আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২৬ (২)

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২৬ (২)
suraiya rafa

দোতলার বেজমেন্ট ছাড়িয়ে ঝড়ের বেগে উপরে উঠছে এলিভেটর টা। গন্তব্য চিরাচরিত মাফিয়া পেন্টহাউজ। এলিভেটরের মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে এরীশ। হৃদয়হীন লোকটার ভেতরে ঠিক কিরূপ ঝোড়ো হাওয়া বইছে সেটা আদৌও অনুমান করা না গেলেও ওর হিং’স্র চোখের অকস্মাৎ পরিবর্তিত হওয়া শিশুসুলভ ব্যাকুল চাহনি অনেক কিছুই বলে দেয়। মুখে প্রকাশ না করলেও স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয় ভেতরের অপ্রকাশিত অনুভূতিরা অসহনীয় বেদনায় নীল হয়ে যাচ্ছে।

এরীশের ব্যাতিগ্রস্থ মন এমন একটা মেয়েকে বেছে নিয়েছে, যে কিনা ওর হাতে নিপীড়িত। একাধিক বার যাকে আ’ঘাত করেছে ও,কথার বারুদে ঝলসে দিয়েছে তার নাজুক হৃদয়টা, এমনকি একজন প্র’স্টিটিউড বানানোর জন্য যা যা করতে হয় ঠিক তাই করেছে। অথচ পৈশাচিক সত্তার বাইরে গিয়ে ওই মেয়েটার জন্যই বারবার বিচলিত হয়েছে ওর কলুষিত আবেগহীন চিত্ত। মাফিয়া বস দূর্বলার উর্ধ্বে, কিন্তু এই মূহুর্তে এরীশের নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে দূর্বল আর বোকা মানুষটি মনে হচ্ছে, যার পাথর হৃদয়টা দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে ওই সাধারণ মেয়েটার জন্য।
ইচ্ছে করছে অস্ত্রাগার থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী মেশিন গানটা নিয়ে বেড়িয়ে পরতে। পুরো শহরে লক ডাউন লাগিয়ে দিয়ে ওই মেয়েটাকে আবারও নিজের কাছে এনে বন্দি করে রাখতে। কিন্তু তাতো সম্ভব নয়! যুদ্ধ বাঁধিয়ে হলেও পছন্দের জিনিস কেড়ে নেওয়া এরীশের ধর্ম। অথচ কারোর মনের দখলদারি কিভাবে কেড়ে নিতে হয় সে কৌশল জানা নেই মাফিয়া বসের। এমনকি এটাও জানা নেই কারও হৃদয় থেকে কিভাবে মুছে ফেলতে হয় পাহাড় সম ঘৃণার আস্তর । জানা থাকলে হয়তো ওই ভীত সরল মেয়েটার চোখ থেকে ঘৃণাটুকু সবার আগে মুছে ফেলতো এরীশ।
কারণ, ওই গভীর নীল চোখে ঘৃণার জোয়ার মোটেই সহ্য হয়না ওর।যেন পৃথিবী কাঁপিয়ে বিদ্রোহ করে ওঠে মাফিয়া বসের সমগ্র অস্তিত্ব।হুংকার ছেড়ে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— পুরো পৃথিবী আমাকে ঘৃণা করার অধিকার রাখলেও, তুমি রাখোনা। তোমার ওই অদ্ভুত নীল চোখের ঘৃণা পৃথিবীর সমগ্র ঘৃণার তুলনায় হাজার গুন বেশি শক্তিশালী, যা আমার পাপিষ্ঠ হৃদয়টাকে যন্ত্রণায় দগ্ধ করে দেয় ক্রমাগত।
অথচ শেষ অবধি ওই নীল চোখে কেবল ঘৃণাই দেখে গেলো এরীশ। এটা বোধ হয় ওর প্রাপ্য। আর যাই হোক, একটা ব্লাডি মনস্টার কে কেউ ভালোবাসে না, বাসতে পারেনা।

