আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২০ (২)

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২০ (২)
suraiya rafa

কোথাও কোনো গার্ড’সদের উপস্থিতি নেই, আর না আছে এরীশের পোষা হিং’স্র মাংসা’শী প্রাণী বোজোর। এরীশ যেহেতু অফিস কক্ষে টালমাটাল, সেহেতু বোজোকে ডেকে বের করে আনার মতো দুঃসাধ্য নেই আর কারোর ।
চারিদিকের নিস্তব্ধতা অবলোকন করতে করতে একেবারে শূন্য মস্তিষ্কে এই প্রথমবার পেন্ট হাউজ ছেড়ে বেড়িয়ে এলো ঈশানী। নিচে এসে এলিভেটর থেকে বেড়িয়ে সোজা ছুটে গেলো মাথা সমান পোক্ত প্রাচীর বেষ্টিত গেটের সম্মুখে। আজ আর উদভ্রান্ত নয় বরং ঠান্ডা মাথায় ভেবে বের করতে লাগলো ঠিক কোন দিকে গেলে রাস্তা পাবে ও।

আজ বিকেলের ফ্লাইটে মাত্র রাশিয়ায় ল্যান্ড করেছে তুষার। এরপর মাইল ত্রিশেক বরফ আবৃত পিচ্ছিল রাস্তা পারি দিয়ে পেন্ট হাউজে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা রাত। আজই ফেরার কথা ছিল না তুষারের,কিন্তু Bratva এর অনুষ্ঠিত মাফিয়া প্রোগ্রামে থাকাটা আবশ্যক। তবে পেন্টহাউজে প্রবেশের আগেই এরীশের পাঠানো খুদে বার্তায় চক্ষু সচকিত হয়ে ওঠে ওর।
— জাস্ট প্রটেক্ট হার।
কাকে প্রটেক্ট করার কথা বলছে এরীশ? কার প্রটেকশন নিয়েই বা এতোটা মাথা ব্যথা মাফিয়া বসের? ব্যাকসিটে গা এলিয়ে দিয়ে তুষার ভাবলো কিয়ৎক্ষন। পরমূহুর্তেই ওর অজ্ঞাত ভাবনার ইতি টেনে দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে ঈশানীর ভয়ার্ত মুখমণ্ডল। ঈশানীকে দেখা মাত্রই চট করে মাথা তুলে কিঞ্চিৎ ঝুঁকে সামনের দিকে গভীর দৃষ্টিপাত করলো তুষার।
ওদিকে গেট ছাড়িয়ে বের হতে না হতেই ঈশানীর পথ আটকে দেয় একটা কালো রঙা রোলস রয়েস। গাড়ির ইঞ্জিন ছিল পুরোপুরি বন্ধ, অগত্যা গাড়ির মধ্যে কে আছে না আছে সে-সব লক্ষ্য না করেই পায়ের কাছে পরে থাকা একটা পাথরের ন্যায় বরফ খণ্ড দিয়ে ক্রমাগত আ’ঘাত করতে করতে গাড়ির ফ্রন্ট গ্লাসটা ভাঙতে শুরু করে ঈশানী ।
তাও কয়েক মূহুর্ত ধরে চুপচাপ ঈশানীর অনিয়ন্ত্রিত কর্মকান্ডগুলো আশ্চর্য হয়ে দেখছিল তুষার। আঁচ করার চেষ্টা করছিল ওর পরবর্তী পদক্ষেপ। গাড়ির কাচটা যখন পুরোপুরি চূর্নবিচূর্ণ ঠিক সেই মূহুর্তে হাতে থাকা বরফের খন্ডাংশটি ছুড়ে ফেলে, তুষারকে একপ্রকার হতবিহ্বল বানিয়ে দিয়ে হঠাৎ করে জঙ্গলের উল্টো পথে ছুট লাগায় ঈশানী। এবার আর ভুল পথে নয়, সঠিক পথ ধরেই ছুটছে মেয়েটা। এরীশ কি তাহলে ঈশানীকেই প্রটেক্ট করার কথা বলেছিল একটু আগে?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— ওহ শীট!
নিজের মূর্খতায় বিরক্ত হয়ে সশব্দে গাড়ির স্টিয়ারিং এর উপর পাঞ্চ বসালো তুষার। ধীরে ধীরে অন্ধকারের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা, এদিকে গাড়ির বেহাল দশা। এক্ষুনি ওকে না আটকালে আজ রাতে যা কিছু হয়ে যেতে পারে। সেই ভেবে তাড়াহুড়ো করে আধভাঙ্গা গাড়িটাকে নিয়েই উল্টো রাস্তা ধরে অপ্রতিরোধ্য গতিতে ছুটে যায় তুষার।

ল্যামপোস্টের নিয়ন রোশনাই এ আলোকিত চারিপাশ। সুক্ষ্ম আলোক রশ্মি অনুসরণ করে অবশেষে জঙ্গল ছাড়িয়ে হাইওয়ে রাস্তায় এসে পৌঁছেছে ঈশানী। হিমালয়ের ন্যায় তুষার আবৃত নামহীন পর্বতমালার ফাঁক ফোকর গলিয়ে এগিয়ে গিয়েছে রাস্তাটা। শুনশান নিস্তব্ধ রাতে আঁকাবাকা রাস্তাটাকে মৃ’ত অজগরের মতোই ভয়াতুর ঠেকছে নীলাম্বরীর দু’চোখে। তবে ভয়াতুর এই রাস্তার চাইতেও হাজার গুন শঙ্কায় চুপসে আছে ঈশানী। এরীশ ইউভানের গোলোক ধাঁধা থেকে মুক্তি পাওয়া মুখের কথা নয়, যখন তখন বদলে যেতে পারে দৃশ্যপট, সেই ভয়ে তটস্থ মেয়েটা। কুণ্ঠিত দৃষ্টি ফেলে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে শুষ্ক ঢোক গিললো আলগোছে। অতঃপর গলায় প্যাঁচানো ওড়নার সাহায্যে খানিকটা মুখ ঢেকে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো রাস্তার ধারে।

রাস্তাটা নির্জন। মিনিটের মাথায় না হলেও কিছুক্ষণ পর পর দেখা মেলে দু’একটা মালামাল বোঝাইকৃত কার্বাড ভ্যান আর লরির। অচেনা দেশে এসবে উঠতে সাহস পায়না ঈশানী, সহসা চাতকিনীর ন্যায় নিস্প্রভ দৃষ্টি ফেলে চেয়ে থাকে রাস্তার অদূরে। ভাগ্যের জোরে যদি কোনো বিশ্বাস যোগ্য গাড়ি মিলে যায়, তবেই এ যাত্রায় মুক্তি ওর।
কিন্তু ঈশানীর ভাবনাকে আচানক নস্যাৎ করে দিয়ে জঙ্গলের এবড়ো খেবড়ো রাস্তার মাঝ থেকে হাওয়ার বেগে বেড়িয়ে আসে তুষারের ভঙ্গুর জরাজীর্ণ গাড়িটা। গাড়িটাকে দেখা মাত্রই চিনে ফেললো ঈশানী। কারণ একটু আগেই নিজ হাতে গাড়ির এই হাল করেছে ও। পেন্টহাউজ থেকে এতদূর পালিয়ে এসে আবারও সেই ভাঙাচোরা গাড়িটার সম্মুখীন হতে না হতেই কলিজার পানি শুকিয়ে ম’রা কাঠে পরিনত হলো অন্তঃকরণ । ঈশানী ভয়াতুর ঢোক গিললো, অতঃপর গাড়ির মধ্যে উপস্থিত মানবের দৃষ্টি এড়াতে রাস্তার উল্টো দিকে হাঁটা ধরলো জোর কদমে । গাড়ি সমেত ওর পিছু নিয়েছে তুষার, ওদিকে চোখমুখ খিঁচে ঈশানীও হাঁটছে সবেগে।
এভাবে রাস্তা ধরে এগুতে এগুতে এক পর্যায়ে আগন্তুক এক ট্যাক্সির দেখা পেলো ঈশানী। হাত নাড়িয়ে সেটাকে ইশারা করতেই থেমে গেলো ট্যাক্সিটা। ট্যাক্সির দিকে পা বাড়িয়ে পেছনে এক পল শঙ্কিত দৃষ্টি ফেললো মেয়েটা, দেখলো তুষারের গাড়িটা এদিকেই ছুটে আসছে হাওয়ার বেগে।

ওকে দেখেছে কি দেখেনি সেটুকু ভাবনার ফুরসত নেই আপাতত, বরফ ঠান্ডা আবহাওয়ার মাঝেও তিরতিরিয়ে ঘামছে নাকের ডগা। হাতে খুব বেশি সময় অবশিষ্ট নেই আর, সেই ভেবে অযাচিত ভয়ে মুখমণ্ডল নীল হয়ে এলো ওর। উদ্বেগে ঠকঠক করে কাপছে সমস্ত শরীর। তবুও কোনোমনে টেনেটুনে দূর্বল শরীরটাকে নিয়ে সামনে পা বাড়ালো ঈশানী, কিঞ্চিৎ ঘাড় নামিয়ে তড়িঘড়ি করে দু’হাতে কড়া নাড়লো ট্যাক্সির টিন্ডেট জানালায়।
জানালায় টোকা পরার সঙ্গে সঙ্গে কাচ নামালো ড্রাইভার মতো লোকটা। দেখতে শুনতে ভদ্রলোক,চোখের মাঝে নিদারুণ বিস্ময় তার, যদিও কৌতুহল টুকু ধরা দিলোনা ঈশানীর কাছে। চেহারার আদল অত্যন্ত স্বাভাবিক রেখেই রুশ ভাষায় কিছু একটা জিজ্ঞেস করলো সামনে দাঁড়ানো হাঁপানি রোগীর মতো অস্থির চিত্তের মেয়েটাকে। লোকটার কথা বুঝে এলোনা ঈশানীর, উল্টো তার কথার মাঝপথেই মুখমণ্ডলে রাজ্যের আড়ষ্টতা টেনে উতলা হয়ে ওঠে ভীত সন্ত্রস্ত মেয়েটা। কম্পিত স্বরে অনর্গল বলতে শুরু করে,

— হেল্প, প্লিজ হেল্প মি।প্লিজ….
ঈশানীর বলতে দেরী, লোকটা এক মূহুর্তও ভাবলো না আর। চট করেই আনলক করে দিলো গাড়ির দরজা, আরও একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে ফেলে আসা তুষারের গাড়ির পানে শঙ্কিত দৃষ্টিপাত করে তড়িঘড়ি পায়ে গাড়িতে উঠে বসলো ঈশানী। ওর অনুমতির অপেক্ষা না করেই পুনরায় চলতে শুরু করে গাড়িটা। গাড়ি চলছে কি চলছে না সেদিকে হুশ নেই ঈশুর, ও এখনো ঘাড় ফিরিয়ে ব্যগ্র চোখে তুষারের গাড়িটাকে পরখ করায় ব্যস্ত। যেটা এতোক্ষণ ধরে ওকে অনুসরণ করলেও কিয়ৎক্ষনের মাঝে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে তমশাচ্ছন্ন নিস্তব্ধ রাতের আড়ালে।
ভয়ের চোটে হাঁপড়ের মতো ওঠানামা করছে ওর দূর্বল বক্ষপিঞ্জর।চোখমুখের অবস্থা বিমূর্ষ। ড্রাইভার মতো লোকটা লুকিং গ্লাসের সাহায্যে দু’একবার চোখ বুলিয়েছে ঈশুর পানে, তবে মুখ ফুটে একবারও জিজ্ঞেস করেনি ওর গন্তব্য।
এদিকে তুষারের গাড়িটা হারিয়ে যাওয়ার পরপরই ব্যাকসিটে গা এলিয়ে দিয়ে স্বস্তিতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ঈশানী। এতোক্ষণে বোধ হয় বেরিয়ে আসা রুহুটা আবারও অন্তরালে গিয়ে মিশেছে ওর। অহেতুক ক্রন্দনের জোয়ারে ঝাপসা চোখের মনি,মনে হচ্ছে এইতো কিছুক্ষণ আগেই সুন্দর পৃথিবীতে ফের পুনঃ জন্ম নিলো ও।

ঈশানী যখন স্বস্তিতে শিথিল, নিশ্চিন্ত ওর এলোমেলো মস্তিষ্ক। ঠিক তখনই চারিপাশের পরিস্থিতি লক্ষ্য করে সম্বিত ফিরে পায় ও। কাচের জানালা ভেদ করে বাইরে নজর দিতেই ঈশু দেখলো এক জায়গাতেই স্থির হয়ে আছে চারিপাশ। তারমানে গাড়িটা চলছে না আর । জায়গাটা অচেনা,যার দরুন খুব ভালোভাবে খেয়াল করেও কিছুই ঠাওর করতে পারলো না ঈশানী। গাড়িটা হঠাৎ রাস্তার মাঝে থামিয়ে রাখার কারণ কি? ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হলোনা সরল মেয়েটার, অগত্যা ফের দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পরে ওর উচাটন হৃদয়। উপায়ন্তর না পেয়ে মনেমনে কিছু ইংরেজি বাক্য সাজিয়ে প্রশ্ন করার জন্য উদ্যত হয় ড্রাইভারকে।
প্রথমে কিছুটা ইতস্তত বোধ করলেও পরক্ষণে কিঞ্চিৎ জড়তা নিয়ে গলা উঁচিয়ে ড্রাইভারটাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন ছুড়বে,তার আগেই ওর কর্ণগহ্বর ছাপিয়ে মস্তিষ্কে হামলে পরে ড্রাইভারের ফিসফিসিয়ে বলা রাশিয়ান কিছু কথার লাইন । যদিও রাশিয়ান কথার মানে খুব ভালো বোধগম্য নয় ঈশানীর, তবে ফ্লোরার সঙ্গে থেকে থেকে যতটুকু শিখেছে, তাতে লোকটা কথার ভাবার্থ এই দাঁড়ায় যে,

— একটা ফরেইনার মেয়ে পেয়েছি। সকালের মধ্যেই ক্লাবে নিয়ে আসবো। রাতের আয়োজনে আপনি নিরাশ হবেন না আশা করি। কিন্তু এবারে পেমেন্টটা দিগুণ করতে হবে।
এতোটুকুতেই যা বোঝার বুঝলো ঈশানী, এর পরের কথাগুলো অজ্ঞাত, কিইবা হতে পারে আর, হয়তোবা ওর দরদাম নিয়ে তর্কবিতর্ক। তবে এইটুকু কথা শুনেই মুখ থেকে র’ক্ত সরে গেলো ঈশুর, মাত্রাতিরিক্ত আত্নবিশ্বাসী মেয়েটা এতোক্ষণে বুঝতে পেরেছে পেন্টহাউজ থেকে বেড়িয়ে ও আসলে কত বড় বোকামি করে ফেলেছে। পাপের আড়ালে সুরক্ষিত থাকা, আর সরাসরি পাপের সম্মুখীন হওয়া দু’টোর ফারাক যে কতোটা বেশি তা ইতিমধ্যে বোধগম্য হয়েছে ওর। ঘাবড়ানো মস্তিকটা বারংবার চক্কর দিয়ে উঠছে যেন। এমন একটা পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে নিজেকে সস্তা আবর্জনা বৈকি কিছুই লাগছে না আর।
লোকটার কথা শুনে আতঙ্কে ঘাম ছুটে গেলো ঈশানীর। মূহুর্তেই সাহসীকতার মেকি দেওয়াল ভেঙে চূর্ণবিচূর্ন হয়ে অসার হয়ে এলো শরীরটা। কণ্ঠনালীতে ভীষণ বাঁধা, মনে হচ্ছে দানবীয় এক অজানা শক্তিবল কণ্ঠরোধ করেছে ওর।
তারপরেও শরীরের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তপ্তশ্বাস ছেড়ে চ্যাঁচিয়ে ওঠে ঈশানী,

— কোথাও যাবো না, নামিয়ে দিন আমাকে। অসভ্য, বদমাশ লোক আমি নামবো। এক্ষুণি নামবো।
ঈশানীর চিৎকারে হকচকালো লোকটা। ব্যতিগ্রস্থ হয়ে পেছনে ঘুরে শক্ত হাতে মুখ চেপে ধরলো ওর। তবুও দমলো না ঈশানী,শরীরের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে দালাল লোকটাকে প্রতিহত করার চেষ্টায় মত্ত হলো ফের। গলা উঁচিয়ে চ্যাঁচাতে চাইলো সবেগে , কিন্তু বলিষ্ঠ হাতের চাপে মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হলোনা আর। কিছুক্ষনের ধস্তাধস্তিতে বড্ড ক্লান্ত ঈশানী, তবুও হাল ছাড়েনি ও, যেভাবে পেরেছে আ’ঘাত করেছে লোকটাকে। একপর্যায়ে ঈশানীর তেজ আর জিদকে পুরোপুরি দমিয়ে দিতে ওর ঘাড়ের মাঝে ইনজেকশন পুশ করলো লোকটা। অকস্মাৎ ব্যথায় মৃদু আর্তনাদ করে কুঁকড়ে গেলো ঈশানী। পরমূহুর্তেই দুনিয়ার সকল হুশ হারিয়ে ওর শীর্ণকায় নরম শরীরটা আস্তে করে ঢলে পড়লো গাড়ির ব্যাকসিটে।

সকালের উদিত সূর্যের নরম আলোক শিখাটুকু মুখমণ্ডলে আঁচড়ে পরতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে ঈশানী। মাথাটা ঝিমঝিম করছে এখনো,আধো আধো ঝাপসা চোখে চারিদিক অবলোকন করে বুঝলো ও এখনো গাড়িতেই আছে। বাইরের ঝুরঝুরে নিয়ন সূর্যকীরণ দেখে মনে হচ্ছে সকাল হয়েছে বহুক্ষণ। গাড়িটা চাকচিক্যে ঘেরা একটা বিলাশবহুল ক্লাবের সামনে দাঁড় করানো,যদিও দিবালোকের ফলে বাইরের রঙিন আলো গুলো সব নেভানো, তবে ভেতর থেকে ভেসে আসা পাশ্চাত্য মিউজিকের উদ্ভট আওয়াজ আর বিদেশি ম’দের ঝাঁঝালো গন্ধই বলে দেয় এটা অস্বাভাবিক আর নোংরা চিত্তের মানুষ গুলোর উল্লাস করার আস্তানা।

কিয়ৎক্ষণ কৌতুহলী নজরে চারিদিকে চোখ বোলালো ঈশানী। এরমধ্যেই কালকের সেই ড্রাইভার নাম ধারী দালালটা এগিয়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে অকস্মাৎ হাত চেপে ধরে ওর। লোকটার কর্মকান্ডে শঙ্কিত হয়ে পিছিয়ে গেলো ঈশানী,চোখমুখ খিঁচে গুটিয়ে রইলো ব্যাকসিটের এককোণে। ঈশানীর এহেন আতঙ্কিত বিমূর্ষ চেহারা ভাবালো না লোকটাকে। উল্টো সামান্য আবর্জনার মতোই শক্ত হাতে টেনে হিঁচড়ে মেয়েটাকে বের করে আনলো গাড়ি থেকে। লোকটার হাতের মুঠোয় ওর কব্জিটা বন্দি, ভয়ের তোড়ে রূগ্ন মানবীর ন্যায় ঠকঠক করে কাপছে ঈশানী।মাত্রাতিরিক্ত কুণ্ঠায় গলার স্বর ক্ষীণ, কেবল চোখ দিয়ে গড়িয়ে পরছে অনর্গল অশ্রুস্রোত।
এদিকটায় তুষারপাত হচ্ছে না, তবে রাস্তাঘাট ভীষণ পিচ্ছিল, সেই পিচ্ছিল রাস্তা ধরেই টানতে টানতে ক্লাবের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হলো ওকে। দরজার সঙ্গে লাগোয়া করিডোরটা অন্ধকারে ঠাঁসা, সেখান থেকে এগিয়ে যেতেই যেতেই কন্ঠনালী ভেদ করে বেড়িয়ে আসে ঈশানীর রিনরিনে ব্যথাতুর কণ্ঠস্বর,

— আমি ওই নোংরা জায়গাটাকে ঘৃণা করি, প্রচন্ড ঘৃণা। আমি ওখানে যেতে চাইনা দয়াকরে ছেড়ে দাও আমায়।
লোকটার সঙ্গে জোরজবরদস্তি অব্যাহত রেখেই অনর্গল ফোপাঁচ্ছিল ঈশানী। একপর্যায়ে টেনে হিঁচড়ে ওকে প্রবেশ করানো হয় ক্লাবের লাউঞ্জে। এতোক্ষণে আলোর দেখা মিললো অক্ষিপটে। বৈদ্যুতিক বাল্বের স্পষ্ট আলোয় কান্নাকাটি দমিয়ে একঝলক সামনে দৃষ্টিপাত করে ঈশানী। দিনের বেলা হওয়াতে ক্লাবটা ফাঁকা পরে আছে। আধ্যাত্মিক রকমের সৌন্দর্যে বেষ্টিত চারিদিক,দেখেই বোঝা যাচ্ছে এখানে সাধারণ লোকের পা পরেনি কোনো কালেই। বিশ্বের নামি-দামি সব আন্ডারওয়ার্ল্ড গ্যাংস্টারদের মিলনায়তন হতে পারে। তবে এই মূহুর্তে ক্লাবের সকল সৌন্দর্য ছাপিয়ে ঈশুর চোখ গিয়ে আটকালো অন্য কোথাও। ওর খুব কাছে, একেবারে মুখ বরাবর দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা লোক। পরনে তার ব্ল্যাক মাস্ক আর ব্ল্যাক হুডি। তার ধূসরবাদামী নিগূঢ় নেত্রদ্বয় ঈশানীর ফোলা ফোলা আহত চোখে নিবদ্ধ। যেন বহুদিন ধরে এই নীল চোখ জোড়ার সাক্ষাৎ পায়নি সে। তেমনই নিস্প্রভ শূন্য তার চাউনী। দু’চোখে আবেগ নেই আর না আছে অনুভূতির লেশ। তবুও কিছু তো একটা জমে আছে ওই নিষ্পল অক্ষিগহ্বরে।
অন্যকেউ না চিনলেও, এই পিয়ার্সিং করানো শূন্য নির্জীব চোখ দু’টো কখনোই ভুলতে পারবে না ঈশানী। ও নিশ্চিত এটাই এরীশ। যদিও ওর মনোবল ঠুনকো, বারবার ভেঙে যায় আত্নবিশ্বাস। তবুও এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে সবচেয়ে অপছন্দের নিষ্ঠুরতম লোকটার কাছে সাহায্য চাইতে একবিন্দুও দ্বিধাবোধ করলো না ঈশানী। দালালটার হাতের মধ্যে থেকেই ক্রন্দনরত গলা উঁচিয়ে হুডি পরিহিত লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

— আপনি এরীশ তাইনা? দয়া করে রক্ষা করুন। ওরা আমাকে নোংরা জায়গায় পাঠিয়ে দিবে। আপনিতো চাইলে সব পারেন, আমাকে একটু সাহায্য করুন। আমি আর কোনোদিন পালাবো না,মিনতি করছি, এবারের মতো বাঁচান আমাকে।
ঈশানীর এহেন চিত্ত বিদারক কাকুতি মিনতির পরেও কোনোরূপ ভাবান্তর দেখা গেলোনা লোকটার মাঝে। সে এখনো দু’পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঘাড়টা সামান্য করে দাঁড়িয়ে আছে নির্লিপ্তে। অনুভূতিহীন শূন্য চোখজোড়া আটকে আছে কান্নারত ঈশানীর শ্রান্ত ফ্যাকাসে মুখশ্রীতে। লোকটার মাঝে কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া না দেখে সন্দিহান ঈশানী,কান্নার জোয়ারে ফুঁপিয়ে উঠে ফের প্রশ্ন ছুড়লো ওকে,

— আপনি এরীশ তো?
কোনোরূপ জবাব এলোনা অপরপক্ষ থেকে।
দালাল লোকটাও আর ফুরসত দিলোনা ঈশানীকে। জোরজবরদস্তি করে টেনেটুনে নিয়ে গেলো ক্লাবের পেছনের কামরায়। পেছনের কামরা গুলোতে দেশি বিদেশি সুন্দরী রমনীদের অভাব নেই। তাদের প্রত্যেকের পোশাক আশাক অত্যন্ত সুনিপুণ আর নান্দনিক। একেক জনের শরীর থেকে ভুরভুর করে নির্গত হচ্ছে দামী পারফিউমের স্নিগ্ধ সুবাস। অথচ এতো চাকচিক্য আর আকর্ষনীয় পোশাক আশাকের মাঝে ঈশানী দাঁড়িয়ে আছে একটা ময়লা ছেড়া গাউন পরে, যেটা কিনা ওর সরু কাঁধ ছাড়িয়ে নিচে ঢলে পড়ছে বারবার। সবাই তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে ওর মুখের দিকে, যা দেখে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নুয়িয়ে ফেললো ঈশানী। ফুঁপিয়ে কান্নার তোড়ে এখনো কম্পিত হয়ে উঠছে ওর দূর্বল শরীরটা। দালাল লোকটা আঙুলের ঈশারায় ওদের মাঝের একজনকে ডেকে পাঠিয়ে বললো,

— মেয়েটাকে রেডি করাও, সন্ধ্যায় নিলামে উঠবে ও।
রুশ কথার আগামাথা কিছুই বুঝলো না ঈশানী, অগত্যা তাকিয়ে রইলো ফ্যালফ্যাল করে।
লোকটার নির্দেশে এগিয়ে এসে ওর বাহু চেপে ধরে স্লাট টা। আকস্মিক ঘটনায় ভড়কালো ঈশানী, চ্যাঁচিয়ে উঠে বললো,
— যাবো না আমি কোথাও।
তৎক্ষনাৎ চোখ রাঙালো মেয়েটা,তেজি কন্ঠে ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো,
— যাবি না মানে?
বিস্ময়ে হতবিহ্বল ঈশানী, এই মেয়েটা বাংলা জানে। অবশ্য জানারই কথা এখানে সব স্লাটদের টীম লিডার ও।
তথাপি ভাবনার গহ্বরে পৌঁছানোর ফুরসত পেলোনা মেয়েটা।তার আগেই নতুন উদ্যমে শুরু হলো টানা হে্ঁচড়া। মেয়ে স্লাট টার আদেশে আরও একজন এগিয়ে এসে আঁকড়ে ধরলো ওর অন্য বাহুটা। অতঃপর স্থির কন্ঠে বললো,
— ওকে মেকআপ রুমে নিয়ে যাও।
জোরজবরদস্তিতে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে লেপ্টে আছে সমগ্র মুখে। চ্যাঁচামেচিতে কক্ষ থেকে বেড়িয়ে হলরুমে জড়ো হয়েছে সকলে। হাইহিল পরিহিত মেয়েগুলোর টানাহেঁচড়ায় বিধ্বস্ত ঈশানী,যেন রাস্তা থেকে তুলে আনা উদভ্রান্ত এক রুগ্ন মানবী। অবশেষে ভাগ্যের কাছে হার মেনে বৃথা চেষ্টার ইতি টানলো সরল মেয়েটা। এতোগুলা মানুষের সঙ্গে না পেরে সহসা ঢুকে গেলো মেকআপ রুমে।

সন্ধ্যা হতে না হতেই লাল নীল গ্লীটারি আলোয় জ্বলে উঠেছে সমগ্র মাফিয়া ক্লাব। ল্যানটার্নের মৃদু হলদে রোশনাই এ চোখ ধরে আসার উপক্রম। চারিদিকে ম ম করছে রেড ওয়াইন আর সুস্বাদু স্ন্যাক্সের ঝাঁঝালো সুঘ্রাণ। ফ্রন্ট গেইটের সামনে বিস্তৃত লাল গালিচা পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে একের পর এক নামি-দামি গাড়ির বহর। গাড়ি গুলোকে সাদরে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে একঝাঁক সুন্দরী রুশ তরুণী। তাদের আবেদনময়ী পোশাক আর দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিমা যে কোনো মাফিয়ার মনে কামনার ঢেউ তুলে দিতে সক্ষম।
কুশল বিনিময়ের একটু পরেই শুরু হবে নিলাম। নিলামে মূলত সব আকর্ষনীয় আর দামী বস্তুগুলোকে সাজিয়ে গুছিয়ে প্রদর্শন করা হয় সকল মাফিয়াদের সম্মুখে । তারা সেগুলোকে জহুরি চোখে পরখ করে দাম নির্বাচন করেন। অতঃপর যে সবচেয়ে ভালো দাম দিতে পারে তার নিকট হস্তগত করা হয় ওই দামী বস্তুটি।

দেশি-বিদেশি আন্ডারগ্রাউন্ড সহিংস মাফিয়াদের আসর জমেছে পর্দার ওপাশে। সবাই তারা আলাদা আলাদা গ্যাং লিডার হওয়া সত্ত্বেও রাশিয়া তাদের গন্তব্যস্থল। তাইতো বছরে একবার হলেও bratva এর আয়োজিত প্রোগ্রামে উপস্থিত হয় সকলে। নিলামও শুরু হয়ে গিয়েছে বেশকিছুক্ষণ আগেই।
এতোক্ষণে মেকআপ রুম থেকে ঠেলেঠুলে বের করা হয়েছে ঈশানীকে। পরনে ব্যাকলেস টকটকে লাল গাউন।যার একপাশ হাটু অবধি দৃশ্যমান।পায়ে চার ইঞ্চি সমপরিমাণ ব্ল্যাক স্টিলেটো। সরু তুলতুলে কব্জি আর গলায় শোভা পেয়েছে হীরে খচিত চমৎকার শ্বেত পাথরের নেকলেস। স্মোকি আইস্যাডোর সঙ্গে ম্যাচিং করে ঠোঁট রাঙানো হয়েছে গাঢ় ম্যাট লিপস্টিকের আস্তরে। সবকিছু পরিপাটি, কোথাও কোনো খামতিটুকু অবশিষ্ট নেই। তবুও মেয়েটার সমগ্র মুখমণ্ডলে ছেঁয়ে আছে রাজ্যের আধার। ঈষৎ কালো মেঘে ঢেকে যাওয়া আকাশের মতোই ফিকে লাগছে ওর নজরকাড়া সৌন্দর্য। নীল চোখ দু’টোতে অসহায়ত্বের নিদারুণ ছাপ।
ঈশানী চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল বলে আবারও সেই স্লাট টা এসে ধমকাতে শুরু করে ওকে,

— এখনো এখানে দাঁড়িয়ে কি দেখছো? তোমাকে ডাকা হচ্ছে কানে শুনতে পাওনা?
— আমি যাবো না, দয়া করুন। আমি সত্যিই এমন মেয়ে নই।
ঈশানীর কান্নাকাটিতে বিন্দু পরিমাণ তোয়াক্কা না করেই মেয়েটা তেঁতো কণ্ঠে বলে উঠলো,
— শুরুতে কেউই এমন থাকেনা। এটা একটা স্বর্গের মতো জায়গা, ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে যাবে।
— ছিহ!
ঘৃণায় চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো ঈশানী। ওর এহেন অতিব সরলতায় বিরক্ত হয় মেয়েটা। চোখেমুখে ক্ষুব্ধতা জড়ো হয় মূহুর্তেই। তৎক্ষনাৎ হাত ধরে টানতে টানতে এগিয়ে যায় ক্লাবের দিকে। যাওয়ার সময় পথিমধ্যে পুনরায় থমকালো ঈশানী। আবারও সেই হুডি আর মাস্ক পরিহিত লোকটা। এখনো ওর দিকে শূন্য চোখে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে । লোকটাকে দেখা মাত্র নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না ঈশানী। এক ঝটকায় মেয়েটার হাত ছাড়িয়ে ছুটে গেলো লোকটার কাছে, বেঘোরে দু’হাত দিয়ে তার হুডিটা খামচে ধরে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠলো আচমকা। কাঁদতে কাঁদতেই উদভ্রান্তের মতো বলতে আরম্ভ করলো,

— অরণ্য আমাকে বাঁচান। আমাকে ওরা নোংরা জায়গায় পাঠিয়ে দিতে চাইছে, দয়া করে ওদের বাঁধা দিন। আর কোনোদিন পেন্টহাউজ থেকে পালাবো না আমি। একটাবার চিন্তাও করবো না পালানোর কথা। তাও দয়া করুন। ওখানে যেতে দেবেন না আমায়। বিশ্বাস করুন আমি পবিত্র, ওই জায়গাটাকে আমি ঘৃণা করি। কিছুক্ষণ পরেই সব শেষ হয়ে যাবে আমার। একটু দয়া করুন, এতোটা নিষ্ঠুর হবেন না, এতো বড় পাপ হতে দেবেন না। কিছুতো বলুন, অরণ্যওও।
শরীরের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে দু’হাতে সৌবিষ্ঠ লোকটাকে ঝাঁকিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে ঈশানী। অথচ বরাবরের মতোই নিশ্চুপ সে।ভাবলেশহীন নির্জীব চোখ দু’টোতে না আছে কোনো আবেগ আর না তো করুনা।
ওর কাহিনীতে বিরক্তির চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো স্লাট টা। রাগে গজরাতে গজরাতে ওর রুগ্ন শরীরটাকে দু’হাতে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে পা বাড়ালো সামনের দিকে, এবারও পেছন ঘুরে ডেকে উঠলো ঈশানী,
— অরণ্য বাঁচান আমাকে, ওই পাপীষ্ঠ চোখ গুলোকে ঘৃণা করি আমি, ভীষণ ঘৃণা ।
টানা হেঁচড়ার এই পর্যায়ে অকস্মাৎ মেজাজ হারিয়ে ওর তুলতুলে গালে সপাটে চড় বসিয়ে দিলো মেয়েটা। অতঃপর এক ধাক্কায় তুলে দিলো স্টেজে।

স্টেজে উঠতে না উঠতেই ফোকাস লাইট গুলো একযোগে তাক করানো হলো ওর উপর । যার দরুন ক্লাবে উপস্থিত জোড়া জোড়া ভয়ংকর চোখ গুলো সব স্থির হলো ওর পানে। পাশেই একজন এ্যাংকর মতোন লোক দাঁড়িয়ে আছেন, ঈশানী আসতে না আসতেই সে ব্রিটিশ একসেন্টে সাবলীল গলায় গরগর করে বলতে শুরু করলো,
— সে এই ক্লাবের নতুন মুখ, কেউ কি তার দাম ধরতে চান?
সামনে বসা অনেকের মাঝ থেকে একজন প্রথমেই বলে উঠলো,
— ছাব্বিশ মিলিয়ন রুবল।
এখানে যে প্র’স্টিটিউড কেনাবেচা হয় তা আর বুঝতে বাকি নেই ঈশানীর। এই মূহুর্তে মস্তিষ্কটা পুরোপুরি ফাঁকা,পালাতে পালাতে ক্লান্ত মেয়েটা। অগত্যা এরকম একটা নোংরা জায়গায় দাঁড়িয়ে ভাগ্যের হাতে নিজেকে সমর্পণ করা ছাড়া আর কোনো উপায় অবশিষ্ট নেই ঈশানীর হাতে। তাইতো নিম্ন মস্তকে চোখদুটো খিঁচে বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ।

— থার্টি মিলিয়ন।
— থার্টি ওয়ান মিলিয়ন।
— থার্টি ফাইভ মিলিয়ন।
—ফোরটি মিলিয়ন।
এভাবেই মাফিয়াদের মাঝখানে তড়তড় করে দাম বাড়ছিল ঈশানীর। এমন একটা নোংরা জায়গায় দাঁড়িয়ে মানুষ হয়ে মানুষের কাছে নিজের দামাদামি শুনে গা ঘিনঘিন কর ওঠে ওর। অসহনীয় যাতনায় গর্জে ওঠে ভেতরের সুপ্ত আত্মসম্মানবোধ। বুজে রাখা চোখ দু’টো থেকে আপন গতিতে নেমে আসে অশ্রুজলের চিকন স্রোত। এরই মাঝে একজন মাফিয়া হুট করেই বলে ওঠে,
— ফিফটি মিলিয়ন রুবল।
এবারে অন্যসব মাফিয়ারা নিশ্চুপ। দামাদামি করার দুঃসাহস দেখালো না কেউ আর।সহসা জিতে যাওয়ার আনন্দে ঘাড় বাকিয়ে কপট হাসলো ডেনিয়েল। এ্যাংকর লোকটা, পুনরায় মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলতে আরম্ভ করে,
— ফিফটি মিলিয়ন ওয়ান, ফিফটি মিলিয়ন টু…
বাকি কথাটুকু জিহ্বায় আটকে গেলো লোকটার, যখন হুট করেই কেউ একজন ক্লাবে প্রবেশ করে উচ্চস্বরে বলে ওঠে,
— হান্ড্রেড মিলিয়ন রুবল।

সাধারন একটা স্লাটের জন্য এতো মোটা অঙ্কের প্রাইস শুনে হকচকালো ক্লাবে উপস্থিত সকলে।তাড়াহুড়ো করে একযোগে পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো এরীশ ইউভানকে। একশো মিলিয়ন শব্দটা যেন ভূমিকম্পের মতোই নাড়িয়ে দিলো পুরো মাফিয়া ক্লাব।ঈশানী নিজেও আশ্চর্য হয়ে চোখ খুলে ফেললো তৎক্ষনাৎ। আশেপাশে এক পল নজর বুলিয়ে , সামনে দৃষ্টিপাত করতেই দেখতে পেলো এরীশকে। একটু আগের মতো হুডি আর মাস্ক পরে নয়, বরং ব্ল্যাক ভেলভেট মানানসই স্যুটের সঙ্গে হোয়াইট গোল্ডের ঘড়ি হাতে চড়িয়ে পুরো মাফিয়া ভাইব নিয়ে প্রোগ্রামে হাজির হয়েছে সে। পেছনে দাঁড়িয়ে আছে তুষার। বরাবরের মতোই মুখভঙ্গিমা স্থির তার, সরল কপাল টানটান করে সেও পা বাড়ায় সবেগে।

আশেপাশের সকল মাফিয়াদের দৃষ্টি এখন এরীশের পানে নিবদ্ধ। ঈশানী নিজেও হতবিহ্বল নয়নে চেয়ে আছে মাফিয়া বসের দিকে। অথচ শুধু মাত্র ওই একজোড়া ধূসর বাদামি অনুভূতিহীন শূন্য এখনো মাদকের ন্যায় আটকে আছে নীলাম্বরীর দু’চোখে।
অবাকের মাত্রা ছাড়ালো পুরো আন্ডারওয়ার্ল্ড, সেসবে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করেই ধীরে ধীরে স্টেজের দিকে এগিয়ে এলো এরীশ। সামনে এসে মেয়েটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ওর আশ্চর্য চোখের সঙ্গে নিজের শূন্য চোখ দু’টোর মিলন ঘটালো বিনাবাক্যে । বরাবরের মতো’ই গভীর নীল চোখের মাঝে থমকে দাঁড়ালো মাফিয়া বসের পুরো দুনিয়া।
নির্দ্বিধায়, নির্লিপ্তে কয়েক মূহুর্ত সেভাবেই অতিবাহিত করে চোখের তৃষ্ণা মেটালো খানিক। অতঃপর হাস্কিস্বরে বলে উঠলো ,
— হ্যান্ড্রেড মিলিয়ন, ইয়েট আই ওয়ান্ট হার।

বিরস মুখে গাড়িতে বসে আছে ঈশানী। ভেতর ভেতর সুপ্ত এক প্রশান্তির পারদ ছোটাছুটি করলেও,অজ্ঞাত অস্বস্তিতে তেঁতো হয়ে আছে জিভের ডগা। একাধিক বার দুঃসাহস দেখিয়ে পালানোর চেষ্টা করেও সেই এরীশের মুখোমুখি হতে হয় বারবার। নিজের কর্মকান্ডে ভীষণ লজ্জিত ঈশানী। তবুও আজকের মতো বেঁচে যাওয়ার আনন্দে পুলকিত হৃদয়টা, মাফিয়া ক্লাবের বাইরে আসার পর থেকেই খুশির জোয়ারে কেঁদে ভাসাচ্ছে মেয়েটা,তুলতুলে নাকের ডগা র’ক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। সুশ্রী ফ্যাকাশে মুখটাতে এতোক্ষণে ধরা দিয়েছে সজীবতা।
ওদিকে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ক্লাব কতৃপক্ষের সঙ্গে আনুষাঙ্গিক কার্যকলাপ গুলো মিটিয়ে নিলো এরীশ। ক্লাব কতৃপক্ষ আজ আহ্লাদে গদোগদো, পারছে না এরীশকে মাথায় তুলে কুর্নিশ জানাতে। মাত্র একটা মেয়ের জন্যই একশো মিলিয়ন গুনেছে এরীশ ইউভান। সমীহ তো করতেই হবে।
কাজ শেষ করে গাড়ির দিকে পা বাড়িয়ে,কি ভেবে যেন পুনরায় ঘুরে দাঁড়ালো এরীশ। হাতের সাহায্যে আন্ডার কাট চুল গুলোতে ব্যাকব্রাশ করতে করতে চট করেই বলে উঠলো,

— ওয়ান সেকেন্ড, ডু মি অ্যানাদার ফেইবার।
দ্রুত কদমে ছুটে এলো ক্লাবের লোকটা,উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,
— আর কিভাবে সাহায্য করতে পারি আপনাকে স্যার?
প্রত্যুত্তরে এরীশ বললো,
— আমার আরও একটা মেয়ে চাই।
উচ্ছ্বাসে চিকচিক করে ওঠে লোকটার দু-চোখ, সে তাড়াহুড়ো করে বলে,
— অবশ্যই স্যার, কোন মেয়েটা লাগবে বলুন।
বিনাবাক্যে আঙুল উঁচিয়ে মেয়েটাকে দেখালো এরীশ। মেয়েটা এই ক্লাবের স্লাটদের লিডার, আজ সকাল থেকে যার তত্বাবধানেই ছিল ঈশানী।
ক্লাবের লোকটা ঘাড় বাকিয়ে তাকালো পেছনে, অতঃপর অবিশ্বাসের স্বরে বললো,

— এই মেয়েটা?
লম্বা পা ফেলে গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে জবাব দিলো এরীশ ,
— হ্যা এই মেয়েটাই। পেমেন্ট হয়ে গেলে তুষার নিয়ে যাবে ওকে।
ফের আগ বাড়িয়ে কথার বলার সাহস পেলোনা লোকটা। মাথানত করে এরীশের গাড়িটাকে কুর্নিশ জানিয়ে, ঠোঁট উল্টে মনেমনে বিড়বিড়ালো শুধু,
— এতো সুন্দরী সুন্দরী স্লাট থাকতে এই মেয়েটাই কেন? আশ্চর্য!

নির্জন হাইওয়ে রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে বিশাল চকচকে রোলস রয়েস।গাড়ির মধ্যেস্থানে পিনপতন নিরবতা বিরাজমান। এরীশ নিজেই ড্রাইভ করছে আজ, ওর পাশের সিটে মুখ কাঁচুমাচু করে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে ঈশানী। কান্নাকাটি থেমেছে বহু আগেই, তাও জ্বলজ্বলে চোখের কার্নিশে জমে আছে ব্যথাতুর লোনাজল। পুরো গাড়িতে দুজনার শ্বাস প্রশ্বাস ছাড়া কোনোরূপ আওয়াজ নেই আর।
রাতের আকাশে চাঁদের হদিস নেই, থেকে থেকে মেঘ গুরগুর করছে ঈশান কোণে। আজ বহুদিন বাদে হয়তো রাশিয়াতে বৃষ্টি হবে, অসময়ের বৃষ্টি। ঈশানীর বড্ড ইচ্ছে করছে একটু খানি খোলা আকাশে মুখ বাড়িয়ে দিতে। স্নিগ্ধ বাতাসে বক্ষ শীতল করতে। কিন্তু মুখ ফুটে বলার সাহস হলোনা ওর। অগত্যা কাচের জানালার ভেতর থেকেই চেয়ে রইলো আধারে ঢাকা আকাশ পানে।

ঠিক এমন সময় শান্ত নদীর স্রোতের ন্যায় একটু একটু করে নিচে নেমে গেলো টিন্ডেট জানালার কাচটা। মূহুর্তেই ঝপাৎ করে এক ঝটকা স্নিগ্ধ মেঘ ভেজা শীতল বাতাস এসে চোখে মুখে আঁচড়ে পরলো ঈশানীর। হঠাৎ জানালা খুলে যাওয়ায় বিস্ময় নিয়ে এরীশের পানে ঘাড় ঘোরালো অবুঝ মেয়েটা।
সামনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে নির্বিগ্নে গাড়ি চালাচ্ছে এরীশ। ঈশু তখন থেকে ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে আছে দেখে একাই কটমটিয়ে বলে ওঠে সে ,
— সাফোকেশন হচ্ছিল তাই খুলে দিয়েছি।
এতোবড় গাড়িতে সাফোকেশন, ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত! তাও চুপ হয়ে রইলো ঈশানী। আবারও বিষাদপূর্ণ নিরবতায় ছেয়ে গেলো পুরো গাড়িটা। তবে কিছুক্ষণ পরেই সকল নিরবতার ইতি টেনে স গতিতে বেজে ওঠে এরীশের ভাইব্রেট করা মোবাইল ফোনটা। ফোনের লোকেশন দেখে এগুচ্ছিল এরীশ। কানে কোনো এয়ারপড ও ছিল না, অগত্যা ড্রাইভিং অব্যাহত রেখেই লাউডস্পিকারে দিয়ে ফোনটা রিসিভ করলো ও। ফোন তুলতে না তুলতেই ওপাশ থেকে তুষার বললো,

— মেয়েটাকে কি করবো এখন?
কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে জিভের ডগায় গাল ঠেলে চোয়াল শক্ত করে এরীশ বলে ওঠে,
— জানে মে’রে ফেলো।
এরীশের হুকুম শুনে শিউরে ওঠে ঈশানী। চকিতে দৃষ্টি ফিরিয়ে ভয়ার্ত ঢোক গেলে চুপচাপ।
ওর কথায় সম্মতি জানিয়ে তুষার কল কেটে দেবে, তার আগেই এরীশ বাঁধ সেধে বললো,
— মা’রার আগে ওর ডান হাতটাতে ভেঙে গুড়িয়ে দেবে।
এবারও সম্মোহনী সূচক বাক্য প্রয়োগের মাধ্যমে কল কাটে তুষার।
এরীশের নৃ’শংসতা দেখে অভ্যস্ত ঈশানী। নতুন করে আঁতকে ওঠার কিছু নেই, কিন্তু ওর চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ সুস্পষ্ট। সহসা কৌতুহলের পারদ দমাতে না পেলে চট করে প্রশ্নটা করেই ফেললো এরীশকে,
— এভাবে হাত ভে’ঙে দিতে বললেন কেন ? কি ক্ষতি করেছে উনি আপনার?
নিশ্চুপ এরীশ। ভাবলেশহীন হয়ে ড্রাইভ করছে সে। প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে কিঞ্চিৎ অপমান বোধ করলো ঈশানী। অন্যদিকে ঘুরে বিড়বিড়ালো তৎক্ষনাৎ,

— ভুলেই গিয়েছিলাম,উনি কাউকে কৈফিয়ত দেন না।
— ও তোমাকে থাপ্পড় মে’রেছে তাই।
অত্যন্ত রূঢ় স্বরে জবাব দেয় এরীশ। এটুকু বলতে ওর বোধ হয় জিভ খসে পড়ার উপক্রম।
এরীশের প্রত্যুত্তরে চোখ কপালে উঠে গেলো ঈশানীর। বিদ্রুপাত্তক হেসে মনেমনে বললো,
— মেয়েটা সামান্য একটা থাপ্পড় মে’রেছিল বলে তাকে এই শা’স্তি দিলেন। তাহলে আপনার আদতে কি শা’স্তি হওয়া উচিৎ এরীশ ইউভান?
মনেমনে হাজারটা ঝাঁঝালো বাক্য আওড়ালেও এরীশের মুখের উপর সেসব বলার বিন্দুমাত্র সাহস নেই ভীত সন্ত্রস্ত মেয়েটার, যার দরুন গলারস্বর কিঞ্চিৎ খাদে নামিয়ে রিনরিনে আওয়াজে ফের শুধালো,

— ইয়ে মানে, আপনার তো ঘুমিয়ে থাকার কথা ছিল। তাহলে এতো সকালে এতদূর ড্রাইভ করে এলেন কি করে?
মেয়েটার কথায় কপট হাটিতে প্রসারিত হলো এরীশের ঠোঁটের আগা। কয়েক ন্যানো সেকেন্ডের মাঝে আবারও মিলিয়ে গেলো হাসি,গভীর গলায় বললো,
— তুমি যে কতোটা বোকা সেটা তোমার কর্মকান্ডতেই প্রকাশ পায়। নইলে কাউকে ড্রা’গ দেওয়ার আগে এটলিস্ট চেক করা উচিৎ আদৌও সেটার মেয়াদ আছে কিনা।
প্রত্যত্তরে চোখ মুখ কালো করে ঈশানী কিছু বলবে, তার আগেই অকস্মাৎ মাঝ রাস্তায় ব্রেক কষলো এরীশ। কিছু একটা দেখতে পেয়ে মূহুর্তেই স্বাভাবিক মুখভঙ্গিমা থমথমে হয়ে উঠলো ওর। স্টিয়ারিং এ রাখা হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ করে র’ক্তিম চোখে তাকিয়ে রইলো সামনের দিকে। ওর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে নজর দিতেই ঈশানী দেখলো, কালকের সেই দালাল লোকটার দু’বাহু শক্ত করে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন গার্ড’স।
মাঝরাস্তায় আবারও কালকের সেই লোকটাকে দেখে ধুকপুক করে উঠলো ঈশানীর উচাটন হৃদয়। শুষ্ক ঢোক গিলে তড়িঘড়ি করে গুটিয়ে গেলো অজানা আশঙ্কায়। বৃষ্টি পড়ছে না, তাও গ্লাস ওয়াইপার টা চালু করে, গাড়ি থেকে নেমে যেতে যেতে ঈশানীকে উদ্দেশ্য করে এরীশ বলে,

— এখানেই বসে থাকো।
ঈশানী তাই করলো, গাড়িতে বসে থেকেই সামনের দিকে দৃষ্টিপাত করে বুঝতে চেষ্টা করলো এরীশের পরবর্তী পদক্ষেপ। এর কিছুক্ষণের মাঝেই ওর ভাবনাকে পুরো নব্বই ডিগ্রি এ্যাঙ্গেলে ঘুরিয়ে দিলো এরীশ। ও এগিয়ে গিয়ে দু’হাতে সার্জিক্যাল গ্লাভস পরে লোকটার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো প্রথমে, অতঃপর এদিক ওদিক ঘাড় ফুটিয়ে আচমকা টান মে’রে গাড়ির ডিঁকির সঙ্গে চেপে ধরলো লোকটার মাথা।
এরীশের কান্ডে চোখ বড়বড় হয়ে গেলো ঈশানীর। চোখ মুখ জুড়ে ঝরঝর করে নেমে এলো অপ্রত্যাশিত আতঙ্ক। ওর আতঙ্কের মাঝে আরেকদফা জলোচ্ছ্বাস তুলে দিলো এরীশ। কোনোরূপ কথাবার্তা ছাড়াই গাড়ির সঙ্গে একের পর এক আ’ঘাত করে থেঁতলে দিতে শুরু করে লোকটার সমগ্র মুখমণ্ডল। এহেন নৃ’শংসতা দেখে ঘাম ছুটে যায় ঈশানীর,মেয়েটা হাঁপাতে হাঁপাতে চিৎকার করে ওঠে আচমকা ,

— কি করছেন এসব? কেন লোকটাকে এভাবে মা’রছেন? থামুন!
ঈশানীর কথায় কোনোরূপ খেয়াল নেই এরীশের, অত্যন্ত ক্রোধের বশবর্তী হয়ে ক্রমাগত লোকটাকে গাড়ির সঙ্গে আ’ঘাত করে যাচ্ছে সে । আ’ঘাতে আ’ঘাতে লোকটার মাথা ফেটে চৌচির। নাক,মুখ থেঁ’তলে গিয়ে বীভৎস দেখাচ্ছে মুখমণ্ডল।গলগল করে জলস্রোতের ন্যায় বেড়িয়ে আসছে তাজা র’ক্ত, ওর র’ক্তে বারবার ভরে উঠছে গাড়ির ফ্রন্টগ্লাস।পরমূহুর্তেই গ্লাস ওয়াইপারের সাহায্যে মুছে যাচ্ছে সবটা। এমন হৃদয়বিদারক বী’ভৎস দৃশ্য খুব বেশিক্ষন বসেবসে সহ্য করতে পারলো না ঈশানী,চোখ মুখ খিঁচে গলা ছেড়ে চ্যাঁচিয়ে উঠলো পুনরায়,
— দয়া করে থামান এসব। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।অনেক হয়েছে আর না, ছেড়ে দিন ওকে। মাথা ঘুরছে আমার, ম’রে যাবো তো।
*
চোখ মুখ খিঁচে বসেছিল ঈশানী। ভয়ের তোড়ে রুহুটা বোধ হয় ঠোঁটের আগায় উঠে এলো এবার। হাত পা এখনো কাপছে। হাঁপড়ের মতো ওঠানামা করছে বক্ষপিঞ্জর। আশেপাশের সবকিছু শান্ত লাগছে, অবশেষে চোখ বন্ধ অবস্থাতেই ও অনুভব করলো গাড়িটা চলছে। সহসা ভয়ডরের লাগাম টেনে আধো আধো করে চোখ খুললো ঈশানী। চারিদিকে নজর বুলিয়ে দেখলো সবকিছু স্বাভাবিক,এরীশ ওর পাশেই বসে আছে।ফ্রন্ট গ্লাসে র’ক্তের কোনো ছিটে ফোঁটাও নেই। সবকিছু এতোটা স্বাভাবিক লক্ষ্য করে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ঈশানী, ফলস্বরূপ মুখের উপর একহাত রেখে একা একাই বলে ওঠে,
— আমি কি তবে এতোক্ষণ ধরে স্বপ্ন দেখছিলাম?
— মেইবী।
স্টিয়ারিং এ হাত চালাতে চালাতে ছোট্ট করে উত্তর দেয় এরীশ। অতঃপর সিটের অন্যপাশে ফেলে রাখা র’ক্তা’ক্ত গ্লাভস দু’টোকে আস্তে করে সরিয়ে রাখে পেছনে।
মেঘের গর্জনের সাথে সাথেই রাতের আকাশের বুক চিঁড়ে ঝমঝমিয়ে নেমে এসেছে এক পশলা ঝুম বৃষ্টি। আজ বহুদিন বাদে বৃষ্টি দেখলো ঈশানী। রাতের বৃষ্টিতে মন খারাপ উবে গেলো ওর। গত দু’দিনের এতো এতো ঝড়ঝাপটা, দুশ্চিন্তার পাহাড়, সবকিছুকে মস্তিষ্ক থেকে দূরে সরিয়ে বাইরে হাত বাড়ালো বৃষ্টি ছোঁয়ার প্রয়াসে। ঈশানীকে জানালা দিয়ে বৃষ্টি ছুঁতে দেখে কি ভেবে যেন হুট করেই গাড়ি থামিয়ে এরীশ বলে ওঠে,

— তুমি চাইলে ভিজতে পারো।
মাফিয়া বসের অনুমতি পেয়ে ঘাবড়ালো মেয়েটা, চোরা চোখে ওর পানে দৃষ্টি নিক্ষেপণ করে, শুষ্ক একটা ঢোক গিলে শুধালো,
— কি ভুল করেছি আবার?
— ভুলের কথা কখন বললাম?
— সত্যিই ভিজতে পারি?
ঠোঁট উল্টালো এরীশ, বললো,
— এ্যাজ ইউর উইশ।
তৎক্ষনাৎ গাড়ি থেকে নেমে পরলো ঈশানী। ফাঁকা রাস্তার মাঝে ঠায় দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধ বারিধারায় নির্বিগ্নে মেলে ধরলো দু’বাহু। ভেতর থেকে উগড়ে আসছে দলা পাকানো কান্নার জোয়ার। ঈশানী কাদঁলো না,কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাঁড়িয়ে রইলো নিরন্তর। যেন বৃষ্টির এই শীতল পরশে ধূয়েমুছে সাফ হয়ে যাচ্ছে ওর পবিত্র শরীরটা, ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে ওই পাপীষ্ঠ মানুষগুলোর নোংরা হাতের অযাচিত স্পর্শ।

ওদিকে ব্যাকসিটে শরীর এলিয়ে দিয়ে বৃষ্টিস্নাত সরলতার পানে ব্যাকুল নয়নে তাকিয়ে আছে মাফিয়া বস। বাঁধ ভাঙা উত্তাল উর্মিমালার মতোই বেসামাল ওর হৃদয়টা,ভেতরে দাউদাউ করে জ্ব’লছে অসহনীয় সুপ্ত আগ্নেয়গিরির দাবানল। অথচ চারিদিকে ধরণি মাতানো বাঁধভাঙা বৃষ্টি। এভাবেই, ঠিক এমন করেই, মাফিয়া বসের শক্ত কড়াপড়া উত্তপ্ত হৃদয়ে সরলতার হঠাৎ আগমন যেন ছিল একপশলা স্নিগ্ধ শীতল বারিধারা। যে বারিধারার ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর কণাকেও ধ্বংস স্তূপে পরিনত করায় অক্ষম স্বয়ং মাফিয়া বস।

সেই তখন থেকে ধ্যানমগ্ন হয়ে মেয়েটাকে সুক্ষ্ম নজরে পরখ করছে এরীশ । ওর হাসি, ওর আনন্দ, ওর কান্না, ওর অভিমান, সব সবকিছু। এভাবেই নীলাম্বরীকে দেখে দেখে চোখ জুড়িয়ে আসে ওর। আবেশে চোখের পাতায় পলক ছেড়ে মনেমনে কঠোর সিদ্ধান্ত নেয় অকস্মাৎ , যা খুশি হয়ে যাক, এখন থেকে আর নিজের বেসামাল হৃদয়টাকে আটকাবে না ও। যত যাই হোক,লাগাম টানবেনা অনুভূতির। এখন থেকে হৃদয়টা যা চায় সেটাই হতে দেবে ও। হোক সেটা দূর্বলতা,ভালোলাগা কিংবা এর চেয়েও ভয়ংকর কোনো কিছু ।
কারণ অসহনীয় বেসামাল হৃদয়ের এই টানাপোড়েনে ইতিমধ্যে হাঁপিয়ে উঠেছে এরীশ। ও বুঝে গিয়েছে ঈশানী তুজ কর্ণিয়া কোনো সাধারণ মেয়ে নয়। মাফিয়া বসের ইস্পাত কঠিন হৃদয়টা শুধু মাত্র চোখের চাউনীতে ওলট-পালট করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে যেই মেয়ে , সে আর যা-ই হোক অতিসাধারণ মানবী নয়।
মেয়েটাকে নিয়ে ভেবে ভেবে ক্লান্ত এরীশ। এখন একটু বিশ্রামের প্রয়োজন, অগত্যা বিশ্রাম নেওয়ার উদ্দেশ্যে মাথাটা শূন্যে ছেড়ে দিয়ে দু’চোখ বুঝে তপ্ত নিগূঢ় স্বরে বিড়বিড়ালো সে,

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২০

— প্রেম আমার।
মাফিয়া বস আর সরলতার দৃশ্যপট অনুকরণ করে ভাবনার জগত ছাপিয়ে ভেসে আসে তখন অযাচিত দু’টো গানের লাইন,
” চাইলে আস্কারা পাক
বেঁচে থাকার কারণ,
আজকে হাতছাড়া যাক
ব্যস্ততার বারণ,
লিখবো তোমার হাতে…
আমি আমার মরণ”

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২১