আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩০
suraiya rafa
— প্রায় বছর খানিক পরে আজ দেশে ফিরেছেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত গ্লোবাল সুপারস্টার মাহিন বেনজামিন। সামাজিক মাধ্যম গুলো থেকে জানা যায়, দেশীয় মানচিত্রের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজের কর্মদক্ষতা এবং সুখ্যাতি বিস্তারের প্রয়াসে গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে কানাডায় পারি জমিয়েছিলেন মাহিন। এবং সে কাজে বেশ সফল ও হয়েছেন তিনি। কুড়িয়েছেন দেশিবিদেশি একাধিক সম্মাননা, মডেল হয়ে হেটেছেন পৃথিবী বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের পোশাক প্রদর্শনীতে । আর তাইতো সব জল্পনা কল্পনার ইতি টেনে মডেলিং পেশাকে সামনে রেখেই বেশ কয়েকটি খ্যাতিমান কোম্পানির ব্র্যান্ড এম্বাসেডর হিসেবে নিযুক্ত হয়ে অবশেষে দেশে ফিরলেন মাহিন।
নিঃশ্বাস নেওয়ার ফুরসতটুকু নেই, টেপরেকর্ডারের মতোই গরগর আওয়াজে সংবাদ পেশ করে এক সেকেন্ড মতো থামলেন বক্তা। এয়ারপোর্টে লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে। লোকটা কথার জোয়ারে লাগাম টানতে না টানতেই ভিআইপি এক্সিট ধরে বেড়িয়ে এলো দু’জন কালো পোশাকের সুঠামদেহী বলবান পুরুষ। দেহরক্ষী হবে হয়তো। এর পরপরই ইউ টার্ন ধরে বেরিয়ে আসে আডিডাস ব্র্যান্ডের গ্রে ট্রাকস্যুট আর নাইকি খচিত স্নিকার্স পরিহিত একটা ছিমছাম গড়নের লম্বাটে পুরুষ। বয়স কতইবা হবে, সাতাশ, আটাশ কিংবা তারচেয়ে একটু বেশি। তবে আপাতত ম্যানলি হাঁটার সৌন্দর্য আর গতিবিধিই তার পরিচয়ের বাহক। যদিও লোকটার পুরুষালী মুখাবয়ব সমগ্রটা ঢাকা পরেছে কালো মাস্কের অন্তরায়, তাও যে কেউই এক দেখায় নিঃসন্দেহে বলে দিতে পারবে এটাই মাহিন বেনজামিন।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
মাহিন বেরুতেই অপেক্ষার অবসান ঘটলো সকলের। এয়ারপোর্টের অভিমুখে জোর কদমে ছুটে আসতে লাগলো গণজোয়ার। তাদের বেশির ভাগই তরুণ তরুণী।অগত্যা অনুগামী ভক্তকূলের সান্নিধ্যে দাড়াতে হলো মাহিনকে। ছবি তুললো কয়েকজন। এরপরই শুরু হলে সাংবাদিকের একের পর প্রশ্নের বহর। পেশাগত অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করে ব্যাক্তিগত জীবনের হালচাল সবকিছুই ছিল প্রশ্নের অন্তর্গত। মাহিন যতটুকু সম্ভব উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলো। তবে পরিস্থিতি অনুকূলে নয়। হু হু করে ভীড় বাড়ছিল এয়ারপোর্টে , ইতিমধ্যে হইহট্টগোলে মুখরিত চারিপাশ। সিকিউরিটি পুলিশ গুলো হিমশিম খাচ্ছে রীতিমতো। এই পর্যায়ে ভীর ঠেলে দ্রুত এগিয়ে আসে মাহিনের পিএ তুর্য। দেহরক্ষীদের চোখের ইশারা দিয়ে ঝটপট পরিস্কার করে ফেলে রাস্তাটা ,অতঃপর সামনে এগিয়ে নিয়ে যায় মাহিনকে। পেছনে ফেলে আসা সাংবাদিকের প্রশ্নের জোয়ার থামেনি এখনো। কিছু শোনা যাচ্ছে, কিছু যাচ্ছে না। এতো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পরিস্থিতি নেই, সহসা গাড়ির দিকেই এগুচ্ছিল মাহিন। তন্মধ্যে কেউ একজন উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
— বিয়ের পিঁড়িতে কবে বসছে মাহিন? আর যদি বসেও থাকে তাহলে সেই ভাগ্যবতী কে?
অকস্মাৎ প্রশ্নটা চট করেই স্থির মনোযোগ কেঁড়ে নিলো মাহিনের। ফলস্বরূপ পেছনে ঘুরলো সে, মুখের আদলে স্ফীত হাসি ধরে রেখে জানালো,
— আছে একজন। যদি তার অভিমান ভাঙাতে সক্ষম হই, তবে শীঘ্রই সুসংবাদ পাবেন।
এখানেই পজ হলো ভিডিও, মাহিনের হাস্যোজ্জল মুখখানা এখনো প্রতীয়মান পুরো আইপ্যাড জুড়ে। ট্রেড মিলের গতিস্থীর করে হাতের সাহায্যে কানের এয়ারপড’স গুলো টেনে টেনে খুললো এরীশ। অতঃপর কাচের জানালা ভেদ করে সেগুলো ছুড়ে মা’রলো জঙ্গলের অদূরে । তুষারের থমথমে অভিব্যাক্তির পরিবর্তন হলোনা তাতে। সে আইপ্যাডটাকে গুছিয়ে নিলো সযত্নে ,মাহিনের কিঞ্চিৎ প্রশংসা করে বললো,
— মানতেই হবে, হি হিজ ভেরি কনফিডেন্ট।
মুখাবয়ব র’ক্তিম হলো এরীশের। দাঁতের সাথে দাঁত পিষে গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,
— ননসেন্স! সরাও এটাকে।
হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো তুষার। আইপ্যাড সমেত সরে গেলো কয়েক পা। জিম রুমের এক পার্শে ছড়িয়ে রয়েছে আধুনিক ধাঁচের নান্দনিক কারুকাজ শোভিত কয়েকটি কালোরঙা ডিভান, সামনে সেন্টার টেবিল অনুপস্থিতিত। কালোর উপর স্বর্ণালী প্রলেপ, দেখতে চমৎকার লাগছে বেশ। তার পাশেই একটা মিনি ফ্রিজ। টুকটাক সোডা আর কোমল পানীয় রয়েছে হয়তো। তুষার এগিয়ে গেলো সেদিকে। ফ্রিজ খুলে হাতে একটা কোল্ড ড্রিংক্স এর ক্যান নিয়ে গিয়ে বসলো ডিভানে।
বিস্তৃত ডিভানে গা ছড়িয়ে বসতে বসতে এরীশের উদ্দেশ্যে ভাবুক স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লো সে ,
— আজকাল আপনি খুব ডিস্টার্ব এরীশ। অকারণেই রেগে যাচ্ছেন,হুটহাট গার্ডদের কে শ্যুট করে দিচ্ছেন, ইভেন ব্লাড ডায়মন্ড মিশন কম্পিলিট হওয়ার পার্টিটা পর্যন্ত সামান্য কিছু তুচ্ছ কারণে যু’দ্ধক্ষেত্র বানিয়ে দিলেন। আমাদের কতগুলো ম্যান পাওয়ার নষ্ট হলো। ইজন’ট দিস আ কজ ফর কনসার্ন?
নির্বিকারে সামনের পাঞ্চিক ব্যাগটার কাছে এগিয়ে গেলো এরীশ। বক্সিং গ্লাভস গুলো হাতে চড়াতে চড়াতে জবাব দিলো,
— কি বলতে চাইছো? স্পষ্ট করো।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো তুষার। কয়েক মূহুর্ত নিস্প্রভ চেয়ে রইলো উদভ্রান্ত এরীশের পানে, যে এই মূহুর্তে পৈশাচিক দানবের মতোই ফোঁস ফাঁস করছে ক্রোধে। শরীরের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তীব্র কষাঘাতের তোড়ে বালু ভর্তি পাঞ্চিক ব্যাগটাকে দিশেহারা করে ফেলছে অহর্নিশ। নেতিয়ে যাওয়া ব্যাগটার আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে এসেছে যেন। তাও দমছে না মাফিয়া বস। পরিধেয় ব্ল্যাক স্যান্ডো গেঞ্জি আর ব্যাগি কার্গোটা অচিরেই চোখ ধাঁধাচ্ছে গৌড় বর্ণের পুরুষালি শরীর জুড়ে। মানান সই ঘর্মাক্ত পেশি গুলো ক্রোধের তাড়নায় ফুলে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। এটা কোনোরূপ শরীর চর্চার স্বাভাবিক কার্যক্রম নয়, সেটা বেশ ভালোই উপলব্ধি করতে পারছে তুষার, ফলস্বরূপ নীরবতা ভেঙে প্রত্যুত্তর করলো সহসা,
— আই থিংক ইউ নিড সাম পিচ এরীশ।
তৎক্ষনাৎ থমকালো এরীশ। হাতের গতি পুরোপরি স্তব্ধ হয়ে এলো ওর । মাফিয়া বসের ক্ষীপ্রতা থেকে কিয়ৎক্ষন ফুরসত পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো দোদুল্যমান পাঞ্চিং ব্যাগটা। চোখের মাঝে কৌতুহলের ইন্ধন ধরে রেখে ঘাড় ঘোরালো সে,মূহুর্তেই আদান প্রদান হলো ক্ষীণ অভিব্যাক্তির।
— আর ইউ সিওর?
কণ্ঠের মাঝে কিছুটা অসংগতি আর গম্ভীরতা সুস্পষ্ট। তীক্ষ্ণ চোয়ালের প্রতিটি শিরা উপশিরায় অস্থিরতার দাবানল। অথচ বিদ্রুপাত্তক স্বরে প্রশ্নটা ছুড়লো এরীশ। প্রত্যুত্তরে নেত্রপলে সায় জানালো তুষার। কন্ঠে দৃঢ়তা ধরে রেখে বললো,
— আ’ম সিওর।
কথা বাড়ালো না এরীশ। এদিক ওদিকে ঘাড় ফুটিয়ে,ফের বক্সিং এ মনোযোগ স্থির করলো সে। তীব্র ক’ষাঘাতে অবিরত থেকে উদভ্রান্ত আওয়াজে জানালো,
— then bring me some peace tushar. I think u know very well where my peace is.
আজ পহেলা ফাল্গুন, বসন্তের প্রথম দিন। ঋতুরাজের আগমনে রঙিন পুরো শহর। কোথাও কোনো মলিনতার লেশমাত্র নেই,নেই একঘেয়ে সেই শীতল নির্জীবতা। সমগ্র শহর জুড়ে বইছে বাসন্তীক হিমেল হাওয়া ,উৎসব মুখর চারিপাশ। বছরের অন্যতম এই রঙিন দিনটিকে স্বাগত জানাতে পিছিয়ে নেই রয়েল টিউলিপ। পর্যটন এরিয়া ইনানী আজ লোকে লোকারন্য। একান্ত ব্যাক্তি মালিকানাধীন বীচটিও জনসমাগমে পরিপূর্ণ।
বীচের চারিদিকে অমোঘ পুষ্পরাজির স্নিগ্ধ বিচরণ। তাজা গোলাপ, গাঁদা আর রজনীগন্ধার সুবাসে মাতোয়ারা দিগ্বিদিক। উৎসব আর আধুনিকতার মিশেলে সকলের পোশাকে প্রস্ফুটিত হয়েছে অভিন্ন সংস্কৃতির বৈচিত্র্যতা। বাসন্তী শাড়ি আর পাঞ্জাবি পরিধেয় কপোত-কপোতীরা যেন সদ্য ফোঁটা ভৃঙ্গরাজ।
ফাল্গুনী আবহে গা ভাসিয়ে সুশ্রী অঙ্গে সফেদ আর বাসন্তীর মিশেলে জামদানী শাড়ি চড়িয়েছে নিঝুম ও। খোপায় তুলেছে তাজা ফুলের গাজরা, ঘন পাপড়ি যুক্ত আঁখিদ্বয়ে টেনেছে কাজলের ভারী প্রলেপ,ফিনফিনে ওষ্ঠপুট জুড়ে লেপ্টে আছে মানানসই লাল লিপস্টিক। তবে শাড়ি পরে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে ওর, না পারছে ঠিকভাবে কুঁচি সামলাতে আর না তো আঁচল।
কোনোমতে শাড়িটাকে দু’হাতে আকড়ে ধরে পা বাড়িয়েছে বুটিক হাউজের দিকে। ঈশানী বোধ হয় ওখানেই আছে। বসন্তবরণ উপলক্ষে রয়েল টিউলিপে আজ এলাহী আয়োজন। পর্যটকদের মনোরঞ্জনে আয়োজন করা হয়েছে বিশাল কনসার্টের। আধুনিক, ক্লাসিক্যাল অনেক শিল্পীরাই মঞ্চ মাতাবেন আজ। পরিস্কার গোধূলির ললাটে ঝুরঝুরে আলোর ছটা, সন্ধ্যা হলেই উৎসবে মেতে উঠবে সকলে। নিঝুম আর দেরী করলো না, সাজগোছে সাবধানতার হাত বুলিয়ে এগিয়ে গেলো বুটিক হাউজের পানে। সেখানে গিয়ে বাইরে থেকেই ডাকলো ঈশানীকে,
— ঈশু আছিস?
নিঝুমের আওয়াজ পেয়ে ব্যগ্র কদমে ছুটে এলো ঈশানী, জানালো,
— হ্যারে, আর ঘন্টাখানিক। এরপরই মার্কেট বন্ধ হয়ে যাবে। ততক্ষণে একটু বীচ টা ঘুরে আয়, আমি সবকিছু গুছিয়ে বেরোলে দু’জন মিলে কনসার্টে যাওয়া যাবে।
ঈশানীকে দেখে হতবিহ্বল নিঝুম। মেয়েটার দিকে আশ্চর্য নজর বুলিয়ে নমনীয় ওষ্ঠাধর আপনাআপনি ফাঁক হয়ে এলো ওর। দু’হাতে ঈশানীর বাহু আঁকড়ে ধরে অবাক স্বরে বলে উঠলো,
— দাঁড়া দাঁড়া তোকে দেখে নেই আগে।
ম্লান হাসলো ঈশানী, কৌতুক করে শুধালো ,
— বেশি সুন্দর লাগছে বুঝি?
অজান্তেই মুখের উপর হাত চলে গেলো নিঝুমের,হতচকিত নয়ন জোড়া ঈশানীর উপর নিপতিত হলো ফের । বাসন্তী রঙে গা ভাসায়নি ঈশানী আজ, পরেছে কালো পাড়ের খয়েরী তাঁতের শাড়ি, ধনুকের মতো বাঁকানো শরীরে মসৃণ শাড়ির আবরণ যেন দিগুণ আকর্ষনীয় করে তুলেছে সুগঠিত নারী দেহের তীর্যক অবয়ব। কানের পাশ ঘেঁষে খোলা চুলে আঁটকে আছে রক্তিম লাল গোলাপ। পেলব মুখশ্রী জুড়ে গোলাপি ব্লাশের মিহি আস্তর, অধর ডগায় চিকচিক করছে রঙহীন স্নিগ্ধ গ্লস। নীল জলরাশির ন্যায় অকৃত্রিম চোখ দু’টো আজ লাবণ্যতায় সিক্ত,চোখে পলক ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন অনিমেষ দ্যুতি ছড়াচ্ছে সেগুলো।
— শেষ কবে এভাবে সেজেছিলি বলতো?
নিঝুমের কথায় ফিক করে হাসলো ঈশানী, জানালো,
— মনে নেই। তবে তোর সঙ্গে দেখা হওয়ার খুশিতে ইদানীং মনটা আমার বেশ ফুরফুরে। নয়তো আমি আর কনসার্ট? অসম্ভব!
শেষ কথাতে অবিশ্বাসের পারদ। বিতৃষ্ণায় চোখ বড়বড় করে ফেললো ঈশানী। মৃদু হাসির ঝঙ্কার ভেসে এলো অপর প্রান্ত থেকে, নিঝুম আস্বস্ত করলো ওকে। বললো,
—চিইল ঈশু, আমি আছিতো। তাছাড়া এমন প্রোগ্রাম আমাদের ভার্সিটিতে অহরহ হয়ে থাকে, আমার অভ্যেস আছে।
নিঝুমের কথার পাছে ঈশানী কিছু বলবে, তার আগেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো পুরুষালী কণ্ঠের অযাচিত প্রশংসা বাক্য,
— হায়হায় আমিতো দৃষ্টি ফেরাতে পারছি না, ফাগুনে বুঝি বউ ফুল ফোটে?
অতর্কিতে চোখ ঘোরালো নিঝুম ঈশানী। আশ্চর্যের চরম শিওরে পৌছে চকিতে দৃষ্টিপাত করলো অপর প্রান্তে। দেখলো বুকের উপর দু’হাত ভাঁজ করে,দেওয়ালে ঠেস দিয়ে নির্নিমেষ চোখে এদিকেই চেয়ে আছে পাঞ্জাবি পরিহিত এক সুদর্শন যুবক।
— তোমাকে আজ সত্যি সত্যিই পরীর মতো লাগছে ঈশানী। শাড়ি পরিহিতা বাঙালি পরী। চমৎকার উপাধি দিয়েছি না বলো?
ঠোঁট প্রসারণ করে নিঃশব্দে হাসতে লাগলো ছেলেটি।
কিঞ্চিৎ নাক ফুলিয়ে বিরস মুখে প্রত্যুত্তর করলো ঈশানী,
— হেয়ালি করোনা তো রিদান, যাও নিজের দোকানে যাও।
— উহুম, মোটেই হেয়ালি করছি না। ওই চন্দন রঙা ফাঁকা কপালটা দেখছো,ওখানে একটা কালো টিপ খুব মানাতো। তাহলেই বাঙালি পরী শব্দটা পরিপূর্ণ।
আঙুল উঁচিয়ে ঈশানীর কপালটাকে ইশারা করলো রিদান। ওদিকে রিদানের ফ্লার্টিং দক্ষতা দেখে অভিভূত হয়ে ঠোঁট উল্টালো নিঝুম।
অনর্থক কথায় গা ভাসালো না ঈশানী, রিদানকে তৎক্ষনাৎ থামিয়ে দিয়ে চট করে বললো,
— আরেহ তোমার কাস্টমার দাঁড়িয়ে আছে দেখি।
ধড়ফড়িয়ে উঠলো রিদান, তাড়াহুড়ো ঘাড় ঘুরিয়ে দোকানে চোখ বুলালো একপল। শুধালো,
— সত্যি বলছো?
হ্যা সূচক মাথা নাড়ায় ঈশানী,উচাটন স্বরে বলে,
— হ্যা মাত্রই ভেতরে ঢুকলো দুজন।
ঈশানীর কথায় এক দণ্ড দাঁড়িয়ে অতিবাহিত করার ফুরসত পেলো না রিদান। ব্যতিগ্রস্ত হয়ে তক্ষুনি ঢুকে গেলো দোকানে।
— কে এটা?দেখতে তো বেশ ভালোই।
রিদান চলে যেতেই সন্দিহান হয়ে প্রশ্ন ছুড়লো নিঝুম।
ভাবলেশহীন হয়ে সামনের এ্যান্টিকের শপটার পানে একপল দৃষ্টি বোলালো ঈশানী, অতঃপর জানালো,
— রিদান,পাশে যে বড় এ্যান্টিকের জিনিস পত্রের শপটা দেখছিস, ওটা ওর। এমনিতে ভদ্র, বেশ সাহায্য পরায়ণ ও বটে। তবে কথা একটু বেশি বলে, যেটা আমার একদমই পছন্দ নয়।
— তবে যাই বলিস ছেলের ফ্লার্টিং স্কিল কিন্তু মারাত্মক। কেমন ইনিয়ে বিনিয়ে তোর প্রশংসা করে গেলো দেখলি?
নিঝুমের কথায় ঠোঁট উল্টালো ঈশানী, হাতের জিনিস গুলো সমেত দোকানের দিকে ফিরে যেতে যেতে আশাতীত স্বরে বললো,
— কি জানি!
সন্ধ্যার আকাশে তাঁরার দেখা নেই। ঈষৎ মেঘে ঢাকা পরেছে চিকন লম্বাটে চাঁদ। অবশ্য আজ চাঁদের আলো নিয়ে মাথা ব্যথা নেই কারোর। ধরণি জুড়ে রাতের পর্দা টেনে দিতেই জ্বলে উঠেছে রং বেরঙের স্টেজ লাইট। ফেইরী আর স্মোকি লাইটের মৃদু আলোতে চমৎকার দ্যুতি ছড়াচ্ছে পুরো রয়েল টিউলিপ। কনসার্ট শুরু হয়েছে বহুক্ষণ। একপাশে তানপুরার তরঙ্গোচ্ছ্বাসে রবি ঠাকুরের অপার্থিব গানের সুর আর অন্যপাশে ভৈরব নৃত্যের অমোঘ সংপৃক্ততা বিমুগ্ধ করেছে শ্রোতা সমাজের মন মস্তিষ্ক। সুরের মূর্ছনায় ডুবে থাকা কণ্ঠশিল্পীর তালে গলা মিলিয়ে একযোগে গাইছে সকলে,
থাক্ থাক্ নিজ-মনে দূরেতে
আমি শুধু বাঁশরির সুরেতে..
থাক্ থাক্ নিজ-মনে দূরেতে
আমি শুধু বাঁশরির সুরেতে…
পরশ করিব ওর প্রাণমন অকারণ
মায়াবন বিহারীনি।
একদিকে মায়াবন বিহারীনির মন মাতানো সুরের তালে হারিয়ে যাওয়ার বাসনা, অন্যদিকে নিগূঢ় আঁধারের বুক চিঁড়ে কালো পোশাকধারী এক বিশেষ বাহিনীর আগমন।চোখের পলকে তারা ঘেরাও করে নিয়েছে সমগ্র ইনানী বিচ। কেউই সশস্ত্র নয় তারা, তবুও মূর্তিমান সচকিত মস্তিষ্কের গভীর দৃষ্টি। যেন আদেশ পাওয়ার বিমূর্ত অপেক্ষা।
সেই বিকেল থেকে শাড়ির হালচালে বিরক্ত নিঝুম। জনসমাগমের মাঝখানে পরে কখন যে কুঁচি খুলে হাতে চলে এসেছে সেই হদিস জানা নেই ওর। কিন্তু যখন টের পেলো তখন সংকোচ আর বিরক্তির একনিষ্ঠতায় কুপোকাত মস্তিষ্ক। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়, অগত্যা উপায়ন্তর না পেয়ে ঈশানী কে ডেকে উঠলো নিঝুম,
— ঈশু! একটু ঝামেলা হয়ে গিয়েছে, আমাকে এক্ষুণি ওয়াশরুমে যেতে হবে।
আওয়াজের কারণে শব্দ শোনা মুশকিল, তবুও বহু কসরতে হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়লো ঈশানী,
— কি হয়েছে? আমি কি সাথে আসবো?
এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে না জানালো নিঝুম। বললো,
— আসার দরকার নেই, তুই এখানেই থাক। অন্য কোথাও যাস না। হারিয়ে গেলে আবার ঝামেলা, ভীরের মাঝে ফোন করলেও শুনতে পাবি না।
— ঠিক আছে যা তুই। আমি এখানেই আছি, জলদি ফিরে আসিস।
ঈশানীর কথায় সায় জানিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে গেলো নিঝুম। অচেনা ভীরের মাঝে চেনা মুখটা হারিয়ে যেতেই বেঘোরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ঈশানী। ভেতর ভেতর কেমন একটা অশুভ দাঙ্গা চলছে ওর। যেন কোথাও কিছু ঠিক নেই। বিতৃষ্ণায় তেঁতো হয়ে আছে জিভের ডগা। আজ একটা শুভ দিন, সবকিছু ভালোই হবে, সেই ভেবে নিজেকে খানিক আস্বস্ত করলো ঈশানী। ভুলভাল চিন্তা বাদ দিয়ে ফের মনোযোগ স্থির করলো কনসার্টে।
ঠিক তখনই বলা নেই, কওয়া নেই কোথা থেকে যেন ছুঁটে এসে ঈশানীর সামনে হাঁটুগেড়ে বসে পরলো রিদান।হাতে একগুচ্ছ তাজা গোলাপ। সেগুলো বাড়িয়ে দিলো ঈশানীর পানে, চমৎকার হেসে বললো,
— গত দু’মাসে কতবার বলতে চেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। কেন যেন তোমার গম্ভীর ব্যক্তিত্ব বারবার পিছু হটিয়ে দিতো আমাকে। কিন্তু আজ আর পিছু হাটার সময় নেই,কারণ আজ তো শুধু পহেলা ফাল্গুন নয়, আজ ভালোবাসা দিবস ও বটে। আজ না জানালে খুব আপসোস হতো মনে। তাই ভয় কে জয় করে কথাটা বলতে চলেই এলাম। ঈশানী, তোমার অকৃত্রিম রূপে বিমোহিত আমি। তোমার অভূতপূর্ব চাহনিতে ঘায়েল হয়েছে এ হৃদয়। তুমি কি তার দায়ভার নিবে?একটু, সামান্য একটু ভালোবাসার পরশ দিয়ে বাঁচাবে এই অধম কে?
মাথা ঘোরাচ্ছে ঈশানীর। এতো এতো মানুষের মাঝে এসব সার্কাজম মোটেই পছন্দ নয় ওর। অথচ সেই তখন থেকে একাধারে ভালোবাসার বুলি আওড়াচ্ছে রিদান।ওকে এখনই সরানো দরকার, মানুষ কি ভাবছে? মাত্রাতিরিক্ত দ্বিধাগ্রস্ততায় কথা গুলিয়ে যাচ্ছে ঈশুর। কিছুতেই গোছানো শব্দগুলো বাক্যাকারে নির্গত হচ্ছে না কণ্ঠনালী ভেদ করে । তাও বহু তিতিক্ষার পরে সামান্য একটু বাক্য উচ্চারণ করলো ঈশানী।
— দেখো রিদান, এসব নিয়ে পরেও কথা বলা যাবে। তুমি প্লিজ উঠে এসো মানুষ দেখছে।
মৃদু হাসলো রিদান। বললো,
— তোমার অস্বস্তি হলে উঠে যাবো কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু প্লিজ এগুলো ফিরিয়ে দিওনা। মামার ঝুরির শেষ ফুল কটা নিয়ে এসেছি তোমার জন্য।
— না্ দ…দেখো।
— ঠিকাছে ঠিকাছে।
হাত উঁচিয়ে তৎক্ষনাৎ ঈশানীকে থামিয়ে দিলো রিদান। ধাতস্থ স্বরে বললো,
— এক্ষুনি চিন্তিত হতে হবে না। উত্তরটা না হয় তোলা থাক, পরে শুনে নেবো। এটলিস্ট ফুল গুলো তো নাও, ইট’স আ হাম্বল রিকোয়েস্ট।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ঈশানী, এদিক ওদিকে অস্বস্তির নজর বুলিয়ে জলদি করে নিয়ে নিলো ফুল গুলো। অতঃপর ঢুকিয়ে রাখলো সোজা ব্যাগে।
রয়েল টিউলিপের সুউচ্চ ভবনের টপ ফ্লোরের কাচের জানালাটা খোলা পরে আছে বহুক্ষণ । সেখানে নির্লিপ্তে দাঁড়িয়ে দীর্ঘকায় এক পুরুষালি অবয়ব। ধারালো মুখশ্রী জুড়ে তার উদ্ভাসিত পাশবিকতা। ধূসর চোখ দুটো আটকে আছে দূরবীনে। নিচের দৃশ্যটুকু বিনাবাক্যে অবলোকন করে, কর্ণকূহুরে এয়ারপড বসালো সে। অতঃপর কাউকে কঠোর আদেশ করে রুক্ষ আওয়াজে জানালো,
— নিড সাম প্রাইভেসী।
ব্যাস সঙ্গে সঙ্গে গ্রেনেড বি’স্ফো’রণের প্রকাণ্ড আওয়াজে প্রকম্পিত হয়ে উঠলো ধরিত্রী। চোখের পলকে বদলে গেলো দৃশ্যপট, জীবন নিয়ে পালানোর আমূল প্রচেষ্টায় আপামর ছুটতে লাগলো বিকেলের সেই বাসন্তী রঙা ভৃঙ্গরাজের দল। অকস্মাৎ স’হিংসতায় ভরকে গেলো ঈশানী। চোখের সামনে দাউদাউ অগ্নিশিখার অপ্রতিরোদ্ধ বিচরণ। এ যেন বিভীষিকা ময় রাশিয়ার একচ্ছত্র প্রতিচ্ছবি। ছত্রভঙ্গ মানুষগুলো যে যেখানে পারছে ছুটে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে । কেউ কেউ জীবন যুদ্ধে হে’রে গিয়ে মৃ’ত্যুকে আলিঙ্গন করছে বী’.ভৎস লহমায়। এহেন নৃ’শংসতা দেখে দম আটকে আসছে ঈশানীর। ও নিজেও সকলের সঙ্গে পা মিলিয়ে ছুটতে চাইলো অর্হনিশ। তবে সুযোগ হলোনা আর। তার আগেই ক্লোরোফর্মের তীক্ষ্ণ গন্ধে ভারী হয়ে এলো মস্তিষ্ক। একটু একটু করে নিভে এলো অক্ষিপুট। অবশেষে শরীরের সমস্ত শক্তি অচিরেই ম্লান হলো অ’গ্নিদগ্ধ ধূসর বাতাসের অন্তরায় ।
ঝিম ধরা শুনশান নিস্তব্ধতায় বিষণ্ণ লাগছে চারিপাশ। বিকেলের আনন্দ, উৎসবের সেই মনমাতানো আমেজ কোনোকিছুই অবশিষ্ট নেই আর। বিমূর্ষ নির্জীবতার আড়ালে বিলীন হয়েছে সেসবের অস্তিত্ব। বড্ড বেশি দুশ্চিন্তায় ধরে আছে মাথাটা। চোখ খোলার পরপরই ভারী লাগছে মস্তিষ্ক। আশেপাশে আলোর উপস্থিতি ক্ষীণ, ঝাপসা দৃশ্যপট। কাউচ চেয়ারের হেডবোর্ড থেকে মাথাটা টেনে তুলতে প্রচন্ড বেগ পোহাতে হলো ঈশানীর। জুতসই বসার জায়গা,ঘরময় পুরুষালী ক্লোনের নেশালো সুঘ্রাণ। মানুষের উপস্থিতি সুস্পষ্ট। সহসা ভারী হয়ে আসা চোখ দু’টোকে হালকা করার প্রয়াসে বার কয়েক পলক ছাড়লো ঈশানী। তখনই কর্ণকূহর ভেদ করলো অতিপরিচিত এক রাশভারি পুরুষালি কন্ঠস্বর,
— লং টাইম নো সি.. বেইব।
হাস্কি আওয়াজটা ছিল কর্ণগহ্বরে আলতো আদর বোলানোর মতোই আকর্ষনীয় আর বেসামাল। তবে ঈশানীর মাঝে লক্ষ্যনীয় হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাবাবেগ। বাক্যটুকু শ্রবণ করা মাত্রই অতর্কিত আশংকায় ধড়ফড়িয়ে উঠলো ওর হৃদযন্ত্র। আরও কয়েকদফা অক্ষিপল ছেড়ে দৃষ্টি স্থাপন করলো সম্মুখে। দেখলো, ওর থেকে কয়েক হাত দূরে অন্য একটা কাউচ চেয়ারে পায়ে পা তুলে বসে আছে সুঠামদেহী এক সুদর্শন পুরুষ।
আপাদমস্তক কালো দিয়ে মোড়ানো সে। মারাত্মক আকর্ষনীয় তার চাহনী। মাস্কের আড়ালে মুখ ঢাকা থাকলেও, অতি পরিচিত সেই পিয়াসর্ড করা ধূসর বাদামি অনুভূতিহীন চোখ দু’টোকে চিনতে কিয়ৎক্ষন সময় নষ্ট হলোনা ঈশানীর।এই চোখ, এই চাহনি, এই কণ্ঠস্বর যা ওকে মিশ্র অনুভূতি দেয় প্রতিমূর্হুতে।কখনো পাহাড় সমান ঘৃণা তো কখনো এক সমুদ্র অনুভূতির প্লাবন। এই চোখ যে এতো সহজে ভোলার নয়। কিন্তু এখন, এই মূহুর্তে, নিষিদ্ধ দুনিয়ার সম্রাট,আধারের নিশাচর,মাফিয়া বস টার অপ্রত্যাশিত দর্শনে অকস্মাৎ আঁতকে ওঠে ঈশানী। মুখ থেকে র’ক্ত সরে গিয়ে মূহুর্তেই থমথমে ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করে নমনীয় পেলব কপোল।
মস্তিষ্ক জুড়ে জীবন্ত হয় রাশিয়ায় ফেলে আসা পদে পদে নৃ’শংসতার সেই ভ’য়াবহ স্মৃতির অধ্যায়। কুণ্ঠিত নজরে পুনরায় লোকটাকে একপল পরখ করে শুষ্ক ঢোক গিললো ঈশানী, কণ্ঠনালীতে রাজ্যের আড়ষ্টতা ধরে রেখে কম্পিত স্বরে বলে উঠলো,
— এ.. এরীশ।
বিপরীত প্রান্ত থেকে ভেসে এলো এক চিলতে ম্লান হাসির নৈঃশব্দিক মিশ্র ধ্বনি । সে আওয়াজে ফের গুটিয়ে গেলো ঈশানী।
— মনে আছে তাহলে?
পুরুষালী কণ্ঠস্বর আবেগ দ্বারা পরিপূর্ণ। বোকা মেয়েটা তা বুঝলে তো? বরং মাফিয়া বসের কথার প্রত্যুত্তরে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠলো সে। ফুঁপিয়ে কান্নার তোড়ে কেঁপে উঠলো ওর সর্বাঙ্গ।ক্রন্দনরত অবস্থাতেই ভয়ার্ত স্বরে বললো,
— কেন ফিরে এসেছেন আপনি আবার? কেন বারবার আমার সাজানো জীবনটাকে পায়ে পিষে তছনছ করে দিয়ে যান সবসময় ? বিশ্বাস করুন, বারবার জোড়া লাগানোর শক্তি আর অবশিষ্ট নেই আমার। সত্যিই হাঁপিয়ে উঠেছি আমি।
— কেন এসেছি সত্যিই জানতে চাও?
ভরাট গলায় প্রশ্ন ছুড়লো এরীশ। ওদিকে এরীশের কণ্ঠস্বর কানে আসা মাত্রই কান্না থামালো ঈশানী। তাড়াহুড়ো চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো কাউচ ছেড়ে। বাইরে যাওয়ার প্রয়াসে সম্মুখে পা বাড়িয়ে শক্ত কন্ঠে বললো,
— কিছু জানার নেই আমার, দয়াকরে যেতে দিন।
ঈশানী সামনে এক পা দিয়েছে কি দেয়নি তার আগেই শিকারি হস্তে আচমকা কোমরে টান মে’রে ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ফেললো এরীশ।নমনীয় হাতের কব্জিদ্বয় নিজের বলিষ্ঠ হাতে আবদ্ধ করে টেনে নিয়ে এলো নিকটে। গ্রীবাদেশ সামান্য নিচে নামিয়ে ক্রন্দনরত মেয়েটার মুখের কাছে মুখ নিয়ে দাঁতে দাঁত পিষলো মাফিয়া বস। হিসহিসিয়ে বললো,
— জানতে চাও না কেন?
মাফিয়া বসের ক্রুদ্ধস্বর আর ডমিনেটিং আচরণে হৃদযন্ত্র থমকে গেলো ঈশানীর। চোখ তুলে তাকানোর সাহস হলোনা আর।
— লুক এ্যাট মি।
কঠোর আদেশ ভেসে এলো বিপরীত প্রান্ত থেকে। সে আদেশ মান্য করলো না ঈশানী। বরাবরের মতোই মেকি আত্মবিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ। মেয়েটার অবাধ্যতায় অপ্রীতিকর ক্ষীপ্রতা ছড়িয়ে পড়লো মস্তিষ্কে। তৎক্ষনাৎ হাতের বাঁধন শক্ত করলো সে , তীব্র অধিকারবোধ দেখিয়ে বললো,
— লুক এ্যাট মি রাইট নাও। আই ওয়ান্না সি ইউর ব্লু আইস।
মূর্হুতেই ভেতরের পৈশাচিক মন খেঁকিয়ে উঠলো ওকে। তীব্র বাঁধা প্রদান করে বললো,
— এতো উতলা হোস না। ওই চোখের ঘৃণা সহ্য হবে না তোর ।
ভেতর ভেতর বিভ্রান্তির টানাপোড়েনে দমে গেলো এরীশ। দৃষ্টির মিলন ঘটলো না আজ আর। তবে বাহুমাঝে আবদ্ধ থাকা শীর্ণকায় মেয়েটাকে হুট করে এতোটা কাছে আবিস্কার করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো ভেতরের অন্য এক নিষিদ্ধ প্রেমানুভূতি। নিগূঢ় দর্শনে ঈশানীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত অবলোকন করলো এরীশ। শাড়ি পরিহিত মেয়েটাকে অপ্সরার মতোই স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। বুঁজে রাখা চোখের পাপড়ি থেকে শুরু করে দৃষ্টির এলোমেলো বিচরণ ঘটলো সমগ্র মুখশ্রী জুড়ে। পরিশেষে নজর আটকালো তিরতির করে কাঁপতে থাকা মোলায়েম ওষ্ঠপুটের নরম ভাঁজে। বেঘোরে ঠোঁট বাড়ালো মাফিয়া বস। আরেকবার সেই সুমিষ্ট স্বাদ গ্রহনের নিদারুণ প্রচেষ্টা।
ওদিকে মুখের কাছে পুরুষালি তপ্ত নিঃশ্বাস অনুভূত হতেই হতচকিত হলো ঈশানী। এই নিঃশ্বাস ওর নিকট পরিচিত। কারণ সেবার পেন্টহাউজে বসে এই একই কাজ করেছিল এরীশ। সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না তো আবার?
মস্তিষ্ক জুড়ে অযাচিত প্রশ্নটা হামলে পরতেই চকিতে চোখ খুলে ফেললো ঈশানী। খারাপ লোকটাকে এতোটা কাছাকাছি আবিষ্কার করে গলা ছেড়ে চ্যাঁচিয়ে উঠলো হঠাৎ,
— নাহহ!
থমকে গেলো এরীশ। নিঃশব্দে উঠানামা করলো তার পুরুষালি এ্যাডামস অ্যাপেল। মনে হয় বড়সড় ঢোক গিলেছে।
— কি করতে যাচ্ছিলেন আপনি? আমাকে কি আপনার মাফিয়া ক্লাবের প্র’স্টিটিউড মনে হয়?আ…
— শাট আপ! নিজের ভালো চাইলে এই ছোট্ট মুখটা বন্ধ করো এক্ষুণি।
অকস্মাৎ ধমকে ধড়ফড়িয়ে কেঁপে উঠলো ঈশানী। তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি নামিয়ে চোখ রাখলো মেঝেতে।
ওর কথায় ভীষণ চটে গেলো এরীশ। মস্তিষ্ক জুড়ে উদ্ভাসিত হলো আগ্নেয়গিরির জলন্ত দাবানল। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো মাত্রাতিরিক্ত ক্রোধে। কিন্তু ঈশানীকে আ’ঘাত করতে পারবে না ও। ফলস্বরূপ দেওয়ালেই পাঞ্চ বসিয়ে দিলো সবেগে। এরীশের কর্মকাণ্ড পরখ করে উদগ্রীব হয়ে ওঠে ঈশানী,প্রথমে কব্জি ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে, ফের শরীরের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ঠেলে সরাতে চাইলো লোকটাকে। ঈশানীর আচানক বল প্রয়োগে ঠাস করে দেওয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেলো বেখেয়ালি এরীশ। ক্রমশ একই কাজে অবিরত থেকে উদভ্রান্ত স্বরে চ্যাঁচিয়ে ওঠে ক্রন্দনরত মেয়েটা,
— যেতে দিন আমাকে। যেতে দিইইন!
পাইথন লিডারকে এভাবে ক্রমাগত ধাক্কা প্রদান করায় তৎক্ষনাৎ সচকিত হলো মূর্তিমান গার্ড’স। এতোক্ষণ ধরে যান্ত্রিক রোবটের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকা গার্ড গুলো দায়িত্বের জের ধরে অকস্মাৎ রাইফেল তাক করালো ঈশানীর কপালে। এহেন কান্ডে ঈশানীকে একটানে অন্যপাশে সরিয়ে নিয়ে গার্ড’সদের দিকে জলন্ত স্ফুলিঙ্গের ন্যায় কঠোর দৃষ্টিপাত করলো এরীশ। হিং’স্র দানবের ন্যায় গর্জে উঠে বললো,
— ইফ শী গেট’স আ লিটল স্ক্র্যাচ, দেন আ’ল বি দ্যা ওয়ান, হু টেইক ইউর লাইভ’স ফার্স্ট।
তৎক্ষনাৎ থমকে গেলো সকলে। আতঙ্কিত হয়ে নামিয়ে নিলো অ’স্ত্রের বহর। মাথা নমিত করে ঈশুকে একযোগে কুর্শিন জানিয়ে পিছু হাটলো জোর কদম। এরীশের কথায় হতবিহ্বল ঈশানী। ও নিজেও ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না কি হলো হঠাৎ । মাফিয়া বস কি বললো একটু আগে?
— আমি কি ভুল শুনেছি? নাকি ইংরেজির ভুলভাল অর্থ বুঝেছি?
আপনমনে বিড়বিড়ালো মেয়েটা। তখনই হাতের বাঁধন ঠিলে করলো এরীশ, নিগূঢ় স্বরে বললো,
— তুমি যেতে পারো।
সম্বিত ফিরে পায় ঈশানী। বন্দি খাঁচা থেকে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত পাখির ন্যায় হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে তড়িঘড়ি করে উদভ্রান্ত কদমে পা বাড়ায় দরজার অভিমুখে। তবে কোনো এক সুপ্ত পিছুটান ফের আটকে দিলো ওকে। অগত্যা তীক্ষ্ণ টান অনুভব করলো শাড়ির আঁচলে। চকিতে পিছু ঘুরলো ঈশানী, দেখলো এরীশের সিলভার রঙের মেটালিক ব্রেসলেটের সঙ্গে আঁটকে আছে ওর শাড়ির আঁচল। কেন যেন বারবার এরীশের ইউভানের সঙ্গেই আঁটকে যায় ও। বাঁধা পরে যায় অজ্ঞাত দোটানায়।
এরীশ চেয়ে আছে নির্লিপ্তে।ঈশানী পিছিয়ে এলো পুনরায়, বার কয়েক নিজের অ’পটু হাতে টেনেটুনে ছাড়ানোর প্রচেষ্টা চালালো আঁচলটা। কিন্তু কাজ হলোনা। অথচ মাফিয়া বসের দৃষ্টির অগোচরে যাওয়ার প্রয়াসে উদগ্রীব হয়ে আছে মেয়েটা। সোজা কথায় বলতে গেলে পালাতে চাইছে। তাইতো হাজার বার টেনেটুনেও আলাদা করতে না পেরে অবশেষে নিজের আঁচলটাই ছিঁড়ে ফেলার পায়তারা করলো ঈশু। তখনই নতুন উদ্যমে টান পরলো আঁচলে,এবার আর সুপ্ত টান নয়, জোর প্রকোপে মেয়েটাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে এলো এরীশ। যার দরুন তাড়াহুড়ো আঁচল সামলালো ঈশানী, বিরক্তিতে চিড়বিড়িয়ে উঠে বললো,
আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ২৯
— কি করলেন এটা?
ভাবান্তর দেখা গেলো না এরীশের মাঝে। সে নির্বিকার। বিনাবাক্যে নিজের কব্জি থেকে ব্রেসলেটটা খুলে ছেড়ে দিলো আঁচলটা। সহসা লজ্জিত হলো ঈশানী, সেই সাথে অনুতপ্ত ও।
— ব্রেসলেট টা পাওনা রইলো।
বাক্য সম্পূর্ণ করে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালো মাফিয়া বস। ঈশানী ও আগ বাড়িয়ে কথা বলার সাহস দেখালো না আর। আঁচলের সঙ্গে আঁটকে যাওয়া এরীশের ব্রেসলেট সমেত কক্ষ ত্যাগ করলো নৈঃশব্দ্যে।