ভবনের শেষ মাথায় এসে থামলো এলিভেটর। দরজার পাসওয়ার্ড দিয়ে ভীরু কদমে ভেতরে প্রবেশ করলো এরীশ। এক পা,দু’পা, তিন পা,
ব্যাস, থমকে গেলো পদধ্বনি। ক্রমশ স্থবির হয়ে পরলো দানবীয় শরীরের সমস্ত শক্তিবল। নিগূঢ় শূন্যতায় আচ্ছাদিত হতে লাগলো মস্তিষ্কের শিরা উপশিরা। নির্জীব দৃষ্টি ফেলে চারিদিকে চোখ ঘোরালো সে। লাউঞ্জ, কিচেন কাউন্টার, ছাঁদ বারান্দা,স্টাফ কোয়ার্টার সবকিছুতে নেমে এসেছে ভয়াবহ শূন্যতা। চারিদিকে ফকফকে আলোক রোশনাই, তাও কালো লাউঞ্জের প্রগাড় তমশায় ঘোলাটে লাগছে নেত্রদ্বয় ।

কোথাও নেই সাকুরা, কোথাও না। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে এরীশের, যেন চোখের সামনে সবকিছু অচেনা। পুরো পেন্টহাউজ জুড়ে উপচে পরছে আভিজাত্য। কোনো খাদ নেই, কোনো কমতি নেই, তবুও কিসের যেন অনুপস্থিতিতে অহেতুক ফিকে লাগছে সব। জীবনে প্রথমবার কারোর অনুপস্থিতি নীরবে পো’ড়াচ্ছে ওকে।হৃদযন্ত্রে হাতুড়ির মতো আ’ঘাত করে ক্রমাগত বুঝিয়ে দিচ্ছে একটা অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা।
— এটা কোনো সুপ্ত অনুভূতি ছিলইনা, এটা ছিল অনুভূতির জলোচ্ছ্বাস। যে জলোচ্ছ্বাসের বহুল তীব্রতায় অজান্তেই গুড়িয়ে গিয়েছে আত্মসংযমের কঠোর প্রাচীর,প্রেমানুভূতির শীতল বারিধারায় সিক্ত হয়েছে পাথর হৃদয়।
কিন্তু বিধিবাম, এতোগুলো দিনেও তার সামান্য তম গভীরতা আঁচ করতে পারেনি মাফিয়া বস।
— কেন এসেছিলে আমার জীবনে? কেন তোমাকে উপেক্ষা করতে পারিনি আমি? কেইবা তোমাকে পাগলের মতো মিস করছি এখন? আহহহ! আই হেইট দিস ফাকিং ইমোশন।
দু’হাতে চুল খামচে ধরে আনমনে গর্জে ওঠে এরীশ। তার ক্ষীপ্রতার স্বীকার হয় পায়ের কাছে অবস্থানরত নান্দনিক সেন্টার টেবিলটা।

কাচ ভাঙার ঝনঝন আওয়াজে এপাশ ওপাশ থেকে লুকিয়ে চুরিয়ে উঁকি দেয় স্টাফরা।
তাতে বিন্দু পরিমাণ ভ্রুক্ষেপ না করেই সামনে এগোয় এরীশ,প্রচন্ড ক্রোধের বশবর্তী হয়ে অতর্কিতে হাতের কাছে যা পায় সেটাকেই ছুড়ে ফেলে দেয় দিগ্বিদিক। মূহুর্তেই কাচের টুকরো আর ভাঙা আসবাবে ভরে ওঠে লাউঞ্জের তকতকে মসৃণ মেঝেটা।
যুদ্ধটা যখন মনের সঙ্গে মস্তিষ্কের হয়, তখন দ্বিধাগ্রস্থতা হয় কেবলই রসিকতা। এরীশ কোনোভাবেই পারছে না নিজের অনুভূতিকে সামাল দিতে, পারছে না ওই পান পাতার মতো আদুরে মুখটা মানস্পট থেকে এক মূহুর্তের জন্য সরিয়ে দিতে। ওর চোখে ঈশানী ছিল শুভ্র মেঘের মতো নমনীয় ,যা পৃথিবীর সকল রুক্ষতাকে এক নিমেষে গলিয়ে দিতে সক্ষম।
কিন্তু সেই নমনীয়তাটুকু এখন আর অবশিষ্ট নেই,সুমিষ্ট ভ্যানিলার সুঘ্রাণ নেই, নীল চোখের অভিমানী চাহনি নেই, নুপুরের রিনরিন আওয়াজ নেই, কোথাও খিলখিল হাসির ঝঙ্কার নেই, সর্বোপরি সাকুরা নেই। নেই,নেই, কোথাও নেই।

আবারও হাতের কাছের ইনডোর প্লান্টটা সশব্দে ছুড়ে মা’রে এরীশ। ঈশানীর অনুপস্থিতি ওকে ক্রমশ উন্মাদ বানিয়ে দিচ্ছে। এগুতে এগুতে সিঁড়ির কাছে এসে দ্বিতীয়বারের মতো থমকালো মাফিয়া বস, কি মনে করে সামনে পা বাড়িয়ে গতিপথ পাল্টালো ফের। এগিয়ে গেলো ঈশানীর বারো বাই বারো ফিটের ছোট্ট রুমটার দিকে। রুমের সামনে দাঁড়িয়ে একচিলতে তপ্তশ্বাস ছেড়ে, হাত বাঁড়িয়ে ঠেলে খুললো দরজাটা।
তৎক্ষনাৎ ভ্যানিলার হৃদয় নিংড়ানো সুবাসটা হানা দেয় ওর নাসারন্ধ্রে। এতোক্ষণে শ্বাসপ্রশ্বাস কিছুটা স্বাভাবিক হলো যেন। ভেতরে দানাবাঁধা ধ্বং’সাত্বক যুদ্ধটাও ক্ষণিকের মাঝে বিলীন হয়েছে মুগ্ধতার আড়ালে।
—লিভ

কক্ষের মাঝে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতায় কার্যরত স্টাফ গুলোকে কঠোর স্বরে আদেশ করে এরীশ। তৎক্ষনাৎ মাফিয়া বস কে কুর্নিশ জানিয়ে দ্রুত পায়ে রুম ত্যাগ করে তারা।সকলে বেড়িয়ে যেতেই প্রকম্পিত গতিতে ভেতরে পা বাড়ায় এরীশ। এই স্নিগ্ধ সুবাসটা ক্রমান্বয়ে স্মৃতিকে জীবন্ত করে দিচ্ছে ওর। ঘরের আনাচে-কানাচে প্রত্যেকটা জিনিস কেবল ঈশানীকেই মনে করিয়ে দিচ্ছে। একজোড়া ভীত নীল চোখ, অসাধারণ সেই নাচের ভঙ্গিমা, মেকি আত্মবিশ্বাস ধরে রাখার বৃথা প্রচেষ্টা, এমনকি যাওয়ার আগের অতর্কিত ঠোঁটের মিলন, যা কোনোদিন ভুলতে পারবে না এরীশ। যদিও চুমু টা ছিল একপাক্ষিক, এটার জন্য হয়তো ভবিষ্যতে আরও বেশি ঘৃণা করবে ঈশানী ওকে। তাও শুধু মাত্র এই একটা ব্যাপারে অনুশোচনা নেই এরীশের।
ভাবনার জগত ছাপিয়ে ধীরে ধীরে স্টাডি টেবিলটার দিকে এগিয়ে যায় এরীশ, সেখানে কলম টা পরে থাকলেও ডায়েরিটা অনুপস্থিত।

এই রুমটা ছিল জেলখানার মতোই একাকী আর অসহনীয় । মোবাইল, ইন্টারনেট এমনকি যোগাযোগের জন্য ফ্যাক্স মেশিনটাও ছিল অনুপস্থিত ।ফ্লোরার রুমে তাও ফ্যাক্স মেশিন রয়েছে, এখানে সেটাও দেওয়া হয়নি। অবশ্য দেওয়ার কথাও নয়, এরীশ তো মেয়েটাকে ট’র্চার করতে রেখে দিয়েছিল। নিজের ক্ষমতা আর কাঠিন্যতার জোরে বাধ্যগত মেয়েটাকে ওর বশ্যতা স্বীকার করাতে চেয়েছিল।
ভাগ্যের পরিহাসে হলো তার উল্টো টা। ডেসটিনি সবকিছু পাল্টে দিয়েছে,মাফিয়া বস হাজার চেয়েও নিজের মনের উপর কতৃত্ব ফলাতে পারেনি,আর না পেরেছে নাজুক মেয়েটাকে শেষ অবধি নিজের অন্ধকার সাম্রাজ্যে বন্দি করে রাখতে। উল্টো নিজের অজান্তেই নিপতিত হয়েছে প্রণয়ের দিশাহীন অনলে।
টেবিলের উপর অযত্নে ফেলে রাখা তুচ্ছ কলমটার দিকে দুনিয়ার সবটুকু মনোযোগ স্থির রেখে চাপা দীর্ঘশ্বাসের মাধ্যমে ভেতরের আহত বাতাসটুকু ঠেলে বের করলো এরীশ। অতঃপর হাত বাড়িয়ে ছুলো কলমটাকে,তুচ্ছ বস্তুটিকে অহেতুক নাড়াচাড়া করতে করতে সেদিকে নিগূঢ় দৃষ্টি ফেলে আহত স্বরে বলে উঠলো ,
— আই নো, আই ওয়াজ নেভার দ্যা হিলার। আই ওয়াজ অলওয়েজ আ বার্ডান টু ইউ। ইয়েট, আই মিস ইউ। মিস ইউ লাইক হেল।

