আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩৩
suraiya rafa
বিস্তার বেলাভূমি ধরে নিরিবিলি হাঁটছে ঈশানী। ওর সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে একটু একটু করে এগুচ্ছে মাহিন। ঢেউয়ের গর্জনে মুখরিত চারিপাশ। শঙ্খচিলের কিচিরমিচির শব্দে স্তম্ভিত কর্ণকূহুর। আনমনা মেয়েটাকে খানিক বাদে বাদে আড় চোখে পরখ করছে মাহিন। সুতির টপস আর লং স্কার্টের সাথে ফ্রেন্স বিনুনিটা মানিয়েছে বেশ। বলাবাহুল্য রুশ কণ্যাদের মতোই গোলাপি আভায় আবিষ্ট তার গমরঙা পেলব ত্বক।
প্রথমে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলো মাহিন, পরবর্তীতে আপসোসের তরঙ্গোচ্ছ্বাস খেলে গেলো ওর মানস্পট জুড়ে। ব্যতিগ্রস্ত হয়ে মনেমনে ভাবতে লাগলো,
— কি করলাম আমি এটা? কেন সেদিন একটাবার মামনির কথা মতো মেয়েটার ছবি দেখলাম না? তাহলে কি আজ এতো আপসোস হতো? হতো না বোধ হয়। কারণ সেদিন এক নজরের জন্য এই মুখটা দেখলে ভবিতব্য আজ পাল্টে যেতো। পাহাড় সম অপরাধ বোধের গ্লানিতে ডুবে যেতে হতোনা আমায়। এই পুষ্পরেণুর মতো প্রস্ফুটিত নীল নয়না হতো আমার। একান্তই আমার।
মাহিনের ভাবনার সুতো ছিঁড়লো ঈশানীর পরবর্তী পদক্ষেপে। ও দেখলো মেয়েটা এগিয়ে গিয়ে নারকেল গাছের ছায়ায় আসন পেতেছে।মাহিন ও এগিয়ে গেলো সেদিকে, রমনীর সঙ্গে সামান্য দূরত্ব বজায় রেখে নিজেও বসে পরলো নির্দ্বিধায়। দৃশ্যপটে অগাধ জলরাশির নিদারুণ উত্থানপতন। হাঁটুতে দু’হাত ভাজ করে সেদিকেই নির্বিকারে চেয়ে আছে ঈশানী। নীলাম্বর অক্ষিপুটে টুপটাপ পলক ছেড়ে বিমুগ্ধ চিত্তে আহরণ করছে প্রাকৃতিক কলতান।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
— তুমি, না মানে আপনি দেখতে অনেক সুন্দর।
মাহিনের সোজাসাপ্টা কমপ্লিমেন্ট। ঈশানী আশ্চর্য হলোনা, বরং পার্শ্বে ঘাড় ঘুরিয়ে নিরেট স্বরে জানালো,
— আপনি আমাকে তুমি বলতে পারেন। বয়সে আমি আপনার ছোটই হবো।
জিভের ডগায় অধর ভিজিয়ে, কিঞ্চিৎ মাথা দোলালো মাহিন। খানিক সংকুচিত হয়ে শুধালো,
— তোমার আমার প্রতি কোনো অভিযোগ নেই?
— না তো।
রমনীর কাট কাট প্রত্যুত্তর। যা মাহিন কে আরও একদফা আত্মগ্লানির অনলে ডুবিয়ে মা-রার জন্য যথেষ্ট।
খানিক নীরবতা।পরমূহুর্তেই শুষ্ক একটা ঢোক গিলে নিজেকে জাহির করার বৃথা চেষ্টা চালালো মাহিন। বললো,
— ওয়েল, সেদিন আমি আসলে….
জিভের ডগায় জড়ো হওয়া বাক্যবাণ, হামেশাই আটকে দিলো ঈশানী। কথার মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললো,
— আপনার আমাকে এতোকিছু কৈফিয়ত দিতে হবে না মাহিন। আমি মোটেও সেদিনের জন্য দুঃখিত নই।আপনিও প্লিজ আমার জন্য দুঃখিত হবেন না। ব্যাপারটা খুবই বিব্রতকর।
এতোক্ষণে আড়ষ্টতার বাধ ভাঙলো মাহিনের। সে উদগ্রীব হয়ে বলে উঠলো,
— কিন্তু আমি বলতে চাই ঈশানী। আজ এখানে দাঁড়িয়ে তোমার জন্য নয়, বরং নিজের জন্য দুঃখ হচ্ছে আমার।ক্রমশ আপসোসের গ্লানিতে ডুবে যাচ্ছি আমি। সেদিনের করা একটা সামান্য ভুল যে আমাকে এভাবে দুমড়ে মুচড়ে একাকার করে তুলবে, সেটা আমি কখনো কল্পনাও করিনি।
— কেন করছেন এতো আপসোস? আপনি একজন প্রখ্যাত সেলিব্রিটি। ভুলে গেলেন?
অনুভূতিহীন জবাব ঈশানীর। মাহিনের চোখে মুখে অসহনীয় উৎপীড়ন। গলায় আহত সুর। সেভাবেই বলে উঠলো যুবক,
— সেদিন বিয়েটা হয়ে গেলে তুমি আমার হতে ঈশানী। এতোদিনে আমাদের একটা সাজানো সংসার হতো। তুমি হতে আমার সেই স্বর্গ রাজ্যের একমাত্র ঘরণী, আমার নীল নয়না।
— আমার নীল চোখ দেখে ভয় করেনা আপনার? আমি আরও ভেবেছিলাম এই নীল চোখ দেখেই বোধ হয় বিয়ে না করে পালিয়েছিলেন আপনি।
কথার মাথায় তাচ্ছিল্যের হাসিতে প্রসারিত হলো রমনীর ওষ্ঠাধর।এতোক্ষণে মাহিন বোধ করলো মেয়েটা বেশ চাপা স্বভাবের। তাকে খোলা বইয়ের মতো চোখ বুলিয়ে পড়ে ফেলা মোটেই সহজ কাজ নয়।
— ভয়! তোমার চোখ দেখে? হাসালে।
কথাটা বলে ফিচেল হাসলো মাহিন। হাসির অন্তরায় খেলে গেলো একরাশ অব্যক্ত ব্যথার তুফান। এবার খানিক ইতস্তত কন্ঠে নিজে থেকেই প্রশ্ন ছুড়লো ঈশানী,
— মা কেন ডেকে পাঠিয়েছে আপনাকে?
সরাসরি প্রত্যুত্তর করার সাহস পেলোনা মাহিন। কৌশলে কথা ঘুরিয়ে বললো,
— সবকিছু নিয়ে কি আরেকটা বার ভাবা যায় না? তুমি আমার বাগদত্তা ছিলে।
চোখের পলকে বদলে গেলো অভিব্যক্তি। মুখাবয়ব জুড়ে ঝরঝরিয়ে নেমে এলো আঁধারের ঘনঘটা, বক্ষ মাঝে একরাশ অস্বস্তি ধরে রেখে পুনরায় প্রশ্ন ছুঁড়লো ঈশানী,
— ঠিক বুঝলাম না।কি নিয়ে ভাবতে বলছেন আপনি?
মাহিন যথেষ্ট স্পষ্টভাষী। তাই নিজের অপরাধের মূল্য স্বরুপ ছোট হতে দ্বিধা নেই ওর।অগত্যা ভারী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জবাব দিলো,
— আমাকে কি আরেকটা বার সুযোগ দিবে ঈশানী? সবকিছু স্বাভাবিক করে তোলার জন্য, তোমাকে বৈধ ভাবে নিজের করে পাওয়ার জন্য। অন্তত আমার অসহায়ত্বের শেফা দেওয়ার জন্য হলেও আরেকবার ভাবো আমায় নিয়ে। প্লিজ!
ঈশানী নিরুদ্বেগ। ওর মাঝে হেলদোল নেই কোনোরূপ।
মাহিনের নিজেকে জোকার ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না এই মূহুর্তে । তাও আরেকদফা মানানোর প্রয়াসে বললো,
—আমি জানি আমার করা অন্যায়ের ক্ষমা নেই, কিন্তু এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে তুমি আমার না হওয়া জীবন সঙ্গি, এই ব্যাপারটা ভাবলেই হৃদয়টা ছটফট করে উঠছে। এই পুতুল বউটাকে কি করে হাত ছাড়া করে ফেললাম আমি?আম….
— প্লিজ! থামুন এবার মাহিন।
আহত কণ্ঠস্বর। সত্যিই ক্রমশ আপসোসের পারদে এফোঁড়ওফোঁড় হচ্ছে হৃদযন্ত্র। তবুও থামতে বাধ্য হলো মাহিন। মাহিন পুরোপুরি নিশ্চুপ হয়ে গেলে নিরাশ ভঙ্গিতে কথা বলে ওঠে ঈশানী।
— জানেন এক বছরে কতকিছু বদলে যায়? আদৌও ধারণা আছে আপনার?
মাহিন নির্বিকার। টলটলে নীল চাহনি যেন ব্যথার সমুদ্র, এই চোখে তাকানোর হিম্মত হলো না ওর। নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে ফের বলে ওঠে ঈশানী,
— সবকিছু বদলে গেছে মাহিন। কোনোকিছুই আগের মতো নেই আর। জীবনের সবচেয়ে বীভৎস সময় পার করেছি আমি গত একবছরে। এখন চাইলেও কেন যেন স্বাভাবিক ভাবে সবকিছু ভাবতে পারিনা। তাই অনুরোধ করছি নতুন করে আর এসব নিয়ে ভেবে অহেতুক সময় নষ্ট করবেন না। আপনার স্বপ্নের মতো সাজানো ভবিষ্যত দয়াকরে আমার মতো একটা কোল্ডব্লাডের পেছনে নষ্ট করতে যাবেন না।
কথাশেষ করে তরতরিয়ে উঠে দাঁড়ায় ঈশানী। কাঁধের টোট ব্যগটা নিয়ে তাড়াহুড়ো হাঁটা ধরে সম্মুখে। তখনই পেছন থেকে আরেকদফা বাক্য ছুঁড়লো মাহিন।
— আর যদি বলি পারিবারিক ভাবে আমাদের বিয়েটা আবারও ঠিক করা হয়েছে?
— ধরে নেবেন আমার সম্মতি নেই।
পেছনে না ঘুরেই কঠোর গলায় জবাব দিলো মেয়েটা। ফের গলা ছেড়ে বলে উঠলো মাহিন,
— তুমি মোটেও কোল্ডব্লাড নও ঈশানী। তুমি ভালোবাসতে জানো। তোমার চোখে আমি নাজুকতা দেখেছি।
কোনোরূপ প্রত্যুত্তর না করেই নির্বিকারে হেঁটে চলে গেলো রমনী। বালুর আস্তরে পা দাবিয়ে নিশ্চল কদমে এগুতে এগুতে নিজেকে কটাক্ষ করে অভিমানী স্বরে বিড়বিড়ালো সে ,
— বেসেছিলাম তো একটা জানোয়ার কে। যে ভালোবাসা নয় ধ্বংসে বিশ্বাসী। দূর্বলতা নয় নিষ্ঠুরতায় আগ্রহী। নিষিদ্ধ দুনিয়াতে তার অবাধ বিচরণ,অথচ বাস্তবতায় সে মরীচিকার মতোই বেমালুম অস্তিত্বহীন।
বেশ কয়েকদিন পরে…..
শীতের আবহ বিদায় নিয়েছি বহুদিন। বসন্ত এখন মাঝ দুয়ারে। গত কয়েকটা দিন বেশ রৌদ্রজ্বল থাকলেও, আজ সকাল থেকে আকাশটা মেঘলা। ধূসর মেঘের প্রলেপে ঢাকা পরেছে সূর্য কীরণ। ক্ষণে ক্ষণে আকাশ চিঁড়ে প্রকম্পিত হচ্ছে ধরিত্রী কাঁপানো বজ্রধ্বনী। ঈশান কোণে ঝড়ের পূর্বাভাস। সন্ধ্যা নাগাদ ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে স্যাঁতেসেতে চারিপাশ, বৈরী বাতাসের তালে তালে বেড়েই চলেছে বৃষ্টির তোড়।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, বাড়ি ফেরা প্রয়োজন। অথচ টাউনহলের করিডোরে একমনে দাঁড়িয়ে আছে ঈশানী। নিস্প্রভ নয়ন জোড়া বৃষ্টিস্নাত রাস্তায় অকপটে নিবদ্ধ তার। বাড়ি ফেরার নিদারুণ অভিলাষ ভর করেছে চোখেমুখে। ছিপছিপে বৃষ্টিতে ছাতা ছাড়াই যাতায়াত করছে মানুষ। ঈশানীও ঠিক করলো বৃষ্টি কমার অপেক্ষা না করে একছুটে এগিয়ে গিয়ে রিকশা ধরবে ও। তাছাড়া এই বৃষ্টিতে গা ভিজবে না। যেই ভাবা সেই কাজ, গলার ওড়নাটা ভালোমতো মাথায় প্যাঁচিয়ে তরতরিয়ে রাস্তায় নেমে এলো ঈশানী। ঠিক তখনই পেছন থেকে ভেসে এলো চমৎকার পুরুষালি কণ্ঠস্বর।
— আরে ঈশানী!
অকস্মাৎ ডাকে পেছনে ঘুরলো ঈশানী। নিগূঢ় দৃষ্টিতে পরখ করে নিশ্চিত করলো মাহিনের উপস্থিতি।পরপরই নজর চলে গেলো যুবকের হাতে আবদ্ধ বিশাল সাইজের কেক আর চকোলেট বক্সের দিকে। ঈশানীর ভাবনার মাঝেই পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো মাহিন। মোলায়েম হাসিতে ঠোঁট প্রসারণ করে শুধালো,
— বাড়িতে যাচ্ছো তাই না।
নিঃশব্দে মাথা নাড়িয়ে হ্যা জানালো ঈশানী।
— আজ তো ঊষার জন্মদিন। সকালেই কল দিয়ে আমন্ত্রণ করেছে আন্টি , আমিও তোমাদের বাড়ির দিকেই যাচ্ছিলাম। চলো একসাথে যাওয়া যাক।
অপ্রস্তুত হাসলো ঈশানী। বললো,
— না মানে আসলে, আমিও তো সকাল বেলা কেকের অর্ডার দিয়ে গিয়েছিলাম। ওটা আনতে হবে। আপনি বরং চলে যান, আমি রিকশা নিয়ে আসছি।
— ইট’স ওকে। তুমি ভেতরে গিয়ে নিয়ে এসো, আমি এখানেই ওয়েট করছি।
মাহিন নাছোড়বান্দা। মাঝ রাস্তা হওয়াতে খুব বেশি বাকবিতন্ডা করলো না ঈশানী। শুধু যেতে যেতে বললো,
— বৃষ্টির মাঝে দাঁড়াবেন?
চমৎকার হাসলো মাহিন। ওকে এগিয়ে যেতে ইশারা করে বললো,
— আমি এখানেই আছি তুমি যাও।
ঈশানী ভেতরে গিয়েছে বেশ কিছুক্ষন। গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষারত মাহিন। কপালে লেপ্টে থাকা ঈষৎ বাদামি চুলে আনমনে হাত বুলিয়ে ক্ষণে ক্ষণে ঘড়িতে দৃষ্টিপাত করছে সে।ইতিমধ্যে বৃষ্টির প্রকোপ বেড়েছে বহুগুণ। ফলস্বরূপ আশেপাশে পথচারীর উপস্থিতি খুব একটা নেই। নিরিবিলি পরিবেশ। এরই মাঝে ভয়াল কালো মেঘের মতোই অকস্মাৎ মাহিনের মুখোমুখি হয় একটা দীর্ঘদেহী কালো অশরীরী। মুখে মাস্ক নেই , তবে ওভার সাইজ রেইনকোটের আস্তিনের হুডিটা কপাল পর্যন্ত টেনে রাখা তার। ফলস্বরূপ বরাবর মুখোমুখি না হলে এপাশ ওপাশ থেকে মুখ দেখার জো নেই আর । প্রথমে নিতান্ত পথচারী ভেবে উপেক্ষা করে গেলেও পরবর্তীতে মানবের শীতল চাহনিতে খানিক অপ্রস্তুত হয়ে পরে মাহিন। কপালে বিরক্তির ভাজ টেনে বলে ওঠে,
— কে আপনি? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?
— জাস্ট স্টে এ্যাওয়ে ফ্রম মাই গার্ল।
মেঘের মতো আবির্ভূত ব্যক্তির বজ্রের ন্যায় ধারালো কণ্ঠস্বর। আড়ালে শুষ্ক একটা ঢোক গিললো মাহিন পরমূহুর্তেই ভ্রু বাঁকিয়ে শুধালো,
— আশ্চর্য তো! আমি কার কাছে থাকবো, কার থেকে দূরে থাকবো, সেটা আপনি বলার কে?
— আমি ওর সব।
বাক্য কটা উগড়ে দিয়ে, কোনোরূপ পূর্বাভাস ছাড়াই পরপর কয়েক ঘাঁ ঘু’ষি বসিয়ে দিলো মাহিনের নাক বরাবর। যেন বালু দিয়ে তৈরিকৃত পাঞ্চিং ব্যাগের একাংশ সে, তেমন ভাবেই আ’ঘাতের উপর আ’ঘাত করে নিমেষে ধরাশায়ী বানিয়ে ফেললো মাহিন কে। কথার মাথায় কথা বলা একদম পছন্দ নয় এরীশের, অথচ মাহিন সেই ভুলটাই করে বসেছে অজান্তে। শক্ত পুরুষালি ক’ষাঘাতে নাক ফেঁটে ফিনকি দিয়ে র’ক্ত বেড়িয়েছে ওর।
— আই সয়ার এবার থেকে অন্যের ব্যাপারে নাক গলানোর স্বাদ পুরোপুরি মিটে যাবে।
দু’বারের পর তৃতীয় ঘু’ষিটা দিতে ব্যতিগ্রস্ত হলো এরীশ। ঠিক তখনই নিজের পেশীবহুর বলিষ্ঠ বাহুতে একটা সরু হাতের তীর্যক টান অনুভব হলো তার। তৎক্ষনাৎ গর্জে উঠে পেছনে ঘুরলো মাফিয়া বস। বেসামাল হয়ে মাত্রাতিরিক্ত ক্রোধে পাঞ্চ বসাতে উদ্যত হলো পেছনের ব্যক্তিকে। তবে নীল অক্ষি গহ্বরের সান্নিধ্যে ধূসর নেত্রদয়ের মিলন ঘটতেই থমকে গেলো সেই ক্রোধান্বিত হাত। উবে গেলো পেশীর দৃঢ়তা, ধ্বং’সাত্মক পরাশক্তি খেই হারিয়ে দপ করে নিভে গেলো হিং’স্রতা।
— কি হলো থেমে গেলেন কেন? মা’রুন! আপনি তো এটাই ভালো পারেন,মানুষকে ট’র্চার করতে। তাইনা?
কখন যে গতি হারিয়েছে হৃদস্পন্দন সেই হদিস জানেনা এরীশ। অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো জলন্ত চোখ দু’টো নিমেষে ধারণ করেছে জলধারার ন্যায় শান্ত রূপ। সাকুরার কথায় অক্ষিপুটে জাগ্রত হয়েছে ব্যাকুলতা। অথচ হিমালয়ের মতো নিটোল সেই অভিব্যক্তি। মাহিনের অবস্থা বেগতিক, কোনো মতে নাকে হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা, সেদিকে একপল দৃষ্টি বুলিয়ে ফের ঝাঁঝিয়ে ওঠে ঈশানী। এরীশের পানে বিতৃষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ক্রন্দনরত স্বরে বলে,
— আর কি কি করলে শান্ত হবেন আপনি? ঠিক কি করলে ছেড়ে দিবেন আমার পিছু?
— ও তোমার সাথে কেন?
শান্ত সাবলীল আওয়াজে আকাশসম অধিকার বোধ।ঈশানী জ্বলে উঠলো পুনরায়।কণ্ঠে দৃঢ়তা টেনে বললো,
— কারণ মাহিন আমার ফিয়ন্সে, বিয়ে ঠিক হয়েছে আমাদের। বুঝতে পেরেছেন?
বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো অকস্মাৎ ছলকে উঠলো আকাশ।আকাশের ভারে তীব্র বর্ষণে মুখরিত ধরণি। নিষ্পাপ শিশুর ন্যায় ঈশানীর পানে এক ধ্যানে চেয়ে আছে এরীশ। যেন কণ্ঠনালির জোর হারিয়ে বাক্যহীন সে । হিমালয়ের ন্যায় নিটোল শরীরের সমস্ত শক্তি গ্রাস করেছে পরাশক্তি। বুকের র’ক্ত তোলপাড় করা উৎপীড়নে পুরোপুরি জ্ঞান শূন্য মাফিয়া বস। ওর শিশুসুলভ অভিমানী চাহনিই বলে দেয়,অপরপ্রান্তে দাঁড়ানো মেয়েটার নিকট ঠিক কতটা পরাস্ত, কতটা দূর্বল ওর নরকীয় সত্তা।
প্রবল বর্ষনের তোড়ে কাক ভেজা ঈশানী। চোখের কার্নিশে জড়ো হওয়া বাধভাঙ্গা অশ্রুরা নিমেষেই বিলীন হয়েছে বারিধারার অন্তরায়। ইতিমধ্যে গাড়িতে প্রবেশ করেছে মাহিন, খোলা আকাশের নিচে নিগূঢ় বর্ষায় সিক্ত হচ্ছে কেবল এক জোড়া অভিমানি চিত্ত। চোখের দৃষ্টি অবিচল রেখে,সন্তোর্পণে লুকালো অভিমান। অতঃপর আরও এক দফা কথার তীরে হৃদয়ে র’ক্তক্ষরণ বাঁধিয়ে দিলো রমনী।
—পা’গলা কুকুরের মতো সারাক্ষণ আমাকে ধাওয়া করা বন্ধ করুন এবার। একটু শান্তি দিন আমায় । কথা দিচ্ছি এই মুখ আপনাকে আর দেখতে হবে না কোনোদিন। তাও দয়া করে বাঁচতে দিন।
কথা শেষ করে গটগটিয়ে রাস্তা ছাড়লো ঈশানী। চোখের পানি মুছতে মুছতে তাড়াহুড়ো গিয়ে বসলো গাড়িতে। ওদিকে এরীশ এখনো একই জায়গাতে ঠায় দাঁড়িয়ে। কোনো এক অদৃশ্য শক্তি বলে পায়ের শক্তি পুরোপুরি লোপ পেয়েছে ওর। ঘৃণার শেকলে বাঁধা পরেছে সমগ্র অস্তিত্ব। নিজের নিষ্ঠুরতায় আজ নিজেই ধরাশায়ী এরীশ ইউভান। কি হতো যদি এই সাধারণ মেয়েটার তরে আবেগহীন হৃদয়টা হুমড়ি না খেত? সে কথা দ্বিতীয়বার ভাবতে চায় না এরীশ। কারণ পেন্টহাউজের সেই বি’ধ্বং’সী কলুষিত দিন গুলোর জন্যই ঈশানীর চোখে ও এখনো একটা অ’ত্যাচারী জানোয়ার ছাড়া আর কিছুই নয়। ব্যাপারটা ভেতর থেকে গুড়িয়ে দেয় এরীশকে। এখানে এসেই থমকে যায় সকল অধিকারবোধ, সাকুরার ঘৃ’ণার অনলে ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পরে মাফিয়া বস।
ফ্রন্ট মিররে তাকিয়ে একটা টিশ্যুর সাহায্যে নাকের র’ক্তটুকু মোছায় গভীর মনোযোগী মাহিন। তীব্র ব্যথায় টনটন করছে তার নাসারন্ধ্র। একজন মডেলের কাছে তার নিখুঁত চেহারার গুরুত্ব অপরিসীম। অথচ সরু নাকটাকেই মে’রে বেঁকিয়ে দিলো লোকটা। আশ্চর্য! যদিও নিজের দোষ সম্মন্ধে এখনো অবগত নয় মাহিন। এরই মাঝে গাড়িতে প্রবেশ করে ঈশানী। শরীরে তার ভেজা সম্ভ্রম।ঈশানীকে দেখে সম্বিত ফিরে পায় মাহিন,র’ক্তা’ক্ত টিশ্যুটা ময়লার ঝুড়িতে ছুড়ে ফেলে স্টিয়ারিং এ হাত রেখে আগ বাড়িয়ে শুধালো,
— গাড়িতে তোয়ালে রাখা আছে, দেবো কি?
না সূচক মাথা নাড়ালো ঈশানী বড্ড অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
— তোয়ালে দিতে হবে না, একটু তাড়াতাড়ি চলুন, ভীষণ শীত লাগছে।
ক্ল্যাচারে পা রেখে গাড়ি স্টার্ট দিলো মাহিন। দু’চোখ সড়কে স্থির রেখে স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে বলে উঠলো,
— কে এই সাইকো টা?
নৈঃশব্দ্যে ব্যাকসিটে মাথা এলিয়ে দিলো ঈশানী। চোখ দু’টো বুজে ভারী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ব্যথাতুর স্বরে জানালো,
— আমার আত্মা, আমার প্রাণ, আমার অরণ্য।
মনেমনে আওড়ালো,
— যে হারিয়ে গিয়েছে। এরীশ ইউভান নামক নি’ষ্ঠুরতম হিং’স্র সত্তার আড়ালে।
ওদিকে ঈশানীর মুখে বাক্য কটা শোনা মাত্রই অভিব্যক্তি বদলে গেলো মাহিনের। উজ্জ্বল মুখশ্রী জুড়ে উদ্ভাসিত হলো প্রগাঢ় আঁধার। রাস্তায় মনোযোগ স্থির রেখেই তপ্ত শ্বাস টানলো মাহিন, মনেমনে অনুভব করলো,
— তারমানে নীল নয়নাকে আমি পাইনি। আমি নই বরং অন্য কারোর অবাধ বিচরণ রয়েছে তার হৃদয়ে। আমার অনুপস্থিতি, আমার ভুল সিদ্ধান্ত, আজ সত্যি সত্যি হারিয়ে দিলো আমায়।
ফল সিজন চলছে এখন। নিরবিচ্ছিন্ন টুরিস্ট এরিয়া। মার্কেটেও ভীর নেই তেমন। ফলস্বরূপ আজ বহুদিন বাদে কল করে নিঝুমকে শপে ডেকেছে ঈশানী। বিকেল নাগাদ মার্কেটে এসেছে নিঝুম। নিঝুম আসার পরপরই বুটিক হাউজ বন্ধ করে দিয়ে ওর সঙ্গে হাঁটতে বেরিয়েছে ঈশানী। নিঝুমকে উদাসীন লাগছে ভীষণ। সুশ্রী মুখে বিষণ্ণতার ছাপ সুস্পষ্ট। তাই আজ চিরাচরিত অভ্যেসে ভিন্নতা টানলো ঈশানী। নিজ উদ্যোগে শুধালো,
— এখনো চিটাগং ফিরলি না যে?
ঠোঁট উল্টালো নিঝুম, দায়সারা হয়ে বললো,
— যেতে তো চাই, কিন্তু খালা মনি কিছুতেই ছাড়ছে না। একা থাকে তো সবসময়, তাই আমাকে পেয়ে পারছে না কোটরে লুকিয়ে রাখতে।
একযোগে মলিন হাসলো দু’জন। ঈশানী ফের শুধালো,
— কেন, তার ছেলে মেয়ে নেই?
— আছে বিদেশে।
আবারও দায়সারা প্রত্যুত্তর করলো নিঝুম। ওর এহেন উদাসীনতায় ভ্রু কুঁচকালো ঈশানী। মেকি রাগ দেখিয়ে বললো,
— কি হয়েছে বলতো তোর? তখন থেকে দেখছি চো’রের মতো এদিকে ওদিকে চোখ ঘোরাচ্ছিস, সত্যি করে বল কাকে খুঁজছিস?
তৎক্ষনাৎ প্রসঙ্গ পাল্টালো নিঝুম। আমতাআমতা করে বললো,
— না মানে ওইদিনের রিদান ছেলেটাকে দেখলাম না আজ।
নিঝুমের কথায় চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ঈশানী। আহত স্বরে জবাব দিলো,
— রিদান অসুস্থ। আই সি ইউ তে আছে। ভেবেছি কেবিনে শিফট করলে একবার দেখতে যাবো।
চমকালো নিঝুম। হতবিহ্বল হয়ে শুধালো,
— কি বলিস! কি করে হলো এসব?
— জানিনা।আ….
— এই যে মিস ব্লু আইড!
আচমকা কারোর পিছু ডাকে কথার বহর খেই হারালো ঈশানীর। হাঁটতে হাঁটতে সীবিচের শেষ মাথায় চলে এসেছে ওরা দু’জন। মার্কেট থেকে অনেকটা দূরে।গোধূলির লালিমা ম্লান হয়ে এসেছে দিগন্তে। পূবের আকাশে সন্ধ্যা তাঁরার মিটিমিটি উদ্ভাসন। ঠিক তখনই গমগমে আওয়াজ ভেসে এলো অদূর থেকে।
সম্মোধন টা ভীষণ পরিচিত মনে হলো ঈশানীর, অগত্যা ডাকের উৎস জানতে একযোগে পেছনে ঘুরলো ওরা দু’জন। ঈশানী যা সন্দেহ করেছিল তাই, এটা অন্য কেউ নয়, মাফিয়া বসের একান্ত সহচর তুষার জাওয়াদ। মেয়ে দু’টো যতক্ষণে পেছনে ঘুরলো, ততক্ষণে ওদের কাছাকাছি চলে এসেছে তুষার। এগিয়ে এসে কোনোরূপ বাক্য বিনিময় করার প্রয়োজন বোধ করলো না লোকটা, বরং সরাসরি ঈশানীকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— এরীশ ওয়েট করছে তোমার জন্য। সামনেই দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি নিয়ে।
— আমার জন্য মানে?
উল্টো প্রশ্ন করে ভ্রু কুচকালো ঈশানী। ঠিক তখনই পাশ থেকে হাঁকিয়ে ওঠে নিঝুম। ব্যগ্র আওয়াজে শুধায়,
— ঈশু, তোরা দু’জন দু’জনকে চিনিস? আর এরীশই বা কে আগে কখনো বলিস নি তো?
দোটানায় পড়ে গেলো ঈশানী, কাকে রেখে কাকে উত্তর দিবে। তাও নিঝুমকে শান্ত করার প্রয়াসে বললো,
— এরীশ কেউ না। বাদ দে তো।
কপালে সরু ভাজ টেনে তুষারের পানে দৃষ্টিপাত করলো নিঝুম। তারস্বরে বলে উঠলো,
— সত্যিই এরীশ কেউ না? তাহলে উনি যে বললো।
নিঝুমের কথায় কোনোরূপ ভাবান্তর হলোনা তুষারের, ও পুনরায় ঈশানীকে তাড়া দিয়ে বললো,
— এরীশ ওয়েট করছে, তুমি নিশ্চয়ই চাও না সে রেগে গিয়ে আরেক ধ্বং’সযজ্ঞ বাঁধাক।
— নাহ!
জোর গলায় বাঁধ সাধলো ঈশানী। ভয়ার্ত ঢোক গিলে বললো,
— যা..যাচ্ছি আমি।
— আরেহ, এরীশ কে সেটা তো বল।
ব্যগ্র কদমে এগিয়ে যেতে যেতে নিঝুমের কথার বিপরীতে আস্তে করে প্রত্যুত্তর করলো ঈশানী,
— অরণ্য, অরণ্যই এরীশ।
— কিহ! আমিও দেখতে চাই অরণ্যকে।
ঝুমঝুমিয়ে কথার বহর ছুড়লো নিঝুম। অতঃপর এগোতে লাগলো ঈশানীকে অনুসরণ করে। তৎক্ষনাৎ পেছন থেকে ওর পাতলা হুডির আস্তিন টেনে ধরলো তুষার।মেয়েটার পায়ের গতি প্রতিরোধ করে গম্ভীর গলায় বললো,
— তুমি কোথায় যাচ্ছো?
— অরণ্যকে দেখতে।
— উহু, ওখানে যাওয়া যাবে না।
— আপনার কথায়? ছাড়ুন তো, হুডি ছাড়ুন।
ত্যাক্ত হয়ে তুষারের হাতটা ঝটকা মে’রে নিজের থেকে ছাড়িয়ে দিলো নিঝুম। তখনই আরেক দফা বাঁধ সাধলো তুষার, নিঝুমের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট গলায় বললো,
— আমি বলেছি ওদিকে যাওয়া যাবেনা, তার মানে দুনিয়া উল্টে গেলেও যাবেনা ।
বিস্তার সিবীচ কে পেছনে ফেলে আড়ষ্ট পায়ে ধীরে ধীরে রাস্তার অভিমুখে এগিয়ে গেলো ঈশানী। সরু রাস্তা ছাড়িয়ে হাইওয়ের দিকে একটু মোড় নিতেই দৃষ্টি সীমানার অদূরে ভেসে উঠলো বিলাসবহুল রোলস রয়েস। আরেকটু ভালোভাবে খেয়াল করতেই নজরে এলো রোলস রয়েসের অধিপতির মাস্ক আবৃত ঝাপসা মুখাবয়ব। কালো হুডির মধ্যবর্তী চেইন টা পুরোপুরি খুলে রাখার দরুন ভেতরের স্কিনি স্যান্ডো গেঞ্জিটা স্পষ্ট দৃশ্যমান। বাংলাদেশের আবহাওয়ার তারতম্যের সঙ্গে বোধহয় জুতসই মানিয়ে উঠতে পারেনি তুষারপাতে অভ্যস্ত রাশিয়ান মাফিয়া বস। তাইতো ঘামে সিক্ত তার চওড়া সুডৌল বক্ষদেশ।
একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, পায়ে পায়ে সেদিকেই এগুলো ঈশানী। গিয়ে দাঁড়ালো এরীশের সম্মুখে। ভীষণ রূঢ় স্বরে বলে উঠলো,
— কি বলবেন বলুন।
— গাড়িতে ওঠো।
স্থবির চিত্তে আদেশ করলো মাফিয়া বস। ওদিকে বাক্যটা শুনে ভ্রু বাঁকালো ঈশানী,অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
— গাড়িতে উঠবো মানে? কোথায় নিয়ে যাবেন আপনি আমাকে?
তপ্ত শ্বাস ছাড়লো এরীশ।মেয়েটার পানে সামান্য গ্রীবা বাঁকিয়ে গভীর গলায় বললো,
— লিসেন, অযথা প্রশ্ন করোনা। কৈফিয়ত দিতে অভস্ত্য নই আমি।
— আপনি কি গাড়িতে ওঠার জন্যই ডেকে পাঠিয়েছেন আমাকে?
— কি মনে হয়?
— তাহলে আমি কোথায় যাবোনা।
কথা শেষ করে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে হাঁটা ধরে ঈশানী। তৎক্ষনাৎ ওর হাত চেপে ধরে এরীশ। পরপর হ্যাঁচকা টানে কয়েক কদম পিছিয়ে এনে রমনীর মাখন নরম হাতদুটো উপরে তুলে কব্জিবদ্ধ করে নেয় মাফিয়া বস। বহুদিন বাদে এরীশের এমন ডমিন্যান্ট, কঠোর আচরণে আতঙ্কের জলোচ্ছ্বাস খেলে যায় নাজুক মেয়েটার বক্ষপিঞ্জরে। লোকটার চোখে চোখ রেখে কুণ্ঠিত স্বরে বলে ওঠে ,
— কি করছেন। রাত হয়ে যাচ্ছে ছাড়ুন।
ঈশানীর কথায় কোনোরূপ প্রত্যুত্তর না করে গাড়ির সঙ্গে ওর হাত দু’টো সপাটে চেপে ধরলো এরীশ। অতঃপর নীল চোখের অনলে দৃষ্টিপাত করে কঠোর স্বরে বললো,
— হয় চুপচাপ গাড়িতে ওঠো। নয়তো রাস্তার মাঝে এভাবেই আমার সঙ্গে লেপ্টে দাঁড়িয়ে থাকো। দ্যা চয়েস ইজ ইওর’স।
আড়ষ্টতায় চোখ মুখ বুঁজে এলো ঈশানীর। গলা নামিয়ে শুধালো,
— আগে বলুন, ক..কোথায় নিয়ে যাবেন?
— সেটা তোমার কনসার্ন নয়।
বাক্য শেষ করে, আচমকা গাড়ির দরজা খুলে ঈশানীকে ভেতরে ছুড়ে মা’রলো এরীশ। অতঃপর নিজেও গিয়ে বসে পরলো ড্রাইভিং সিটে।
সাগর পারে দাঁড়িয়ে নির্বিগ্নে নিকোটিনের ধোঁয়া ওড়াচ্ছে তুষার। নিঝুমকে বসিয়ে রেখেছে পাশেই। সেই তখন থেকে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে নিঝুম। ওদিকে সন্ধ্যা ছাঁপিয়ে রাত নেমেছে ধরণি জুড়ে। ঈশানীর ফিরে আসার নাম নেই, ফলস্বরূপ এবার আগ বাড়িয়ে কথা বলে উঠলো নিঝুম। গম্ভীর চিত্তের লোকটাকে উদ্দেশ্য করে শুধালো,
— আচ্ছা ঈশু কখন আসবে?রাত হয়ে গেলো তো।
— আমি নিজেও জানিনা।
সিগারেটের শলাকায় নিগূঢ় টান মে’রে জবাব দিলো তুষার। এবার নিঝুম কিছুটা ইতস্তত বোধ করলো। সংকোচে জড়োসড়ো হয়ে গেলো ওর সমগ্র অস্তিত্ব। ভয়ার্ত গলায় বললো,
— আচ্ছা ঈশু ঠিক আছে তো? ওর কোনো ক্ষতি হবেনা তো আবার?
— এরীশ ঠিক থাকলে, ঈশানীও ঠিক আছে।
নির্বিকার জবাব ভেসে এলো অপর প্রান্ত থেকে। লোকটার দায়সারা জবাবে বিরক্তিতে “চ” উচ্চারণ করলো নিঝুম। বললো,
— তাহলে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিন খালামনি অপেক্ষা করছে।
চকিতে ঘাড় ঘোরালো তুষার। ভ্রু বাঁকিয়ে বলে উঠলো,
— আমাকে কি তোমার পার্সোনাল এ্যাসিসট্যান্ট মনে হয় যে প্রতিদিন বাড়ি পৌঁছে দিবো?
কাটখোট্টা লোকটার মুখ থেকে এর থেকে ভালো প্রত্যুত্তর আশা করা যায়না, অগত্যা নিরাশ হলো নিঝুম। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— অন্তত একটা রিকশা ধরিয়ে দিন। রাত হয়ে গিয়েছে তো।
তৎক্ষনাৎ দাঁড়িয়ে পরলো তুষার। বিরক্তির স্বরে বলে উঠলো,
— কথা একটু কম বলা যায় না? কোথায় খালা বাড়ি?
সহসা উঠে দাঁড়ালো নিঝুম। জানালো,
— এতো ঠিকানা মনে নেই, তবে রিকশা ওয়ালা মামাকে তন্দ্রাভিলা বললেই চিনে ফেলবে। তন্দ্রা আমার খালামনির নাম।
অকস্মাৎ থমকে গেলো তুষার। ওষ্ঠাধরের ফাঁকে আঁটকে থাকা আধপোড়া সিগারেটটা পরে গেলো তৎক্ষনাৎ । কোনো এক অজানা শিহরণে প্রকম্পিত হলো যুবকের সমগ্র অস্তিত্ব। অচিরেই মেয়েটার পানে গভীর দৃষ্টিপাত করে ধাতস্থ গলায় জিজ্ঞেস করলো তুষার,
— তোমার খালামনির পুরো নাম?
ভাবলেশহীন হয়ে ঠোঁট উল্টালো নিঝুম। নির্দ্বিধায় জানালো,
— তন্দ্রা, তন্দ্রা জাওয়াদ। কেন বলুন তো?
অহর্নিশ চলতে চলতে লোকালয় ছাড়িয়ে দূর বহুদূরে চলে এসেছে গাড়িটা। গাড়ির ভেতরে পিনপতন নীরবতা। নিটোল তমশার মাঝে কেবল ক্ষণে ক্ষণে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সরলতার চাপা আর্তনাদ। সেই তখন থেকে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা। সেদিকে বিন্দুমাত্র নজর নেই এরীশের। কোনো এক অযাচিত কারন বশত ক্রোধের তাড়নায় ফুঁসছে সে,পূর্বাভাস বিহীন প্রলয় আসন্ন, তেমন করেই বেসামাল গতিতে গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরাচ্ছে সে। মাফিয়া বসের উদভ্রান্ত গতিতে, কান্নার লাগাম টানলো ঈশানী। ভয়ের তোপে জড়োসড়ো হয়ে বসে,উদ্বিগ্ন গলায় বলে উঠলো,
— কি করছেন টা কি? মে’রে ফেলবেন নাকি আমায়?
তৎক্ষনাৎ ক্ল্যাচারে পা চেপে হার্ডব্রেক কষলো এরীশ । অকস্মাৎ ঘটনায় সামনের দিকে হুমড়ি খেতে নিয়েও সিট বেল্টের কল্যানে মাঝ পথে থমকালো ঈশানী। তীব্র ঝটকায় তিরতিরিয়ে কেঁপে উঠলো মেয়েটা।রুহু এসে আটকে গেলো ঠোঁটের আগায়, ঠিক তখনই আরেকদফা ঝটকা দিলো মাফিয়া বস। দাঁতে দাঁত পিষে জানালো,
— তোমার বিয়েটা হবে না । বিয়ের আগেই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে মাহিন বেনজামিন।
— কি বলছেন এসব?
ঈশানীর কণ্ঠে আতঙ্ক সুস্পষ্ট।
— যা বলছি সত্যি বলছি। আমি বেঁচে থাকতে এই বিয়ে হতে পারেনা।
আজ আর চ্যাঁচালো না ঈশানী।ভীষণ আড়ষ্টতায় ডুকরে কেঁদে উঠে বলতে লাগলো ,
— কেন করছেন এমনটা? আমি তো আপনার কোনো ক্ষতি করিনি। তাহলে কোন জিদে মত্ত হয়ে মাহিন কে আ’ঘাত করছেন বারবার? দয়া করে মাহিনের কোনো ক্ষতি করবেন না। আমার জন্য মাহিনের কিছু হয়ে গেলে সারাজীবনেও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না আমি।
কথাশেষ করার সঙ্গে সঙ্গে আচমকা ঈশুর পেলব কপোলে খরখরে দু’আঙুলের চাপ প্রয়োগ করে এরীশ। শক্ত হাতে চেঁপে ধরে, আজ প্রথমবারের মতো জোর খাটিয়ে বলে,
— মাহিনের জন্য এতো কিসের দরদ তোর?কেন মাহিনের জন্য এতো এতো চিন্তা? আমাকে চোখে পরেনা ?
মূহুর্তেই স্তম্ভিত হয়ে পরে ঈশানী। এরীশের শূন্য চোখের হলকায় ভস্ম হয়ে যাচ্ছে ও। মুখের উপর আঁচড়ে পরা তপ্তশ্বাসে চামড়া পু’ড়ে ঝলসে যাচ্ছে যেনো। কোনটাকে প্রাধান্য দিবে, মাফিয়ার রাগ, নাকি তার কথাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না ঈশানী, ফলস্বরূপ ধড়ফড়িয়ে উঠে বললো,
— কি চাইছেন আপনি?কেন করছেন এসব?
— আমি তোমাকে চাই। শুধু তোমাকে! জানিনা কি করে হলো এসব , কেন হঠাৎ কড়াপড়া হৃদয়টা বেইমানি করলো আমার সঙ্গে। কিন্তু আমি পারিনি, তোমার চাহিদা থেকে নিজের নির্জীব হৃদয়কে শত চেষ্টা করেও আটকাতে পারিনি আমি। নিজের টেরিটোরি, আন্ডারওয়ার্ল্ড, পাইথন প্যারাডাইস সবকিছু ফেলে এখানে পরে আছি। ইউ নো হোয়াট, শুধু তোমার জন্য।
শুনতে হাস্যকর হলেও তোমাকে না দেখে, তোমার প্রতিটি নিঃশ্বাসের শব্দ না শুনে থাকতে পারিনা আমি, বুকের ভেতর যন্ত্রণা হয় ভীষণ , খুব গভীরে কিছু একটা পু’ড়তে থাকে সারাক্ষণ । আমি সত্যিই জানিনা এসব আমার সঙ্গে কি হচ্ছে? কেনইবা হচ্ছে? বাট দ্যাট’স হাউ আই এ্যাক্সুয়ালি ফিল।
মাফিয়া বসের সহজ সীকারোক্তি।
কথা শেষ করে আস্তে করে ঈশানীকে ছেড়ে দিলো এরীশ। ব্যতিগ্রস্ততায় ভারী হয়ে আসা মাথাটা,নিঃশব্দে ব্যাকসিটে এলিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
— আমি তোমার চোখে শুধুই একটা টর্রচারার। আই উইশ আমি সময়টাকে পেছনে নিয়ে যেতে পারতাম, আর ওই বাজে, বীভৎস অতীত গুলো তোমার স্মৃতি থেকে পুরোপরি মুছে দিতাম। কিন্তু সেটা কখনোই সম্ভব নয়। দ্যাট’স হোয়াই আমি তোমার চোখে সারাজীবন ওই অ’ত্যাচারী জানোয়ারটাই রয়ে যাবো, যাকে তুমি দুনিয়ার সবথেকে বেশি ঘৃণা করো। অথচ আমাকে দেখো, তোমার ওই চোখের ঘৃণাতে প্রতিমূহুর্তে জ্বলেপু’ড়ে খাক হয়ে যাই আমি।
এক মনে অজস্র কথা আওড়াচ্ছিল এরীশ। ঠিক তখনই ভাইব্রেট আওয়াজ তুলে অকস্মাৎ বেজে ওঠে ফোনটা। সম্বিত ফিরে পায় মাফিয়া বস। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কানের এয়ারপড সচল করে রিসিভ করে ফোনকল। পরিস্থিতি গুমোট। চুপচাপ অপরপ্রান্তের কথাগুলো নির্বিকারে শুনলো এরীশ। অতঃপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই চোখের পলকে সিট বেল্টটা টান মে’রে খুলে জোর হস্তে ধাক্কা দিয়ে রাস্তার অদূরে ছিটকে ফেলে দিলো ঈশানীকে।
আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩২
অকস্মাৎ ঘটনায় হতবিহ্বল ঈশানী। রাস্তার খাদে পরে গিয়ে আর্তনাদে গুঙিয়ে উঠলো মেয়েটা, সঙ্গে সঙ্গে ব’ম্ব বি’স্ফোরণের প্রকাণ্ড আওয়াজে প্রকম্পিত হলো ধরণি। ফাঁকা মস্তিষ্কে আচানক পেছনে ফিরে চাইলো ঈশানী, দেখলো একটু আগেই বি’স্ফোরিত হয়ে দাউদাউ অগ্নিশিখার অনলে শূন্যে ভাসছে গাড়িটা। তা দেখে মূহুর্তেই অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠলো নাজুক রমনী,
— অরণ্যওওওওও!