আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩৫

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩৫
suraiya rafa

অপ্রীতিকর মূহুর্তের বিভীষিকাময় আবহ এখনো বিরাজমান। চারিদিক থমথমে গুমোট। টমেটো প্রিন্স আর তার দলবল পেন্টহাউজ ত্যাগ করেছে বহুক্ষণ।সেকেন্ড লিডারের অকস্মাৎ আগমনে ইতিমধ্যে সচকিত পাইথন প্যারাডাইস। টেরিটোরি সুরক্ষায় কালো পোশাক ধারী মাফিয়া সৈন্যদের নির্ভীক অবস্থান। শত্রুপক্ষের কিঞ্চিৎ আভাসে খুলে দেওয়া হয়েছে দোতলার বেজমেন্টের একাংশ। সেখান থেকে শয়ে শয়ে বেড়িয়ে এসেছে হিং’স্র সাদা নেকড়েদের পাল। নেকড়ে প্যাকের সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত এবং চৌকস আলফার পিছু নিয়েছে বাকি সদস্যগন,উদ্দেশ্য চোখের পলকে পুরো জঙ্গল ঘেরাও করা। পাইথন লিডারের অন্যতম শক্তির উৎস বোধহয় এই নেকড়ে প্যাক। একদল হিং’স্র দৈত্যাকার জানোয়ারকে এভাবে বশবর্তী করে নিজের টেরিটোরি সুরক্ষায় নিয়োজিত রাখা চারটে খানিক কথা নয়। এরীশ ইউভানের দক্ষতায় অভিভূত bratva সহ পুরো আন্ডারওয়ার্ল্ড। তবে মানুষখেকো নেকড়েদের বশ করার মতো এমন ভয়ংকর মৃত্যুঞ্জয়ী খেলার পেছনে যে মাফিয়া বসের কোনো কলুষিত দূর্ধর্ষ অতীত রয়েছে সে ধারণা নিশ্চিত।

নৈঃশব্দ্যে কেটে গিয়েছে কয়েক প্রহর। সেই যে সিঁড়ি ভেঙে নিজের ঘরে ঢুকেছে তুষার তারপর আর এ মুখো হয়নি সে। ফ্লোরা মেয়েটা এখনো ঠায় বসে আছে লাউঞ্জে। কোমল শরীরের সবটুকু ভার শীতল মেঝেতে ছেড়ে, অশ্রু বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে অনর্গল। কোনো এক অযাচিত কারণবশত হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল মেয়েটার হৃদয় জুড়ে উদ্ভাসিত অভিমানে আজ থমকে গিয়েছে পুরো পেন্টহাউজ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অভিব্যক্তিহীন শক্ত হৃদয়ের মানুষটার জন্য ভেতরে তৈরি হওয়া অনুভূতিটুকু অশ্রু জোয়ারের মিশেলে বিলীন হচ্ছে নৈস্বর্গে।মাফিয়া পেন্টহাউজ কভু ভালোবাসা,মোহ, আসক্তি কিংবা অনুভূতি দেখানোর জায়গা নয়,সে সম্পর্কে বেশ ভালোমতো অবগত রয়েছে ফ্লোরা।অগত্যা ওই থমথমে কাঠখোট্টা লোকটার প্রতি হৃদ গহীনে একটু একটু করে জন্মানো অনুভূতির পালকে প্রাধান্য দেওয়ার ইচ্ছেটাও জাগেনি কোনোকালে। কিন্তু আজ কি জানি কি হলো, ওমন একটা কলুষিত মূহুর্তের মাহেন্দ্রক্ষণে মানুষটার এহেন কড়া অপ্রতিরোধ্য বাক্যবান গুলো মোটেই সহ্য হলোনা ফ্লোরার। টমেটো প্রিন্সের কর্মকান্ডের চেয়েও তুষারের বলা প্রত্যেকটি কথা হাজার গুন বেশি আ’ঘাত হানলো হৃদয়ে। নাজুক বক্ষপিঞ্জরের সমগ্র জুড়ে বিদ্রোহ করে উঠলো অজ্ঞাত এক কৈশোরিক অভিমান। যেন অধিকারবোধের তাড়নায় মাথাচাড়া দিয়েছে অবিন্যস্ত বাক্যরা, অভাবনীয় সাহসের ঢেউ তুলে জোর গলায় বলছে ,

— আপনি আমাকে উপেক্ষা করতে পারেন না।কথায় কথায় এভাবে কষ্ট দেওয়ার অধিকার রাখেন না। আমি আপনার সাবলীলতায় অভস্ত্য হতে চাই কঠোরতায় নয়।
মনের আকুতি মনেই চাপা পরে রয় রুশকন্যার। দোতলা থেকে আগত আসবাবের ভারিক্কি আওয়াজে মূহুর্তে বেরিয়ে আসে ভাবনা থেকে। ধ্যান ভঙ্গ হয়ে গেলে কর্ণ সচকিত করে উপর তলার করিডোরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফ্লোরা। কিয়ৎক্ষন পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারে শব্দের উৎস তুষার জাওয়াদের মাস্টার বেডরুম। এহেন অতর্কিত আওয়াজে ক্রন্দন স্বর খেই হারালো মেয়েটার। কপোল বেয়ে গড়িয়ে পরা স্বচ্ছ নোনাজল থমকে গিয়ে টলটলে হয়ে উঠলো ডাগর চোখের কার্নিশ।বাম হাতের পিঠ দিয়ে সেটুকু সন্তোর্পণে মুছে দ্রুত কদমে এগিয়ে গেলো তুষারের কক্ষের অভিমূখে।
*
বিশালকার কক্ষের কালো দরজাটা হাট করে খোলা, ভেতরে ঢুকলোনা ফ্লোরা, বাইরে থেকেই উঁকি দিয়ে অবলোকন করতে লাগলো তুষার কে। উদভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক ছুটছে তুষার ।কাভার্ড, কেবিনেট, কফিটেবিল এমনকি কাউচের সঙ্গে আবদ্ধ সিক্রেট ড্রয়ার গুলো পর্যন্ত উল্টেপাল্টে নিমেষে পুরো রুমটাকে তছনছ করে ফেলেছে সে। তুষারের কর্মকান্ডে হতচকিত হলো ফ্লোরা, ব্যগ্র কদমে সামনে এগুতে এগুতে বললো,
— কি করছেন টা কি? ঘরটাকে এভাবে এলোমেলো করার উদ্দেশ্য কি? নিশ্চয়ই আমাকে অহেতুক পেরেশানি দেওয়া?
জবাব এলোনা অপর প্রান্ত থেকে। কোনোকিছু খোঁজার প্রয়াসে ব্যতিগ্রস্ত তুষার। সুডৌল কপাল জুড়ে স্পষ্ট দুশ্চিন্তার ভাজ। শ্যাম রঙা সুদর্শন মুখাবয়বে গাঢ় হয়েছে বিষণ্ণতা। ওর এহেন অদ্ভুত উদ্বিগ্নতা লক্ষ্য করে ফের প্রশ্ন ছুড়লো ফ্লোরা,

— কি লাগবে বলুন না? আমি খুজে দিচ্ছি এক্ষুণি।
— দ্যাটস নান অফ ইওর বিজনেস।
কাটকাট জবাব দিলো যন্ত্র মানব। নিমেষে চোখ মুখ শুকিয়ে এইটুকু হলো ফ্লোরার। শুষ্ক একটা ঢোক গিলে অভিমানী স্বরে বললো,
— আমি কিন্তু আর গোছাতে পারবো না।
— লাগবে না।
আবারও তিরিক্ষি আওয়াজ। এবার সত্যিই বিভ্রান্ত হলো ফ্লোরা, হঠাৎ কি এমন হলো তুষারের? গ্যাংস্টার মিশনে যত চড়াই-উতরাই কিংবা উৎপীড়ন ই থাকুক না কেন, এই মানুষটাকে কখনো এতোটা ব্যতিগ্রস্ত হতে দেখেনি ফ্লোরা। তাছাড়া হঠাৎ পেন্টহাউজে ফিরে এসে এমন করে কিইবা খুঁজে বেরাচ্ছে সে ? ভাবনার মাঝেই তুষারের পানে এগিয়ে গেলো ফ্লোরা, বিঘাত খানিক দূরে দাঁড়িয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বলে উঠলো,

— কতদিন পরে পেন্টহাউজে ফিরে এলেন। অথচ শুরু থেকে বকেই যাচ্ছেন। এখন কিছু জিজ্ঞেস করছি তাও ঠিক ভাবে উত্তর দিচ্ছেন না। আমি কি এতোটাই ফেলনা?
কোনো এক অযাচিত কারণে বুক ভার করা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো তুষার। উল্টানো কফি টেবিলের একেবারে মাঝ বরাবর অদৃশ্য এক গোপন কৌটো। হাঁটু ভেঙে মেঝেতে বসে সেটাই টেনেটুনে বের করার অদম্য চেষ্টা চালাতে চালাতে ফ্লোরার কথার প্রত্যুত্তর করলো সে,

— আমাকে কি নতুন দেখছো তুমি? নাকি আমার আচার-আচরণ নতুন তোমার কাছে? কোনটা?
তুষারের মুখোমুখি হয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসলো ফ্লোরা, বুকের মাঝে অদম্য সাহস জুগিয়ে বললো,
— কোনোটাই নতুন নয়। কিন্তু আপনার মুখ থেকে নিজের প্রতি যত্নশীল বাক্য শোনার আগ্রহটা নতুন। আপনার চোখে আমার জন্য মায়া দেখতে চাওয়ার অনুরক্তিটা নতুন।
অকস্মাৎ থমকে গেলো তুষার। টেবিল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তরাগ চোখ ঘোরালো সম্মুখে। কুণ্ঠিত নজরে এদিকেই চেয়ে আছে ফ্লোরা। তুষারের কৌতুহলী চাহনিকে মোটেই উপেক্ষা না করে, কথা বাড়ালো সে। খানিক সংকীর্ণতা নিয়ে কম্পিত স্বরে বলে উঠলো,

— আ..আপনি তখন লাউঞ্জে বলেছিলেন, বলেছিলেন যে আমি আপনার। না মানে টমেটো প্রিন্সকে ওভাবে মা”রছিলেন, তখন খুব অধিকার নিয়ে বলেছিলেন কথাটা ।
—কি অবুঝ তুমি মেয়ে । কতটা সরলই না তোমার ভাবনা গুলো, তোমার সহজ সীকারোক্তি গুলো।
ভাবনার অতলে এক মূহুর্ত ডুবলো তুষার। পরক্ষণেই অভিব্যক্তি বদলে ফিরে এলো বাস্তবতায়, ফ্লোরার সুক্ষ্ম অনুভূতিকে এক প্রলয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিতে চিরাচরিত থমথমে গলায় বলে উঠলো,
— এই পেন্টহাউজ থেকে শুরু করে পুরো পাইথন প্যারাডাইস, ক্যাসিনো ক্লাব সবকিছুই আমার দ্বায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত ফ্লোরা। এরীশের টেরিটোরি রক্ষায় জীবন উৎস্বর্গ করার ক্ষমতা রাখি আমি, আর তুমি তার বহির্ভূত নও। তোমার সুরক্ষা নিশ্চিত করাও আমার অন্যতম দ্বায়িত্ব।

স্বগোতক্তিতে কথা শেষ করে হাতের কাজে মন দিলো তুষার। টেবিলের সিক্রেট ড্রয়ারে সন্তোর্পণে তুলতে লাগলো ইলেকট্রিক পাসওয়ার্ড।অভিমানে চুপসে গেলো ফ্লোরা, ধরা গলায় শুধালো,
— ব্যাস এটুকুই! আর কিছু নয়?
জবাব দেওয়ার ফুরসত হলোনা বিপরীত পক্ষের, তার আগেই হাতে এসে আটকালো একটা আধপোড়া সাদাকালো ফটো। আঙুলের ভাঁজে আটকানো ছবিটার পানে মৌহ দৃষ্টে নিস্প্রভ চেয়ে আছে তুষার। তুষারের এহেন শূন্য ভাবাবেগ লক্ষ্য করে ফ্লোরাও উঁকি দিলো সেদিকে, দেখলো সদ্য বিবাহিতা এক বাঙালির রমনীর হাস্যোজ্জল মুখাবয়ব। ক্যানক্যান শোভিত সাদা গাউন আর হাতের ফ্লাওয়ার বাকেটের সমৃদ্ধে এখনো সেই প্রথম দিনের মতোই স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে তার বৈবাহিক সাজসজ্জা। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো রমনীর পার্শে অবস্থিত মানবের চেহারাটা পুরোপুরি পু”ড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অ’গ্নিশিখার অনলে। পুরো ছবি জুড়ে এখন শুধু এক স্নিগ্ধ বাঙালি রমনীর অস্তিত্ব। যার হাস্যোজ্জল মুখ পানে অনিমেষ চেয়ে আছে তুষার। সেদিকে একপল দৃষ্টিপাত করে কিছু একটা অনুমান করলো ফ্লোরা। মুখগহ্বরে অবশিষ্ট তরল টুকু আড়ালে গলাধঃকরণ করে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলে উঠলো,

— আপনার মা নিশ্চয়ই?
প্রত্যুত্তর করলো না তুষার। বিনাবাক্যে নৈঃশব্দ্যে কাটিয়ে দিলো বেশ কিছুক্ষণ। ফ্লোরা বুঝলো তুষার হয়তোবা কোনো মন মস্তিষ্কের দ্বন্দ্বে আঁটকে গিয়েছে, এই মূহুর্তে একা থাকাটাই শ্রেয়। সহসা তুষারকে যথাযথ একাকীত্ব দিয়ে নীরবে পিছিয়ে এলো মেয়েটা, পরনের ফিনফিনে ফ্রকটা ঠিকঠাক করে নিঃশব্দে পা বাড়ালো সম্মুখে। ঠিক তখনই পেছন থেকে ওর সরু হাতের কব্জিটা টেনে ধরলো তুষার। আকস্মিক কান্ডে ভড়কালো রমনী। পিছনে ঘাড় ফিরিয়ে শান্ত স্বরে শুধালো,

— ক..কিছু হয়েছে?
— একটু থাকবে এখানে?
শক্ত হৃদয়ের মূর্তিমান লোকটার হঠাৎ এহেন জড়ানো কণ্ঠস্বরে হৃদয় খামচে উঠলো ফ্লোরার, তৎক্ষনাৎ তরতরিয়ে পিছিয়ে এলো মেয়েটা,পুনরায় তুষারের মুখোমুখি হয়ে হাঁটু ভেঙে বসে আস্বস্ত গলায় বললো,
— আমি এখানেই আছি।
চোখ নমিত করলো তুষার। তবে হাত ছাড়লো না ওর। ছবিটার পানে একধ্যানে চেয়ে রইলো ফের।
— আপনি কি শুধুমাত্র এই ছবিটা খোঁজার জন্যই রাশিয়া ফিরেছেন?
ধীরস্থির চোখ তুললো তুষার। রুশকন্যার মোহনীয় গোলাপি মুখপানে চেয়ে অতি ভঙ্গুর স্বরে বলে উঠলো,
— ফ্লোরা!
— উমমম,
— ক্যান আই হাগ ইউ ফর আ মোমেন্ট?
হকচকালো ফ্লোরা। গ্যাংস্টার মানবের মুখে বারংবার এমন শিশুসুলভ আবদার শুনে নিমেষে মিয়িয়ে গেলো আড়ষ্টতায়। কণ্ঠনালি রোধ করে রেখেছে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মহা প্রাচীর,অগত্যা সংকীর্ণতায় তোতলাতে শুরু করে মেয়েটা,

— আসলে.. ম মানে…।
জিভের ডগায় বাক্য আঁটকে আছে, ঠিক সেই মূহুর্তে ওকে চট করে থামিয়ে দিলো তুষার। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবাবেগ শূন্য থমথমে গলায় বললো,
— আ’ম সরি, এক্সট্রেমলি সরি।
কথা ক’টা শেষ করে তাড়াহুড়ো উঠে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয় তুষার। ঠিক তখনই টান পরলো পুরুষালি হাতের মাঝে। সহসা পিছু ফিরলো তুষার, কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফ্লোরা ঝুঁকে এসে দু’হাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরলো সবেগে। ঝরঝরে সিল্কি চুলে নমনীয় হাতের পরশ বুলিয়ে বললো,

— আমি আছি তো।
মূহুর্তেই রুশকন্যার লতানো পৃষ্ঠদেশ আবদ্ধ হলো পুরুষালি দু’হাতে। বলিষ্ঠ হাতের বাঁধনে সংকীর্ণ হয়ে এলো দু’টি দেহের সামান্যতম দূরত্ব। মূর্তি মানবের প্রতিটি অসহায় দীর্ঘশ্বাস কম্পিত করে তুললো ফ্লোরাকে, কি ভেবে যেন আরও খানিকটা কাছাকাছি এসে হাতের বাঁধন শক্ত করলো ফ্লোরা, চওড়া পিঠ জুড়ে আস্বস্তির প্রলেপ বোলাতে বোলাতে ভীষণ আদুরে স্বরে শুধালো,
— আপনি এতোদিন বাংলাদেশে ছিলেন। নিশ্চয়ই সেখানে মা কে খুঁজে পেয়েছেন?
বাক্যহীন তুষার। সম্পূর্ণ নীরবতার মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হলো কিয়ৎক্ষন। মুখ ফুটে জবাব না দিলেও নিজের উন্মুক্ত ঘাড়ে অনুভূত হওয়া তপ্ত নোনাজলটুকু অনেক কিছুই জানান দিয়ে গেলো ফ্লোরাকে। ও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নতুন উদ্যমে বলে উঠলো,

— মা বোধ হয় চিনতে পারেননি আপনাকে তাইনা?
রমনীর ঘাড়ে মুখ গুঁজে রাখা অবস্থাতেই অবুঝের মতো না সূচক মাথা নাড়ালো তুষার। জিভের ডগায় অধর ভেজালো ফ্লোরা। বললো,
— আপনি চিনেছিলেন?
পুনরায় নৈঃশব্দ্য।
ফ্লোরা দমলো না, ভগ্নহৃদয়ের তুষারকে সন্তোর্পনে দু’হাতে আগলে রেখেই ছুড়লো বাক্যবান,
— আপনি চিনেছিলেন, তাহলে পরিচয় কেন দিলেন না?
অতঃপর বহুক্ষণ বাদে নড়েচড়ে ওঠে তুষার। রুশকন্যার ফিনফিনে ভূষণে বাঁধাভাঙা অশ্রুজল টুকু আলগোছে মুছে ইতি টানে জোরালো সেই স্বর্গীয় আলিঙ্গনের। আধপো’ড়া সাদাকালো ছবিটা পুনরায় চোখের সামনে তুলে ধরে জানায়,
— এতোগুলো বছর পরে নিজের জন্মদাত্রীর কাছে তুলে ধরার মতো কোনো পরিচয় নেই আমার ফ্লোরা। আমি যে নিষিদ্ধ দুনিয়ার অন্তহীন পা’পিষ্ঠ। আমার দু’হাতে নৃ’শংসতার ছড়াছড়ি, শরীর জুড়ে বিভীষিকার উদ্ভাসন, সমগ্র বাস্তবতার কাছে ঘৃণিত এক মানব আমি।
— কে বলেছে সমগ্র বাস্তবতার কাছে ঘৃণিত আপনি? আমাকে কি মরীচিকা মনে হয়?
মেয়েটার পানে নির্লিপ্তে চাইলো তুষার। ভীষণ কাতর স্বরে বললো,
— তাহলে সমগ্র দুনিয়ার কাছে আমার মা কেন আমায় অস্তিত্বহীন বানিয়ে রাখলো বলতে পারো?
কিঞ্চিৎ আশ্চর্য হলো ফ্লোরা,কণ্ঠ খাদে নামিয়ে শুধালো,

— মানে?
হাতের মুঠোয় আবদ্ধ থাকা ছবিটার দিকে অনিমেষ চেয়ে অতীতে ডুবলো তুষার। মানস্পটে ভেসে উঠলো সেদিন নিঝুমকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার মূহুর্তটা।

