আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২৫
suraiya rafa
তুষার আবৃত বিস্তর শ্বেত রঙা হাইওয়ে। জঙ্গলের সীমানা ছাঁড়িয়ে যতদূর চোখ যায়, ততোদূর অবধি ভয়াল রাত্রির তমশাচ্ছন্ন গর্জন। বরফের ঝাঁঝ মিশ্রিত বৈরী হাওয়ায় হিমশীতল চারিদিক।বছরের এ সময়ে শহরগুলো হয়ে পরে কিছুটা জনমানবশূন্য আর ফাঁকা। নিগূঢ় হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডায় ভর করে সন্ধ্যাক্ষণে বাড়ির দার আঁটে সকলে। অতঃপর এ্যান্টিকের জানালা গুলো বন্ধ করে, ঘরের মাঝে ফায়ার প্লেস জালিয়ে,একটু একটু করে হাত লাগায় টুকটাক ইনডোর ডেকোরেশনে। সেই সাথে অধীর অপেক্ষায় দিন গুনতে শুরু করে বছরের সবচেয়ে বড় উৎসব ক্রীসমাসের।
অথচ এই নিবিড় নিস্তব্ধ তুষার আচ্ছাদিত নিশীথে শিকারে বেরিয়েছে একজোড়া কুটিল বিধ্বংসী চোখ। তার গভীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত জুড়ে ঘনীভূত হয়েছে পাশবিক অ’গ্নিদাহ। যতটা প্রতিহিংসার দাপটে অক্ষিপুট ছেঁয়ে গিয়েছে পৈশাচিক হিংস্রতায়, ঠিক ততটাই সাবলীল তার গম্ভীর মুখাবয়ব। চোয়ালের মাঝে অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছে পেপারমিন্ট ফ্লেভারের আধখাওয়া চুইঙ্গাম।তখন থেকে চিবুতে চিবুতে স্বাদটা কেমন পানসে হয়ে এসেছে, তবে এই মূহুর্তে তুচ্ছ চুইঙ্গামে কোনোরূপ মনোযোগ নেই গাড়িতে বসা মানুষরূপি দানবীয় শিকারি টির।
প্লে লিস্টে ড্রার্ক মিউজিক চলছে,সেই সুরের মূর্ছনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দ্বিধাহীন লোকটা গাড়ির জানালায় কনুই ঠেকিয়েছে অকপটে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
অন্যহাত স্টিয়ারিং এ বজায় রেখে স্পিডোমিটারে একশোর উর্ধে গতি তুলে হায়নার মতো তাড়া করে বেড়াচ্ছে সামনে ছুটে চলা ব্ল্যাক মার্সিডিজটাকে।
একজন অতর্কিতে হন্যে হয়ে ছুটছে আর অন্যজন নৈঃশব্দ্যে ঠান্ডা মাথায় তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাকে। এভাবেই হাওয়ার বেগে অতিক্রম হচ্ছে মাইলের পর মাইল।চোখের পলকে একেক করে পেরিয়ে যাচ্ছে হাইওয়ে,কখনো সুক্ষ্ম ওভারটেক তো কখনো সরাসরি ইউ টার্ন, এভাবেই চলে যাচ্ছে ঘন্টা খানিকের এই চোর পুলিশ কাহিনী।
তাও কিছুতেই ধরাশায়ী হচ্ছে না গতিহীন ব্ল্যাক মার্সিডিজটা। ভেতরে যে কোনো এক সুদক্ষ কার রেচার বসে নেই তার গ্যারান্টি কোথায়? তবে পেছন থেকে ছুটে আসা বিএমডব্লিউর মালিক ও যে এতো সহজে ছাড়বে না তার শিকারকে, সেটা এতোক্ষণে সুস্পষ্ট।
প্রায় দু’ঘন্টার চলমান স্নায়ু সহিংসতার ইতি টেনে অকস্মাৎ গতি হারায় ব্ল্যাক মার্সিডিজ।রং সাইড থেকে আগত লরির ধাক্কায় মাত্রাহীন চলন্ত গাড়িটা কয়েকহাত দূরে ছিটকে গিয়ে উল্টে পরে মাঝরাস্তায়। চোখের সামনে দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে যায় ব্র্যান্ডেড নিউ গাড়িটা। পেছনে এখনো বিএমডব্লিউর সটান অবস্থান। মনে হচ্ছে গাড়ির ভেতরের মানুষটাকে পুরোপুরি নিঃশেষ না করে এক পা ও এগোবে না সে।
— কামঅন! রাত শেষ হয়ে যাচ্ছে।
