আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২৭

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২৭
suraiya rafa

নিরিবিলি আঙিনায় তিতির পাখির সুমিষ্ট কলরব।
উঠোন জুড়ে খেলা করছে পরন্ত বিকেলের মরচে ধরা রোদ। সরষে ফুলের হলুদিয়া পরশে নব্য বধূর ন্যায় সেজে উঠেছে বাড়ির একধার। চারিদিকে পৌষালি মাতনের সুমধুর সমারোহ। উত্তরের কনকনে বৈরী বাতাসে শৈতপ্রবাহের তীব্র পূর্বাভাস। সমগ্র লন জুড়ে পরিচ্ছন্নতার শেষ নেই, অশরীরীর অশুভ আত্মাকে যেন ঝেটিঁয়ে বিদেয় করেছেন স্বয়ং গৃহকর্তী।

দুপুরের ভাতঘুমে বিভোর সারা মহল্লা। ঝিম ধরা এই নিগূঢ় নিস্তব্ধতার রেশ কাটিয়ে অকস্মাৎ ধরিত্রী কাঁপানো আর্তনাদে জেগে উঠলো পুরো বাড়ি । পুরোনো কংক্রিটের দেওয়াল জুড়ে প্রতিধ্বনিত হলো সেই হৃদয়বিদারক তীব্র হাহাকার। আসবাবের ঝনঝন আওয়াজে মূহুর্তেই প্রকম্পিত যেন সমগ্র বাড়ির প্রতিটি কোন। ছাঁদের পাঁচিলে ঝিমুতে থাকা বেনামি পাখির দল একযোগে ডানা ঝাপটে চোখের পলকে উড়ে গিয়ে ঠায় জমালো অন্যত্র।
ঊষা মাত্রই ফিরেছে স্কুল থেকে,বেবি পিংক কালারের হ্যালো কিটির ব্যাগটা এখনো ঝুলে আছে তার কাঁধেই, পরিশ্রান্ত শরীরটাকে টেনেটুনে দূরহ কদমে ঘরের দুয়ারে এক পা রেখেছে কি রাখেনি, তন্মধ্যে ভেতর থেকে ভেসে এলো মেয়েলী ক্রন্দনের ব্যগ্র আওয়াজ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কান খাঁড়া করলো ঊষা, সুপরিচিত কণ্ঠস্বরের ক্ষীণ আর্তনাদ কর্ণগোচর হতেই প্রবল শঙ্কায় আঁতকে উঠল তার দূর্বল চিত্ত। এক মূহুর্তও দাঁড়ালো না মেয়েটা,পায়ের জুতো কাঁধের ব্যাগ ইতিউতি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ছুটলো ঘরের দিকে। আস্তে ধীরে নয়, বাতাসের বেগে গিয়ে থমকালো বসার ঘরে।ঘরের মাঝে ওলট-পালট সব, যেন প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডবে চূর্নবিচূর্ন চারিপাশ। যার সূত্রপাত হয়েছে কিয়ৎক্ষন আগেই,কেন্দ্রস্থল ওর বোন ঈশানী। হ্যা ঈশানী ফিরে এসেছে। আজ প্রায় তিন/চার মাস পর দেখা মিলেছে তার। আর এই মূহুর্তে মায়ের রণচণ্ডীর মুখোমুখি সে।
এক, দুই করে পরপর চারখানা চপেটাঘাত একাধারে হামলে পরেছে তার মাখন নরম গালে। মা’রের আ’ঘাতে তুলোর মতো গাল দু’টো ছিঁড়ে আসার উপক্রম। গালের যন্ত্রণা ছাপিয়ে আ’ঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে মস্তিষ্ক। চোখের সামনে ভনভন করে ঘুরছে পুরো দুনিয়া। মেয়ের এহেন নাস্তানাবুদ অবস্থা দেখেও রাগে ভাটি পরলো না রোকেয়া প্রাচীর। এতোগুলো দিনের জমানো ক্রোধের বশবর্তী হয়ে ফের হামলে পরলেন মেয়ের উপর। একহাতে রুটি তৈরির বেলুন নিয়ে অন্যহাতে আঁকড়ে ধরলেন ঈশানীর রেসমের মতো ঝুরঝুরে চুলের একাংশ। কথা বলার কোনো ফুরসত না দিয়েই জোর হস্তে বসিয়ে দিলেন কয়েক ঘাঁ। কাঠের আ’ঘাতে প্রচন্ড যাতনায় টনটন করে উঠলো ঈশানীর সমগ্র শরীর। কোনোমতে ক্ষীণ শ্বাস টেনে কাকুতি করে উঠলো মেয়েটা,

