আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২২

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২২
suraiya rafa

ডিসেম্বরের তুষারপাতে শ্বেতরঙা চাদর মুড়ি দিয়ে অসহনীয় হিম শীতল ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে কাঁপছে প্রকৃতি। তাপমাত্রা ঝুলে আছে মাইনাস থার্টিতে। রাত যত গভীর হচ্ছে ততই মাইনাসের কাটায় যোগ হচ্ছে রোমান সংখ্যারা। এ বছর ডিসেম্বরের অন্যতম শীতল রাতটি বোধ হয় আজ। অথচ কৃত্রিম তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রকের উষ্ণতায় ঘিরে আছে পুরো পেন্টহাউজ।
রাতের অন্তিম প্রহর চলমান। কাচের দেওয়ালের পর্দাগুলো আলতোভাবে টেনে রাখা,যার দরুন ল্যামপোস্টের বিস্তার আলোর নিশানা ধরে যতদূর চোখ যায় ততোদূর অবধি দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে কেবল বরফের আস্তরে ডুবে যাওয়া জংলা ক্রীসমাসের গাছ গুলো।

ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে হলদে হ্যাজাক জ্বালিয়ে জঙ্গল পাহারায় কর্মরত নাইট ওয়াচের মতো কালো পোশাকধারী একদল গার্ড’স। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে পাইথন টেরোটোরিতে দিগুণ সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে ইদানীং। জঙ্গলের পথ অতিক্রম করে একটা কাক পক্ষির ও প্রবেশ করার সাধ্য নেই পেন্ট হাউজে। তবুও কাজের ফাঁকে ফাঁকে ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে দু’একবার অবিরত তুষারপাতের দিকে দৃষ্টিপাত করে এরীশ। রুমের মাঝে খুব একটা আলো নেই, বেডসাইড টেবিলে ড্রিম লাইট জ্বালানো শুধু । আজ রাতটা পেন্টহাউজেই অতিবাহিত করবে এরীশ , অগত্যা মাঝরাতে শরীরে কালো রঙের স্কিনি স্যান্ডো গেঞ্জি চড়িয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসে ছিল বিছানায়।
ঘুম জিনিসটা বোধ হয় সত্যিই ঈশ্বরের এক নিদারুণ ব্লেসিং। সবাই সেটা লাভ করতে পারেনা। এরীশ তার মধ্যে অন্যতম। পাহাড় সমান পাপ গ্রাস করে রেখেছে ওকে। ফলস্বরূপ ঘুমের প্রবণতা হারিয়েছে বহু আগেই। নিস্তব্ধ নিঝুম স্নো ফলের রাতে পুরো পেন্টহাউজ যখন ঘুমে আচ্ছন্ন,তখনও নির্ঘুম চোখ দু’টো মেলে তৃষ্ণার্থ চাতকের ন্যায় ল্যাপটপ স্ক্রিনে দৃষ্টিপাত করে আছে এরীশ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তন্মধ্যে সকল নিস্তব্ধতার ইতি টেনে শুনশান করিডোর ছাপিয়ে ভেসে আসে রিনঝিন নুপুরের বেসামাল ঝঙ্কার। চকিতে চোখ ঘোরায় সে। দৃষ্টিগত হয় , নিরিবিলি রাতে নিষিদ্ধ মাফিয়ার অন্ধকার ঘরে সরলতার ছন্নছাড়া আগমন। মেয়েটাকে এলোমেলো লাগছে, জবুথবু সর্বাঙ্গ জুড়ে মিশে আছে অকৃত্রিম মাদকীয়তা। বেঘোরে টালমাটাল সে। হেলেদুলে এদিকেই এগিয়ে আসছে, গাঢ় নীল চোখ জোড়া ঘোরে আচ্ছন্ন, তবুও গমরঙা পেলব মুখশ্রী জুড়ে ঠিকরে পড়ছে লাবণ্যতা।
সামনের দিকে এক পল নজর বুলিয়ে থমকালো এরীশ, মেয়েটার হঠাৎ আগমন নিয়ে ভাবনায় ডুবলো কিয়ৎক্ষন। পরক্ষণেই চিরাচরিত কঠিন রূপে ফিরে এসে রাশভারি কন্ঠে বললো,
— এখানে কি চাই?

আজ আর সংশয় দেখা গেলোনা নীলাম্বরীর দু’চোখে। আর না তো সে চোখ নামালো কুণ্ঠায়। উল্টো এরীশের কথায় বিন্দু পরিমাণ তোয়াক্কা না করেই ছুটে এসে এক লাফে উঠে দাঁড়ালো খাটের উপর। ঈশানীর হঠাৎ কান্ডে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে মাফিয়া বসের চোখে মুখে, তৎক্ষনাৎ বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে পরলো এরীশ । খাটের উপর দাঁড়িয়ে টলতে থাকা মেয়েটার দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে সন্দিহান গলায় বললো,
— আর ইউ ড্রাংক?
— উহু, মন ভালো হওয়ার ওষুধ খেয়েছি শুধু।
চোখ বুজে, বেঘোরে টলতে টলতে জবাব দেয় ঈশানী।
— হোয়াট!
অবিশ্বাসের ঝঙ্কার বেরিয়ে আসে এরীশের পুরুষালি কণ্ঠনালি ভেদ করে। ফের অস্পষ্ট আওয়াজে বলে ওঠে মেয়েটা,

— ঠিকই শুনেছেন, ফ্লোরা বলেছে ব্যথা ভোলার ওষুধ ছিল এটা।
বাক্যটুকু শেষ করে অকস্মাৎ শরীর ছেড়ে দিয়ে দু’হাতে এরীশের গ্রীবা জড়িয়ে ধরে ঈশা। মেয়েটার আকস্মিক কান্ডে হকচকিয়ে ওঠে এরীশ। চট করেই জমে বরফপিন্ডে রূপান্তরিত হয় মাফিয়া বসের সিংহের মতো রগরগে আত্মাটা ।প্রচন্ড উত্তেজনায় হৃদপিণ্ড ফেটে পড়ার উপক্রম, তাও নিয়ন্ত্রণহীন অবচেতন মেয়েটাকে নিজের থেকে সরালো না এরীশ।
দু’হাত মুঠি বদ্ধ করে স্থির হয়ে রইলো সেখানেই। ঈশানী এখনো খাটের উপর দাঁড়িয়ে। এরীশের মাত্রাতিরিক্ত বেসামাল হৃদয়ে আবারও ভূকম্পন বাঁধিয়ে দিয়ে ওর বলিষ্ঠ কাঁধের উপর আচানক চিবুক ঠ্যাকালো ভীত মেয়েটা। অতঃপর চোখ বন্ধ রেখে অস্পষ্ট আওয়াজে বিড়বিড় করে বললো,

— জানেন আমার অনেক ব্যথা। হৃদয়টা ভেঙে তছনছ। ওই মাফিয়া এরীশ একটা অ’ত্যাচারী, ও একটা সত্যিকারের জা’নোয়ার। ঘৃ’ণা করি আমি ওকে ।
মূহুর্তেই সবটুকু অনুভূতির জোয়ার গ্রাস করে নিলো নিদারুণ তিক্ততা। এতোক্ষণের থমকে থাকা মস্তিষ্কটা ফিরে গেলো তার চিরাচরিত পৈশাচিক সত্তায়। চোখের মাঝে নেমে আসা সুপ্ত সাবলীল ভালোলাগা টুকু উবে গিয়ে অক্ষিপুট ছেয়ে গেলো শূন্যতায়।
চেতনাহীন ঈশানীর মুখ থেকে বের হওয়া প্রত্যেকটা কথা ছিল বি’ষাক্ত তীরের ফলার মতোই য’ন্ত্রনাদায়ক। যা সোজা গিয়ে বিঁধেছে এরীশের বুকের বাম পাশে। হৃদয়ে এখন র’ক্তক্ষরণ। তবে মাফিয়া বস সামলাতে জানে নিজেকে,দুনিয়া থেকে আলগোছে লুকোতে পারে তার নিদারুণ কষ্টের পাহাড়। ফলস্বরূপ একই ভঙ্গিমায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে, ফের গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো এরীশ ,

— সত্যিই ঘৃণা করো?
ভার হয়ে আসা মাথাটা জোরপূর্বক ঝাঁকালো ঈশানী। মাতাল স্বরে বললো,
— করি তো, ওকে আমি ভীষণ ঘৃণা করি। ও আমায় জোর করে আটকে রেখেছে। বাড়িতেও যেতে দিচ্ছেনা। এমনকি আমার পরিবার কেও মে’রে ফেলার হুমকি দিয়েছে। আপনি জানেন ও অনেক খারাপ।
ঈশানীর কথায় কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া করেনা এরীশ। স্থির চিত্তে দাঁড়িয়ে রয় অকপটে। মনেমনে ভাবতে থাকে শুরু থেকে শেষ অবধি,সত্যিই তো মেয়েটাকে অহেতুক কম কষ্ট দেয়নি ও। এমনকি ওই খারাপ জায়গাটায়…নাহ! আর ভাবতে পারলো না এরীশ। এই মূহুর্তে দাড়িয়ে সেসব কথা ভাবতে গেলেও বিতৃষ্ণায় চোয়াল শক্ত হয়ে আসে ওর।ভীষণ ক্রোধের পারদে নিজেকেই নিজের নিঃশেষ করে দিতে ইচ্ছে হয় এক নিমেষে।
মাফিয়া বসের ট্যাটু আবৃত কাঁধের উপর নাক ঘষতে ঘষতে আচমকা ফুঁপিয়ে ওঠে ঈশানী, ওর চোখ থেকে গড়িয়ে পরা তপ্ত নোনাজলে ভিজে ওঠে এরীশের বলিষ্ঠ বাহু। সামান্য ঘাড় ফিরিয়ে আড় চোখে সেদিকে এক পল নজর বুলিয়ে গমগমে আওয়াজে এরীশ বলে,

— কাঁদছো কেন? কে ম’রেছে?
না সূচক মাথা দোলায় ঈশানী, নাক টেনে বলে,
— জানেন আমি একটা বোকা মেয়ে ।
মেয়েটার অযাচিত কথায় ভেতর ভেতর কৌতূহল ঘিরে ধরলো এরীশকে। অগত্যা নিয়ন্ত্রণহীন সুক্ষ্ম মনোযোগটুকু আপাতত ঈশানীর পানে তাক করালো সে। কিছু মূহুর্ত নিশ্চুপ থেকে ফের একাই বলতে আরম্ভ করে ঈশানী,
—দুনিয়াতে কেউ আমায় কখনো ভালোবাসে নি। একটু মাথায় হাত বুলিয়ে কাছে টানেনি। অথচ একটা সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষের প্রতীক্ষায় সারাজীবন অপেক্ষার প্রহর গুনেছি আমি। ভেবেছিলাম কেউ না কেউ আসবে ,হঠাৎ এসে ভালোবাসার সমুদ্রে তুফান তুলে অহর্নিশ ভিজিয়ে দিয়ে যাবে হৃদয়ের শুষ্ক বেলাভূমিটা। আমাকে ঠিক ততটাই ভালোবাসবে যতটা ভালোবাসা পৃথিবীর কেউ কোনোদিন কল্পনাও করতে পারবে না। সে আমাকে ঠিক ততটাই চাইবে যতটা চাহিদা একজীবনে মানুষের জন্য পূরণ করা অসম্ভব। তার প্রেমে আলাদা সুবাস থাকবে। তার মাত্রাতিরিক্তি প্রণয়ের সুবাসে পুলকিত হবে আমার হৃদয়ের প্রতিটি অনু পরমাণু । আমাদের বিষণ্ণ ভালোবাসার রং হবে গাঢ় নীল। তার নিগূঢ় ভালোবাসার নীল ব্যথায় মুড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু এমন কেউই এলোনা জীবনে, মনে হয় বিধাতা আমার জন্য কাউকে বানায়নি। কারণ কি জানেন? কারণ আমি বোকা। বোকা বলেই সবাই ঠকায় আমাকে।