চোয়াল শক্ত করে আপন মনে বিড়বিড়ায় পেছনের শিকারিটা। তন্মধ্যে চূর্ণবিচূর্ণ গাড়ির দরজা ঠেলে পা টেনে টেনে বেরিয়ে আসে আহত লোকটা। র’ক্তের তোড়ে ঝুপঝুপ করছে তার সমগ্র শরীর। পা ভেঙে বেঁকিয়ে গিয়েছে। থেঁতলে যাওয়া মাংসপেশির ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসতে চাইছে জীবন্ত শ্বেতরঙা তরতাজা হাড়গোড় । তাও রুগ্ন শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে সামনের দিকে ছুটে চলার বৃথা চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে লোকটা। যদিও তার সমস্ত শরীর জুড়ে ভর করেছে ভয়াবহ রুগ্নতা, তবে ল্যাম পোস্টের নিয়ন আলোক শিখায় স্পষ্ট তার বিধ্বস্ত মুখাবয়ব। লোকটা অন্য কেউ নয়, ডেনিয়েলের একমাত্র বিশ্বস্ত স্পাই এডওয়ার্ড ফ্র্যাঙ্কি।যে এই মূহুর্তে আসণ্ণ মৃ’ত্যুকে মাথায় নিয়ে ছুটছে দিগ্বিদিক।
তবে পেছনের গাড়িতে অবস্থানরত মানুষরূপি পিশাচটার বোধহয় কিঞ্চিৎ দয়া অনুভব হলো না তার প্রতি। উল্টো নির্জীব হয়ে পরা ক্রোধান্বিত সত্তাটাকে পুনরায় জাগ্রত করে দাঁতে দাঁত চাপে সে। তৎক্ষনাৎ গিয়ার টেনে গাড়ি স্টার্ট দেয় সবেগে। গতিপথ একই, তবে গাড়ি এখন দিগুণ তালে ছুটছে । যতটা দ্রুত এগিয়ে গেলে মানুষের পলক ফেলার সময়টুকু অবশিষ্ট থাকেনা, ঠিক ততটা দ্রুত স্পিড বাড়িয়ে আলোআঁধারির মাঝেই ফ্র্যাঙ্কির মূমুর্ষ দেহটাকে রাস্তায় পিষে দিয়ে গেলো এক নিমেষে। অতঃপর গাড়ি ঘুরিয়ে ফের পিছিয়ে এসে একাধিক চাকার ঘর্ষণে ছিন্নভিন্ন করে রাস্তার পিচের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে লাগলো ফ্র্যাঙ্কির অর্ধমৃ’ত দেহাবশেষ। যতক্ষণ পর্যন্ত গাড়ির নিচে শক্ত কিছু অনুভব হয়েছিল, ঠিক ততক্ষণই চাকার সঙ্গে দে’হটাকে জ্যান্ত পিষেছিল লোকটা। ছিন্নভিন্ন দেহটা থেকে ফিনকি দিয়ে বেড়িয়ে আসা র’ক্তের স্রোতে ভরে উঠেছিল বিএমডব্লিউর সমস্ত জানালা গুলো। গাড়িটাকে দেখে মনে হচ্ছিল হ্যালুউইনের কোনো জলজ্যান্ত কস্টিউমস, যার ভেতরে স্বয়ং অবস্থানরত ভয়ংকর কদাচিৎ এক ডেভিল কিং। চোখ দু’টো ঘুমন্ত হায়নার মতো নেতিয়ে থাকলেও চারিপাশের তাজা র’ক্তের উৎকট গন্ধে অচিরেই তৃপ্তিতে ঠোঁট প্রসারিত হলো তার ।
ড্রাগন হান্টার গ্রুপের মূল ভবনটা আজ ভয়াবহ নিস্তব্ধতায় একীভূত। নিভৃত মৃ’ত্যুপুরির মতোই চারিদিক থমথমে। সবসময় যান্ত্রিক মানবের ন্যায় দায়িত্বরত গার্ড’স গুলো আজ অত্যাধিক শঙ্কায় জর্জরিত। কোন এক অযাচিত কারণ বশত তারাও আজ চিন্তিত।ভয়ের ক্লেশে শুকিয়ে আছে প্রত্যেকের অন্তরাত্মা, মাত্রাতিরিক্ত শীতল আবহাওয়ার মাঝেও ঘামে জবুথবু শরীরে জড়ানো বিশেষ কালো পোশাক। হাতের মাঝে চেপে ধরে রাখা শটগান গুলোর অজ্ঞাত কম্পন আজ বেগতিক।
এরই মাঝে বক্ষগহ্বরে জমে থাকা আতঙ্কিত রূহুটাকে আচানত কণ্ঠনালীতে ঠেলে দিয়ে আগমন ঘটে ডেনিয়েল এবং তার ব্যক্তিগত ফরেনসিক টীমের। পরনে কালো স্যুট, হাতের মাঝে জ্বলজ্বল করছে ধারালো চাপাতি। যা দেখা মাত্র চিরাচরিত স্থির দাড়িয়ে থাকা রোবটিক গার্ড’স গুলো ও আজ ভয়ের তোড়ে নড়েচড়ে ওঠে কিছুটা। ডেনিয়েলের গম্ভীর চোখে দাউদাউ করছে প্রতিহিংসার লেলিহান ।
লবিতে ঢুকে ডানে বামে কোনোরূপ অতর্কিত দৃষ্টিপাত না করেই লম্বা পা ফেলে হনহনিয়ে ঢুকে গেলো ভেতরের সিক্রেট কামরায়। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করা মাত্রই ভলভলিয়ে নাকে এসে হানা দেয় মৃ’ত লা’শ থেকে নির্গত এক বিদঘুটে দুর্গন্ধ। গম্ভীর মুখে ভাঁজ পরে ডেনিয়েলের।এহেন বেগতিক দূর্গন্ধে টিকতে না পেরে সকলে নাকের ডগায় রুমাল চাপলেও ডেনিয়েল নিরুদ্বেগ। সে সামনের দিকে চেয়ে আছে এক দৃষ্টে, মাথার উপর বিস্তৃত সিলিং তাতে একে একে উল্টো হয়ে ঝুলে আছে ডেনিয়েলের দূরদর্শী বিচক্ষণ সব স্পাইদের ম’রদেহ। প্রতেকের চেহারা বীভৎস, দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভয়াবহ ট্রাজেডিক মৃ’ত্যু দেওয়া হয়েছে তাদের। জংলি হায়নার মতোই একে একে শিকার করা হয়েছে প্রত্যেককে। মৃ’ত্যুর ধরন ও অনেকটা কাছাকাছি। মনে হচ্ছে সবগুলোই একজনের কাজ।
ম’রা লা’শগুলোকে নিস্প্রভ নয়নে পরখ করতে করতে এক পর্যায়ে ডেনিয়েলের দৃষ্টি আটকালো পেছনে ঝুলে থাকা সবচেয়ে নিকৃষ্ট লা’শটার পানে। মুখ চেনার উপায় নেই, চোখ দু’টো কোটরে নেই, শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে শুরু করে মাথার খুলিটা ভেঙেচুরে তরতাজা মগজ পর্যন্ত দৃশ্যমান। ধীর কদমে ডেনিয়েল এগিয়ে গেলো বীভৎস মৃ’তদেহটার দিকে। বিষণ্ণ মুখাবয়বে প্রতিহিংসার দাপট খেই হারিয়েছে কিছুটা। বেজার মুখে নিজের বলিষ্ঠ খরখরে হাতটা আস্তে করে ওই চূর্ণবিচূর্ণ মগজের উপর রাখলো ডেনিয়েল, অতঃপর সেখানটায় আবেশিত হাত বুলিয়ে তপ্তস্বরে বিড়বিড়িয়ে উঠলো আচানক,
— ফ্র্যাঙ্কি, মাই ফ্র্যাঙ্কি।
ডেনিয়েলের মুখে ফ্র্যাঙ্কির নামটা শুনে মূহুর্তেই আঁতকে ওঠে সকলে। কানাঘুঁষায় ভরে ওঠে পুরো কামরা, সবার মাথাতে একটাই প্রশ্ন হানা দেয় তৎক্ষনাৎ ,
— ফ্র্যাঙ্কির মতো এমন বিচক্ষণ,দূরদর্শী,ট্রেনিং প্রাপ্ত গুপ্তচরকে কে দিলো এমন ভয়াবহ নৃ’শংস মৃ’ত্যু?
তবে সকলের ভাবনার ছেদ ঘটে ডেনিয়েলের অকস্মাৎ গর্জনে,
— কে করেছে এটা, কে করেছে?
সঙ্গে সঙ্গে মুখে তালা লাগিয়ে ভয়ে গুটশুটি মে’রে গেলো সকলে। উদভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক দৃষ্টি ঘোরায় ডেনিয়েল। ফ্র্যাঙ্কিকে হারিয়ে পাগল প্রায় সে। এমন সময় লা’শের শরীর থেকে খসে পড়ে ছোট্ট একটা চিরকুট, দিশেহারা হাতে চিরকুটটা খুলে ডেনিয়েল দৃষ্টি বোলায় তাতে, যেখানে র’ক্তা’ক্ত অক্ষরে ছোট্ট করে লেখা,
— ইট ওয়াজ আ সিম্পল রিভেঞ্জ।
চিরকুটে দৃষ্টি বোলানোর পরপরই পুরো ভবন কাঁপিয়ে গর্জে ওঠে ডেনিয়েল। মহাপ্রলয়ের ন্যায় শরীরের সকল তেজ মস্তিষ্কে একীভূত করে দাঁতে দাঁত পিষে গজরাতে গজরাতে বলে,
— এরীশ ইউভান। ইউ ফাকিং ব্লাডিবিস্ট,আ’ল বার্ন ইওর এন্টায়ার টেরিটোরি টু এ্যাসেস।
অতর্কিতে কাঁপছে ডেনিয়েল। রাগের তোড়ে থরথর করছে তার শক্ত চিবুক। চক্ষু গহ্বরের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ এর দাপদাহে যে কারোর বিনাশ আসন্ন, ঠিক এমন সময় উদভ্রান্ত কদম ফেলে ঠাস করে দরজায় ধাক্কা মে’রে ভেতরে প্রবেশ করে একটা গার্ড। লোকটার অকস্মাৎ আগমনে একযোগে পেছনে ঘুরলো সকলে। ভেতরে ভেতরে উদ্বিগ্নতার ছাঁপ, কণ্ঠনালী শুকিয়ে কাঠ, তারউপর বেগতিক শ্বাসপ্রশ্বাসে হাঁপড়ের মতো ওঠানামা করছে রুগ্ন বক্ষপিঞ্জর। লোকটার এহেন উদভ্রান্ত ভঙ্গিমায় ভ্রু কুঁচকালো ডেনিয়েল, গমগমে আওয়াজে বললো,
— হাউ ডেয়ার ইউ? আ..
ডেনিয়েলের কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই লোকটা হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
—এ এরীশ ইউভান নয়, ও..ওটা তুষার জাওয়াদ ছিল।
— হলি শীট!
এবার যেন সকলের চোয়াল ঝুলে পরার উপক্রম। রুমে উপস্থিত সকলে লোকটার দিকে অবিশ্বাস্য কুটিল নজরে তাকিয়ে থাকলেও, অজ্ঞাত স্বরে ডেনিয়েল বলে ওঠে,
— কি বলতে চাইছো?
এবার আর মুখ খুলে প্রত্যুত্তর করেনা লোকটা,বরং ধীরে সুস্থে আঙুল তাক করে ফ্র্যাঙ্কির ছিন্নভিন্ন দেহাবশেষের দিকে। এতোক্ষন খেয়াল না করলেও গার্ডটার আঙুলের ইশারা অনুসরণ করে সেদিকে সচকিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ডেনিয়েল। গভীর চাউনী মেলে তাকাতেই দেখতে পায়, ওর শরীরের অবশিষ্ট চামড়ায় ব্লে’ড দিয়ে খোদাই করে রুশ ভাষায় লেখা রয়েছে কিছু একটা। যার অর্থ দাঁড়ায় এই যে,
— এরীশ ইউভানের পেছনের কাটা গুলো ঠিক এভাবেই নৈঃশব্দ্যে উপড়ে ফেলি আমি।
ব্যাস এটুকুই, পরপরই দ্বিতীয়বারের মতো হতচকিত হয়ে গগন কাঁপিয়ে গর্জন করে ওঠে গড ফাদার ডেনিয়েল।
দক্ষিণের কাচের দেওয়ালের কয়েকটা উইন্ডো খোলা পরে আছে। অদূরের রাস্তায় গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে এতোক্ষণ ধরে দূরবীনের সাহায্যে ডেনিয়েলের কার্যক্রম পর্যবেক্ষন করছিল তুষার। যেই মূহুর্তে গড ফাদারটা গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো,সেই মূহুর্তেই সামনে থেকে দূরবীন টা সরিয়ে চোখে সানগ্লাস চড়ালো সে । অতঃপর পেছনে ঘুরে দরজা ঠেলে গাড়িতে প্রবেশ করতে করতে হাত বাঁড়িয়ে রিমোটে প্রেস করে চোখের পলকে জ্বালিয়ে দিলো বহুতল ভবনটা।
গাড়ি চলতে শুরু করেছে আপন গতিতে ,ড্রাইভার ড্রাইভ করছে, প্যাসেঞ্জার সিটে গা এলিয়ে দিয়ে গাড়ি ময় ইলেকট্রনিক সিগারেটের ধোঁয়ার কুন্ডলি ছড়াচ্ছে তুষার। পেছনে দাউদাউ করে জ্বলছে বিলাসবহুল কালো টাকার বহর।গাড়িতে পিনপতন নীরবতা, এক পর্যায়ে অসহনীয় নীরবতা ভেঙে ড্রাইভার লোকটা বলে ওঠে,
— এরীশ বসের অনুমতি ব্যাতিত ড্রাগন হান্টারকে মে’রে দিলেন?
— কই মাছের প্রাণ ওর। এতো সহজে ম’রবে না, তুমি সামনে এগোও।
কথা শেষ করে ফের ব্যাকসিটে গা এলিয়ে দিয়ে, নিঃশব্দে চোখ বোজে তুষার।
ভোরের আভা ফুটেছে বহুক্ষণ । বাল্ব বিহীন রুমটাও দিবালোকে আলেকিত। সকালের দিকে কমে এসেছে তুষার পাত , বিস্তার কুয়াশার চাদর ভেদ করে সবেগে উঁকি দিয়েছে সূর্যের নরম রোশনাই। তাও শিশির জমে ভিজে আছে কাচের দেওয়াল। বাইরে থেকে এসে সরাসরি অফিস রুমে প্রবেশ করেছে তুষার। কিন্তু আশ্চর্য এরীশ নেই এখানে। ব্যগ্র দৃষ্টি ফেলে চারিদিকে এক পল চোখ বুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। অতঃপর নিঃশব্দে বেড়িয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে ওপাশ থেকে কর্ণগোচর হয় এরীশের রাশভারি কন্ঠস্বর।
—ফিরে যাচ্ছো যে?
ফের ঘুরে তাকালো তুষার। দু’পা এগিয়ে গিয়ে কনফারেন্স রুমে উঁকি দিতেই দৃশ্যগত হলো এরীশের চওড়া পৃষ্ঠদেশ, লম্বা ঘাড়ে জুতসই করে কাটা সিল্কের মতো ঝরঝরে কালো চুল । মাফিয়া বসের জন্য বরাদ্দকৃত স্বর্ণাক্ষরে পাইথন সীলমোহর খোদাই করা বিশেষ কাউচ চেয়ারটাতে গা ছড়িয়ে বসে আছে এরীশ। তার পা দু’টো সামনের কনফারেন্স টেবিলের উপর আড়াআড়ি ভঙ্গিমায় মৃদু তালে দোল খাচ্ছে নির্বিগ্নে । চোখের সামনে খোলা ম্যাকবুক,তাতে একটা ঘাসের ওয়ালপেপার ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না আপাতত। পরনে এখনো ব্ল্যাক ভেলভেট স্যুট, একহাতের খাঁজে আটকে আছে রিভলবার, অন্যটাতে জলন্ত সিগারেট আর ওয়াইনের গ্লাস দু’টোই।
সব মিলিয়ে ভীষণ এলোমেলো লাগছে এরীশকে। তুষার নিজেও এই বারুদের মতো জ্বলন্ত দানবীয় সত্তার লোকটাকে এতোটা এলোমেলো দেখেনি কখনোই। তুষারের জানামতে এরীশ একটা যান্ত্রিক হৃদয়হীন জানোয়ারের চেয়ে কম কিছু নয়। তাহলে একটা জানোয়ার এতোটা উদাসীন হয়ে বসে থাকতে পারে কিভাবে ? কিইবা চলছে তার পৈশাচিক মস্তিকে? তখন থেকে পিনপতন নীরবতায় ছেঁয়ে আছে চারিপাশ, ধীর কদমে সামনে এগুতে এগুতে নীরবতা ভাঙলো তুষার, দ্বিধাহীন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— সকাল সকাল রেড ওয়াইন নিয়ে বসেছেন? ইজ’ন্ট ইট টু মাচ?
— আমার দুনিয়ায় সকাল বলে কিছু নেই তুষার। প্রতিটা মিনিট, প্রতিটা সেকেন্ড, প্রতিটা মূহুর্তই রাতের মতো কালো!
রুক্ষ স্বরে জবাব দিলো এরীশ। তুষার প্রত্যুত্তর করলো না আর, বিনাবাক্যে এগিয়ে এলো সম্মুখে। এরীশের নিকট আসতে না আসতেই ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে আরেক বীভৎস দৃশ্যপট। এরীশের পায়ের কাছে উপুর হয়ে আছে একটা নিথর শরীর। যার গরম রক্তস্রোতে চারিপাশ বর্ণালী। কুটকুটে কালো দেওয়ালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তাজা র’ক্তের রঞ্জিত লালিমা। যেন কালোর উপর লালের মিশ্রণে শৈল্পিক কোনো আবহ চিত্রকর্ম।
হতচকিত দৃষ্টি মেলে সামনের দিকে একবার তো এরীশের ভাবলেশহীন মুখের দিকে একবার চাওয়া চাওয়ি করলো তুষার।পরক্ষণেই
পায়ের কাছে পরে থাকা নিথর লা’শটাকে তীক্ষ্ণ চোখে পরখ দাঁত দাঁত পিষলো সে। থমথমে মুখাবয়বে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন না এনেই বিরক্তির স্বরে এরীশকে শুধালো,
— ওকে হঠাৎ মে’/রেছেন কেন?হাতের ট্যাটু দেখেতো মনে হচ্ছে টমেটো প্রিন্সের লোক।
— ডিল পছন্দ হয়নি তাই। এর বেশি জিজ্ঞেস করোনা, উত্তর পাবে না ।
এরীশের প্রত্যুত্তরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তুষার । মাফিয়া বসের এই উদভ্রান্ত কার্যকলাপ গুলো আজকাল সত্যিই বেশ ভাবায় ওকে।
— ইজ হি বিকাম আ সাইকোপ্যাথ অর সামথিং?
একা একাই বিড়বিড়ায় তুষার। তবে ওর ভাবনার সুতো ছিঁড়ে যায়, ওপাশ থেকে আগত এরীশের অযাচিত প্রশ্নবাণে,
— কাজটা তুমি করেছো তাই না?
সম্বিত ফিরে পায় তুষার। যদিও ওর অকুতোভয় কলিজাটা বড্ড বেশিই বেপরোয়া, তবে এরীশের নিকট বরাবরই ধরাশায়ী সে। সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহচর ঠিক যেমন করে মনিবের সামনে নতজানু, তুষার ও তার ব্যতিক্রম নয়। নিজের বুক চিতিয়ে হলেও এরীশ ইউভানের টেরিটোরি রক্ষায় সর্বদা তৎপর তুষার ।
ফলস্বরূপ বছর দশেকের পরিক্রমায় আজ এরীশ ইউভানের ডান হাত সে।
। তুষারের থেকেও প্রতিশোধের স্পৃহায় কয়েক ধাপ এগিয়ে এরীশ। সহজ ভাষায় বলা যায় অভিনব উপায়ে খু’ন করার কৌশল গুলো এরীশের কাছ থেকেই শেখা ওর । ওই জন্যই বোধ হয় খু’নের ধরণটা খুব বেশি পরিচিত ঠেকেছে এরীশের নিকট। সে যাই হোক আপাতত জটিল প্রশ্নের সম্মুখীন তুষার। ওর নিশ্চুপ অভিব্যক্তি যা বোঝার বুঝিয়ে দিলো এরীশ কে। সহসা আরেকদফা প্রশ্ন ছোড়ে মাফিয়া বস,
— ব্লাড ডায়মন্ড যে এখনো আমাদের হাতে এসে পোঁছাইনি সেটা ভুলে গেলে? আর তার চেয়েও বড় কথা,
মাঝপথে থমকে গেলো এরীশ, নিগূঢ় ভাবনায় ঠোঁট কামড়ে ধরলো অকস্মাৎ। এরীশ থেমে যাওয়াতে সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করে তুষার,
— তার চেয়েও বড় কথা কি এরীশ?
তুষারের প্রশ্নের জবাব দিলো না এরীশ। কিয়ৎক্ষন ভেবে তপ্তশ্বাস ছাড়লো নীরবে। অতঃপর নির্জীব যান্ত্রিক ভঙ্গিমায় আদেশ করলো তুষারকে,
— মেয়েটাকে মুক্ত করে দাও।
সরল কপাল বেঁকে গেলো তুষারের। দিগুন উদ্বেগে পুনরায় তরতরিয়ে জিজ্ঞেস করলো সে,
— আপনি কি কোনোভাবে মিস ব্লু আইড এ্যাঞ্জেল, আই মিন বাঙালি মেয়েটার কথা বলছেন?
নৈঃশব্দ্যে হ্যা সূচক মাথা নাড়ায় এরীশ। পরপরই বলে ওঠে,
— প্রাইভেট জেট রেডি করতে বলো। এস সুন এস পসিবল ওকে বিডি তে পৌঁছে দিয়ে এসো।
সহসা মুখাবয়ব থমথমে রূপ ধারণ করলো তুষারের। ও বোধ হয় খুব করে চেয়েছিল এটা না হোক, এরীশ কিছুতেই বদলে না যাক।নিজের চিরাচরিত পাশবিক হিংস্র সত্তায় দূর্গের ন্যায় অটুট থাকুক সে। কিন্তু না, সত্যি সত্যিই প্রথমবারের মতো পাইথন টেরিটোরি থেকে মৃত্যুর আগেই মুক্তি পেতে যাচ্ছে কেউ একজন।
অবশেষে এরীশের মতের বদল ঘটলোই তবে। সেই একরত্তি সহজ সরল মেয়েটার কাছে অজান্তেই পরাস্ত হলো এরীশ ইউভান। কিন্তু কিভাবে? অজ্ঞাত ভাবনায় বুদ হয়ে আসে তুষারের কৌশলী মস্তিষ্ক, অগত্যা ভাবান্তর না করে নির্দ্বিধায় বলে ওঠে সে,
— এরীশ ইউভানের হাতের মুঠো থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছে কেউ একজন। এটাকে কি হে’রে যাওয়া বলেনা?
তুষারের অযাচিত বাক্যে ঝিমিয়ে পরা মস্তিষ্কটা হুট করেই সচকিত হলো এরীশের। “হে’রে যাওয়া” শব্দটা বড্ড বেশি বেমানান মাফিয়া বসের সঙ্গে। বড্ড বাজে লাগে শুনতে।একরোখা জিদি সত্তটা ভেতর ভেতর চিড়বিড়িয়ে ওঠে প্রতিহিংসার অনলে।
অথচ এইমূহুর্তে এই বাজে শব্দটা গভীর ভাবনায় ডোবালো এরীশ কে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ছাপিয়ে মানস্পটে ভাসমান হলো একটা তুলতুলে আদুরে মুখ। সমুদ্র জলরাশি ন্যায় একজোড়া অপার্থিব গভীর নীল চোখ।যার পুরোটা জুড়ে ঘিরে আছে পবিত্রতার মহাপ্রাচীর। না চাইতেও ভেতরের অকুতোভয়ী পাপী সত্তাটা বারবার হাত বাড়ায় সেদিকে।ওদিকে ধ্বংস অবধারিত জেনেও পবিত্রতায় মিলেমিশে একীভূত হতে চায় ভেতরের বেপরোয়া বিধ্বংসী কলুষিত হৃদয়টা।মেয়েটার কথা ভাবলেই মরীচিকার মাঝে বিলীন হয়ে যাওয়া সুপ্ত অনুভূতি আজও গুপ্তঘাতক হয়ে জ্বালিয়ে দেয় অন্তঃকরন।
এরীশ জানে এটা কিছুতেই সম্ভব নয়। একটা অত্যাচারীর চোখে নিজের জন্য এই অনুভূতিটুকু আবিষ্কার করলে নিশ্চয়ই সেটা ঝিল ধরা অঙ্গারের মতোই নীরবে পো’ড়াবে ঈশানীকে। তবুও, তবুও সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে মেয়েটাকে এখানে, এই পেন্টহাউজে, অর্থাৎ নিজের কালো দুনিয়ায় সারাজীবন রেখে দিতে পারে এরীশ। তথাপি কোনোদিন মুখে প্রকাশ না করেও চোখের তৃষ্ণাটুকু অন্তত মেটানো যেত আড়ালে। কিন্তু সেদিন রাতে নেশায় বুদ হয়ে ঈশানীর বলা ওই অসহায় কথাগুলো আজকাল বড্ড পো’ড়ায় এরীশকে। কর্ণকূহর ছাপিয়ে ভেতরের মানব সত্তাটাকে ঝোড়ো হাওয়ার মতো নাড়িয়ে দেয় নীলাম্বরীর আহত গলার সুর। দিনরাত সারাক্ষণ কানের মাঝে ঝঙ্কার তোলে ওই ক্রন্দনরত বাক্যগুলো,
— আপনি আমায় নিয়ে যেতে পারবেন বাড়িতে? আমি সত্যিই এখান থেকে মুক্তি চাই, ঘৃণা করি এরীশকে, ভয় পাই ওকে।বলুন না এখান থেকে নিয়ে যাবেন তো আমায়?
সেসব কথা ভাবতে ভাবতে অচিরেই পরাস্ত হয়ে পরে মাফিয়া বস। তুষারের কথার প্রত্যুত্তরে মনে মনে বলে,
— দুনিয়া জানেনা। অথচ এরীশ ইউভান অলরেডি হেরে গিয়েছে তুষার৷ ওই মেয়েটার সরলতা, পবিত্রতা, একাগ্রতা সবকিছুই ছিল আমার বুকে নিক্ষেপ করা একেকটা বি’ষাক্ত তীরের ফলা। যা অসাবধানতায় হারিয়ে দিয়েছে আমাকে। চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে পুরো দুনিয়ার কাছে মাফিয়া কিং হলেও ওর নিকট সুক্ষ্ম পন্থায় পরাজিত আমি । আর সে পরাজয় নির্দ্বিধায় মাথা পেতে নিয়েছে এরীশ ইউভান।
তখন থেকে নির্বিকার এরীশ,এতোক্ষণ ধরে তুষার বিনাবাক্যে দাঁড়িয়ে থাকলেও এই পর্যায়ে এসে আগ বাড়িয়ে প্রশ্ন করলো সে। গলার মাঝে মেকি গম্ভীরতা টেনে গমগমে আওয়াজে বললো,
— আপনাকে বুঝে উঠতে পারছি না এরীশ। দিনে দিনে কেমন রহস্যে রূপান্তরিত হচ্ছেন।
তুষারের কথায় সম্বিৎ ফিরে পেলো এরীশ,আঙুলের ফাঁকে পু’ড়তে থাকা সিগারেটের শেষাংশটুকু তুচ্ছ হস্তে ছুড়ে ফেলে দিয়ে হাস্কিস্বরে বললো,
— হার টা যেমন আমি নিশ্চিত করি, জিত টাও তাই। আমি চেয়েছি বলেই ও জিতে গিয়েছে তুষার । তবে হ্যা, এরীশ মুক্তি দেয় ঠিকই, স্বাধীনতা নয়।
আবারও রহস্য। সহসা মাফিয়া বসের সঙ্গে কথার মারপ্যাঁচে হে’রে গিয়ে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তুষার।অতঃপর কানে এয়ারপড গুঁজে কল লাগায় কাউকে, কিয়ৎক্ষন সেভাবেই অতিবাহিত হয়। কথা শেষ করে ফের এরীশের পানে দৃষ্টিপাত করে সে, নিরেট স্বরে বলে,
— এজেন্সির সঙ্গে কথা বলেছি, সন্ধ্যায় স্নো ফল হওয়ার সম্ভাবনা প্রকট, এমতাবস্থায় এয়ারট্রাফিক বেশি হয়ে থাকে। আজ না হলেও কাল…
ওকে মাঝপথে থামিয়ে দেয় এরীশ। কঠোর আদেশ করে বলে,
— আজ বলেছি মানে আজই। গতকাল রাতে তুমি যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছো তার পরেও সবকিছু স্বাভাবিক থাকবে বলে তোমার মনে হয়?
— আপনি কি কৌশলে মেয়েটাকে সেফ করতে চাইছেন এরীশ ?
জবাব দিলোনা এরীশ। তুষার ও আর ঘাটালো না ওকে। লম্বা পা ফেলে নিঃশব্দে ত্যাগ করলো কনফারেন্স রুম।
— এটা কি মাছ?
— স্টার্জেন ফিশ বলে এটাকে।
— সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু এটার পেট থেকে এমন ঠেলেঠুলে টানা হেঁচড়া করে ডিম কেন বের করছো তুমি।
— তুমি ক্যাভিয়ার চেনোনা।
ফ্লোরার অযাচিত বাক্যে সহসা না সূচক মাথা নাড়ায় ঈশানী, অজ্ঞাত স্বরে বলে,
— ক্যাভিয়ার! সেটা কি জিনিস?
মৃদু হাসে ফ্লোরা, হাতের কাজ অব্যাহত রেখে বলে,
— এই মাছের ডিমটাকেই সংরক্ষণ করা হলে সেটাকে ক্যাভিয়ার বলা হয়। এই ডিমগুলো স্বর্ণের চেয়েও দামি আর অত্যাধিক পুষ্টিকর । সাধারণ মানুষ সচারাচর খেতে পারেনা এগুলো। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এটাকে কাঁচাই খাওয়া হয়, লাইক স্যামন অর টুনা।
ফ্লোরার কথায় নাক সিঁকোয় উঠে যায় বাঙালি রমণীর। যদিও ঈশানী সাগর পারের মেয়ে। তবুও কাঁচা মাছ, অথবা মাছের ডিম খাওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনা ও। ফলস্বরূপ ব্যয়বহুল এই ক্যাভিয়র নিয়ে আরও কথোপকথন এগোবে তার আগেই একজন গার্ড এসে হাজির হয় কিচেন কাউন্টারের সামনে। গার্ডটাকে দেখা মাত্রই জমে যায় ওরা দু’জন। কিছু না ভেবেই চোখাচোখি করে কৌতূহলে। এরই মাঝে মূর্তিমান গার্ডটা কথা বলে ওঠে অকস্মাৎ। সে ঈশানীকে উদ্দেশ্য করে বলে,
— গোছগাছ করে নাও। তুমি শীঘ্রই চলে যাচ্ছো।
গার্ডটার কথায় ভ্রু কুঁচকালো ঈশু,ফ্লোরার পানে একপল শঙ্কিত দৃষ্টি ফেলে, ফের প্রশ্ন ছোড়ে সবেগে,
— যাবো মানে! কোথায় যাবো?
মাফিয়া ক্লাবের ওই বিশ্রী রাতটার কথা মনে পরতেই ইতিমধ্যে বুকের ভেতরটা ধরাস ধরাস করতে শুরু করে দিয়েছে ভীত মেয়েটার। যদিও বা গত বেশকিছুদিন ধরে ওকে কোনোরূপ আ’ঘাত করে না এরীশ। না মানসিক, আর না তো শারীরিক । তবুও কেন যেন আতঙ্কে জর্জরিত হয়ে প্রতিটা মূহুর্ত পেন্টহাউজে অতিবাহিত করে ঈশানী। কে বলতে পারে এই শিথিলতা যে মাফিয়া বসের নতুন কোনো চাল নয়? ওর র’ক্ত সরে যাওয়া আতঙ্কিত মুখের পানে চেয়ে নির্নিমেষ উত্তর দিলো গার্ডটা,
— বাড়িতে, তুমি তোমার বাড়িতে ফিরে যাচ্ছো। খুব শীঘ্রই এই পেন্টহাউজ থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছো তুমি।
গার্ডটার কথায় চোখ কপালে উঠে গেলো ঈশানীর। কয়েক মূহুর্তের জন্য কথা বলতে ভুলে গেলো ও। কেবল অবিশ্বাস্য নজরে ফ্যালফ্যালিয়ে রাশিয়ান গার্ডটার দিকে চেয়ে রইলো একদৃষ্টে।
মনে হচ্ছে ভুল শুনেছে ও। রুশ ভাষা বুঝতে ভুল হতেই পারে, কিন্তু যদি সত্যি হয়? এটা কি আদৌও সম্ভব এ জীবনে? নিজেকেই নিজে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে ঈশানী।
এমন সময় ওর বাহু আঁকড়ে ধরে ঝাঁকিয়ে ওঠে ফ্লোরা। খুশির জোয়ারে উদ্ভাসিত ওর সুশ্রী মুখমণ্ডল।সেভাবেই চমৎকার হাসিতে ঠোঁট প্রসারণ করে বলে,
— অবশেষে তোমার ইচ্ছে পূরণ হতে যাচ্ছে ঈশু! তুমি এবার বাড়ি ফিরতে চলেছো।
চকিতে চোখ ঘোরালো ঈশানী। অবিশ্বাস্য কন্ঠে ফ্লোরাকে উদ্দেশ্য করে বলে ,
— আমি বোধ হয় ভুল শুনেছি ফ্লোরা, একটা চিমটি কাটো তো দেখি।
সবকিছু রেডি, সন্ধ্যা রাতের ফ্লাইট। একটু পরেই পেন্টহাউজ ত্যাগ করবে ঈশানী। যাওয়ার আগে শেষ বারের মতো এরীশের অফিস কক্ষের সামনে এসে দাড়িয়েছে ও। আজ আর কুণ্ঠিত পায়ে নয়, বরং অনেকটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে হেঁটে এসেছে এখানে।
ঈশানী দরজার সামনে দাঁড়াতেই গার্ড’সরা খুলে দিলো দরজাটা। এরীশ ভেতরেই ছিল, সঙ্গে তুষার ও। মাঝখানের দরজাটা সরে যেতেই গন্তব্য খুঁজে পায় এরীশের কাঙ্ক্ষিত দু নয়ন। সে চিবুকে আঙুল ঠেকিয়ে দ্বিধাহীন ব্যগ্র চিত্তে নিস্প্রভ চেয়ে থাকে মেয়েটার দিকে। মনে হচ্ছে আত্মসংযম আজ পুরোপুরি ব্যাহত।
কিছু একটা ভেবে ভেতরে ঢুকতে যেয়েও ঢুকলো না ঈশানী। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে লম্বা শ্বাস টেনে ভেতরে অনেকটা সাহস পুঁজি করে নিলো প্রথমে।অতঃপর মাফিয়া বস টাকে উদ্দেশ্য করে ক্রুদ্ধস্বরে বলে উঠলো,
— বলেছিলাম আপনাকে, আপনার এই পাপের দুনিয়া থেকে কোনো না দিন ঠিক বের হবো । সেদিনই আপনাকে হারিয়ে জিতে যাবো আমি । আর দেখুন সেই সময় সন্নিকটে। আপনার মতো অ’ত্যাচা’রী, পাপিষ্ঠ, খু/নিটাকে হারিয়ে দিয়েছি আমি। আপনি আমাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছেন। এভাবেই সবসময় পরাস্ত হয় পাপীরা। বুঝেছেন? আমার মতো একটা দূর্বল অসহায় মেয়ের কাছে হে’রে গিয়েছেন আপনি। এরীশ ইউভান হে’রে গিয়েছে। আপনার এই কলুষিত মুখটা আর দ্বিতীয়বার দেখতে চাইনা আমি, কোনোদিন না!
এক নিঃশ্বাসে জোর গলায় কথাগুলো বলে থমকায় ঈশানী। মাফিয়ার শূন্য দৃষ্টির সঙ্গে ওর নীল চোখ জোড়ার মিলন ঘটার সঙ্গে সঙ্গে আড়ষ্টতায় চোখ নামায় মেয়েটা। জিভের ডগায় শুষ্ক অধর ভিজিয়ে বিতৃষ্ণার ঢোক গিলে আচানক। এতোকিছু বলার পরেও কেন নির্বিকার লোকটা? কেন আজ ধূসর চোখে হিং’স্রতার লেশ নেই? না আছে কঠিন মুখাবয়ব। যেন ঈশুর কথাগুলো বড্ড বেশি অপ্রিয় ঠেকছিল তার নিকট, তেমন করেই শূন্য অনুভূতিহীন চোখ মেলে চেয়েছিল শুধু।
এরীশের নির্বিগ্নতায় ঈশানী যখন পুরোপুরি হতচকিত। তখনই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় মাফিয়া বস। নিভৃত কদম ফেলে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে মেয়েটার নিকট। এরীশ এগিয়ে আসতেই ওর পানে কুণ্ঠিত চাউনী নিক্ষেপ করে ঈশানী, দেখতে পায় নির্ঘুম এলোমেলো মুখাবয়ব। ফিনফিনে শুষ্ক অধর, তার ঠিক নিচে কুচকুচে কালো তিল। লোকটার উদভ্রান্ত ব্যাকুল চেহারার পানে এক পল নজর বুলিয়ে তরাগ করে চোখ নামায় ঈশানী। আড়ষ্টতায় জমে গিয়ে পিছুপা হয় নীরবে। এরীশ ওর কাছে এগোয়, খুব কাছে। গ্রীবাটা সামান্য নিচু করে গভীর দৃষ্টি মেলে মেয়েটার চোখের মাঝে চোখ রাখে, কিছুক্ষণের অসহনীয় নীরবতা। অতঃপর চট করেই হাস্কিস্বরে বলে ওঠে,
— জানিনা আবার কবে সুযোগ পাবো।
আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২৪
ব্যাস এটুকুই, কথাশেষ হতে না হতেই ঈশুকে বুঝে ওঠার সামান্যতম ফুরসত না দিয়ে, ওর সরু ঘাড়টা ঢেউয়ের আঁচড়ের ন্যায় কাছে টেনে আনে একহাতে , অন্যহাতে তুলতুলে চিবুকটা শক্ত করে চেপে ধরে বিদ্যুৎ বেগে অধর ডোবায় সরলতার কোমল ওষ্ঠপুটে। প্রথমবারেই গভীর এক জোরালো চুম্বনের তোড়ে ঝোড়ো হাওয়ার মতো লণ্ডভণ্ড করে তোলে রমণীর নেতিয়ে পরা অনুভূতির অভায়ণ্যকে। ভয়, জড়তা, আর অবিশ্বাসের মিশেলে
রুগ্ন মানবীর ন্যায় তিরতির করে কেঁপে ওঠে তার সবার্ঙ্গ। যা স্পষ্ট অনুভব করেছিল মাফিয়া বস । তবুও ছাড়েনি মেয়েটাকে। যেন বহুবছরের আমরণ তৃষ্ণা একযোগে মেটানোর ক্ষুদ্র প্রয়াস চালাচ্ছে সে।