রিকশা না ধরিয়ে দিলেও নিজের গাড়িতে করে নিঝুমকে খালা বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়েছিল তুষার। মন মস্তিষ্ক জুড়ে চলছিল অসহনীয় উৎপীড়ন। তন্দ্রা জাওয়াদ নামটা শোনার পর থেকেই অজ্ঞাত সব কৌতুহল ক্রমশ প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছিল মাস্টার মাইন্ড খ্যাত তুষারকে। নিজের মাকে খুব ছোট বেলায় দেখেছিল তুষার,মানস্পটে চেহারা স্পষ্ট নয় কভু। তবুও স্বপ্নে বিচরণ করা একচ্ছত্র এক শ্যামলতা মানবীর মুখাবয়ব আজ বহুবছর ধরে তাড়া করে বেড়াচ্ছে ওকে। তুষার জানে এটাই ওর মা তন্দ্রা জাওয়াদ। তবে নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জুড়ে যাওয়া মাফিয়া সম্রাজ্যের কলুষিত অধ্যায়ের শেকড়ে পৌঁছে আর কখনো খুঁজে দেখার ইচ্ছে হয়নি ওই অস্পষ্ট চেহারার অন্তরালের শ্যামলতা মানবীকে। কিন্তু আজ কিছুতেই মানছে না পাথর কঠিন মন। বারবার তাকে দেখার প্রয়াসে মাথাচাড়া দিয়ে জাগ্রত হচ্ছে অবাধ্য ইচ্ছেরা। ফলস্বরূপ নিঝুমের খালা বাড়ি অবধি চলে আসা।
বাড়ির গেটে পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমে পরে নিঝুম, সঙ্গে তুষারও। চোখের সামনে মার্বেল পাথর শোভিত বিশাল বড় অট্টালিকা। সফেদ আলোর রোশনাই এ রাজপ্রাসাদের ন্যায় ঝলমল করছে চারিপাশ। চারিদিকের সৌন্দর্য্য বর্ধক গাছগাছালি আর সাজসজ্জা যেন গৃহকর্তীর রুচিশীলতার বাহক। গেটের বাইরে থেকেই পুরো বাড়িটা একনজরে পরখ করে নিলো তুষার। তন্মধ্যে ওপাশ থেকে এগিয়ে এলো নিঝুম, সম্মোহনী হেসে বলে উঠলো,

— সুন্দর তাই না?
— ইয়াপ! তোমার খালামনি বেশ রুচিশীল।
চট জলদি হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো নিঝুম। বললো,
— ঠিকই ধরেছেন। সারাদিন একা একা থাকে আর বাড়ির পরিচর্যা করে।
— একা একা কেন? তোমার আঙ্কেল, কিংবা খালাতো ভাই বোন নেই?
নিমেষেই আঁধার ঘনালো দু’চোখে। পাংশুটে মুখটা আড়াল করার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে নিঝুম জানালো,
— আঙ্কেল মা’রা গিয়েছেন বহু আগে। একজন খালাতো ভাই রয়েছে, তূর্য ভাই। সেও নিজের কাজে বেশ কিছু বছর ধরে বিদেশে, শুনেছি কিছুদিন হলো দেশে ফিরেছেন, তবে অফিসের কাজ মিটিয়ে এখনো বাড়িতে আসার সুযোগ হয়নি তার। ওই জন্যই তো সবসময় একা থাকতে হয় খালামনিকে।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো তুষার। আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— আর কোনো ছেলে মেয়ে নেই তার?
তৎক্ষনাৎ না জানালো নিঝুম। তুষার ফের বলে উঠলো,
— আচ্ছা তোমার খালামনি কখনো রাশিয়া গিয়েছে?
অজ্ঞাত তুষারের এতো এতো প্রশ্ন শুনে ভ্রু কুঁচকালো নিঝুম। সন্দেহের উৎপত্তি ঘটলো মস্তিষ্কে, নিগূঢ় দর্শনে যুবককে পরখ করতে করতে কপাল বেঁকিয়ে বলে উঠলো,
—তখন থেকে একের পর এক অহেতুক প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন।বলি আপনি জেনে কি করবেন এতো কিছু ?
জোরপূর্বক কেশে উঠলো তুষার। বিষম খাওয়ার ভান ধরে বললো,
— না মানে এমনি কিউরিওসিটি। তোমার খালামনির এতো বড় বাড়ি অথচ তোমার ভাষ্যমতে তোমরা মধ্যবিত্ত।
আনমনে ব্যাগের চেইন ধরে টানাটানি করতে করতে ঠোঁট উল্টালো নিঝুম। আপসোসের স্বরে বললো,
— তাতো হবেই। খালামনি কোটি কোটি টাকার মালিক। তার রাশিয়ান বাবার সব সম্পত্তিই তো খালামনির। আর আমার মা তো খালামনির সৎ বোন হয়। দু’জনার মা একজন হলেও বাবা আলাদা। খালা মনি তো তার বাবার কাছেই ছোট থেকে বড় হয়েছেন । তারপর কেন যেন অনেক বছর পরে হুট করেই দেশে ফিরে এলেন। দেশে ফেরার পরেই মূলত আঙ্কেলের সাথে বিয়ে হয় তার।

— সেকেন্ড ম্যারেজ তাইতো?
— আপনি কি করে জানলেন?
হতচকিত হয়ে প্রশ্ন ছুড়লো নিঝুম। ওর কথার পাছে তুষার কিছু বলবে আর আগেই একটা অফ হোয়াইট টয়েটো এসে থামলো বাড়ির গেটে, ফলস্বরূপ এখানেই ইতি ঘটলো দু’জনার রহস্যে ঘেরা বাক্যালাপের। তৃতীয় ব্যক্তির আগমনে নিঝুম তুষার একযোগে ঘাড় ঘোরালো পেছনে। নজরে এলো শাড়ি পরিহিত একজন মাঝ বয়সী আধুনিকা রমনী, পা থেকে মাথা অবধি বেশভূষা অত্যন্ত পরিপাটি তার। গেটের কাছ থেকেই গাড়িটাকে বিদায় জানিয়ে স্বগোতক্তিতে সামনে এগুলো সে। মাঝপথে নিঝুম কে দেখতে পেয়ে গতি স্থির হলো পায়ের। মেয়েটাকে আগাগোড়া পরখ করে স্নেহের স্বরে শাসিয়ে উঠলেন তিনি।

— সন্ধ্যা হয়েছে সেই কখন। এখনো বাইরে কি করছো?
— এই তো খালামনি বাড়িতেই ঢুকছিলাম।
— ঘোরাঘুরি যাই করোনা কেন সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত। এরপর আর বাইরে থাকার দরকার নেই, টুরিস্ট এরিয়া হলেও এলাকাটা ভালো নয়। আশেপাশের কাউকে বিশ্বাস নেই। কখন কার মধ্যে থেকে সুইট ডেমোন বেরিয়ে আসে তা বলা মুশকিল।
— সুইট ডেমোন!
ভ্রু বাঁকিয়ে পরপর একই শব্দের পুনরাবৃত্তি করে নিঝুম। ওর কথার জের ধরে তন্দ্রা জাওয়াদ কিছু বলবেন তার আগেই দৃশ্যগত হয় বলিষ্ঠ শরীরের একটা লম্বা মতো যুবক। স্ট্রিট লাইটের তীর্যক আলোয় ঝকঝকে পরিষ্কার ছেলেটার ধারালো কঠিন মুখাবয়ব। কি ভেবে যেন যুবকের মুখের পানে নির্লিপ্তে চেয়ে রইলেন তন্দ্রা জাওয়াদ। খানিকক্ষণ অতিবাহিত হলো নৈঃশব্দ্যে। অতঃপর অস্ফুটে বলে উঠলেন,

— কে তুমি?
তন্দ্রা জাওয়াদের প্রশ্নে স্থবির হয়ে পরলো তুষার। মাথার উপর সদ্য বাজ পরার মতোই চমকে উঠলো অকস্মাৎ । ওর নির্বাক অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছে এর চেয়ে কঠিন প্রশ্ন বোধ হয় পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আর নেই। সত্যিই তো নেই। পরিচয় থাকুক আর না ই বা থাকুক, হিমালয়সম দূরত্বের প্রাচীরের অন্তরালে যার সহিত প্রাকৃতিক নিয়মে ঈশ্বর প্রদত্ত নারীর টান বিদ্যমান সেই জন্মদাত্রী মানবীকে কি প্রত্যুত্তর করবে তুষার? কি বলবে আমি আপনার ছেলে? এমন করে কি আদৌও বলা যায়? বোধ হয় যায়না। কারণ ইতিমধ্যে তুষার অনুমান করতে পেরেছে পুরো পৃথিবীর সম্মুখে তন্দ্রা জাওয়াদের ছেলে হিসেবে একজনেরই পরিচিতি রয়েছে। আর সে হলো, তূর্য জাওয়াদ!
নির্বাক শিশুর ন্যায় সেই তখন থেকে তন্দ্রা জাওয়াদের পানে ফ্যালফ্যালিয়ে চেয়ে আছে তুষার। তা লক্ষ্য করতেই আগ বাড়িয়ে কথা পারে নিঝুম। খালামনিকে ধাতস্থ করে বলে ওঠে,

— উনি আসলে আমার ভার্সিটির সিনিয়র খালামনি। হঠাৎ বীচের ওখানে দেখা হয়, কথা বলতে বলতে বাড়ি অবধি এগিয়ে দিলো আর কি।
নিঝুমের কথায় আস্বস্ত হয়ে তপ্ত শ্বাস ছাড়লেন তন্দ্রা জাওয়াদ। গেট খুলে বাড়ির অভিমুখে এগিয়ে যেতে যেতে তুষারের পানে একপল নিগূঢ় দৃষ্টিপাত করে ভাগ্নির উদ্দেশ্য বললেন,
— অতিথি কে ভেতরে নিয়ে এসো।
মিষ্টি হেসে হ্যা সূচক মাথা নাড়ায় নিঝুম। তৎক্ষনাৎ কঠোর আওয়াজে বাঁধ সাধলো তুষার। উদগ্রীব হয়ে পিছনে ঘুরে লম্বা পা ফেলে গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
— আমি আসছি।

ভাবনার ইতি ঘটলো তুষারের। নতুন উদ্যমে চোখের কার্নিশ সিক্ত হলো নোনাজলে। সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয়বারের মতো উষ্ণ আলিঙ্গনে র’ক্তা’ক্ত হৃদয়ের ভঙ্গুর মানুষটাকে আবদ্ধ করে নিলো ফ্লোরা। এবার আর সংকুচিত হয়ে নয়, অনেকটা সাহস আর অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়ে বাহ্যিক দূরত্ব ঘোচালো অকপটে। কোমল দু’হাতের আবেশিত পরশে শখের পুরুষের এক সমুদ্র দুঃখ দূরীভূত করার ক্ষুদ্র প্রয়াস চালিয়ে স্বগতোক্তিতে বললো,
— আপনি আমায় ভালো নাই বাসলেন। নিজের মাফিয়া ইগোর কাছে দূর্বল নাই হলেন। তাতে আমার কোনো আপসোস নেই তুষার। কারণ দিন শেষে আপনার দূর্বলতা প্রকাশের একমাত্র পিছুটান আমি। আর আপনি চাইলেও সেটা উপেক্ষা করতে পারবেন না।এবার থেকে পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকবেন, হৃদয়ের ওই দূর্বলতারা আপনাকে আমার কথা মনে করিয়ে দিবে অহর্নিশ।

সংলাপ বিহীন নিগূঢ় আলিঙ্গনের হাত ধরে সুপ্ত অনুভূতিরা যখন তুঙ্গে বিরাজমান, তখন হৃদগহীনে ভেসে ওঠে অবাধ সুখের এক নিদারুণ পঙক্তিমালা,
“বাড়িয়ে দাও তোমার হাত,
আমি আবার তোমার আঙুল ধরতে চাই।
বাড়িয়ে দাও তোমার হাত,
আমি আবার তোমার পাশেই হাঁটতে চাই।
বাড়িয়ে দাও তোমার হাত,
তোমার হাত…….

দর্শনার্থীদের ভীরে জমজমাট ইনানী। রয়েল টিউলিপ আজ লোকে লোকারণ্য। মার্কেটে বেশ ভালোই ভীর। বুটিক হাউজে সেই সকাল থেকে ব্যস্ত সময় পার করছে ঈশানী। আরও দু’জন মেয়ে আছে, তবে দ্বায়িত্বের বহুলাংশই ঈশানীর উপর বর্তানো, সহসা ক্রেতা সমাদরে দুদণ্ড দাঁড়িয়ে থাকার ফুরসত নেই তার। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এসেছে, এই সময়ে কাস্টমারের ভীড় কিছুটা কমে আসে, পরবর্তীতে সন্ধ্যা গড়ালেই শুরু হয় নতুন উদ্যমের ব্যস্ততা।
যেহেতু ক্রেতা সমাগম কমে এসেছে কিছুটা, এই ফাঁকে এলোমেলো জিনিস গুলো গোছাতে শুরু করে ঈশানী। গোছগাছ হয়ে গেলে তবেই মিলবে ফুরসত। কিন্তু সেই ফুরসত বোধ হয় ঠিক জুতসই লাঘব করা হলোনা ঈশানীর। তার আগেই ওপাশের মার্কেটে কর্মরত একটা মেয়ে এগিয়ে এলো হন্তদন্ত হয়ে। মেয়েটার আকস্মিক আগমনে ভ্রু কুঞ্চিত করলো ঈশানী। দরজার কাছে এগিয়ে এসে শুধালো,

— কি হয়েছে হঠাৎ এমন ছুটে এলে যে?
মেয়েটা হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
— তোমার কাছেই এসেছি, মার্কেটের গেটে একটা ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। তোমাকে ডেকে পাঠাতে বললো। আমি আবার দোকান ভর্তি কাস্টমার রেখে এসেছি, তাই ছুটতে ছুটতে এলাম।
— ভাইয়া! কোন ভাইয়া?
বাঁকানো কপাল আরও খানিকটা বেঁকে গেলো রমনীর। ঈশানীর প্রশ্নে অপর প্রান্তের মেয়েটা ঠোঁট উল্টালো সবেগে। আবারও ফিরে যেতে যেতে বললো,
— কি জানি, দেখে তো মনে হলো তোমার ভার্সিটির সিনিয়র হবে হয় তো।
— কিন্তু আমিতো আজ পর্যন্ত ভার্সিটিতে কখনো….

বাক্য শেষ করার ফুরসত পেলোনা ঈশানী, তার আগেই ব্যস্ততার ভানে দৃশ্যপটের আড়াল হয়ে গেলো মেয়েটা।
ঈশানী আর কিইবা করবে উপায়ন্তর না পেয়ে মেয়ে দু’টোকে দোকানে বসিয়ে সদ্য উদয় হওয়া সিনিয়র ভাইয়ের খোঁজে এগিয়ে গেলো মার্কেটের গেটের দিকে।
* গেটের বাইরে পা রাখতে না রাখতেই হতভম্ব হয়ে গেলো ভীত মেয়েটা। চোখ দু’টোকে আচমকা তুলে ফেললো কপালে, বিস্মিত স্বরে একা একাই বলে উঠলো,
— এ তো মাফিয়া বস। কিন্তু উনি এখানে, তাও বাইক নিয়ে?
বাইকের পানে দৃষ্টিপাত করা মাত্রই ঈশানীর মনে পরে যায় সপ্তাহ খানিক আগের কথা,
— বাইক চলবে?

কিন্তু তখন তো ঈশানী এমনিই হেয়ালি করেছিল ওসব। তাছাড়া সেদিনের পর থেকেই এরীশ পুরোপুরি লাপাত্তা। কক্সবাজারের কোথাও আর কখনো দেখা যায়নি তাকে। অথচ এতোগুলা দিন বাদে হঠাৎ করে কোথা থেকে উদয় হয়ে সোজা বাইক নিয়ে মার্কেটে হাজির। মাফিয়া বস টা ভীষণ অদ্ভুত, কখন দর্শন দিবে আর কখনই বা উধাও হয়ে যাবে সে কথা বাহুল্য।

চোরা চোখে আশপাশটা ভালোমতো পরখ করে ধীর গতিতে সামনে পা বাড়ালো ঈশানী, যেতে যেতেই আড় চোখে একপলক দৃষ্টিপাত করলো সুদর্শন লোকটার পানে। অফ হোয়াইট সোয়েট শার্টের ওপর ব্ল্যাক লেদার জ্যাকেট, ব্ল্যাক ব্যাগি ডেনিম আর হোয়াইট কনভার্সে তাকে সত্যিই ভার্সিটির সিনিয়র ভাই লাগছে আজ।
চোখ জুড়ে আবৃত বিশালাকার রোদ চশমাটা না খুলেই আন্ডার কাট ঝরঝরে চুল গুলোতে আঙুল বোলাচ্ছিল এরীশ, তখনই সম্মুখে এসে উপস্থিত হয় ঈশানী। এরীশ ঘাড় ফিরিয়ে তাকানোর আগেই তাড়াহুড়ো করে শুধায়,
— ডেকে পাঠিয়েছেন কেন? মার্কেটে আজ অনেক ভীর, বুটিক হাউজ খালি পরে আছে।
— তাহলে আজকের জন্য পুরো মার্কেট সিলগালা করে দিই?
বাইকের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে,ফ্রন্ট মিররে নিজের চুল ঠিক করতে করতে ভাবলেশহীন গলায় জবাব দিলো মাফিয়া বস।
— কিহ!কেন!
এরীশের কথায় আঁতকে উঠলো রমনী। এই লোক হেয়ালি করেনা মোটেই, যেটা বলে সেটাই করে ছাড়ে। ফলস্বরূপ ঈশানীর মুখশ্রী জুড়ে প্রস্ফুটিত হলো নিদারুণ উদ্বেগের ছাপ।
এতোক্ষণে ঘাড় ঘোরালো এরীশ। সাবলীল ভঙ্গিতে বললো,

— কারণ তুমি এই মূহুর্তে আর দোকানে ফিরছো না।
— ফিরছি না মানে? কোথায় যাবো?
— লং ড্রাইভে।
তৎক্ষনাৎ এরীশের কথায় আপত্তি জানালো ঈশানী, এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে ভয়ার্ত স্বরে বললো,
— আজ কিছুতেই ফাঁকি দেওয়া যাবে না। এতো কাস্টমার রেখে ফাঁকি দিয়েছি জানতে পেরে মালিক স্যালারী কেটে নিলে তখন?
— যে তোমার স্যালারী কাটার দুঃসাহস দেখাবে, তার গ’র্দান কেটে নেবো আমি। নাও গেট আপ।
মাফিয়া বসের কঠোর অভিব্যক্তি। কণ্ঠে স্পষ্ট দৃঢ়তা। ওর কথায় শুষ্ক ঢোক গিললো ঈশানী,অবিশ্বাস্য স্বরে বলে উঠলো,
— আপনি মজা করছেন তাই না? কিন্তু আমি আজ কিছুতেই যেতে পারবো না।
কথা শেষ করে তড়িঘড়ি করে পিছু হাটে ঈশানী।তবে গেট অবধি আর পৌঁছাতে পারে না, তার আগেই ওকে টান মে’রে কাঁধে তুলে ফের বাইকের কাছে নিয়ে এলো এরীশ। সিটের উপর বসিয়ে কোমল হাতদুটো মুঠোবন্দি করে গ্রীবাদেশ বাঁকিয়ে এগিয়ে এলো সাকুরার পানে, গমরঙা সুশ্রী মুখের উপর তপ্তশ্বাস ছেড়ে দাঁতে দাঁত পিষে হাস্কি গলায় বললো,

— এতো অবাধ্য কেন তুমি? আমাকে শান্ত দেখতে ভালো লাগছে না তাই না? কি চাও এভাবে কাঁধে তুলে লং ড্রাইভে নিয়ে যাই?
হৃদযন্ত্র খামচে উঠলো ঈশানীর। মাফিয়া বসের বজ্র কঠিন রূপে অভস্ত্য থাকা সত্ত্বেও কুণ্ঠায় চুপসে গেলো রমনী,তরিৎ বেগে চোখ নমিত করে জড়ানো গলায় বলতে লাগলো ,
— আপ.. আপনি, না মানে আমি।
— এতো এক্সপ্লেইনশন শুনতে চাইনি। চুপচাপ এখানেই বসে থাকো।
নাজুক মেয়েটার মাথায় হেলমেট চড়িয়ে তার উইন্ডো নামিয়ে দিতে দিতে কঠোর আদেশ করলো এরীশ। ঈশানী আর সাহস দেখালো না, বাঁধ্য মেয়ের মতো বসে রইলো চুপচাপ। ঈশুকে বসিয়ে ঘুরে গিয়ে বাইক স্টার্ট দিলো এরীশ,গিয়ার টানার আগে স্পষ্ট আওয়াজে বললো,

— ধরে বসো।
— কেন?
অবুঝের মতো প্রশ্নটা বেখেয়ালেই করে বসেছে ঈশানী। মস্তিষ্ক জুড়ে দুশ্চিন্তার অবিরাম লড়াই, এখন এভাবে এরীশের সঙ্গে যাওয়াটা ঠিক কতটা যুক্তিযুক্ত জুতসই বুঝে উঠতে পারছে না মেয়েটা। মন বলছে কোনো বাঁধা নেই,মস্তিষ্ক বলছে নিষিদ্ধ দুনিয়ার কলুষিত মানুষটার চেয়ে বড় বাঁধা আর কিই বা হতে পারে ? ভাবনার গহীনে পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলোনা ঈশানী। তার আগেই স্পিডোমিটারে একশোর উপর গতি বাড়িয়ে আচানক বাইক টান দিলো এরীশ। আকস্মিক স্থান পরিবর্তনে এরীশের পিঠের হুমড়ি খেয়ে পরলো বেখেয়ালি মেয়েটা। তড়িঘড়ি করে ওর জ্যাকেট খামচে ধরে উদ্বিগ্ন স্বরে বলে উঠলো,
— আস্তে পরে যাবো তো।
— আমি আছি কি করতে?
তীব্র বাতাসের গতিবেগে কথাগুলো স্পষ্ট নয় এরীশের। তবুও সংকীর্ণ হস্তে ওর জ্যাকেট খামচে ধরে কি ভেবে যেন আনমনে মৃদু হাসলো ঈশানী।

লোকালয় থেকে বহুক্রোশ দূরে একটা প্রাইভেট সিবীচের কাছাকাছি এসে দীর্ঘ যাত্রার ইতি টানলো ওরা। বাইক থেকে নেমে ঈশানীকে নিয়েই ভেতরে প্রবেশ করলো এরীশ। কয়েক কদম সামনে এগিয়ে যেতেই থমকালো ঈশানী। শুনশান নিরিবিলি চারিদিক। ডানে-বামে সামনে পেছনে যতদূর অবধি চোখ যায় মানুষ তো দূরে থাক কোথাও একটা শঙ্খচিলের উপস্থিতি পর্যন্ত নেই। অথচ চারিপাশের পরিপাটি আর গোছানো পরিবেশ দেখলে মনে হয় বহুবছরের পরিচর্যার ফল এসব। বুক ভরে স্নিগ্ধ বাতাস গ্রহন করে সাগরের দিকে এগিয়ে গেলো ঈশানী। গোধূলির আভায় স্বর্ণাভ ঝিল দিচ্ছে স্বচ্ছ জলরাশির বহর। আঁচড়ে পরা ঢেউয়ের তালে বারংবার সিক্ত হচ্ছে পদযুগল। কি ভেবে ঢেউয়ের মাঝে হাত বাড়িয়ে দিলো ঈশানী। শীতল স্রোতের বিপরীতে আঙুলের খেলায় মত্ত থেকে প্রশ্ন ছুড়লো এরীশের পানে,

— আপনি বেছে বেছে সবসময় নির্জন জায়গা গুলোতে কেন আসেন বলুন তো?
— মানুষের উপস্থিতি অস্বস্তিদায়ক।
নিঃশব্দে এগিয়ে এসে ঈশানীর পাশ ঘেঁষে বিস্তৃত বেলাভূমিতে বসতে বসতে জবাব দিলো এরীশ।
জলরাশির গহীন থেকে হাত বের করলো ঈশানী, পাশ ঘুরে নির্বিকারে পরখ করলো মাফিয়া বস টাকে। খানিক নীরবতা ভেঙে বলে উঠলো,
— আর আমার উপস্থিতি?
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো এরীশ।চোখের উপর থেকে রোদ চশমা সরিয়ে আচানক দৃষ্টি আবদ্ধ করলো নীলাম্বরির নেত্রগহ্বরে। নদীর মতো শান্ত গলায় জানালো,
— তোমাকে আমি চেয়েও পাইনা।
— আমি আপনার পাশেই বসে আছি।

ফের দীর্ঘশ্বাস। অন্তহীন জলরাশির পানে দৃষ্টিপাত করলো এরীশ। নিরেট স্বরে বললো,
—এক্সুয়ালি উই আর লাইক ডিসেম্বর এন্ড জানুয়ারি। উই আর সো ক্লোজ, ইয়েট সো ফার।
চিত্ত জুড়ে অসহনীয় সুপ্ত ব্যথার উদ্ভাসন। মাফিয়া বসের সামান্য এই আপসোস টুকু কেন হঠাৎ পীড়ার বর্ষন নামালো হৃদয় জুড়ে জানা নেই রমনীর। অথচ ও পু’ড়ছে। দুই মনের দ্বন্দ্বে নীরবে পু’ড়ছে ঈশানী। ঈশানীর ভাবনার ছেদ ঘটালো এরীশের অকস্মাৎ বাক্যবান,

— আমাকে কি আরেকটা সুযোগ দেওয়া যায়না? আমি জানি এটা তোমার জন্য কতটা কষ্টদায়ক, মেইবি অসম্ভব। তবুও আমি চাইছি। কারণ আমার হৃদয় আমাকে এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে।
“একটা সুযোগ” সেদিন মাহিন ও ঠিক একই ভাবে একটা সুযোগের অনুরোধ জানিয়েছিল ঈশানীর নিকট।আর আজ এরীশ ও। তফাৎ শুধু একটাই, মাহিনের জীবনটা জলসা ঘরের মতোই ঝলমলে আলোকিত, চোখের সামনে সাজানো ভবিষ্যত তার। সর্বজন গ্রহীত ভদ্র,সভ্য সামজ স্বীকৃত একজন ভালো মানুষ সে। বাস্তবতায় তার বসবাস। আর অন্যদিকে নিষ্ঠুরতম মানব এরীশ ইউভান। তার চোখের মাঝে অন্তহীন শূন্যতা, আবেগ, অনুভূতি,মায়া,মমতা এমনকি কোনো মনুষ্যত্বই ছুঁতে পারেনা তাকে, অন্ধকারের নিশাচর সে। নিষিদ্ধ দুনিয়ার কলুষিত আত্না, বাস্তবতা যার কাছে মরীচিকার সমতূল্য।

তবুও অদ্ভুত ভাবে মাহিন নয় বরং নিষিদ্ধ দুনিয়ার কালো অধ্যায় চৌম্বকের মতো টানছে ওকে। চোখের সামনে বসা মাফিয়া বসের প্রতি অগাধ দূর্বলতায় ভেসে যাচ্ছে হৃদযন্ত্র। অথচ লোকটাকে সারাজীবনে ক্ষমা না করার পণ করেছিল ঈশানী। আর আজ দ্বিতীয়বার সুযোগের দোটানায় তার দিকেই ক্রমশ ঝুঁকছে হৃদয়। মাহিনের উজ্জ্বল ভবিষ্যত কিংবা সর্বগ্রহীত সত্তা কোনো কিছুই ধরাশায়ী করতে পারেনা ঈশানীকে। মস্তিষ্কের হাজারো বিঘ্নতা ছাপিয়ে অবাধ্য মন বলে “অরণ্য”।

ঈশানীর নিগূঢ় ভাবনার ছেদ ঘটালো এরীশ। গ্রীবাদেশ বাঁকিয়ে খানিকটা কাছাকাছি এসে বললো,
— আমি হয়তো সবার মতো তোমাকে কখনো সংসার দিতে পারবো না। স্বাভাবিক দম্পতিদের মতো একটা পরিবার দিতে পারবো না, সাবলীলভাবে জীবনযাপন করতে পারবো না। তোমাকে কখনো স্বাধীনতা দিতে পারবো না। বাট বিলিভ মি, আমি তোমাকে কখনো ছেড়ে যাবোনা। মৃ’ত্যুর আগ অবধি না। থাকবে আমার সাথে?
এরীশের মুখ থেকে হঠাৎ এহেন প্রস্তাবে অপ্রস্তুত হয়ে পরলো ঈশানী। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে এখনো চেয়ে আছে এরীশ।ওর দৃষ্টির অনলে ক্রমশ ভস্ম হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা, ফলাফল তৎক্ষনাৎ চোখ সরিয়ে পেছনে চাইলো ঈশানী। আঙুল উঁচিয়ে খানিক দূরে অবস্থিত ক্যাফেটা দেখিয়ে পরপরই বলে উঠলো,

— ক্যাফে মনে হচ্ছে। লোক নেই কেন?
ঈশানীর ইশারা অনুসরণ করে পেছনে দৃষ্টিপাত করে এরীশ। অতঃপর জানায়,
— বছরে একবার দু’বার মাফিয়া রিইউনিয়ন হয় এখানে। তখনই কেবল ক্যাটারিং আনানো হয়। এছাড়া খালিই পরে থাকে সবসময়।
— কফি খাবেন? আপনার পছন্দের ব্ল্যাক স্প্রেসো।
— তুমি বানাবে?
উচ্ছ্বাসিত বদনে হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে জলদি উঠে পরলো ঈশানী, অতঃপর এরীশের দৃষ্টিকে একপ্রকার উপেক্ষা করে পায়েপায়ে এগিয়ে গেলো নান্দনিক ক্যাফেটার দিকে।
সবকিছু সুসজ্জিত ভেতরে। কোনো কিছু খুঁজে না পাওয়ার অবকাশ নেই, অগত্যা ভেতরে ঢুকেই কাউন্টারের কাছে গিয়ে কফি মেকারে হাত চালালো ঈশানী। ওর পেছন পেছন ক্যাফেতে প্রবেশ করে এগিয়ে এসে কাউন্টারের অপরপ্রান্তে দাঁড়ালো এরীশ। মনোযোগী সাকুরার পানে নিগূঢ় দৃষ্টি স্থাপন করে নৈঃশব্দ্যে অতিবাহিত করলো কিয়ৎক্ষন।
পরপরই গভীর গলায় বলে উঠলো,

—মনে হচ্ছে কফি মেকিং এ খুব আগ্রহ তোমার।
এতোক্ষণ বাদে অবশেষে ফিক করে এক চিলতে হাসলো ঈশু। মাফিয়া বসের দিকে কফির কাপটা এগিয়ে দিতে দিতে বললো,
— জানেন একসময় স্বপ্ন দেখতাম আমার এমন একটা ক্যাফে হবে। আর তারপর….
কি ভেবে যেন মাঝপথে থেমে গেলো ঈশানী। কফির কাপে নির্লিপ্ত চুমুক দিয়ে ভ্রু বাঁকালো এরীশ, উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলো,
— তারপর?
তৎক্ষনাৎ প্রসঙ্গ পাল্টালো ঈশানী, কফির কাপে ইশারা করে শুধালো,
— কফি কেমন হয়েছে? তেঁতো নিশ্চয়ই?
কফির কাপটা কাউন্টারে রেখে আচানক ঘুরে ঈশানীর প্রান্তে চলে এলো এরীশ।বিনাবাক্যে দু’হাত বাড়িয়ে নাজুক মেয়েটাকে একটানে তুলে বসিয়ে দিলো কাউন্টারে। ঘটনার আকস্মিকতায় ধড়ফড়ালো ঈশানী, বিস্মিত হয়ে বলে উঠলো,

— কি করছেন?
ওর দু’পাশে হাতের ভর ছেড়ে নির্বিকারে সম্মুখে ঝুকলো এরীশ। মাফিয়া বসের তপ্ত নিঃশ্বাসের পরশে মূহুর্তে নড়েচড়ে উঠলো মেয়েটা। কণ্ঠনালিতে দলা পাকিয়েছে আড়ষ্টতা,উচাটন শ্বাসপ্রশ্বাস ব্যাতিত কোনো আওয়াজ নেই মুখে। হৃদযন্ত্রের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে ইতিমধ্য জমে গিয়েছে সর্বাঙ্গ। বিপরীত দিক থেকে আগত তপ্ত নিঃশ্বাসের আবহে ক্রমশ ঝলসে যাচ্ছে মুখশ্রী। তাও মাফিয়া বসের ধূসর বাদামি চোখে নির্লিপ্তে দৃষ্টিপাত করলো সরলতা। বুঝতে চাইলো আবেগহীন চিত্তের সুপ্ত অনুরক্তি। ঠিক তখনই নীরবতা ভাঙলো এরীশ।চোখের মাঝে এক আকাশসম ব্যকুলতা ধরে রেখে হাস্কিস্বরে বলে উঠলো,

— একবার চুমু খেতে দিবে? আই জাস্ট ওয়ান্না ফিল ইউ ফ্রম কোর অফ মাই হার্ট।
— হৃদয় আছে আপনার? অনুভব করবেন কিভাবে?
ঈশানীর কথার মাঝেই দু’জনার মধ্যবর্তী সংকীর্ণতা বাড়ালো এরীশ, ধীর গতিতে রমনীর পানে এগুতে এগুতে জানালো,
— প্রাণ সঞ্জীবনী তুমি আমার। তোমার সংস্পর্শে সেটাও আছে।
কথার গভীরতা আঁচ করার প্রয়াসে এক মূহুর্ত থমকালো ঈশানী, তৎক্ষনাৎ ওর হতচকিত ফাঁকা ওষ্ঠাধরের মাঝে অনুভূত হলো একজোড়া পুরুষালি অধরের তপ্ত নিগূঢ় স্পর্শ। এক সেকেন্ডের মাথায় ব্ল্যাক স্প্রেসোর তিতকুটে স্বাদে ভরে উঠলো মুখগহ্বর। বেমালুম অস্থিরতায় দু’চোখ খিঁচে বন্ধ হয়ে গেলো আপনাআপনি । তৎক্ষনাৎ ঠোঁটের গভীরতায় দৃঢ়তা টানলো মাফিয়া বস, নিগূঢ় আঁকিবুঁকি ক্রমশ পরিনত হলো তীক্ষ্ণ দং’শনে। নিমেষেই ক্ষ’তবি’ক্ষত হলো রমনীর মাখন নরম ওষ্ঠ।

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩৪

ঈশানী নিরুদ্বেগ, যেন বাস্তবে থেকেও নেই। মিষ্টি যন্ত্রনাটুকু লাঘবের প্রয়াসে দু’হাত দিয়ে অচিরেই খামচে ধরে রেখেছে অযাচিত স্বামী নামক নিষ্ঠুর ব্যক্তির কলারের একাংশ। একপর্যায়ে ব্যতিগ্রস্থতায় নাজেহাল হয়ে ছাড়াতে উদ্যত হয় নিজেকে, তবে এরীশ ছাড়লো না, কেবল এক মূহুর্তের জন্য ফুরসত দিয়ে বলে উঠলো,
— ইউ নো সুগার ইজ নট মাই টাইপ। বাট ইট’স টেস্ট লাইক সফ্ট মার্সমেলো।
ব্যাস এতোটুকুই, পরপরই দিশেহারা হয়ে হিং’স্র দানবীয় উদ্যমে আঁকড়ে ধরলো সাকুরার র’ক্তিম মোলায়েম ওষ্ঠাধর।

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩৬