আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২৪

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২৪
suraiya rafa

এক পশলা শীতল হাওয়া এসে উড়িয়ে নিয়ে গেলো বিকেলের মরচে পরা নরম রোদ। ধূসর গোধূলির লালিমা ছাপিয়ে প্রকৃতিতে ভর করেছে কুয়াশা মোড়ানো অপার সন্ধ্যা বেলা। বিশাল আকাশের বক্ষচিড়ে ঝুমঝুমিয়ে নেমেছে তুষারের বর্ষণ। হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা হাওয়ায় চেরিব্লোসমের গাছ গুলো দোল খাচ্ছে নীরবে ।
নিরবিচ্ছিন্ন পিচঢালা রাস্তার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এরীশ। যার চোখেমুখে জড়ো হয়েছে পাশবিক হিং’স্র’তা।ক্রোধের তোড়ে মটমট করছে ধারালো চোয়াল। ধূসর বাদামি চোখ দু’টোতে ঘনীভূত আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত।
তড়িৎ বেগে বু’লেট টা ছুটে আসার সঙ্গে সঙ্গে ঈশুকে বুকে চেপে ধরে এরীশ। অকস্মাৎ ঘটনায় সচকিত হয়ে ওঠে ওর প্রতিটি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়, বুলেটের গতি পথে বাজপাখির মতো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মাত্রাতিরিক্ত রাগে থরথর করে কেঁপে ওঠে মাফিয়া বস। যেন রক্তিম চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে এক্ষুণি ছিঁ’ড়ে বের করে নিয়ে আসবে আ’ক্র’মণকারীর অকুতোভয়ী হৃদপিন্ডটা। ভস্ম করে দিবে তার অ’স্ত্র ধারিত কুটিল হাতের প্রতিটি শিরা উপশিরা।
অথচ ওর পৈশাচিক মস্তিষ্ক জুড়ে ভলভলিয়ে বেড়ে ওঠা তীব্র ক্রোধ আর হিং’স্র’তাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে কড়াপড়া হৃদয়ে বহমান মন্থর শিথিলতা। জীবনে প্রথমবার, ফর দ্য ফার্স্ট টাইম এমন বেগতিক দোটানার সাক্ষী হয়েছে ব্লাডিবিস্ট খ্যাত হৃদয়হীন মাফিয়া বস ।

চোখের সামনে শ’ত্রুদের মিছিল। অথচ এক তীক্ষ্ণ অনুভূতির জোয়ারে ভাসছে অন্তঃকরণ। তুলতুলে নরম শীর্ণকায় নারী শরীরের সংস্পর্শে স্তম্ভিত এরীশ। যখন মনে পরে এই ধনুকের মতো বাঁকানো ছোট্ট নারী দেহের অধিকারীনি অন্য কেউ নয়, স্বয়ং নীলাম্বরী তখনই থমকে যায় পৃথিবী। গতি হারায় হৃদস্পন্দন। ভেতরের দাবিয়ে রাখা সুপ্ত য’ন্ত্রণাগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে অর্হনিশ। ভয়ের তোড়ে তিরতির করে কাঁপছে নাজুক মেয়েটার সমগ্র শরীর,অজান্তেই মুখ দাবিয়ে রেখেছে নিষ্ঠুর মাফিয়ার ইস্পাত কঠিন বক্ষ ভাঁজে। দু’হাতে খামচে ধরেছে পিঠের দিকের ওভার কোটটা। হাতে থাকা আইসক্রিম গুলো ছিটকে পরে গড়াগড়ি খাচ্ছে পায়ের কাছে।
এরীশের শূন্য দৃষ্টিতে জমে আছে ক্রোধের পাহাড়। হৃদয়ে তার অনুভূতির তুফান। অথচ অভিব্যক্তি অত্যন্ত স্বাভাবিক। ওভার কোট সরিয়ে দু’হাত গুঁজেছে পকেটের ভেতর। বুকের মাঝখানে ভ্যানিলার মতো লেপ্টে আছে নাজুক তুলতুলে মেয়েটা। এরীশ না তো মেয়েটাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরছে বুকে, আর না তো নিজের থেকে সরিয়ে দিচ্ছে দূরে । কেবল বিনাবাক্যে পবিত্র মেয়েটার ভয়টুকু কে
গুটিয়ে নিচ্ছে আলগোছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তবে আ’ক্র:মণের পরে চারিদিকের এমন নীরবতা, হঠাৎ করে পার্কের গেইট বন্ধ হয়ে যাওয়া, সবকিছুই এরীশের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়তে দিয়ে যাচ্ছে আকস্মিক গেরিলা আ:ক্রম’ণের নিদারুন পূর্বাভাস।
দু মিনিট, মাত্র দু মিনিট ও ভাবনার সুযোগ পেলোনা এরীশ। পরমূহুর্তেই চারিপাশ থেকে ছুটে আসে শটগানের একাধিক বজ্রধ্বনি। ততক্ষনাৎ ঈশানীকে নিয়ে আইসক্রিম ভ্যানটার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায় এরীশ। এহেন নৃ’শংস অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পরে মুখ চেপে ধরে হুঁ হুঁ করে কেঁদে ওঠে ভীত মেয়েটা। কোমরের খাঁজ থেকে রি’ভলবার বের করে আড়াল থেকে শত্রুদের উদ্দেশ্য কয়েক দফা গু’লি ছুড়ে ঈশুর দিকে ঘুরে তাকায় এরীশ। গ্রীবা বাড়িয়ে ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে ঠোঁটের ডগায় আঙুল চেপে ধরে বলে,
— হুশশশশশ!

হৃদয়হীন লোকটার কঠোর নির্দেশে থেমে যায় ঈশু। কান্নার তোড় কমে এলে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হেঁচকি তোলে ক্রমশ।
শ’ত্রুদের মোকাবিলার মাঝেও আরেকবার নিস্প্রভ দ্বিধাহীন নজরে ক্রদনরত মেয়েটার মুখাবয়ব পরখ করলো এরীশ। ল্যামপোষ্টের আবছা আলোয় দেখতে পেলো ঠান্ডায় জমে র’ক্তিম হয়ে ওঠা একটা কান্নারত মুখ। ফোলা ফোলা অভিমানী নীল চোখ। পেজা তুলোর মতো বরফের আচ্ছাদনে ভরে ওঠা এলোমেলো সর্পিল চুল।প্রচন্ড শীতে জবুথবু মেয়েটার শ্বাসপ্রশ্বাস থেকে বেড়িয়ে আসছে শ্বেত রঙা শীতল বাষ্প। যা দেখা মাত্রই নিজের পরনের ওভার কোটটা খুলে ওর দিকে বাড়িয়ে দেয় এরীশ।
চোখের সামনে ওভার কোট দেখতে পেয়ে ওর দিকে প্রশ্ন সূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঈশানী। এদিক ওদিক সচকিত দৃষ্টি ফেলে মেয়েটার চাউনী সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে রাশভারি কঠোর আওয়াজে এরীশ বলে ,

— হারিআপ।
ঈশানী বাকবিতন্ডা করলো না আর, ঠান্ডায় জমে আসছে হৃদপিণ্ড। যার দরুন ভয়ে ভয়ে হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিলো উষ্ণ পোশাকটা। এরপর সেটাকে গায়ে চড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো আড়ালে। কোনো এক অযাচিত কারণ বশত একহাত দিয়ে ওর মাথার উপর হুডিটা টেনে দেয় এরীশ, তাতক্ষণিক বিকট আওয়াজে কেঁপে ওঠে পুরো ধরণি। অ’গ্নিশিখার পারদে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে চেরিব্লোসমের সুন্দর বাগানটা। আচানক অ’গ্নিকা’ণ্ডে কানে হাত দিয়ে নিচে বসে পরে ঈশানী,দুনিয়ার হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে কেঁদে ওঠে হাউমাউ করে। অথচ এতোকিছুর পরেও কোনোরূপ ভাবান্তর দেখা গেলোনা এরীশের মাঝে। ওর অভিব্যক্তি নিস্প্রভ, কানে লাগানো এয়ারপডটা সচল রেখে কাউকে জোর হুকুমে আদেশ করলো সে,

— আই ওয়ান্ট অল অফ দেম ইন মাই বেজমেন্ট।বি এ’লার্ট! একজন ও যাতে পালাতে না পারে।
এরীশের কথার পাছে ওপাশ থেকে কি প্রত্যুত্তর ভেসে এলো তা আর শোনা হলোনা ঈশুর। তার আগেই ওর দৃষ্টি গোচর হলো একটা খরখরে পুরুষালি হাত, আঙুল বেশ লম্বা, কালো রঙের ট্যাটু ব্যতিত অন্ধকারের মাঝেও গৌড় বর্ণের শিরা উপশিরা গুলো স্পষ্ট দৃশ্যমান।
হাতের সূত্র ধরে ফোপাঁতে ফোপাঁতে মুখ তুলে তাকাতেই দেখলো, নিষ্ঠুর লোকটার শূন্য অভিব্যক্তি। এবার হাত বাড়ানোর কারণটা ঠিক বোধগম্য হলোনা ওর, তাই কুণ্ঠিত হয়ে মানুষটার অক্ষিপুটে চোখ মেলালো ফের। মেয়েটাকে বারবার ভয় পেতে দেখে আড়ালে তপ্তশ্বাস ছাড়ে এরীশ। অস্ফুটে বলে,
— কাম অন।আ’গু’ন ছড়িয়ে যেতে আর বেশি বাকি নেই।
ভীত হরিণীর মতো শঙ্কায় জর্জরিত মেয়েটা আস্বস্ত হতে পারলো না খুব একটা। অগত্যা জড়ানো গলায় বললো,
— কি ছিল এটা?
— গ্রে’নেট।
হাতটা বাড়িয়ে রেখেই গম্ভীর স্বরে জবাব দিলো এরীশ। ততক্ষণাৎ আঁতকে উঠল ঈশানী, খেই হারিয়ে তড়িঘড়ি করে আঁকড়ে ধরলো এরীশের বলিষ্ঠ খরখরে হাতের আঙুল । উঠে দাঁড়িয়ে চারিদিকের পরিস্থিতি পরখ করে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠে ভীষণ কষ্টে বললো,

—দাউদাউ করে আ’গু’ন জ্বলছে, কি করে বের হবো এখান থেকে? নাকি এখানেই?
ক্রন্দনরত মেয়েটার মুখের দিকে এক পল চাইলো এরীশ। ওকে আস্বস্ত করে কিছু বলতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু কিভাবে কাউকে কম্ফোর্ট ফিল করাতে হয়, কিভাবে সাবলীল কথায় শান্তনা দিতে হয়, কোনো কিছুই জানা নেই হৃদয়হীন লোকটার। ওর জীবনে তো সাবলীল বলেই কোনো শব্দের অস্তিত্ব নেই। যা আছে তা কেবলই ধ্বং’সযজ্ঞ,পা’পাচারে নিবিষ্ট এক অন্তহীন মরীচিকা। জীবন মর’ণ পরিস্থিতিতেও ওর ডিকশনারিতে একটাই বাক্য প্রচলিত সবসময় ,
— নিষিদ্ধ দুনিয়ার মাফিয়া বস কখনো হেরে যায়না। জীবনের অন্তিম প্রহর ঘনিয়ে এলেও জয় নিশ্চিত করে তবেই মৃ’ত্যুকে আলিঙ্গন করে সে।

এরীশের ভাবনার মাঝেই গতি হারালো ধ্বং’সলীলা। আ’ক্রমণ পাল্টা আ’ক্রমণের তান্ডবে থমথমে চারিপাশ। গু’লির তীব্রতায় চোখের সামনে ঝাঁঝরা হয়ে গেলো আইসক্রিম ভ্যানটা। গাঁ ঢাকা দেওয়ার শেষ আশ্রয়টুকু এভাবে নস্যাৎ হয়ে যাওয়ায় আঁতকে ওঠে ঈশানী। ওকে টান মে’রে বুকের একপাশে ফেলে দিয়ে অন্যহাতে সবেগে গু’লি চালায় এরীশ। পেছনের কয়েকজন দূর্বিত্তকে পর পর মা’র্ডার করে ঈশানীকে নিয়ে দ্রুত হেটে পার্কের পেছনের এক্সিট ধরে সে । আ’গুনের কারণে রাস্তাটা ব্লক হয়ে আছে, পাশেই ভেন্টিলেটরের ছোট এক্সিট। আপাতত সেটাই গু’লি করে উড়িয়ে দিলো এরীশ, অতঃপর ঈশুর কোমর চেপে ধরে চোখ মুখ খিঁচে লাফ দিলো সেখান থেকে।
ওদিকের গো’লাগু’লি এখনো চলমান। পাইথন লিডারের সব কৌশলী গার্ড’স গুলো উপস্থিত হয়েছে ইতিমধ্যে।
ভারী অ’স্ত্রের ঝনঝন আওয়াজ আর রাইফেল থেকে বের হওয়া ঝাঁঝালো বারুদের গন্ধে ভরে উঠেছে জায়গাটা। ক্ষণে ক্ষণে ছোট বড় গ্রে’নেটের বি’স্ফোরণ বিকট আওয়াজ তুলে কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছে যেনো।
একের পর এক বীভৎস লা”শ পরে যাচ্ছে চোখের পলকে। চারিদিকে র’ক্তে’র ছড়াছড়ি।

কংক্রিটের শক্ত প্রাচীরের আড়ালে জীর্ণশীর্ন হয়ে দাঁড়িয়ে একহাতে রিভলবার চালাচ্ছে এরীশ। বুকের মধ্যে সজোরে চেপে ধরে রেখেছে ঈশুকে। হঠাৎ এভাবে টান মে’রে কাছে নিয়ে আসার দরুন ঝপাৎ করে খুলে গিয়েছে মাথার হুডিটা। সেইসাথে সবগুলো চুল গিয়ে আঁচড়ে পরেছে মাফিয়া বসের শরীরে।
অকস্মাৎ ঘটনায় হাতের শক্তি উবে গেলো এরীশের। ঈগলের ন্যায় শিকারি মনোযোগের সবটুকু গ্রাস করে নিলো একটা আদুরে মুখের ঘোর লাগানো মুগ্ধতা। এতোক্ষণে এরীশ খেয়াল করলো সাকুরা ওর কতটা কাছে দাঁড়িয়ে, ঠিক কি ভাবে গুটিসুটি মে’রে অনেকটা সাহস জুগিয়ে দু’হাতে খামচে ধরে রেখেছে ওর শার্টটাকে। আর সবশেষে চারিদিকের এতো জ্বালাও পো’ড়াও গন্ধের মাঝেও , মেয়েটার শরীরের সবচেয়ে আলাদা, সবচেয়ে আকর্ষনীয় সুঘ্রাণ। যা বারবার মনোযোগ কেড়ে নেয় মাফিয়া বসের। সহসা চোখ বুজে গভীর শ্বাস টেনে বিড়বিড়ায় সে,
— ভ্যানিলা।

এতোক্ষণ দিশেহারা হয়ে শ’ত্রুদের দিকে দৃষ্টি স্থির করে রাখলেও, এরীশের অকস্মাৎ থমকে যাওয়া দেখে চোখ ঘোরায় ঈশু। ওর স্থির সাবলীল অভিব্যক্তি দেখে আতঙ্কে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ওকে ঝাঁকিয়ে উঠে বলে,
— ওরা চলে আসছে তো, জলদি কিছু করুন।
ওর চোখেমুখে ভীষণ উদ্বিগ্নতার ছাঁপ। এরীশ চোখ খুললো সবেগে, ঈশানীও তাকিয়ে ছিল ভয়ার্ত চোখে, ফলস্বরূপ আবারও ঘোলাটে দৃষ্টির মিলন হলো দুজনার। চোখে চোখ পরার সঙ্গে সঙ্গে বিষণ্ণ অনুভূতির মিশেলে চুপসে গেলো ঈশানী। মুখ কালো করে নামিয়ে নিলো অক্ষিপুট। তৎক্ষনাৎ স’হিংস গো’লাগু’লির আওয়াজে যুদ্ধক্ষেত্রের মতো ঝনঝনিয়ে ওঠে চারিপাশ। গগন বিদারিত আওয়াজে ফের হকচকিয়ে উঠে এরীশের বুকে মুখ লুকায় মেয়েটা। কান্নার তোড়ে ঢেউ তুলে বলে,

— ওরা চলে এসেছে, এবার কি হবে? কে বাঁচাবে আমাকে?
ঈশানীর কথার মাঝেই আকস্মিক গতিতে একটা তেল চকচকে ধাতব বু’লেট ছুটে এলো ওদের দিকে । ততক্ষণাৎ ঈশুকে নিয়ে হাওয়ার বেগে অন্যপাশে ঘুরে যায় এরীশ। এবার দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে ঈশানীর, আর ওর মুখোমুখি এরীশ। মাঝখানে কয়েক ন্যানো সেন্টিমিটারের দূরত্ব মাত্র। ঈশানীর মাথার দু’পাশে হাত রেখে সটান দাঁড়িয়ে আছে মাফিয়া বস টা। তার মুখভঙ্গিমা স্থির ভাবলেশহীন, ঠোঁটের আগায় জড়ো হয়েছে রহস্যের ঘনঘটা, সেভাবেই নাজুক ভীত মেয়েটাকে বাহুবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত পিষলো লোকটা। এরীশের গতিবিধি পর্যবেক্ষন করে শুষ্ক ঢোক গেলে ঈশু।ওর চোখের আড়ষ্টতায় বাঁকা হাসিতে ঠোঁট প্রসারণ করে এরীশ, গম্ভীর স্বরে জবাব দেয়,
— চিন্তা নেই, আমি বেঁচে থাকতে তুমি ম’রবে না।

এরীশ কথাটা বলতে বাকি মূহুর্তেই ভুমিকম্পের ন্যায় কাঁপন দিয়ে উঠলো চারিপাশ, আচানক ঘটনায় দিগ্বিদিক হারিয়ে ছুটতে শুরু করে সকলে। অবাকের চরম সীমানায় পৌছে ঈশানী নিজেও ভ্রু কুঁচকালো কৌতূহলে।
একটু পরেই মিসাইল বি/স্ফো’রণের বিকট আওয়াজে থরথরিয়ে কেঁপে উঠলো পুরো শহর। কয়েক সেকেন্ডের মাঝে চোখের সামনে ভস্ম হয়ে গেলো আগন্তুক আ’ক্রম’নকারীর দল। চোখমুখ জ্বলে যাচ্ছে, জলোচ্ছ্বাসের জলের ন্যায় ছড়িয়ে যাচ্ছে আগু’নের লেলিহান। পুরো ঘটনার সাক্ষী হয়ে স্তম্ভিত বাকরুদ্ধ ঈশানী। দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটা শ্বাস নিতেই ভুলে গিয়েছে। নৃ’শংস পাপের শহর এই মস্কো, তার চেয়েও বেশি নৃ’শংস এই শহরের পাপী হৃদয়হীন মানুষ গুলো। ঈশানীকে আরও একধাপ অবাকের চূড়ায় পৌঁছে দিয়ে জলন্ত অ’গ্নিদাহ থেকে বেড়িয়ে এলো একটা আ’ক্রমনকারী লোক। মূমুর্ষ পায়ে সামনে এগোতে এগোতে নিঃশব্দে রাইফেল তাক করালো এরীশের পানে। তবে ট্রিগার প্রেস করার সুযোগ হলো না আর, তার আগেই পেছনে না ঘুরে রি’ভলবারের সবকটা গু’লিতে ওর মস্তিষ্কটা ঝাঁঝরা করে দেয় ব্লাডিবিস্ট খ্যাত মাফিয়া বস ।
এরীশের এহেন বীভৎস কর্মকান্ডে আঁতকে ওঠে ঈশানী। ওর নির্জীব ক্রোধান্বিত মুখের পানে চেয়ে হকচকিয়ে শুধায়,

— কি করে দেখলেন ওনাকে?
— তোমার চোখে।
নিশ্চয়ই ঈশানীর অবাক চোখের মাঝে লোকটার প্রতিবিম্ব ফুটে উঠেছিল। তারমানে এতোক্ষণ ওর চোখের মাঝেই ডুবে ছিল এরীশ।
তবে ঈশানী আশ্চর্য হলো এই ভেবে যে লোকটার নিশানা কত নিখুঁত। সামান্য চোখের প্রতিবিম্ব দেখেই লোকটাকে শ্যুট করে দিল সে , একবার পেছনে অবধি তাকানোর প্রয়োজন বোধ করলো না।
— এরীশ! কাম ফাস্ট।
এতোকিছুর মাঝে হুট করে তুষারের স্মিত কন্ঠস্বরের আওয়াজে সম্বিত ফিরে পায় ঈশানী। চোখ ঘুরিয়ে দেখতে পায় স্পোর্টস কার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। এরীশ ততক্ষণাৎ ঈশুর হাতটা ধরে এগিয়ে যায় গাড়ির দিকে, দরজা খুলে কঠোর আদেশের স্বরে বলে,

— বসো।
ঈশানী তাই করলো, এগিয়ে গিয়ে গুটিসুটি মে’রে বসলো গাড়িতে। ও বসতেই ভেতরে গিয়ে নিঃশব্দে গিয়ার টানলো এরীশ। স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে ধ্বং’সযজ্ঞের ওই স্থান ত্যাগ করে চলে গেলো অনেক দূরে। গাড়ির মাঝে পিনপতন নীরবতা। নিরিবিলি সুন্দর বিকেলের সবটুকু প্রচেষ্টা মাটিতে মিশে গিয়েছে। চেরিব্লোসমের স্নিগ্ধ গাছগুলো পরিনত হয়েছে দগ্ধ আবর্জনায়, সেসব ভাবলেই হিং’স্রতার প্রভাবে চিড়বিড়িয়ে ওঠে এরীশের পৈশাচিক মস্তিষ্ক। ইচ্ছে করে এক্ষুনি গিয়ে সবকটার ছাই হয়ে যাওয়া ম’রদেহকে আবারও মে’রে ফেলতে।
কিন্তু এই মূহুর্তে সেটা সম্ভব নয়। না তো এই মূহুর্তে কারোর সঙ্গে সামনা সামনি লড়াই করার সুযোগ ছিল ওর । কারণ সারাটাক্ষন ভয়ের চোটে ওর সঙ্গে লেপ্টে ছিল একটা স্নিগ্ধ চেরিব্লোসমের বাগান। পৃথিবীর সব চেরিব্লোসম পু’ড়ে ছাই হয়ে গেলেও, এটাকে সুরক্ষিত রাখায় সর্বদা তৎপর এরীশ ইউভান।

খানিকক্ষণ সময় গড়ালে বিশাল রানওয়ের মাঝখানে এসে গাড়ি থামায় এরীশ। অদূরে লাল নীল আলো জ্বালিয়ে প্লেন যাতায়াত করছে, খুব কাছেই এয়ারপোর্ট হয়তো। তবে এটা প্রাইভেট রানওয়ে।
গাড়ির জানালায় উঁকি দিতেই ঈশু দেখলো সামনের হ্যালিপ্যাডে দাঁড়িয়ে আছে কালো রঙা একটা লাক্সারিয়াস হেলিকপ্টার। তার বিস্তৃত পাখাগুলো চলন্ত। কিন্তু এখানে এসে হঠাৎ গাড়ি থামানোর কারণ ধরতে পারলো না মেয়েটা। অগত্যা ওর ভেতরে ভেতরে বইতে শুরু করলো সংশয়ের ঝোড়ো হাওয়া।
— নেমে এসো।

গাড়ি থেকে নেমে ঈশানীকে সশব্দে আদেশ করলো এরীশ।
মেয়েটা শঙ্কিত হলো, ও আসলে এরীশকে বিশ্বাস করেনা মোটেই। এই নির্দয় লোকটা যখন তখন খারাপ কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে, সেই ভয়ে তটস্থ ঈশানী। ফলস্বরূপ হাতের মাঝে হাত কচলাতে কচলাতে কুণ্ঠিত স্বরে বললো,
— নামবো মানে? কোথায় যাবো? এটাতো পেন্ট হাউজ নয়।
সচরাচর কৈফিয়ত দেওয়ার অভ্যেস নেই এরীশের। তারউপর মেজাজটাও বিগড়ানো সহসা শক্ত কঠিন আওয়াজে বললো,

— নামতে বলেছি নামো। মুখের উপর প্রশ্ন ছোঁড়ার অভ্যেসটা বদলাও, এসব আমার একদম পছন্দ নয়।
লোকটা এমন ভাবে কথাটা বললো, যেন নিজের বিয়ে করা বউকে মানিয়ে নিয়ে সংসারে অভ্যস্থ হওয়ার হুকুম করছে সে । ওদিকে এরীশের কথায় ক্ষীপ্র হয়ে ওঠে ঈশানী। জোরপূর্বক তেজ দেখিয়ে ঝাঁঝালো স্বরে বলে,
— নামবো না, কিছুতেই নামবো না। আপনি নিশ্চয়ই আমাকে অন্য কোথাও বেঁচে দিবেন তাই না? কেন এমন করছেন? কি ক্ষ’তি করেছি আপনার? নিজের আত্মসম্মান, নিজের পবিত্রতা রক্ষার জন্য আর কতো মিনতি করতে হবে আমায়? আপনার কি একটুও দয়া নেই?
কথা বলতে বলতে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে ওঠে মেয়েটা। এরীশ আর জবাব দিলো না কোনো, অকস্মাৎ গাড়ির দরজাটা খুলে হিং’স্র শিকারির ন্যায় একটানে ছোঁ মে’রে কাঁধে তুলে নিলো মেয়েটাকে। নিঃশব্দে ওর চিকন কোমরটা নিজের বলিষ্ঠ বাহুতে আঁকড়ে ধরে পা বাড়ালো হেলিপ্যাডের অভিমুখে।

এরীশের কান্ডে হাত পা ছুড়তে ছুড়তে চ্যাঁচাতে শুরু করে ঈশানী। সরু দু’হাতে মাফিয়া বসের সুডৌল পৃষ্ঠদেশে একের পর এক কিল ঘুষি দিতে দিতে শরীর কাঁপিয়ে কেঁদে ওঠে মেয়েটা। ওর কিল ঘুষি গুলো মোমের ন্যায় পিছলে যায় মাফিয়া বসের শরীর থেকে। সে পাহাড়ের ন্যায় অটল। শুষ্ক বরফ খণ্ডের ন্যায় নির্জীব তার মুখাবয়ব।
অবশেষে নিজের অপারগতায় মিয়িয়ে গিয়ে ক্লান্ত স্বরে মিনতি করে ক্রদনরত মেয়েটা,
— দয়া করে আমাকে ওই নোংরা জায়গাতে পাঠাবেন না অরণ্য। আমি সত্যিই ভেঙে যাবো।
এরীশ জবাব দিলোনা কোনোরূপ। কাঁধ থেকে নামিয়ে আস্তে করে বসিয়ে দিলো হেলিকপ্টারে। কানে গুঁজে দিলো বিশালাকৃতির হেডফোন। অতঃপর নিজে গিয়ে বসলো ককপিটে। এরীশকে হেলিকপ্টার চালাতে আজ প্রথমবার দেখেনি ঈশানী, তাই অবাক হলোনা খুব একটা। বরং অস্তিত্ব হারানোর শঙ্কায় গুটিয়ে গিয়ে অনর্গল চোখের জল বিসর্জন দিতে লাগলো নিঃশব্দে। ওকে এভাবে ফুপিয়ে কাঁদতে দেখে এতোক্ষণে চোখ ঘোরালো এরীশ। মস্তিষ্ক কিছুটা শিথিল হয়ে এলে,গিয়ারে হাত রেখেই গমগমে আওয়াজে বললো,

— কাঁদছো কেন কে ম’রেছে?
ভ্রুর ভাঁজে তীক্ষ্ণ কুঞ্চনে বিরক্তিভাব সুস্পষ্ট।
বোকা মেয়েটা চোখের পানি নাকের পানি একাকার করে ওষ্ঠপুট চেপে ধরে ফোপাঁতে ফোপাঁতে বলে,
—আপনি আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?
— পেন্টহাউজে।
ছোট্ট করে জবাব দিলো এরীশ। অতঃপর একহাতে টান মে’রে মুখের মাস্কটা খুলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একাই বিড়বিড়ালো ,
— ইট ওয়াজ আ ওয়োর্স্ট ডে।
এরীশের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো ঈশানী। ক্রন্দনরত ঠোঁট জোড়া তার ফাঁক হয়ে গেলো আপনাআপনি। ততক্ষণাৎ ব্যগ্র হাতে চোখ মুছে আশ্চর্য কণ্ঠে শুধালো ও,
— আমরা পেন্টহাউজে যাচ্ছি?
কুয়াশার আড়ালে ঢাকা পরেছে তারকারাজির দল । তুষারের আচ্ছাদনে কিঞ্চিত ঘোলাটে আকাশপথ। দুষ্কর পরিস্থিতিতে সয়ংক্রিয় মনোযোগ টুকু গতিপথে নিবেশ করে নির্লিপ্তে হ্যা সূচক মাথা দোলায় এরীশ।
পরক্ষণেই প্রশ্নবাণ ছোড়ে কৌতুহলী মেয়েটা।
— তাহলে হেলিকপ্টারে কেন?
প্রত্যুত্তরে এরীশ বলে,
— জঙ্গলের রাস্তায় গু’প্তঘাত’ক রয়েছে। ইভেন ওরা তুষারকে এট্যা’ক করেছে।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ঈশানী। রাতের ঘুমন্ত শহরের দিকে নিস্প্রভ নয়নে তাকিয়ে বিষণ্ণ মুখে বলে,
— আজ আপনাদের স’হিংসতার জন্য কতগুলো সাধারণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে একবারও ভেবে দেখেছেন?

— হু কেয়ারস।
গম্ভীর স্বরে জবাব দিলো এরীশ। লোকটার হৃদয়হীন কথায় আত্নাটা কেঁপে ওঠে ঈশানীর। মস্তিষ্ক চিড়বিড়িয়ে ওঠে অযাচিত ক্ষুব্ধতায়। গলার স্বর খাদে নামিয়ে কিঞ্চিৎ তেঁতো স্বরে ঈশু বলে,
— ওগুলো মানুষ ছিল, কোন কীটপতঙ্গ নয়।
সরল মেয়েটার কথায় কোনোরূপ প্রত্যুত্তর করলো না এরীশ। এমনকি ঘুরেও তাকালো না এক পল। শুধু মনে মনে আওড়ালো,
— তোমাকে সুরক্ষিত রাখার প্রশ্ন উঠলে,কয়েকটা সাধারণ মানুষ কেন,পুরো পৃথিবীর সঙ্গে যু:দ্ধ বাঁধিয়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করবো না আমি।
এরীশের মাঝে ভাবান্তর নেই কোনো। ধূসর বাদামি চোখ জোড়া বরাবরের মতোই অনুভূতিহীন শূন্য। এমন কেউ কি পৃথিবীতে নেই যার জন্য এই চোখে অনুভূতির জোয়ার বয়ে যাবে? পাংশুটে চেহারাতে কিছুটা আবেগ জাগ্রত হবে? ভেবে পায়না ঈশানী। অগত্যা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ সরিয়ে নিলো নির্দয় লোকটার দিক থেকে।
তবে চোখ সরাতে গিয়ে ওর দৃষ্টি আটকালো এরীশের গলার কাছে নীল হয়ে যাওয়া ক্ষতস্থানে। ফর্সা কণ্ঠনালিতে দগদগে হয়ে যাওয়া বীভৎস ক্ষ’তটা চোখে লাগছে খুব। দেখে মনে হচ্ছে অনেক বেশি ব্যথা পেয়েছে, কিছুতে কা’মড়েছে মনে হয়। ক্ষতস্থানটা কিয়ৎক্ষন পরখ করে রিনরিনে আওয়াজে আগ বাড়িয়ে শুধালো ঈশানী,
— আপনার গলায় কি হয়েছে?
ঈশানীর কথায় ভ্রম কাটে এরীশের। এক হাতে গিয়ার চেপে ধরে অজ্ঞাত ভঙ্গিমায় অন্য হাতটা নিয়ে রাখে গলার ক্ষ’তস্থানে।কয়েক মূহুর্তে সেখানটায় নির্বিগ্নে হাত বুলিয়ে তপ্তস্বরে জবাব দেয়,

— দেখতেই পাচ্ছো ব্যথা লেগেছে।
—দেখে মনে হচ্ছে বোজো কামড়েছে।
মুখ ফসকে বাক্যটা বের হতে না হতেই ঈশুর পানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এরীশ। এরীশের ধূসর চোখের গহ্বরে লুকায়িত কঠোর নিষেধাজ্ঞা। যা দেখে আবারও চুপসে গেলো ঈশানী, শুষ্ক একটা ঢোক গিলে চোখ সরিয়ে নিলো আড়ষ্টতায়।ভীত মেয়েটার পানে নিস্প্রভ দৃষ্টি স্থির রেখে হাস্কিস্বরে বলে ওঠে এরীশ,
— মনে হচ্ছে, কি হয়েছে সেটা জানার খুব আগ্রহ তোমার।
তরাগ করে চোখ তুলে চাইলো ঈশানী,এরীশের কথায় ঘোর অসম্মতি জানিয়ে বললো,
— মোটেই না। ক্ষতটা চোখে লাগছে, মলম লাগাননি তাই জানতে চেয়েছি।
ঈশুর দিক থেকে চোখ সরিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে কিঞ্চিৎ হাসলো এরীশ। পরক্ষণেই ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গেলো চিরাচরিত গাম্ভীর্যের আড়ালে। আকাশ পথের গন্তব্য ধরে এগুতে এগুতে অস্ফুটে বলে উঠলো এরীশ,
— সব ক্ষতই পীড়দ্বায়ক নয়। কিছু কিছু ক্ষত সুখের চিহ্নও বহন করে। এটা বোধ হয় তেমনই এক সুখকর ক্ষত। তাই মলম লাগানোর প্রয়োজন বোধ করিনি।
এরীশের কথার মাথামুণ্ড বুঝতে না পেরে নিঃশব্দে ঠোঁট উল্টালো ঈশানী। অতঃপর দৃষ্টি বাড়িয়ে চাইলো তুষার আচ্ছাদিত শ্বেতকায় জঙ্গলের পানে। নৈঃশব্দে বরফে ঢাকা পাতাবিহীন নিস্তব্ধ জঙ্গলটাকে মৃ’ত লাগছে। তবুও সেদিকে চেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে ঈশানী। মনেমনে নিজেকেই নিজে আস্বস্ত করে বলে,
— এতোক্ষণে বোধ হয় পেন্ট হাউজের কাছাকাছি চলে এসেছে হেলিকপ্টারটা।

গভীর রাত। চারিদিকে কম্বল চড়ানো শীতল ঘুমের আয়োজন। ঝিঁঝি পোকার অর্হনিশ গুঞ্জনে মাথা ধরে আসার উপক্রম। সেই সন্ধ্যা থেকে লাউঞ্জে বসে অপেক্ষারত ফ্লোরা। ঈশানীর চিন্তায় ধরে আছে মাথাটা,কিছুতেই ঘুম আসছে না। মাফিয়াদের নৃ’শংসতা সম্মন্ধে বেশ ভালোই ধারণা রয়েছে ফ্লোরার,সহসা চিন্তার প্লাবনে ভেসে যাচ্ছে মস্তিষ্ক।
ঠিক এমন সময় ধীর গতিতে পা টেনে টেনে পেন্ট হাউজে প্রবেশ করে তুষার। ওকে আহত লাগছে। হাঁটুর কাছের অনেকটা জায়গা ধরে র’ক্তক্ষরণ হচ্ছে। চওড়া কপালের অবস্থা আরো বেগতিক, সেখানে আ’ঘাতের নীল বর্ণ সুস্পষ্ট। বাম পাশের চোখটাও ফুলে ঢোল হয়ে আছে।

অযাচিত পদচারণার শব্দে সচকিত হয়ে চোখ ঘোরায় ফ্লোরা। তখনই দেখতে পায়, হিমালয়ের মতো শক্ত পোক্ত মানবের ভঙ্গুর মুখাবয়ব। তুষারের এমন নাজেহাল অবস্থা দেখে হৃদয়টা ছ্যাত করে ওঠে ফ্লোরার। ততক্ষণাৎ ছুটে গিয়ে ওকে দু’হাতে সামলায় মেয়েটা। লম্বা চওড়া পেটানো শরীরের অধিকারী তুষারের এক বাহু আঁকড়ে ধরতেই বড্ড বেগ পোহাতে হলো শীর্ণকায় ফ্লোরার। তবুও মূমুর্ষ শরীরটাকে টেনেটুনে নিয়ে এসে বসালো কাউচে। শরীরের বিভিন্ন স্থান ক্ষ’তবিক্ষ’ত হলেও, ভেতরের তীর্যক মূর্তিমান সত্তার পরিবর্তন ঘটেনি মোটেও। আর না তো হৃদয়ের কোণে জড়ো হয়েছে বিন্দু পরিমাণ শঙ্কা।

তুষারকে আধশোঁয়া করে বসিয়ে দিয়ে ওর ঘাড়ের কাছে কুশন টেনে দিলো ফ্লোরা। নিজ হাতে বুট গুলো খুলে, একজোড়া স্বস্তিদায়ক স্লিপার এনে পরিয়ে দিলো পায়ে। অতঃপর তাড়াহুড়ো করে কুসুম গরম পানি আর ফাস্ট এইডস নিয়ে বসলো তুষারের ক্ষ’ত সারাতে। এই সবগুলো কাজ বিনাবাক্যে করে গেলো ফ্লোরা। মুখ ফুটে একটা কথাও জিজ্ঞেস করলো না তুষারকে। আর না তো একবারের জন্যও চোখ তুলে চাইলো ওর মুখের পানে।
ফ্লোরার এহেন মন্থর নিশ্চুপ অভিব্যক্তি ভাবালো তুষারকে,সহসা আগ বাড়িয়ে প্রশ্ন ছুড়লো তুষার। গলার মাঝে কৃত্রিম গাম্ভীর্যতা ধরে রেখে বললো,
— সেদিন বকেছিলাম বলে এখনো রাগ করে আছো?
তুষারের কথার পাছে চট করে ওর মুখের পানে দৃষ্টিপাত করে ফ্লোরা। মোহাবিষ্টের ন্যায় ব্যাকুল চোখে লোকটাকে পরখ করে বলে,

— একটা প্রশ্ন করবো?
ফ্লোরার শুকনো মুখের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তুষার। সামান্য হ্যা সূচক মাথা দুলিয়ে বলে,
—ইউ ক্যান।
— আপনি কি সত্যিই আমায় কোনো মাফিয়ার কাছে বিয়ে দিয়ে দিবেন?
ফের দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে তুষারের প্রসস্থ বুক চিঁড়ে। সামনে হাঁটু ভাজ করে বসে থাকা সুন্দরী রুশ মেয়েটাকে নিস্প্রভ চোখে পরখ করে তুষার বলে,
— তোমার জন্য যেটা ভালো হবে সেটাই করবো আমি ফ্লোরা। এরীশের মতো সবচেয়ে পাওয়ার ফুল মাফিয়া বস খুঁজে নিয়ে আসবো আমি। ইভেন তোমার সুখের জন্য যা করতে হয় তাই করবো।
— আপনি নিজেও তো মাফিয়া।
হাতের কাজ অব্যাহত রেখেই প্রশ্ন ছোড়ে ফ্লোরা। ওর এহেন প্রশ্নে সরল কপালে ভাঁজ টানলো তুষার। এইটুকুতেই মাস্টার মাইন্ড খ্যাত তুষারের বুঝতে বাকি নেই ফ্লোরার ভেতরে লালিত সুপ্ত অনুভূতির কথা। তবে তুষার তো এসব ভাবে না। কোনোদিন ভাবতে চায়ও না। নিজের গন্তব্যহীন অনিশ্চিত জীবনে কাউকে যোগ করার মতো সাহস কিংবা ইচ্ছে কোনোটাই নেই ওর। অগত্যা সরল মেয়েটার কথার পাছে চোয়াল শক্ত করে ফেললো তুষার। কঠিন স্বরে জবাব দিলো,

— আমি কোনো মাফিয়া বস নই ফ্লোরা । আমি গ্যাংস্টার।
অতর্কিত অপমানে নীল হয়ে গেলো ফ্লোরার ধবধবে ফর্সা ত্বক। গলার মাঝে দলা পাকালো কান্নার বাঁধ। জিভটা তেঁতো লাগছে ভীষণ, চাইলেও কথা বলার মতো আর শব্দ অবশিষ্ট নেই ওর দিশেহারা মস্তিষ্কে। সহসা মাথা নুয়িয়ে চুপচাপ হাতের কাজ চালায় মেয়েটা। দু’জনার মাঝে অসহনীয় নীরবতা বিরাজমান। অনেকক্ষন ধরে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেও ভেতরের অস্বস্তিটা কিছুতেই দমিয়ে রাখতে পারলো না তুষার। অগত্যা ড্রেসিন করার মাঝ পথেই উঠে দাঁড়ালো সে, ধীর কদমে ফ্লোরাকে ছাড়িয়ে সামনে এগুতে এগুতে নিরেট স্বরে বললো,
— অনেক রাত হয়েছে, গিয়ে ঘুমিয়ে পরো। ঈশানীকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই, ও ঠিক আছে।
আরও একবার বক্ষপিঞ্জরে কিঞ্চিৎ সাহস সঞ্চার করে পেছন থেকে গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো ফ্লোরা,

— আপনি কি কোনোদিন কাউকে ভালোবাসবেন না তুষার ? আর বিয়ে ও করবেন না?
— না!
থমকে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট আওয়াজে জবাব দিলো তুষার। হতবিহ্বল মেয়েটার দিকে না তাকিয়েই গমগমে আওয়াজে বলে উঠলো ফের,
— মাফিয়ারা কখনো কাউকে ভালোবাসে না। যদিও বা মনের দ্বন্ধে হেরে গিয়ে বেসে ফেলে তাও আগলে রাখতে পারেনা।
— কে বলেছে পারেনা? আমার বাবা মা তো ভালোবেসেই বিয়ে করেছিল।
তুষারের যুক্তিতে ঘোর আপত্তি জানিয়ে প্রত্যত্তুর করলো ফ্লোরা।

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২৩

— তাদের শেষ পরিনতি নিশ্চয়ই তোমার অজানা নয়।
তৎক্ষনাৎ সর্বশেষ আ’ঘাত হেনে নাজুক মেয়েটাকে পুরোপুরি দাবিয়ে দিতে বি’ষাক্ত তীরের ফলার মতো বাক্য নিক্ষেপ করে তুষার।
এরপর আর কন্ঠনালী ভেদ করে কোনোরূপ শব্দ উচ্চারণ করার সাহস পেলোনা ফ্লোরা।ভাঙা মনের সুপ্ত ব্যথাগুলো আলগোছে লুকিয়ে বিনাবাক্যে যেতে দিলো তুষারকে।
— সত্যিই তো, অনিশ্চিত মরীচিকার মতো অন্ধকার জীবনের পিছুটান হটিয়ে রংধনুর মতো প্রণয়ের প্লাবনে গা ভাসানো কি এতোটাই সহজ?

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২৫