— ছেড়ে দাও মা, লাগছে।
ঈশানীর মুখ ফুটে মা ডাক বের হতেই আগুনের মাঝে ঘি পরলো যেন। ক্ষীপ্রতায় চিড়বিড়িয়ে উঠলেন রোকেয়া। মূহুর্তেই মেয়েটার অন্যগালে সপাটে চ’ড় লাগিয়ে ক্ষুদ্ধতার শিওরে পৌঁছে ক্রুদ্ধস্বরে বলে উঠলেন,
—কে তোর মা? মুখপুড়ি! এই মুখ নিয়ে আবার ফিরেছিস কোন সাহসে ? ম’রে যেতে পারলি না? নাকি আমাদের মুখে চুনকালি লাগিয়ে যার সাথে ভেগেছিলি তার আর প্রয়োজন নেই? নিশ্চয়ই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে?
মায়ের বলা নোংরা কথা কর্ণগহ্বর ছুঁতে পারলো না ঈশানীর। শেষ চড়টা এতোটাই জোরালো ছিল যে তাল হারিয়ে ছিটকে পরেছে সোফার এককোণে মেঝেতে। সোফার হাতলে লেগে ইতিমধ্যে র’ক্তপাত শুরু হয়েছে তার কপালের এক প্রান্তে। রোকেয়ার ধ্যান নেই তাতে,সে পুনরায় হাতের কাছের গরম পানির কেতলিটা ওর দিকে ছুড়তে উদ্যত হলেন, রাগে চিড়বিড় করে বললেন,

— নোংরা মেয়েছেলে, এতোদিন ধরে কোন নাগরে ভাত খায়িয়েছে তোকে? কে দিয়েছে এতো দামি জামা কাপড়? নষ্টামি করে ফিরে আসতে একটুও লজ্জা হলোনা? তোকে দেখে ঘেন্না হচ্ছে আমার। এই মেয়ে পেটে ধরেছি ছিহ! তোর তো লজ্জায় ম’রে যাওয়া উচিৎ। এখনো বসে আছিস কোন মুখে?
কপাল থেকে চুয়িয়ে পরা র’ক্তে হাত চাপলো ঈশানী। চোখ মুখ খিঁচিয়ে ব্যথা সংবরণ করে, মায়ের কথার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে বললো,

— আমি কোনো নোংরা কাজ করিনি।মুখ লুকানোর মতো কোনো অসভ্যতায় জড়ায়নি, তাহলে লজ্জা পাবো কেন?
মেয়ের জুতসই প্রত্যুত্তরে শরীরে আ’গুন ধরে উঠলো রোকেয়ার,প্রচন্ড রাগে থরথর করে কম্পিত হলো তার আটপৌরে মেজাজি শরীর। ঈশানীর বাক্য শেষ হতেই ফের ছুড়তে নিলেন হাতে থাকা কেতলিটা। কেতলির মধ্যে গরম পানি বিদ্যমান, সেই ভেবে জোর কদমে বোনের নিকট ছুটে এলো ঊষা। দু’হাতে আগলালো তাকে। তবে কেতলি হাতছাড়া হওয়ার আগেই পেছন থেকে রুক্ষ আওয়াজ ভেসে এলো এক পরিচিত বৃদ্ধার।
— থামছুনো! এত্তর মাইয়াফুয়ার গত আত কিল্লাই তুলোর?( থাম বলছি, এতোবড় মেয়ের গায়ে হাত কেন তুলছিস ?)

ঈশানীর নানী দেবোরা বৃদ্ধা মানুষ। খানিক আগেই দুপুরের খানা শেষে গা এলিয়েছিলেন বিছানায়, এরই মাঝে শুরু হয়েছে বসার ঘরের প্রলয়ঙ্কারী তান্ডব। ফলস্বরূপ মেয়ের চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে হতচকিত হয়ে একদণ্ড শুয়ে থাকার ফুরসত পেলেন না বৃদ্ধা। লাঠি ভর করে তাড়াহুড়ো কদমে নেমে আসেন নিচ তলায়। অতঃপর এতোগুলা দিন বাদে বড় নাতনিকে দেখে আরেক দফা স্তম্ভিত হয়ে পরেন তিনি।

