আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২৩
suraiya rafa
মিথ্যের প্রাচীরে ঢাকা বিধ্বংসী এক গোলোকধাঁধা। মাঝখানে উদভ্রান্ত পথিকের ন্যায় আটকা পড়ে আছে গড ফাদার খ্যাত ডেনিয়েল হ্যারিসন । ঈর্ষা আর প্রতিহিংসার দাবানলে দিনরাত জ্বলেপু’ড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে তার ব্যতিগ্রস্থ মস্তিষ্ক। ডেনিয়েলের দৃঢ় বিশ্বাস এরীশ ইউভান এতো সহজে কারোর সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ করতে পারেনা, এটা অসম্ভব। তার মানে কি সে ব্লাড ডায়মন্ডের আশা ছেড়ে দিয়েছে? কিন্তু এটাতো আরও আগে অসম্ভব।
কারণ এরীশ যেটা একবার চায় ঈগলের মতো হাজার ক্রোশ দূরত্বে থাকলেও সেটা ছোঁ মে’রে নিয়ে নেয়। সেখানে একই চুক্তিতে বারবার লক্ষ্যচুত হওয়ার কারণ কি? কেনই বা এরীশের এমন আচানক ব্যতিক্রম সিদ্ধান্ত? তাহলে কি এরীশ অন্য কোনো কৌশল অবলম্বন করতে চাইছে? নাকি…..
ভাবনার অতলে ডুবে যেতে যেতে সকল প্রশ্নের একটাই যোগসূত্র খুঁজে পেলো ডেনিয়েল, আর তা হলো একটা সাধারণ বাঙালি মেয়ে। এরীশের বারবার সিদ্ধান্তের বদল, কঠোর নিষেধাজ্ঞা প্রজ্ঞাপন আর শেষমেশ হান্ড্রেড মিলিয়ন রুবলের বিশাল গরমিল সবকিছু ওই একটা মেয়েকে ঘিরেই। মেয়েটা যদি এরীশের ব্যক্তিগত স্লাট হয়েও থাকে, তাও একটা সাধারণ স্লাটের জন্য এতোকিছু কেনো করবে এরীশ ইউভান? সে তো কখনো কারোর প্রতি দয়া দেখায় না? আর না তো নিজের স্বার্থের বাইরে গিয়ে কাউকে এতোটা গুরুত্ব দেয় কোনোদিন। তাহলে এই মেয়েটাই কেন?
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
একটা সাধারণ মেয়ের জন্য এরীশের এহেন আকস্মিক পরিবর্তন দ্বিধাগ্রস্থ করে তোলে ডেনিয়েলকে। না চাইতেও বারবার ওই মেয়েটাকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য হয় সে। চোখের সামনে এনে ছিঁ’ড়েখুড়ে বের করে আনতে ইচ্ছে করে মেয়েটার লুকায়িত সব গোপন রহস্য। কোন দেশের জাদুকরিনী সে ? কিইবা আশ্চর্য লুকিয়ে আছে তার মাঝে?কেন মেয়েটার তুলনায় চারিপাশের সবকিছু এতো মূল্যহীন? এরীশ ইউভান যে মেয়ের জন্য একশো মিলিয়ন অনায়সে বিলিয়ে দিতে পারে, পায়ে ঠেলে দিতে পারে ব্লাড ডায়মন্ডের মতো দূর্লভ রত্নখন্ড, সেই মেয়েকে তো ডেনিয়েলের কব্জাবন্দি হতেই হবে। সেটা হোক আজ কিংবা কাল। তাও যে কোনো মূল্যে মেয়েটাকে ওর চাইই চাই।
নির্ঘুম ক্রুর মস্তিষ্ক টা জুড়ে প্রশ্নের সমাহার। একেরপর এক রহস্যের জটিলতা ভেদ করে গন্তব্যে পৌঁছানো মুশকিল,সহসা চিন্তায় ভারী হয়ে আসা মাথাটা শূন্যে এলিয়ে দিয়ে দু’চোখ বন্ধ করে আরাম কেদারায় দুলছে ডেনিয়েল। ঠিক সেসময় টোকা পরার ঠকঠক আওয়াজ হলো দরজায়। কে এসেছে জানার আগ্রহ দেখালোনা সে । অগত্যা ভাবলেশহীন নিরেট কন্ঠে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিলো নির্দ্বিধায়,
—কাম ইন।
অনুমতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখমুখ শুকনো অবস্থায় দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে একজন গুপ্তচর। তার চালচলন সুবিধার নয়,বিমূর্ষ নতজানু মুখমণ্ডল দেখে মনে হচ্ছে বিশেষ কোনোকিছু নিয়ে শঙ্কিত সে। লোকটা ভয়ার্ত কদম ফেলে সামনে এগুলো খানিক, অতঃপর আড়ষ্ট কন্ঠে জানালো,
— কিছু দুঃসংবাদ ছিল।
— আপডেট?
