আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪
suraiya rafa

বাড়ির উঠোনে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নারকেল গাছের চিড়ল পাতার ফাঁক ফোকর গলিয়ে নিদারুণ বেড়িয়ে আসা মুঠো মুঠো রোদের হাতছানি, ধূসর মেঘের আড়ালে গা ঢাকা দিয়েছে সেই কখন। সকাল থেকে দুপুর অবধি অবাধে আলোক রশ্মি ছড়ানো সেই চনমনে সোনালী রোদ মিলিয়ে গিয়ে নতুন উদ্যমে আষাঢ়িয়া বৃষ্টিতে ঝমঝম করে উঠেছে ভূবণ।

ঈশানীর ছোট্ট রুমের এক কোনে যে দক্ষিনের জানালাটা রয়েছে, ঠিক তার কোল ঘেঁষে বেড়ে উঠেছে এক দানবাকৃতির বিশাল বড় জাড়ুল গাছ।গাছটা বোধ হয় ঈশানীর জন্মের আগে থেকেই এমন তাগড়া হয়ে বেড়ে উঠেছিল, তাইতো এখন বৃদ্ধ বয়সে মানুষের রুগ্নদেহের মতোই কেমন কুঁচকে গিয়েছে শরীরের ছাল-বাকল, ডালপালা সবকিছু। অথচ সেই ডালপালা দিয়েই চুইয়ে চুইয়ে বৃষ্টির ছাট এসে একেবারে প্লাবিত করে দিয়েছে ঈশানীর ঘরের সমগ্র মেঝে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ওদিকে কিছু ঘন্টার জন্য পৃথিবীর সকল আয়োজন, সকল অনিরাপত্তা, দুঃখ কষ্ট ঝুট-ঝামেলা, সবকিছু বেমালুম ভুলে গিয়ে আপন মনে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে ঈশানী। মেয়েটা ধাক্কা খেয়েছে, কষ্ট ও পেয়েছে খুব, তবে বহিঃপ্রকাশ করার মতো ভাষা ওর জানা নেই। হয়তো-বা ওর দুঃখ কষ্টকে এতোটা গুরুত্ব দেওয়ার মতো মানুষের অস্তিত্বই নেই। আর নয়তো ঈশানী নিজেই নিজের জগতটাকে পুরো পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে । ঘরকুনো স্বভাবটা নিজের অজান্তেই একেবারে মনেপ্রানে ধারণ করে ফেলেছে মেয়েটা, এখন চাইলেও আর কারও কাছে মনের কথা ব্যক্ত করে নিজেকে হালকা করতে পারেনা ঈশানী।

ওর এই স্বভাবটা যে বরাবরই একগুয়ে ছিল তেমনটাও নয়। ঈশানীর যতটুকু মনে পরে, এই ঘরকুনো স্বভাব, পুরো দুনিয়া থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখার আপ্রান প্রচেষ্টা, জন্ম সূত্রে পাওয়া অতিব সুন্দর নীল চোখকে নিজের অপাপ্তি মনে করা, এই সবকিছুই শুরু হয়েছিল ঈশানীর বাবার মৃ’ত্যুর পর থেকে।
ঈশানীর বাবার স্বাভাবিক মৃ’ত্যু হয়নি, ওর বাবা একজন সেনাবাহিনীর সৈনিক ছিলেন, যদিও তখন পরিস্থিতি বোঝার জন্য ঈশানীর বয়স খুবই কম ছিল, তবে ও নানীর মুখে শুনেছে, কোনো এক পার্বত্য অঞ্চলে পোস্টিং এ থাকাকালীন, দূধর্ষ , হৃদয়হীন কিছু অজ্ঞাত মাফিয়া টেরিটোরিস্টের সঙ্গে গো’লাগু’লির এক পর্যায়ে নৃ’শংস ভাবে নি’হত হন তিনি।
আসলে পার্বত্য অঞ্চলগুলো একদিকে যেমন অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রানকেন্দ্র,ঠিক তার বিপরীত দিকে নজর বোলালে,তেমনই নাম না জানা উঁচু নিচু পাহাড়ে ঘেরা বিস্তৃত জঙ্গলের আড়ালে একটা রহস্য বেষ্টিত ঘুটঘুটে কালো অন্ধকার দিক ও রয়েছে বটে এর।

ফ্যান্টাসী বলে, সৌন্দর্যের পাহারাদার বরাবরই কুৎসিত আর ভ’য়ঙ্কর হয়। ব্যাপারটা কিছুটা তেমনই।
কারন সেই মেঘ ভেজা ঝর্ণা গায়ে মাখানো অকৃত্রিম রূপসী পর্বতমালার অন্ধকার রহস্য জন সাধারণ কিংবা প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আহরন করতে আসা টুরিস্টদের দ্বারা কখনোই উন্মোচন করা সম্ভব নয়। তাই তো যুগের পর যুগ কেটে গেলেও, পর্বতমালা বেষ্টিত এই পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু নাম না জানা, কৌতুহলী,আর অন্ধকার দিক, পুরো দেশ বাসীর কাছে অজানাই রয়ে যায়। হয়তো কোনো না কোনো ভাবে জন সাধারনের মঙ্গলের জন্যই সরকারের এই অপারগ গোপনীয়তা।

সে যাই হোক, সেবার ঈশানীর বাবার এই অকাল মৃত্যুর পরেই এক ধাক্কায় কেমন ওলোট পালোট হয়ে যায় ছোট্ট ঈশানীর জীবনটা। এভাবে অকালে স্বামী হারানোর শোক যেন বানভাসি নদীর মতোই এফোড় ওফোড় যন্ত্রনায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল মাত্র সতেরো তে মা হওয়া রোকেয়া কে। যার দরুন খুব অল্প বয়সে বিধবা তকমা গায়ে লেগেছিল বলে মায়ের পরামর্শ আর সব ভাইয়েদের সিদ্ধান্তে একমাত্র বোনকে একটুখানি সুখে থাকার প্রয়াসে দ্বিতীয়বারের মতো অন্যত্র বিয়ে দেওয়া হয় ।

আর এদিকে নানীর হাত ধরে এই ছোট্ট দোতলা বাড়িটির এককোনে শুয়ে বসে দিবারাত্রি যাপন করে জীবন অতিবাহিত হতে থাকে নিঃসঙ্গ ঈশানীর। তখন থেকেই অবুঝ মেয়েটা কেমন গুটিয়ে নিয়েছিল নিজেকে। মুক্ত আকাশে অবাধে ডানা ঝাপ্টানো বুনো শালিকটা হুট করেই খাঁচায় বন্দী হলে যেমন নেতিয়ে পরে, ঠিক তেমন করেই বিষণ্ণতা ছড়িয়ে পরেছিল আট বছরের ঈশানীর মন মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে । গায়ে পায়ে বয়স না বাড়লেও মনের বয়সটা তখনই যেন হু হু করে দিগুণ তালে বেড়ে যায় ওর।

তবে ঈশানীর একাকী নিঃসঙ্গ জীবনের ইতি টেনে বছর তিনেক পরেই, ওর মা রোকেয়া প্রাচী আবারও ফিরে এসেছিলেন বটে, কোনো এক অজানা কারণে রোকেয়া প্রাচীর দ্বিতীয় সংসার আর করা হয়ে ওঠেনি। তবে তিনি যখন ঈশানীর নিকট ফিরে এসেছিলেন তখন তার কোলে ছিল ছোট্ট দুধের শিশু ঊষা। যেহেতু ঈশানীর দাদা দাদি কিংবা সেভাবে নজর রাখার মতো অন্য কোনো আত্নীয় স্বজন ছিল না, তাই তখন থেকেই ঊষাকে নিয়ে এই বাড়িতে বসবাস শুরু করেন রোকেয়া প্রাচী। কিন্তু যতদিনে রোকেয়া প্রাচী ফিরে এসেছিলেন, ততদিনে ঈশানী যেন নির্লিপ্তে গা ভাসিয়ে দিয়েছিল স্রোতের বিপরীতে। ওর মাঝের পরিবর্তন গুলো ছিল স্পষ্ট দৃশ্যমান।

তখন পরিবার, মানুষের আনাগোনা, উচ্চস্বরে কথাবার্তা কোনোকিছুই আর ভালো লাগতো ঈশানীর। বরং এগুলোকে বিরক্তিকর ঝঞ্জাট আর বেহুদা মনে হতো ওর নিকট। তবে মেয়ের এই নিঃসঙ্গতা, অন্তর্মুখী স্বভাব পরিবর্তন করার জন্য রোকেয়া প্রাচীরও কোনো মাথা ব্যথা ছিল না। কোনো এক অযাচিত কারনে তিনি ঈশানীর মাঝের এই ভীত সন্ত্রস্ত আর নিজেকে গুটিয়ে রাখা স্বভাবটা খুব কৌশলে পুষে রাখতে চাইতেন। যার দরুন আজ এতো বছর পরেও ঈশানীর হৃদয়টা সেই আট বছরেই আটকে আছে। নিজেকে সাহসী আর আত্নবিশ্বাসী প্রমান করতে গিয়ে বারবার বি’পদ আর লজ্জাজনক ঘটনার সম্মুখীন হওয়াটা ওর স্বভাবে পরিনত হয়েছে।

