আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩৪

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩৪
suraiya rafa

নিশুতি রাতে এক পরাস্ত রমনীর আহত চিৎকারে জাগ্রত হয়ে ওঠে সমগ্র প্রকৃতি। নিশাচর জন্তু জানোয়ারের অযাচিত হুংকারে ধড়ফড়িয়ে ডানা ঝাপটায় ঘুমন্ত পক্ষীকূল। নিগূঢ় চিৎকারে গলার স্বর ভঙ্গুর হয়ে ওঠে ঈশানীর, দম আটকে শ্বাসযন্ত্রের কার্যক্রম মূহুর্তে স্তব্ধ হয় কণ্ঠনালীর আগায়। ফলস্বরূপ ব্যাকুল চিত্তে এদিক ওদিক চোখ বোলায় মেয়েটা। জনমানবহীন নির্জন হাইওয়ে। রাস্তার দু’ধারে ঘন জঙ্গল আর ছোট বড় পাহাড় ব্যাতিত কোনো লোকালয়ের উপস্থিতি নেই। কয়েক ক্রোশ ব্যতিরেকে ল্যাম্পপোস্টের ক্ষীণ আলো পুরোপুরি আচ্ছাদন করতে পারেনা বিস্তৃত সড়কের ভয়াল তমশাকে।

অমানিশার আকাশে চাঁদের দেখা নেই, আগ্রাসী আঁধারের অশরীরী যেন মাথা চাঁড়া দিয়েছে সড়কের দু’ধারে। প্রগাঢ় আঁধারের বুক চিঁড়ে কেবল র’ক্তি’ম দাবদাহের অসহনীয় উৎপীড়ন। বিলাসবহুল রোলস রয়েসটা দুমড়ে মুচড়ে একীভূত হয়ে খেলনা গাড়ির মতোই পরে আছে কিনারায়।
তিমিরে ঢাকা ভয়াল প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে জঙ্গলের অদূর থেকে ভেসে আসা হুতুম পেঁচার বিদঘুটে আওয়াজে আচমকা বুকের র’ক্ত ছলকে ওঠে ঈশানীর। দ্বিতীয় দফায় চারিদিকে তাকিয়ে নিশ্চিত করে নেয় নিজের অবস্থান। রাস্তা থেকে অনেকটা নিচে ঝোপঝাড়ের মাঝে একটা কর্দমাক্ত স্যাঁতসেতে খাদে ভেঙেচুরে পরে আছে ও। এখান থেকে তড়িঘড়ি করে বেয়ে ওঠা মুশকিল বললে ভুল হবে, একেবারে অসম্ভব।অগত্যা নিজের জায়গায় অনড় থেকে ভগ্ন স্বরে ফ্যাসফ্যাসিয়ে ফের এরীশকে ডেকে ওঠে ঈশানী,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— অরণ্য, অরন্য, শুনতে পাচ্ছেন?
ঈশানীর ক্ষীণ আওয়াজ আদৌও রাস্তা অবধি পৌঁছেছে কিনা সন্দেহ। যার দরুন ফাঁকা মস্তিষ্ক আর প্রবল ব্যতিগ্রস্ততায় খানিকক্ষণ নৈঃশব্দ্যে অতিবাহিত হয় সেখানেই। অতঃপর
ল্যাম্পপোস্টের টিমটিমে আলোতে নিজের শরীরের দিকে লক্ষ্য করে ডুকরে কেঁদে ওঠে মেয়েটা। বনবিঁচুটি আর কণ্টকের আ’ঘাতে মোলায়েম হাত পা গুলো ছি’ড়েখুঁড়ে একাকার। এ কোথায় নিয়ে এলো এরীশ তাকে? “এরীশ” নামটা তীরের ফলার মতো মস্তিষ্কে গিয়ে আটকালো ওর। তৎক্ষনাৎ সম্বিত ফিরে পেয়ে আরেকদফা ধড়ফড়িয় ওঠে ঈশানী । মনের মাঝে দানাবাঁধে তীব্র আশঙ্কার তুফান।
— এরীশ ঠিক আছে তো?

এইতো কিছুক্ষণ আগেই অতোগুলো কথা বলেছিল এরীশ । মেপে মেপে কথা বলা লোকটার মুখে অমন সহজ স্বীকারোক্তিতে বাকরূদ্ধ হয়ে পরেছিল ঈশানী। ঘৃণার প্লাবনে পোক্ত বেরিগেড টেনে দিয়েছিল আবেগাশ্রু। বাকশক্তিহীন এক নাজুক কবুতরের ন্যায় শুধু চেয়ে থেকেছিল অনিমেষ। অন্তঃগহ্বরে কোথাও একটা অনিশ্চয়তার অনুভূতি হয়েছিল বটে। যেন ভেতরের সত্তা চ্যাঁচিয়ে বলছিল,
— মাফিয়া বস আমাকে কেন চাইবে? সে তো ভালোবাসতে জানেনা, সে তো হৃদয়হীন অন্ধকার গোলোক ধাঁধা মাত্র । তাহলে কিসের এই অনুভূতি? কেনই বা হুট করে এতো নমনীয়তা তার? ওই কড়াপড়া শুষ্ক হৃদয়ে আদৌও কি প্রণয়ের বর্ষন নামানো সম্ভব?

ওয়েল, ভালোবাসা সব পারে। সেটা কিছুক্ষণ পরেই টের পেয়েছিল ঈশানী। যখন ওই হৃদয়হীন জানোয়ারটা নিজের সিট বেল্টের পেছনে এক মূহুর্ত সময় অতিবাহিত না করে ঈশানীর সিট বেল্ট খুলে দিয়েছিল। নিজের জীবনের পরোয়া না করে ঈশানীকে বাঁচিয়েছিল। আর তারপরই ভ’য়াবহ সেই বো’মা বি’স্ফো’রণ। খানিকক্ষণ আগের কথা ভেবে হতচকিত হয়ে উঠলো ঈশানী। ক্লান্ত শরীরের সবটুকু সংকীর্ণতা ভুলে মুঠিবদ্ধ করলো দু’হাত। মনোবল স্থির রেখে দাঁড়ালো ধীরে ধীরে।
রাস্তার পানে নজর বুলিয়ে দৃঢ় স্বরে বলে উঠলো,

— এরীশের কিছু হতে পারেনা। যে করেই হোক এখান থেকে উঠে তাকে ঠিক খুঁজে বের করবো আমি।
একমুহূর্তের জন্য পেন্ট হাউজের বীভৎস স্মৃতিগুলো ভুলে গেলো ঈশানী, ভুলে গেলো এই মানুষটাকে ও ঠিক কতটা ভয় করে।আজ থেকে বছর খানিক আগে তার আগমন ওর সাবলীল জীবনকে ঠিক কি ভাবেই না লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল প্রলয়ের তান্ডবে । অথচ সেই নিষ্ঠুর হৃদয়ের মরীচিকার সম্রাটের সামান্য অনিশ্চয়তা কত গভীর ভাবেই না চিন্তিত করে তুলেছে রমনীকে। প্রাকৃতিক ভাবেই মানুষ নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়, ঈশানী তার জলজ্যান্ত প্রমান। ভদ্র, সভ্য, উজ্জ্বল ভবিষ্যতধারী মাহিন নয়, বরং অন্ধকার দুনিয়ার পাপিষ্ঠ হৃদয়হীন এরীশের জন্য অন্তর পু’ড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে ওর। এই অনুভূতির নাম জানা নেই, আছে শুধু বুকের র’ক্ত তোলপাড় করা নিষিদ্ধ সব চাহিদা। যা সমাজ, মানবকূল এমনকি পুরো পৃথিবীর অন্তরায়।

সুউচ্চ ঢাল, রাস্তা বেয়ে একদম খাঁড়া হয়ে নেমে এসেছে খাদে। আশেপাশে বন্য লতাপাতা আর কণ্টক গাছের অভাব নেই, সোঁদা মাটির উপর দু’পা রেখে অন্ধকারের মাঝে সেগুলোই হাত দিয়ে চেপে ধরলো ঈশানী। সঙ্গে সঙ্গে কাঁটার আ’ঘাতে বিদীর্ণ হলো ওর পেলব করতাল। মাত্রাতিরিক্ত ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে গাছের বাঁকল ছেড়ে দিয়ে ফের কর্দমাক্ত মাটিতে ধপ বসে পরলো মেয়েটা। হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে ফের অসহায় সুরে বলে উঠলো,
— কিভাবে উঠবো আমি? আপনি ঠিক আছেন তো?
কিয়ৎক্ষন নীরবতায় অতিবাহিত হলো, পরমূহুর্তেই এরীশের কথা ভেবে গা ঝেড়ে দাঁড়িয়ে পরলো ঈশানী।পায়ের জুতো জোড়া সেখানেই ফেলে রেখে নখের সাহায্যে সন্তোর্পণে খামচে ধরলো ভেজা মাটি। এক পা, দু’পা করে উঠে এলো অনেকটা। আশেপাশের বনবিচুটি আর কণ্ঠক ফুলে বিঁধে চিড়চিড় করে ছিঁড়ে গেলো ওর পরনের ফিনফিনে সাদা কুর্তিটা।

নিজের অসহায়ত্ব গায়ে মাখলো না ঈশানী। স্যাঁতেসেতে মাটিতে হামাগুড়ি দিতেদিতে এসে দারস্থ হলো শুকনো বালির। তখনই আরেকদফা দফা তীক্ষ্ণ টান অনুভব করলো খোলা চুলে। আঁধারের মাঝে কোনোকিছু স্পষ্ট দেখার জো নেই, পেছনে ফিরে তাকানোর মতো বুকে সাহস নেই, অগত্যা নিজের রেসমের মতো সর্পিল চুলের খানিকটা বিসর্জন দিয়ে তরতরিয়ে উঠে এলো রাস্তায়।
ঈশানী যখন রাস্তায় উঠেছে তখন ওর অবস্থা বেগতিক, সমস্ত শরীর জুড়ে টনটনে ব্যথার উপশম, পরনের কূর্তিটা ছিঁড়ে কুচিকুচি। নির্মেদ কোমর, পেলব ত্বক সবকিছু উন্মুক্ত। লেডিস জিন্সটার একাংশ কাঁদায় মাখামাখি,গমরঙা সুশ্রী ত্বক জুড়ে ছোপ ছোপ র’ক্তের অজস্র ক্ষ’তচিহ্ন। নিজের শরীরে একপল নজর বোলানোর ফুরসত হলোনা ঈশানীর, উল্টো দিশেহারা হয়ে রাস্তার এদিক ওদিক সচকিত দৃষ্টিপাত করে ভঙ্গুর স্বরে চ্যাঁচিয়ে ডাকতে লাগলো এরীশকে,

— অরণ্য, অরণ্য, আপনি কোথায়?
প্রত্যুত্তর এলো না,ক্রন্দনরত গলায় পরপর আবারও ডাকলো ঈশানী,
— আপনি কোথায় চলে গেলেন? অরণ্য….
কয়েক মূহুর্ত অতিবাহিত হলো অনিশ্চয়তায়। নিগূঢ় ব্যথায় নীল হয়ে উঠছে রমনীর হৃদয়,আত্ন চিৎকারে খেই হারাচ্ছে অন্তঃকরণ। ঠিক এমন সময় ছাই হয়ে যাওয়া ধ্বং’সাবশেষ গাড়ির অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে আছে পুরুষালি গোঙানির ক্ষীণ আওয়াজ। সামান্য আওয়াজে কর্ণ সচল হলো ঈশানীর, আর এক মূহুর্তও দেরী না করে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটলো সেদিকে।গাড়ির নিকট গিয়ে নিভু নিভু অঙ্গার মারিয়ে, আলতো পায়ে খানিক এগুতেই দেখতে পেলো এরীশকে। জলন্ত গাড়ির অপর পার্শে গাছের গুঁড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগে অবচেতন হয়ে পরে আছে সে।

এরীশকে দেখা মাত্রই ভীষণ স্বস্তিতে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠলো ঈশানী। শরীর জুড়ে ঝরঝরিয়ে নেমে এলো ক্লান্তি। হৃদয় গহীনে অকস্মাৎ বয়ে গেলো নৈসর্গিক প্রশান্তির হাওয়া। সংকুচিত পায়ে আরেকটু এগুলো মেয়েটা। কাছাকাছি যেতেই দেখতে পেলো, নিদারুণ র’ক্তের প্রবাহে সিক্ত হয়ে আছে এরীশের সমগ্র মুখমণ্ডল।
উজ্জ্বল কঠিন চেহারা জুড়ে বীভৎস র’ক্তের লালিমা বড্ড চোখে লাগলো ঈশানীর। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে তৎক্ষনাৎ বসে পরলো ওর শিওরে,নির্দ্বিদায় হাত বাড়িয়ে অপছন্দের পুরুষের মাথাটা সন্তোর্পণে তুলে নিলো নিজের কোলে। মোলায়েম হাত দুটো নিয়ে রাখলো মাফিয়া বসের খরখরে পুরুষালি কপোলে, করুন আর্তনাদ করে বললো,

— এ…এতো র’ক্ত কেন! এরীশ শুনছেন?
দু’হাত দিয়ে ঝাঁকিয়ে উঠলো ঈশানী। অতঃপর সুদর্শন র’ক্তাক্ত মুখটাকে এদিক ওদিকে ঘুরিয়ে খুঁজতে লাগলো র’ক্ত প্রবাহের আসল উৎস। খানিক বাদে আলো আঁধারির ধোঁয়াসায় আবছা দৃষ্টিপাত করলো মাফিয়া বসের কপালে। চোখে পরলো বীভৎস ক্ষ’ত। তৎক্ষনাৎ নিজের গলার স্কার্ফটা দিয়ে ওর চওড়া কপালটা প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে হেঁচকি তুলে কেঁদে উঠলো ঈশানী। বিড়বিড়িয়ে বলতে লাগলো,
— আপনাকে আমি ঘৃণা করি। খুব, খুব, খুব ঘৃণা করি। কি করলেন আপনি এটা? এরকমটা তো আপনার করার কথা ছিলনা। আপনি যে হৃদয়হীন, নিষ্ঠুর, তাহলে সব বাদ দিয়ে আমাকে কেন বাঁচালেন?
ফের নীরব চিত্তে অনর্গল অশ্রু বিসর্জন।

কয়েক প্রহর অচিরেই অতিবাহিত হলো নিস্তব্ধতায়। ঈশানীর এলোমেলো চুলে ঢাকা পরেছে অশরীরীর র’ক্তাক্ত মুখমণ্ডল। বাঁধভাঙা কান্নার তোড়ে রমনীর নির্মেদ পেটের ওঠা নামার ঘর্ষণে ক্রমাগত নড়েচড়ে ওঠে মাফিয়া বস। এক পর্যায়ে নিজের সম্ভ্রমহীন উন্মুক্ত কোমড়ের খাঁজে গরম নিঃশ্বাসের প্রগাঢ়তায় অকস্মাৎ শিউরে ওঠে নাজুক মেয়েটা। গভীর নিঃশ্বাসে পেলব ত্বক ঝলসে যাওয়ার উপক্রম, সহসা তন্দ্রা কাটে ঈশানীর। কান্নাকাটির লাগাম টেনে ফোপাঁতে ফোপাঁতে নিগূঢ় দৃষ্টিপাত করে এরীশের মুখপানে। শুনতে পায় অস্ফুট স্বরের বিড়বিড়ানি,
— ভ্যানিলা।

ছোট একটা শব্দের প্রয়োগ করে ফের গভীর শ্বাস টানলো এরীশ। হতচকিত হয়ে পরলো ঈশানী। দু’হাতে এরীশের কপোল ঝাঁকিয়ে মৃদু আর্তনাদ করতে লাগলো অর্হনিশ। বললো,
— আপনি এটা কি করলেন? যদি কিছু হয়ে যেত? আমাকে বাঁচাতে গিয়ে আপনি এতোটা আ’ঘাত প্রাপ্ত কেন হলেন ? কি হই আমি আপনার?
প্রত্যুত্তর এলোনা অপরপ্রান্ত থেকে, উল্টো সাকুরাকে গভীর নজরে পরখ করে, স্ফীত আওয়াজে প্রশ্ন ছুড়লো মাফিয়া বস,

— একটা জা’নোয়ারের জন্য এভাবে কাঁদছো? ইট’স নট ফেয়ার।
উথালপাথাল মিশ্র অনুভূতির তোড়নে ফের ঠোঁট কামড়ে ফুঁপিয়ে উঠলো ঈশানী। আজ কিছুতেই বাঁধ মানছে না প্রবল অশ্রুধারা। হৃদয়ের ব্যথা, মস্তিষ্কের নিষেধাজ্ঞা সব একীভূত হয়ে উগরে দিচ্ছে আবেগাশ্রু। কোলের উপর নির্লিপ্তে শুয়ে থাকা ঘৃণিত অস্তিত্বের দিকে নিস্প্রভ চেয়ে মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতেই বলতে লাগলো,
— আমি জানিনা আমি কেন কাঁদছি। কেন এমন করে আমার হৃদয় ছিঁ’ড়ে যাচ্ছে। কেনইবা আপনার কষ্টে এতোটা দহন অনুভূত হচ্ছে অন্তরে। বিশ্বাস করুন, আমি আমার এই নিষিদ্ধ অনুভূতি গুলোকে আটকাতে পারছি না, নিজেকে সামলাতে পারছি না কিছুতেই।

— নিজের জন্য তোমার চোখে ঘৃণা দেখে অভস্ত্য আমি সাকুরা , কান্নাটা কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না।তুমি কি প্লিজ এটা অফ করবে? সামথিং ইজ বার্নিং হেয়ার।
আঙুল দিয়ে নিজের সুডৌল বক্ষদেশে ইশারা করলো মাফিয়া বস। যা দেখে ঈশানী কাঁদতে কাঁদতে বললো,
— এভাবে কেন জীবনের ঝুঁকি নিতে গেলেন হঠাৎ ? যদি আপনার কিছু হয়ে যেত তাহলে…
— কিছুই হতোনা।
কথার মাঝপথে থমকে গেলো ঈশানী। নরম কোল থেকে ধীরে ধীরে মাথা তুলে ওর মুখোমুখি হয়ে বসলো এরীশ। বললো,

— আমি ম’রে গেলে কিছুই হতোনা। সমগ্র পৃথিবীর কোথায় কিছু থমকে যেতো না। বরং একটা দূধর্ষ টেরোরিস্টের মৃ’ত্যুতে বেঁচে যেত গোটা জেনারেশন।
চারিপাশে অসহনীয় নীরবতা। ভীত মেয়েটা ফ্যালফ্যালিয়ে চেয়ে আছে শুধু। এই মূহুর্তে অপর প্রান্তের মানুষটাকে ব্ল্যাক হোলের মতোই অস্বাভাবিক শূন্য দেখাচ্ছে। যেন তার অসীম রহস্য আবৃত অস্তিত্ব জুড়ে ঈশানী এক ধরাশায়ী কীটপতঙ্গ মাত্র। নীলের গভীরতা প্রগাঢ় হলো চোখে, নিগূঢ় দর্শনে মানুষটাকে পরখ করতে করতে আনমনে ভাবলো রমনী,

— বোধ হয় থমকে যেতো, আমার দ্বিধাগ্রস্থ অবচেতন হৃদয়টা।
— তোমার আর মাহিনের বিয়েটা হচ্ছে না। বিয়ে তো দূরে থাক দ্বিতীয়বার তোমার দিকে চোখ তুলে তাকালে ওকে জ্যান্ত ক’বর দেবো আমি।
গম্ভীর রাশভারি আওয়াজে ভাবনার ছেদ ঘটে ঈশানীর। নিগূঢ় দৃষ্টি ঢাকা পরে যায় অবিশ্বাস্য চাহনির আড়ালে। সরু গলার ফাঁক গলিয়ে বেড়িয়ে আসে হতবিহ্বল কণ্ঠস্বর,
— আপনি কি পা’গল! নিজের শরীরের দিকে একবার তাকান।কতটা র’ক্তাক্ত হয়ে আছেন, আপনার ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন। আর আপনি পরে আছেন আমার বিয়ে নিয়ে?

* নিঝুম নিরিবিলি রাতে মুখোমুখি একজোড়া উচাটন অস্তিত্ব। বারুদের মতো জ্বলছে হৃদয়। অযাচিত অনুভূতির তুফানে ধরাশায়ী অন্তঃকরণ ।অথচ নিরাময়ের উদ্ভাসনে নিতান্তই অপারগ দু’জন। সেই তখন থেকে নির্লিপ্তে চেয়ে আছে এরীশ। স্ট্রিট লাইটের নিয়ন আলোক শিখায় রমনীর অপ্রীতিকর ভূষণ সুস্পষ্ট হয় মানবের মোহনীয় দৃষ্টে। শরীরের ফিনফিনে কাপড়টুকু নিতান্তই অনুপস্থিত। জামা ছিঁড়ে দু’ভাগ হয়ে যাওয়ার দরুন,উন্মুক্ত হয়ে আছে আলো পিছলানো মোম নরম পেলব ত্বক। নিঃশ্বাসের তালে তালে নির্লিপ্তে ওঠানামা করছে কবুতরি নরম বক্ষপিঞ্জর। নারী শরীরের অতি সংবেদনশীল বাঁকানো উপত্যকা জুড়ে লেপ্টে আছে এক টুকরো ফিনফিনে ভূষণ। সম্ভ্রম আচ্ছাদনে যা নিতান্তই সামান্য। যথাযথ জামার অস্তিত্ব না থাকায় ধনুকের মতো নারী দেহটা স্পষ্ট দৃশ্যমান এরীশের চোখে।

মেয়েটাকে মোহাবিষ্টের ন্যায় পরখ করতে করতেই এতোক্ষণে টনক নড়ে তার। ঈশানীর এই নাজেহাল অবস্থার জন্য নিজেকে দ্বায়ী করে আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে এরীশ। তবে দৃষ্টি সরায় না কিছুতেই, আর না তো অক্ষিপুট নমিত করে একপল। প্রগাঢ় অধিকার বোধ নিয়ে মৌহ দৃষ্টে চেয়ে থাকে নির্নিমেশ। যেন ওর নিকট অতিপরিচিত এই দৃশ্য। সেই থেকে বাকশূন্য এরীশ। আবছা আঁধারে ওর শূন্য চোখ দু’টো অবলোকন করে ঈশানী, অতঃপর গভীর দৃষ্টি অনুসরণ করে নজর বোলায় নিজের শরীরে। সঙ্গে সঙ্গে আড়ষ্টতায় কুঁকড়ে ওঠে মেয়েটা। কর্তিত ডগার ন্যায় গুটিয়ে গিয়ে দু’হাতে নিজের সম্ভম ঢাকার আপ্রাণ চেষ্টায় অবিরত থেকে ঘুরে বসে অন্যদিকে। তাতে অবশ্য লাভ হলোনা বিশেষ, কারণ পেছনের দিকের ও একই অবস্থা। অগত্যা উপায়ন্তর না পেয়ে মেয়েটা রিনরিনে আওয়াজে বলে ওঠে,

—দয়া করে চোখ সরান। আ.. আসলে তখন অন্ধকারের মাঝে…
কথাশেষ করার ফুরসত পেলোনা ঈশানী, তার আগেই পেছন থেকে বড়সড় বস্ত্রের আবরণে আচ্ছাদিত হলো ওর উন্মুক্ত নারী শরীর । নিজের হুডিটা ঈশানীর শরীরে চড়িয়ে দিতে দিতে নির্বিগ্নে বলে উঠলো এরীশ,
— ডোন্ট এক্সপ্লেইন, কিচ্ছু বলতে হবেনা। আমি বুঝতে পেরেছি।
কাপড়ের ছোঁয়ায় ভীষণ স্বস্তি পেলো মেয়েটা। দ্রুত হাতে হুডির চেইনটা লাগিয়ে পেছনে ঘুরলো সহসা।তৎক্ষনাৎ বিনা অনুমতিতে ওকে একটানে কোলে তুলে নিলো এরীশ। আবছা আলোতে ঈশানী তাকিয়ে দেখলো,মাথায় প্যাঁচানো ওড়নার একাংশ দিয়ে খুব ভালো মতো নিজের মুখটা আড়াল করে নিয়েছে স্যান্ডো গেঞ্জি পরিহিত এ্যাবস ধারী বলবান পুরুষ । কিন্তু আহত শরীরে এভাবে কোলে তোলার কি প্রয়োজন? অগত্যা বাঁধ সাধলো ঈশানী, তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো,

— আরে আরে কোলে কেন তুলছেন?আমি ঠিক আছি।
— পায়ের চামড়ার একাংশ ও অক্ষত নেই, তাহলে ঠিক কিভাবে আছো?
জবাব দিলো না ঈশানী, আলতো করে মাফিয়া বসের পুরুষালি গ্রীবায় দু’হাত প্যাঁচিয়ে নিশ্চিত করলো দৃঢ়তা। অতঃপর লোকটার আবৃত মুখাবয়ব পরখ করে শুধালো,
— মুখ কেন ঢেকেছেন?
— তোমাকে সেফ রাখার জন্য ।
বিস্তার সড়কের ফুটপাত ধরে ধাতস্থ পায়ে এগুতে এগুতে রাশভারি আওয়াজে জবাব দিলো এরীশ।
এবারে কিঞ্চিৎ সাহস দেখিয়ে বলে উঠলো ঈশানী,

— আমাকে সেফ রাখার জন্য এভাবে নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন। কি হই আমি আপনার?
থমকালো এরীশ। পায়ের গতি পুরোপুরি স্থীর করে অকস্মাৎ দাঁড়িয়ে পরলো মাঝরাস্তায়।এরীশের হঠাৎ থেমে যাওয়া দেখে কুণ্ঠিত হলো ঈশানীর নাজুক চিত্ত। দৃঢ় হাতে গলা প্যাঁচিয়ে বুকের উপর সন্তোর্পনে লেপ্টে থাকা হতচকিত মেয়েটার পানে নিগূঢ় দৃষ্টিপাত করলো মাফিয়া বস। অতঃপর কপালে কপাল ঠেকিয়ে মিলন ঘটালো নেত্রদ্বয়ের। নীরবে অতিবাহিত হলো কয়েক মূহুর্ত, পরপরই দু’চোখ বুজে গভীর শ্বাস টানলো এরীশ, একমুহূর্তের জন্য দুনিয়া,সমাজ এমনকি সকল বিঘ্নতা ভুলে হাস্কিস্বরে সম্মোধন করে উঠলো,
— প্রেম আমার।

রাত প্রায় নয়টা। আমবশ্যার আঁধারে স্থবির চারিপাশ। অফ হোয়াইট রেঞ্জ রোবারটা মাত্রই এসে থেমেছে ঈশানীদের মহল্লার গলিতে। এখানে থেকে মিনিট দু’য়েক হেঁটে গেলেই দেখা পাওয়া যায় ওদের শ্যাওলা পরা দোতলা বাড়ির। গাড়ির অকস্মাৎ ব্রেকে কিঞ্চিৎ ভড়কালো ঈশানী, শুষ্ক একটা ঢোক গিলে এরীশকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— আপনি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে আছেন। ড্রাইভার লোকটাকে সাথে নিয়ে এলেই পারতেন।
— আমি ঠিক আছি।
ছোট্ট করে জবাব দিলো এরীশ। ঈশানীও কথা বাড়ালো না আর। হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে জানালো,
— ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি।
তৎক্ষনাৎ বাঁধ সাধলো এরীশ। ঈশুর গতি প্রতিরোধ করে বললো,

— পেছনের সিটে স্নিকার্স আর জামা কাপড় রাখা আছে, চেঞ্জ করে তারপর যাও।
— লাগবে না আমি ঠিক আছি।
কিছু একটা ভেবে জিভের ডগায় গাল ঠেললো এরীশ, কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে চট করেই বলে উঠলো,
— তুমি কি শুধু ইনার পরা অবস্থায় বাড়ি ফিরতে চাচ্ছো নাকি?
মাফিয়া বসের আচানক বাক্যবানে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পরলো ঈশানী। লজ্জা,ভয়, সংকোচের মিশেলে ফাঁকা হয়ে গেলো রমনীর ফিনফিনে ওষ্ঠাধর। সহসা ফুরিয়ে এলো শব্দভান্ডার, জুতসই প্রত্যুত্তর করার কোনোরূপ বাক্যই খুঁজে পেলো না আর। মেয়েটাকে এভাবে চুপচাপ নির্লিপ্ত বদনে বসে থাকতে দেখে পুনরায় বলে ওঠে এরীশ,
— আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। চেঞ্জ করে নেমে এসো।
নিজের কথা শেষ হলে, কোনোরূপ প্রত্যুত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই ইলেকট্রিক সিগারেটটা মুঠোয় পুরে তাড়াহুড়ো গাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলো এরীশ।

গাড়ির সঙ্গে বেশ অনেকটা দূরত্ব বাড়িয়ে রাস্তার ধারে সটান দাঁড়িয়ে আছে এরীশ। ঠোঁটের ফাঁকে উদ্ভাসিত ধোঁয়ার কুণ্ডলী তার।চওড়া কপালে আঁটকে আছে সফেদ গজের মোটা প্রলেপ। ধারালো মুখাবয়ব জুড়ে শূন্য অভিব্যক্তির নিদারুণ অস্তিত্ব। মস্তিষ্ক ভার হওয়া তীব্র য’ন্ত্রনারা মোটেই ছুঁতে পারেনা মাফিয়া বসকে। তবে বাংলাদেশের মতো একটা রেস্ট্রিকটেড জায়গায় দাঁড়িয়ে, এমন দুঃসাহসিক একটা কাণ্ড যে ঘটিয়েছে তাকে নিয়ে দু’দণ্ড না ভাবলেই নয়। পাইথন লিডারের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ গেম খেলছে ,নিশ্চয়ই সাধারণ প্রজাতির কোনো পাতি গুন্ডা নয় সে। অতকর্তিতে ভাবনায় ডুবলো এরীশ। ঠিক তখনই মধ্য বয়সী কর্কশ গলার এক উদ্ভট সম্মোধনে ধ্যান ভাঙে ওর।
— ওই ফুয়ায়া!

ব্যান্ডেজ আবৃত কপালে তীক্ষ্ণ ভাজ টানলো এরীশ। খানিক বিরক্ত হয়ে ঘুরে তাকালো পেছনে, দেখলো মাঝ বয়সী এক বৃদ্ধ লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে অপর প্রান্তে। এরীশের তীক্ষ্ণ চাহনি পরখ করে ফের তিরিক্ষি আওয়াজ ছুড়লো বৃদ্ধ। নাক মুখ সিঁকোয় তুলে বলে উঠলো,
— ওয়া, তুই হন? আরার ফারার মাইয়া অক্কলের লগে এতো লাতিয়া কিরর? উনো, ইবা ভদ্র মাইনশের এলাহা, এডে ফেম ফিরিতির নামোত, এইল্লা লাশারা গিরি নো চলিবো। এইল্লা অইলে, এলাহার, বেক্কিনোরে ডাকি এনে হন ফরিবো।(কে গো তুমি ছোকরা? আমাদের মহল্লার মেয়েদের সাথে এতো রাতে কি তোমার? শোনো, এটা ভদ্রলোকের এলাকা, এখানে প্রেমপিরিতির নামে এসব বেলাল্লাপনা চলবে না। এমন হলে কিন্তু মহল্লার সবাইকে ডেকে ডেকে জানাবো আমি।)

অকস্মাৎ চড়াৎ করে ফুঁসে উঠলো মস্তিষ্ক। বৃদ্ধের কথায় নির্বিকারে দাঁতে দাত পিষলো এরীশ। ছেলেটার এহেন বেয়াদবি, ম্যানারলেস মুখাবয়ব পরখ করে ফের কথা ছুড়লেন বৃদ্ধ,
— ওবুক ওবুক! এইল্লা ভাব গরের, লাগেদ্দে হাই ফেলিবো আরে। হইদ্দি, গাড়ীর ভিতর হোন মাইয়াফুয়া গল্লাই লাইক্কো? লাতিয়া জোয়ান মাইয়া ইবা কিরের, ফোয়া অক্কলের লগে। নাম হ সাঈ! আই এহন বিচার দিওম ইতির বাড়িত
(আরেহ বাপ রে বাপ!ভাবখানা দ্যাখো,এমনে চাইয়া আছে যেন গিলা খাইবো আমারে। বলি গাড়ির মধ্যে কোন মাইয়া আছে? এমন রাতবিরেতে জোয়ান ছেলেগো সাথে কি করে সে? নাম বলো, আমি এক্ষুনি বিচার দিমু অর বাড়িতে।)

বৃদ্ধের কুঁচকে যাওয়া ঢলঢলে গ্রীবাদেশ খুব করে টানছে এরীশকে। কণ্ঠনালির ঠিক মাঝ বরাবর একটা গভীর ক্ষ’ত সৃষ্টি করতে পারলে খানিক শান্তি লাগতো বোধ হয়। পৈশাচিক আশে মত্ত হয়ে দক্ষ কৌশলে শর্টনাইফটা বের করেও কি ভেবে যেন আবার সেটাকে চুপচাপ আড়াল করে ফেললো এরীশ। খরখরে করতালের মাঝে ধারালো চা’কুটা চেপে রেখে, অকস্মাৎ নিক্ষেপ করলো জোড়ালো গম্ভীর আওয়াজ ,
— বউ হয়! গাড়িতে বসা মেয়েটা বউ হয় আমার। লিগ্যাল ওয়াইফ বোঝেন নিশ্চয়ই ?
তৎক্ষনাৎ স্তব্ধ হয়ে গেলো বৃদ্ধ। জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে নিজের ভুলভাল সম্মোধনের জন্য অজস্র দুঃখ প্রকাশ করে, ফের উদ্ভ্রান্ত হয়ে বলে উঠলেন তিনি,

—ও আইচ্চে,আগে নো হইবা তুই, আরার এলাহার জামাই ওঁ দে,। তো তুই হোন বাড়ির জামাই, ও ফুৎ? (ওহ! আগে বলবনা তুমি আমাদের মহল্লার জামাই হও। তা তুমি কোন বাড়ির জামাই বাবা?)
বৃদ্ধার কথার পাছে এরীশ কিছু বলবে, তার আগেই গাড়ির ভেতর থেকে শীতল গলায় ডেকে উঠলো ঈশানী,
— হয়ে গিয়েছে আসুন এবার।
বিব্রতকর পরিস্থিতি সামাল দিতে জোর পূর্বক হেসে তড়িঘড়ি করে প্রস্থান করে বৃদ্ধ। লোকটা চলে গেলে গাড়ির অভিমুখে পা বাড়ায় এরীশ। কাছাকাছি এলে ঈশানী জানতে চায়,

— কে উনি?কিছু বলেছে দেখলাম।
— নাথিং মাচ । জাস্ট সাম বুলশিট।
দরজা ঠেলে ড্রাইভিং সিটে বসতে বসতে জবাব দিলো এরীশ।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ঈশানী, হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে বললো,
— ঠিক আছে, আমি আসছি এবার ।
কোনোরূপ প্রত্যুত্তর করেনা এরীশ।কেবল সাকুরার যাওয়ার পানে চেয়ে থাকে নিস্প্রভ। মেয়েটা যখন বেশ খানিকটা পথ এগিয়ে যায়, তখন হুট করেই পিছু ডেকে ওঠে ফের।

— এই যে।
লোকটার অযাচিত সম্মোধনে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে দৃষ্টিপাত করে ঈশানী। নির্বিকার চোখে তার অগণিত প্রশ্নের ছড়াছড়ি। সে দিকে চেয়ে আচমকা বলে ওঠে মাফিয়া বস,
— লং ড্রাইভে যাবে?
কিয়ৎক্ষন নীরবতা, পরমূহুর্তেই ঠোঁট উল্টে জবাব দিলো বিপরীত পক্ষ,
— চার দেওয়ালে আবৃত ঠান্ডা গাড়িতে পোষাবে না আমার । বালিকা আকাশ দেখতে চায়। একঢাল খোলা আকাশ।
— বাইক চলবে?
দ্বিতীয়বার জবাব দিলোনা রমনী। মৃদু হাসি উপহার দিয়ে ফের হারিয়ে গেলো তমশায়।

বেশ কিছুদিন পরে, মস্কো,রাশিয়া।
শীতের শহর রোদ্রজ্জল আজ। প্রখর রোদের উষ্ণতায় গলতে আরম্ভ করেছে ঠকঠকে বরফের আস্তর। পেন্ট হাউজের চারিপাশে বিস্তৃত গহীন জঙ্গলে ঝুরোঝুরো সোনালী রোদের ছটা,যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে প্রকৃতি। সেই কতগুলো দিন থেকে একা একাই পেন্ট হাউজে দিনাতিপাত করে আসছে ফ্লোরা। অবশ্য একা থাকায় বরাবরই অভস্ত্য মেয়েটা। তুষার আর এরীশ তো আর ওকে সঙ্গ দেয় না কোনোকালেই । মাঝখানে শুধু ঈশানী এসে কতগুলো দিন সপ্নের মতো কাটিয়ে চলে গেলো এখানে । যেই দিন গুলো ছিল ফ্লোরার নিকট সবচেয়ে সুন্দর,আর সবচেয়ে স্বরণীয়।

সকাল সকাল থালাবাসন ধুতেধুতে সিঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে সুমিষ্ট গলায় গান ধরেছে ফ্লোরা,
I saw peace of heaven,
Waiting patiently for me,
Down…
And i was running far away,
Would i run off the world some day,
Nobody knows,nobody knows….
— খুব সুন্দর গাও তো তুমি। আই এপ্রেশিয়েট।
গানের শেষাংশে এসে থমকালো ফ্লোরা। অযাচিত পুরুষালি আওয়াজে চকিতে ঘাড় ঘোরালো তৎক্ষনাৎ। দেখলো কাউচের উপর গা এলিয়ে দিয়ে লাউঞ্জের মাঝ বরাবর টানটান হয়ে বসে আছে টমেটো প্রিন্স। ওকে দেখা মাত্রই ভ্রু কুঁচকালো ফ্লোরা।বিতৃষ্ণ গলায় বললো,
— আপনি আবার এসেছেন? কতবার বলেছি এরীশ তুষার কেউ নেই।কথা কানে যায়নি?
— ওরা নেই দেখেই তো এসেছি প্রিন্সেস। এতো বড় পেন্ট হাউজে তোমাকে কে পাহারা দিবে বলোতো? তুষারই বা কেমন মানুষ তোমাকে একা ফেলে এভাবে চলে গেলো।
কথা বলতে বলতে কাউচ ছাড়িয়ে ধীর গতিতে কিচেন কাউন্টারের দিকে অগ্রসর হলো এ্যালেক্স। ফ্লোরা নিজের কাজে অবিরত থেকে জানায়,

— এসব ভার বকা বন্ধ করুন। পেন্ট হাউজে এতো এতো দক্ষ গার্ড থাকতে আমাকে পাহারা দেওয়ার জন্য আপনার মতো টমেটো প্রিন্সের প্রয়োজন পরবে না। দরজাটা ওদিকে আপনি আসতে পারেন।
কপট হেসে গ্রীবা বাঁকালো এ্যালেক্স। মেয়েটার গোলাপী আভাযুক্ত পেলব কানের কাছে মুখ নিয়ে হিসহিসিয়ে বললো,
— ওদের শক্তি আছে ঠিকই, কিন্তু বুদ্ধি নেই।আর আমি এও জানি তুমি আমাকে প্রচন্ড ভয় পাও। কারণ তুমি ভালো করেই জানো আমি হায়নার চেয়েও অধিক পরাশক্তিধর।
কথাশেষ করে অকস্মাৎ ফ্লোরার জামার হুকটা টান মে’রে খুলে ফেললো এ্যালেক্স।
এ্যালেক্সের কাণ্ডে থরথর করে কেঁপে উঠলো রুশকন্যা। মাখনের মতো নমনীয় পৃষ্ঠদেশে অকস্মাৎ অনুভব করলো রুক্ষ হাতের অতর্কিত স্পর্শ। সঙ্গে সঙ্গে ফুঁসে ওঠে ফ্লোরা। এক ঝটকায় এ্যালেক্সের হাত সরিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে,

— পেন্ট হাউজে দাঁড়িয়ে ফ্লোরার গায়ে হাত দিচ্ছেন, এতো সাহস হলো কি করে আপনার?
ফের ফ্লোরার নিকট এগিয়ে যেতে যেতে এ্যালেক্স বলে,
— কাম অন, ইউ আর জাস্ট আ মেইড হেয়ার।আর আমি তোমাকে প্রিন্সেস ডেকেছি, লেট’স হ্যাভ আ বিগ রাউন্ড। এখানে কেউ নেই দেখো।
তড়িঘড়িকে করে চারিদিকে চোখ ঘোরালো ফ্লোরা। সত্যিই কেউ নেই আশেপাশে, গার্ড’সরা সব গেলো কোথায়? অগত্যা শঙ্কিত চিত্তে শুষ্ক ঢোক গিললো মেয়েটা। প্রকম্পিত স্বরে বললো,
— দয়া করে চলে যান। নইলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।
ফ্লোরার কথা গায়ে না মেখে, খপ করে ওর হাতটা টেনে ধরে এ্যালেক্স, কোমল চিবুকে আলতো হাত বোলাতে বোলাতে বলে,

— কিচ্ছু খারাপ হবে না। তুমি জাস্ট নিজের মুখটা বন্ধ রাখবে।
অযাচিত স্পর্শে ঘৃণায় চোখ মুখ খিঁচিয়ে ফেললো ফ্লোরা। হাত সরিয়ে ওর ফর্সা গলায় মুখ ডোবাবে এ্যালেক্স, সেই উদ্যেগে ধীরে ধীরে গ্রীবা নমিত করলো সম্মুখে, ঠিক তখনই শক্ত হাতের তীব্র এক ক’ষাঘাত হামলে পরলো ওর সদ্য সেরে ওঠা পুরুষালি চোয়ালে। এক ঘু’ষিতে মেঝেতে মুখ থুবড়ে পরলো টমেটো প্রিন্স। ব্যথার তোড়ে গুঙিয়ে উঠে কোনোমতে পেছন দিকে ঘাড় ফিরিয়েছে কি ফেরায়নি, তৎক্ষনাৎ ওর বুকের উপর হাঁটু গেঁড়ে বসে দু’হাতে এলোপাতাড়ি ঘু’ষি দিতে শুরু করে আগন্তুক । মূহুর্তেই নাক মুখ থেঁ’তলে গিয়ে বীভৎস চিত্র ধারণ করে এ্যালেক্সের সমগ্র মুখমণ্ডল।বুকের উপর শক্ত ভারে শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম, ফলস্বরূপ তিরতিরিয়ে র’ক্তে ভরে উঠলো শুভ্র চোখের কোটর। এ্যালেক্সের এমন ভ’য়াবহ পরিস্থিতি লক্ষ্য করে আতঙ্কিত হয়ে পরে ফ্লোরা।উদ্বিগ্ন হয়ে তৎক্ষনাৎ এগিয়ে গিয়ে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে তুষারের বাহু । বলবান পুরুষালি শক্তির সঙ্গে পেরে ওঠার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে উদগ্রীব হয়ে বলে,

— ছাড়ুন, নইলে ম’রে যাবে এক্ষুণি।
ক্রোধের তাড়নায় থরথর করে কাপছে তুষার।ফ্লোরার কথায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না শুধু এ্যালেক্সকে মে’রেই যাচ্ছে একাধারে। হাতের কাজে অবিরত থেকে গর্জন করে বলে ওঠে সে ,
— কাকে মেইড বলিস তুই? কে তোর মেইড? পেন্ট হাউজে দাঁড়িয়ে তুষারের জিনিসে হাত দিয়েছিস, তোকে আর দিনের আলো দেখতে দেবো ভেবেছিস? বা’স্টার্ড!
ফের অজস্র ক’ষাঘাতে বিদীর্ণ হলো এ্যালেক্সের মাংসপিণ্ড ।
ছেলেটার অবচেতন হওয়ার উপক্রম। ফ্লোরা এবার কেঁদেই ফেললো কুণ্ঠায়। পেছন থেকে তুষারকে থামানোর প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে বললো,
— তুষার থামুন। প্লিজ থামুন। মা’রতে হলে ট’র্চার সেলে নিয়ে যান। তবুও দয়া করে এখানে এসব বন্ধ করুন।
ফ্লোরার কথাগুলো চুপচাপ শুনে গেলো এ্যালেক্স। ট’র্চার সেলের নাম মুখ নিতেই হুট করে বদলে গেলো ওর অভিব্যক্তি। কি ভেবে যেন অকস্মাৎ আড়ালে মুঠিবদ্ধ করে নিলো দু’হাত। এরই মাঝে ফ্লোরার টানাহেঁচড়া কান্নাকাটিতে থামতে বাধ্য হয় তুষার। মেয়েটাকে আচানক ধমকে উঠে বলে,

— কতবার বলেছি মাফিয়া পেন্টহাউজে ইনোসেন্ট সেজে থাকা বন্ধ করো। তোমাকে প্রটেক্ট করার জন্য সবসময় বসে থাকবো না আমি। কথা শুনেছো আমার?
— কি করেছি আমি?
রুশ কন্যার ক্রন্দনরত কণ্ঠস্বর। অশ্রুসিক্ত মেয়েটাকে একপল পরখ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো তুষার। দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
— এই যে একটু র’ক্ত দেখে কেঁদে ভাসাচ্ছো এটাই তোমার দূর্বলতা। এসব এখনই বাদ না দিলে ভবিষ্যতে আপসোস করবে তুমি । মাফিয়া পেন্টহাউজে কেউ তোমার ইনোসেন্সি, তোমার এই বাচ্চা বাচ্চা চেহারা দেখার জন্য বসে নেই। এখানে থাকতে হলে ডেভিল হতে হয়, নয়তো হরিণ শাবকের মতোই হা’য়নাদের দংশনে অস্তিত্ব হারাবে নিজের ।
— আপনি কি সব বলছেন।
— নাও লিভ মি এ্যালোন।
এ্যালেক্সের নিথর দেহটা লাউঞ্জে ফেলে রেখেই লম্বা পা ফেলে গটগটিয়ে উপরে উঠে যায় তুষার। তুষারের যাওয়ার পানে নিগূঢ় দৃষ্টি ফেলে আরেক দফা ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে ফ্লোরা। নাক টেনে অস্ফুটে বলে,
— আপনি ভীষণ নির্দয় তুষার।বরফ পিণ্ডের মতোই কঠিন আপনার হৃদয়।

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩৩

ওদিকে মুখের মাঝে জমে থাকা তাজা র’ক্তগুলো থু দিয়ে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে, রুগ্ন শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে যেতে ফ্লোরার পানে কুটিল দৃষ্টিপাত করে বিড়বিড়ায় এ্যালেক্স ,
— যেই জিনিস একবার ভালো লাগে, সেদিকে বারবার নজর দেয় টমেটো প্রিন্স। কেউ আটকাতে পারেনা।কথাটা ভালোমতো মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে নিও। প্রিন্সেস!
কথার শেষে মুখ জুড়ে খেলে যাওয়া বি’শ্রী এক কপট হাসি অচিরেই অন্তরাত্মায় কাঁপন ধরালো রুশকন্যার।

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩৫