আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২৮
suraiya rafa
রাতের শেষ আঁধারে আচ্ছাদিত ধরণি। পশ্চিম আকাশে মিটিমিটি আলোক শিখায় ভূবন ভোলাচ্ছে শুক্লপক্ষের বিষণ্ণ চাঁদ। বরফের দেশে চাঁদের আবহে অপার্থিব চারিপাশ। বিস্তৃত জঙ্গলা প্রকৃতিতে ঘিরে আছে রহস্যের ইন্দ্রজাল।
নেকড়েদের হাউলিং কমে এসেছে খানিক। সমগ্র রাত জুড়ে জঙ্গল পাহাড়ায় ন্যাস্ত থেকে শেষ রাতে নেতিয়ে পরেছে নিশাচর গুলো। জঙ্গলের রাত জাগা দানব গুলোর আগ্রাসন যখন হামেশাই ফুরিয়ে আসে, তখনই ঘুটঘুটে তমশার বুক চিঁড়ে শিকারের তাড়নায় ভস ভস করে বেড়িয়ে আসে মানুষরূপি অশরীরীর দল। একের পর এক বিলাসবহুল রোলস রয়েসের বহর বেরুতে শুরু করে পাইথন টেরিটোরির হিডেন গেটের এক্সিট ধরে। গাড়িতে উপস্থিত প্রতিটি মূর্তিমান মানবের পা থেকে মাথা অবধি অমানিশার ন্যায় কুচকুচে কালো দ্বারা আবৃত। মাথার হেলমেট থেকে শুরু করে হাতের স্নাইপার সবকিছুতে রাশিয়ান অক্ষর খচিত পাইথন সিলমোহর । কালো রঙে আচ্ছাদিত প্রতিটি মানবের নেত্রপুটে জমে আছে প্রগাঢ় শূন্যতা। নির্জীব, যান্ত্রিক তাদের অভিব্যক্তি, যেন যুদ্ধ, বিগ্রহ,হানাহানি আর সর্বোপরি ব্লাডিবিস্ট টার হুকুম পালন ব্যাতিত পৃথিবীর সবকিছুই মূল্যহীন তাদের নিকট।
শুনশান নিরিবিলি রাতে টম এ্যান্ড জেরী এপিসোড দেখতে দেখতে ঘর কাঁপিয়ে হাসছে আরেক নিশাচর। হলরুমের বিশাল পর্দায় টম এ্যান্ড জেরীর হাস্যরসিক দ্বন্দ্ব চলমান, ম্যানসনে কর্মরত স্টাফ গুলো পরিশ্রান্ত হয়ে নীরবে ঝিমাচ্ছে, দিনরাত একটানা কার্যরত থেকে বড্ড ক্লান্ত তারা,ঘুমের ভারে টলমল করছে মস্তিষ্ক, অথচ তাদের প্রিন্সের চোখে ঘুম তো দূরের কথা, এইটুকু ক্লান্তি অবধি নেই। তারউপর কিছুক্ষণ পরপরই গগন কাঁপানো হাসির আওয়াজ,বিতৃষ্ণায় ভেতর ভেতর চিড়বিড় করছে সকলে। তাতে অবশ্য বিন্দু পরিমাণ হেলদোল নেই টমেটো প্রিন্স খ্যাত এ্যালেক্স এর মাঝে । পরনে ঢিলেঢালা শর্টস আর হাফ স্লিভ টিশার্ট চড়িয়ে কাউচের উপর আধশোয়া হয়ে বেমালুম পপকর্ণ চিবুচ্ছে সে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
এর মাঝেই ঘটে যায় অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা। দেওয়াল জোড়া মনিটরের পর্দায় যেই মূহুর্তে টম জেরীকে এক থাবায় কুপোকাত করলো, ঠিক তখনই কোথা থেকে যেন বিদ্যুৎ বেগে ছুটে এসে অতর্কিতে টমেটো প্রিন্সের বক্ষস্থলে থাবা বসায় রগরগে এক হিং’স্র দানব। চোখের পলকে পপকর্ণ গুলো ছিটকে পরে সমগ্র মেঝেতে,সেই সাথে ধরাশায়ী হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে এ্যালেক্স।অতর্কিত আ’ক্রমণের তোড়ে সমস্ত শরীর ব্যথায় টনটন করে ওঠে তার।সামনের পাটির দাঁত থেকে গলগল করে বেড়িয়ে আসে তরতাজা র’ক্তবাণ। নিজেকে সামলে কোনো মতে ঘাড় বাঁকিয়ে পেছনে ঘোরে এ্যালেক্স, পিয়ার্সড করা শূন্য চোখ দু’টো দেখে মূহুর্তেই রূহু ছলাৎ করে ওঠে তার। অজানা আশঙ্কায় কুঁকড়ে গিয়ে, আড়ালে কয়েক দফা শুষ্ক গিললো সে। অতঃপর আড়ষ্ট স্বরে বলে উঠলো ,
— রীশস্কা ত..তুমি?
জবাব দিলো না এরীশ, বুকের কাছের টিশার্টটা জোর হস্তে খামচে ধরে ফের ঝপাৎ করে টেনে তুললো এ্যালেক্সকে। বলবান হাতের সবগুলো আঙুলের চাপ ওর গলায় প্রয়োগ করে হুংকার ছেড়ে বললো,
— ব্লাড ডায়মন্ড কোথায় এ্যালেক্স।
গলা কাঁটা মুরগীর মতো ছটফট করে ওঠে এ্যালেক্স, কণ্ঠনালির মোলায়েম হার গুলো চিড়চিড় করে ভেঙে বেড়িয়ে আসতে চাইছে যেন। শ্বাসপ্রশ্বাসের গতিরোধ হয়েছে অনেকক্ষন,ফলস্বরূপ ভাসমান চোখ দু’টো ধারণ করেছে টকটকে র’ক্তিম আভা। ওদিকে স্বয়ং টমেটো প্রিন্সের এহেন ম’রিমরি হাল দেখে সশস্ত্রে ছুটে আসে ম্যানসনের একদল সুরক্ষাকর্মী। তবে পাইথন লিডারের ছায়া অবধি পৌঁছানোর আগেই তাদের গতিরোধ করে কালো পোশাকধারী অন্যদল।
আপাতত দু’দলের গার্ড’সরা তাদের লিডারের প্রতিরক্ষায় ব্যতিগ্রস্ত। অন্যদিকে দীর্ঘক্ষণ শ্বাসরোধের ফলে চোখের মনি উল্টে বেড়িয়ে আসে এ্যালেক্সের। ওর র”ক্তাক্ত মুখাবয়ব লক্ষ্য করে হাতের বাঁধন কিঞ্চিৎ ঢিলে করলো এরীশ। ক্রোধান্বিত গোখরার ন্যায় বরফ শীতল কণ্ঠে হিসহিসিয়ে নতুন উদ্যমে জিজ্ঞেস করলো,
— ব্লাড ডায়মন্ড কোথায়? শেষ বারের মতো উত্তর দাও এ্যালেক্স। নয়তো সেকেন্ড চান্স আর এ জীবনে পাবেনা।
বহু কষ্টে শ্বাস টেনে তুললো এ্যালেক্স, হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে তার গতিহীন বক্ষপিঞ্জর। চোয়ালের মাঝে র’ক্তের বিদঘুটে নোনতা স্রোত, সেটুকু বিতৃষ্ণায় গলাধঃকরণ করে, মুখ খুললো টমেটো প্রিন্স ,অজ্ঞাত স্বরে বললো,
—তুমি আমাকে কেন মা’রতে চাইছো? ব্লাড ডায়মন্ড তো ডেনিয়েল হ্যারিসনের কাছে।
মূহুর্তেই চোখের বর্ণ পাল্টে গেলো এরীশের। আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের মতো চড়াৎ করে ফুঁসে উঠলো সে। বাম হাতের রিভলবারটা অকস্মাৎ এ্যালেক্সের মুখে গুঁজে দিয়ে বজ্রকণ্ঠে প্রত্যুত্তর করলো,
—ইউ ব্লাডি ফাকার! আমাকে কি তোর ডেনিয়েল মনে হয়? তোর মতো মুখোশধারী হায়নার সঙ্গে বিষ দাঁতবিহীন ডোরা সাপ ডেনিয়েলের মিত্রতা থাকতেই পারে কিন্তু আমার নয়। এতোটা কমন সেন্সের অভাব এখনো এরীশ ইউভানের হয়নি। দিন শেষে আসল চালটা যে তুইই চালবি সেটা আমি বহু আগেই বুঝতে পেরেছি।
খুকখুক করে মেকি কান্না জুড়ে দিলো এ্যালেক্স।যেন বড্ড বেশি অসহায় সে, তেমন করে নাক টেনে বললো,
— আমাকে তুমি শ’ত্রু ভাবছো রীশস্কা? ছি ছি ছি! আমি কোন সাহসে ব্লাড ডায়মন্ড হাতাতে যাবো বলো? কি স্বার্থ আমার? আমিতো আরও ডেনিয়েল…
পুরো বাক্য শেষ করার আগেই ওর নাক বরাবর ঘুষি বসিয়ে দিলো এরীশ, একটা দু’টো নয়, একধারে অনেকগুলো। নাসারন্ধ্র থেঁতলে গিয়ে ক্ষ’তবি’ক্ষত হয়ে উঠলো টমেটো প্রিন্সের উজ্জ্বল মুখমণ্ডল। তবুও দমলো না এরীশ, উর্ধ্বশ্বাসে বসাতে লাগলো একের পর এক কষাঘাত। দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
— ডেনিয়েল যে চিকিৎসার জন্য আত্নগোপনে রয়েছে সেটা আমি জানি বাস্টার্ড! তোর কপালে ম’রণ খেলা করছে তাই পাইথন লিডারের সঙ্গে জোকারগিরি শুরু করেছিস।
কথাশেষ করে এ্যালেক্সের মুখের মাঝেই রিভলবার লোড করালো এরীশ। আঙুল দাবিয়ে ট্রিগার প্রেস করতে যাবে ঠিক তখনই ধড়ফড়িয়ে উঠে জোরে জোরে হ্যা সূচক মাথা নাড়াতে শুরু করে এ্যালেক্স। কথা বলার শক্তি না পেয়ে আর্তনাদের স্বরে গোঙাতে শুরু করে অর্হনিশ। ওর প্রতিক্রিয়া দেখে রিভলবার সরালো না এরীশ,হাতের বাঁধন ঢিলে করলো শুধু, অতঃপর রিভলবারের নলটা আস্তে করে ওর জিহ্বার বিপরীতে চেপে ধরে ক্রুর স্বরে বললো,
— বাঁচতে চাস?