শুধুমাত্র এই ঘরমুখ স্বভাবের জন্যই স্কুল কলেজ সবখানে বন্ধুমহল তৈরিতে অক্ষম ঈশানী। যেখানে বন্ধুই নেই যেখানে প্রেমে পরার মতো দুঃসাহসী কাজ তো ওর জন্য কল্পনাতীত। ঈশানীকে যে কখনো কেউ প্রোপোজ করেনি এমনটা নয়, ওই জ্বলজ্বলে আকর্ষনীয় নীল চোখ দেখে পাগল না হয়ে উপায় আছে? চোখ তো নয় যেন মাদকে ঠাসা।
কিন্তু বিধিবাম! প্রেমের প্রস্তাবের চেয়েও তিরস্কার আর ভৎসনাটাই বেশি জুটেছে ঈশানীর কপালে। কেউ যদি ওকে প্রপোজ করতো, তখন ক্লাসের সবাই কানাঘুঁষা করে টিপন্নী কেটে বলতো,
— ওকে প্রোপোজ করেছিস? মেয়েটা তো এক্কেবারে ডাম্ব,ঠিক ভাবে চোখে চোখ রেখে তাকাতে অবধি পারে না, সে নাকি করবে প্রেম? ওর সাথে প্রেম করে প্রেমিকের স্বাদ পাবি আদৌও?

অগত্যাই চারপাশের মানুষের নেতিবাচক কথায় বারংবার ধসে গুড়িয়ে যেতো ঈশানীর আত্মবিশ্বাসের পাহাড়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত কাউকে ভালোবাসার সাহস কিংবা ইচ্ছে কোনোটাই জাগেনি ঈশানীর মনে।
আর আজ যখনই মনে হলো, অবশেষে কেউ হয়তো সত্যিকারের ভালোবাসার বহর সাজিয়ে ওর নিকট আসতে চলেছে, যার কাছে ঈশানী নিজেকে মেলে ধরবে, নির্জীবতা ছাপিয়ে নিজের উষ্ণ হৃদয়টাকে যার হাতে নির্বিগ্নে তুলে দেবে, সেও ওকে বিয়ে না করেই, ওর মুখটা অবধি না দেখেই দূর দেশে পাড়ি জমিয়ে আরও একবার দুমড়ে মুচড়ে নষ্ট করে দিলো ঈশানীর একটু একটু করে তৈরি করা এতোদিনের আত্নবিশ্বাসী হৃদয়টাকে। আচ্ছা, মাহিন বেনজামিন যদি একটাবার ঈশানীর মুখটা দেখতো, তাহলে কি এভাবে বিয়ে না করে ফেলে চলে যেতে পারতো?
যদিও বা এই অধ্যায় এখানেই সমাপ্ত, তবুও অজ্ঞাত এই নিছক প্রশ্নটা রয়েই গেলো ঈশানীর মন মস্তিষ্ক জুড়ে।

—- কিরে এই সাত সকাল বেলা কোথায় যাচ্ছিস ব্যাগ নিয়ে?
সকাল সকাল লং কুর্তি আর স্কার্ফটা গলায় পেঁচিয়ে ব্যাগ সমেত নিচে নেমে এসে, ঘরের দুয়ারে বসে বসে ঈশানী যখন দক্ষ হাতে স্নিকার্সের ফিতে গুলো বাঁধছিল, তখনই পেছন থেকে কথা পারেন ওর মা রোকেয়া প্রাচী ।
পেছনে না ঘুরে জুতোর ফিতেয় হাত চালাতে চালাতেই শুকনো মুখে জবাব দিলো ঈশানী,
— চিটাগং ফিরে যাচ্ছি।
মেয়ের কথা শুনে রোকেয়া বেগম কিছুটা অধৈর্য কন্ঠে বলে ওঠেন,

— এখনই যেতে হবে কেন? আমি ঘটকের সঙ্গে কথা বলেছি উনি অন্যত্র ছেলে দেখছেন। তাছাড়া কাল বিয়ে ভেঙেছে, এই মূহুর্তে বাড়ি থেকে বের হলে মহল্লার মানুষই বা কি বলবে?
মায়ের কথায় চড়াৎ করে আ’গুনের হল্কার মতোই জ্বলে উঠলো ঈশানীর শান্ত হয়ে থাকা মেজাজটা। ভেতরের সব রাগ ক্ষো’ভ যেন নিংড়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছে ওর। কিন্তু ঈশানী তো চ্যাঁচামেচি পছন্দ করে না। তাই চুপচাপ চোখ বন্ধ করে নিজেকে কিছুটা সংবরণ করে পেছনে ঘুরে মায়ের উদ্দেশ্য বলে উঠলো,
— আমার বিয়ে হোক কিংবা না হোক মহল্লার মানুষ কোনোকালেই আড়ালে কথাবলা বন্ধ করবে না মা। কারণ এটাই তাদের স্বভাব। আর না তো আমার বিয়ে নিয়ে তোমাকে আর চিন্তা করতে হবে। যতদিন অবধি বিয়ে না হচ্ছে ততদিন দরকার পরলে আমার এই মুখ দেখাবো না তোমাকে আমি, তবুও দয়াকরে এবার একটু স্বস্তি দাও আমাকে।

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো উগরে দিয়ে, ব্যাগ সমেত গটগটিয়ে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যায় ঈশানী। ওদিকে মেয়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে ক্ষুব্ধস্বরে হাঁক পেরে ওঠেন রোকেয়া,
— মুখে মুখে তর্ক করছিস? মায়ের মুখে মুখে? আমিও দেখবো তোর দৌড় কতদূর, বিয়ে আমি তোকে দিয়েই ছাড়বো।
রেগেমেগে কথাশেষ করে তপ্তশ্বাস ফেলেন রোকেয়া। ওদিকে লাঠি ভর করে ঈশানীর নানী এগিয়ে এসে মেয়েকে ধমকের সুরে বলে ওঠেন,
—- আহা যাইতে তো,মাইয়াটার মন ভালো নাই, সব কিছু কি বাইন্ধা রাখা যায়? বাইন্ধা রাখতে গেলে পাখি আরও তাড়াতাড়ি ফুরুত হইয়া যায়, জানোস না হেইডা?

রোকেয়া প্রাচী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, মায়ের মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করে ক্লান্তস্বরে বলে ওঠেন,
— তুমি কি জানোনা, এই বাড়িটা যে ঈশানীর নামে? আমি যদি আমার পছন্দমতো ছেলের হাতে ওকে তুলে দিতে না পারি, তাহলে তো সর্বনাশ মা। ও যদি নিজের পছন্দের কাউকে বিয়ে করে, তাহলে তো বিয়ের ক’দিন পরেই ওরা আমাদের এই বাড়ি থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে, তখন আমার আর ঊষার কি হবে বলোতো?
মেয়ের কথায় বিরক্তি প্রকাশ পেলো ঈশানীর নানীর কপালের ভাঁজে, তিনি পুনরায় লাঠি ভর করে ভেতরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলেন,
—- আমার ঈশু মোটেই এমন মাইয়া না, চুপ কর তুই।
মায়ের কথার বিপরীতে আর মুখ খুললো না রোকেয়া, শুধু বুক চিড়ে বের করে দিলো ভারী এক দীর্ঘশ্বাস।

গত দুদিন ধরে ভারী বর্ষনে তলিয়ে আছে রাস্তাঘাট। শহরের অলিগলিতে যানজটের বেহাল দশা। পুরো শহর ডুবে আছে প্রায় মিটার খানিক বদ্ধ পানির নিচে। সেই কর্দমাক্ত নোংরা পানি পেরিয়েই লোক সমাগম নিদারুণ ছুটে চলেছে আপন কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে।
ঈশানীর অবশ্য এই নোংরা পানি পেরিয়ে আপাতত ক্যাফেতে ছুটতে হচ্ছে না। কারণ জয়া আন্টির শর্তানুসারে আগামী একসপ্তাহ বিনা কৈফিয়তে ছুটি কাটাবে ঈশানী। তাই বাড়ি থেকে ফিরে এসে এই ছোট্ট সিঙ্গেল ফ্ল্যাটটাতেই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দিন রাত অতিবাহিত করছে ঈশানী। ঈশানীর মতে একা থাকা বড্ড সুখের। তাই সারাদিন ঘরের মধ্যে শুয়ে বসে থেকেও মন ফুরফুরে হয়ে আছে মেয়েটার।

তবে আশেপাশে নিঝুম থাকলে অন্যকথা। নিঝুম ওর স্বস্তি, আরও সহজ ভাষায় বলতে গেলে কম্ফোর্ট জোন। মাস ছয়েক আগে যখন শান্ত নিরিবিলি ঈশানী এই বাসাতে সাবলেট উঠেছিল, তখনই ওর পরিচয় হয়েছিল একটা প্রানোবন্ত হাসিখুশি শ্যামাবতীর সাথে। সেই চঞ্চলা উচ্ছ্বাসিত মেয়েটাই ধীরে ধীরে সময়ের পরিক্রমায় ঘরকুনো বন্ধুহীন ঈশানীর সবচেয়ে কাছের মানুষ বলো বন্ধু বলো দুটোতেই পরিনত হয়েছে।
ভরসন্ধ্যা বেলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঈশানী যখন একমনে হিজিবিজি ভাবছিল, ঠিক তখনই বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ শোনা গেলো।
সাধারণত ভার্সিটি টিউশন শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে যায় নিঝুমের, কিন্তু আজ সে ফিরলো সন্ধ্যা বেলাতে।
ঈশানী গিয়ে তাড়াহুড়ো করে দরজা খুলে দিতেই নিঝুম একগাল হেসে বলে উঠলো,