তারা তো ধরেই নিয়েছিলেন এই মেয়ে আর ফিরবে না। পুলিশ কেইস,কোর্টে দৌড়ানো অতো সতো ঝামেলা করার লোকবল কিংবা আর্থিক সচ্ছলতা কোনোটাই তাদের নেই। অগত্যা থানায় একচ্ছত্র সাধারণ ডায়েরি করে চুপচাপ হাত গুটিয়ে নিয়েছিলেন সকলে।লোক মুখে কানাঘুঁষায় শুনেছিলেন, যে ছেলের সঙ্গে পালিয়েছে, তার সঙ্গেই নাকি বিদেশ পারি জমিয়েছে তার নাতনী।সেই ভেবে আরও এক দস্তুর স্বস্তিতে হাফ ছেড়েছিল পরিবারের সকলে। কিন্তু এতোগুলো দিন বাদে এভাবে ফিরে আসায় আশঙ্কার টানাপোড়েনে কলিজা শুকিয়ে কাঠ হলো বৃদ্ধার। কিয়ৎক্ষন সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে থেকে,সমস্তটা পর্যবেক্ষন করে মেয়েকে থামানোর প্রয়াসে হাঁক ছাড়লেন তিনি।
মায়ের অযাচিত আওয়াজে থমকালেন রোকেয়া, ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে দৃষ্টিপাত করতেই দেখলেন লাঠিতে ভর করে তার মা দাঁড়িয়ে। দেবোরা মেয়ের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে চোখাচোখি করলেন একপল, পরমূহুর্তেই সোজা পায়ে এগিয়ে গেলেন নাতনীর অভিমুখে। হাত বাড়িয়ে টেনে তুললেন ঈশানীকে,বয়সের ভারে কুঁচকে যাওয়া আলতো হাতে ওর র’ক্তজমাট মুখে আদুরে পরশ বুলিয়ে, শান্তস্বরে বললেন,

— ওবুক! আর নাতনির মুক ইবা এইল্লা ফুয়াই কা গিয়ে?( ওবুক! আমার নাতনীর মুখটা এমন শুকিয়ে গিয়েছে কেন?)
নানীর আদুরে কথায় আস্বস্ত হতে পারলো না ঈশানী। কারণ সর্বোপরি মায়ের কানে কুটনৈতিক পরামর্শ গুলো যে নানীই দিয়ে থাকে, এতোগুলো বছরে তা আর অজানা নয় ঈশুর।সহসা আবেগ সংবরণ করে নাক টেনে চুপ হয়ে রইলো মেয়েটা। বুকের মাঝে অভিমানের তোলপাড়, অথচ কাছে বসিয়ে দু’টো খাবার মুখে তুলে দিয়ে, এতোগুলা দিনের চড়াই-উতরাই এর কাহিনী শোনার জন্য বসে নেই কেউই। ওসব কলুষিত অধ্যায়কে এ জীবনে সামনে আনার জন্য যেই মনের জোর টুকু প্রয়োজন সেটাও এই মূহুর্তে অবশিষ্ট নেই ঈশুর মাঝে। আর না আছে সকলের সম্মুখে নিজেকে জাহির করার নূন্যতম ইচ্ছে। অতএব চুপ থেকে পরিস্থিতি সামাল দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ।
—এইল্লা গরি এনে,হনে মা’রে?(এভাবে কেউ মা’রে?)
ঈশানীর ভাবনার ছেদ ঘটে নানীর উদ্বিগ্নতায়। এবারও নিশ্চুপ মেয়েটা। কোমল চিবুকে সন্তোর্পনে হাত বুলিয়ে নানী ফের শুধায়,

—তুই এহালা কিল্লাই? নাতি জামাই হডে?( তুই একা কেন নাত জামাই কোথায়?)
নানীর কথায় ছঁলকে উঠলো ঈশানী,আশ্চর্য কণ্ঠে শুধালো,
— নাত জামাই মানে?কি বলছো এসব নানী?
ঈশানীর কথায় তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন রোকেয়া।দাঁতের মাঝে দাঁত পিষে ঝাঁঝালো গলায় বলেন,
— ঢং পেয়েছে ঢং। কোথায় না কোথায় থেকে বেলাল্লাপনা করে, এতোদিন বাদে ফিরে রসিকতা জুড়েছে আমাদের সাথে। মহল্লার সবাই জানে তুই জিসানের সঙ্গে পালিয়েছিস, আর এখন নাটক করা হচ্ছে?
দেবোরা শাসালেন মেয়েকে। জোর গলায় থামিয়ে দিয়ে,ফের হাসিমুখে নাতনী কে শুধালেন,
— হ্যারে বিয়ে হয়নি?

মা আর নানীর অযাচিত প্রসঙ্গে মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরলো ঈশানীর। নিজের নামে তৈরি হওয়া এতো এতো কুৎসায় মাথা ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে ওর।কিসের স্বস্তি কিসের কি? এ যেন অসহায়ত্বের নদী ছাড়িয়ে মহাসমুদ্রে পতন। তবে ঘাবড়ালো না মেয়েটা। অহেতুক কথা বিনাবাক্যে উপেক্ষা করে, কপাল সংকোচন করে নিলো ব্যতিগ্রস্থতায়। কোনো প্রকার দ্বিধাবোধ ছাড়াই মায়ের কথার পাছে ব্যগ্রস্বরে বলে উঠলো,
— জিসান ঠিক আছে? ওর কিছু হয়নি তো? ভালো আছে ও?
ঈশানীকে শঙ্কিত দেখাচ্ছে, দৃষ্টি জুড়ে ভর করেছে অহেতুক কাতরতা। মেয়ের উদ্বিগ্নতায় কপাল কুঁচকে ফেললো রোকেয়া প্রাচী,মাকে উদ্দেশ্য করে বিরক্তির স্বরে বললো,
— দেখলে মা দেখলে? যার সাথে পালিয়েছে তার নাকি খবরই জানেনা। এতো নাটক কোথা থেকে শিখেছিস? আমিতো শেখাইনি।

— তখন থেকে পালিয়েছি অপবাদ কেন দিচ্ছো? আমি কারও সঙ্গে পালায়নি।
মেজাজ সংবরণ করতে না পেরে তৎক্ষনাত তেতে উঠলো ঈশানী। দিশেহারা মস্তিষ্কের পাহাড় সমান ভার বইতে না পেরে ক্লান্ত পথিকের ন্যায় তপ্তশ্বাস ছেড়ে আহত গলায় বললো,
— আমি ভালো ছিলাম না মা, বিশ্বাস করো আমি মোটেই ভালো ছিলাম না। ভয়ঙ্কর ভাবে ফেঁসে গিয়েছিলাম একটা জায়গায়। যেখান কোনোদিন বেঁচে ফিরবো কিনা, তোমাদের আদৌও দেখতে পাবো কিনা, সেটাও জানা ছিল না আমার।
ঈশানীর এতোএতো আহাজারির পাছে চড়াৎ করে উঠলেন রোকেয়া।আচানক ঝাড়ি মে’রে বললেন,

— আবারও নাটক শুরু করেছিস, আবারও ? চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি দামি দামি সব জামা কাপড় পরে আছিস।অথচ মুখে বুলি আওড়াচ্ছিস তুই ফেঁসে গিয়েছিলি? বলি নিজের মা কে তোর এতোই বোকা মনে হয়? দিনের পর দিন কি খেয়েছি না খেয়েছি, কোনো খোঁজ রাখিস নি। তোর ছোট বোনটা সবে স্কুলে পড়ে, বাড়িতে বৃদ্ধা নানী, এতোকিছু জানা সত্ত্বেও তুই চাকরি ছেড়ে পালালি কোন মুখে? আর এখন ফিরে এসে নাটক জুড়ে দিয়েছিস, পালিয়ে গিয়ে তুই নাকি মোটেই ভালো ছিলি না। যদি ভালোই না থাকিস তাহলে এই দামি দামি পোশাকের উৎস কি? কোথা থেকে জুটিয়েছিস এসব?
মায়ের অভিযোগের তোপে নিজের দিকে দৃষ্টিপাত করলো ঈশানী। অশ্রুসিক্ত নয়ন জোড়া নীরবে বোলালো বিধ্বস্ত শরীরে।

পরনে গুচ্চি ব্র্যান্ডের ক্রিমি ওভারকোট, পায়ে শ্যানেলের তৈরি ব্ল্যাক ব্যালেরিনা, এমনকি গলার স্কার্ফটাও লুইস ভুইটোনের লোগো দিয়ে ভরপুর। এগুলো নিঃসন্দেহে কোটি টাকার পোশাক।
কিন্তু ঈশানী তো জানে এগুলো সব কালো টাকায় কেনা। যার মূল্য ঈশানীর নিকট এক পয়সাও না। যার টাকা দিয়ে কেনা সেই মানুষটার মতোই এই পোশাক গুলোকে আমূল ঘৃণা করে ঈশানী। নেহাৎ লজ্জা নিবারণে সম্ভ্রমের প্রয়োজন তাই পরেছিল এতোদিন। কিন্তু এখন তো আর এসবের প্রয়োজন নেই।