মূমুর্ষ এ্যালেক্স, নিভুনিভু তার বিদীর্ণ অক্ষিপুট।তবুও এরীশের কথার প্রত্যুত্তরে র’ক্তা’ক্ত মাথাটা আস্তে করে দোলালো ফের ।
— ব্লাড ডায়মন্ড কোথায়?
এবার আর ছলচাতুরী নয়, জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাসফ্যাস করে জবাব দিলো টমেটো প্রিন্স খ্যাত ধূর্ত এ্যালেক্স,
— আমি জানিনা, সত্যিই জানিনা।
এরীশের সিক্স সেন্স জানান দিলো এ্যালেক্স সত্যি বলছে,তাই ধাতস্থ স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
— ডেনিয়েলের কাছ থেকে চুরি করে কোথায় লুকিয়েছিস?
— ভ্লাদিমিরের পাকস্থলীতে, ক..কিন্তু ওকে তো তুমি মে’রে লোপাট করে দিয়েছো।
“ভ্লাদিমির” নামটা নিয়ে কিয়ৎক্ষন চিন্তায় ডুবলো এরীশ, পরমূহুর্তেই মাথায় হানা দিলো সেদিন অফিস কক্ষে অতর্কিতে শ্যুট করে দেওয়া টমেটো প্রিন্সের স্পাইটার কথা। তুষার তো বলেছিল এটা টমেটো প্রিন্সের লোক।
বাজপাখির ন্যায় আচানক দৃষ্টি ঘোরালো এরীশ,এ্যালেক্সের নিথর শরীরটাকে আরেকদফা ঝাঁকি দিয়ে বললো,
— ওর পেটে ব্লাড ডায়মন্ড কি করে গেলো? আর রত্মটি যদি ওর পেটেই থেকে থাকে তাহলে ডিল ফাইনালের জন্য ওকে কেন পাঠিয়েছিলি?
ক্ষীণ শ্বাস টানলো এ্যালেক্স,রুগ্নস্বরে জানালো,
— অপারেশনের মাধ্যমে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল,যেটা ভ্লাদিমির নিজেও জানতো না। আর তোমার কাছে পাঠানোর কারণ, যাতে ব্লাড ডায়মন্ড তোমার আশেপাশে থাকার পরেও তুমি তার অস্তিত্ব খুঁজে না পাও, সন্দেহের তীর টা যাতে আমার দিকে না আসে।
কিন্তু…
কথার এপর্যায়ে শ্বাস টেনে তুলতে অত্যন্ত বেগ পোহাতে হলো এ্যালেক্সের। শীর্ণকায় দেহটা চেতনাহীন হয়ে পরছে ক্রমশ। উত্তেজনায় ধুকপুক করছে তার আহত হৃদযন্ত্র। বুকের উপর হাঁটু গেঁড়ে বসা ধ্বংসাত্ত্বক আগু’ন চোখের লেলিহান নজরে এলে ভয়ার্ত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পুনরায় বলে ওঠে সে,
— ডাক্তার বলেছিল পাকস্থলীর ইনফেকশনের কারণে খুব শীঘ্রই মা’রা যাবে ভ্লাদিমির, আর তখনই কম্পিলিট হতো আমার ব্লাড ডায়মন্ড মিশন। কিন্তু মাঝখান থেকে সব প্ল্যানে জল ঢেলে দিয়ে তুমি ওকে ডিলের জের ধরে মে’রে দিলে।এমনকি লা’শ টাকেও রাতারাতি অদৃশ্য করে দিয়েছো। ফলস্বরূপ না তো এখন আমি ভ্লাদিমিরের লাশের খোঁজ জানি, আর না তো ব্লাড ডায়মন্ডের।
টমেটো প্রিন্সের ধূর্ততা সম্পর্কে অবগত ছিলো এরীশ। কিন্তু এতোটা ছলচাতুরী আর কপটতাও আশা করেনি ও। সবাই ঠিকই বলে টমেটো প্রিন্স একটা জীবন্ত হায়না। ওর গতিবিধি আর কর্মকান্ড বুঝে ওঠা মারাত্নক রহস্য জনক। তবে এই মূহুর্তে জোকার টাকে নিয়ে এক সেকেন্ড ও ভাবার সময় নেই, রাতের আঁধার ফুরিয়ে আসছে, ব্লাড ডায়মন্ডের খোঁজ করা প্রয়োজন।
এ্যালেক্সের কথা শেষ হতে না হতেই বাম হাতের কব্জিতে একপল দৃষ্টিপাত করে এরীশ। অতঃপর কানের এয়ারপড সচল করে কল লাগায় কাউকে। ওপাশ থেকে কিছু বলার আগেই রাশভারী আওয়াজে স্পষ্ট হুকুম করলো মাফিয়া বস,
— নেকড়ে গুলোকে কানিগা ফরেস্টে নিয়ে এসো, সাথে বোজো কেও।
পাইথন টেরিটোরির চারিপাশ বেষ্টনীর মতো আবদ্ধ করে রেখেছে বিস্তার কানিগা ফরেস্ট।এই জঙ্গলের বিশালতা খালি চোখে অনুমান করা দুঃসাধ্য। সুকৌশলী আর অভস্ত্য না হলে এই জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়ার প্রবণতা প্রকট। সাধারণ পথচারী হলে সঠিক রাস্তার খোঁজ পাওয়ার জন্য ম্যাপ নিয়ে চলাচল আবশ্যক। যদিও পুরো জঙ্গলটাই রেসট্রিক্টটেড, জনসাধারণের জন্য এই জায়গা নয়। কারণ কানিগা ফরেস্টের একচ্ছত্র দখলদারি একমাত্র পাইথন প্যারাডাইসের। শুধু মাত্র এই একটা নাম, “পাইথন” পুরো মস্কোর বুকে দূর্বোধ্য কাঁপন ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