ঈশানীর বিরতিহীন কথার মাঝে বাঁধ সাধলো না এরীশ। এই প্রথমবার মেয়েটার মুখে এতোগুলো কথা শুনলো ও, তাই বাঁধা দিতে ইচ্ছে হলোনা একদম । এরীশের ভাবনার ছেদ ঘটে ঈশুর অকস্মাৎ দিক পরিবর্তনে। সেই তখন থেকে একই জায়গায় সটান দাঁড়িয়ে আছে এরীশ, ওদিকে পেছন থেকে ওর কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে খাটের ওপর দাঁড়িয়ে অনর্গল কথা বলা যাচ্ছে ঈশানী। এক চিলতে রিনরিনে নেশালো আওয়াজ। অথচ এই মৃদু আওয়াজ টুকুই মাফিয়া বসকে এক পায়ে দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট।
কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে এপাশ থেকে ওপাশে মুখ ঘোরায় চেতনাহীন মেয়েটা। সহসা ওর রেসমের মতো ঝুরঝুরে চুল গুলো এলোমেলো ঢেউয়ের মতো আঁচড়ে পরে এরীশের সমগ্র মুখমণ্ডল জুড়ে । কোনোরূপ দ্বিধাবোধ না করেই মুখের উপর থেকে আঙুলের সাহায্যে আলোগোছে চুলগুলো সরিয়ে দিলো এরীশ।
সেসবে বিন্দুমাত্র খেয়াল দিলোনা ঈশানী, নিভু নিভু চাউনী মেলে ঝাপসা চোখে পরখ করলো মানুষটাকে। তার শরীরের কৃত্তিম সুগন্ধি মিশ্রিত পুরুষালি ক্লোনের সুঘ্রাণ আর সূঁচালো খরদাড়িতে ঢাকা গৌড় ধারালো চিবুক, দু’টোই অস্পষ্ট ।

চাহনি যতটা ঝাপসা, মস্তিষ্ক ঠিক ততটাই ব্যতিগ্রস্থ। যার দরুন আধো আধো চোখ খুলে ফের বলে ওঠে ঈশানী,
— আমার প্রথম ভালোবাসা,আমার অরণ্য ঠকালো আমায়। মাহিনও বিয়ে না করে, আমার মুখটা অবধি না দেখেই চলে গেলো। কেন বলুন তো? আমি কি এতোটাই অসুন্দর? এতোটাই অপয়া? এইটুকু কি ভালোবাসা যেতো না আমাকে?
এতোক্ষণে ঈশুর কথায় শান্ত মস্তিষ্কটা আচানক চড়াৎ করে উঠলো এরীশের। সরল কপালে জড়ো হলো তীক্ষ্ণ গাম্ভীর্যের ভাঁজ। ভেতরে জাগ্রত কৌতুহলের উত্তাপে মুখমণ্ডলে ঘনীভূত হয়েছে র’ক্তিম আভা। সেভাবেই ঘাড় ঘোরালো এরীশ। এরীশ ঘুরতেই ঈশুর টলতে থাকা অবচেতন মাথাটা পরে যেতে নেয় অকস্মাৎ, তবে তার আগেই ওর নরম তুলতুলে গালটাকে হাতের সাহায্যে তুলে ধরে এরীশ। ধরে রাখা অবস্থাতেই ওর নরম গালে হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে প্রশ্ন ছোড়ে সে,
— মাহিন কে?
ঘোরে আচ্ছন্ন মস্তিষ্কটা খাটিয়ে ভালোভাবে উত্তর দিতো পারলো ঈশানী। অগত্যা এলোমেলো কথার পসরা সাজিয়ে বললো,

— উমমম! মাহিন খুব সুদর্শন, একেবারে মিস্টার পার্ফেক্ট। দেখতে ঠিক রাজপুত্রের মতো। কিন্তু আমার মুখটা পর্যন্ত দেখলো না সে, বিয়েটা ভেঙে দিয়ে চলে গেলো।
ঈশানীর আগেও বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল, ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই অযাচিত ব্যথায় টনটন করে উঠলো এরীশের শুষ্ক কড়াপড়া হৃদয়টা। তারমানে মেয়েটা আগে থেকেই ভাঙাচোরা। অথচ এই হৃদয় ভাঙা মেয়েটাকে পুনরায় ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার কতইনা প্রচেষ্টা ছিল মাফিয়া বসের। তবে এই মূহুর্তে সেই নিগূঢ় ব্যথাটুকু ছাপিয়ে ওর মস্তিষ্কে চড়াও হয়েছে অহেতুক ক্রোধের দাবানল।

ঈশানীর মুখে এতো এতো প্রশংসা শুনে মাহিন নামটার প্রতি একরাশ প্রতিহিংসায় জ্বলেপু’ড়ে যাচ্ছে ভেতরটা। ফলস্বরূপ এবার আর নিজের অনুভূতি গুলোকে সামাল দিয়ে উঠতে পারলো না মাফিয়া বস। অবচেতন মেয়েটার নরম চিবুকটা আলতো হাতে চেপে ধরে তীব্র অধিকারবোধ খাটিয়ে ক্রোধান্বিত স্বরে বলে উঠলো ,
— হোক সুদর্শন।এই নামটা তুমি আর দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করবে না মুখে। আর কোনোদিন যাতে না শুনি এসব ইউজলেস গুনগান। শুনতে পেয়েছো? এ্যাই শুনতে পেয়েছো?
ঈশানীর সরু বাহু দুটো আলতো করে ঝাঁকিয়ে উঠলো এরীশ। হঠাৎ ঝাঁকুনি খেয়ে চোখ খোলে ঈশু। ঘাড়টা কিঞ্চিৎ কাত করে, নিভু নিভু চোখে এরীশের পানে চেয়ে ঠোঁট উল্টে শুধায়,
— আপনি কি আমায় নিয়ে যেতে পারবেন বাড়িতে? আমি সত্যিই এখান থেকে মুক্তি চাই। বাড়িতে না হোক অন্তত ওই এরীশের হাত থেকে মুক্ত করে অনেক দূরে কোথাও? বলুন না, পারবেন?

— তুমি সত্যিই চলে যেতে চাও ?
নির্জীব বিষণ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো এরীশ। তৎক্ষনাৎ হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে জবাব দেয় ঈশানী,
— বিশ্বাস করুন আমার এখানে , এই পাপের শহরে একটুও থাকতে ইচ্ছে করেনা । স্বপ্নের মাঝেও মানুষের হাহাকার চিৎকারে কলিজা কেঁপে ওঠে আমার । মুখে না স্বীকার না করলেও সত্যি তো এটাই আমি এরীশ কে প্রচন্ড ভয় পাই। ভয় পাই ওর নৃ’শংসতাকে। যেনে শুনে কি কেউ এমন একটা নির্দয় মানুষের সংস্পর্শে থাকতে চায় বলুন? আপনি এরীশের সঙ্গে লড়াই করে আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবেন। তাই না?
কথা বলতে বলতে এরীশের স্কিনি স্যান্ডো গেঞ্জিটা ধরে শূন্যে ঝুঁকে পরে ঈশানী। এরীশ পুনরায় সামলালো ওকে, টেনেটুনে দাঁড় করিয়ে ওর গাঢ় নীল চোখের মাঝে দৃষ্টি স্থাপন করে স্তব্ধ স্বরে বলে উঠলো ,

— তোমার গল্পে এরীশ ইউভান শুধুই খলনায়ক, তাই না সাকুরা?
—সাকুরা!
আশ্চর্য কণ্ঠে একই শব্দের পুনরাবৃত্তি করে ঈশানী।তৎক্ষনাৎ চোখের পলক ছেড়ে হ্যা বোঝালো এরীশ, মনে মনে বললো,
— তুমি আমার চোখে সাকুরার মতোই স্নিগ্ধ। পার্ফেক্ট ইন এভরি ওয়ে।
এরীশের শূন্য চোখে সদ্য জন্মানো অনুভূতির ভাষা বুঝলো না ঈশু। অগত্যাই টলতে টলতে জবাব দিলো মেয়েটা,
— হ্যা ও সত্যিই একটা ভিলেন। আমাকে ঠকিয়েছে, কষ্ট দিয়েছে,জোর করে এই পা’পের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রেখেছে। সাধ্য থাকলে আমি ওকে মে’রেই ফেলতাম।
কথা শেষ করতে না করতেই অকস্মাৎ মুখ বাড়িয়ে এরীশের গলার মাঝে কামড় বসিয়ে দিলো ঈশু। দিন দুনিয়ার সমস্ত হুশ হারিয়ে নেশার ঘোরে বুদ হয়ে এতো
বড় অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। শরীরের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে শক্ত ভাবে চেপে ধরেছে দু’চোয়াল। ধরেছে তো ধরেছে ছাড়ার কোনো নাম গন্ধ নেই। অথচ রাগি হিং’স্র মাফিয়া বসটা আজ নিস্ফল। নিস্প্রভ ওর মুখানুভূতি। যার দরুন এতো অসহনীয় যন্ত্রণার মাঝেও দূরে ঠেললো না ঈশুকে, দু’হাত মুঠিবদ্ধ করে চুপচাপ ব্যথা সহ্য করে গেলো চোখ খিঁচে। মেয়েটার প্রকান্ড কামড়ের তোপে চামড়া ভেদ করে র’ক্ত বেড়িয়ে আসার উপক্রম। তবুও টু শব্দটি করলো না এরীশ। মনে মনে বোধ করলো ঈশানীর ব্যথায় জর্জরিত হৃদয়টার তুলনায় ওর এটুকু শারীরিক যন্ত্রণা ছিল নিতান্তই নাজুক আর স্বল্প।

বেশ অনেকক্ষণ বাদে ধীরে ধীরে চোয়ালের শক্তি কমে এলো ঈশুর। অগত্যা ঢিলে হয়ে গেলো দাঁতের বাঁধন। একপর্যায়ে পুরোপুরি ওর গলা ছেড়ে দিতেই আস্তে করে মাথাটা ঢলে পরলো এরীশের ঢেউ খেলানো বুকের মাঝে।
লম্বাটে পুরুষালি গ্রীবা থেকে চুঁয়িয়ে চুঁয়িয়ে পরছে তরতাজা র’ক্তস্রোত। অথচ নিজের দগদগে ক্ষ’তর কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে চেতনাহীন পেলব অপ্সরীটাকে চোখ দিয়ে গ্রাস করে নিচ্ছে মাফিয়া বস। স্ফটিকের মৃদু আলোতে কিয়ৎক্ষন নিস্প্রভ চোখে ভীত মেয়েটাকে পরখ করে ঠোঁট বাঁকালো এরীশ। অতঃপর জিভের ডগায় গাল ঠেলে হাস্কিস্বরে বলে উঠলো ,
— তোমার ডেসটিনিতে ভিলেইন লেখা আছে। তাহলে অযথা হিরোর খোঁজ কেন করছো প্রেম আমার?

আজ ভর সন্ধ্যাবেলায় একরাশ কাপড় ভিজিয়েছে ফ্লোরা। হঠাৎ এতো কাপড় ভেজানোর কারণ জানতে চাইলে ঈশানীকে বলেছে,
— ওয়েদার চেক করেছিলাম, আগামীকাল তাপমাত্রা এক ডিগ্রিতে পৌঁছবে। মানে হালকা রোদে বরফ গলতে শুরু করবে। তাই তাড়াহুড়ো এগুলো পরিস্কার করে রাখছি, যাতে সকাল সকাল শুকোতে দেওয়া যায়।
ফ্লোরার জবাব শুনে ফোঁস দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ঈশানী।আজ আর ওর মাঝে ভাবান্তর নেই কোনো, অযাচিত ভাবনার অনলে সেই সকাল থেকে ডুবে আছে মেয়েটা। ঈশানীর উদাসীন মুখশ্রী নজরে এলে ভ্রু কুঁচকে বাদামী চোখ জোড়া ছোট ছোট করে ফেললো ফ্লোরা। সহসা কাপড়চোপড়ে সাবান লাগাতে লাগাতে ভাবুক ঈশানীকে আচমকা ডেকে উঠে বললো ,

— এ্যাই মেয়ে, কি এতো ভাবছো তখন থেকে?
ফ্লোরার ঝাঁঝালো ডাকে তৎক্ষনাৎ সম্বিত ফিরে পেলো ঈশানী। এক আকাশ সম টানাপোড়েনের তোপে গালের উপর একহাত ঠেকিয়ে চিন্তিত স্বরে জবাব দিলো ,
— আমার না কালকে রাতের কিছুই মনে পরছে না ফ্লোরা।
— এতে আবার চিন্তার কি আছে? সকালে উঠে তো দেখলাম নিজের বিছানায় ঠিকই পরে পরে ঘুমাচ্ছো।
হাতের কাজ করতে করতে ঠোঁট উল্টে প্রত্যুত্তর করলো ফ্লোরা।
— না, তেমন কিছুই না। আসলে রুমের কোথাও আমার ওড়নাটা খুঁজে পাচ্ছি না তাই । এমনকি লাউঞ্জেও না, মনের ভুলে কোথায় যে রাখলাম কে জানে?
ভবঘুরে মেয়েটা আরও কিছু বলবে, তার আর ফুরসত দিলোনা ফ্লোরা। ঈশুকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে তাড়াহুড়ো পায়ে হাত ভর্তি সাবান ফেনা নিয়েই ছুটে গেলো লাউঞ্জের দিকে। ফ্লোরার গতিবেগ পর্যবেক্ষন করে ঘাড় ঘুরিয়ে লাউঞ্জের দিকে উঁকি দিলো ঈশানী। দেখলো মাত্রই দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করেছে টমেটো প্রিন্স। ঈশানীর জানা মতে এই লোককে দু’চোখে দেখতে পারেনা ফ্লোরা। তাহলে আজ হঠাৎ এতো তাড়া কিসের ওর ?

লাউঞ্জের ওদিকে দাঁড়িয়ে ওভার কোটের বরফ গুলো ঝেড়ে ঝেড়ে পরিস্কার করছিল এ্যালেক্স। ঠিক সে সময় দ্রুত পায়ে ছুটে এলো ফ্লোরা। ফ্লোরাকে দেখা মাত্রই হাতের কাজ থমকে যায় লোকটার। অথচ চোখের সামনে স্থির দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। অগত্যাই বেহায়া চোখে অধিক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো সোনালী চুলের দুধে-আলতা গড়নের ফর্সা মেয়েটার মুখপানে।
টমেটো প্রিন্সের এহেন ধ্যানমগ্ন চাউনীতে কিঞ্চিৎ বিব্রত ফ্লোরা। তাও জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে ওকে কুর্নিশ জানালো রুশ মেয়েটা। ঠান্ডা গলায় বললো,

— কালকের কর্মকান্ডের জন্য আমি ভীষণ লজ্জিত, পারলে ক্ষমা করে দিবেন।
মেয়েটার সুশ্রী মুখ থেকে বের হওয়া মুক্তোদানার মতো বাক্যগুলো কামনার ঢেউ তুলে দিলো টমেটো প্রিন্সের উদভ্রান্ত হৃদয়ে। সে ধীরে পায়ে সামনে এগিয়ে আসতে আসতে ঈষৎ রাগত্ব স্বরে বলে,
— উহু ক্ষমা করে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
— তাহলে?
উদ্বিগ্ন হয়ে চোখ তুললো ফ্লোরা। এ্যালেক্স আরও খানিকটা এগিয়ে এসে ওর সোনালী চুলে দু’আঙুল বুলিয়ে বললো,
— আই রিপিট, তোমাকে ক্ষমা করার প্রশ্নই ওঠেনা।
লোকটার প্যাঁচানো কথায় ভড়কালো মেয়েটা। সহসা চোখ মুখ কালো করে বললো,
— কেন এভাবে বলছেন? দেখুন আপনি যদি চান তো আমি নিজের ভুলের জন্য আপনার পায়ে ধরতেও রাজি। তবুও অহেতুক ঝামেলা করবেন না দয়াকরে।
কপট হাসিতে ঠোঁট প্রসারিত করলো এ্যালেক্স, বললো,

— বুঝিনা,রীশস্কা সবসময় বেছে বেছে কেন ইনোসেন্ট মেয়েগুলোকেই পেন্টহাউজে রেখে দেয়।
— কি বললেন?
ফ্লোরার কথার প্রত্যুত্তরে লোকটা চোখ নামিয়ে বলে ওঠে ,
— তোমাকে ক্ষমা করার ইচ্ছে নেই, চাইলে অন্য কিছু…..
নিজের কথাটুকু সম্পূর্ণ করতে পারলো না এ্যালেক্স, তার আগেই পেছন থেকে তীক্ষ্ণ স্বরে গলা ছেঁড়ে ডেকে ওঠে তুষার,
— ফ্লোরা!
তুষারের হঠাৎ ডাকে লাফিয়ে উঠে চকিতে পেছনে ঘুরলো ফ্লোরা। দেখলো লম্বা পা ফেলে এদিকেই এগিয়ে আসছে তুষার। ওর মুখভঙ্গিমা এখনো স্বাভাবিক, তবে র’ক্তিম কটমটে চোখ দু’টো দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই। ফ্লোরার ভাবনার মাঝেই লাউঞ্জে এসে দাঁড়িয়ে পরে তুষার।
অতঃপর কোনোরূপ কথাবার্তা ছাড়াই আচমকা ওর ফেনা মিশ্রিত হাতটা খপ করে চেপে ধরে হ্যাঁচকা টানে এ্যালেক্সের থেকে কয়েক হাত দূরে সরিয়ে এনে দাঁড় করালো ফ্লোরাকে। হাতের ব্যথায় মেয়েটা মৃদু আর্তনাদে “উহ! ” করে উঠলে ওর পানে চেয়ে
গমগমে আওয়াজে প্রশ্ন ছোড়ে তুষার ,