— সারপ্রাইজ মাই লেডি।
নিঝুমের সারপ্রাইজে উত্তেজিত হতে দেখা গেলোনা ঈশানী কে, বরং ওকে ভেতরে আসতে বলে একগ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে ঈশানী শুধালো,
— আজ এতো তাড়াতাড়ি ফিরলি যে?
নিঝুম ঢকঢক করে এক নিঃশ্বাসে পানিটুকু শেষ দিয়ে বলে,
— কারণ আছে।
— কি কারণ?
নিঝুম চোখ বড়বড় করে উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলে ওঠে,
— আজ টিউশনি করাই নি, কারণ আজ হবে অনলি গার্লস নাইট।
ওর কথার আগামাথা বুঝলো না ঈশানী, অগত্যাই ঠোঁট উল্টে শুধালো,
— মানে কি?
— মানে হচ্ছে আমরা আজ সারারাত কাথা মুড়ি দিয়ে মুভি দেখবো, বৃষ্টি বিলাশ করবো তারপর ভোর বেলা ঘুমাতে যাবো, কারণ কাল তো উইকএন্ড।
ঈশানী ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

— বুঝলাম।
— এতো বুঝলে হবেনা, যা গিয়ে পপকর্ন ভেজে নিয়ে আয়, আমি এক্ষুনি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
কথাশেষ করে দ্রুত ওয়াশরুমের দিকে চলে যায় নিঝুম। আর এদিকে ঈশানী ব্যস্ত হয়ে পরে একমাত্র বান্ধবীর আবদার মেটাতে।

ঘরের দরজা জানালা পর্দা সব লাগিয়ে দিয়ে পুরো রুমটাকে থিয়েটার বানিয়ে, ম্যাচিং করে পোকেমন ওভার সাইজ টিশার্ট, থ্রী কোয়ার্টার লেগিংস আর চুলগুলো চুড়ো করে বেধে, ঈশানী আর নিঝুম বসে পরেছে ল্যাপটপের সামনে। ল্যাপটপের স্ক্রিনে টাইটানিক মুভি চলছে, এই মুভি দেখে দেখে বিরক্ত ঈশানী, তবুও দেখতে হয়, কারন টাইটানিক নাকি নিঝুমের ফেবারিট মুভি।

এই মুভি দেখে কত হাজার বার যে কেঁদেছে মেয়েটা তার ইয়ত্তা নেই। ঈশানী ভেবে পায়না এক মুভি দেখে মানুষের ঠিক কতবার কান্না পায়? মেয়েটাকে তো আর কম বুঝায়নি ও যে, এই মুভির শুটিং সুইমিং পুলে করা হয়েছে সত্যিকারে কেউ ম’রেনি, সবাই বেঁচে আছে ভাই। কিন্তু কে শোনে কার কথা, নিঝুম মেয়েটা সেই শেষ সিনে এসে কাঁদবেই কাঁদবে। কারণ ওর নাকি বিচ্ছেদ একদম সহ্য হয়না, ম’রে যেতে ইচ্ছে করে। বাস্তবে কখনো বিচ্ছেদের তিক্ততা অনুভব করলে এই মেয়ে যে আদতে কি করবে, কে জানে?
নিঝুমের কথা ভেবে কুল পায়না ঈশানী, ওদিকে নিঝুম পপকর্ণ চিবুতে চিবুতে পর্দায় চলতে থাকা জ্যাক আর রোজের ক্যামিষ্ট্রি দেখিয়ে আপসোসের সুরে বলে ওঠে,

— ইশ আমি যে কবে একটা প্রেম করবো৷ আমার জীবনে কবে যে এমন একটা জ্যাক আসবে?
ঈশানী ঘাড় ঘুরিয়ে মৃদু হেসে বললো,
— ভার্সিটিতে পড়িস, ছেলেদের তো আর অভাব নেই, করলেই পারিস।
নিঝুম চোখ মুখ কুঁচকে মুখটাকে বাংলার পাঁচের মতো করে বললো,
— ধূর, বললেই কি আর প্রেম হয় নাকি? তাছাড়া আমি যে কেমন ছেলে চাই, সেটা তো আমি নিজেই জানিনা।
কথা বলতে বলতে চট করেই নিঝুম ঈশানীকে শুধালো,
— আচ্ছা ঈশু, তুই কখনো প্রেমে পরিস নি?
ঈশানী এবার মুচকি হেসে আসন দিয়ে বসলো, অতঃপর ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে নিস্প্রভ চোখে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলো ,

— প্রেমে পরতে হয় বলে পরা, সেরকম প্রেমে আমি কোনোদিনও পরতে চাইনা নিঝুম, আমি চাই আমার প্রেমে পরাটা হোক ঘূর্নিঝড়ের গতিপথ পাল্টে যাওয়ার মতোই হুট করে। যাকে এক দেখাতেই আমার হৃদস্পন্দন গতি হারাবে, ভেতরের সুপ্ত অনুভূতিরা মাথা চাড়া দিয়ে একযোগে বিদ্রোহ করে উঠবে, প্রেমে পড়ার নিদারুণ য’ন্ত্রনায় নীল হয়ে উঠবে আমার হৃদয়। তাকে আমার মস্তিষ্কে নয়,বরং মানস্পটে আটকাতে হবে ।শরীরের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ছাপিয়ে যাকে আমি শুধুমাত্র অন্তর দিয়ে অনুভব করতে পারবো। যাকে না দেখতে পেয়ে আমি পা’গল পাড়া হয়ে যাবো। আমার শরীর মন, এমনকি সমগ্র অস্তিত্ব তাকে পাওয়ার জন্য আকষ্মিক আন্দোলন করে উঠবে। ঠিক এমন ভাবেই প্রেমে পড়তে চাই আমি নিঝুম। আর আমি এও জানি, পৃথিবীতে এমন কারও অস্তিত্বই নেই যাকে দেখে কিনা আমার হৃদয়ে এমন অনুভূতির ঝড় উঠবে।
ঈশানীর প্রেমে পরার ব্যাখা শুনে, নিঝুম এদিকে ওদিক অপারগ মাথা নাড়িয়ে আপসোসের স্বরে বলে উঠলো,

—- বুঝেছি, তুই নিজের মাঝে প্রেমের সুখ নয় বরং প্রেমের বি’ষ ধারণ করতে চাইছিস। এই জন্যই বলি ফ্যান্টাসী ফিকশন গুলো একটু একটু কম কম পড়।
আজ বহুদিন বাদে নিঝুমের কথা শুনে হো হো করে ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো ঈশানী। যেন নিঝুম মাত্রই আস্ত একটা জোক্স শুনিয়েছে ওকে। প্রেমের বি’ষ সেটা আবার কি জিনিস? অথচ সবচেয়ে ফানি জোক্স শুনেও মেয়েটা কখনো এভাবে হাসেনা। সাইকোলজি বলে, যখন কেউ অকারণেই খুব হাসে, তার মানে সে বড্ড একা, তার ভেতরটা অজস্র দুঃখে কলুষিত। সেই ভেবেই ঈশানীর হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে চেয়ে একটুখানি ব্যথাতুর হাসলো নিঝুম।

দুজনার গল্প আর আড্ডায় বেশ অনেকটা সময় পার হয়ে যায়, তখনও মুভি চলছিল। নিঝুম শেষ সিনে নাক টেনে টেনে কেঁদে ভাসাচ্ছে, আর ঈশানী ওর দিকে টিশ্যু এগিয়ে দিচ্ছে, ঠিক এমন সময় তারস্বরে ফোনটা বেজে ওঠে ঈশানীর। জিসান কল দিয়েছে, নিঝুম যেহেতু কান্নাকাটি করছে তাই একটু দূরে গিয়েই ফোনটা রিসিভ করলো ঈশানী। ফোন তুলতেই ওপাশ থেকে কথা শুরু করে জিসান, শান্তস্বরে বলে ওঠে,

— কেমন আছি ঈশা?
— হুম ভালো, তুই?
আস্তে করে জবাব দেয় ঈশানী।
— ভালো আছি, চিটাগং ফিরেছিস তাও কাজে আসছিস না যে?
— আমি ছুটি নিয়েছি জিসান, আগামী একসপ্তাহ আসবো না।
— বাহ! দারুণ তো,
চট করেই মুখের উপর কথাটা বলে ওঠে জিসান।
জিসান কে অমন হুট করেই খুশি হয়ে যেতে দেখে ঈশানী বলে ওঠে,
— দারুণ মানে?
জিসান এবার সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো,

— শোন তাহলে,কাল তো ছুটির দিন আর আমি একদিন বাড়িয়ে ছুটি নিয়েছি, আমাদের ভার্সিটি থেকে কাল সবাই খাগড়াছড়ি যাচ্ছে, হাইকিং এ, তোকেও নিয়ে যাবো সাথে।
খাগড়াছড়ি নামটা শোনা মাত্রই অকস্মাৎ সেদিনের সেই কালো হুডি পরিহিত অপরিচিত লোকটার পিয়ার্সিং করা রিং বসানো শূন্য ডমিনেটিং ধূসর বাদামী চোখজোড়া ভেসে উঠলো ঈশানীর মানস্পটে। যে ওকে সেদিন অমন ঝড়বৃষ্টির রাতে একটা বড়সড় বি’পদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। যদিও বা লোকটার চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায়নি ঈশানী, তবুও কোথাও যেন মনে হয়েছিল এই লোকটা দেখতে মারাত্মক সুদর্শন আর স্টাইলিশ। যার সামান্য ভ্রু তে এতো সুন্দর স্টাইল করে রিং বসানো থাকতে পারে সে নিশ্চয়ই অনেক বেশি রুচিশীল আর আধুনিক মন মানসিকতার?

— কিরে কিছু বল?
জিসানের রাশভারি আওয়াজে ধ্যান ভেঙে যায় ঈশানীর, কি থেকে কিসের ভাবনায় চলে গেলো ও আশ্চর্য, অতঃপর নিজের ফোকাস ফিরিয়ে এনে,স্পষ্ট আওয়াজে ঈশানী বলে,
—- আমি কোথাও যাবোনা জিসান, তোরা যা।
— কেন যাবি না? ভ’য় পাচ্ছিস?
— কিসের ভয়? আশ্চর্য!
— এই যে বৃষ্টির মধ্যে পাহাড়ি রাস্তায় হাইকিং।
ঈশানী এবার বিরক্তির স্বরে বললো,
— না আমি ভয় পাঁচ্ছি না, তুই আমাকে যতটা ভীতু আর সহজ সরল ভাবিস আমি ততটাও ভীতু নই জিসান।
— তাহলে যাবি না কেন?
— আমার ভালো লাগছে না তাই যাবোনা।
জিসান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঈশানীকে মানানোর চেষ্টা করে সহজ গলায় বললো,

—- একবার গিয়েই দেখ না, আই সয়ার বর্ষাকালে পাহাড়ি সৌন্দর্যে পাগল হয়ে যাবি তুই, মনটা একদম ফ্রেশ হয়ে যাবে,বারবার মনে হবে এমন পরিবেশ উপভোগ করার জন্য হলেও আরও একশো বছর আয়ু বাড়ুক আমার।
জিসানের মুখে এমন পাহাড়ি বর্ণনা শুনে ঈশানীর মনে কি একটুও হাইকিং করার লোভ জাগেনি? জেগেছে তো, কিন্তু ওর সমস্যা টা তো অন্য যায়গায়, তাই এবার আর কপটতা নয়, বরং সরাসরিই বলে দিলো ঈশানী,
— দেখ জিসান, আমি জানি বর্ষাকালে পাহাড় কতোটা সুন্দর হয়, কিন্তু তোর ভার্সিটির বন্ধু বান্ধবদের তো আর আমি চিনিনা তাইনা? তাহলে ওদের সাথে কি করেই বা সাচ্ছন্দ্য বোধ করবো আমি, তুইই বল? আর আমি যদি সবার সাথে মিশতেই না পারি তাহলে হাইকিং করার আনন্দটা আর পেলাম কই?
জিসান তৎক্ষনাৎ ঈশানীকে আস্বস্ত করে বললো,

— তোর কারও সাথে মিশতে হবে না ঈশানী, এমনকি মেশার চেষ্টা ও করতে হবে না, আমি আছি তো।
জিসানের কথায় চিড়বিড়িয়ে উঠলো ঈশানী,বললো,
— কতবার বলেছি আমার ক্ষেত্রে একদম নিজের গার্জিয়ান গিরি দেখাতে আসবি না তুই। আমি নিজের খেয়াল নিজে রাখতে পারি।
ঈশানীর কথায় চোখ জোড়া বড়বড় হয়ে গেলো জিসানের, ও অবিশ্বাস্য স্বরে বলে ওঠে,
— তারমানে কি তুই যেতে রাজি হয়েছিস?
— মোটেই না, আমি তো শুধু তোকে বোঝালাম যে আমি ভীতু নই, চাইলেই যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারি আমি।

— তাহলে চল আমাদের সাথে, তুই তোর মতো থাকবি, কেউ তোকে ডিস্ট্রাব করবে না, আই প্রমিস।
— এতো কথা ভালো লাগছে না আমার জিসান।যাবো না বলেছি তো?
জিসান এবার কথার মাঝে একটু খানি কৌশল খাটালো, কারণ ও জানে ঈশানী আত্মবিশ্বাসী হতে চায়। তাই হুট করেই বলে ওঠে,
—- আমি তোকে ডেয়ার দিলাম ঈশা, তুই যদি এবার আমাদের সাথে না যাস, তাহলে তুই সত্যিই একটা ভীতুর ডিম।
ঠিক এই কথাতেই কাজ হলো,জিসানের কথাটা বড্ড মানে লাগলো ঈশানী, তাই কিছুক্ষন নীরব থেকে আচমকা ঈশানী বলে ওঠে,
— ডেয়ার একসেপ্টেড।এবার খাগড়াছড়ি গিয়ে হাইকিং করে সবার আগে পাহাড়ে উঠে আমিও দেখিয়ে দেবো তোকে, যে আমি আদতে কতোটা সাহসী।
অবশ্য মুখে এ কথা বললেও ভেতর ভেতর ঠিকই একঝাঁক জরতা আর ভয় এসে ইতিমধ্যে খামচে ধরেছে ঈশানীর কলিজাটা। কিন্তু ভয় কে তো জয় করতেই হবে। সাহসীকতার প্রশ্ন বলে কথা, ঈশানীকে তো খাগড়াছড়ি যেতেই হবে এবার।

পরের দিন যথাসময়ে চট্টগ্রাম বায়েজিদ বাসস্ট্যান্ডে এসে পৌঁছায় ওরা সকলে।
জিসান ঈশানীকে ওর বাসার নিচে থেকে এগিয়ে নিয়ে তবেই এসেছে, পুরো একটা বাস ভর্তি মানুষ খাগড়াছড়ি যাচ্ছে ওরা, সেখানে ঈশানীই একমাত্র মানুষ যে কিনা জিসান ছাড়া কাউকে আর চেনেনা, কাউকে চেনার আগ্রহ ও অবশ্য ওর মাঝে নেই। ব্যাপারটা ভীষণ অসহিষ্ণু। তবুও খুব করে সবার মাঝে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর নিদারুণ চেষ্টা চালাচ্ছে ঈশানী।

আজ সকাল থেকে আবহাওয়াটা গুমোট হয়ে আছে, আকাশ ফুটো হয়ে ঝিরঝির করে ঝড়ে পরছে বারিধারা। তবে এই বৃষ্টি গায়ে লাগার মতো নয়, বরং ধূসর রাঙা এই শীতল আবহাওয়াটাই দারুণ উপভোগ্য, যেহেতু ওরা হাইকিং এ যাবে, তাই অতি ভোর বেলাতেই গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বাস ছেড়ে দিয়েছে ওদের। বাস ছেড়ে দিতেই বাসের টিন্ডেট জানালার কিছু অংশ খুলে দেয় ঈশানী, সঙ্গে সঙ্গে মেঘ ভেজা এক নিদারুণ দমকা হাওয়া এসে আঁচড়ে পরে ওর মুখ মন্ডলে,আর তৎক্ষনাৎ পরম আবেশে দু’চোখ বন্ধ করে নেয় ঈশানী, অতঃপর ধীরে সুস্থে বুক ভরে বাতাস গ্রহন করে। এই সজীব বাতাসটুকু বোধ হয় ওর দরকার ছিল, তাই মনেমনে ওকে নিয়ে আসার জন্য জিসানের উপর খুশিও হয় অনেকটা।

ঈশানী যখন প্রকৃতির মাঝ থেকে স্নিগ্ধতা আহরণ করে নিজেকেই নিজে বিনোদন দিচ্ছিল, ঠিক তখনই ওর পাসের সিটে এসে বসে পরলো পাতলা সিমসাম গড়নের একটা সুন্দরী মেয়ে, কারও উপস্থিতি টের পেয়ে ঈশানী ঘুরে তাকাতেই মেয়েটা হাত বাড়িয়ে করমোর্দন করার প্রয়াসে সম্মোহনী হাসি দিয়ে বলে ওঠে,
— হাই, আমি মৃণা মানে মৃণালিনী,জিসান আমার ভালো বন্ধু, নাইস টু মিট ইউ।
ঈশানীও সহসা হেসে হাত মেলালো মেয়েটার সঙ্গে, অতঃপর বললো,
— আমি ঈশানী, ঈশানী তুজ কর্ণিয়া। নাইস টু মিস ইউ ঠু।
মেয়েটা গল্প করার আশে কথা এগোতে শুরু করে এবার। আগ বাড়িয়ে বলে,
—- জানো আমরা এখানে বেশির ভাগই কাপল, ওই যে দেখছো ওটা আমার বয়ফ্রেন্ড।তুমি আর জিসান ও নিশ্চয়ই?
মৃণার ঘোরানো কথার মানে বুঝতে পেরে, তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো ঈশানী,
— মোটেই না, জিসান আর আমি ভালো ফ্রেন্ড সাথে কো-ওয়ার্কার। কিন্তু এ কথা তোমাকে কে বলেছে? নিশ্চয়ই জিসান?
কথা শেষ করে কয়েক সিট পেছনে বসে মোবাইলে গেইম খেলতে থাকা জিসানের পানে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঈশানী। মৃণা মেয়েটা নিজের বোকামি কথার ভুল ধরতে পেরে ঈশানীকে বুঝিয়ে বলে,

— থাক ঈশানী, হয়তো জিসান এতোগুলো কাপলের মাঝে নিজেকে আন কম্ফোর্টেবল ফিল করছিল, তাই ওভাবে বলেছে, তুমি কিছু মনে করোনা।
মৃণার কথায় জোরপূর্বক হাসলো ঈশানী।
ঈশানী আর কিছু বলছে না দেখে মৃণা ওকে চিয়ার আপ করার জন্য পুনরায় বলে,

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩

—- দেখো বাইরের প্রকৃতি কি সুন্দর। বৃষ্টির পানিতে ভিজে গাছগাছালির সবুজ যেন তার চিত্ত চিড়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছে, এবারের হাইকিং এ নিশ্চয়ই আমাদের জন্য নতুন আর এডভেঞ্চার কিছু অপেক্ষা করছে, আ’ম সো এক্সাইটেড। উফফ!
মৃণার কথায় আবারও বিমর্ষ হয়ে যাওয়া মনটা ফট করেই ফুরফুরে হয়ে যায় ঈশানীর। তৎক্ষনাৎ মৃণাকে এক টুকরো মৃদু হাসি উপহার দিয়ে চলন্ত প্রকৃতির দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে বিড়বিড়ায় ও,
—- তাই যেন হয়।

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৫