ভোরের আলো ফোটেনি এখনো,আকাশে নিভু নিভু শুকতারা। তুষারপাতের দৃঢ়তা কমে এসেছে কিছুটা। এরই মাঝে পুরো জঙ্গল তন্নতন্ন করে খোঁজা হচ্ছে ভ্লাদিমিরের লা’শ। কাজটা সম্পন্ন করা গার্ড’সদের পক্ষে একপ্রকার অসম্ভব। কারণ মাটির উপর কয়েক হাত পুরু হয়ে জমে আছে পাথর খণ্ডের মতো শক্তিশালী বরফের স্তর। তাই লা’শ খোঁজার জন্য নিয়ে আসা হয়েছে বিশেষ ট্রেনিং প্রাপ্ত একপাল সাদা নেকড়ে।
খোঁজাখুঁজির কাজটা তারা ই আপাতত সামলাচ্ছে।
খানিকবাদে আদ্র শুভ্রতার আস্তর পায়ে মারিয়ে জঙ্গলের অভিমুখে এগিয়ে আসে মাফিয়া বস। তার পদধ্বনির নিস্প্রাণ আওয়াজে কর্ণ সচল হয়ে ওঠে সকলের। কালো ওভার কোট আর মাস্ক পরিহিত এরীশের পায়ের সান্নিধ্যে তীক্ষ্ণ পা ফেলে ধীরে ধীরে এগোয় ডোরাকাটা স্বর্ণাভ চোখের আরেকটি লকলকে দানব।ধূসর অন্ধকারের মাঝেও তার চোয়াল ছাপিয়ে ভেসে ওঠা হিং’স্র শিকারির ন্যায় সূচালো দন্তরাশি স্পষ্ট দৃশ্যমান। অন্ধকারের মাঝে ওমন জ্বলজ্বলে দানবীয় চোখের চাহনি যে কেউ দেখলে পিলে চমকে যাবে। অথচ মাফিয়া বসের অতি আদরের বোজো সে।
জঙ্গলের মাঝ বরাবর এসে পায়ের গতি ধীর করলো এরীশ, হাঁটু গেঁড়ে বোজোর মুখোমুখি হয়ে বসে, ওর লোমশ শরীরে আদুরে হাত বুলিয়ে হাস্কিস্বরে বললো,
— আই নিড সামওয়ান বোজো।
প্রত্যুত্তরে ধরিত্রী কাঁপিয়ে উচ্চস্বরে হাউলিং করে ওঠে দানবটি। যেন প্রভুর কথার যথাআজ্ঞা জানালো সে। আরেকদফা ওর গলায় আদর দিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে নীরবে হাসলো মাফিয়া বস,
— হাউ উইল ইউ ব্রিং হার ব্যাক ডিউড ?কজ শী হিজ নো লংগার হিয়ার।
নিস্প্রভ চোখে চেয়ে রইলো বোজো। কাউকে হারিয়ে ফেলার নিগূঢ় যন্ত্রণাটুকু অজান্তেই উদ্ভাসিত হলো পিয়ার্সড করা ভ্রুর ভাজে আটকানো একটুকরো রুপোলী পাথরে আড়াল করে রাখা শূন্য চোখে। সময় অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে,এরীশ আর সময় নষ্ট করলো না, তপ্তশ্বাস ছেড়ে ভ্লাদিমিরের পরিধেয় কাপড়ের একাংশ প্রাণীটির নাকে ধরে বললো,
—চু চু.. গো এহেইড বোজো।
এরীশের আদেশ পাওয়া মাত্রই লোমশ শরীরটাকে একমুহূর্ত ঝাঁকিয়ে উঠে বিদ্যুৎ বেগে ছুট লাগায় বোজো।অতঃপর চোখের পলক ফেলার আগেই মিলিয়ে যায় নিস্তব্ধ ঘুটঘুটে আঁধারে ঢাকা গভীর অভ্যায়ণ্যের মিশেলে।
** বোজো চলে গেলে, বরফ আচ্ছাদিত ক্রীসমাস গাছের আড়াল থেকে ধীর পায়ে বেড়িয়ে আসে দু দু’টো মানুষের অবয়ব। তাদের মাঝে একজনের অবস্থা বেগতিক। হাতে, পায়ে, নাকে, মুখে আরও কোথায় কোথায় ব্যান্ডেজ লাগানো তার ইয়ত্তা নেই। অন্যজন রুগ্ন মানবটিকে ধরে আছে কোনোমতে। দু’জনার গভীর দৃষ্টি জঙ্গলের মাঝে আবদ্ধ, এরই মাঝে সুস্থ সবল লোকটি হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,
— কি মনে হচ্ছে প্রিন্স? ব্লাড ডায়মন্ড কি খুঁজে পাওয়া যাবে?
সরু নাকের ডগায় পোটলার মতো করে শক্ত ব্যান্ডেজ বেধে দেওয়া হয়েছে টমেটো প্রিন্সের। কথা বলা দুষ্কর। কসরত করে বললেও তা শুনতে বেশ হাস্যকর লাগে, তবুও এদিক ওদিক সচকিত দৃষ্টি বুলিয়ে নিম্নস্বরে প্রত্যুত্তর করলো সে,
— পাইথন লিডার যেহেতু বলেছে, তারমানে ধরে নাও ব্লাড ডায়মন্ড এখন ওর হাতে।
— কিন্তু আপনি এতো সহজে হার মেনে নিলেন?
জোকারের মতো করে নিঃশব্দে হাসলো এ্যালেক্স, রহস্য জড়ানো কণ্ঠে বললো,
— এতো বড় জঙ্গলের ভেতর থেকে লা’শ খুঁজে বের করার জন্য এইটুকু হার তো মানতেই হতো রুশো । সবুর করো, দাদু বলতেন সবুরে মেওয়া ফলে।
কক্সবাজার, বাংলাদেশ।
কেটে গিয়েছে দীর্ঘ একসপ্তাহ। ঈশানীর বিষণ্ণ মনের নিগূঢ় তিক্ততা দূর হচ্ছে ধীরে ধীরে। এর মাঝে রোকেয়া প্রাচী ও আর ঝামেলা করেনি কোনো। মা মেয়ের মাঝে ঘনীভূত অদৃশ্য দূরত্বের দেওয়ালকে জোর খাটিয়ে ভাঙার চেষ্টা করেনি কেউই, আর না তো রাশিয়ার সেই বিভীষিকা ময় দিনগুলোর কথা আগ বাড়িয়ে কাউকে জানাতে গিয়েছে অন্তর্মুখী মেয়েটা। ফলস্বরূপ সময়গুলো অতিবাহিত হয়েছে নির্ঝঞ্ঝাট আর নিরিবিলি ।
সকাল হয়েছে বহুক্ষণ,বাড়ির আঙিনায় বেনামি পাখির বিমুগ্ধ কলতান। হীমেল শীতের আবহে কম্বলের ওমটুকু যেন অমৃতসম। ঘুমের রেশ কাটিয়ে ওঠা দুষ্কর। ওমের পরশে কম্বলের মাঝে মুখ গুঁজেছে ঈশানী, এমন সময় বাজখাঁই আওয়াজে বেজে ওঠে ওর আটপৌরে বেয়ারা মুঠোফোন। ফোনের চিৎকারে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো ঈশানী, তাড়াহুড়ো হাতে কল রিসিভ করে জড়ানো গলায় বললো,
— হ..হ্যালো!
হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো চিরচেনা সেই উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠস্বর।
— ঈশুরেএএএ.. তুই বেঁচে আছিস?
পরিচিত কণ্ঠের চঞ্চলতায় এক চিলতে খুশির ঝিলিক উদ্ভাসিত হলো ঈশানীর ঠোঁটের আগায়। মিষ্টি করে নীরবে হাসলো মেয়েটা, সম্মোহনী স্বরে শুধালো,
— কেমন আছিস রে নিঝুম?
— আমি কেমন আছি সেটা তোর এতো মাস পরে মনে পরলো? এতোদিন কোথায় ছিলি তুই? সেই যে আন্টির ভয়ে গা ঢাকা দিলি তারপর থেকেই নিখোঁজ। নিখোঁজ কি একেবারে লাপাত্তা। জানিস তোকে কোথায় কোথায় খুঁজেছি আমি?
এক নিঃশ্বাসে অভিযোগের বহর উগরে দিলো নিঝুম। মনে হলো যেন কতদিন মন খুলে একটু কথা বলেনি মেয়েটা। নিঝুমের এতো এতো অভিযোগের পাছে বাকরুদ্ধ ঈশানী, নতুন করে সেসব কলুষিত অধ্যায় সামনে টেনে আনতে চায়না ও, সহসা কথা ঘুরিয়ে শুধালো,
— হঠাৎ পুরোনো নাম্বারে কল করলি যে? কি করে বুঝলি এই নাম্বার চালু আছে?
অভিমানে গলা ধরে এলো নিঝুমের, কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,
— যখন একটু সময় পাই, তখনই তোর সব নাম্বার গুলোতে ডায়াল করি। জানি ওপাশ থেকে বন্ধ সুর ভেসে আসবে, তাও করি। কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি বলনা ঈশু?
ফিচেল হাসলো ঈশানী,অনুভূতিহীন স্বরে বললো,
— সে অনেক কথা, সামনাসামনি বলবো একদিন। এখন বল তোর কি খবর? বিয়ে করিস নি এখনো?
অপর পাশে শুনশান নীরবতা,বেশকিছুক্ষণ পরে দীর্ঘশ্বাসের বিষণ্ণ আওয়াজ, অতঃপর কথায় ফিরলো নিঝুম। বললো,
— ঠিক হয়েছিল,কিন্তু ভেঙে দিয়েছি।
— ওমা, কেন? ছেলে পছন্দ হয়নি? নাকি অন্য কোনো সমস্যা?
— কোনো সমস্যা নেই, ছেলেটা একটু বেশি ভদ্রলোক। এতো লাজুক, ভদ্র, কেয়ারিং, গ্রীন ফ্ল্যাগ দিয়ে কি হবে? আমার এতো ভদ্র ছেলে চাই না।
ফিক করে হাসলো ঈশানী, ঝুমঝুমিয়ে বললো,
— তাহলে তোর কেমন ছেলে চাই?
— ডেভিল লাভার। তার মধ্যে একটা ভিলেইন ভিলেইন ভাব থাকবে। ওভার অল আই ওয়ান্ট ফোর্স ম্যারেজ। ওই যে ইংলিশ নোবেল গুলোতে হয়না? ঠিক ওরকম।
মূহুর্তেই ঠোঁটের হাসি উবে গেলো ঈশানীর, চোখে মুখে ভর করলো প্রগাঢ় তমশা। পেলব ঠোঁট জোড়া শুকিয়ে কাঠ, অপর পাশের নিঝুমকে তৎক্ষনাত বাঁধ সেধে বললো,
— এসব চিন্তা ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল নিঝুম। জীবনটা কোনো ইংলিশ নোবেল নয়, ভুলক্রমে সত্যি সত্যি জীবনে ভিলেইন চলে এলে তখন কি…
কথা শেষ করতে পারলো ঈশানী, আড়ষ্টতায় শুষ্ক ঢোক গিললো শুধু। ঈশানীকে হঠাৎ থেমে যেতে দেখে ওপাশ থেকে উৎসুক হয়ে নিঝুম বললো,
— এসব কথা তুই আমাকে বলছিস ঈশু? তুই! কেন যেন একদম বিশ্বাস হচ্ছে না, তুই না একরাতের এক দেখায় প্রেমে পরে গিয়েছিলি? সে কি গভীর অনুভূতি, অরণ্যর জন্য কি পাগলামোটাই না করতিস! হ্যারে তোর অরণ্যর কি খবর? আর ওই জিসানের?
নিঝুমের কথায় এক মূহুর্তের জন্য সেসব দিনগুলোতে হারিয়ে গেলো ঈশানী। “তোর অরণ্য ” কথাটা শোনা মাত্রই নীরব দহনে খামচে ওঠে ওর নাজুক বক্ষপিঞ্জর। বেখেয়ালে বুকের বা পাশে হাত ছোঁয়ায় মেয়েটা, এরীশ ইউভান নামটা শুনলে যতটা ঘৃণায় মস্তিষ্ক বুদ হয়ে আসে, অরণ্য নামটা শুনলে ঠিক ততটাই আবেগের প্লাবনে ভেসে যায় অন্তঃকরণ। এ কেমন অসহনীয় দোটানা?
— কিরে শুনতে পাচ্ছিস? জিসানের কি খবর বললি নাতো?
কয়েক মূহুর্ত চোখ বুঁজে নিজেকে খানিক শান্ত করলো ঈশু।
— যেই অরণ্য, সেই এরীশ। দুজনই ওই নিষিদ্ধ দুনিয়ার নরপিশাচ ।
তপ্তশ্বাস ছেড়ে মনকে বোঝানোর বৃথা চেষ্টা চালালো কিয়ৎক্ষন। পরমূহুর্তেই নিঝুমের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলো ঈশানী। বললো,
— জিসানের কথা বলছিস?
—হু।
ছোট্ট করে সায় জানালো নিঝুম।
— সত্যি বলতে জিসানের ব্যাপারটা নিয়ে আমি বেশ উদ্বিগ্ন নিঝুম। বেশ কিছুদিন আগে কল দিয়েছিলাম ওকে। কল তো তুলেছিল ঠিকই, কিন্তু ওর কথাবার্তা ভীষণ অদ্ভুত লেখেছিল আমার কাছে।
— মানে?
কৌতুহলী নিঝুম।আপন মনে কয়েক সেকেন্ড ভেবেচিন্তে ফের বলতে আরম্ভ করে ঈশানী,
— সত্যি বলছি, জিসান কে আমি এতো ঠান্ডা আচরণ করতে কখনো দেখিনি। কোথাও একটা মনে হচ্ছিল এটা আসলে জিসান নয় অন্য কেউ। কিন্তু কণ্ঠস্বরের তো কোনো তফাৎ ছিলনা । তার চেয়েও বড় কথা আমাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এতোবড় ঘটনার পরেও ওর এমন স্বাভাবিক আচরণ সত্যিই অদ্ভুত!
— কি ঘটনার কথা বলছিস বলতো? একটু ক্লিয়ার কর, বুঝতে পারছি না।
তৎক্ষনাত জোর পূর্বক কেশে উঠলো ঈশানী, কিঞ্চিৎ গলা খাঁকারি দিয়ে কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে বললো,
— আচ্ছা জিসান কি এখনো জয়া আন্টির ওখানে পার্ট টাইম করে?
ভবঘুরে আওয়াজে উত্তর পেশ করলো নিঝুম,
— কই নাতো। কিন্তু হ্যা, তুই চাইলে চাকরিটা আবার কন্টিনিউ করতে পারিস। আমি যতদূর জানি জয়া আন্টি এখনো কোনো লোক নেয়নি, ভ্যাকান্সি খালি পরে আছে।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে না জানালো ঈশানী। বললো,
— আমার আর একা একা অতো বড় শহরে থাকার সাহস নেই নিঝুম। আমি বাড়িতেই ভালো আছি।
— কিন্তু তোর পরিবার তো…
বাক্য শেষ করার ফুরসত দিলোনা ঈশানী,আহত স্বরে বললো,
— জানি। ওরা আমায় ভালোবাসে না, বিশ্বাস ও করেনা। মুখে প্রকাশ না করলেও, ওরা ভাবে এই বুঝি ওদের মাথার ছাঁদ টুকু কেঁড়ে নিয়ে যাই আমি, কারণ বাড়িটা দাদু আমার নামে করে দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু বিশ্বাস কর, এমনটা আমার কল্পনাতেও আসেনা, ওরা তো আমার পরিবার, ওদের বাদ দিয়ে কোথায় যাবো আমি?আ…
ঈশানী আরও কিছু বলবে, তার আগেই দরজা ঠেলে হুড়মুড়িয়ে কক্ষে প্রবেশ করেন রোকেয়া। মেয়েকে জহুরি চোখে পরখ করে চটজলদি প্রশ্ন ছোড়েন তিনি,
— কার সঙ্গে কথা বলছিস তখন থেকে?
কথার লাগাম টেনে একপল মায়ের পানে ঘুরে চাইলো ঈশানী। জানালো,
— নিঝুমের সঙ্গে।
কথা বাড়ালেন না রোকেয়া প্রাচী। বিনাবাক্যে রুম ত্যাগ করে চলে গেলেন দেবোরার কক্ষে। খোলা জানালার পাশেই বেতের মোড়া পেতে রোদ পোহাচ্ছিলেন দেবোরা। বার্ধক্যে নুয়ে এসেছে তার সরল পৃষ্ঠদেশ, ফর্সা কুঁচকানো চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে ছোপ ছোপ সৌন্দর্যের দ্যুতি। শরীরে উলের চাদর প্যাঁচিয়ে পান চিবুচ্ছিলেন বৃদ্ধা, এহেন সময় আগমন ঘটে রোকেয়ার। তার চেহারায় উদ্বিগ্নতা ছাপ। মেয়েকে চিন্তিত দেখে ভ্রু কুঁচকালেন দেবোরা, ভঙ্গুর গলায় শুধালেন,
— কি অইয়্যেদে?( কি হয়েছে?)
নিঃশব্দে খাটের উপর গিয়ে বসলেন রোকেয়া, তপ্তশ্বাস ছেড়ে বললেন,
— মেয়েটাকে সন্দেহ হচ্ছে। এতোদিন কোথায় ছিল, কোথা থেকে ফিরেছে কিছু তো বলাতেই পারলাম না, উল্টো ঘর আঁটকে বসে থাকে সবসময়। কার সাথে যেন কথা বলে ফুসফুস করে। জিজ্ঞেস করলাম, বললো নিঝুম।
— বিয়া দি ফেলা।( বিয়ে দিয়ে দে)
বুড়ির কাছে সব সমস্যার একটাই সমাধান। আজকাল ঊষার ব্যাপারেও একই বুলি আওড়ান তিনি। অন্য সময় হলে হয়তো এ কথায় বিরক্তবোধ করতো রোকেয়া, কিন্তু এই মূহুর্তে মায়ের কথাটা বড্ড ভাবালো তাকে। লায়েক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেওয়াই উত্তম, তাছাড়া এ যাবত ঝামেলা অঘটন তো আর কম হলো না। ঈশানীকে বিয়ে দিতে পারলে সব দিক দিয়েই ঝামেলার অবসান।
— কিন্তু পাত্র?
আচানক বলে ওঠেন রোকেয়া। মেয়ের কথার পাছে নিঃশব্দে হাসলেন দেবোরা। ভাঙা গলায় রসিয়ে রসিয়ে বললেন,
— উন, বুদ্ধি হাডায় এনে হাম গরন ফরিব। নাতি জামাই খুজোন ফরিবো, এক্কানা বড়লোক সাঈ এনে। যাতে নাতির লগে আরারেও সাঈত ফারে। (বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করতে হয় বুঝলি? নাতি জামাই খুঁজতে হবে বড়লোক দেখে, যাতে নাতনীর পাশাপাশি সারাজীবন আমাদের ও খেয়াল রাখতে পারে।)
উচ্ছ্বাসের জোয়ারে চিকচিক করে উঠলো রোকেয়া প্রাচীর সাবলীল দু নয়ন। তিনি চকিতে চোখ ঘোরালেন মায়ের পানে, ঠোঁটের আগায় বিশ্বজয়ের হাসি ঝুলিয়ে বললেন,
— তোমার তো ভারী বুদ্ধি মা। কিন্তু এমন সু’পাত্র কোথায় পাবো বলোতো?
— তোর বদ্দা রে হ সাঈবাল্লাই। এনে আর নাতিন তো হম সুন্দরী নো ওয়া, দুয়ো নীল চোখ, ইবাত হোনো অসুবিধা নাই। ( তোর ভাইজান কে বল খোঁজ করতে। তাছারা আমার নাতনী তো আর কম সুন্দরী না,একটু নীল চোখে কোনো অসুবিধা হবেনা।)
মায়ের কথায় হ্যা সূচক মাথা নাড়ালেন রোকেয়া।বললেন,
— ঠিকই বলেছো মা। মেয়েটাকে এবার বিয়ে দিতেই হবে, ওর বিয়েটা হলে আমাদের ও দুঃখের অবসান।
* ভোরবেলা তৈরি হয়ে ঘর থেকে বেড়িয়েছে ঈশানী। পরনে হাফসিল্ক চুড়িদার, গলায় কাতানের ওড়না, কাঁধে মাঝারি সাইজের টোট ব্যাগ, সর্বোপরি দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোথাও একটা যাচ্ছে সে, বেশ তোরজোর করে নেমেছে সিঁড়ি ভেঙে। বসার ঘরের কাছাকাছি আসতেই ডাকলো ওকে ঊষা,
— আপু খেতে আয়।
মা, নানী, এমনকি মামাও তখন ডাইনিং এ উপস্থিত, সবাই সকালের নাস্তার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তখন। ঈশানী আশেপাশে নজর দিলোনা খুব একটা,
— নারে সময় নেই, তোরা খেয়ে নে।
উর্ধ্বশ্বাসে জবাব দিলো শুধু । অতঃপর তাড়াহুড়ো করে পায়ে জুতো জোড়া চড়িয়ে পা বাড়ালো দরজার দিকে। তৎক্ষনাত পেছন থেকে ডাকলেন রোকেয়া। নিরেট গলায় শুধালেন,
— কোথায় যাচ্ছিস এতো সকালে?
