আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২৯

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২৯
suraiya rafa

কক্সবাজার,বাংলাদেশ,
কক্সবাজারের অন্যতম বিলাসবহুল পাঁচ তারকা রিসোর্ট রয়েল টিউলিপ। ইনানী বিচ সংলগ্ন রিসোর্টটির বেশিরভাগ কাস্টমারই হয়ে থাকে বিত্তশালী, ক্ষমতাবান কিংবা ফরেইনার । ফলস্বরূপ সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত সিবীচ থেকে শুরু করে মার্কেট, প্রসস্থ সুইমিংপুল, রেস্টুরেন্ট সবকিছুই এই রিসোর্টের সুবিধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ।
সন্ধ্যা হয়েছে অনেকক্ষণ। আকাশে উদ্ভাসিত গোধূলির শেষ লালিমা টুকু নৈর্সগ্যে মিলিয়ে গিয়ে এখন ঝলমলে নক্ষত্রের সুবিন্যস্ত বিচরণ।

শীতের বিদায় বেলাতেও ধূসর কুয়াশায় ঝাপসা চারিপাশ। পায়ের তলায় সুস্পষ্ট টলমলে শিশিরের মোলায়েম আদ্রতা, যেন প্রিয় মৌসুম যাবো যাবো করেও গা ছড়িয়েছে নিটোল হৃদ্যতায়।
রিসোর্ট এরিয়ার আশপাশটা বেশ নির্জন আর কোলাহল মুক্ত। টুরিস্ট স্পট হলেও ভিআইপি ব্যাতিত জনসাধারণের আনাগোনা নজরে পরে না খুব একটা, কারণ জায়গাটা রেস্ট্রিকটেড। ভিআইপিদের যথাযথ সুব্যবস্থা দিতে মসৃণ রাস্তার দু’ধারে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু কনভিনিয়েন্স স্টোর। একচ্ছত্র নিরিবিলি কনভিনিয়েন্স স্টোর গুলো সন্ধ্যারাতে কাস্টমারে পরিপূর্ণ। সেখান থেকেই মাত্র কিছু কেনাকাটা সেরে বেরিয়েছে ঈশানী। শীতের রাতে নির্জন রাস্তায় রিকশার হদিস মেলা দুষ্কর। অগত্যা অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করলো না মেয়েটা। বাড়ি এখান থেকে বেশ দূরে, এখনই হাঁটা না ধরলে রাত হয়ে যাবে অনেক , সেই ভেবে কাঁধের জুতসই টোট ব্যাগ আর হাতের ভারী জিনিস গুলো নিয়ে ধীর কদমে বাড়ির পথে পা বাড়ালো ঈশানী।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ল্যাম্পপোস্টের ঝকঝকে আলোয় পরিস্কার দৃষ্টিসীমা, তাই হেঁটে যেতে বেগ পোহাতে হচ্ছে না মোটেই। সামনের দিকে হয়তো হলদে আলোর রোশনাই কমে যাবে ক্ষানিক, তখন ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে নেওয়া যাবে ক্ষণ। আঁধারের ভয়ে ঘাবরালো না ঈশানী, ভেতরে সাহস সঞ্চার করে এগোলো সবেগে। তখনই নীরবতা ছাঁপিয়ে অকস্মাৎ বেজে উঠলো মুঠো ফোন। ফোনের আওয়াজে অতর্কিতে কম্পিত হলো ভীতু মেয়েটার নাজুক হৃদপিণ্ড। কয়েক সেকেন্ড অক্ষিপুট বুঁজে নিজেকে সামলালো সে। সামান্য ফোনের আওয়াজে ওর এহেন হৃদকম্পন দেখে মনে হচ্ছে অযাচিত কোনো বেনামি আশঙ্কায় নিরন্তর বুদ হয়ে আছে মেয়েটা।
টোট ব্যাগের সাইড পকেটে আপন সুরের তরঙ্গোচ্ছ্বাসে ভাসছে যান্ত্রিক বস্তুটি। সময় অতিবাহিত করলো না ঈশানী, ন্যস্ত হাতে টেনেটুনে পকেট থেকে বের করে আনলো মোবাইল খানা। অতঃপর স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নাম্বারে একপল অবলোকন করে হাসিমুখে রিসিভ করলো সেটি ।কানে ধরার প্রয়োজন পরলো না, ভিডিও কল দিয়েছে নিঝুম। এপাশ থেকে কল রিসিভ করার পরপরই কথার জোয়ার ভেসে এলো অপর প্রান্ত থেকে।

— কিরে রাতের বেলায় রাস্তায় কি করছিস? এখনো বাসায় যাস নি কেন?
অধর প্রসারিত করে ফিচেল হাসলো ঈশানী, জবাব দিলো,
— কাজ শেষে কিছু কেনাকাটা ছিল, তারউপর রাস্তায় রিকশাও নেই।
বোধগম্য সুরে ফের প্রশ্ন ছুঁড়লো নিঝুম,
— কি বলিস! লাজ ফার্মা থেকে তোদের বাড়ি এতদূর?
মেয়েটার ভবঘুরে স্বভাব আর গেলোনা, দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ঈশানী। বললো,
— গত সপ্তাহে যে বললাম লাজ ফার্মার চাকরিটা আরও দু’মাস আগে ছেড়েছি সেটা ভুলে গেলি?
নিজের মাথায় চাটি মা’রে নিঝুম, ভোলাভুলির স্বভাব ওর বহুদিনের। পুনরায় প্রশ্ন করার ফুরসত না দিয়ে নিজেই বলতে আরম্ভ করে ঈশানী,

— এখন একটা বুটিক হাউজে আছি, স্যালারি ও ভালো । বার্মিজ মার্কেট, বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে তবে প্রাইভেট এরিয়া হওয়াতে ঝামেলা মুক্ত।
নির্লিপ্তে মাথা দোলালো নিঝুম। মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওর মনটা খুব বেশি ভালো নেই। ফলস্রুতিতে আগ বাড়িয়ে শুধালো ঈশানী,
— তোকে আজ এতো আনমনা লাগছে কেন বলতো? কিছু হয়েছে?
স্টাডি টেবিলের এককোণে স্থবির দাঁড়িয়ে থাকা টেবিল ল্যাম্পের সুইচটাকে অন-অফ করতে করতে বিষণ্ণ স্বরে বিড়বিড়ালো নিঝুম,
— আমি একজন কে খুঁজছি রে ঈশু। কিন্তু পাচ্ছি না। তাঁকে খুঁজে পাবার প্রয়াসে কতগুলো বিকেল সি আর বি তে বসে রইলাম। বিনা ফুরসতে কাটিয়ে দিলাম ঘন্টার পর ঘন্টা, কিন্তু তার দেখা আর পেলাম না।
— তুই ঠিক কার কথা বলছিস বলতো?
ভাবনার সুতো ছিঁড়ে যায় নিঝুমের। চকিতে মোবাইল স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে না সূচক মাথা নাড়ায় নীরবে। কথার ঘোরানোর পায়তারা করে বলে,

— তোর হাতে ওগুলো কি বলতো? দেখেতো মনে হচ্ছে বেশ ভারী।
সম্মতি জানালো ঈশানী, তপ্তশ্বাস ছেড়ে বললো,
— এগুলো সিকিউরিটি ক্যামেরা। বাড়িতে গিয়ে রুমে লাগাবো। দু-একটা নিজের সাথেও রাখবো।
ঈশানীর কথায় ভ্রু কুঁচকে গেলো নিঝুমের। সবটুকু মনোযোগ স্থির হলো মোবাইল স্ক্রিনে,চটজলদি কৌতূহলী স্বরে বলে উঠলো,
— সিকিউরিটি ক্যামেরা মানে? হুট করে গোয়েন্দাগিরি শুরু করলি নাকি ঈশু?
বাক্য শেষে অট্টহাসিতে ফেটে পরলো নিঝুম। মূহুর্তেই ভ্যানিস হলো ওর হৃদয়ের উৎপীড়ন। কিন্তু ঈশানী? বিমূর্ত তার ফ্যাকাসে মুখাবয়ব।
— আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, কেউ আমাকে সারাক্ষণ স্টক করে নিঝুম। শুধু রাস্তাঘাট কিংবা মোবাইল ফোনে নয়, এমনকি বাড়িতেও।
ঈশানীর কথায় স্তব্ধ হয়ে গেলো নিঝুম। মূহুর্তেই উবে গেলো খিলখিল হাসির ঝঙ্কার।মলিনতা গ্রাস করলো সমগ্র মুখমণ্ডল। তৎক্ষনাৎ আশ্চর্য কন্ঠে বলে উঠলো ,

— মানে!
এপাশ থেকে গভীর দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো ঈশানীর নিগূঢ় চিত্ত চিঁড়ে। চিন্তিত স্বরে বললো,
— জানিনা, গত দু’মাস ধরে আমাকে কেন্দ্র করে আশেপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো প্রচন্ড উদ্বেগ দিচ্ছে মস্তিষ্কে । যেন সবকিছু একই সূত্রে গাঁথা। তারউপর ওই রেসট্রিক্টটেড নাম্বারটা…
— কি হয়েছে গত দু’মাসে?
কথা বলতে বলতে কখন যে ইনানীর সড়ক ছাড়িয়ে মহল্লার সরু গলিতে পা বাড়িয়েছে খেয়াল নেই ঈশুর। এই রাস্তায় ল্যাম্পপোস্ট গুলো নষ্ট পরে আছে, আলোর দিশা নেই। সহসা ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফের নিঝুমের কথায় মনোযোগ স্থির করে ঈশানী । নানান জটিলতায় একাগ্র প্রশ্নবিদ্ধ মেয়েটা কথার মাঝেই ধীরে ধীরে ডুবে যায় ভাবনার অতলে,

লাজ ফার্মায় যুক্ত হওয়ার পরে বেশ কয়েকদিন ভালোই গিয়েছিল। ঈশানী যতটা অনুমান করেছিল ততটাও কঠিন ছিল না কাজটা। ম্যানেজার থেকে শুরু করে অন্যান্য স্টাফরাও ছিল বেশ বন্ধুসুলভ আর দ্বায়িত্বশীল। অন্তর্মুখী স্বভাবের ঈশানী তখনও সহজ হয়ে উঠতে পারেনি সকলের সঙ্গে, তবে কাজটাকে আঁকড়ে ধরেছিল নিজের সবটুকু পরিশ্রম দিয়ে। কিন্তু চাকরির প্রায় সপ্তাহ খানিকের মাথায় এক অনাকাঙ্ক্ষিত সত্যের সম্মুখীন হতে হয় ঈশুকে।
লাঞ্চ টাইম চলছিল তখন, যে যার মতো খাওয়া দাওয়ায় ব্যস্ত সবাই। সকলের সাথে সেভাবে বোঝাপড়া হয়ে ওঠেনি বলে স্টোরের এককোণে বসে নিরিবিলি মধ্যহ্নভোজ সারছিল ঈশানী। ঠিক এমন সময় ভারী ভারী ওষুধ ভর্তি স্কয়ার বক্স আর কার্ড বোর্ডের আড়াল থেকে ভেসে আসা ক্ষীণ ক্রন্দনের আওয়াজে কর্ণ সচল হয়ে ওঠে ঈশানীর। প্রথমে মতিভ্রম ভেবে এরিয়ে গেলেও পরপর কয়েকদফা ক্ষীণ আর্তনাদে সচকিত হয়ে ওঠে ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রীয়।সহসা খাবার নিয়ে বসে রইলো না ঈশানী, তাড়াহুড়ো করে উঠে সরু কদমে এগিয়ে গেলো জিনিসপত্র ভর্তি অন্ধকার স্টোর রুমের অভিমুখে।

কয়েক দফ কার্ডবোর্ডের আঁকাবাঁকা স্তূপ পেরিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত এক দৃশ্যপটের সাক্ষী হয়ে থমকালো ঈশু। দেখলো ওর থেকে কয়েক হাত দূরে সকলের দৃষ্টির আড়ালে ভালো মানুষ সেজে থাকা শপের ম্যানেজারের পশুসুলভ আচরণ। সেই তখন থেকে বিশ্রী ভাবে গালি গালাজ করছে একটা ফিমেইল স্টাফ কে। শাসানোর নাম করে বারবার দৃঢ় হাতে স্পর্শ করছে মেয়েটার নাজুক শরীরের বিভিন্ন স্থান । কাজের দোহাই দিয়ে আজেবাজে কথা বলার পাশাপাশি চোখের লোলুপ দৃষ্টি দিয়ে যেন গিলে খাচ্ছে মেয়েটাকে। নাম মুনিয়া, বয়সে ঈশানীর থেকে ছোটই হবে। অহেতুক নোংরা হাতের স্পর্শে ক্রমাগত কুঁকড়ে যাচ্ছে মেয়েটা, নিঃশব্দে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে অশ্রুজল বিসর্জন দিচ্ছে অবিরত।
— সুইট ডেমোন!
দাঁতে দাঁত পিষে বিড়বিড়ালো ঈশানী।চোখের সামনে এহেন দৃশ্য অবলোকন করে,মূহুর্তেই ক্রোধান্বিত হয়ে ওঠে ওর ভেতরের আগ্রাসী সত্তা,ফলস্বরূপ জোর পদধ্বনিতে এগিয়ে গিয়ে এক ঝটকায় মুনিয়ার শরীর থেকে লোকটার হাত সরিয়ে দিলো র’ক্তিম চেহারার নীলাম্বরি। আচানক কান্ডে হতচকিত হলো লোকটা,তরিৎ বেগে ঘাড় ঘুরিয়ে ধমকে উঠলো ঈশানীকে,

— সাহস তো কম নয় তোমার! আমার কাজে বাঁধা দিচ্ছো?
— মেয়েদের ফিজিক্যালি এ্যাভিউস করাটা বুঝি আপনার কাজ?
জ্বলন্ত নীল চোখে দাউদাউ করছে ক্ষুব্ধতা। মুখশ্রী জুড়ে অকৃত্রিম লাবন্যতার দ্যুতি, চেহারায় ভয়ের লেশমাত্র নেই। ঈশানীর এমন গায়ে পরা প্রতিবাদ দেখে খেঁকিয়ে উঠলো লোকটা,কন্ঠে একরাশ বিরক্তি ধরে রেখে বললো,
— ভুল করেছে তাই শোধরানোর জন্য শাসন করছি, বেশি ফটরফটর না করে যাও তো কাজে যাও।
নির্দ্বিধায় মুনিয়ার হাত চেপে ধরে ঈশানী,কঠোর স্বরে বলে,
— আমি তো যাবোই, সাথে মুনিয়া ও যাবে।
তৎক্ষনাৎ মুনিয়ার অত্যহাতের কব্জিটা শক্ত করে টেনে ধরে ম্যানেজার। ঈশানীর চোখের কাঠিন্যতা পরখ করে অত্যন্ত রূঢ়স্বরে বলে,

— আমার অনুমতি ছাড়া এক পা ও এগোবে না মুনিয়া। চাকরি হারানোর ভয় থাকলে এক্ষুনি কাজে যাও।
— দেখে কি মনে হয়? ভয় পাচ্ছি আদৌও ?
একবলে ছক্কা হাঁকালো ঈশানী, লোকটার লোলুপ দৃষ্টিপানে আঙুলের ইশারা করে বিদ্রুপাত্তক স্বরে বললো,
— আপনার এই নোংরা চেহারাটা সবার সামনে আসা উচিৎ।
কথাশেষ করে মুনিয়াকে আস্বস্ত করলো ঈশানী, পৃষ্ঠদেশে সম্মোহনী হাত বুলিয়ে বললো,
— মুনিয়া চলো।
এগোলো না মুনিয়া। উল্টো কুণ্ঠিত দৃষ্টি ফেলে আড়ষ্ট হয়ে চেয়ে রইলো ম্যানেজারের পানে।
— কি হলো তুমি কি ভয় পাচ্ছো?
এবারও ঈশানীর কথার কোনোরূপ প্রত্যুত্তর করলো না মেয়েটা। বিনাবাক্যে মাথা নমিত করে রাখলো চুপচাপ। মুনিয়ার এই নিশ্চুপতা ম্যানেজারের জন্য ছিল ঈশানীকে পরাস্ত করার মোক্ষম হাতিয়ার। আর সঙ্গে সঙ্গে সেটাই প্রয়োগ করলো লোকটা, এগিয়ে এসে মুনিয়ার হাতটা এক ঝটকায় ছাড়িয়ে অত্যন্ত বিশ্রী ভাষায় ধরাশায়ী করতে উঠেপড়ে লাগলো সে,

— ফাউল মেয়েছেলে! বেশি লায়েকগিরি দেখাচ্ছো এখানে? আমার স্টাফদের আমারই পেছনে লাগিয়ে প্রতিবাদ শেখানো হচ্ছে? এমন ভাবে সর্বনাশ করে ভাইরাল করবো না,যে সারাজীবনের মতো প্রতিবাদ করার শখ ঘুচে যাবে।
— তার মানে মুনিয়াকেও এই একই ভয় দেখিয়েছেন?
দু’হাত মুঠিবদ্ধ করে শক্ত কন্ঠে বলে ওঠে ঈশানী। ওর জুতসই কথায় হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পরে লোকটা, মেজাজের খেই হারিয়ে আ’ক্রমনাত্তক স্বভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটে তৎক্ষনাৎ। ঈশানী কিছু বুঝে ওঠার আগেই শক্ত থাবায় ওর চুল টেনে ধরে লোকটা। রেশমের মতো মোলায়েম চুলগুলো খামচে ধরে রাগে গজরাতে গজরাতে বলে ওঠে,
— বড্ড বেশি কথা বলিস মা**। তোর ও ভিডিও করবো এবার।
একা এতোটা দুঃসাহস দেখানোর অনুশোচনায় ভেতর ভেতর শিউরে ওঠে ঈশানী। রাশিয়াতে কাটিয়ে আসা ওই নৃ’শংস কালো দিনগুলো মূহুর্তেই হানা দেয় মস্তিষ্কে। মনের শঙ্কায় আড়ষ্ট হয়ে গতি হারায় আত্নবিশ্বাস। ভেতর ভেতর যাই হয়ে যাক না কেন দমে যায় না সে, হাতের কাছে কুড়িয়ে পাওয়া কার্ডবোর্ড দিয়ে আচমকা আঘাত করে বসে লোকটার মুখ বরাবর। নমনীয় কার্ডবোর্ডের আঘাতে টললো না ম্যানেজার,বরং দিগুণ ক্রোধে ওকে ছুড়ে মা’রলো স্তূপাকৃতির ওষুধের বক্স গুলোর উপর। মূহুর্তেই ঝনঝন করে ভেঙে গেলো সব। কাঁচের শিশি গুলোর ধারালো আ’ঘাতে পিঠ থেকে শুরু করে হাতের তালু অবধি ছিঁড়েফেড়ে একাকার। সঙ্গে সঙ্গে অতর্কিত যন্ত্রনায় দিশেহারা হয়ে চোখ খিঁচে ব্যথাতুর আর্তনাদ করে ওঠে ঈশানী,

— আহহহ!
ওর নিগূঢ় আর্তনাদের তোড়ে মনেমনে পৈশাচিক আনন্দ লাভ করলো লোকটা,ফলস্বরূপ একই কাজের পুনরাবৃত্তি করলো ফের। পরপর দু’বার একই ভাবে আ’ঘাত প্রাপ্ত হওয়ায়, ব্যথায় নীল হয়ে উঠলো রমনীর সমগ্র মুখমণ্ডল। কয়েক মিনিটের মাথায় র’ক্তিম স্যাতেস্যাতে বর্ণ ধারণ করলো অফহোয়াইট কুর্তিটা। হাতের মাঝে বিঁধে আছে স্বচ্ছ কাচের টুকরো, প্রবাহমান র’ক্তের স্রোতে ভরে উঠছে সমগ্র মেঝে। সেদিকে চেয়ে প্রবল যাতনায় হাসফাস করে ওঠে ঈশানী।
ওদিকে সুযোগ পেয়ে মুনিয়া দৌড়ে গেলো আউট লেটে। কাহিনি বিশ্লেষণ করার কোনোরূপ পায়তারা না করে হাঁপাতে হাঁপাতে ডেকে নিয়ে এলো সব স্টাফদের। হতচকিত মুনিয়াকে দেখে স্টাফদের পাশাপাশি কয়েকজন কাস্টমার ও উদভ্রান্ত হয়ে ছুটে গেলো ভেতরে। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল, অনেকেই….
সেদিনের মতো ঘটনার ইতি এখানেই ঘটে। কথার এই পর্যায়ে রাগে রণচণ্ডী ধারণ করে নিঝুম। ফুটন্ত তেলের মতো চিড়বিড়িয়ে উঠে বলে,

— কি বলিস! পুলিশ আসেনি? কোমরে দড়ি বেঁধে চোরের মতো পে’টানো উচিৎ ছিল শালা কে। আমি হলে ওর পুরো গোষ্ঠীকে জেলের ভাত খায়িয়ে ছাড়তাম।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ঈশানী, শীতল কণ্ঠে জবাব দেয়,
— পুলিশ এসেছিল। তবে সেদিন নয় তার পরের দিন ম্যানেজারের লা’শ নিতে।
—কিহ!
হকচকালো নিঝুম। তড়িঘড়ি করে টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাস নিয়ে এক নিঃশ্বাসে শেষ করলো পুরোটা। পরক্ষণেই কৌতুহলী স্বরে শুধালো,

— কিভাবে হলো এটা? কে মা’রলো ম্যানেজার কে?
— জানিনা। এটাই সবচেয়ে বড় মিস্ট্রি।
কথায় কথায় আবারও দু’মাস আগের অতীতে ফিরে গেলো ঈশানী।
সেদিন ক্লিনিক থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে স্টাফদের সাহায্যে বাড়ি পৌঁছায় ঈশানী। মনেমনে সিদ্ধান্ত নেয় লাজ ফার্মাতে আর চাকরি করবে না ও। যার দরুন সাত কর্মদিবসের পারিশ্রমিক আর নিজের জিনিস পত্রগুলো ফিরিয়ে আনার প্রয়াসে পরের দিন অসুস্থ শরীর নিয়ে আবারও শপে উপস্থিত হয় ঈশানী।
তবে সেখানে গিয়ে যেই আকস্মিক মর্মান্তিক ঘটনার মুখোমুখি হয়, তা এ জীবনে ভুলতে পারবে না ও। চোখের সামনে দুলে ওঠে পুরো দুনিয়া। হতবিহ্বল চিত্তে আহাম্মকের মতো হা করে চেয়ে থাকে একরাতের ব্যাবধানে ধ্বং’সস্তূপে পরিনত হওয়া লাজ ফার্মার দিকে। আশেপাশের সব দোকান ঠিকঠাক শুধু লাজ ফার্মা উধাও। দেখে মনে হচ্ছে ভারী বস্তু তোলার যন্ত্রের সাহায্যে কেউ গুড়িয়ে দিয়েছে শপটাকে। কিন্তু কে? ভেতরের কৌতূহল দমাতে পারলো না ঈশানী, ভারী কদম ফেলে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো কিছুটা সামনে।

মার্কেটের অধিকাংশ মানুষই এখানে উপস্থিত, সংকুচিত বদনে ঈশানীও গিয়ে দাঁড়ালো এক কোণে। তখনই কর্ণগোচর হলো কোনো এক অজ্ঞাত মেয়ে মানুষের হৃদয় বিদারক হাহাকার। এহেন কান্নার আওয়াজে সমস্ত শরীর তিরতিরিয়ে কেঁপে ওঠে ঈশানীর। নিগূঢ় যন্ত্রণায় হু হু করছে অন্তঃকরণ। মনেমনে ভাবতে থাকে,
— ওদিকে কি এমন হয়েছে? এমন করে কেন কাঁদছে ওই মহিলা?
ঈশানীর ভাবনার মাঝেই রেসট্রিক্টটেড বেষ্টনী ভেদ করে একে একে বাইরে বেড়িয়ে আসে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সাদা পোশাক ধারী টীম। শুধু তারা ই নয় সঙ্গে ছিল সাদা কাপড়ে আচ্ছাদিত একটা লা’শের কফিন।
কিছুটা ভীতিগ্রস্ত হয়ে ঈশানী এগিয়ে গেলো লাশটার সম্মুখে। সাতপাঁচ না ভেবে একহাতে টেনে সরালো কাপড়টাকে। কাপড় সরানোর সঙ্গে সঙ্গে বিদঘুটে এক নৃ:শংস চেহারা দৃষ্টিগত হতেই অন্তরাত্মা ধড়ফড় করে ওঠে ওর। মাত্রাতিরিক্ত আতঙ্কে বিভীষিকার ন্যায় খামচে ওঠে ওর দূর্বল চিত্ত। কয়েক মূহুর্ত, মাত্র কয়েক মূহুর্তের মাঝে গরগর করে বমি করে চারিদিক ভাসিয়ে দিলো ঈশানী। ওর এহেন কান্ডে তাড়াহুড়ো করে লা’শ গাড়িতে তুললো পুলিশ। আশপাশ থেকে মানুষজন বলাবলি করছিল,

— বমি করবেনা! কি হাল করেছে লা’শটার দেখেছো? মানুষের আকৃতিটুকুও অবশিষ্ট নেই আর। পুলিশ বললো মৃ’ত্যুর পরেও ওষুধের ভাঙা শিশি দিয়ে ইচ্ছেমতো কে’টে ছিঁড়ে একাকার করা হয়েছে শরীরটাকে । চামড়া তো নেই ই, তারউপর চোখ, দাঁত,কান এমনকি না’ড়িভুড়ির পর্যন্ত অস্তিত্ব নেই। সবকিছু টুকরো টুকরো করে ফেলেছে। তারচেয়েও বড় কথা এতো এতো মা”রণাস্ত্র বাদ দিয়ে, শুধুমাত্র ওষুধের শিশির সাহায্যে এমনভাবে হ’ত্যাকাণ্ডের পেছনে কারণটা কি ? ঠিক কোন ধরনের শত্রুতা হলে ওষুধের শিশি দিয়ে এভাবে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাটতে পারে অন্য একজন মানুষ?
এমন নৃ’শংস খু’নের বর্ণনা শুনে আতঙ্কিত সকলে। চোখে মুখে ভীষণ উদ্বিগ্নতার ছাঁপ। আপাতত সকলের দৃষ্টি পুলিশের বিবৃতির পানে নিবদ্ধ। ঠিক এমন সময় অযাচিত সেই ক্রন্দনরত মহিলার আওয়াজ ভেসে এলো ফের।
— এই মেয়েটা, এই মেয়েটার সঙ্গেই গতকাল ঝামেলা হয়েছিল আমার স্বামীর। আর আজ তার এমন নৃ’শংস মৃ’ত্যু, সব দোষ ওর । ওই মে’রছে আমার স্বামীকে। ও কোনো সাধারণ মেয়ে নয়, ও একটা সাইকো। খু/নি ও খু/নি।
বিস্মিত হলো সকলে। জনসাধারণের সবটুকু মনোযোগ মূহুর্তেই স্থির হলো ঈশানীর পানে। সবার সন্দিহান চাহনিতে শঙ্কিত হয়ে কুণ্ঠায় মিয়িয়ে গেলো ভীত মেয়েটা। শুষ্ক একটা ঢোক গিলে অপরাধীর ন্যায় নুয়িয়ে ফেললো আপন মাথা।
ম্যানেজারের স্ত্রী আগ্রাসী হয়ে আরও কিছু বলতে যাবে, তার আগেই কঠোর আওয়াজে মহিলাকে থামিয়ে দিলো মুনিয়া, সবার মাঝ থেকে বলে উঠলো,

— কাকে দোষ দিচ্ছেন আপনি? কাল আপনার স্বামী ঈশানীপুর সঙ্গে ঠিক কি কি করেছে আদৌও ধারণা আছে আপনার? মেয়েটা না থাকলে মানসম্মান হারানোর লাঞ্ছনায় কাল হয়তো আ’ত্মহ’ত্ত্যা করে জীবন খোয়াতে হতো আমায়। আর আপনি বলছেন আপনার স্বামীর সঙ্গে ঈশানীপুর ঝামেলা? শুনুন ,কাল আপনার স্বামী, না শুধু কাল নয় গত একটা বছর ধরে আপনার স্বামী ফিমেইল স্টাফদের সাথে যা যা করেছে, তাতে মৃ’ত্যুর মতোই কঠোর শা’স্তি হওয়া উচিৎ ছিল তার। কিন্তু আপসোস আইনের হাতে শাস্তি ভোগ করার আগেই পটল তুলেছে সে। তাই ভুক্তভোগীদের দোষারোপ করা বন্ধ করুন, নয়তো কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেড়িয়ে আসবে। আর কি যেন বললেন , ঈশানীপু আপনার স্বামীকে মে’রেছে তাইতো? যদি তেমন কিছুই হতো তাহলে সারারাত হ’ত্যায’জ্ঞ চালিয়ে সকাল সকাল নিশ্চয়ই চেহারা দেখাতে আবার শপে আসতো না সে। তাছাড়া গতকাল আপনার স্বামী যেভাবে একের পর আ’ঘাত করেছে,তার পরেও এতো শক্তি কোথায় বলুন?
মুনিয়ার সঙ্গে একে একে সায় জানালো সকলে।দমে গেলো ম্যানেজারের স্ত্রী। তর্ক থামিয়ে ফের শুরু করে দিলো স্বামীর নাম করে অজস্র বিলাপ।

সকলের মতামত আর বক্তব্য শুনে অনুসন্ধানের অজুহাত দিয়ে সেদিনের মতো চলে গেলো গোয়েন্দা পুলিশ। অসহনীয় দুশ্চিন্তা আর ভয়াবহ স্মৃতিকে পাছে ফেলে অবশেষে বাড়ি ফিরলো ঈশানী।
তবে শেষ আশ্রয়স্থলে ফিরেও শান্তি মিললো না ওর। সদর দরজা ডিঙিয়ে বসার ঘরে পা রাখতে না রাখতেই নজরে এলো পরিবারের সচকিত আলোচনা। মামা আর মা কোনো একটা ছবি নিয়ে নিগূঢ় আলোচনায় মত্ত। তাদের বিস্তৃত সংলাপ শুনে মনে হলো কারোর বিয়ের আলোচনা চলছে। ঈশানীর ইচ্ছে হলোনা সেদিকে কান দিতে, সহসা এলোমেলো পা ফেলে এগুতে লাগলো সিঁড়ির পানে, তবে ওঠার ফুরসত পেলোনা আর, তার আগেই পিছু ডাকলেন মামা। অপ্রস্তুত হলো ঈশানী, না চাইতেও জোরপূর্বক হেসে এগিয়ে গেলো বসার ঘরে। ঈশানী এগিয়ে এলে ওর মুখের সামনে একটা ছবি বাড়িয়ে দিলো রোকেয়া প্রাচী, আবেগহীন স্বরে বললো,
— বিয়ের কথা চলছে, মেয়ে তাদের পছন্দ হয়েছে। খুব শীঘ্রই হয়তো দিন তারিখ ঠিক হবে।
— কার কথা বলছো মা?
কৌতুহলী শোনালো ঈশানীর কণ্ঠস্বর। আহত শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর, তবে কেন যেন মনে হচ্ছে খুব শীঘ্রই ওর হৃদয়টাও দূরুহ বেদনায় আহত হতে চলেছে ।
— কার আবার? এই বাড়িতে বিবাহ উপযুক্ত মেয়ে কে? অবশ্যই তুই।
ঈশানী যা সন্দেহ করেছিল তাই, মূহুর্তেই ভগ্ন হৃদয়টা বেদনার অভিলাষে গুড়িয়ে গেলো যেন।

— মা!
আহত স্বরে শব্দটা উচ্চারণ করে স্তম্ভিত পায়ে দাঁড়িয়ে রইলো ঈশু। যেন বাঁক শক্তি হামেশাই লোপ পেয়েছে ওর। রোকেয়া প্রাচীর ভাবাবেগ পরিবর্তিত হলোনা তাতে। বরাবরের মতোই কঠোর তার অভিব্যক্তি। মা মেয়ের নীরব দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করে উঠে দাঁড়ালেন মামা, ভাগ্নির মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে শান্ত স্বরে বোঝালেন,
— মায়ের দিকটা বুঝবি না মা? তোর মা একা মানুষ আর কতদিক সামলাবে বলতো ? তুই আর ঊষা হলি ওর দ্বায়িত্ব, দ্বায়িত্বের অবহেলা কি চলে কখনো ? তাছাড়া বাড়ির বড় মেয়ে হিসেবে পরিবারের প্রতি তোর ও তো কিছু দ্বায়িত্ব রয়েছে তাইনা? তাই বলছি বিয়েটা হলে সবার মঙ্গল, রাজি হয়ে যা মা। মামুর অনুরোধ টা রাখ এবার।
বাকরুদ্ধ ঈশানী। পেলব কপোল বেয়ে অহর্নিশ গড়িয়ে পরছে অভিমানী নোনাজল। মামার কথার যথাযথ উত্তর খুঁজে না পেয়ে মেয়েটা অসহায়ের মতো জড়ানো গলায় বলে উঠলো ,

— আমাকে কি দু’দণ্ড শান্তিতে থাকতে দেওয়া যায়না মামু? একদম একাকী নিজের মতো। এটা কি খুব বেশি চাওয়া?
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন মামা। রোকেয়া রেগেমেগে অস্থির হলেও ব্যতিগ্রস্ত হলেন না তিনি। দিগুণ ধৈর্য নিয়ে মেয়েটাকে আদুরে স্বরে বোঝালেন,
— তোকে তো আর আমরা পানিতে ছুঁড়ে ফেলছি না মা। বরং একটা সুন্দর সাজানো জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। ছেলেটা বেশ ভালো,পয়সা কড়ির অভাব নেই। কক্সবাজারে বেশ কয়েকটি মোটেল রয়েছে। বয়স তোর চেয়ে খানিকটা বেশি, তবে দেখতে সুদর্শন। খানদানি পরিবার, বিয়েটা হলে তোকে সহ তোদের পুরো পরিবারকে সারা জীবন পায়ের উপর পা তুলে খাওয়ানোর সামর্থ্য আছে। ওদের সঙ্গে আত্নীয়তা আমাদের ভাগ্যের ব্যাপার মা। এখন তুই রাজি হলেই সব ঠিকঠাক।
মামার কথায় থমকালো ঈশানী,গভীর মনে ভাবলো,

—এই তাহলে কাহিনী! ছেলে বড়লোক মানে এরা আমাকে বিয়ে দিয়েই ছাড়বে।
বুক চিঁড়ে বেড়িয়ে এলো আহত দীর্ঘশ্বাস। পরমূহুর্তেই ছোট্ট করে জানালো,
— আমার কিছু বলার নেই।
কথাশেষ করে দাঁড়ালো না আর, থমথমে পায়ে প্রস্থান করলো বসার ঘর। ঈশুর যাওয়ার পানে চেয়ে ফের গলা উঁচিয়ে শুধালেন মামু,
— ধরে নিলাম হ্যা।
যেতে যেতে নৈঃশব্দে উপহাস করে হাসলো ঈশানী, মনেমনে আওড়ালো,
— যেন আমার সম্মতি দিয়ে আদৌও কিছু যায় আসে।

— তারপর বিয়েটা ভাঙলো কি করে?
কথার এ পর্যায়ে এসে ঈশানীকে থামিয়ে দিয়ে সবেগে প্রশ্ন ছুড়লো নিঝুম।
বাড়ির কাছাকাছি ল্যাম্পপোস্টটা নিয়ন আলো ছড়াচ্ছে, মানুষ জনের আনাগোনা নগন্য।অথচ স্ট্রিট লাইটের নিচের বেঞ্চিটাতে হঠাৎ মনে হলো কেউ বসা। আনমনা চাহনি গায়েব হলো ঈশুর। সচকিত হয়ে ছোট ছোট চোখ করে সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুড়লো একপল।
—কই না কেউ নেই। ইদানীং একটু বেশিই ভাবি আমি ধুর।
— কি হলো বলনা, বিয়েটা ভাঙলো কি করে?
ফের নিঝুমের কথায় কর্ণপাত করে ঈশানী। জানায়,
— বিয়ে ভাঙেনি তো। বিয়ের আগের রাতে ছেলের পুরো বাড়ি সহ জ্বালিয়ে দিয়েছে কেউ।
চোখ কপালে উঠে গেলো নিঝুমের,ভয়াতুর স্বরে শুধালো ,

— কি বলিস! ঠিক আছে তো ওনারা?
— উহু, কেউ বাঁচেনি। এক রাতের ব্যবধানে পুরো পরিবার জ্বলেপু’ড়ে ছাঁই য়ে রূপান্তরিত হয়েছে।
কলিজার পানি শুকিয়ে কাঠ। এসব কি হচ্ছে বলতো? পুলিশ কিছু করতে পারছে না? হাত গুটিয়ে কেন বসে আছে তারা?
— জানিনা, দু’টো ঘটনাই পুলিশের নিকট অমীমাংসিত, এমনকি আমার কাছেও পুরোটাই মিস্ট্রি । তবে একটা জিনিস ভালোই হয়েছে বুঝলি, অহরহ বিয়ের প্রস্তাব আসা বন্ধ হয়েছে একদম। সবাই মনে করে আমি অপয়া, সেই সঙ্গে আমার মা ও।
কথাশেষ করে ব্যথাতুর হাসলো ঈশু। কিয়ৎক্ষন ভেবে নিঝুম শুধালো,
— রেস্ট্রিকটেড কলের ব্যাপারে কিছু বলেছিলি।
ফোনের নোটিফিকেশন অপশনে নজর বুলিয়ে জবাব দিলো ঈশানী,
— আর বলিস না, প্রায়ই এরকম নাম্বার থেকে হুটহাট ম্যাসেজ আসে। আমি বুঝতে পারিনা নাম্বার গুলো এমন প্রাইভেট কেন? তারপর কি সব সিল্যি ম্যাসেজ, ধর সন্ধ্যা বেলায় ম্যাসেজ আসবে “গুড মর্নিং”।
ঈশানীর কথায় ফিক করে হেসে দিলো নিঝুম। বললো,

— হবে হয়তো এলাকার কোনো বখাটের আজাইরা কাজ, এসব নিয়ে এতো বেশি ভাবিস নাতো। বেশি ডিস্টার্ব করলে সীম পাল্টে ফেলিস।
নীরবে হ্যা সূচক মাথা দোলালো ঈশানী, চট করেই বললো,
— আজ শুধু আমার কথায়ই শুনে গেলি। তোর কথা কিছু বললি না যে?
উতকণ্ঠায় ঝুমঝুম করে ওঠে নিঝুম।ভীষণ আগ্রহ নিয়ে বলে,
— দেখেছিস আমি কতোটা বেখেয়ালি? যে কথাটা বলতে কল দিলাম এতোক্ষণে সেটাই বলা হলোনা।
— কি কথা তাড়াতাড়ি বল?
ঈশানীর কণ্ঠে উচ্ছ্বাসের জোয়ার। গড়িমসি না করে নিঝুম জানালো,
— খালা মনির বাড়িতে বেড়াতে আসছি। খুব শীঘ্রই তোর সঙ্গে দেখা হবে।
হাজারো দুশ্চিন্তার মাঝে এইটুকু শুনে খুশিতে দুলে উঠলো ঈশানীর বিষণ্ণ মন। পুলকিত বদনে জড়তা হীন বেসামাল কণ্ঠে বললো,

— সত্যি বলছিস? তাড়াতাড়ি আয় নিঝুম , আমাদের মার্কেটে বড় করে বসন্ত উৎসবের আয়োজন চলছে, তুই এলে দু’জনে একসঙ্গে শাড়ি পড়ে যাবো।
নীরব হাসিতে প্রসারিত হলো নিঝুমের পেলব ওষ্ঠাধর, ছোট্ট করে জানালো,
— আচ্ছা যাবো।
কথা বলতে বলতে অবশেষে বাড়ির গেটে প্রবেশ করে ঈশানী। মেয়েটা বাড়িতে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে আধারের মাঝ থেকে কুয়াশার বুক চিঁড়ে নিঃশব্দে বেড়িয়ে আসে কালো পোশাকধারী এক ঝাপসা অবয়ব । নীলাম্বরি যতদূর এগোয় ততোদূর অবধি গভীর দৃষ্টিতে পরখ করে সে। অতঃপর কানের এয়ারপড সচল করে গমগমে আওয়াজে কাউকে আস্বস্ত করে জানায়,
— শী ইজ টোটালি সেফ নাও ।

রুমে ফিরে সব কাজ বাদ দিয়ে আগে সিকিউরিটি ক্যামেরা গুলো ঠিকঠাক করতে ব্যস্ত হয়ে পরে ঈশানী। মনে মনে ভাবে,
— একজন ইলেক্ট্রিশিয়ান আনালে বোধ হয় বেশি ভালো হতো।
ওদিকে ঈশানীর এসব ছেলেমানুষী কর্মকাণ্ড গুলো একদৃষ্টে গভীর নয়নে পরখ করতে করতে রাশভারি আওয়াজে বিড়বিড়ালো অন্য একজন,
— তুমি আমাকে খোঁজার জন্য যে সিকিউরিটি ক্যামেরা লাগাচ্ছো, সেই সিকিউরিটি কোম্পানি ওউন করি আমি। হাউ সিল্যি সাকুরা।
একহাতে হুইস্কির গ্লাস আর অন্যহাতে পুরুষালি অভ্যাস বশত চিবুকে আঙুল বোলাতে বোলাতে নির্লিপ্তে ল্যাপটপ স্ক্রিনে দৃষ্টিপাত করে আছে এরীশ। আজকাল এটা ওর সকল ব্যস্ততার উর্ধ্বে। ঈশানী গন্তব্যে না থাকলে প্রিভিউ ভিডিও গুলো অযথাই টেনে টেনে দেখতে থাকে বারবার । আর যদি বাড়িতে থাকে তখন শত ব্যস্ততার মাঝেও কানে এয়ারপড লাগিয়ে হাতের অ্যাপেল ওয়াচের দিকে নজর রাখে সর্বক্ষণ। মিটিং , ডিল , মাফিয়া রিইউনিয়ন যেকোনো কিছুতেই এরীশের দৃষ্টি থাকে এ্যাপেল ওয়াচে নিবদ্ধ। আজকাল ঈশানীকে কোনোরূপ প্রাইভেসী দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করে না এরীশ। সেটা যে কোনো অপ্রীতিকর দৃশ্যই হোক না কেন,বিন্দু পরিমাণ দ্বিধাবোধ না করেই সবটা নিগূঢ় দর্শনে গ্রাস করে মাফিয়া বস। কোনো এক অযাচিত কারণে ও মনে করে এটা একান্তই ওর প্রাপ্য। আর যেটা এরীশের সেটার ভাগ ও পৃথিবীর কাউকে দেয়না, কাউকে না।

— সিকিউরিটি!
তখন থেকে একই শব্দ বলে যাচ্ছে এরীশ। ওর এই ভাবলেশহীন মুখাবয়ব দেখে কপাল বেঁকে গেলো তুষারের। সে পাইথন লিডারের উপর প্রচন্ত বিরক্ত হয়ে বললো,
— হ্যা সিকিউরিটি, তখন থেকে এটাই বলে যাচ্ছি আপনাকে।
তুষারের কর্কশ আওয়াজে সম্বিত ফিরে পায় এরীশ। গম্ভীর স্বরে বলে,
— আহ! আই হেইট নয়েজ। কি হয়েছে সিকিউরিটির?
— সেই কখন থেকে বলে যাচ্ছি, আমাদের বাংলাদেশী সিকিউরিটি কোম্পানির নতুন কিছু প্রোডাক্ট লঞ্জ হচ্ছে আগামী মাসে। মার্কেটিং এর জন্য একজন মডেল হায়ার করা হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল মডেল, তবে বাংলাদেশী বংশভূত। দেখতেও বেশ সুদর্শন, নাম মাহিন বেনজামিন। কিন্তু আপনি তো কানেই নিচ্ছেন না।
— কি বেনজামিন বললে?
— মাহিন বেনজামিন।
তৎক্ষনাৎ মনে পরে যায় এরীশের, এই নামটা, একজ্যাক্ট এই নামটাই ঈশানীর মুখে শুনেছিলো ও। সে কি প্রশংসা। এখনো মনে পরলে মস্তিষ্কে দাউদাউ করে আ’গুন ধরে যায় ওর।
— বায়োডাটা দেখি?
গম্ভীর স্বর ভেসে এলো বিপরীত প্রান্ত থেকে। তুষার বিস্মিত হলো। কৌতূহলী কণ্ঠে বলে উঠলো,
— মডেলের বায়োডাটা আপনি চেক করবেন ? কিন্তু আমি তো আইপ্যাড নিয়ে আসিনি।
— কোনো কাজই তো ঠিক মতো করোনা।
কুঁচকানো নয়নে কথাটা বলে, ফের ল্যাপটপে দৃষ্টিপাত করে এরীশ।
ওদিকে পাইথন লিডারের তিরস্কারে থতমত খেলো তুষার। সেই সঙ্গে আশ্চর্য হলো দিগুণ।
— আজকাল কোম্পানির মডেলের বায়োডাটা ও চেক করতে চাইছে, হঠাৎ এ কি হয়ে গেলো মাফিয়া বসের?
এক মনে বিড়বিড় করতে করতে লাউঞ্জ ত্যাগ করে তুষার। পরিশ্রান্ত কদমে এগিয়ে যায় নিজের রুমের দিকে।

নিজ রুমে এসে কোনোরূপ সময় নষ্ট না করে প্রসস্থ কাঁউচে গা এগিয়ে দিলো তুষার। চারিদিকের টানাপোড়েনে অবশ হয়ে আসছে চব্বিশ ঘণ্টা একাধারে দায়িত্বে অবিরত থাকা যান্ত্রিক শরীরটা। তবে নিঝুম নিস্তব্ধতা ভেদ করলো খুটখাট ক্ষীণ আওয়াজ, কর্ণ সচল হলো তুষারের, নিমেষে অক্ষিপুট খুলে চোখ বোলালো ঘরের চারিদিকে। দেখলো কাবার্ডের সম্মুখে দাড়িয়ে আছে রুশ কন্যা ফ্লোরা । সম্পূর্ণ মনোযোগ স্থির রেখে নির্লিপ্তে জামাকাপড় গোছাচ্ছে সে। চিরাচরিত ফিনফিনে ফ্রক আর এ্যাপ্রোনে মারাত্মক স্নিগ্ধ লাগছে তাকে। বাঁধন হারা সর্পিল কেশ জুড়ে খেলা করছে ঈষৎ র’ক্তিম আভা। শীর্ণকায় শরীরের প্রতিটি গঠন ধনুকের মতোই সুস্পষ্ট আর আকর্ষনীয়। পেলব মুখশ্রীতে অকৃত্রিম গোলাপি আভা, যেন গাছ থেকে পেরে আনা তরতাজা সুমিষ্ট পাঁকা ফল। তুষারের ভাবনার মাঝেই হাতের কাজ সম্পন্ন করে এদিকে ঘোরার জন্য উদ্যত হলো ফ্লোরা, তৎক্ষনাৎ বাঁধ সাধে তুষার, ঘোর আপত্তি জানিয়ে বলে,

— কিছুই হয়নি আবার গোছাও।
ভ্রু কুঁচকালো ফ্লোরা, এতোক্ষণ ধরে পরিশ্রম করে পুরো কাবার্ড গোছানোর পর বলছে কিছুই হয়নি। আজব মানুষ! কেন যেন কথা বাড়াতে ইচ্ছে হলোনা মোটেই , তাই তুষারের পানে বিরক্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফের কার্বাড গোছাতে আরম্ভ করলো মেয়েটা। পুনরায় ঘরজুড়ে নেমে এলো বিরস নিস্তব্ধতা। তুষার চেয়ে রইলো শুধু। দ্বিতীয়বারের মতো গোছানোর কাজ শেষ করে ওর দিকে চেয়ে গভীর কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো ফ্লোরা,
— এবার হয়েছে? না হলে নিজে করে নিন আমি আর পারবো না।
বেখেয়ালে কাবার্ডের দিকে একপল দৃষ্টিপাত করলো তুষার। অতঃপর ছোট্ট করে জানালো —ঠিক আছে।
ফ্লোরা চলেই যাচ্ছিল, তার আগেই পিছু ডাকে তুষার, তপ্তস্বরে জিজ্ঞেস করে,
— এতো অভিমান কেন তোমার? সেই কবে থেকে মুখ ফুলিয়ে আছো।
ঘাড় ফিরিয়ে প্রত্যুত্তর করলো ফ্লোরা,তাচ্ছিল্য করে হেসে বললো,
— আপনি হলেন রাশিয়ান গ্যাংস্টার। ম্যান পাওয়ার অব bratva। আপনার সঙ্গে অভিমান করার অধিকার কোথায় আমার?
অভিব্যক্তিহীন তুষার।প্রগাঢ় তমশায় ছেয়ে গিয়েছে ওর স্তব্ধ মুখমণ্ডল। চোখের মাঝে এক আকাশ বিষণ্ণতা ধরে রেখে জবাব দিলো শুধু,
— অথচ আমার মনে হয় তোমার যতটুকু আছে, তার নূন্যতম অংশটুকু ও পৃথিবীর অন্য কারোর নেই।
— কি বললেন বুঝিনি?
— বুঝতে হবেনা, এখন যেতে পারো।
রাগ হলো ফ্লোরার, একেতো সোজা কথা সোজা ভাবে বলেনা, তারউপর মুখের সামনে ঠাস করে বলে,” যেতে পারো”। আবারও ভেতর ভেতর অভিমানে হু হু করে ওঠে ওর নাজুক বক্ষপিঞ্জর। অথচ সামনাসামনি বিরক্তির স্বরে ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে,

— যাচ্ছি।
ফ্লোরা চলেই যাচ্ছিল, ফের পিছু ডাকে তুষার।নিরেট স্বরে বলে,
— লাইট টা অফ করে যেও।
আধুনিক সিস্টেম। মুখে বললেই অটোমেটিক অফ হয়ে যায় লাইট, তবুও অহেতুক ফ্লোরাকে পেরেশানি দেওয়ার কি মানে আছে জানা নেই ওর। অগত্যা বিরক্তবোধ করলো মেয়েটা, ধারালো স্বরে বললো,
— আমাকে এতো জ্বালাতন করেন কেন আপনি?
— কোনো কারণ নেই, স্রেফ অভ্যাস।
— বউকে গিয়ে করুন। সে এসব অভ্যাস সহ্য করুক, আমি পারবো না।
— আমি এই জীবনে বিয়ে করবো না, তাই বলে কি আমার অভ্যাস চালু রাখার জন্য কোনো মানুষ থাকবে না?এটা কি যৌক্তিক তুমিই বলো?

— থাকুন আপনি আপনার যুক্তি নিয়ে, আমি গেলাম।
তেঁতো স্বরে কথাগুলো বলে গটগটিয়ে বেড়িয়ে গেলো ফ্লোরা। ওদিকে ফ্লোরা চলে যেতেই আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কপালে বাহু ঠেকিয়ে নীরবে চোখ বুজলো তুষার। অতিবাহিত হলো খানিকক্ষণ। কয়েক মূহুর্ত বাদেই পা টিপে টিপে ফিরে এলো ফ্লোরা। ঘুমন্ত তুষারের গলা থেকে টাই টা ঢিলে করে দিলো সাবধানে, অতঃপর পা থেকে জুতো জোড়া খুলে, শরীরে চড়িয়ে দিলো উষ্ণ চাদর। যাওয়ার আগে লাইট টা অফ করে দিয়ে ব্যথাতুর আওয়াজে রিনরিনিয়ে বললো,

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২৮

— গুড নাইট।
ফ্লোরা চলে গেলে, অন্ধকারের মাঝে মৃদু হেসে নির্বিগ্নে ঠোঁট নাড়ালো তুষার। যার শাব্দিক অর্থ দ্বারায়,
— গুড নাইট ।
(I own the Security company, সংলাপটি হান্টিং এডলিন থেকে অনুপ্রানিত)

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩০