরক্ত হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে থমথমে মুখে বসে আছে এরীশ। কনুই এর উপর সমস্ত শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে টেবিলের দিকে ঝুঁকে আছে খানিক। ঠিক এমন সময় নিঝুম রাতের নিস্তব্ধতা ছাঁপিয়ে দরজার ওপাশ থেকে ভেসে আসে একজোড়া নীরব পদধ্বনি, সেই সাথে রিনঝিন নুপুরের মাদকিত আওয়াজ। সামান্য নুপুরের আওয়াজে কর্ণকূহুর সচকিত হয় এরীশের। না চাইতেও আচানক মাথা তুলে ব্যাকুল চোখে পরখ করে সামনের দৃশ্যপট।
এরীশ চাইতে না চাইতেই দরজা ঠেলে ধীর পায়ে ভেতরে প্রবেশ করে ঈশানী। মেয়েটার চোখেমুখে রাজ্যের কুন্ঠা,হাতের মাঝে আটকে আছে ধোঁয়া ওঠা গরম কফির কাপ। ঈশানীকে দেখা মাত্রই পিঠ টানটান করে চেয়ারে গা ছড়িয়ে সোজা হয়ে বসলো এরীশ। দু’চোখের মাঝে আচানক জাগ্রত ব্যাকুলতা হটিয়ে কপালে টানলো কয়েক খানা বিরক্তির ভাঁজ। সেভাবেই মেয়েটার আগা থেকে গোড়া অবধি বিচক্ষণ নজর বুলিয়ে গমগমে কঠিন আওয়াজে প্রশ্ন ছুড়লো হঠাৎ,
— এখানে কি চাই?
প্রত্যুত্তর করলো না ঈশানী, বিনাবাক্যে হাত বাড়িয়ে এরীশের দিকে এগিয়ে দিলো কফির কাঁপ। ঈশানীর কান্ডে ভ্রু কুঁচকালো এরীশ,তারস্বরে বললো,
— চেয়েছি কফি?
ওর গমগমে আওয়াজে কিঞ্চিৎ ভড়কালো মেয়েটা। আড়ষ্ট কন্ঠে জানালো,
— ব্ল্যাক স্প্রেসো, আপনার পছন্দের।
ঈশানীর মৌনতা বড্ড বেশ সন্দেহজনক। কৃত্রিম আড়ষ্টতায় কপটতা সুস্পষ্ট, তবুও কফির কাপে ছোট্ট করে সিপ নিলো এরীশ। কফিটুকু গলাধঃকরণ করতে করতেই সন্দেহবাতিক বাক্য ছুড়লো ঈশানীর পানে,
— বি’ষ টিশ মেশাও নি তো আবার?
এরীশের কথায় তরাগ করে চোখ তুললো ঈশানী। ভেতরের আক্রোশ ভেতরেই ধামাচাপা দিয়ে শুষ্ক একটা ঢোক গিলে কাটকাট আওয়াজে বললো,
— তাহলে আমার আর আপনার পার্থক্যটা রইলো কোথায় তাহলে?
ঠান্ডা মাথায় সুক্ষ্ম অপমান। যদিও তার বিপরীতে জিভের ডগায় গাল ঠেলে ঠোঁট বাঁকিয়ে ক্রুর হাসলো এরীশ। অতঃপর দ্বিতীয়বারের মতো চুমুক দিলো কফিতে । ওর ভাবভঙ্গিমা দেখে মনে হচ্ছে যদি এটাতে বি’ষ থেকেও থাকে তবুও নির্দ্বিধায় এটা পান করতে চায় ও। কথায় বলে বি’ষে বি’ষক্ষয় হয়। সেখানে এরীশ তো আস্ত একটা বি’ষের দুনিয়া, তাইতো মেয়েটার হাতের বি’ষটুকুও আজকাল নিজের অজান্তেই অমৃতসুধা ভেবে নির্বিগ্নে গ্রহন করে মাফিয়া বস।
তবে মায়াবী নীলাম্বরীর স্বভাবে আজ হুট করেই জাগ্রত হয়েছে ভিন্ন এক সত্তা। মেয়েটা এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সেখানে , ক্ষণে ক্ষণে চোরা চোখে পরখ করছে এরীশকে।
এদিকে কফিতে পর পর দু’টো চুমুক দিতে না দিতেই অকস্মাৎ মাথাটা ভনভন করে চক্কর দিয়ে উঠলো এরীশের। হঠাৎ এই অস্বাভাবিকতায় একাধারে কয়েকবার অক্ষিপল ছেড়ে ঈশানীর দিকে নজর ঘোরালো এরীশ। চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ফিনফিনে সফেদ গাউন পরিহিত মেয়েটাকে কেমন ঘোলাটে লাগছে, ওর টলমলে ভয়ার্ত নীল চোখ, মায়ামায়া শঙ্কিত মুখ সবকিছুই মরীচিকার মতো ঝাপসা হয়ে আসছে ক্রমশ। চোখের পাতা ভার হয়ে এসেছে অযাচিত ম’রণ ঘুমের তোরণে। সচল মস্তিষ্কটা পুরোপুরি কর্মক্ষম হয়নি এখনো, তাও চোখদুটো মেলে রাখা যুদ্ধ জয়ের সমানুপাতিক।
এতোক্ষণ ধরে অফিস কক্ষে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চুপচাপ এরীশের নিস্তেজতা পরখ করেছে ঈশানী, যেই মূহুর্তে মনে হয়েছে ওর মাঝের হিং’স্র মানবসত্তাটা পুরোপরি নিশ্চল অসার হয়ে গিয়েছে,ঠিক সেই মূহুর্তে শরীর থেকে একটানে এ্যাপ্রোনটা খুলে, সেখানেই ছুড়ে ফেলে দিয়ে দরজা ঠেলে ছুট লাগায় ঈশানী।
আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ১৯ (২)
বাইরে গার্ড’সরা পাহারায় নেই আজ, সেই সুযোগে পালানোর পায়তারা করেছে ঈশু। এতোক্ষণে মেয়েটার সমস্ত সুক্ষ্ম পরিকল্পনা নিখুঁত ভাবে ধরে ফেলছে এরীশ। কিন্তু শরীর নাড়িয়ে ওঠার মতো শক্তি ওর মাঝে অবশিষ্ট নেই এই মূহুর্তে। মস্তিষ্কটাও হয়তো খানিকবাদে অচল হয়ে যাবে পুরোপুরি। হাই ডোজের ঘুমের ওষুধ পরেছে শরীরে, ঠিক কতক্ষণ এর কার্জকারিতা স্থায়ী হবে মাথা খাটিয়ে ভাবতে পারলো না ও। অগত্যা তন্দ্রাচ্ছন্ন আধবোজা চোখ দু’টোকে অগাধ জোর খাটিয়ে খানিকক্ষণ খুলে রেখে টেবিলে রাখা ফোন হাতরে, কোনোমতে আঙুল নাড়িয়ে কাউকে ম্যাসেজ করে এরীশ ,
— জাস্ট প্রটেক্ট হার।