জামা কাপড় গুলোর উৎস ভাবতে গিয়েই অস্বস্তিতে হাসফাস করে ওঠে মেয়েটার বক্ষপিঞ্জর । এই দামি পোশাক গুলো ওকে মোটেই শান্তি দিচ্ছে না। ক্রমাগত স্মৃতির পাতায় জাগ্রত করে তুলছে পেন্টহাউজের সেই ভয়াবহ নিশীথ। নিশীথে ডুবে থাকা মরীচিকার সম্রাট নিশাচর এরীশ ইউভানের ধারালো মুখাবয়ব। তার পাষণ্ড হৃদয় থেকে উগড়ে আসা প্রতিটি কলুষিত বাক্য, মিসাইল হা’মলার সেই বীভৎস দৃশ্যপট, কীটপতঙ্গের মতো বর্বর হ’ত্যাকাণ্ড, মেয়ে জাতিকে পন্যের মতো বেচাকেনা, মতের অমিল হলেই শ্যু’ট করে দেওয়া, আর পরিশেষে এরীশ ইউভানের সেই বেজমেন্টের নৃ’শংসতা। প্রতি পদে পদে যেই মানুষটা ওকে ভোগ্য পন্যের মতোই একাধিক পুরুষের নিকট ছুড়ে দিতে দ্বিধাবোধ করেনি একবারও । হয়তো নিজেই আবার প্রতিহত করেছিল সেসব , কিন্তু এতে ঈশানীর সম্মানহানী কি হয়নি মোটেই? হয়ছিল তো বটে।

চাকচিক্য পোশাকের অন্তরায় ওই বীভৎস, কলুষিত সময়গুলোর কথা ভাবতে গিয়ে কলিজা কেঁপে ওঠে ঈশানীর। অজান্তেই ভয়ের তোড়ে শিউরে ওঠে মেয়েটা। মস্তিষ্কের খেই হারিয়ে এক নিমেষে শরীর থেকে ছুড়ে ফেলে দেয় রেশমের মতো ফিনফিনে কোমল স্কার্ফটা, অতঃপর ওভার কোটটা টেনে খুলতে খুলতে তরতরিয়ে উঠে যায় দোতলায়। গন্তব্য নিজের কক্ষ, এগুলো না ছাড়তে পারলে শান্তি নেই, কিছুতেই শান্তি নেই।
ঈশানীর যাওয়ার পানে হতবিহ্বল নয়নে তাকিয়ে আছে সকলে। ওকে এভাবে বিনাবাক্যে ঘরে চলে যেতে দেখে কটমটিয়ে ওঠেন রোকেয়া। মেয়েকে আটকানোর পায়তারা করে তিনি সিঁড়ি ডিঙিয়ে উঠতে উদ্যত হয়ে বলেন,

— কথার জবাব না দিয়ে কোথায় যাচ্ছিস তুই? এটা কোনো আশ্রম নয় যে, যেখান থেকে খুশি নোংরামি করে ফিরে এসে বিনা কৈফিয়তে ঘরে ঢুকে পরবি, এটা ভদ্রলোকের বাড়ি, পাড়া মহল্লায় চলতে হয় আমাদের। আ…
এক পা সিঁড়িতে দিয়েও বাঁধাহীন সম্মুখে এগুতে পারলেন না রোকেয়া। তার আগেই চোখের ইশারায় মেয়েকে ধরাশায়ী করলেন দেবোরা। কুঁচকে যাওয়া নিটোল চোখে অকস্মাৎ আ’গুন ধরিয়ে খেঁকিয়ে উঠলেন তিনি। বললেন,
— নিজের হতি গরিবার লাই, এইল্লা উডি ফরি লাইজ্ঞোস কিল্লাই? নো ভুলিস, ঘর ইবা মাইয়াফুয়া ইতির।(নিজের ক্ষতি করার জন্য এমন উঠে পরে লাগলি কেন? ভুলে যাস না এই বাড়িটা কিন্তু ওর।)
মায়ের কথা শেষ হতে না হতেই থমকে গেলেন রোকেয়া। তপ্তশ্বাস ছেড়ে বললেন,
— এবার আর ছাড়াছাড়ি নেই কোনো। ওকে যোগ্য পাত্রস্থ করে তবেই দম নেবো আমি।
—যেইল্লা মনোত হ, এইল্লা গর। সা, জামা হোত্তা, ইগিন বউত দামী ফাল্লার।( যা খুশি করিস। কিন্তু দ্যাখ, কত দামী দামী কাপড়)

কথাগুলো বলার সময় উচ্ছ্বাসে চিকচিক করে ওঠে বৃদ্ধার শীর্ণকায় মুখাবয়ব।তবে খুব বেশিক্ষন স্থায়ী হলোনা সেই খুশির ঝিলিক,নানীর উচ্ছ্বাসের পারদে এক বালতি জল ঢেলে দিয়ে, মেঝেতে অযত্নে পরে থাকা পোশাক গুলো এক নিমেষে কুড়িয়ে নেয় ঊষা। সেগুলো বাহুবদ্ধ করে নিজের ঘরে যেতে যেতে নানীকে ভেংচি কেটে বলে,
—এ্যহ! বুড়ির শখ কতো।
বিগড়ে যাওয়া নাতনীর পানে চেয়ে দাঁত খিঁচিয়ে ওঠেন নানী। বিরক্তির স্বরে বিড়বিড়ান,
—জারগো মাইয়াফুয়া হত্তুন !( ফাজিল মেয়ে কোথাগার)

জামা কাপড় ছেড়ে, কপালে একটা অন-টাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে মাত্রই জানালা ঘেঁষে বসেছে ঈশানী। আজ বহুদিন বাদে নিজেকে মুক্ত পাখি মনে হচ্ছে ওর। বুকের মাঝে নীরব আঁচে পুড়তে থাকা অসহনীয় দাবানলের হয়তো ইতি ঘটবে কোনো একদিন, বিভীষিকার সমাপ্তি ঘটিয়ে মুক্তিপাবে স্মৃতির পাতা। সেদিন হয়তো সত্যি কারের পরিসমাপ্তি ঘটবে এই নৃ’শংসতার।
কিন্তু খারাপ সময়,খারাপ স্মৃতি এগুলো কি এতো সহজে ভোলা যায়? মানবজাতি বরাবরই আবেগ দ্বারা পরিচালিত, ভালো সময় দীর্ঘক্ষণের হলেও মানুষ তা মনে রাখেনা খুব একটা, অথচ ক্ষণিকের সামান্যতম খারাপ স্মৃতিটাকেও তারা আঁকড়ে ধরে থাকে সারাজীবন।তবুও ঈশানী অপেক্ষারত। পেছনের কলুষিত স্মৃতিকে ছুড়ে ফেলে একটা স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবার প্রয়াসে দিবারাতি অপেক্ষার প্রহর গুনছে অন্তর্মুখী মেয়েটা। কিন্তু আদৌও কি সেটা সম্ভব?

নীরবে অতিবাহিত হলো কিয়ৎক্ষন। আশেপাশে প্রগার নিস্তব্ধতা। সন্ধ্যার বুক চিঁড়ে বিষণ্ণ আঁধারের হাতছানি। যেন কেউ কোথাও নেই, শুধু ঈশু আর তার অন্তহীন ভাবনারা তমশায় হাবুডুবু খাচ্ছে নির্নিমেষ। পরমূহুর্তেই কি ভেবে যেন বাস্তবতায় ফিরে এলো মেয়েটা। হাত বাড়িয়ে টেবিলের ড্রয়ার থেকে পুরোনো মোবাইল ফোন আর একটা সীম তুলে নিলো নিঃশব্দে। অতঃপর আটপৌরে মোবাইল খানায় সীম প্রতিস্থাপন করে ডায়াল করলো একটা বেনামি নাম্বারে। একবার দু’বার করে কয়েকবার রিং হতেই অপরপাশ থেকে ফোন রিসিভের পিক পিক আওয়াজ ভেসে এলো।মৃদু সেই আওয়াজ টুকু কর্ণগোচর হতেই এপাশ থেকে দ্বিধাগ্রস্থ স্বরে ডেকে উঠলো ঈশানী,
— হ্যালো জিসান!

টিকটিক করে ঘড়ির কাটা জানান দিয়ে যাচ্ছে রাতের অন্তিম প্রহরের নীরব আগমন। বাইরে তুষার পাতের একচ্ছত্র বিচরণ। বরফের আস্তরণে ঢুবে আছে প্রকৃতি। কেমন যেন ঠান্ডায় জমে মৃ’ত লাগছে সব। আজকাল এই নির্জীবতা, এই বিষণ্ণ নিরবতা বড্ড বিরক্ত লাগে এরীশের। মস্তিষ্ক ছাঁপিয়ে সেই বিরক্তিটুকু আনমনে উদ্ভাসিত হয় তার সমগ্র মুখমণ্ডলে। তুষার আচ্ছাদিত মস্কো শহরের মতোই একটুকরো বরফ খন্ডে রূপান্তরিত হয়ে আছে তার বিধ্বস্ত নিগূঢ় চিত্ত।

হৃদয়হীন লোকটার অনুভূতি প্রকাশের ভাষা জানা ছিলনা, জানা ছিল না অভিমানীনির অভিব্যক্তি বুঝে ওঠার অভিনব কৌশল। তাইতো সবসময়ের মতোই পরিশেষে ওর প্রাপ্তির খাতা শূন্য। অনুভূতি দিয়ে প্রাপ্তি বিচার করা মূর্খতার লক্ষন,এরীশ সেটা ফলাতে চায়না কখনোই। ওর কাছে জীবন মানে ভ্যালু অব পাওয়ার। কলুষিত হওয়ার কোনো পরিসীমা নেই। এরীশ সাইকোপ্যাথ না, তবুও ওর ক্রা’ইম গুলো অত্যন্ত সুনিপুণ আর দূরদর্শী, অবশ্য সবটাই bratva এর কামাল। bratva ই ওকে জানোয়ার বানিয়েছিল। কিন্তু ঠিক কিরূপ জানোয়ার সে কথা আজও পুরো আন্ডারওয়ার্ল্ডের অন্তরায় । আজকাল ঈশানীর ব্যাপারে ভাবতে গেলে গতি হারায় হৃদযন্ত্র, সেই বেপরোয়া, বেগতিক হৃদয়ের লাগাম টানায় অপারগ স্বয়ং মাফিয়া বস। যে কোনো পন্থায় মেয়েটার সান্নিধ্য পেতে চায় মন। হাজার কিলোমিটারের দূরত্বে থেকেও সেই নীল চোখের অন্তরালে ডুব দিতে যায় মস্তিষ্ক। হোক সে যতই খারাপ আর অশুভ পন্থা। তবে কি এটাই সাইকোনিউরোসিস?

— এ্যাম আই সিক? আমি কি ওর জন্য ধীরে ধীরে ডেস্পারেট হয়ে পরছি?
বর্ষিত তুষারপাতের বিপরীতে, কাচের দেওয়ালের অভিমুখে দাঁড়িয়ে আনমনে বিড়বিড়ালো মাফিয়া বস। বিধিবাম! মস্তিষ্ক উত্তর খোঁজার আগেই ভাবনার সুতো ছিঁড়ে যায় তার। পেছন থেকে নিম্নস্বরে ডেকে ওঠে আগন্তুক।
— প্রিভিয়েট, মাই লর্ড।
এরীশ পেছনে ঘুরতে না ঘুরতেই নতজানু হয়ে সম্মান জানালো গার্ড। চোখের পাতায় কিঞ্চিৎ পলক ছেড়ে সম্মান গ্রহন করে,পরবর্তী আর্জিতে অবিচল থাকার আদেশ জানালো পাইথন লিডার।
প্রথমে কিছু অপ্রাসঙ্গিক কথা দিয়ে শুরু করে, লোকটা জানালো,

— পাইথন প্যারাডাইসের বেশ কয়েকটি ক্ল্যাব দখলে নিয়ে নিয়েছে ড্রাগন হান্টার গ্রুপ। তাদের গুপ্তচরেরা ইতিমধ্যে অর্থশতাধিক পাইথন গার্ড’স কে হ’ত্যা করে ধরাশায়ী করে ফেলেছে অন্যদের। স্লাট গুলো সব তাদের হাতে বন্দি।তুষার বস গন্তব্যে না থাকায় গার্ড’সরা সেভাবে লিড পায়নি, ফলস্বরূপ এই অবনতি।
কথা বলার সময় তীব্র শঙ্কায় কণ্ঠনালী তিরতির করে কাঁপছিল তার। এই বুঝি রুথলেস মাফিয়া বসের নৃ’শংসতার শিকার হতে হয়। ক্লাবের খবরাখবর সাধারনত তুষারই হস্তান্তর করে এরীশকে, গার্ড’সরা অনিবার্য কারণ ব্যাতিত সম্মুখীন হয় না মাফিয়া বসের। যেন নিষিদ্ধ দুনিয়ার বি’ধ্বংসী জানোয়ারটার ভয়ে অহর্নিশ জর্জরিত সকলে। কিন্তু এখন তো তুষার নেই, ক্লাবে ঘটে যাওয়া একের পর এক অতর্কিত হাম’লার কথা জানানোটা জরুরি, তাইতো এই অকুতোভয়ী আগমন।