থমকালো ঈশানী, ঘাড় ফিরিয়ে শান্তস্বরে জবাব দিলো,
— নিঝুমের খালামনির সাহায্যে একটা পার্ট টাইম চাকরির সুযোগ পেয়েছি, লাজ ফার্মায়। আপাতত ওখানেই যাচ্ছি।
— বেতন কত ধরেছে?
অসহনীয় প্রশ্ন, তবুও দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিলো ঈশানী,
— শুরুতে সাত হাজার। এছাড়া লাঞ্চের সুবিধা আছে।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন রোকেয়া, চোখের ইশারায় যাওয়ার অনুমতি দিয়ে বললেন,
— চাকরী যেহেতু পেয়েছো, আশা করি পরিবারের দিকটাও মাথায় রাখবে।
ঈশানী আর জবাব দিলো না, কোনোরূপ অভিব্যক্তি ছাড়াই নিঃশব্দে ত্যাগ করলো বসার ঘর।
প্রায় দু’মাস পরে……
অবশেষে হাতের আটপৌরে মোবাইলটাকে বিদায় জানিয়েছে ঈশানী। আগের কিছু জমানো টাকা আর দু’মাসের পরিশ্রমে অবশেষে একটা স্মার্ট ফোন হাতে এসেছে ওর । আর আজকেই প্রথম মোবাইলে ভিডিও কল দিয়েছে নিঝুম। কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে কথা বলতে বলতে কখন যে বাড়ি তে পৌঁছে গিয়েছে সে হদিস জানেনা ঈশু। শেষমেশ রুমে প্রবেশ করে কথার ঝুড়ির ইতিটানে দুই সখি। নিঝুমকে হাসিমুখে বিদায় জানিয়ে ফোনটা সাইডে রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় ঈশানী।
সারাদিনের পরিশ্রান্ত শরীরটাকে টেনে তোলা দায়, অথচ ফ্রেশ হওয়া জরুরি। ধুলোবালির মিশ্রনে গিজগিজ করছে সমস্ত শরীর, অগত্যা অলসতা না করে হেলেদুলে উঠে বসলো ঈশানী, হাত বাড়িয়ে দক্ষিণের জানালার কপাট গুলো লাগিয়ে দিলো সশব্দে, অতঃপর রুমে বসেই অলস হাতে টেনেটুনে খুলতে আরম্ভ করলো বাইরের পোশাক।
বোকা নীলাম্বরী শরীর থেকে জামাটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ঠাস করে ল্যাপটপের উইন্ডো নামিয়ে দিলো অন্য একজন।
— শীট! এটা কি ছিল?
প্রগাঢ় আঁধারের মাঝে কোনোকিছুর অস্তিত্ব নেই, কেবল ক্ষণে ক্ষণে বাতাসে ভেসে আসছে ভারী নিঃশ্বাসের তপ্ত আওয়াজ। হাসফাস লাগছে এরীশের,দৃঢ় হাতে টাইয়ের নটটা খানিক ঢিলে করে কাউচ চেয়ারে মাথা দিলো সে।দাঁতের সাহায্যে অধর কামড়ে ধরে চোখ বুঝে নিলো সবেগে, ভারী নিঃশ্বাসের তালে তালে ক্রমাগত ওঠানামা করছে তার পুরুষালি এ্যাডামস অ্যাপেল। হৃদয় থেকে শুরু করে মস্তিষ্কের প্রতিটি শিরা-উপশিরা ওই একটা দৃশ্যে আটকে আছে। ভেতর ভেতর অদম্য উদ্দীপনায় ক্রমশ থমকে যাচ্ছে হৃদযন্ত্র।
পৃথিবীটা বিরস রঙহীন। ফুটন্ত সাকুরা ছাড়া সবকিছু ফিকে। মস্তিষ্কে জড়ো হওয়া বেসামাল চিন্তা, আর হৃদয়ের নিষিদ্ধ বাসনায় ব্যতিগ্রস্ত হয়ে চট করে উঠে দাঁড়ায় এরীশ। একহাতে শার্টের বোতাম গুলো খুলতে খুলতে লাউঞ্জ ছাড়িয়ে পা বাড়ায় জিম রুমের দিকে। তখনই সার্ভার ফিরে আসে বিস্তার মনিটরে, বাংলাদেশী চ্যানেলে নিউজ চলছে, এরীশ বিরক্ত হাতে মনিটর টা বন্ধ করতে যাবে তখনই একটা ছোট্ট নাম শুনে স্তম্ভিত হয়ে পরে ওর এলোমেলো মস্তিষ্ক। নিউজের সাংবাদিকটা প্রবল আগ্রহ নিয়ে একাধারে বলে যাচ্ছিল,
আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২৭
— প্রায় এক বছর পরে অবশেষে আবারও দেশে ফিরতে চলেছেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত গ্লোবাল সুপারস্টার মাহিন বেনজামিন।
ব্যাস পরপরই সার্ভার চলে গেলো ফের। নামটা শোনা মাত্র কপাল কুঞ্চিত করে একাই বিড়বিড়ালো মাফিয়া বস,
— “মাহিন” নামটা কোথাও শুনেছি!