আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩২
suraiya rafa
ঈশানী এরীশের কথোপকথনের বেশ কয়েকঘণ্টা পূর্বে……
কক্সবাজার ইনানী বিচের সবচেয়ে নিকটে একচ্ছত্র মালিকানাধীন যে রিসোর্ট টি রয়েছে তার নাম “ব্ল্যাক হোল”। অদ্ভুত নামের এই রিসোর্টটি পুরোপুরি রেস্ট্রিকটেড।ভেতর থেকে বাইরে কিংবা বাইরে থেকে ভেতরে মানুষ ঠিক কিভাবে যাতায়াত করে সে বিষয়ে অজ্ঞাত জনসাধারণ।কারণ পুরো রিসোর্ট টাই বেষ্টন করে আছে প্রসস্থ কংক্রিটের সুদীর্ঘ প্রাচীর। প্রাচীরের চারিদিকে কোনো গেট কিংবা এক্সিটের উপস্থিতি নেই, অগত্যা এই কালো রঙের সুউচ্চ ভিলাটি সর্বসাকুল্যের রহস্যের প্রাণকেন্দ্র।
কেবল দূর থেকে গভীর দৃষ্টিপাত করলে ধোঁয়াসার মতো দৃশ্যগত হয় পাহাড়ের চূড়ায় মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কালো ক্রিস্ট্যাল পাথর খচিত একটা বিশালকার দূর্গ। বাইরের দিকটা তার সূর্যের আলোয় ঝলমল করে সারাক্ষণ। যেন জাদুকরী সম্রাটের অন্তর্নিহিত মায়াজাল। রাত হলে তার অস্তিত্ব বিলীন হয় তমশায়, হারিয়ে যায় ঝলমলে আভা। ক্রিস্ট্যাল খচিত এই মায়া দূর্গের অভ্যন্তরে আলো জ্বলছে আজ। মোম নরম আলোতে চমৎকার ঝিল দিচ্ছে ব্ল্যাক হোলের প্রতিটি দেওয়াল। বিস্তার হল রুমের রাজকীয় ডিভানে গা ছড়িয়ে বসে আছে মাফিয়া বস।এক পাশে গ্যাংস্টার তুষারের সটান অবস্থান, সামনে দাড়ানো সুরক্ষাকর্মীটির অনুনয়ের দৃষ্টি, মাফিয়া বসের গভীর দৃষ্টির অনলে ক্রমশ ধরাশায়ী সে ।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
এরীশের মুখাবয়বে ভর করেছে র’ক্তিম তেজস্ক্রিয়তা। পিয়ার্সড করা ধূসর বাদামি নেত্রগহ্বরে ধ্বংসের অভিলাষ।
চারিপাশে পিনপতন নীরবতা। শরীর শিউরানো এই ভয়াবহ নিস্তব্ধতার অবসান ঘটালো তুষার। থমথমে গলায় লোকটার উদ্দেশ্য ছুড়লো তীর্যক বাক্যবাণ,
— তুমি বলতে চাইছো মিস ব্লু আইড কে যে লোকটা হ্যারাস করেছে, সে রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান এ্যাপোলো খান?
তারস্বরে মাথা ঝাঁকালো লোকটা, কুণ্ঠিত স্বরে বললো,
— জি বস। গত সপ্তাহে সপরিবারে ভ্যাকেশনে এসেছেন এ্যাপোলো খান। ওনার পরিবার দু’দিন আগেই ঢাকা ফিরেছেন। কিন্তু কোনো একটা মিটিং এর জন্য নাকি এখনো রয়েল টিউলিপে অবস্থান করছেন উনি।
— এ্যাপোলো খান আমার সম্পদে হাত বাড়ালো, আর তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে তাইতো?
মুখশ্রী জুড়ে আগ্নেয়গিরির দাবানল, অথচ বরফের মতোই শীতল তার অভিব্যক্তি। এরীশের কথায় হৃদযন্ত্র ছলকে উঠলো লোকটার। তৎক্ষনাৎ নতজানু হয়ে শরীরের ভার ছাড়লো হাঁটুতে,গলা খাদে নামিয়ে কাকুতির স্বরে বললো,
— না বস! এ…এমনটা নয়, প্রতিদিনের মতোই আমি অনুসরণ করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ওই ঘটনার সময় আমি পৌঁছানোর আগেই ওখানে অন্য একজন চলে আসে। আর তারপর সঙ্গে করে….
গার্ডটার বাক্য শেষ হওয়ার আগেই অকস্মাৎ শটগান লোড করে ফেললো এরীশ। নির্বিকারে তাক করালো সেটি গার্ড এর ললাটপটে। আতঙ্কে ধড়ফড়িয়ে উঠলো লোকটা, বিন্দু বিন্দু ঘামে মূহুর্তেই সিক্ত হলো তার ছিপছিপে মুখ মণ্ডল। তবে ট্রিগার প্রেস করার আগেই জোর গলায় বাঁধ সাধলো তুষার, কণ্ঠে স্পষ্ট দৃঢ়তা ধরে রেখে বললো,
— কি করছেন এরীশ! এটা বিডি, এখানে ওপেন ফায়ারিং এলাও নয়।
তুষারের কথায় ধীর গতিতে শটগান নামিয়ে নিলো এরীশ। এর পর মূহুর্তেই শিকারী হায়নার ন্যায় দেওয়ালে আড়াআড়ি লাগোয়া ধারালো কুঠার টা ছোঁ মে’রে নিয়ে, এক ক’ষাঘাতে ধর থেকে মস্তক আলাদা করে ফেললো লোকটার। অকস্মাৎ র’ক্তের হলকা ছিটকে এলো তুষারের সমগ্র শরীরে । র’ক্তের ঈষৎ নোনতা স্বাদে ভরে উঠলো মুখগহ্বর,বিনাবাক্যে হাতের পিঠের সাহায্যে র’ক্ত টুকু মোছার প্রয়াস চালালো তুষার। আপন কাজে অবিরত থেকে অস্থির হয়ে বললো,
— কি করলেন এটা? মিস ব্লু আইড কার সঙ্গে গিয়েছিল সেটাই তো জানা হলোনা।
ক্রোধের তাড়নায় কাপছে এরীশ, মুখশ্রী জুড়ে তার তাজা র’ক্তের নিদারুণ উপস্থিতি। মোছার প্রয়োজন বোধ করলো না, গভীর গলায় বলো,
— ধার ঠিকঠাক আছে কিনা সেটাই চেক করে নিলাম।
— তাই বলে এভাবে? নিজের স্পাই কে…
বাক্য সম্পূর্ণ করতে পারলো না তুষার, তার আগেই দাঁতে দাঁত পিষে বিড়বিড়ালো মাফিয়া ,
— সাম বাস্টার্ড টাচড্ মাই গার্ল। আর ও এখানে আমাকে সেই গল্প শোনাচ্ছে, সন অব আ বিচ!
কথা শেষ করে স্বগোতক্তিতে হাটা ধরলো এরীশ। তৎক্ষনাৎ পিছু ডাকলো তুষার।ব্যতিগ্রস্থ হয়ে শুধালো,
— কোথায় যাচ্ছেন?
এদিক ওদিকে ঘাড় ফুটিয়ে, র’ক্তসিক্ত কুঠার টা চোখের সামনে তাক করালো এরীশ। বললো,
— এটার যথাযথ ব্যাবহার সম্পন্ন করতে।
— কেইস টা আমি হ্যান্ডেল করছি। এটা বিডি, আপনাকে হাইড থাকতে হবে।
তুষারের কথা অগ্রাহ্য করে ঠোঁট বাঁকিয়ে শ্লেষ হাসলো এরীশ। সম্মুখে অগ্রসর হয়ে লম্বা পা ফেলে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
— আমি মরীচিকা তুষার। আর মরীচিকাকে আগ্রাসন করা মানুষের সাধ্য নয়।
মূহুর্তেই এলিভেটর ধরে ধ্বং’সলীলায় মত্ত হতে চলে গেলো এরীশ। তুষার দাঁড়িয়ে রইলো একই ভাবে, যেন শ্বাসপ্রশ্বাসে অবিচল এক জীবন্ত মূর্তিমানব। র’ক্তাক্ত চেহারায় তার উদ্বিগ্নতার ছাপ, দু’চোখ ভার করা দুশ্চিন্তারা গ্রাস করেছে ওকে। গভীর ভাবনায় বিভোর হয়ে আপনাআপনি ঠোঁট নাড়ালো তুষার। ভয়াল স্বরে বলে উঠলো,
— মরীচিকা হয়ে স্নিগ্ধ সাকুরার জন্য কেন উন্মাদ হলেন এরীশ? আপনি যে ধ্বংস, কেন সৃষ্টিকে আলিঙ্গন করতে চাইছেন? এর পরিনতি নিয়ে সত্যিই বিচলিত আমি!
* গভীর রাতে নেশায় জবুথবু এ্যাপোলো খান। ভি আই পি বার কাউন্টার থেকে বেড়িয়ে মাত্রই রাস্তা ধরেছে রিসোর্টের। সবসময়ের মতো সঙ্গে দেহরক্ষী কিংবা ব্যক্তিগত সহকারী কেউই নেই তার। মাঝরাতে একটু একান্তে আমোদ ফূর্তি করার জন্যই সকলকে নিজ হুকুমে বিদায় করেছেন তিনি। কিন্তু আপসোস একটা মেয়েকে পেয়েও হাতছাড়া করতে হলো। আপসোসের থেকে অবশ্য বিরক্তিটা বেশি লাগছে তার,ফলস্বরুপ অস্ফুট স্বরে হাঁটতে হাঁটতে বলতে লাগলেন এ্যাপোলো খান।
— আশ্চর্য জেদি মেয়ে। এতোগুলো টাকার লোভ দেখালাম তাও আসলো না, সুগার ড্যাডির মর্ম বুঝলো না, মূর্খ বাঙালি। ব্যাংকক হলে এতোক্ষণে মেয়েদের লাইন লেগে যেত। আর আমি তাদের সবাইকে সুখের স্বর্গে ঘুরিয়ে আনতাম।
নেশাগ্রস্ত গলায় কথাগুলো বলে আনমনে তৃপ্তির ঢোক গলাধঃকরণ করেন এ্যাপোলো খান। ঠিক তখনই পেছন থেকে ভেসে আসে গম্ভীর রাশভারি আওয়াজ,
— স্বর্গ নয়, চল তোকে নরক দেখাই আজ।
নেশার তোপে দোদুল্যমান পৃথিবী। নিয়ন্ত্রণহীন মস্তিষ্ক, তবুও আঁধার থেকে ভেসে আসা কাট কাট আওয়াজে খানিক সচকিত হয়ে উঠলেন এ্যাপোলো। পেছনে না ঘুরেই, টলতে টলতে অস্পষ্ট আওয়াজে জিজ্ঞেস করেন,
— কে কথা বলে?
— তোর জম।
পেছনের ঘোরার প্রয়োজন পরলো না। আলো আঁধারির তীর্যক জাদুকরী খেলায় রাস্তার মাঝে নিজ প্রতিবিম্বের পাশেই সদ্য ভেসে উঠলো কালো আলখাল্লা পরিহিত দীর্ঘদেহী এক অবয়ব। হাতে তার র’ক্তসিক্ত মা’রণাস্ত্র। চকিতে নেশা কেটে গেলো লোকটার। মূহুর্তেই চোখ দু’টোতে ঘনীভূত হলো প্রবল আতঙ্কের ছাপ। কয়েকবার মাথায় ঝাঁকি মে’রেও যখন ছায়াটা নড়ানো গেলোনা, তখনই শঙ্কিত চিত্তে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালো প্রগাঢ় তমশার পানে। স্ট্রিট লাইটের মরচে ধরা আলোয় ঝাপসা অবয়ব ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো এবার। সরু কুঠারের হাতলটা হাতের মাঝে ঘোরাতে ঘোরাতে এদিকেই অগ্রসর হচ্ছে সে। যা দেখে অন্তরাত্মা ধড়ফড় করে ওঠে এ্যাপোলো খানের।ভয়ার্ত কাঁপন ছড়িয়ে পড়ে সর্বাঙ্গে। প্রকম্পিত হাতে ব্লেজারের পকেট থেকে মোবাইল সংগ্রহের পায়তারা করেন তিনি। আশেপাশে তাকিয়ে অহেতুক ডেকে ওঠেন দেহরক্ষীদের,
— গ…গার্ড’স! এ্যাসিসট্যান্ট! কোথায় সব।
—পেছনে ঘুরে দ্যাখ কেউ নেই।
এরীশের কথায় এবার পেছনে ঘুরলো লোকটা। চারিদিকে শুধু নিস্তব্ধ আঁধার, অদূর থেকে ভেসে আসছে সামুদ্রিক ভয়াল গর্জন। এছাড়া প্রাণীকূলের অস্তিত্বহীনতায় খাক হয়ে আছে পুরো সীমানা। চারিদিকের এহেন নিস্তব্ধ প্রতিকূলতা অবলোকন করে দমে গেলেন এ্যাপোলো। তৎক্ষনাৎ জুতসই ভয়ার্ত স্বর বেড়িয়ে এলো তার পুরুষালি কণ্ঠনালি ভেদ করে,
— সত্যিই তো কেউ নেই!
— বাঁচতে চাস?
ফের হৃদয় কাঁপানো প্রশ্নবাণ। কুণ্ঠায় তাড়াহুড়ো হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো এ্যাপোলো খান। যেন এরীশের হাতের জীবন্ত পুতুল সে।
— দৌড়া।
দাঁতে দাঁত পিষে হুকুম করলো মাফিয়া বস। অকস্মাৎ শব্দটি বুঝে উঠতে সময় লাগলে ষাটোর্ধ লোকটার। ফলস্বরূপ স্থির দাড়িয়ে রইলো সে।
— বাঁচতে চাইলে দৌড়া।
পুনরাবৃত্তি ঘটলো আদেশের। সঙ্গে সঙ্গে চোখমুখ খিঁচে দিশাহীন হয়ে ছুট লাগালো লোকটা। তবে খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হলোনা তার এই বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা। দৌড় লাগানোর পরপরই পেছন থেকে বিদ্যুৎ বেগে ছুটে আসা ধাতব কুঠারটা অকস্মাৎ শিরদাঁড়া ভেদ করলো তার। শক্ত মেরুদণ্ডের প্রতিটি কোষ ভেঙেচুরে মা’রণাস্ত্র গিয়ে বিঁধলো নমনীয় হৃদপিণ্ডে। আচানক থমকে গেলো দূরন্ত পা, আত্মা ফাঁটিয়ে চিৎকার করার সুযোগ হলোনা আর,তার আগেই রোধ হলো শ্বাসপ্রশ্বাস। ক্রমশ ভারী হয়ে এলো চোখের পাতা।ঠিক সে সময় পিঠে বিঁধে থাকা কুঠার সমেত লোকটাকে মাটি থেকে কয়েকহাত উপরে তুলে ফেললো ব্লাডিমনস্টার। শক্তির প্রয়োগে হাড্ডি গুড়িয়ে এফোঁড় ওফোঁড় হলো হৃদযন্ত্র। জলধারার ন্যায় গড়িয়ে পরা র’ক্তের স্রোতে ভিজে গেলো তার সমগ্র শরীর । সেদিকে বিন্দুমাত্র পরোয়া না করে সদ্য মৃ”ত্যুবরণ করা লোকটার পানে চেয়ে হিসহিসালো মাফিয়া বস,
— একটা মাত্র দূর্বলতা আমার, সেদিকেই কেন হাত বাড়াতে গেলেন চেয়ারম্যান সাহেব?
খানিক অপ্রাসঙ্গিক নীরবতা। পরপরই কুঠারটা টান মে’রে বের করে ভারী দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো এরীশ। এক ধাক্কায় লা’শটাকে পাহাড়ের খাদ থেকে সোজা সাগরে ফেলে দিয়ে বলে উঠলো ,
—আপনার প্রয়াত আত্মার শান্তি কামনা করছি।
সকালের মেঘমুক্ত আকাশে ঝুরো ঝুরো সোনালী রোদের ছটা। খোলা জানালা ভেদ করে আগত বাসন্তিক হিমেল হাওয়ায় বুনো বকুলের সুঘ্রাণ। আজ ছুটির দিন, তাই বেশ বেলা করে ঘুম থেকে জেগেছে ঈশানী। সকালের আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছাড়তেই মস্তিষ্ক জুড়ে হামলে পরলো একরাশ বিষণ্ণ স্মৃতি। কাল রাতে এরীশ এসেছিল এ ঘরে। বাতাসের তরে ফেলে যাওয়া মাদকীয় পুরষালি সুঘ্রাণ স্পষ্ট জানান দিচ্ছে তার। এরীশের এমন হুটহাট দর্শনে ঈশানী যে ভয় পায়না, তেমনটা নয়। ভয় না পেয়ে উপায় আছে? সে যে প্রলয়ংকারী ঝোড়ো হাওয়া। যখনই উদয় হয়, অনুভূতি থেকে শুরু করে চারিপাশের সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে রেখে তবেই চলে যায়। কিন্তু আজকাল ভয়ের চেয়ে কৌতুহল বেশি হয় ঈশানীর। না চাইতেও প্রশ্ন জাগে মনে,
— কেন সে এভাবে ফিরে আসে বারবার? কি উদ্দেশ্য তার?
তবে হৃদয়হীন লোকটাকে নিয়ে এতো ভাবার প্রয়োজন বোধ করেনা ঈশানী। অগত্যা মনের প্রশ্ন মনেই রয়ে যায়।
ভেতরের অযাচিত সব প্রশ্নের বহর আলগোছে চাপা দিয়ে, সিঁড়ি ভেঙে তরতরিয়ে নিচে নেমে এলো ঈশানী। গায়ে চড়ানো ফিনফিনে টপ আর ট্রাউজার, এক পিঠ এলোমেলো চুল, ঘুমের ভারে ফুলে যাওয়া নিভু নিভু চোখ সব মিলিয়ে রাস্তার পাগলের মতোই অস্বাভাবিক লাগছে ওকে। এক দেখায় চিনে ওঠা মুশকিল। নিচে নেমে চারিদিকে নজর দিলোনা ঈশানী, তার আগেই ওর সবটুকু মনোযোগ কেঁড়ে নিলো টিভিতে অনবরত চলতে থাকা সকালের শিরোনাম।
— মাঝ সমুদ্রে ভেসে উঠেছে অজ্ঞাত ব্যক্তির ছিন্নভিন্ন লা’শ। তদন্ত সাপেক্ষে জানা যায় তিনি আর কেউ নন, বাংলাদের প্রখ্যাত ব্যবসায়ী রংধনু গ্রুপের বয়জেষ্ঠ চেয়ারম্যান মিস্টার এ্যাপোলো খান।
নিউজ দেখে হতবিহ্বল ঈশানী। শিরোনামের মাথায় মাথায় অচিরেই ভেসে উঠছে কাল রাতের সেই নেশাগ্রস্ত ব্যক্তির ঢ্যাবঢ্যাবে ফ্যাকাসে মুখাবয়ব। লোকটাকে দেখে বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠের মতোই আচানক ঝটকা খেলো মেয়েটা। আপনাআপনি ফাঁক হলো তার ওষ্ঠাধর। অজান্তেই মুখ ফুটে বেড়িয়ে এলো কথার পারদ,
— আরেহ, এটাতো…
—কালকের সেই লোকটা।
পেছন থেকে ভেসে আসা পুরুষালি বাক্য শ্রবনেন্দ্রিয় ভেদ করতেই থমকালো ঈশানী। ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এসে তরিৎ বেগে ঘুরে তাকালো পেছনে।দেখলো পুরোনো আটপৌরে সোফায় গা এলিয়ে জুতসই আসনে নির্বিগ্নে বসে আছে কালকের সেই সুদর্শন যুবক। লোকটাকে দেখে আশ্চর্য না হয়ে, উল্টো নিজের বেশভূষা লক্ষ্য করে ভড়কালো ঈশানী। এলোমেলো চুল, জামা কাপড় সবকিছু আপন হাতে ঠিকঠাক করার বৃথা প্রয়াস চালিয়ে অবাক স্বরে বলে উঠলো,
— আ..আপনি!
ঈশানীর দূর্দশা অবলোকন করে ঠোঁট কামড়ে হাসি সংবরণ করলো মাহিন। অতঃপর ভ্রু নাচিয়ে হ্যা জানালো অকপটে।
— না মানে আপনি আমাদের বাড়িতে।
জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে ফের প্রশ্ন ছুড়লো ঈশানী। হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে প্রত্যুত্তর করলো মাহিন,
— আন্টি ডেকে পাঠিয়েছে।
অকস্মাৎ থমকে গেলো ঈশানী। সরল কপাল নিমেষে বেঁকে গেলো ওর। ভেতরের অস্বস্তি দমিয়ে পূর্ণ মনোযোগ স্থির করলো লোকটার মুখশ্রী পানে। তৎক্ষনাৎ হতচকিত হয়ে পরলো দু’নয়ন। ভেতর ভেতর তৈরি হওয়ার সন্দেহের বশবর্তী হয়ে অস্ফুটে বলে উঠলো,
— আপনি মাহিন তাইনা? মাহিন বেনজামিন।
বিপরীতে অপ্রস্তুত হাসলো মাহিন। তীব্র সংকোচে উপর নিচ মাথা দুলিয়ে নিঃশব্দে হ্যা জানালো শুধু। ঈশানীর আর বলার কিছু নেই।
অসহনীয় যন্ত্রনারা মূহুর্তেই গ্রাস করেছে ওকে। মস্তিষ্কে জাগ্রত করে তুলেছে লজ্জা জনক সেই বিষণ্ণ স্মৃতি। এই লোকটা, এই লোকটাই বাগদানের প্রারম্ভে বিয়ে না করেই অপয়া বানিয়ে চলে গিয়েছিল ওকে । ক্যারিয়ারের এতোই তাড়া ছিল যে হবু বউয়ের মুখটা পর্যন্ত দেখার সময় হয়ে ওঠেনি তার ।
তাহলে আজ হঠাৎ এভাবেই কেন মুখোমুখি হলো সে? ঈশানীর তো কিছু বলার নেই তাকে।আর না আছে কোনো অভিযোগ। পিনপতন নীরবতায় কেটে গেলো কিয়ৎক্ষন। মাহিন এখনো নিশ্চুপ। তীব্র অপরাধ বোধ নৈঃশব্দ্যে কুড়েকুড়ে খাচ্ছে ওকে। মূহুর্তটা অস্বস্তিদায়ক, সহসা ঈশানী আর দাঁড়ালো না, কেন যেন এভাবে মাহিনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে নিজেকে ভীষণ ছোট অনুভব হচ্ছে ওর, ফলস্বরূপ বিনাবাক্যে সিঁড়ি অভিমুখে পা বাড়ায় ঈশানী। তৎক্ষনাৎ পিছু ডাকে মাহিন।কণ্ঠে একরাশ জড়তা টেনে বলে ওঠে ,
আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩১
— আমরা কি একটু একান্তে কথা বলতে পারি ঈশানী? খুব বেশি কিছু না, শুধু একটু সময় চাইছি।
ঈশানী জানেনা আদতে কি বলতে চায় মাহিন।নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট করে মাহিনের অহেতুক কথা শোনার খুব একটা ইচ্ছেও নেই ওর। তাও ভদ্রতার খাতিরে না করার অপশন খুঁজে পেলোনা মেয়েটা।
বিস্তার বেলাভূমি ধরে নিরিবিলি হাঁটছে ঈশানী। ওর সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে একটু একটু করে এগুচ্ছে মাহিন। ঢেউয়ের গর্জনে মুখরিত চারিপাশ। শঙ্খচিলের কিচিরমিচির শব্দে স্তম্ভিত কর্ণকূহুর। আনমনা মেয়েটাকে খানিক বাদে বাদে আড় চোখে পরখ করছে মাহিন।