গ্লাসের ওয়াইন ফুরিয়ে এসেছে, এরীশ এগুলো ওয়াইন সাজানো বিস্তার তাকের দিকে। ধীরে ধীরে সময় নিয়ে দেখতে লাগলো প্রতিটা বোতল, সবগুলোর মধ্যে নান্দনিক কারুকার্য শোভিত একটা ছোট মতো জার তুলে এনে ছিপি খুলে চুমুক দিলো তাতে।
সেই তখন থেকে মাফিয়া বসের কার্ন্ডকারখানা গুলো কুণ্ঠিত নজরে পরখ করছে আগন্তুক। এতো বড় একটা দূর্ধষ খবর শোনার পরেও কিভাবে এতোটা স্বাভাবিক রয়েছে বস? আপাতত সেটাই তার ভাবনার বিষয়।
— ইয়াক! ভেরী ব্যাড টেস্ট।
অকস্মাৎ কিছু একটা ভাঙার ঝনঝন আওয়াজে ভাবনা থেকে ছিটকে বেড়িয়ে এলো গার্ডটা। মার্বেল পাথর খচিত তকতকে মেঝের উপর ইসাবেলা ইসলেই হুইস্কির চূর্ণবিচূর্ণ জারটা পরে থাকতে দেখে হকচকালো সে,এটা পৃথিবীর সবচেয়ে দামি ওয়াইন গুলোর একটি, দাম আনুমানিক চল্লিশ কোটি। এমন একটা ব্যয়বহুল জিনিসকে এভাবে পায়ের কাছে গড়াগড়ি করতে দেখে মাফিয়া বসের রাগের পারদ কিঞ্চিৎ হলেও অনুমান করতে পারলো গার্ডটা।
টেরিটোরি সুরক্ষার অপারগতায় ভড়কালো সে। মাত্রাতিরিক্ত ভীতিগ্রস্থতায় ওষ্ঠাগত প্রাণ, তাও কম্পিত স্বরে লিডার কে মানানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখে বললো,

— আ..আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আ.. আমি লিড দিচ্ছি সকলকে। আজ রাতেই ক্লাব বেদখল করে ছাড়বো আমরা।
— লিভ।
চকিতে চোখ তুললো রুশ লোকটা। নদীর মতো শীতল অথচ প্রগাড় কণ্ঠে ফের একই শব্দ আওড়ালো মাফিয়া বস,
—লিইইভ।
উপায়ন্তর না পেয়ে হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো লোকটা।তড়িঘড়ি করে কুর্নিশ জানিয়ে কক্ষের বাইরে পা বাড়ালো সবেগে। তৎক্ষনাৎ গগনবিদারী গু’লির আওয়াজে প্রকম্পিত হলো সমগ্র মাফিয়া পেন্টহাউজ।বারুদের গন্ধে ভরে উঠলো চারিপাশ,বক্ষভেদ করা বুলেটের আ’ঘাতে শ্বাসরুদ্ধ হলো আগন্তুকের। ফিনকি দিয়ে বেরোনো তাজা র’ক্তের প্রবল স্রোতে সিক্ত হয়ে অফিস কক্ষের দরজায় আচানক মুখ থুবড়ে পরলো সে। পাইথন লিডারের ক্রোধের কবলে অবশেষে ধড়ফড়িয়ে প্রাণ উবে গেলো তার । সেদিকে বাজপাখির নজরে দৃষ্টিপাত করে পেছনের আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে রিভলবারের সাহায্যে খানিক কপাল চুলকে বিরক্তির স্বরে বিড়বিড়ালো মাফিয়া বস,

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২৬ (২)

— সেকেন্ড চান্স মাই ফুট।
খানিকক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে বসে থেকে মমেমনে কিছু একটা হিসেব কষলো এরীশ। অতঃপর কানে এয়ারপড গুঁজে কাউকে ফোন লাগিয়ে রুক্ষ স্বরে আদেশ করলো সে,
— ব্লাড ডায়মন্ড মিশনের টীম রেডি করো, রাইট নাও। আসল কার্লপিটকে পেয়ে গেছি। রাতের আঁধার মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ব্লাড ডায়মন্ড আমার চাই। চাইই চাই।

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২৮