আরাম কেদারায় দুলতে দুলতে প্রশ্ন ছোড়ে ডেনিয়েল। জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে শুষ্ক একটা ঢোক গিলে লোকটা বলে,
— ইনফরমেশন অনুযায়ী আমরা ক্লাব থেকেই মেয়েটার পিছু নিয়েছিলাম। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত গাড়িটা এরীশ ইউভান নিজেই ড্রাইভ করছিল। তাই তার সঙ্গে গতিপথের কৌশলে পেরে ওঠা যায়নি আর। অতঃপর যখন জঙ্গলের পথ ধরে পেন্টহাউজে এট্যাক করার পরিকল্পনা করলাম, সেখানেও ব্যাপক সুরক্ষা তৈরি করে রেখেছে পাইথন লিডার। কেবল গার্ড’স নয় একদল সাদা নেকড়ে রেখে দিয়েছে জঙ্গলের প্রবেশদ্বারে। যারা দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা একাধারে পেন্টহাউজের পাহাড়ায় কার্জরত। আমাদের লোকেরা পাইথন প্যারাডাইসের গার্ড’সদের সঙ্গে লড়তে জানলেও যথাযথ কৌশল এবং আত্নবিশ্বাসের অভাবে ওই হিং’স্র লকলকে ওয়্যার ওলফ গুলোকে ধরাশায়ী করতে অক্ষম হয়েছে। তাদের সামনে মেটালিক অ’স্ত্র গুলো কোনো কাজেই আসেনি। একের পর এক আকস্মিক আ’ক্রমনে পরাস্ত হয়েছে সকলে। ফলস্বরূপ নেকড়েদের কবল থেকে একজন গার্ড’স ও জীবিত ফিরে আসতে পারেনি আর ।
— তাহলে তুমি এখানে কি করছো?
এতোবড় একটা গোপনীয় মিশনের দফারফা হয়ে যাওয়ার পরেও নিশ্চল ভাবলেশহীন কন্ঠে প্রশ্ন করলো ডেনিয়েল। লিডারের এহেন প্রশ্ন শুনে আতঙ্কে ধড়ফড়িয়ে ওঠে লোকটা। গলার মাঝে আঁটকে থাকা সংশয়টুকু আড়াল করে জোর হস্তে কাকুতির স্বরে বলে,
— মাই লর্ড একটা সুযোগ দিন! শুধু একটা, এবার আর সুক্ষ্ম খামতি টুকুও অবশিষ্ট রাখবো না। আমি নিজে গিয়ে তুলে নিয়ে আসবো ওই মেয়েটাকে।
লোকটার কথায় ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো ডেনিয়েল, আরাম কেদারা ছেড়ে স্ফীত পায়ে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
— কোথাও শুনেছো মাফিয়ারা কাউকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেয়? এ পর্যন্ত যে’ই দূর্বলতার কাছে বশ্যতা স্বীকার করে সেকেন্ড চান্স দিয়েছে সেই ধ্বংস হয়েছে। ড্রাগন হান্টারকে কি এতোটাই বোকা মনে হয় তোমার ?
ডেনিয়েলের ধূর্ত কথার গাম্ভীর্য স্পাই লোকটাকে অযাচিত আতঙ্কে কম্পিত করে তোলার জন্য জন্য যথেষ্ট। সে থরথরিয়ে কাঁপছে, বাষ্পীয় জলকণিকার ন্যায় ঘামের তোড়ে ভিজে উঠেছে তার সমস্ত শরীর। সেভাবেই ভয়ার্ত ঢোক গিলে হাতজোড় করে কিছু একটা বলতে চাইলো ফের, ওর মুখ থেকে টুঁশব্দ বেড়িয়ে আসার আগেই, গর্জন করে আদেশ করলো ডেনিয়েল,
— নিলললল ডাউউউন।
কথার ক্ষুব্ধতা আঁচ করতে পেরে কয়েক সেকেন্ডের মাঝে হাঁটু ভাজ করে নতজানু হয়ে মেঝেতে বসে পরলো লোকটা। দ্বিতীয়বার কথা বলার সাহস করে উঠতে পারলো না আর। এপাশ ওপাশ ঘাড় ফোটানোর মটমট আওয়াজ ভেসে এলো বিপরীত দিক থেকে। অতঃপর কয়েক সেকেন্ডের মাথায় একটা দ্বিখন্ডিত ছিন্ন মস্তক চোখের সামনে ছিটকে পরলো তকতকে সফেদ মেঝেতে। ঝুপঝুপ করে বেরিয়ে আসা তাজা র’ক্তস্রোতে বন্যার মতো ভেসে গেলো পুরো ঘর। অগত্যা কামরার সামনে পাহারারত গার্ড’স গুলোর পা ভিজে ওঠে অযাচিত তরল পদার্থের স্পর্শে। শুকনো মেঝেতে হঠাৎ পানীয় এর উপস্থিতি টের পেয়ে কৌতুহল বশত মাথা নুয়িয়ে পায়ের দিকে সুক্ষ্ম দৃষ্টিপাত করে তারা। সঙ্গে সঙ্গে ভেতরের ঘটনা আঁচ করতে পেরে একই যোগে শরীর শিউরে উঠে চোখ মুখ ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করলো তাদের । দিশাহীন আতঙ্কের অতর্কিত ছাপ সুস্পষ্ট হলো দু’জনার মুখমণ্ডলে। তবে মুখ খুলে ‘রা’ করার সাহস পেলোনা কেউ আর, ভয়ার্ত ঢোক গিলে বিনাবাক্যে চোখাচোখি করলো কেবল।
স্পাই টার বীভৎস শরীরের দু অংশ ভে’ঙেচুরে ছড়িয়ে রয়েছে ঘরের দুই প্রান্তে। সেদিকে কোনো প্রকার ভ্রুক্ষেপ না করেই ভেজা টিশ্যুর সাহায্যে নিজের র’ক্তা’ক্ত মুখমণ্ডল পরিষ্কার করায় ব্যস্ত ডেনিয়েল।
পাইথন লিডারের সঙ্গে হেরে যেতে যেতে উদভ্রান্ত সে, চাইলেও ভেতর থেকে ক্রোধ দমানো মুশকিল। ঠিক এমন সময়,আঠালো র’ক্তস্রোত ডিঙিয়ে হন্তদন্ত পায়ে ভেতরে প্রবেশ করে ডেনিয়েলের বিশ্বস্ত স্পাই ফ্র্যাঙ্কি। ফ্যাঙ্কির ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ পেয়ে ঘাড় ঘোরায় ডেনিয়েল। চোখমুখে বিশেষ কপটতা ধরে রেখে নির্বিগ্নে বলে,
— আপাতত কোনো নেগেটিভ নিউজে আগ্রহ নেই, পরে এসো।
হাঁপাতে হাঁপাতে র’ক্তা’ক্ত ধাতব অ’স্ত্রটির দিকে এক পল নজর দিলো ফ্র্যাঙ্কি, অতঃপর শুষ্ক ঢোক গিলে ডেনিয়েলকে ধাতস্থ করে বললো,
— নিউজটা নেগেটিভ নয় মাই লর্ড। আই হোপ এটা আপনাকে আপনার লক্ষ্যে পৌঁছাতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করবে।
সরল কপাল কিঞ্চিৎ বেঁকে গেলো ডেনিয়েলের, সে কৌতুহলী স্বরে বললো,
— কি বলতে চাইছো?
— সেদিন ক্লাবের ওই নতুন স্লাট টা, যাকে কিনা হান্ড্রেড মিলিয়ন দিয়ে কিনেছিল পাইথন লিডার, ওই মেয়েটাই আসলে টমেটো প্রিন্সের বর্ণনাকৃত ব্লু আইড। যার জন্য ব্লাড ডায়মন্ড পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছে এরীশ ইউভান।
ফ্র্যাঙ্কিকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলো ডেনিয়েল। গম্ভীর স্বরে বললো,
— এসব জানি। অন্যকিছু বলো।
হ্যা সূচক মাথায় দুলিয়ে আবারও তড়িঘড়ি করে বলতে শুরু করে ফ্র্যাঙ্কি,
— সেদিন বারে পাইথন লিডারের একটা বিশাল ঝামেলা হয়েছিল Bratva এর সঙ্গে। কয়েকজন মাফিয়া মিলে ওই ব্লু আইড মেয়েটার লিক হয়ে যাওয়া ছবি নিয়ে মন্তব্য করছিল। তখনই হুট করে ওদের উপর অ’তর্কিত আ’ক্রমণ করে বসে এরীশ ইউভান। আই থিংক সে ড্রাংক ছিল, যার ফলে ওখানে গন্ডগোলটা জোড়ালো হয়। তবে সেখানে দাঁড়িয়ে সবচেয়ে বিস্ময়কর কাজটা করেছিল এরীশ ইউভান নিজেই।
— কি করেছিল?
আচানক স্বরে জিজ্ঞেস করলো ডেনিয়েল।
— এতোবড় একজন গ্যাংস্টার হওয়া সত্ত্বেও bratva এর নিয়ম ভঙ্গ করে বারের সকলের সামনে আচমকা শ্যুট করে দিয়েছিল মাফিয়া গুলোকে। একেতো একসঙ্গে এতোগুলা মা’র্ডা’র করেছে , তারউপর ক্রদ্ধস্বরে বিড়বিড় করে বলছিল,
— ওই মেয়েটা আমার, আমার সম্পদ, শুধু আমার।
— ব্যাস এটুকুই?
ডেনিয়েলের কথায় না সূচক মাথা নাড়ায় ফ্র্যাঙ্কি, কিছুটা চিন্তিত স্বরে বলে,
— এসব কাহিনীর পরে bratva এর লোকের সঙ্গে বসেছিল এরীশ। কিন্তু সেখানেও রেগেমেগে একই কথা বলে দেয় সে।
— কি বলেছে?
এরীশকে অনুকরণ করে গাম্ভীর্যের স্বরে বলতে শুরু করে ফ্র্যাঙ্কি,
— আমি যখন বলেছি মেয়েটাকে বেচবো না, তারমানে বেচবো না। ওই মেয়েটাকে সেফ রাখার জন্য শুধু bratva কেন পুরো আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে যু’দ্ধ বাঁধিয়ে দিতেও দ্বিধা করবো না আমি।
এটুকু বলে থামলো ফ্র্যাঙ্কি, অতঃপর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে কণ্ঠে কিছুটা আড়ষ্টতা টেনে বললো,
— পাইথন লিডারের কথার তীব্রতা শুনে মনে হয়েছিল ওই তুচ্ছ মেয়েটার জন্য সত্যি সত্যিই যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিবে সে। যদিও এরীশ ইউভান সেসময় নেশায় বুদ হয়ে ছিল, কিন্তু ওর ম্যান পাওয়ার সম্মন্ধে সবাই অবগত, তাই এতোগুলা মাফিয়া মা’র্ডা’রের পরেও যুক্তি তুলে ধরার সাহস দেখায়নি কেউ আর।
— কারণ এরীশ ইউভান কারোর যুক্তির পরোয়া করেনা তাইতো?
তপ্তস্বরে একাই বিড়বিড়ালো ডেনিয়েল, ফ্র্যাঙ্কি কিঞ্চিৎ আগ বাড়িয়ে শুধালো,
— মাই লর্ড, কিছু বললেন?
উদাসীন হয়ে না বোধক মাথা দোলায় ডেনিয়েল,প্রতিহিংসায় জ্বলতে থাকা গভীর চোখ দু’টো ছোট হয়ে আসে ধূর্ততায়। হাতের কাছের ধারালো অ’স্ত্র’টা থেকে শুকিয়ে যাওয়া র’ক্তের বান মুছে দিতে দিতে বলে,
— আই থিংক আমি এরীশ ইউভানের দূর্বলতার হদিস পেয়ে গিয়েছি ফ্র্যাঙ্কি। ইউ নো আই লাভ হান্টিং। এবার শুধু মেয়েটাকে হান্ট করার পালা। আর তারপর হবে আসল প্রতিশোধ। এরীশ ইউভান ঠিক যতটা কষ্ট দিয়ে মে’রছে আমার বেবিগার্লকে, তার চাইতেও হাজার গুন অধিক য’ন্ত্রনা দিয়ে তিলে তিলে মৃ’ত্যু দেবো আমি ওই মেয়েটাকে। ওর দূর্বলতা দিয়ে ওকে আমি এমন ভাবে ভাঙবো ঠিক যেমন ভাবে হ্যামার দিয়ে পাথরের টুকরো গুলোকে পিষ্ট করা হয়। আর তারপর পুরো রাশিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে পাইথন প্যারাডাইস। রাশিয়াতে শুধুমাত্র একটা টেরোরিস্ট গ্রুপের অস্তিত্ব থাকবে আর তা হলো ড্রাগন হান্টার।
কোনো এক অজ্ঞাত কারণ বশত আজ খুব সকালে ঘুমিয়ে গিয়েছিল এরীশ। নেশার ঘোরে বুদ হয়ে থাকা মেয়েটার পাগলামি দেখতে দেখতে কখন যে রাত গড়িয়ে গিয়েছে সেই হদিস ছিল না ওর। ভোরে ভোরে যখন অভিযোগের দুয়ারে তালা দিলো ঈশানী, অজান্তেই ঘুমিয়ে পরলো অপ্রিয় পুরুষের নির্জীব বক্ষস্থলে, তখন এরীশ নিজেই কোলে তুলে রুমে দিয়ে আসে মেয়েটাকে।
দ্বিপ্রহরের শেষ আলো টুকু উবে গিয়ে কুয়াশায় ঢাকা পরেছে প্রকৃতি। দিগন্ত জুড়ে ফুরিয়ে এসেছে ধূসর গোধূলির ল্যাপ্টানো নিয়ন সূর্যশিখা। জঙ্গলের আকাশে নামহীন পাখিদের ঘরে ফেরার ঢল, ঠিক এমন মূহুর্তে ঘুম ভাঙে এরীশের। চোখের দৃশ্য পুরোপুরি স্পষ্টত হওয়ার আগেই নাকের গহ্বরে এসে হানা দেয় ভ্যানিলার এক মিষ্টি স্নিগ্ধ সুবাস।কিয়ৎক্ষন নাক টেনে সুঘ্রাণের অস্তিত্ব নিশ্চিত করতেই এরীশের সিক্সসেন্স জানান দিলো এই সুবাস ওর পরিচিত।
এতো কাছ থেকে পরিচিত সুঘ্রাণের উৎস খুঁজতে চকিতে চোখ খোলে এরীশ। রুম জুড়ে বিষণ্ণ আঁধারের মাঝে বিছানা হাতরে খুঁজে পায় একটা শিফনের পাতলা ওড়না।
সহসা নিজের শক্ত পুরুষালি হাতে ওড়নাটা ছোঁ মে’রে তুলে নিলো এরীশ, বাইরের নিভে যাওয়া গোধূলির টিমটিমে ঝাপসা আলোয় সেটাকে পরখ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো নীরবে। অজ্ঞাত ওড়নার দিকে চেয়ে বিরস মুখে বলে উঠলো,
— তোমাকে বারবার ওয়ার্ন করেছিলাম। বলেছিলাম আমার মস্তিষ্ক থেকে বেড়িয়ে যেতে, কথা শুনোনি। উল্টো দিগুণ সাহস দেখিয়ে বুকে এসে গেড়ে বসেছো? আমার দূর্বলতায় পরিনত হতে চাইছো,কিন্তু কেন? আমাকে এভাবে ধ্বং’সের অভিমুখে ঠেলে দিয়ে কি মজা পাচ্ছো তুমি?
ওপাশের ফিনফিনে নরম কাপড় খন্ড থেকে জবাব আসেনা কোনো, মাফিয়া বস পুনরায় তীর্যক দৃষ্টি ফেলে বলে,
—আমাকে পুরোপুরি বশ করতে চাইলে তোমাকে আমার হতে হবে। সামিল হতে হবে ধ্বং’সলীলায়,কিন্তু তুমি যে পবিত্র। তোমার পবিত্রতাটুকু বরাবরই আকর্ষিত করে আমায়, দ্বিধাগ্রস্থ করে তোলে আমার হৃদয়হীন সত্তটাকে, কিন্তু এটাতো আমি চাইনি। কেন বারবার চোখের সামনে এসে, নিজের ইনোসেন্ট ব্লু আইস দেখিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগাও তুমি আমায়?
এরীশের ব্যতিগ্রস্থ ভাবনার ছেদ ঘটে ওপাশে দরজায় কড়া নাড়ার তীব্র আওয়াজে। তুষার ব্যতীত কেউ নয়, তা বোধগম্য হতেই হাতের কাছের ওড়নাটা আড়ালে সরিয়ে ওকে ভেতরে আসার অনুমতি দেয় এরীশ।
অনুমতি পেয়ে ব্যগ্র কদমে ভেতরে প্রবেশ করতেই তুষার দেখলো শরীরে শার্ট চড়াচ্ছে সে, এরীশকে কিয়ৎক্ষন পর্যবেক্ষন করে ভরাট গলায় তুষার বলে,
— ব্লাড ডায়মন্ড মিশনের জন্য আমরা এখন পুরোপুরি প্রস্তুত এরীশ।
কালো শার্টের ওপর কালো ওয়েস্ট কোট আর ক্রোকোডাইল লেদারের ঘড়িটা কব্জিবন্দি করে ডিভানের উপর থেকে ওভার কোট আর লোড করা রিভলবার টা ছোঁ মে’রে নিয়ে বেড়িয়ে পরে এরীশ। করিডোর ধরে যেতে যেতে বলে,
— ব্লাড ডায়মন্ড মিশন ইজ ইম্পর্ট্যান্ট। বাট দেয়ার ইজ সামথিং মোর ইম্পর্ট্যান্ট দ্যান দ্যাট।
এরীশের পথ অনুসরণ করে এগুচ্ছিল তুষার । হঠাৎ করে মাফিয়া বসের এহেন সিদ্ধান্তে থমকালো সে। তুষারকে দাঁড়িয়ে পরতে দেখে এরীশ পেছনে না ঘুরেই এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
— আই নিড চেরিব্লোসম। আপাতত চেরিব্লোসমের বাগান খুঁজে বের করো।
এরীশের কথায় এবার সত্যি সত্যি ভ্রু কুঁচকালো তুষার। চোখে মুখে নিদারুণ বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট তার,সেভাবেই কণ্ঠে একরাশ অনীহা নিয়ে বললো,
— এখনো ডিসেম্বর মাস শেষ হলোনা, এর মাঝে চেরিব্লোসম কোথায় পাবো?
— দ্যাট’স নান অফ মাই বিজনেস। যেখান থেকে খুশি বের করো, দরকার পরলে আর্টিফিশিয়াল গার্ডেন তৈরি করো, বাট আই নিড চেরিব্লোসম।
কথা শেষ করে লম্বা পা ফেলে সামনের দিকে হেটে চলে যায় এরীশ। ওদিকে একই জায়গাতে স্থির দাঁড়িয়ে হতাশায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তুষার। এরীশের হুটহাট সিদ্ধান্তে আজকাল বড্ড চিন্তায় পরে যায় তুষার। মাফিয়া বসের ক্রেজিনেস সম্মন্ধে যথেষ্ট ধারণা রয়েছে ওর, কিন্তু এই উদভ্রান্ত আচরণের নেপথ্যে যদি থাকে অতিব সাধারণ একটা মেয়ে তখন মস্তিষ্কের সবকিছুকে ছাঁপিয়ে যায় তীব্র দুশ্চিন্তার পাহাড়।
পেন্টহাউজ থেকে সরাসরি গাড়ি নিয়ে বেড়িয়েছে এরীশ। গন্তব্য মাফিয়া ক্লাব, স্টিয়ারিং এর পাশে অযত্নে পরে আছে ব্ল্যাক স্পেসোর অন-টাইম জার। কেন যেন আজ আর এতো তুষারপাতের মাঝেও কফি পান করায় মনোযোগ নেই ওর। মস্তিষ্কটা গন্তব্যের দিকে স্থির থাকলেও হৃদয়টা পরে আছে বালিশের পাশে এলোমেলো হয়ে পরে থাকা একটুকরো শিফনের ওড়নায়।
ওই ভ্যানিলা ফ্লেভারের মিষ্টি সুবাস টা ক্রমাগত তাড়া করে বেড়ায় ওকে, বারবার মনে করিয়ে দেয় গত রাতের পুঙ্খানুপুঙ্খ সব ঘটনা গুলো। কাল নিজের অজান্তেই অন্তঃকরণ গতি হারিয়েছিল ওর,ঝোড়ো হাওয়ার মতো অনুভূতির টানাপোড়েনে মেয়েটাকে সম্মোধন করেছিল অতিব প্রিয় সেই ছোট্ট ডাকনামে।
— সাকুরা!
কালকের মতো করে আজ দ্বিতীয়বারের মতো একই শব্দ আওড়ালো এরীশ, একহাতে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিড়বিড়ালো ফের,
— আই উইশ কাল তোমার জায়গায় আমি ড্রাংক থাকতাম। পুরো পৃথিবীকে না জানিয়ে তোমাকে ঘিরে তৈরি হওয়া নিষিদ্ধ সব অনুভূতি গুলো তোমার কাছেই উগড়ে দিতে পারতাম।
মনের কথায় ফিচেল হাসলো এরীশ।
নীলাম্বরীর ভাবনায় বিভোর হয়ে স্পিডোমিটারের কাটা শ’য়ের ঘরে নিয়ে গেলো অনায়সে। উদভ্রান্তের মতো গাড়ি চালাতে চালাতে দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
— আমার মস্তিষ্ক থেকে বেড়িয়ে যাও। কি চাইছো কি তুমি? পা’গল বানিয়ে ছাড়বে নাকি আমায়? তোমার হাসি, তোমার ওই ব্লু আইস সারাক্ষণ পো’ড়ায় আমাকে। ভুলিয়ে দেয় নিজের সর্বগ্রাসী অস্তিত্বকে। মাফিয়া বস এরীশ কখনো দূর্বলতা অনুভব করে না, করতে পারেনা। তাহলে কেন সারাক্ষণ তোমায় নিয়ে ভাবছি আমি?একটা মূহুর্তের জন্যও কেন মাথা থেকে বের হতে চাইছো না, কেন সারাক্ষণ ভেসে বেড়াচ্ছো দু’চোখে? আমার মতো মানুষের কাছ থেকে আর কি চাওয়ার আছে তোমার?
ভীষণ গর্জনে শেষ কথাটা উচ্চারণ করে অকস্মাৎ মাঝরাস্তায় ব্রেক কষলো এরীশ। ওর এহেন কান্ডে থমকে গেলো পুরো হাইওয়ে। মূহুর্তেই চারিদিক দিক থেকে ধেয়ে আসে বিভীষিকাময় হর্ণের বিরক্তিকর আওয়াজ।
আপাতত পুরো দুনিয়া থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে এরীশের উদভ্রান্ত মস্তিষ্কটা। কে কি বললো, কে কি করলো সেসবে বিন্দুমাত্র হুশ নেই ওর।
পুরো শহরটাকে এক পলকে থামিয়ে দিয়ে দু’হাত স্টিয়ারিং এ রেখে মাথাটা আস্তে করে ব্যাকসিটে এলিয়ে দিলো এরীশ। মাত্রাতিরিক্ত ক্রোধের ফলস্বরূপ হাঁপড়ের মতো ওঠানামা করছে ওর ইস্পাত কঠিন বক্ষস্থল। সেভাবেই স্থির থেকে চোখ দু’টো বুজে গভীর নিঃশ্বাসের তালে কাতর স্বরে ভীত স্বন্ত্রস্ত মেয়েটার কাছে অনুরোধ করে বসলো মাফিয়া বস,
— সাকুরা, প্লিজ লিভ মি এ্যালোন।
সুন্দর একটা রোদ্রজ্জল বিকেল। তাপমাত্রা আজ মাইনাস পেরিয়ে টু ডিগ্রি সেলসিয়াস। এতেই যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে পুরো শহর। চারিদিকে ম ম করছে চেরিব্লোসমের মিষ্টি সুবাস। আজ এতোদিন বাদে তুষারে ঢাকা মৃ’ত্যুপুরির ন্যায় পেন্টহাউজ থেকে বেড়িয়ে মন দুলে উঠেছে ঈশানীর। তবে দোদুল্যমান এই মনটাকে খুব বেশি আস্কারা দেওয়ার সাহস করে উঠতে পারলো না নীলাম্বরী, কারণ ওর পাশেই পার্কের লন ধরে হাটছে এরীশ।
আজ হঠাৎ করেই একজন গার্ড পাঠিয়ে ঈশুকে পেন্টহাউজের বাইরে ডেকে পাঠায় এরীশ। প্রথমে তো ভয় পেয়ে গেটের সামনে বসেই অসহায়ের মতো কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিল নাজুক মেয়েটা। পরে যখন বুঝতে পারলো পরিস্থিতি বেশ স্বাভাবিক, তখন কিছুটা আস্বস্ত হয়ে গিয়ে উঠেছে গাড়িতে।
সেই যে গাড়িতে উঠেছে, তারপর থেকে এখন পর্যন্ত ঈশানীর সঙ্গে একটা টু শব্দ ও করেনি এরীশ। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, কেন নিয়ে যাচ্ছে, কবে ফিরবে কিছুই না। ওর গম্ভীর চেহারা আর তিরিক্ষি মেজাজের দিকে পরখ করে, আগ বাড়িয়ে আর প্রশ্ন করার সাহস পায়নি ঈশানী।
কিন্তু সারা বেলা ড্রাইভ করে অবশেষে এরীশ যখন এই চেরিব্লোসমের বাগানে এসে থামলো, তখন না চাইতেও কৌতুহলের পারদে নিশপিশ করে উঠলো ঈশানীর ভেতরটা। বাগানটা ছিল পার্কের সঙ্গে লাগোয়া, মাঝখানে সুন্দর লন, সেই লন ধরে চলে গিয়েছে মসৃণ পিচঢালা এক দীর্ঘরাস্তা।
আপাতত চারিদিকের সৌন্দর্য আহরণ করতে করতে রাস্তা ধরে হাটছে ঈশানী। ভেতরটা উৎফুল্ল তবে নিশ্চিন্ত নয়।কারণ এরীশের ভাবভঙ্গিমা বুঝে ওঠা বেজায় মুশকিল। সহসা পিছু হাটতে হাটতে সামনে এগিয়ে যাওয়া ব্রাউন ওভারকোট আর কালো মাস্ক পরিহিত এরীশকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্নটা করেই বসে ঈশানী,
— এখানে কেন নিয়ে এলেন?
— কাজ আছে আমার।
হাটতে হাটতেই রাশভারি আওয়াজে জবাব দিলো এরীশ। ওর প্রতুত্ত্যরে সন্তুষ্ট হতে পারলো না কৌতূহলী মেয়েটা, ফলস্বরূপ আবারও বলে ওঠে,
— আপনার কাজ আছে তাহলে আমাকে কেন…
বাক্য শেষ করতে পারেনা ঈশানী, তার আগেই গতি স্থির করে ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করে এরীশ। লোকটার তীরের ফলার তীর্যক চাহনিতে ছ্যাত করে ওঠে ঈশানীর বক্ষপিঞ্জর। সূর্যকীরণে ঝিলিক দেওয়া নীল চোখ দু’টো ভয়ের তোড়ে নামিয়ে নেয় অকস্মাৎ। ভীতু মেয়েটাকে আরও সংকুচিত হয়ে যেতে দেখে চোখের দৃষ্টি পাল্টালো এরীশ, তপ্তস্বরে বললো,
— এতো কৈফিয়ত দিতে পারবো না, প্রয়োজন হয়েছে তাই নিয়ে এসেছি। তাছাড়া এখানে ভয় পাওয়ার মতো কিছুই হয়নি। ফিল ফ্রি।
মুখের কালো ভাব মূহুর্তেই উবে গেলো ঈশুর। ও এগিয়ে গিয়ে এরীশের থেকে আরেকটু দূরত্ব ঘুচিয়ে মিনমিনিয়ে বললো,
— যদি একটু বাগানটা ঘুরে দেখা যেতো। আসলে এর আগে কোনোদিন চেরিব্লোসম দেখিনি আমি।
— ইউ ক্যান।
এতোটুকুতেই ভেতর ভেতর আনন্দের ঢেউ খেলে গেলো ঈশানীর। তবে অন্তর্মুখী হওয়ার দরুন মুখের আদলে প্রভাব পরলো না খুব একটা। শুধু দ্রুত কদমে সামনে এগিয়ে গেলো এরীশকে ছাড়িয়ে। ঈশানী সামনে এগিয়ে যেতেই কাউকে কল দিয়ে কানে এয়ারপড গুঁজলো এরীশ। ওপাশ থেকে কল তুলতেই উদ্বিগ্নস্বরে বললো,
— ফুল গুলো সব আর্টিফিশিয়াল ঠিক আছে, কিন্তু চেরিব্লোসমের ন্যাচারাল গন্ধটা কিভাবে এডজাস্ট করালে?
ওর কথার পাছে ওপাশের ব্যক্তিটি ঠিক কিরূপ প্রত্যুত্তর করেছিল তা আর শুনতে পায়নি এরীশ। তার আগেই ওর সামনে এসে হাজির হয় মনে শিহরণ জাগানো সেই সরলতায় ঘেরা ভীত রমনী। তৎক্ষনাৎ রমনীর দু’চোখের মাঝে থমকে যায় মাফিয়া বসের সমগ্র পৃথিবী, মেয়েটা হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে, কিন্তু কি চায় সে? সবেগে ফোন কাটলো এরীশ। কান থেকে এয়ারপড খুলে ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলো,
— হাত পেতেছো কেন? কি চাই?
— টাকা দিন, আমার কাছে রাশিয়ান টাকা নেই।
হঠাৎ করে মেয়েটার এতো জড়তা কোথায় উবে গেলো আজ? আশ্চর্য হলো এরীশ। তবে চোখেমুখে স্পষ্ট গাম্ভীর্যতা ধরে রেখে বললো,
— টাকা দিয়ে কি করবে?
তৎক্ষনাৎ আঙুলের ইশারায় পার্কের এককোণে দাঁড়িয়ে থাকা আইসক্রিম ভ্যানটাকে দেখালো ঈশানী, বললো,
— আইসক্রিম খাবো। আমাদের দেশে রিকশা ভ্যানে করে আইসক্রিম বিক্রি হয়, আর এখানে কাভার্ডভ্যানে। কি অদ্ভুত!
এরীশ টাকা দিলোনা ঈশানীকে। গটগটিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে জানালো,
— এসো দেখছি।
চারিদের মৃদুমন্দ হাওয়া আর চেরিব্লোসমের স্নিগ্ধ সুবাস টুকু উপভোগ করতে করতে কুণ্ঠিত পায়ে সামনে এগুলো ঈশানী। পুনরায় কারোর সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত হলো এরীশ। ওদিকে কাভার্ডভ্যান থেকে কেউ আইসক্রিম ও এগিয়ে দিলোনা ঈশুকে, ফলস্বরূপ কিঞ্চিৎ সাহস দেখিয়ে এরীশকে আরও একবার বিরক্ত করার পায়তারা করে অধৈর্য মেয়েটা। দু’কদম পিছিয়ে এসে এরীশের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে,
— কি হলো কিনে দিন?
ঈশানীর কথায় কপাল জুড়ে অজ্ঞাত ভাজ আটলো এরীশ, ভাবলেশহীন কন্ঠে সামনের ভ্যানটাকে দেখিয়ে বললো,
— এই যে।
— এই যে মানে?
ভ্রু কুঁচকে এলো ঈশানীর। ওর কথার পাছে পুনরায় কানে এয়ারপড গুঁজতে গুঁজতে জবাব দিলো এরীশ,
— পুরো ভ্যানটাই কিনেছি, যত খুশি খাও।
— কিহ!
হতবিহ্বল হয়ে সজোরে শব্দটা বেড়িয়ে এলো ঈশানীর হা হয়ে যাওয়া মুখগহ্বর ভেদ করে । এরীশ এগিয়ে যাচ্ছে,ওর যাওয়ার পানে চেয়ে মেয়েটা চ্যাঁচিয়ে উঠে বললো,
— কিন্তু এতোগুলা আইসক্রিম কি করবো আমি এখন?
— এরীশ কখনো অংশীদার বর্দাস্ত করেনা, যেটার প্রয়োজন হয় পুরোটাই দখল করে নেয়।
পেছনে না ঘুরেই জবাব দিলো এরীশ।
এমন একটা উদ্ভট লোকের কাছে আইসক্রিম চেয়ে যে কি বড় পাপ করে ফেলেছে, তা ঠাওর করতে পেরে মনেমনে কপাল চাপড়ালো ঈশানী। মুখের মাঝে বিরক্তির ভাজ টেনে অসহায় স্বরে বললো,
— তাই বলে পুরো একটা কাভার্ডভ্যান?
জবাব দেয়না এরীশ। নিজের মতো করে হেটে চলে যায় সামনের দিকে। ঈশানী আর কিইবা করবে, যতগুলো পারলো ব্যাগভর্তি করে দু’হাতে তুলে নিলো। বাদ বাকি আইসক্রিম গুলো সব বিলিয়ে দিলো পার্কে খেলে বেড়ানো বাচ্চাদের মাঝে। তারপর আবারও হাটা ধরলো নির্দয় লোকটার পিছু পিছু।
একহাতে আইসক্রিমের প্যাকেট গুলো নিয়ে অন্যহাতে মিন্ট ফ্লেভারের একটা আইসক্রিম খেতে খেতে হাঁটছে ঈশানী। ওর পেছনেই কনফারেন্স কলে কথা বলতে বলতে সামনে এগুচ্ছিল এরীশ। যদিও মোবাইলের অপর প্রান্তে একটা বিরাট ডিল নিয়ে বাকবিতন্ডা হচ্ছে, তবে তার দিকে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই এরীশের। কনফারেন্স তো একটা অজুহাত মাত্র। ও তো কেবল আড় চোখে এই মেয়েটাকেই দেখছে। বুকের মাঝে একরাশ জমানো কষ্ট নিয়ে ব্যথিত মুখে দিনাতিপাত করা এই মেয়েটাকে আজ আনন্দিত দেখাচ্ছে। ওর বোকা বোকা আবদার , অদৃশ্য খোলসের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে কিছুটা উৎফুল্ল হওয়ার প্রচেষ্টা কোনোকিছুই নজর এড়ায়নি এরীশের।
সেদিন যখন অবচেতন মেয়েটাকে রুমে শুয়িয়ে দিয়ে এসেছিল ও, তখনই দু’চোখের দৃষ্টি আর্কষন করেছিল স্টাডি টেবিলের উপরে রাখা ছোট্ট একটা চিরকুট। যাতে লেখা ছিল,
— চেরিব্লোসমের একটা বিকেল হোক আমার, স্বপ্ন পূরণের জন্য একটা নিজের মানুষ আর একমুঠো সতেজ খুশি।
এরীশ জানেনা এই কাব্যিক কথার সারমর্ম। বুঝেও উঠতে পারেনা খুব একটা। তবে ও এটুকু ঠিকই ধরতে পেরেছিল যে, ঈশানী চেরিব্লোসম দেখতে চায়। আর আজ এই প্রথমবার এরীশ সেটাই করেছে যেটা ও নয় বরং অন্যকেউ চায়।
অন্তহীন ভাবনার অনলে বিভোর থেকে এরীশের মন ব’লে,
— আমি জানিনা কেন এই অন্তর্দহন। আমার মতো একটা গন্তব্যহীন পাপী হৃদয়ের আনাচকানাচে কেন তোমার এতো অবাধ বিচরণ। কেন অন্ধকার কালকুটের পাপের সম্রাটের মনের সম্রাজ্ঞী চেরিব্লোসমের মতো একটা পবিত্রসত্তা সেটাও জানা নেই আমার? তোমার পবিত্রতাকে ভয় পাই আমি সাকুরা। এসে বুক চিঁড়ে দেখে যাও, মাফিয়া বস এরীশ কুণ্ঠায় নতজানু। ভালোই তো ছিলাম আমার চিরাচরিত এই কালো দুনিয়ার শোষন আর প্রতিপত্তি নিয়ে। তবে হঠাৎ করে কেন বাঁধালে এই ঝড়? অঙ্গারের মতো জলন্ত জীবনে হুট করে শীতল জলধারা বয়িয়ে দিয়ে কেনো দেখালে এই অদৃশ্য মায়ার লোভ? এখন যে আমার তোমাকে চাই, তোমাকেই চাই!
সে-সময় এরীশের ভাবনার জগৎ ছাপিয়ে ভেসে আসা দু’টো গানের লাইন ছিল ঠিক এমন,
— তোমার নামে রোদ্দুরে
আমি ডুবেছি সুমুদ্দুরে
জানিনা যাবো কতদূরে এখনো…
আমার পো’ড়া কপালে
আর আমার সন্ধে সকালে
তুমি কেন এলে জানিনা এখনো….
ফন্দি আঁটে মন পালাবার
বন্দি আছে কাছে সে তোমার…
যদি সত্যি জানতে চাও
তোমাকে চাই, তোমাকে চাই,
যদি মিথ্যে মানতে চাও
তোমাকেই চাইইই….
প্রাণোচ্ছল মেয়েটাকে দেখতে দেখতে কখন যে ভবঘুরে হয়ে এরীশ ওর অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছিল সে কথা বলা বাহুল্য।
আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২২
তবে সুন্দর সাজানো এই একচিলতে বিকালটাকে চোখের পলকে যু’দ্ধক্ষেত্র বানিয়ে দিলো অজ্ঞাত কিছু মুখোশধারী আ’ক্রম’ণকারী। হুট করেই কোথা থেকে যেন বিকট আওয়াজ তুলে ঈশানীর দিকে ছুটে আসে চকচকে রুপোলি রঙা একটা ধাতব বুলেট। তবে হাওয়ার বেগে ছুটে আসা তীর্যক বুলেটটা ঈশুর বক্ষভেদ করার আগেই ওকে একটানে ঘুরিয়ে নিজের কাছে টেনে আনে এরীশ। আকস্মিক ঘটনায় ভয়ে জর্জরিত হয়ে ঈশানীও দু’হাতে জাপ্টে ধরে এরীশকে। অতঃপর প্রথমবারের মতো সজ্ঞানে আলিঙ্গন হয় দুজনার।ভয়ের তোড়ে দু’টো উদভ্রান্ত দেহের মাঝে চুল পরিমাণ দূরত্বও অবশিষ্ট থাকেনা আর।