কলমটাকে এতো কাতর হয়ে স্পর্শ করছিল যেন মনে হচ্ছিল এটা কলম নয় স্বয়ং ঈশানী। পরমূর্হতেই পেছন থেকে ওর নাম ধরে ডেকে উঠলো কেউ,
—এরীশ!
ভাবনার ছেদ ঘটলো মাফিয়ার । চট করে পেছনে ঘাড় ঘোরাতেই দেখলো ফ্লোরা দাঁড়িয়ে, এরীশ পেছনে ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে ওকে মাথা নুয়িয়ে কুর্নিশ জানালো ফ্লোরা,কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বললো,
— আসলে ঈশু এই পেন্টহাউজ থেকে পাওয়া কোনোকিছুই সাথে করে নিয়ে যায়নি।তাই ঘরটা পরিস্কার করার নির্দেশ আমিই দিয়েছিলাম স্টাফদের।
ফ্লোরার কথায় হতচকিত হলো এরীশ, কৌতূহলে ভ্রু কুঞ্চিত করে সশব্দে টান মে’রে খুলে ফেললো এ্যান্টিকের ছোট্ট আলমারিটা। দেখলো,ঈশানীর পরিহিত ফ্রক থেকে শুরু করে ওভারকোট এমনকি উলের তৈরি সোয়েটার আর গ্লাভস গুলোও এখানে রাখা। পুরো আলমারিতে একপল চোখ বুলিয়ে তীর্যক স্বরে প্রশ্ন ছুড়লো এরীশ,

— নেয়নি কেন?
— বলেছে এখানকার কোনোকিছুই প্রয়োজন নেই ওর।
— ওহ!
ছোট্ট করে প্রত্যুত্তর করলো এরীশ। ফ্লোরা চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়ে, ফের পেছনে ঘুরে শুধালো,
— তাহলে কি স্টাফদের,
— নাহ!
বাক্য শেষ করার আগেই প্রসঙ্গে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলো এরীশ। গমগমে আওয়াজে বললো,
— এটা যেমন আছে তেমনই থাকবে।অহেতুক পরিস্কার করার দরকার নেই।
এরীশের হঠাৎ রুম নিয়ে তৎপরতা দেখে হতবাক হলো ফ্লোরা। তাও কথা না বাড়িয়ে হ্যা সূচক মাথা দোলালো নির্লিপ্তে। অতঃপর এরীশকে একা রেখেই তাড়াহুড়ো করে আড়ষ্ট কদমে ওই জায়গা থেকে প্রস্থান করলো মেয়েটা ।
ফ্লোরা চলে গেলে আলমারির ভেতর থেকে নির্বিকারে ঈশানীর একটা ফ্রক বের করে আনে এরীশ। কোনোকিছু না ভেবেই বেসামাল হয়ে অতর্কিতে নাক ডোবায় তাতে। আলমারিতে পরে থাকার দরুন ভ্যানিলার সুঘ্রাণটা ফিকে হয়ে এসেছে যেন, তবুও এরীশের উদভ্রান্ত মস্তিষ্ক জুড়ে প্রগাড় শিথিলতা ছড়িয়ে দিতে সাকুরার পরিধেয় এই ফিনফিনে ফ্রকটাই ছিল যথেষ্ট।
মস্তিক কিঞ্চিৎ শিথিল হয়ে এলে,তরতরিয়ে মাথাচাড়া দেয় ভেতরের দানবীয় পৈশাচিক সত্তা, একটা মেয়ের অনুপস্থিতিতে মাফিয়ার অসহায় বিবর্ণ চেহারার দিকে চেয়ে উপহাস করে ওঠে সে, অনুভূতির বিপক্ষে কঠোর অবস্থান নিয়ে বলে,

— পাইথন লিডারকে এতোটা অসহায় মানায় না, এতে যোগ্যতার প্রশ্ন ওঠে। যত দ্রুত সম্ভব ভুলে যা মেয়েটাকে, ছিড়ে ফেল ওসব ইউজলেস কাগজ ফাগজ । নয়তো কোনো একদিন এই দূর্বলতা তোর ধ্বং’সের কারণ হয়ে উঠবে! মনে রাখিস, ধ্বং’স হয়ে যাবি তুই!
মস্তিষ্কের ভাবনায় অগ্নুৎপাতের ন্যায় আচানক জ্বলে ওঠে এরীশ। সহসা দানবীয় সত্তার গ’লাটিপে ক্রুব্ধস্বরে বলে ওঠে,
— অসম্ভব!

এক পর্যায়ে রাগ আর অনুভূতির সংমিশ্রণে দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে হাঁটু ভেঙে ধপ করে মেঝেতে বসে পরলো হিমালয়ের ন্যায় অটল মানুষটা। সুঠাম পৃষ্ঠদেশ গিয়ে ঠেকলো সরু খাটের কার্নিশে। ঈশানীর জামাটা তখনও একহাতে মুঠিবদ্ধ,সেভাবেই মাথাটা শূন্যে এলিয়ে দিয়ে বিস্তার সিলিং এর দিকে দৃষ্টিপাত করলো সে।
আশ্চর্য! সমগ্র সিলিং জুড়ে একই দৃশ্য ভাসমান । বুকের মাঝে তোলপাড় করে দেওয়া সেই গভীর নীল চোখ। সেদিকে চেয়ে থেকে নিজের উপর বিদ্রুপ করে হাসলো এরীশ,পরমূহুর্তেই চোখেমুখে নেমে এলো তার বিষাদের ঘনঘটা। কিয়ৎক্ষন অতিবাহিত হলো বিষণ্ণ নীরবতায়। পরমূহুর্তেই মোহাবিষ্টের ন্যায় পূর্ণ দৃষ্টি মেলে ভাসমান নীল চোখের দিকে চেয়ে থেকে মতিভ্রমে বিড়বিড়ালো মাফিয়া বস,
— তুমি ছিলে মরীচিকার সাম্রাজ্যে একফালি পথের দিশা,আঁধার হৃদয়ের একটুকরো আলোক শিখা। তুমি আমার নামে লেখা সেই পবিত্র নীল আকাশ, যার অধিকার থেকে স্বয়ং বিচ্যুত আমি। অথচ তুমি শুধুই আমার, প্রেম আমার!

কক্সবাজার, বাংলাদেশ।
সূর্যের সোনালী রশ্মিতে জ্বলজ্বল করছে চারিদিক। দক্ষিণ থেকে ভেসে আসছে দোদুল্যমান উত্তাল সামুদ্রিক গর্জন। বৃক্ষ আচ্ছাদিত রাস্তার চারিপাশে মুঠো মুঠো সোনালী রোদের হাতছানি। বরফের মাঝে জমে নেই কোনোকিছু, গাছপালা ঘরবাড়ি সবকিছু সতেজ। জানুয়ারি মাসের শেষ কয়েকটা দিন হওয়ায় জুতসই শীতের রেশ এখনো উপস্থিত। তবে রাশিয়ার অসহনীয় ঠান্ডার তুলনায়, এই শীতটুকু নিছকই আরামদায়ক আর ভীষণ উপভোগ্য।
কচি ঘাসে পতিত বিন্দুসম শিশির কণাগুলো যেন ঝুরোঝুরো মুক্তোদানা।
সতেরো ঘন্টার লম্বা ফ্লাইটের ইতি টেনে, ভোর রাতে ঈশানীকে নিয়ে ঢাকায় এসে পৌঁছেছে তুষার। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে সোজা কক্সবাজার। আর এখন তুষারের ব্যক্তিগত রেঞ্জ রোবারটা উর্ধ্বশ্বাসে এগিয়ে যাচ্ছে ঈশানীদের শ্যাওলা পরা ছোট্ট দোতলা বাড়িটার অভিমুখে।
চোখে রোদ চশমা এটে নির্লিপ্তে গাড়ি ড্রাইভ করছে তুষার। মুখের উপর মাস্ক লাগানোর দরুন তার অভিব্যক্তি বুঝে ওঠা দায়। অন্তর্মুখী ঈশানী সেদিকে নজর দিলোনা খুব একটা,

— তুষারের কিসের এতো দায়বদ্ধতা যে ওকে সূদুর রাশিয়া থেকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিচ্ছে? মাফিয়ারা তো এতোটা সদয় নয়?
প্রশ্নটা মনে এলেও, মুখে প্রকাশ করার ইচ্ছে জাগেনি ঈশুর।সহসা ঘাড় ফিরিয়ে সন্তোর্পণে নামিয়ে দিয়েছে গাড়ির টিন্ডেড জানালাটা। জানালা নামাতেই একচ্ছত্র দমকা বাতাসে শরীরের লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেলো নিমেষে ।বহুদিন বাদে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধে প্রাণ জুড়িয়ে এলো ওর। ঈশানী আজ ভীষণ খুশি,চোখে মুখে জড়ো হয়েছে উপচে পরা প্রফুল্লতা। জানালায় চিবুক ঠেকিয়ে এতোটা বিভোর নয়নে চারিদিক অবলোকন করছে যেন সবকিছুই ওর কাছে নতুন। ঠোঁটের আগায় লেপ্টে আছে সদ্য জন্মানো শিশুর ন্যায় এক চিলতে বিমোহিত হাসি, অশ্রুসিক্ত দু’নয়ন।ঈশানী জানেনা এতোগুলা দিনে বাদে বাড়িতে ওর জন্য ঠিক কি অপেক্ষা করছে? জানতে চায় ও না। এই মূহুর্তে বেঁচে ফেরার আনন্দের তুলনায় ওর নিকট সবকিছু তুচ্ছ, সব।

— আই থিংক এটাই তোমাদের বাড়ি।
গাড়িটা স্থির হতে না হতেই সম্বিৎ ফিরে পেলো ঈশানী। হতচকিত নয়নে সামনের দিকে দৃষ্টিপাত করতে ওপাশ থেকে বহুক্ষণের নীরবতা ভাঙলো তুষার।
— সী, শেওলা পরা দোতলা বাড়ি।
অভিমানি অস্রুজলে ভরে উঠেছে চোখের কার্নিশ,কণ্ঠনালি রোধ করেছে জমে থাকা কান্নার জোয়ার, নিজের সুপরিচিত বাড়িটার দিকে এক পল দৃষ্টি বুলিয়ে, তুষারের পানে ঘাড় ঘুরিয়ে সবেগে মাথা নাড়ালো ঈশানী। যার অর্থ
— হ্যা, এটাই আমাদের বাড়ি।
অতঃপর তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে গেলো ঈশানী। আনন্দে আত্মহারা হয়ে দু’কদম এগিয়ে গিয়ে, ফের ঘুরে এলো গাড়ির দিকে,দ্বিধাগ্রস্থ হস্তে টোকা দিলো জানালায়। তুষার ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, এমন সময় হঠাৎ জানালায় কড়া নাড়ার আওয়াজে কাচ নামালো সে, দেখলো মাথাটা আলতো নুয়িয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে ঈশানী। সরল কপালে ভাঁজ পড়লো তুষারের, প্রশ্ন সূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অস্ফুটে শুধালো,

— কিছু বলতে চাও?
— এতদূর পৌঁছে দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ইতস্তত কন্ঠে সম্মোহনী বাক্যটুকু শেষ করলো ঈশানী, তৎক্ষনাত প্রত্যুত্তর করলো তুষার,
—, ইট’স মাই ডিউটি।
—উুঁ
আনমনে শব্দটা উচ্চারণ করলো ঈশানী। পরক্ষণেই জিভের ডগায় অধর ভিজিয়ে কিঞ্চিৎ দ্বিধাগ্রস্থ কন্ঠে বললো,
— আপনি চাইলে বাড়িতে আসতে পারেন।
— নো থ্যাংক্স।
তুষারের প্রত্যুত্তরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে মেয়েটা। যেন না করাতে খুব জোর বেঁচে গিয়েছে ও। সেভাবেই ফের এগিয়ে যায় বাড়ির দিকে। তখনই গাড়ির মধ্যে থেকে আরেক দফা বাক্য ছুড়লো তুষার। পেছন থেকেই রাশভারি কন্ঠে বলে উঠলো,

— মুক্তির আনন্দে আত্মহারা হয়ে ভুল বশত সেই মানুষটাকে রাগিয়ে দিওনা, যে কিনা এক নিমেষে তোমার সব স্বাধীনতা হরণ করার ক্ষমতা রাখে । নিজেকে অন্যকারোর সম্পদ ভেবে, জীবন অতিবাহিত করার অভ্যেস করে নাও।একটা কথা মাথায় রেখো, পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকো না কেন,ইউ আর অলওয়েজ আন্ডার হিজ আইস।
আজ অবধি তুষারের মুখ থেকে এতোগুলো কথা একসঙ্গে কখনোই শোনেনি ঈশানী। তারউপর কথাগুলো ছিল বেশ গভীর আর রহস্যময়। অগত্যা কথার ভাবার্থ বুঝতে এগিয়ে এলো ঈশানী, ঝটপট করে শুধালো,
— কি বললেন ঠিক বুঝতে পারিনি। যদি আরেকবার বলতেন?
ঠোঁট বাঁকিয়ে ফিচেল হাসলো তুষার, জবাব দিলো,
— ইউ নো হোয়াট? আলফা মেল অলওয়েজ প্রটেক্ট হিজ মেইট, বাট অ্যান আলফা এনিমেল জাস্ট ডেসট্রয়েড এভ্রিথিংক ফর হিজ মেইট। তাই একটু সাবধানে থাকতে বলেছি, দ্যাট’স ইট।
এবার যেন কৌতুহলের পারদ দিগুণ হলো ঈশানীর। সংশয়ে ধুকপুক করে উঠলো অন্তঃকরন। কথাগুলো মস্তিষ্কে সাজিয়ে পুনরায় প্রশ্ন করবে, তার আগেই সশব্দে গিয়ার টেনে হাওয়ার বেগে দৃষ্টি সীমানার অগোচরে আড়াল হয়ে গেলো তুষার। অগত্যা ছুটে চলা কালো গাড়িটির দিকে অযাচিত নয়নে তাকিয়ে, নিঃশব্দে শুষ্ক ঢোক গিলে ঈশানী, মনেমনে ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে,
—ফালতু মাফিয়া।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল প্রায়, সকালের শীতের রেশ কাটেনি এখনো। পিঠ পিছলে যাওয়া নরম রোদটুকু এরই মাঝে এলিয়ে পরেছে পশ্চিমে। হালকা কুয়াশায় ধূসর হয়ে এসেছে ধরণি।
বিকেল হতে না হতেই চট্টগ্রাম সি আর বি পাহাড়ে শুরু হয়েছে জনসমাগম। ছোট, বড় মাঝারি থেকে শুরু করে সব শ্রেণীর মানুষের উপচে পরা ভীড়। এক নজরে পর্যবেক্ষণ করলে কখনো চোখে পরে, হাতে হাত রেখে প্রণয় বিলানো নাজুক কপোত-কপোতী, কলেজ ফাঁকি দেওয়া সরগরম বন্ধুদের চায়ের আসর । কখনো আধো আধো পায়ে বেলুন হাতে ঘুরে বেড়ানো নিস্পাপ আদুরে শিশু। কখনো সদ্য বিবাহিত সুখি দম্পতি তো কখনো জীবনের অনেকটা প্রহর একসঙ্গে অতিবাহিত করে আসা বৃদ্ধজুগল।
তবে এই মূহুর্তে সবকিছু ছাপিয়ে তুষারের সুকৌশলী মস্তিষ্কে গেঁথে আছে একটা মেয়ে। মেয়েটা সেই তখন থেকে ওড়নার আড়ালে মুখ ঢাকা দিয়ে পথ অনুসরণ করছে ওর। ব্যাপারটা সন্দেহ জনক,অগত্যা ধীরে ধীরে প্রাচীন ভবনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে নিঃশব্দে রিভলবার লোড করে নিলো তুষার। অতঃপর লোকচক্ষুর আড়াল হতেই খপ মেয়েটার দু’হাত টেনে নিয়ে চেপে ধরলো কংক্রিটের শক্ত দেওয়ালে। দাঁতে দাঁত চেপে ক্রুদ্ধ স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

— সত্যি করে বল, কোন স্পাইয়ের হয়ে কাজ করিস?
তুষারের কথায় বিস্ময়ে হতবিহ্বল হলো মেয়েটা। চোখ দু’টো কপালে তুলে উল্টো শুধালো,
— আশ্চর্য !কাজ করি মানে? আর এভাবে তুই তুকারি করছেন কেন? ওপাশে সিনিয়র রা আছে ডেকে এনে এমন রেগ দেওয়াবো না,জনমের মতো এসব নাটক ফাটক ভুলে যাবেন।
— ওভার স্মার্ট হওয়ার চেষ্টাও করোনা, স্পট ডেথ বানিয়ে ছেড়ে দেবো।
কঠোর আওয়াজ বেরিয়ে এলো মাস্কের আড়াল থেকে। ওদিকে বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকালো মেয়েটা,দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
— শুনুন , নিঝুম কখনোই ওভার স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করেনা। কারণ আমি একটু ওভার স্মার্টই, বুঝেছেন? আর আপনি কোন ক্ষেতের মূলা বলুন তো, এভাবে ধরে রেখেছেন কেন ?

কথা শেষ হতে না হতেই একটানে তুষারের মাস্কটা খুলে হাতে নিয়ে এলো নিঝুম, মাস্কে হাত দেওয়ার কয়েক ন্যানো সেকেন্ডের মাঝে ওর কপালে রিভলবার তাক করালো তুষার। অকস্মাৎ ঘটনাটি ঝড়ের গতিতে ঘটে গেলো যেন।
ওদিকে তুষারের মাস্ক খোলার পর থেকেই দৃষ্টিতে পলক ছাড়ছে না নিঝুম। দিন দুনিয়া ভুলে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সামনের মানুষটার দিকে। তামাটে বর্ণের সুদর্শন লোকটার মুখাবয়ব দেখে যতটা না বিমোহিত হয়েছে, তার চেয়েও বেশি আশ্চর্য হয়েছে তার কর্মকান্ডে। চোখ উঁচিয়ে কপালে তাক করানো রিভলবারের দিকে এক পল নজর দিয়ে,হতবাক হয়ে গেলো নিঝুম, দু’হাতে মুখ ঢেকে, কন্ঠে স্বকীয়তা ধরে রেখে বললো,
— ওবুক! পিস্তল ও দেখি আছে? সত্যি সত্যি নাটক করেন নাকি? আপনি নিশ্চয়ই হিরো?
— ভিলেইন।

গম্ভীর স্বরে জবাব দিলো তুষার।
হতাশায় মুখ দিয়ে “চ” উচ্চারণ করলো নিঝুম। বললো,
— নাহ! ভিলেইন টা ঠিক মানালো না। হিরো হলে ভালো হতো।
ঠোঁট বাঁকিয়ে ক্রুর হাসলো তুষার, মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে, পেছনে ঘুরে লম্বা পা ফেলে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
— আ ভিলেইন ইজ অলওয়েজ হিরো ইন হিজ ওউন মাইন্ড।
লোকটার কথায় আপনা আপনি অধর জুগল ফাঁকা হয়ে গেলো নিঝুমের। মুখাবয়ব র’ক্তিম হয়ে উঠলো অজানা শিহরণে। চোখের মাঝে আকাশ সম উচ্ছ্বাস ধরে রেখে একা একাই বিড়বিড়ালো মেয়েটা,

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২৬

— বাট আই লাভ ভিলেইন।
পর মূহুর্তেই কি ভেবে যেন হুট করে উচ্ছ্বাসের জোয়ারে ভাটি পরলো ওর।লোকটার যাওয়ার পানে চেয়ে চকিতে দাঁতের আগায় জিভ কেটে চনমনিয়ে উঠলো নিঝুম । আপসোসের স্বরে বললো,
— ইশ, ওনাকে ফলো করার কারণ টাই তো বলা হলোনা। কি না কি ভেবে নিলো কে জানে?
দৃষ্টি সীমানায় তখনও ভেসে ছিল লোকটার আবছা অবয়ব। সেটাই কাজে লাগালো নিঝুম, চট করেই ব্যাগ থেকে স্টিকি নোট আর কলম বের করে টুকে নিলো লোকটার আনকমন ক্যানভাস জ্যাকেটের লোগোটি,
— রেটরো ট্র্যাকার~~

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২৭