— এখানে কি?
তুষারের ক্ষীণ হয়ে যাওয়া র’ক্তিম চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেওয়ার সাহস পেলোনা ফ্লোরা, সহসা নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ।
ফ্লোরার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখা অবস্থাতেই এ্যালেক্সের দিকে কঠোর দৃষ্টিপাত করে তুষার, ধারালো কন্ঠে বলে,
— এখানেই ওয়েট করুন পাঁচ মিনিট।৷ আমি ওকে পৌছে দিয়ে আসছি।
কথা শেষ করে এ্যালেক্সের প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করেই ফ্লোরা সমেত কিচেনে দিকে চলে গেলো তুষার। ভেতরে গিয়ে মেয়েটাকে স্থির দাঁড় করিয়ে তপ্তস্বরে বলে,
— কালকে তোমায় নিষেধ করিনি? বলিনি ওই গর্ধভটার সামনে না যেতে? তাহলে আজ আবার ঢ্যাং ঢ্যাং ওখানে কেন গেলে?
শুষ্ক একটা ঢোক গিলে কণ্ঠনালী ভেজালো ফ্লোরা।মুখ কাচুমাচু করে জবাব দেওয়ার প্রয়াস চালালো কিয়ৎক্ষন,

—আআসলে আমি ভেবেছিলাম, কালকে আমার বোকামির জন্য যদি আপনাদের ককিছু..
বাক্য সম্পূর্ণ করার আগেই ওকে মাঝ পথে ধমকে ওঠে তুষার। একরত্তি মেয়েটাকে চোখ পাকিয়ে বলে,
— জাস্ট শাট আপ! টমেটো প্রিন্সকে কি ভাবো তুমি? ওর জন্যে কিইবা হবে আমাদের? লিসেন ফ্লোরা, আমি তোমাকে বড়সড় একজন মাফিয়ার সঙ্গে বিয়ে দেবো। তুমি হবে মাফিয়া কুইন, কোনো এক মাফিয়া কিং এর মনের সম্রাজ্ঞী। তার বিশাল টেরিটোরির একমাত্র রানি। আর তুমি কিনা ভয় পাচ্ছো সামান্য ড্রাগ ডিলার টমেটো প্রিন্সকে? আশ্চর্য!

এতোক্ষণ যা বলেছিল বলেছিল। কিন্তু শেষ বাক্য গুলোতে নাজুক হৃদয়টা এক মূহুর্তে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো ফ্লোরার। নিজের অজান্তেই ভীষণ যন্ত্রণায় নীল হয়ে এলো মেয়েটার আদুরে মুখমণ্ডল।কখন যে জলের জোয়ারে ভরে উঠলো দু’চোখের শীর্ণকায় কোটর সে কথা বলা বাহুল্য।
তুষার ভেবেছে বকাবকিটা একটু বেশিই হয়ে গেছে বোধহয়। তাই হয়তো মেয়েটা কাঁদছে।
সহসা কোনোরূপ কথা না বাড়িয়ে,ফ্লোরাকে একটু একাকী সময় দেওয়ার প্রয়াসে চুপচাপ বিনাবাক্যে প্রস্থান করলো সে। ওদিকে তুষার যেতে না যেতেই ছুটে আসে ঈশানী, উদ্বিগ্ন স্বরে বলে ওঠে,
— তুমি এসব করেছো কাল রাতে ? তাহলে ভাবো আমার তো কিছু মনেও নেই। আমি যেন আরও কি কি ভুল করে বসে আছি।

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২১

ঈশানী কথা বলছিল অনর্গল। তখনই ওর চোখ আটকালো ফ্লোরার বিমূর্ষ অক্ষিপুটে। যতই বকাবকি শুনুক না কেন, মেয়েটাকে এর আগে কখনো এমন বিধ্বস্ত রূপে আবিষ্কার করেনি ঈশানী। আজই প্রথমবার। চঞ্চল হাসিখুশি মেয়েটার হলোটা কি হঠাৎ? মস্তিষ্কের অজ্ঞাত ভাবনায় তৎক্ষনাৎ মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলো ঈশানী। বললো,
— ফ্লোরা, কি হয়েছে তোমার?
আজ আর একগাল হেসে প্রত্যুত্তর করলো না ফ্লোরা। বরং ঈশুর প্রশ্নকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চোখ মুছতে মুছতে এক ছুটে চলে গেলো নিজের কক্ষে।

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২৩