আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩১

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩১
suraiya rafa

কণ্ঠনালী ভার হয়ে আছে ব্যতিগ্রস্ততায়। দূর্বিষহ মূহুর্তগুলো দলা পাকিয়েছে মস্তিষ্কে। আবেগ-অনুভূতির নাজুক ইন্দ্রিয়গুলোকে ধরাশায়ী করেছে পরাশক্তি। কি হচ্ছে এসব? কেনইবা ফিরে এসেছে নিষিদ্ধ দুনিয়ান হৃদয়হীন জানোয়ার টা। আবার কি চায় সে?

হৃদ গহীনে প্রথম প্রেমের অভিশপ্ত অধ্যায় ছিল অরণ্য। যাকে ঘৃণা করার অধিকার থাকলেও উপেক্ষা করার শক্তি ঈশুর নেই। বক্ষপিঞ্জরে প্রথম ভালোলাগা জন্মানো সেই শূন্য নির্জীব চোখ জোড়া যে এখনো মোহাবিষ্টের মতোই টানে ওকে। মূহুর্তেই এলোমেলো করে তোলে আত্মসংযমের প্রগাঢ় অভিলাষ। ঠিক ভুলের দিশে হারিয়ে বিবেক বিবর্জিত ইচ্ছেরা গ্রাস করে মস্তিষ্ক। অথচ ঈশানী ঘৃণা করে। ঘৃণা করে ওই অত্যাচারী পাপিষ্ঠকে,ভয় করে তার গ্রহ দোষের ন্যায় নৃ’শংস নির্জীবতাকে। এমন একটা নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন লোকের চোখ দু’টোর মাঝেই কেন রাজ্যের মায়া ছড়িয়ে দিলেন উপরওয়ালা? কেন তার চোখের দিকে তাকালে ঘৃণিত সত্তা খেই হারায়? দ্বিধাগ্রস্ততায় বানভাসি হয় অনুভূতির জোয়ার।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তবে এবার আর নিজের উপর ভরসা কিংবা বিশ্বাস কোনোটাই অবশিষ্ট নেই ঈশানীর। ও ঠকেছে, হৃদয়হীন লোকটা ওকে ভীষণ ভাবে ঠকিয়েছে। ভালো মানুষের মুখোশ পরে ছু’রিকাঘাতে ক্ষ’তবিক্ষ’ত করেছে নাজুক অন্তঃকরণ। সে যতই সুদর্শন হোক না কেন,এই মানুষটাকে কেবল ঘৃণাই করা যায়।
একটা মাফিয়া টেরোরিস্ট কখনো ক্ষমতা আর স্বার্থের বাইরে গিয়ে কারোর উপর দয়া দেখায় না। ধীরে ধীরে ঈশানীও এখন বিশ্বাস করে নিয়েছে এই তিক্ত অভিজ্ঞতাকে। ও বিশ্বাস করে এরীশ একটা হৃদয়হীন। এই পৃথিবীতে যার সত্যিই কোনো দূর্বলতা নেই। তাছাড়া হুট করে বাংলাদেশে ফিরে আসা যে মাফিয়া বসের নতুন কোনো ম্যানিউপুলেটিভ কৌশল নয়,কে গ্যারান্টি দিতে পারে তার? হতেও পারে ঈশানীর মতোই অন্য কোনো মেয়েকে লক্ষ্য বানিয়ে নতুন কোনো কৌশলী ফাঁদ সাজাচ্ছে সে।

এলোমেলো ভাবনায় বুদ হয়ে গন্তব্যহীন হাঁটছে ঈশানী। বহু আগেই বাঁধ ভেঙেছে অশ্রু প্লাবন। নিগূঢ় বেদনায় সিক্ত হৃদয়, টলমলে ঝাপসা চাহনি। সেভাবেই ধীর পদক্ষেপে একটু একটু করে সামনে এগুচ্ছিল মেয়েটা। ঘন্টাখানিক আগের ধ্বং’সযজ্ঞের ইতি ঘটিয়েছে দমকল বাহিনী। নিহতের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক। সেই নিয়েই বাঁকবিতণ্ডায় মুখরিত চারিপাশ।কেউকেউ স্বজন হারিয়ে বুকফাটা আহাজারিতে মত্ত। আশেপাশের বিষণ্ণ আবহ ছুঁতে পারলো না ঈশানীকে। নিস্ফল পদধ্বনিতে রেস্ট্রিকটেড এরিয়া ছাড়িয়ে বীচের অভিমুখে এগিয়ে গেলো মেয়েটা।

এদিকে খানিকটা নিস্তব্ধ পরিবেশ। বক্ষগহ্বরে জমানো কান্না নিশ্চিন্তে উগড়ে দেওয়ার মতো শুনশান নিরিবিলি বেলাভূমি। চোখের সামনে বিশাল জলরাশির ছলাৎছলাৎ উর্মিমালা ভীষণ গর্জন করে ধেয়ে আসছে এদিকে। যেন সাগরকন্যার অনিমেষ চালচলন। নিস্প্রভ নয়নে সেদিকে দৃষ্টি ফেললো ঈশানী। পরমূহুর্তেই চিত্তাকর্ষক ক্রন্দন ধ্বনিতে ভারী হয়ে উঠলো অমানিশার আকাশ বাতাস। কাঁদতে কাঁদতে চিকচিকে বেলাভূমিতে আচানক ধপ করে বসে পরলো মেয়েটা। তবে অভিমানী নোনাজলে দীর্ঘক্ষণ বুক ভাসানো হলো না ওর , তার আগেই দৃষ্টি গোচর হলো জটলা পাকানো মানুষের অচেনা পদযুগল। মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে তরিৎ গতিতে চোখ মুছলো ঈশানী, পরিস্থিতি বুঝে ওঠার প্রয়াসে উঠে দাঁড়ালো তৎক্ষনাৎ। আঁধারের মাঝে সুক্ষ্ম দৃষ্টিপাত করলো সম্মুখে। দেখলো, একটা আহত অবয়বকে ধরাধরি করে স্ট্রেচারে তুলছে সকলে।হাতের কাজে অবিরত থেকে উদগ্রীব স্বরে একজন আচমকা বলে ওঠে,

— তাড়াতাড়ি কর। শ্বাস এখনো আছে মনে হয়। হাসপাতালে নিতে নিতে বাঁচবে কিনা সন্দেহ।
এতোক্ষণে ঈশানী ঠাওর করলো এরা সবাই সেচ্ছাসেবী। একটু আগের ঘটনার প্রেক্ষিতে আহত লোক গুলোকে রেসকিউ করছে বোধ হয়। তখনই অন্য একজন বিধ্বস্ত স্বরে বলে ওঠে,
— ইশ! কি অবস্থা করেছে,চাপাতি দিয়ে কুঁ'”পিয়েছে ।শরীরটা একদম ক্ষতবিক্ষত, আর হাতের দিকে লক্ষ্য কর, আঙুল গুলো একটাও নেই, ভারী বস্তু দিয়ে থেতলে দেওয়া হয়েছে বোধহয় । আমার মনে হচ্ছে কেউ প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে করেছে এমনটা।
ছেলেটার কথায় ভয়ে আঁতকে উঠল সকলে, একজন চট করেই মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে বললো,
— কি বলিস, দেখিতো?
ছেলেটা মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়েছে কি জ্বালায়নি, এর মাঝে ধড়ফড়িয়ে ওঠে আরেকজন। আহত অবয়বের মুখটা গভীর চিত্তে পরখ করে হতচকিত কণ্ঠে জানায়,

— আরেহ! এটা তো বার্মিজ মার্কেটের রিদান ভাই। হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল একটা মানুষ,এতো বছরে কারোর সঙ্গে কখনো ঝামেলা হতে দেখিনি,পুরো মার্কেটে সবার খুব স্নেহের রিদান ভাই। ভাইয়ের এ অবস্থা কে করলো তাহলে?
— আঙুলের যা অবস্থা, মনে হচ্ছে প্রাণে বেঁচে গেলেও সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করে নিতে হবে।
ছলকে উঠলো হৃদযন্ত্র। অদূর থেকে রিদান নামটা শুনতেই আতঙ্কে মুখ থেকে র’ক্ত সরে গেলো ঈশানীর।শীর দাঁড়া দিয়ে বইলো শীতল ঠান্ডা স্রোত। গলা কাটা মুরগীদের মতোই উর্ধ্ব শ্বাস টেনে সেদিকে ছুটলো ঈশানী, এগিয়ে গিয়ে তাড়াহুড়ো স্ট্রেচার থামিয়ে প্রকম্পিত হস্তে ধীরে ধীরে টেনে সরালো মুখের উপরে ঢাকা দেওয়া ফিনফিনে কাপড়টা। এক মূহুর্ত, মাত্র মূহুর্তের জন্য ওর র’ক্তিম বির্বণ মুখটা দেখা মাত্রই ক্ষীণ আর্তনাদ করে ব্যগ্র পদযুগলে পিছিয়ে এলো ঈশানী।
দম বন্ধ হয়ে আসছে, কি ছিল এটা? একটু আগেও চোখের সামনে হাসিমুখে ঘুরে বেড়ানো জলজ্যান্ত মানুষটা এখন মৃ”ত্যু পথযাত্রী। সদা হাস্যোজ্জল মুখটা নিমেষেই ঢাকা পরেছে গলগলে র’ক্ত প্রবাহের অন্তরায়।
কি বী’ভৎস, কি নরকীয় এ দৃশ্য বলে বোঝানোর নয়। ফের শ্বাস টেনে তোলার বৃথা প্রচেষ্টা চালালো বিধ্বস্ত মেয়েটা, কাঁপা হাতটা আলগোছে মুখের উপর রেখে কাঁদতে কাঁদতে অস্পষ্ট আওয়াজে বিড়বিড়িয়ে বলতে লাগলো,

— কি হচ্ছে এসব? কেন আমার আশেপাশের মানুষ গুলো বারবার এভাবে আ’ঘাত প্রাপ্ত হচ্ছে? কে করছে এসব? কি চায় সেএএ!
প্রচন্ড ক্ষোভ আর অভিমানের মিশেলে, ভেতরের জড়তা ভুলে বেঘোরে গলা ছেড়ে চিৎকার করে উঠলো ঈশানী। সাগরের ভারী গর্জনের আড়ালে ওর এহেন আত্ম চিৎকার বড্ড মিহি শোনালো,
— কি চায় সে!
মৃদু শ্বাস ফেলে কম্পিত স্বরে ফের একই বুলি আওড়ালো মেয়েটা।
গভীর নিস্তব্ধতায় বিষাদিনীর ব্যথাতুর কান্নারা কুন্ডলী পাকালো নৈর্স্বগে। বাসন্তীক দমকা হাওয়ার প্রকোপে এলোমেলো হলো সর্প্লিল কেশরাশি, যেন সমগ্র ধরিত্রী একযোগে জানান দিলো,
— শুধু তোমাকে।

র’ক্তা’ক্ত চাপাতি টা গভীর সমুদ্রে ছুড়ে ফেলে,টিশ্যু দিয়ে হাত মুছতে মুছতে পেছনে ঘাড় ঘোরাতেই থমকালো তুষার। আবছায়া আলোতে অবলোকন করলো একজোড়া উচাটন অক্ষিপুট। ল্যাপ্টানো কাজলে মোড়ানো গভীর কৃষ্ণগহ্বর এদিকেই চেয়ে আছে নিস্প্রভ। প্রখর বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন তুষার এক মিনিটের অধিক সময় অতিবাহিত করলো না চোখ গুলোকে চেনার জন্য। এক মিনিট পেরুতেই অপর প্রান্তে দাঁড়ানো মানুষটার উদ্দেশ্যে থমথমে গলায় প্রশ্নবাণ ছুঁড়লো সে,

— কি চাই?
তুষারের অযাচিত বাক্যটুকু কর্ণকূহর ভেদ করতেই নড়চড়ে উঠলো নিঝুম। আড়ষ্টতায় খামচে ধরলো শাড়ির আঁচল, সবসময় গরগর করে কথা বলতে থাকা অতিউৎসাহী মেয়েটা আজ কেমন গুটিয়ে গেলো অজ্ঞাত আড়ষ্টতায়। নিঝুমের নীরবতায় ভ্রু কুঁচকালো তুষার। ফের একই স্বরে বললো,
— কি হলো, কথা নেই মুখে?
কয়েকদফা শুষ্ক ঢোক গিলে, এতোক্ষণে ম্লান আওয়াজে প্রত্যুত্তর করলো নিঝুম,
— আপনি চিনেছেন আমায়?
হাতের টিশ্যুটা অদূরে ছুড়ে ফেলে বিস্তার বেলাভূমি ধরে নিঃশব্দে হাটা ধরলো তুষার, যেতে যেতে ভাবলেশহীন স্বরে বললো,

— তুষার একবার যাকে গভীর দৃষ্টে লক্ষ্য করে,তাকে এ জীবনে ভোলে না।
তুষারের প্রত্যুত্তর শুনে ভেতর ভেতর খুশি হলো মেয়েটা। ঝরঝর করে বিলীন হলো তার আড়ষ্টতার মেকি অভিব্যক্তি ।মূহুর্তেই কথার জোয়ারে উদ্ভাসিত হলো সমগ্র অস্তিত্ব।রাতের আঁধারে জুতো জোড়া খুলে হাতে নিয়ে অজান্তেই পিছু নিলো লোকটার, সাগরের কোল ধরে এগুতে এগুতে বললো,
— আপনি জানেন, আমি আপনাকে এখানে দেখে সত্যিই খুব অবাক হয়েছি। ভাবতে পারিনি এভাবে দেখা হবে। তবে এখন মনে হচ্ছে কক্সবাজার আসাটা পুরোপুরি স্বার্থক হলো।
তুষার নির্বিকার। ওর মাঝে ভাবান্তর নেই কোনোরূপ , হাঁটছে তো হাঁটছেই।

— আপনি জানতে চাইবেন না কিভাবে খুঁজে পেলাম আপনাকে? আসলে আপনার জ্যাকেটের ব্র্যান্ড…
তুষারের শূন্য অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো নিঝুম। কথা ঘুরিয়ে বললো,
— আচ্ছা সে বাদ দিন। কেমন আছেন তাই বলুন? আপনার শুটিং এর কাজ কতদূর?
এতোক্ষণে পদধ্বনি স্থির করলো তুষার। আড়ালে অস্বস্তির তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বললো,
— এতো কথা কেন বলছো? আমি তোমাকে বলেছি, যে আমি শুটিং করি? আমাকে দেখে কি এ্যাক্টোর মনে হয়?
কথার পারদে অপ্রতিরোধ্য নিষেধাজ্ঞা। নিঝুম যথেষ্ট জ্ঞানী মেয়ে, তুষারের বিরক্তি ধরতে সময় লাগলো না ওর। তাও জড়ানো গলায় এলোমেলো শব্দযুগল উগড়ে দিলো মেয়েটা,

— না মানে আপনি সেদিন বলেছিলেন আপনি ভিলেইন… আর…
নিঝুমের কথা শেষ হওয়ার আগেই বিদ্রুপাত্তক হাসলো তুষার।বললো,
— আর তুমি ধরেই নিয়েছো যে আমি সিনেমার ভিলেইন তাইতো? রিডিকিউলাস।
অযাচিত তিরস্কারে মুখাবয়ব থমথমে হয়ে উঠলো নিঝুমের। লোকটা এতো তিক্তভাষী কেন জানা নেই ওর। সহসা ঠোঁট কামড়ে বলতে উদ্যত হলো,

— না মানে সেদিন আপনার পিছু নিয়েছিলাম….
বাক্য সম্পূর্ণ করতে পারলো না নিঝুম। বাকি কথা কণ্ঠনালীতে আটকে গেলো তুষারের কঠোর বাক্যবাণে,
— তো কি হয়েছে? আমি একবারও জানতে চেয়েছি সেদিন কেন তুমি আমার পিছু নিয়েছিলে? এসব তুচ্ছ জিনিস জানানোর জন্য এতো নাচানাচি করার কি কারণ? অযথা বিপদকে গ্রাস করতে এসোনা, অস্তিত্বহীন হয়ে পরবে।
শেষ কথাতে ধারালো কতৃত্ব।দিশাহীন তার গভীরতা।
মূহুর্তেই আঁধার ঘনালো দু’চোখে।অশ্রুসিক্ত নয়ন জোড়া সাবধানে আড়াল করলো নিঝুম। বহু কসরতে গলার আওয়াজ সাবলীল রেখে কাতর স্বরে বললো,

— কতগুলো দিন সি আর বি তে অপেক্ষা করেছিলাম জানেন? ভেবেছি আবার হয়তো দেখা পাবো। পৃথিবীটা তো গোলাকার একই মানুষের সঙ্গে বারবার দেখা হওয়াটা তো অসম্ভব কিছু নয়। তাই না?
নিঝুমের কথায় তোয়াক্কা না করে আঙুলের ফাঁকে সিগারেটের শলাকা ধরিয়ে ফের হাঁটা ধরলো তুষার, যেতে যেতে জবাব দিলো,
— ভুল করেছো।নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট করে এভাবে অপরিচিত একজন মানুষের জন্য অপেক্ষা করা মোটেই উচিৎ হয়নি। হতেও তো পারে মানুষটা তোমার ভাবনারও উর্ধ্বে, তোমার সুন্দর কল্পনার অনলে ধোঁয়াসা আবৃত তার অভিশপ্ত বাস্তবতা।
তুষারের গম্ভীর আচরণে খুব একটা ভাবান্তর দেখা গেলোনা নিঝুমের মাঝে। আবারও বেখেয়ালে লোকটার পিছু নিলো সে,মোলায়েম বেলাভূমিতে নিরিবিলি কদম ফেলে বললো,

— উহুম, মোটেই ভুল করিনি। মনের টান ছিল বলেই আবারও দেখা হলো আমাদের।
আরেকদফা থমকালো তুষার।ঘাড় বাঁকিয়ে পেছনে দৃষ্টিপাত করে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলো নিঝুমের আগমনী পদযুগলের উপর৷ রাশভারি আওয়াজে বলে উঠলো,
— ওখানেই থামো। আর এক পা ও এগোবে না।
অকস্মাৎ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পরলো নিঝুম। ভ্রু কুঞ্চন করে তুষার শুধালো,
— তখন থেকে আমার পেছন পেছন আসছো। কোথায় যাচ্ছো তুমি?
অপ্রস্তুত পদধ্বনি থমকে গেলো নিঝুমের। তাৎক্ষনিক ভাবনার জগত ছাপিয়ে ছিটকে বাস্তবতায় বেড়িয়ে এলো মেয়েটা। নিগূঢ় আঁধারের মাঝে চারিদিকে শঙ্কিত দৃষ্টি ফেলে হতচকিত কণ্ঠে বলে উঠলো,

— সত্যিই তো এটা কোথায়?
ঈষৎ মেঘে ঢাকা ধূসর আকাশ। গভীর রাতের নৈঃশব্দ্য শ্লোগানে চারিপাশে ম্লান জ্যোতি ছড়াচ্ছে টিমটিমে নক্ষত্ররাজি। দূর আকাশের সেই নিয়ন আলোতে চারিদিকে অবলোকন করলো নিঝুম। বেখেয়ালে হাটতে হাটতে ইনানী ছাড়িয়ে বহুদূর চলে এসেছে ও। সন্ধ্যা রাতের লোমহর্ষক ঘটনার পরে পুরোপুরি পর্যটক শূন্য নিস্তব্ধ সমুদ্র তট। বেলাভূমি ছাড়িয়ে কয়েক ক্রোশ অদূরে লক্ষ্য করেও কোনোরূপ লোকালয়ের দেখা মিললো না, নেই কোনো স্ট্রিট লাইটের উপস্থিতি। এটা কোনো চরাঞ্চল হবে হয়তো। কিন্তু নিঝুম তো ভালো মতো কিছুই চেনেনা এখানকার।
অবিশ্বাস্য নজরে এদিকে ওদিকে দৃষ্টিপাত করে ভয়ার্ত ঢোক গিললো নিঝুম। অতঃপর কোনোকিছু না ভেবেই নতুন উদ্যমে পিছু ডাকলো তুষারকে,

— শুনছেন!
রিনরিনে মেয়েলি আওয়াজে অসহায়ত্বের ছাঁপ সুস্পষ্ট। অগত্যা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পেছনে ঘুরলো তুষার। ভ্রু কুঞ্চন করে বিরক্তির আওয়াজে শুধালো,
— আবার কি হয়েছে?
দ্রুত গতিতে ছুটে এলো নিঝুম। কোনোরূপ দ্বিধাবোধ না করেই অনুনয়ের স্বরে বললো,
— আমাকে একটু এগিয়ে দিন।
— এগিয়ে দিন মানে? এখানে কি আমি তোমায় নিয়ে এসেছিলাম?
না সূচক মাথা নাড়ালো নিঝুম। বড্ড সংকোচ নিয়ে জানালো,
— আমি এখানকার স্থানীয় নই। খালামনির বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। তারউপর এতো রাত হয়ে গিয়েছে, কিচ্ছু চিনতেও পারছি না। ঈশু বোধ হয় বাড়ি ফিরে গিয়েছে। এদিকে আমাকে দেখুন, কোন দিক দিয়ে এসেছিলাম সেটাও ভুলে বসে আছি ।
মুখে কোনোরূপ ভাবান্তর প্রকাশ পেলো না তুষারের। বরং বালুর আস্তর পায়ে মারিয়ে নির্বিগ্নে এগিয়ে যেতে লাগলো সে । ওদিকে স্থির চিত্তে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো নিঝুম। ভাবতে লাগলো,

— লোকটা বোধ হয় এগিয়ে দিতে আগ্রহী নয় । আমি একটু বেশিই আশা করে ফেলেছি।
খানিকবাদে তুষারের অযাচিত কণ্ঠস্বরে বেখেয়ালি ভাবনার সুতো ছিঁড়ে যায় নিঝুমের। সম্বিত ফিরে এলে লোকটার কথায় মনোযোগ স্থির করলো নিঝুম।
— দাঁড়িয়ে পরলে যে? এর মধ্যে খালা বাড়ির ঠিকানা মনে পরে গেলো?
তুষারের কথায় স্বস্তির হাসি হাসলো নিঝুম। লোকটার পদধ্বনি অনুসরণ করে একছুটে গিয়ে দাঁড়ালো ওর পাশে।
বলিষ্ঠ পুরুষের লম্বা লম্বা পায়ের ছন্দে তাল মেলানোর প্রয়াসে জোড়ালো কদমে এগুতে এগুতে অতি অভ্যস্ত স্বরে শুধালো,
— আপনি এতো ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে কথা বলেন কেন বলুন তো? সব মাথার উপর দিয়ে যায়।
— জানিনা।
হাটার গতি অবিচল রেখে, বিশাল জলরাশির পানে নির্নিমেষ চেয়ে ছোট্ট করে জবাব দেয় তুষার।

গভীর রাত। বিষণ্ণ পদযুগলে বাড়ির অভিমুখে এগুচ্ছে ঈশানী। দিশাহীন নিরুদ্দেশ তার একেকটি সুক্ষ্ম পদধ্বণি। বাড়ির অতি পরিচিত নাম্বার থেকে কল আসতে আসতে এক পর্যায়ে ঝিমিয়ে পরেছে মুঠোফোন। এককোণের কটকটে লাল এ্যারো চিহ্ন অবিলম্বে জানান দিয়ে যাচ্ছে, এখন তার নিভু নিভু আয়ুষ্কাল। অতি শীঘ্রই ঘনিয়ে আসবে অন্তিম প্রহর ।তাতেও কোনোরূপ হেলদোল নেই ঈশানীর মাঝে। সন্ধ্যা রাতে এতো এতো কাহিনী তারউপর রিদানের ওমন বীভৎস ক্ষ’তবিক্ষত মুখাবয়ব,সবকিছু মিলিয়ে বিধ্বস্ত মেয়েটা। ভীষণ দুশ্চিন্তায় ভারাক্রান্ত মস্তিষ্ক। হৃদয়ে অদৃশ্য র’ক্তক্ষরণ। মনের ব্যথাকে আলগোছে চাপা দিয়ে নীরবে হাঁটছে মেয়েটা।
রিদানের ওই নৃ’শংস পরিণতি ওকে ভেতর থেকে এতোটাই নাড়িয়ে দিয়েছে যে সেই ইনানী থেকে বিস্তার সড়ক অবধি একনাগাড়ে নিদারুণ অনুসরণকারী অবয়বটাকে খেয়ালই করেনি ঈশানী। আগন্তুকের প্রতিটি পদধ্বনি ছিল টালমাটাল। কখনো কখনো ঈশুর খুব কাছে, আবার কখনো অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ চোখে যুবতী মেয়েটাকে অবলোকন করছে সে। বেশ কৌশলের সাথে অতিক্রম করছে রাস্তার প্রতিটি মোড়।

তবে খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হলোনা তার এই অনুসরণ কৌশল। মস্তিষ্কের স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে না পেরে, শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হুট করে হাতের মাঝে থাকা বিয়ারের ক্যানটা পরে গেলো রাস্তায়।মূহুর্তেই ঝনঝন করে মুখরিত হলো নিস্তব্ধ চারিপাশ। অন্ধকার নিরিবিলি রাস্তায় এহেন তীক্ষ্ণ আওয়াজ সোজা গিয়ে ঝঙ্কার তুললো ঈশানীর কানে। অকস্মাৎ আওয়াজে ছলকে উঠলো হৃদয়।বেমালুম ভয়ের তোড়ে তিরতিরিয়ে প্রকম্পিত হলো সর্বাঙ্গ। তৎক্ষনাৎ সচকিত হয়ে ধীর গতিতে পেছনে চোখ ঘোরালো ঈশানী। দেখলো ওর খুব কাছেই দাঁড়িয়ে আছে ভি আই পি গোছের ষাটোর্ধ একটা লোক। নেশার তোড়ে বুদ হয়ে আছে সে। মাঝ সমুদ্রের তরঙ্গোচ্ছ্বসের মতোই এদিক ওদিক দোল খাচ্ছে তার ভারী মস্তক।

গভীর রাতে শুনশান নিরিবিলি রাস্তায় এহেন নেশাগ্রস্ত মানুষের উপস্থিতি লক্ষ্য করে আঁতকে উঠলো ঈশানী। লোলুপ দৃষ্টে এদিকেই চেয়ে আছে লোকটা। অভিব্যক্তিতে তার ভীষণ ধূর্ততা। নিটোল দর্শনে এক মূহুর্ত পরখ করে কোনোরূপ সময় নষ্ট করলো না ঈশানী। আশেপাশের কোনোকিছু পরোয়া না করে ভারী পদযুগলে এগুতে লাগলো সম্মুখে। ঈশানীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটার গতি দিগুণ করলো লোকটা।ফলস্বরূপ খুব বেশিদূর যাওয়ার আগেই ওর ছাঁয়া অতিক্রম করলো অবয়বটি। অবশেষে আতঙ্কের চরম সীমানায় পৌঁছে দিয়ে অকস্মাৎ টেনে ধরলো ঈশানীর শাড়ির আঁচল।তৎক্ষনাৎ রিনঝিন করে উঠলো আঁচলে লাগোয়া এরীশের মেটালিক ব্রেসলেটটা।

— এটা কি ?
তমশার মাঝে টলতে টলতে ব্রেসলেটটার পানে গভীর দৃষ্টিপাত করে অস্ফুটে বলে ওঠে সে। সঙ্গে সঙ্গে এক ঝটকায় লোকটার হাত থেকে আঁচল সরালো ঈশানী,ভেতরের ভয়ডর একপাশে রেখে কর্কশ গলায় ঝাঁঝিয়ে উঠলো মেয়েটা,
— সমস্যা কি? তখন থেকে আমাকে ফলো কেন করছেন? যেদিক থেকে এসেছেন সেদিকে যান। এক্ষুনি যান।
অন্ধকারের মাঝে আঙুল উঁচিয়ে রিসোর্টের পানে ইশারা করলো ঈশানী। ঈশানীর ইশারায় একপল পেছনে দৃষ্টিপাত করে খ্যাঁক খ্যাঁক করে ক্রূর হাসলো লোকটা। বিশ্রী হাসির আওয়াজে ভড়কালো ঈশু।বিতৃষ্ণ নয়নজুড়ে ঘনীভূত হলো আতঙ্ক। কিয়ৎক্ষন পরে হাসি থামালো সে, মাতাল ভঙ্গিতে বললো,

— সুগার ড্যাডিকে পছন্দ হয়নি মামুনি?সুগার ড্যাডি তোমায় অনেক টাকা দিবো, চলো রিসোর্টে চলো।
— অসভ্য লোক, বুড়ো ভাম, জুতো খুলে মা’রবো। নিজের মেয়েকে গিয়ে এসব অফার কর শালা।
চটে গেলো ঈশানী। এক নাগাড়ে কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে ফের হাঁটা ধরলো ও।তৎক্ষনাৎ সামনে থেকে ওর পথ আটকালো লোকটা, এদিকে ওদিক মাথা নাড়িয়ে বললো,
—উহুম! আজ তো আর তোমায় বাড়ি ফিরতে দেবোনা মামুনি।তুমি বাড়ি চলে গেলে আমাকে সুখ দেবে কে? দেখো, রাস্তায় একটাও মেয়ে নেই।
এদিক ওদিক চোখ বোলালো ঈশানী। সত্যিই চারপাশ মানব শূন্য। একটা পাতা পরার টুপটাপ আওয়াজও হচ্ছে না কোথাও। হাতের ফোনটা বন্ধ হয়ে পরে আছে, এমতাবস্থায় লোকটার সঙ্গে অযথা মেজাজ দেখানো মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়, সহসা দমলো রমনী। গলার স্বর খাদে নামিয়ে লোকটাকে বললো,

— দেখুন আঙ্কেল আমি মোটেও ওই সব মেয়ে নই। ভদ্র পরিবারের মেয়ে আমি। বুঝেছেন? তাই দয়া করে রাস্তা মাপুন।
— ভদ্র বলেই তো এতো খাতির করছি।
বাক্য শেষ হতে না হতেই খপ করে ঈশানীর হাত টেনে ধরলো নেশাগ্রস্ত লোকটা। মূহুর্তেই ভয়ের তোড়ে শরীর ছমছম করে উঠলো ঈশুর। উবে গেলো বক্ষপিঞ্জরের অদম্য আত্নবিশ্বাস।নিজের হাত ছাড়ানোর ব্যগ্র প্রচেষ্টায় উঠেপড়ে লাগলো মেয়েটা,উদগ্রীব স্বরে বলে উঠলো,

— আমি আপনার মেয়ের বয়সই, এটা করবেন না আঙ্কেল। আমি জানি আপনি হয়তো নেশার ঘোরে এসব অনৈতিক কাজ করছেন, কিন্তু এটা মোটেও সমীচীন নয়। দয়া করে হাতটা ছাড়ুন।
ঈশানীর কথায় বিন্দু পরিমাণ হেলদোল হলোনা লোকটার, বরং মজার ছলে ফের অন্য হাতটা টেনে ধরলো সে । কৌতুক হেসে বললো,
— মেয়ের বয়সই। মেয়ে তো আর নও। তাছাড়া কচি জিনিস বরাবরই বেশ পছন্দ আমার।
শেষ কথাটা বলতে না বলতেই লোকটার মুখের উপর থু থু ছুড়ে মা’রলো ঈশানী। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বড্ড হেয়ালি করে মুখের ময়লাটুকু পরিস্কার করলো লোকটা। অতঃপর ভীষণ ক্রোধান্বিত হয়ে চোখ রাঙিয়ে বললো,
— আমি কে জানিস? জানিস না তো? চল বোঝাবো তোকে আমি কে।

তীক্ষ্ণ হস্তে ঈশানীর চুলের গোছা মুঠোয় নিলো সে। শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে মেয়েটাকে হেনে হিঁচড়ে গাড়ির কাছে নিয়ে যাওয়ার পায়তারা করতে লাগলো ক্রমশ। রাগের তোপে ফোঁস ফাঁস করে গজরাচ্ছে সে। অপ্রতিরোধ্য বৈরী আচরণে অচিরেই ভেঙে পরলো মেয়েটা। অপারগ কান্নার জোয়ারে নিমেষে অশ্রুসিক্ত হলো নীলাম্বরী দু’নয়ন। চেষ্টার কমতি না রেখেও লোকটার সঙ্গে কিছুতেই শক্তিতে পেরে উঠছে না ঈশানী। অগত্যা অনুনয় করছে অহেতুক,

— আঙ্কেল দয়া করে ছেড়ে দিন। আপনি আমার বাবার মতো।
লোকটা ছাড়লো না, চুল ধরে টানতে লাগলো জোর হস্তে। ঠিক তখনই আগন্তুক মার্সিডিজের হেড লাইডের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে উঠলো ওদের। সেই সঙ্গে একচ্ছত্র হর্ণের তীক্ষ্ণ আওয়াজে ঝালাপালা হলো কর্ণকূহর। মাত্রাতিরিক্ত আওয়াজে একহাত কানে আবদ্ধ করে তৎক্ষনাৎ চোখ বুজলো ঈশানী। ওদিকে মানুষের উপস্থিতি টেরে পেয়ে হাতের বাঁধন ঢিলে করলো লোকটা। শুষ্ক ঢোক গিলে অস্পষ্ট আওয়াজ বের করলো মুখ থেকে,
— কে!
ওপাশ থেকে জবাব এলোনা কোনোরূপ, হর্ণের আওয়াজ বন্ধ হলো এবার। হর্নের আওয়াজ বন্ধ হতেই তরাগ করে চোখ খুললো ঈশানী, হেডলাইনের তীর্যক দ্যুতিতে ফকফকে পরিস্কার দৃশ্যপট, সহসা লোকটার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে, ঈশানী একছুটে চলে গেলো গাড়ির নিকট। লাগোয়া টিন্ডেড জানালায় টকটক আওয়াজে কড়া নেড়ে বললো,

— ভেতরে কে আছেন। প্লিজ হেল্প করুন। এই নেশাগ্রস্ত লোকটা তখন থেকে অসভ্যতা করছে। উইন্ডো নমিত হলোনা জানালার,বরং ঠাস করে খুলে গেলো গাড়ির দরজা।
আচানক কাণ্ডে দু’কদম পিছিয়ে গেলো ঈশানী। আলো আঁধারীর মাঝে দৃশ্যমান হলো লম্বা মতো চমৎকার এক পুরুষালি অবয়ব। না, লোকটা এরীশ নয়। এরীশের মতো মেদহীন এ্যাবস যুক্ত পেটানো শারীরিক গঠন না হলেও ছিমছাম গড়নের লম্বাটে সুদর্শন যুবক সে। পড়নে গ্রে সোয়েট শার্ট,আর ব্যাগী ডেনিম, পায়ে হোয়াইট স্নিকার্স। ঝরঝরে চুলের মাঝে ঈষৎ বাদামি প্রলেপ তার, তবে মাস্কের কারনে মুখ দেখার জো নেই। আর নাতো এমন একটা টানাপোড়েন সময়ে ঈশানীর তাকে দেখার আগ্রহ জেগেছিলো কোনোরূপ। লোকটা গাড়ি থেকে নেমে এলে ক্রন্দনরত ঈশানী সাহায্যের অনুনয় করলো ফের।

— আমাকে একটু হেল্প করুন প্লিজ!
তৎক্ষনাৎ মুখের উপর থেকে আলগোছে মাস্ক সরালো লোকটা, সম্মোহনী হেসে মেয়েটাকে ধাতস্থ করে বললো,
— চিন্তিত হবেন না, আমি আছি তো।
চেহারার মতোই চমৎকার তার শিশু সুলভ মৃদু হাসির তোরণ ।অথচ লোকটাকে দেখে অহেতুক ভ্রু কুঁচকালো ঈশানী। আশ্চর্য হলেও মুখটা ভীষণ চেনাচেনা ঠেকলো ওর নিকট, কিন্তু মানুষটা তো অপরিচিত। হতেও পারে মার্কেটের কোনো কাস্টমার। ফলস্বরূপ খুব বেশি ব্যতিগ্রস্ত হলোনা ঈশানী, আজেবাজে চিন্তা মাথা থেকে বের করে ফের চোখ ঘোরালো সম্মুখে। হেডলাইটের একচ্ছত্র আলোয় কোথাও উপস্থিতি নেই মাতাল লোকটার। বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ঈশানী। চকিতে বলে উঠলো,

— আশ্চর্য! গেলো কোথায় অসভ্য লোকটা?
পুনরায় মৃদু হাসলো বিপরীত প্রান্তের যুবক । নদীর মতো শান্ত স্বরে বললো,
— পালিয়েছে বোধ হয়।
স্বস্তিতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ঈশানী। হাতের পিঠ দিয়ে নীরবে চোখের জলটুকু মুছতে মুছতে বললো,
— আপনার জন্য খুব বড় বিপদ থেকে বেঁচে গেলাম আজ। ধন্যবাদ আপনাকে।
লোকটা জবাব দিলোনা। দ্বিধাহীন নজরে বিমুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো মেয়েটার টলমলে নীল চোখের পানে। নিস্প্রভ নয়নে বিমোহিত অভিব্যক্তি তার। চোখের মাঝে অবাক দৃষ্টি ধরে রেখে অস্ফুটে বলে উঠলো,
— ব্লু আইড! ইন্টারেস্টিং!
— কিছু বললেন?

অস্পষ্ট আওয়াজের বিপরীতে প্রশ্ন ছুড়লো ঈশানী। অকস্মাৎ মেয়েলি কণ্ঠের দাপটে ধ্যান ভাঙলো যুবকের। তৎক্ষনাৎ এপাশ ওপাশ মাথা নাড়িয়ে না জানালো সে। বড্ড বেশি নাজুক দেখালো তার ভাবাবেগ। যেন কোনো কিছুর চৌম্বকীয় আসক্তিতে টালমাটাল তার অস্তিত্ব। ঈশানী কথা বাড়ালো না আর, ধীর গতিতে পা বাড়ালো সামনে। তৎক্ষনাৎ পিছু ডাকলো লোকটা,

— গাড়িতে উঠুন, আমি এগিয়ে দিচ্ছি।
ঈশানী পিছনে ঘুরলো ঠিকই, তবে হ্যা না কিছুই বললো না। বিনাবাক্যে দাঁড়িয়ে রইলো শুধু। মেয়েটার দ্বিধাগ্রস্ততা আঁচ করতে পারলো যুবক। সহসা গ্রীবা নামিয়ে গাড়ির জানায় উঁকি দিয়ে কাউকে জানালো,
— তুমি গাড়ি নিয়ে রিসোর্টে ফিরে যাও তুর্য। আমি ওকে এগিয়ে দিয়ে আসছি।
তৎক্ষনাৎ বাঁধ সাধলো তুর্য, বললো,
— কিন্তু মাহিন ভাই।
— কিন্তু নয়, যা বলছি তাই করো। এভাবে একা একটা মেয়েকে রাস্তায় বিপদের মধ্যে ফেলে আমি ফিরে যেতে পারি না।

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো তুর্য। মাহিনের কথায় সায় জানিয়ে হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে জানালো,
— ঠিকাছে। রিসোর্টে ফিরে গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি আমি। প্লিজ না করো না ভাই। তোমাকে এভাবে রাস্তায় ফেলে গিয়েছি জানলে কোম্পানি আমার চাকরি খেয়ে নিবে।
নিঃশব্দে হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে তুর্যকে বিদায় জানালো মাহিন। অতঃপর দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো ঈশানীর নিকট। আস্বস্ত স্বরে বললো,
— চলুন এগিয়ে দিচ্ছি।
প্রত্যুত্তর করলো না ঈশানী,হাঁটতে লাগলো নৈঃশব্দ্যে।

পকেটে দু’হাত গুঁজে পায়ে পায়ে এগুলো মাহিন। নীরব পদযুগলে হাঁটতে থাকা মেয়েটার পানে আপাদমস্তক একপল চোখ বুলিয়ে গলা খাঁকারি দিলো সে । পুরুষালি আওয়াজটুকু কর্ণকূহর ভেদ করতেই মাহিনের পানে দৃষ্টিপাত করে ঈশু। মাহিন সময় নষ্ট করলো না, চট করেই জিজ্ঞেস করলো,
— ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আমি কি জানতে পারি আপনার হাতে কি হয়েছে?
মাহিনের কৌতূহলী দৃষ্টি অনুসরণ করে, হাতের পানে চাইলো ঈশানী। দু’টো হাতের কব্জিতেই জমাট বেঁধেছে র’ক্তের বেগুনি প্রলেপ। এটা সন্ধ্যা রাতের ঘটনা,তখন রাগান্বিত হয়ে এরীশ চেপে ধরে রেখেছিল অনেকক্ষণ। ফলস্বরূপ পুরুষালি হাতের পোক্ত বাঁধনে কোমল হাত দুটোর এই হাল। তখনকার কথা ভেবে তপ্ত শ্বাস ছাড়লো ঈশানী। মেয়েটার অহেতুক নির্জীবতা ভাবালো মাহিনকে। কৌতুহলের পারদ দিগুণ হলো ওর। সহসা হাটতে হাটতে ফের বলে উঠলো,

— ইউর স্মেল ইজ লাইক ব্যাড বয়।
থমকালো ঈশানী। তরিৎ বেগে লোকটার পানে ঘাড় ঘুরিয়ে শুধালো,
— কিহ!
— আই মিন ইউর স্মেল ইজ লাইক ক্যারোলিনা হেরে্রা ব্যাড বয়। আমার জানা মতে এই স্মেলটা ছেলেরা বেশি প্রেফার করে। মেইবি আজকাল মেয়েরাও।
কথা শেষ করে ভাবলেশহীন ভঙ্গিমায় ঠোঁট উল্টালো মাহিন।
মাহিনে কথায় কিঞ্চিৎ ইতস্তত হয়ে নাক দাবিয়ে নিজের শরীরের গন্ধ নিলো ঈশানী। পুরুষালি ক্লোনের মাদকীয় এক সুঘ্রাণ। তবে এটা ঈশানীর নয়, এরীশের। তখন এরীশ বেশ কয়েকবার নিজের বাহুতে আবদ্ধ করেছিল ওকে। মনের মাঝে হাজার ক্রোশের দূরত্ব থাকলেও দু’জনার মাঝে বাহ্যিক দূরত্ব ছিলনা খুব একটা। যার দরুন ঈশানীর সর্বাঙ্গ জুড়ে এখন লেপ্টে আছে অপ্রিয় পুরুষের শরীর থেকে নির্গত মাদকীয় সেই সুঘ্রাণ। সবকিছুতে এরীশ,কেন যেন নির্দয় মানুষটাকে অতীত হিসেবে জিয়িয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না আর,ভাগ্যক্রমে দুঃসহ স্মৃতির গণ্ডি পেরিয়ে বারংবার জুড়ে যাচ্ছে বর্তমানে । বিতৃষ্ণায় চিড়বিড়িয়ে উঠলো ঈশানীর ভারী মস্তিষ্ক। তখনই নতুন উদ্যমে বলতে আরম্ভ করলো মাহিন,

—- ইউ নো, মানুষের টেষ্টবাড অনেকাংশে নির্ভর করে তাদের পারফিউমের উপর। এ্যান্ড আই থিংক ইউ লাইক ওয়াইল্ড ম্যান। না মানে আপনার ফ্র্যাগরেন্স তো তাই বলে।
সঙ্গে সঙ্গে ভ্রু উঁচালো ঈশানী, খানিক অপ্রস্তুত হয়ে তেঁতো গলায় বললো,
— আপনি যা ভাবছেন তেমন কিছুই নয়। এটা শুধুই একটা কো-ইন্সিডেন্ট ছিল মাত্র।
কথার জোয়ারে লাগাম টানলো মাহিন, ঈশানীও দাঁড়ালো না আর। কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে পায়ের গতি বাড়ালো সে। রমনীর নাজুক গতিতে পা মেলালো মাহিন,প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,
— আপনি খুব কম কথা বলেন মনে হচ্ছে।
— ঠিকই ধরেছেন।
কাটকাট জবাব এলো ওপাশ থেকে। পরপরই হাঁটার গতি স্থির করে দাঁড়িয়ে পরলো ঈশানী, ভূতুরে দূর্গের ন্যায় স্থবির দাঁড়িয়ে থাকা পেছনের পুরনো বাড়িটাকে ইশারা করে বললো,

— এটাই আমার বাড়ি। এতোটা পথ এগিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আপনি ফিরে যেতে পারবেন তো?
— সিওর।
ছোট্ট জবাবে এ পর্যায়ে কথার ইতি টানলো মাহিন। চোখের পলকে তাকে ধাতস্থ করে গেট ছাড়িয়ে বাড়ির লনে প্রবেশ করে ঈশানী, তখনই পিছু ডাকলো যুবক। জিভের ডগায় আলতো ঠোঁট ভিজিয়ে জানালো,
— আঁচলের সঙ্গে কিছু একটা আঁটকে আছে আপনার ।
নিগূঢ় নয়নে আঁচলের পানে চাইলো ঈশানী, রঙিন সুতোয় জুতসই আঁটকে থাকা ব্রেসলেট টাতে অহেতুক হাত বুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো ,
— জানি!

সন্তুষ্টির ছিটেফোঁটা নেই মাহিনের মাঝে। অযাচিত কারন বশত ভেতর ভেতর হাসফাস করছে ছেলেটা।এক পর্যায়ে সংকোচের ইতি টেনে দ্বিতীয় বারের মতো ডেকে উঠলো মেয়েটাকে। ফের ঘুরে দাঁড়ালো ঈশানী। শুধালো,
— কিছু বলবেন?
— তোমার.. না মানে আপনার নামটা জানতে পারি?
বড্ড ভীড়ু শোনালো মাহিনের কণ্ঠস্বর।ইতস্ততায় ঠাসা।
— ঈশানী, ঈশানী তুজ কর্ণিয়া।
ভদ্রতার খাতিরে আনমনে প্রত্যুত্তর করে তাড়াহুড়ো বাড়ির ভেতর চলে গেলো ঈশানী। ওদিকে নামটা শোনা মাত্রই হতচকিত হলো মাহিনের দু’নয়ন। অযাচিত ভাবনায় বুদ হয়ে একাই বিড়বিড়ালো সে,
— এটা সেই মেয়েটা না তো? হলি শীট!

রাত তখন গভীর। বিস্তৃত সমুদ্র তট থেকে অচিরেই ভেসে আসছে উর্মিমালার ভয়াল গর্জন। সমগ্র ইনানী জুড়ে বিরাজ করছে ভয়াবহ নিস্তব্ধতা। রিসোর্টের সবকটা জানালার কাচ নামানো, চারিদিকে হিমেল হাওয়ার অসহনীয় উৎপীড়ন। আজ রাতের অন্তিম নৃ”শংসতার ইতি টেনে মাত্রই কক্ষে প্রবেশ করেছে এরীশ। হাতে তার র”ক্ত রঞ্জিত ধারালো কু”ঠার। দু’হাত বেয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পরছে তরতাজা র”ক্তস্রোত। উজ্জ্বল কঠিন মুখমণ্ডল থেকে শুরু করে সমগ্র শরীর জুড়ে জবজবে তাজা র’ক্তের নিদারুণ অস্তিত্ব। আগামীকাল প্রথম প্রহরেই যে কক্সবাজারে কোনো এক অজ্ঞাত মানবের বীভৎস লা’শের সন্ধ্যান পাওয়া যাবে, সে ধারণা সুস্পষ্ট। কিন্তু কার?
কিয়ৎক্ষন সময় নিয়ে চোখ বুঁজে গভীর শ্বাস টানলো এরীশ। অতঃপর ভেতরের আহত বাতাসটুকু নির্বিকারে বের করে, অদূরে ছুড়ে মা’রলো হাতের র’ক্তাক্ত মার’ণাস্ত্র টা।পরপর শরীর থেকে টেনেটেনে খুলতে লাগলো র’ক্তে ভেজা শার্ট, স্যান্ডো গেঞ্জি সবকিছু। র’ক্তসিক্ত কাপড় গুলো মেঝেতে ফেলে সফেদ বিছানায় গা এলিয়ে দিলো এরীশ। সটান হয়ে নয়,বরং পায়ের অংশ এখনও মেঝেতে ছুঁই ছুঁই তার। সেভাবেই ভয়াল নিস্তব্ধতায় কেটে গেলো বেশ কিছু প্রহর। এক পর্যায়ে অসহনীয় এই নীরবতার ইতি ঘটালো মাফিয়া বস। ফোনের পাওয়ার অন করে বিনাবাক্যে ডায়াল করলো কাউকে। রিং হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফোন রিসিভ করলো অপর পক্ষ। ঘুমঘুম ভারী আওয়াজে বললো,

— ইজ এ্যানিথিং রং এরীশ?
— ইয়েস।
তিন অক্ষরের ক্ষুদ্র শব্দটি শ্রবনেন্দ্রিয় ভেদ করতেই শোয়া ছেড়ে হকচকিয়ে উঠে বসলো তুষার। ঘুমের গোষ্ঠী চুলোয় দিয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে বলে উঠলো,
— হোয়াট হ্যাপেন্ড!
— আমি সাকুরাকে দেখতে চাই। রাইট নাও।
দ্বিধাহীন নির্বিকার জবাব এরীশের। ওর জবাব শুনে অবাকের চরম সীমানায় পৌঁছালো তুষার, অবিশ্বাস্য গলায় বললো,
— আর ইউ ইনসেইন এরীশ?
— নো আ’ম নট।
— তাহলে এতো রাতে সাকুরাকে কেন খুজছেন? আমরা বিডি তে আছি ভুলে গেলেন? এখানে চেরিব্লোসম কোথায় পাবো?
তুষারের জুতসই হেয়ালিপনা মূহুর্তেই ধরে ফেললো এরীশ।সহসা কথার পারদে গাম্ভীর্য টেনে বললো,
— আর ইউ কিডিং উইথ মি তুষার?
জোরপূর্বক কেশে উঠলো তুষার। গলার স্বর খাদে নামিয়ে অসহায়ের মতো বললো,

— এটা ঘুমানোর সময় এরীশ। এখন ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবেনা? না মানে সকালেও তো…
কথাশেষ করতে পারলো না তুষার। তার আগেই মুখের উপর বেপরোয়া বাক্য ছুড়ে মা’রলো এরীশ।
— আই ডোন্ট কেয়ার।
আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো তুষার।বললো,
— একটা কথা বলি এরীশ?
— বলে ফেলো।
— মানুষ প্রেমে পরলে তার আচার-আচরণে একটু একটু হিরোদের বৈশিষ্ট্য প্রস্ফুটিত হয়। আর আপনি দিন দিন ভিলেইন হয়ে উঠছেন।
তুষারের কথায় নির্বিগ্ন এরীশ। কেবল শূন্য অভিব্যক্তিতে জানালো,
— আমার গল্পে ভিলেইন হিরো দু’টোই আমি। এখানে থার্ডপার্টির কোনো চান্স নেই।

মাঝরাতে নির্ঘুম ঈশানী। পুরো বাড়িতে ওই একটা ঘরেই আলো জ্বলছে টিমটিমিয়ে। আজ রাতটা বড্ড বিভীষিকা ময়। একের পর দূ’র্ঘটনা ঘটেই গেলো শুধু । চোখের সামনে এতো এতো কাহিনী ঘটার পরে বাড়িতে ফিরে মায়ের অনর্গল তিক্ত ভৎসনা। সব মিলিয়ে দু’চোখ হারিয়েছে ঘুমের ক্লেশ। রুমে ফিরে ঘণ্টা খানিক একধারে চোখের জল বিসর্জন দিয়ে অবশেষে গোসলে ঢুকেছে বিষাদীনি। শরীরটা ভিজিয়ে এলে ঘুমের যদি দয়া হয় মোটে।
এরই মাঝে খোলা জানালা ভেদ করলো সুঠাম দেহী বলিষ্ঠ এক অবয়ব। ওভার সাইজ কালোহুডি, বেসবল ক্যাপ,আর মাস্কের অন্তরালে আগাগোড়া মোড়ানো সে। হুডিটার বুকের কাছের চেইনটা খানিক খোলা, যার দরুন তার গৌড় বর্ণের ঢেউ খেলানো বক্ষদেশ স্পষ্ট দৃশ্যমান। রুমে প্রবেশের পর রয়েসয়ে এদিক ওদিকে নির্লিপ্তে চোখ ঘোরালো সে। চোখেমুখে দ্বিধাহীন নির্জীবতা, যেন রুমের মালকিন আদতে কোথায় আছে তা অবগত সে।

সহসা একটু একটু করে সামনে এগুলো অশরীরীর ন্যায় যান্ত্রিক পদযুগল। ভেতরের দিকে কয়েক কদম এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সুপরিচিত ভ্যানিলার মোহিত সুবাসের এক তরঙ্গোচ্ছ্বাস খেলে গেলো আগন্তুকের সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে । মাস্কের আড়াল থেকে বিমোহিত শ্বাস টেনে সেই সুঘ্রাণ টুকু আহরণ করলো আগন্তুক,পরপরই তার দৃষ্টি স্থাপিত হলো মিনি কেবিনেটের উপর সাজিয়ে রাখা একগুচ্ছ রাঙা গোলাপে। তৎক্ষনাৎ চোখের আবহ বদলে গেলো মানবের, চিরাচরিত কঠোর পাশবিক রূপ ধারণ করলো সেগুলো। মাফিয়া বসের হৃদয়হীন সত্তারা মূহুর্তেই জাগ্রত হলো অস্তিত্বে। অগত্যা দাপুটে কদমে ফুল গুলোর দিকে এগিয়ে গেলো এরীশ, অতঃপর এক ঝটকায় সবগুলো ফুল মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে সেগুলোকে বুটের নিচে পিষতে লাগলো অহর্নিশ। যেন এগুলো ফুল নয়, এরীশের চিরস্থায়ী শত্রুদের চিতিয়ে দেওয়া প্রসস্থ বুক।

নিজের কাজে অবিরত এরীশ। এরই মাঝে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এলো ঈশানী। ঘুমানোর জন্য জুতসই একটা ফিনফিনে টিশার্ট আর ট্রাউজার পরে তোয়ালের সাহায্যে মাথা মুছতে মুছতে সামনে এগুচ্ছিল মেয়েটা। তবে রুমের মধ্যে অকস্মাৎ এক কালো অবয়বের স্পষ্ট উপস্থিতি লক্ষ্য করে মূহুর্তেই হৃদযন্ত্র থমকে গেলো ওর। আচানক ঘটনায় অন্তরাত্মা ধড়ফড় করে উঠলো তৎক্ষনাৎ । কণ্ঠনালির শব্দ রোধ করে রেখেছে পরাশক্তি, তাও দিশেহারা হয়ে ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার দেওয়ার প্রয়াস চালালো মেয়েটা, কিন্তু সেসবের সুযোগ দিলোনা এরীশ। ভয়ার্ত নিগূঢ় চিৎকার কণ্ঠনালি ভেদ করার আগেই দ্রুত এসে ছোঁ মে’রে ওর মুখ চেপে ধরলো মাফিয়া বস। কঠোর বাঁধা প্রদান করে মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলো বেনামি শব্দবাণ,

— হুঁশশশ।
থমকালো ঈশানী। জ্বলজ্বলে পাথর খচিত আই ভ্রু পিয়ার্সড টা দৃশ্যগত হতেই দু’নয়নে উদ্ভাসিত হলো দিগুণ আতঙ্ক। তৎক্ষনাৎ কম্পিত স্বরে আওয়াজ করলো মেয়েটা।
— আআপনি!
— হু আমি।
মাস্কের আড়াল থেকে ভেসে এলো পরিচিত হাস্কিস্বর।
— এখানে কি চাই?
— তোমার কি মনে হয়? কি চাই আমার?

—দেখুন। একদম ম্যানিউপুলেট করার চেষ্টা করবেন না। এটা আমার বাড়ি, এখান থেকে আমাকে অপ’হরণ করা এতো সহজ নয়। মা ঠ্যাং ভেঙে রেখে দেবে একদম ।
মেয়েটার ভীতিগ্রস্ত কথায় নিঃশব্দে ফিচেল হাসলো এরীশ। পরপরই বলে উঠলো,
— তুমি প্রতিদিন রাতের বেলা শাওয়ার নাও কেন বলোতো? আর সবসময় এখানে বসেই কেন চেঞ্জ করতে হবে তোমায়? আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে তার ঠিক কি ধরনের শা’স্তি হতো সেটা ভাবলেই নিজের উপর নিজের আ’তঙ্ক ধরে যায় আমার ।
শেষ কথাগুলো ঠিকঠাক বোধগম্য না হলেও প্রথম কয়েকটা বাক্যে হতবিহ্বল হয়ে পরে ঈশানী। প্রবল দুশ্চিন্তায় আপনাআপনি ফাঁক হয়ে যায় ফিনফিনে কোমল ওষ্ঠাধর। অজান্তেই মুখের উপর একহাত রেখে ধপ করে খাটের উপর বসে পরলো মেয়েটা। অবিশ্বাস্য নয়ন জোড়া এরীশের অভিব্যক্তিহীন শূন্য চোখে তাক করে সবেগে বলে উঠলো,

— আপনিই তাহলে স্টকার? এতোদিন ধরে আপনিই আমাকে এভাবে…
বাক্য সম্পূর্ণ করতে পারলো না ঈশানী, কুণ্ঠায় মাথা নমিত করে দু’হাত আড়াআড়ি ভাজ করে রাখলো বুকের উপর। ওর উদ্বিগ্নতা বোধগম্য হতেই, গ্রীবা বাঁকালো এরীশ। মেয়েটার পানে খানিক ঝুঁকে মুখের সংস্পর্শে মুখ নিয়ে বললো,
— ইউর স্মেল ইজ লাইক মাইন।
— মোটেই না।
চট করেই এরীশের কথায় আপত্তি প্রকাশ করে ঈশানী। ঘোর অসম্মতি জানিয়ে বলে,
— খুব ভালো মতো গোসল সেরেছি আমি। এখন মোটেই সেটা নেই।
ঠোঁট বাঁকালো এরীশ। ধূসর বাদামি চোখের দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণতা ধরে রেখে হাস্কি গলায় বললো,
— দ্যাট মিনস, বিফোর শাওয়ার, ইওর স্মেল ওয়াজ এক্সুয়ালি লাইক মাইন।
— নাহ!

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩০

ঈশানীর ছেলেমানুষী আপত্তিকর আওয়াজ বড্ড আদুরে শোনালো। এরীশ আর তর্ক এগোলো না। নৈঃশব্দ্যে পা বাড়ালো জানালার অভিমুখে।
— এভাবে রাতের বেলা জানালা ডিঙিয়ে অবিবাহিত একটা মেয়ের ঘরে ঢুকেছেন। আপনার সত্যিই মনুষ্যত্ব নেই।
পেছন থেকে কর্কশ বাক্য ছুড়লো ঈশানী,রমনীর আওয়াজে গতি স্থির করলো মাফিয়া বস। পেছনে না ঘুরেই জবাব দিলো,
— ঠিকই বলেছো তুমি, ইউ ডিজার্ভ বেটার, বাট ইউ হ্যাভ নো অপশন।তাই অহেতুক চিন্তা বাদ দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাও।
কথাশেষ করে চোখের পলকে জানালা ডিঙিয়ে উঠাও হয়ে গেলো ব্লাডিবিস্ট । নিস্প্রভ দর্শনে সেদিকে চেয়ে ব্যথাতুর হেসে স্বগতোক্তিতে বিড়বিড়ালো ঈশানী,
— নিশ্চিন্ত! আপনি থাকতে দিলে তো?

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩২