আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩৬
suraiya rafa
বিস্তৃত নীল অন্তরিক্ষ জুড়ে ধূসর মেঘের আচ্ছাদন। কেশগুচ্ছের ন্যায় তরঙ্গিত মেঘমালায় গুমোট হয়েছে ঈশান কোণ। ঝিমঝিমে নিরিবিলি নীলাচল, যেন আসন্ন প্রলয়ের পূর্ব উদ্দীপন। উত্তাল জলরাশির উপচে পরা গর্জনের পথ ধরে আগত শাঁই শাইঁ করা বৈরী বাতাসে বুনোফুলের মিষ্টি সুঘ্রাণ।
বোধ হয় ঝড় আসবে শীঘ্রই। নিশানা বিহীন গভীর সমুদ্র ফুলেফেঁপে শান্ত সাবলীল ঢেউগুলো তুফানে রূপান্তরিত হচ্ছে ক্রমশ। উর্মিমালার ঝপাৎ ঝপাৎ আঁচড়ে প্রতি মূহুর্তে সিক্ত হয়ে উঠছে সমুদ্র কোলের শুষ্ক বেলাভূমি। আঁচড়ে পরা সেই ঢেউয়ের তালে ভেসে আসছে কত কি!ফুলেট,পুরোনো আসবাব, ক্রুজ শীপের ভগ্নাংশ, সেই সঙ্গে সদ্য গু’লিবিদ্ধ হয়ে মা’রা যাওয়া একটা তরতাজা শঙ্খচীল। সমুদ্র গহীনের জলদস্যু গুলো বোধ হয় তীরের সন্ধানে মরিয়া, গু’লিপ্রাপ্ত নিথর প্রাণটা তার জলজ্যান্ত প্রমান।
মেঘের গুরগুর আওয়াজ বেড়েই চলেছে ক্রমশ। ক্যাফের মাঝে যদিও সেই শব্দ ক্ষীণ, বাইরের গুমোট ঝোড়ো আবহ অনুমান যোগ্য নয়। কয়েক মূহুর্ত, মাত্র কয়েকমূহুর্ত শূন্য মস্তিষ্ক আর অসার শরীরের একচ্ছত্র বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিল ঈশানী, আবেগের প্রকোপে খেই হারিয়ে ডুব দিয়েছিল মরীচিকায়। নির্লিপ্তে গ্রহন করেছিল অপ্রিয় পুরুষের বন্য স্পর্শ গুলো। মিঠা মিঠা অনুভূতির লহমায় হৃদয়হীন মানবটি চোখ বুজে ছিল আবেশে। তবে অমৃতসুধা পানের এই অপার্থিব মূহুর্তটুকু স্থায়ী হলোনা বেশিক্ষণ। অধর জুড়ে দং’শন পরবর্তী মোলায়েম পরশ অনুভূত হওয়ার পরপরই, আকাশের কোল ঘেঁষে ধেয়ে আসা বজ্রপাতের তীক্ষ্ণ আওয়াজে আচানক সম্বিত ফিরে পায় ঈশানী। বি’ষাক্ত তীরের ফলার মতো মস্তিষ্কে গেড়ে বসে আগ্রাসন, অপরাধ বোধের তরঙ্গোচ্ছ্বাসে মূহুর্তে ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে সর্বাঙ্গ।
শরীর ছাপিয়ে পেলব হৃদপিণ্ড খামচে ধরে সেই প্রকম্পন। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠের ন্যায় এক ঝটকায় নিজের থেকে ঠেলে সরিয়ে দেয় মাফিয়া বসকে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“রিজেকশন” বুঝে উঠতে কিয়ৎক্ষন সময় লাগলো এরীশের। তার মাতাল মাতাল লাগছে ভীষণ, বোধ হয় নিজের মাঝে নেই। যার দরুন তৃষ্ণার্থ চাতকের ন্যায় শূন্য অভিব্যক্তি ধারণ করে চেয়ে আছে নীলাক্ষীর পানে।পৈশাচিকতা এখনো ধরা দেয়নি অস্তিত্বে, ওর দ্বিধাহীন দৃষ্টি অবলোকন করে, ঠোঁট ভেঙে ডুকরে কেঁদে উঠলো ঈশানী, অঝোরে অশ্রুর বির্সজন দিয়ে ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে ভঙ্গুর গলায় বলে উঠলো ,
—কি করলেন এটা? কিভাবে করলেন?
— ওয়াজ আই বিয়িং ভেরী রুড?
মাফিয়া বসের দ্বিধাহীব জবাবের পাছে, মুখের সাহায্যে বিদ্রুপ করে উঠলো ঈশানী, বেরিয়ে এলো অপারগ দীর্ঘশ্বাস। জড়ানো গলায় বললো,
— আমাকে চুমু খাওয়া কিংবা গভীর স্পর্শ করার কোনো এখতিয়ার নেই আপনার। আমি পবিত্র!আর আপনি সবর্দা সীমালঙ্ঘনকারী এক নিষ্ঠুর পাপী অস্তিত্ব। তাহলে কেন বারবার দূর্বল করেন আমায়?
মেয়েটার বলা প্রতিটি বাক্য ছিল এরীশের বুকে নিক্ষিপ্ত হওয়া জলন্ত আ’গ্নেয়াস্ত্র। যা মূহুর্তেই মাফিয়া বসকে হিং’স্র পিশাচে রূপান্তরিত করে ছাড়লো।দু’হাত মুঠিবদ্ধ করে পছন্দের নারীর সম্মুখে দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলানোর পাঁয়তারা চালালো এরীশ।দাঁতে দাঁত পিষে জানালো,
— আমি সব পারি।
— না, আপনি পারেন না। মাফিয়া বস বলে কারোর মনে হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার আপনার নেই।
কথা শেষ করে কাউন্টার থেকে নেমে পরলো ঈশানী।কোনোরূপ প্রত্যুত্তর কিংবা বাক্যের আদান-প্রদান না করেই কাঁধের টোট ব্যাগটা নিয়ে জোর কদমে অগ্রসর হলো সম্মুখে। তৎক্ষনাৎ সরু বাহুতে অনুভূত হলো বলিষ্ঠ হাতের তীক্ষ্ণ টান।সহসা পেছনে ঘুরলো ঈশানী, ওর পানে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো এরীশ,চোখের মাঝে ভয়াবহ কতৃত্ব ধরে রেখে বললো,
— আমি সেটাও পারি। আমার না হলে, তোমার অস্তিত্ব স্বয়ং তোমারও নয়।
হতভম্ব চিত্তে স্থীর দাঁড়িয়ে রইলো ঈশানী। ধূসর বাদামি চোখ দু’টোর মাঝে দৃষ্টিস্থাপন করে মনে মনে আওড়ালো,
— বিকেলের সেই মানুষটা কোথায় হারিয়ে গেলো হঠাৎ! ব্লাডিবিস্ট টাকে বিশ্বাস করে এতো দূর চলে এসে খুব বড় ভুল করিনি তো আমি?
মনের অভিব্যক্তিতে বিতৃষ্ণ হয়ে অস্ফুটে বলে উঠলো,
— মনস্টার!
— ইওর মনস্টার।
এরীশের প্রত্যুত্তরে এক মূহুর্ত স্তব্ধ হলো ঈশানী। অশুভ অনুভূতির মিশেলে ধরাশায়ী হয়ে ফের ছুড়তে চাইলো শব্দের বহর, তবে ফুরসত পেলোনা আর। দু’জনার অকৃত্রিম যাতনার কয়েক ন্যানো সেকেন্ডের মাঝে অকস্মাৎ ব্যালেন্স হারিয়ে ঈশানীর বুকের উপর হুমড়ি খেয়ে পরলো এরীশ। পরপর বু’লেটের আ’ঘাতে চূর্নবিচূর্ন হলো কাঁচের দেওয়াল। স্নাইপার গুলোর বীভৎস আওয়াজে প্রকম্পিত হয়ে উঠলো আকাশ পাতালের মধ্যবর্তী ভূঅঞ্চল।
এরীশের হঠাৎ জায়গা পরিবর্তনে হৃদয় জুড়ে গুমোট এক জলোচ্ছ্বাস বয়ে গেলো ঈশানীর। ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে দু’হাতে সামলালো মাফিয়া বসকে,সঙ্গে সঙ্গে তাজা র’ক্ত প্রবাহে ঝুপঝুপ করে ভরে উঠলো রমনীর ছোট্ট করতল। র’ক্তাক্ত হাতের মাঝে দৃষ্টি বোলাতেই দুনিয়া দুলে উঠলো ঈশানীর। তৎক্ষনাৎ কোনোকিছু না বুঝে অসহায় নেত্রদয় বড়বড় করে নজর আবদ্ধ করলো পর্বতের ন্যায় অটল দাঁড়িয়ে থাকা মাফিয়া বসের ভঙ্গুর দৃষ্টে। কাঁপাকাঁপা গলায় বললো,
—র..রক্ত।
ঈশানীর কথায় নিজের বাহুতে দৃষ্টিপাত করে এরীশ। হিং’স্রতায় দু’চোখ ধাঁধিয়ে ওঠে তার। চোয়াল শক্ত করে বলে,
— গড ড্যাময়েট।
হতবিহ্বল ঈশানী। ঘটনার আকস্মিকতায় থরথর করে কাপছে তার নাজুক শরীরের প্রতিটি কোষ। ফাঁকা মস্তিষ্ক জুড়ে উদ্ভব হয়েছে আড়ষ্টতার। সেভাবেই প্রকম্পিত চিত্তে শুধালো,
— কি হয়েছে? আপনার গু’লি লেগেছে!
জবাব দিলোনা এরীশ। যেন চিরাচরিত থমথমে সেই পাইথন লিডার। রাশিয়ান মোস্ট ওয়ান্টেড মাফিয়া টেরোরিস্ট, আন্ডারওয়ার্ল্ডের হার্টলেস ব্লাডিবিস্ট রীশস্কা।তেমন করেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বোলালো নিজের গু’লিবিদ্ধ বাহুতে, অতঃপর অনুমতির ধারে কাছে না গিয়ে একটানে কেড়ে নিলো ঈশানীর গলায় প্যাঁচানো ওড়নাটা,এরীশের কান্ডে খানিক ভড়ভালো ঈশানী, ধড়ফড়িয়ে উঠে বললো,
— কি করছেন।
নির্বাক এরীশ। ফিনফিনে সুতির আস্তরণে নিজের র’ক্তাক্ত বাহুটা বাধঁতে বাঁধতে ছুঁড়লো শব্দের বহর,
— জায়গাটা সেফ নয়, তোমাকে এক্ষুণি যেতে হবে।
— যাবো মানে? আপনার গু’লি লেগেছে, এ অবস্থায়…
কণ্ঠজুড়ে ভাঙা ভাঙা অসহায় এক অভিব্যক্তি। যেন এরীশের ব্যথায় ক্ষ’তবিক্ষত স্বয়ং ঈশানী। ওর পানে তাকালো না এরীশ, শত্রুপক্ষের গেরিলা কৌশল আঁচ করতে পেরে জলদি কানে গুঁজলো এয়ারপড। ওয়েস্ট বেল্টের মাঝে আটকে থাকা রিভলবারটা বের করে ভেতরে বুলেট লোড করতে করতে কাউকে কঠোর আদেশে বলে উঠলো,
— বি অ্যালার্ট। পায়ারেটস আর হেয়ার।
তৎক্ষনাৎ সাদা পোশাকধারী গার্ডসরা এসে ঘিরে ফেললো ক্যাফের চারিপাশ, বাজপাখির ন্যায় সচকিত দৃষ্টি ফেলে সমুদ্র পৃষ্ঠে ফাঁকা গু’লি ছুড়ে নিশ্চিত করলো নিজেদের পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্ভীক অবস্থান। প্রবল বর্ষনে ঝাপসা দৃষ্টিসীমা। সন্ধ্যা নামার আগেই কালো হয়ে এসেছে ধরিত্রী। এরই মাঝে আরেকদফা গু’লির আওয়াজে আঁতকে উঠলো ঈশানী, ব্যতিগ্রস্ত হয়ে চোখমুখ খিঁচে খামচে ধরলো এরীশের শার্ট। ক্ষান্ত হলোনা এরীশ, তাড়াহুড়ো রিভলবার লোড করতে করতে একা একাই রাশিয়ান ভাষায় বিড়বিড়ালো সে,
— বুইট বিসট্রাম(Be fast)।
দোষটা আসলে এরীশের। ঈশানীর সঙ্গে একান্তে সময় অতিবাহিত করবে বলে কোনোরূপ সেলফ গার্ডের কথা মাথায় আসেনি তার। এমনকি রিভলবারটা পর্যন্ত ছিল আনলোড। দ্বায়িত্বের স্বার্থে গার্ডসদের কয়েকটি টীম সাদা পোশাকে এলেও, তাদেরকেও থাকতে বলেছিল নিরস্ত্র। কারণ একটাই নৃ’শংসতাকে ঘৃণা করে ঈশানী। কিন্তু নৃ’শংসতা যে এরীশের র’ক্তে মিশে, চাইলেই কি এতো সহজে দূরীভূত করা সম্ভব? বোধ হয় না।
এরীশের কর্মকান্ড পর্যবেক্ষন করে উদগ্রীব হয়ে উঠলো ঈশানী, ক্রন্দিত স্বরে বললো,
— কি করছেন কি? আপনার হাত কাঁপছে তো ,এক্ষুনি হসপিটালে যাওয়া প্রয়োজন। আমার ভয় করছে, প্লিজ চলুন।
— শত্রুদের মোকাবিলায় কখনো পিছু হাটেনা এরীশ । ওদের প্রত্যেকটাকে গু’লির আ’ঘাতে ধরাশায়ী করে মা’রবো ,তবেই এই জায়গা ত্যাগ করবো আমি। একটা নির্বাক প্রাণীকেও ছাড়বো না আজ।
— আর যদি আপনি ম’রে যান?
সর্বদা ভীত সন্ত্রস্ত মেয়েটা আজ নির্দ্বিধায় একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে মাফিয়া বসকে। যেন খুব কাছের সে। অবশ্য কথাটা ভুল নয়, সেই শুরু থেকে ক্রমান্বয়িক বিপদ, নৃ’শংসতা, কিংবা গন্তব্যহীন বিভীষীকা এই সবই ছিল দু’জনার কাছাকাছি আসার মূল হেতু।
— নো অফেন্স, কারও কিছু যায় আসে না।
মাফিয়া বসের অনুভূতিহীন নির্জীব প্রত্যুত্তর। পরপরই একহাতে রিভলবার আর অন্যহাতে ঈশানীর সরু কব্জিটা মুঠিবদ্ধ করে ক্যাফে থেকে বের হওয়ার জন্য সম্মুখে পা বাড়ালো এরীশ। অভিমান আর গ্লানি একীভূত হয়ে দলা পাঁকিয়েছে গলায়। আড়ষ্টতার অদৃশ্য শেকলটা প্যাঁচিয়ে ধরেছে কণ্ঠনালি।ফলস্বরূপ বাক্য বের হলোনা মুখ থেকে। কেবল মনেমনে ভাবতে লাগলো,
— আপনার কিছু হলে না চাইতেও য’ন্ত্রণায় দগ্ধ হই আমি, ভুলে যাই নিজের সমস্ত আত্মসংযম। এটা কি যায় আসা নয়?
বৃষ্টিস্নাত লনজুড়ে সশস্ত্র মাফিয়া বাহিনীর নির্ভীব অবস্থান। ক্যাফের পেছনে আ’ক্রমণে আগ্রাসী শত্রুপক্ষ, একের পর গু’লি বর্ষনে বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠের মতোই ক্ষণে ক্ষণে জ্বলে উঠছে চারিপাশ। তীক্ষ্ণ বারুদের গন্ধে জ্বলে যাচ্ছে নাসারন্ধ্র। তুমুল বর্ষনের মাঝে ঈশানী সমেত বাইরে বেড়িয়ে এলো এরীশ।
এর আগে যখনই হাত ধরেছে এরীশ, ঈশু খেয়াল করেছে ওর হাতগুলো বরফপিণ্ডের মতোই শীতল সবসময়, অথচ আজ বৃষ্টির মাঝেও সমগ্র করতল জুড়ে ভয়াবহ রকমের উত্তাপ, যেন ধোঁয়া ওঠা জলন্ত অ’ঙ্গার। এতোকিছুর মাঝে ঈশানী অনুমান করলো, বোধ হয় জ্বর এসেছে এরীশের। লনের দিকে এগিয়ে এসে ঈশানীর হাতটা আস্তে করে ছেড়ে দেয় এরীশ, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দু’জন বিশ্বস্ত গার্ডকে উদ্দেশ্য করে বলে,
— যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে সরিয়ে নাও ওকে।
জীবন্ত পুতুলের ন্যায় মাথা নাড়িয়ে হ্যা জানালো তারা। নিস্ফল কদমে এগিয়ে গেলো ঈশানীর পানে, মাথার উপর ছাতা তুলে ধরে গভীর স্বরে বললো,
— চলুন।
এখনো নির্বাক দাঁড়িয়ে ঈশানী।বহু কসরত করেও কণ্ঠনালির জড়তা কাটানো গেলোনা কিছুতেই। সহসা গুটি গুটি কদমে এগুতে লাগলো গার্ড’সদের সঙ্গে। তখনই গার্ডদের উদ্দেশ্য পেছন থেকে আরেকদফা বাক্য ছুড়লো মাফিয়া বস,
— বাই দ্যা ওয়ে, ডোন্ট টাচ হার এ্যনি মোর।
এরীশের হাস্কিস্বরটা কর্ণগোচর হতেই থমকালো ঈশানী। এক মূহুর্তও সময় নষ্ট না করে ছাতা থেকে বেড়িয়ে উদভ্রান্ত কদমে মাফিয়া বসের পানে ছুটে এলো নীলাম্বরি।শূন্য অভিব্যক্তি নিয়ে মেয়েটার নীল চোখের সঙ্গে দৃষ্টির মিলন ঘটালো এরীশ। বৃষ্টিতে ভিজে ঠোঁটের নিম্নভাগে জ্বলজ্বল করছে তার কুচকুচে কালো তিলক, নিগূঢ় দৃষ্টি স্থাপন করে সেই অপার্থিব পুরুষালি চিবুকে বেমালুম অনামিকা ছোঁয়ালো রমনী।
অতঃপর তীব্র বর্ষন,বি’ধ্বংসী আবহ, জীবন ম’রণ সন্ধিক্ষণ, সবকিছু উপেক্ষা করে অকস্মাৎ উচাটন চিত্তে জড়িয়ে ধরলো পর্বতের ন্যায় সটান দাঁড়িয়ে থাকা জীবন্ত অশরীরীকে। নির্বিকার এরীশ।বারিধারায় সিক্ত নারীদেহের প্রতিটি তীক্ষ্ণ ভাজ পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুভব হচ্ছে শরীরে। সৌষ্ঠব বক্ষমাঝে মোমের ন্যায় লেপ্টে আছে প্রিয় রমনীর তুলতুলে মোলায়েম একজোড়া নারী উপত্যকা। সবকিছুকে পাথরের ন্যায় উপেক্ষা করে গেলো সে । ঈশানীর থেকে চোখ সরিয়ে ফের কঠোর আদেশ করলো গার্ড’সদের,
— নিয়ে যাও।
তক্ষুনি অবাধ্য বালিকার ন্যায় এদিক ওদিকে মাথা নাড়িয়ে না জানালো ঈশানী, উদভ্রান্ত স্বরে বলে উঠলো,
— না যাবোনা আমি। ‘গুলি লেগেছে আপনার,ম’রে যাচ্ছেন আপনি। এই অবস্থায় আপনাকে ফেলে কোথাও যাবোনা আমি, কোথাও না।
ওদিকে গো’লাগু’লির আওয়াজ বেড়েই চলেছে ক্রমশ। কখন কোন অঘটন ঘটে যায় অনুমান করা দুষ্কর। অগত্যা ঈশানীর কথায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করলো না এরীশ। নতুন উদ্যমে গার্ডদের ইশারা করে, অনুভূতিহীন গলায় বলে উঠলো,
— নিয়ে যাওওও।
— কিন্তু বস কিভাবে? না মানে টাচ্ না করে…
মাফিয়া বসের থমথমে মুখাবয়ব পরখ করে বাক্য সম্পূর্ণ করার সাহস পেলোনা গার্ড। পরবর্তী আদেশের অপেক্ষায় চেয়ে রইলো নির্বাক,
নাজুক রমনীর লতানো শরীরটা লেপ্টে আছে বুকের মাঝে, সেভাবেই ধীর স্থীর চোখ বুজলো এরীশ।তপ্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মুঠিবদ্ধ করে নিলো খরখরে শক্ত করতল। পেছনে ধেয়ে আসা দু’টো আ’ক্রমণ কারীর পেটানো বুকে পরপর গু’লি নিক্ষেপ করে, ছুঁড়লো তীর্যক বাক্যবান,
— পারমিশন গ্রান্টেড।
মাফিয়া বসের আদেশ কার্যকর হওয়ার পরক্ষণেই দু’জন গার্ড এগিয়ে এলো ঈশানীর নিকট। দু’দিক থেকে ওর নমনীয় বাহু দু’টো আঁকড়ে ধরে টেনে সরালো এরীশের কাছ থেকে। বহু জোরজবরদস্তিতে আলাদা হলো দু’টো শরীর। বলবান গার্ডদের সঙ্গে টানা হেঁচড়ায় না পেরে, ছটফট করে চ্যাঁচিয়ে উঠলো মেয়েটা,
— যাবো না আমি। এরীশ শুনছেন, আমি যাবো না। আপনার গু’লি লেগেছে আমি আপনাকে ফেলে কিছুতেই যাবোনা।
ক্রন্দনরত মেয়েটার তীব্র আহাজারি শোনার এক মূহুর্ত ফুরসত হলোনা এরীশের, বুকের মাঝ থেকে ঈশানীকে সরিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উদ্ভাসন ঘটলো পৈশাচিকতার। চোখের মাঝে আ’গ্নেয়গিরির দাবানল জ্বালিয়ে একের পর এক ধাতব বুলেটের ক’ষাঘাতে বিদীর্ণ করতে লাগলো শত্রুপক্ষের নির্ভীক বক্ষপিঞ্জর। বারিধারার একচ্ছত্র প্রবাহের সঙ্গে র’ক্তের একাগ্রতা যেন হার্টলেস মাফিয়ার শৈল্পিক নৃ’শংসতার উদ্ভাবন।
অথচ অদূর থেকে ভেসে আসা সাকুরার হৃদয় বিদারক কান্নারা ক্রমশ মনোযোগ কেঁড়ে নিচ্ছে ওর। বারবার লক্ষ্যচ্যুত হচ্ছে নিশানা , অদৃশ্য হওয়ার অন্তিম মূহুর্তে এসে সাকুরা বলে উঠেছিল,
— যায় আসে, আপনি ম’রে গেলে যায় আসে আমার। জানিনা কেন? কোন অদৃশ্য পিছুটানে বাঁধা পরেছি আমি, কিন্তু আপনার জন্য আমি য’ন্ত্রণা অনুভব করছি, শুনতে পাচ্ছেন!
এক মূহুর্তের জন্য থমকালো এরীশ, মনেমনে ভাবলো,
— সত্যিটা জানলে তুমি আমাকে আরও বেশি ঘৃণা করবে হয়তো। অথচ না জেনেই অদৃশ্য পিছুটান অনুভব করছো। ইজ ইট ডেসটিনি?
সঙ্গে সঙ্গে বজ্রপাতের আওয়াজে প্রকম্পিত হলো ধরণি।
— মেইবি।
গর্জে ওঠা আকাশের পানে চেয়ে ছোট্ট শব্দটা উচ্চারণ করে ফের শত্রুদের ধরাশায়ী করতে ব্যতিগ্রস্ত হয়ে পরলো মাফিয়া বস।
সন্ধ্যা হয়েছে বহুক্ষণ। আকাশ জুড়ে ফেরারী পাখিদের ঘরে ফেরার ঢল। ঈশানীও ফিরলো, বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে দুরুদুরু বুকে বাড়ি ফিরলো সে। পা দু’টো যেন চলেও চলছে না, বি’ধ্বস্ত হৃদয়,জ্বলজ্বলে নীল চোখ দু’টোতে জমে আছে নোনাজল। শীতের তোড়ে তিরতির করে কাপছে সর্বাঙ্গ। দু’হাতে কোনোমতে ভেজা শরীরটাকে আঁকড়ে ধরে মাত্রই ঘরের দুয়ারে পা দিয়েছে মেয়েটা। উদ্দেশ্য, সবার দৃষ্টির অগোচরে তাড়াহুড়ো রুমের দিকে এগিয়ে যাওয়া। তবে সেই উদ্দেশ্য পূরণ হলোনা আর, সিঁড়ির মাঝে এক পা দিয়েছে কি দেয়নি তৎক্ষনাৎ কর্কশ স্বরে বাঁধ সাধলেন রোকেয়া।
— দাঁড়া, কোথায় গিয়েছিলি?
মায়ের ডাকে পেছনে ঘুরলো ঈশানী,দায়সারা হয়ে বললো,
— কোথায় আবার বুটিক হাউজে।
— আমাকে কি তোর বোকা মনে হয়? বৃষ্টিতে ভিজে কার সঙ্গে বাড়িতে ফিরেছিস?
আড়ালে শুষ্ক ঢোক গিললো ঈশানী, নিজের খাদ টুকু লুকোতে ব্যগ্র স্বরে বলে উঠলো,
— কি বলছো আজেবাজে? কারও সঙ্গে ফিরিনি আমি।
কথাটুকু শেষ করে তাড়াহুড়ো সিঁড়িতে পা চালালো ঈশানী, তৎক্ষনাৎ পিছন থেকে কথা ছুঁড়লেন রোকেয়া,
— তাহলে বৃষ্টিতে ভিজলি কি করে? আর তোর ওড়নাই বা কোথায়?
পুনরায় থমকালো ঈশানী, মায়ের অযাচিত কথায় মনে পরে যায় তখন এরীশ কেঁড়ে নিয়েছিল ওড়নাটা,সহসা জুতসই উত্তর দিতে না পেরে আমতাআমতা করতে লাগলো মেয়েটা, সিঁড়ির অভিমুখে এগিয়ে এলেন রোকেয়া, মেয়ের পানে ক্ষুদ্ধ দৃষ্টিপাত করে তিক্ত স্বরে বললেন,
— দুদিন বাদে মাহিনের সঙ্গে বিয়ে, আর এখন একটা গুন্ডা, স’ন্ত্রাসীর ঘুরে বেড়াতে একটুও লজ্জা লাগলো না তোর?
ঘরময় ছক্কা হাঁকালো রোকেয়া প্রাচী। মায়ের শেষ কথায় পুরোপুরি স্তম্ভিত হয়ে পরলো ঈশানী। ঊষা আর নানী টিভিতে সিরিয়াল দেখছিলেন ওপাশে, উত্তেজনা মূলক বিশেষ পর্ব রেখে তারাও ছুটে এলেন এবার, দেবোরা অস্থির হয়ে শুধালেন,
— কি ওইদ্দে!
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই নানীর পানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করে ঈশানী। অতঃপর জিভের ডগায় শুষ্ক অধর ভিজিয়ে জোর গলায় বলে,
— আমি কোনো গুন্ডার সঙ্গে ঘুরে বেড়াই নি মা। খুব ক্লান্ত লাগছে দয়াকরে রুমে যেতে দাও।
রোকেয়া চোখ গরম করলেন এবার, মেয়েকে একহাত দেখিয়ে বললেন,
— আবারও মিথ্যা বলছিস? জিসান সব বলেছে আমাকে । একটা স’ন্ত্রাসীর সঙ্গে কিসের এতো ঘনিষ্ঠতা তোর?
— জিসান আমার সঙ্গে কখনো যোগাযোগ করেনা। অথচ তোমাকে কল দিয়ে ঠিকই এসব ভুলভাল কুৎসা রটিয়ে বেড়ায়।
— ভুলভাল! কোনটা ভুলভাল? আজ বুটিক হাউজ ফাঁকি দিয়ে তুই ঘুরে বেড়াস নি ওই গুন্ডা লোকটার সঙ্গে?
হৃদয়টা ভরে উঠলো ব্যথায়, জিসান বরাবরই বন্ধুত্বের নামে বিশ্বাসঘাতকা করে এসেছে, এবারও তার ব্যতিক্রম নয়, কিন্তু ঈশানীকে এভাবে হেনস্তা করে কি লাভ ওর? বিতৃষ্ণায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ঈশানী, মায়ের অনবরত লজ্জাদায়ক ভৎসনায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বললো,
— স’ন্ত্রাসী বলা বন্ধ করো, অরণ্য কোনো স’ন্ত্রাসী নয় ।
দমলেন না রোকেয়া। নতুন করে ছুঁড়তে লাগলেন গা জ্বালানো বাক্য বহর,
— একটা স’ন্ত্রাসীকে কে স’ন্ত্রাসী বলেছি বলে খুব গায়ে লেগেছে? ভুলে যাস না মাহিন তোর হবু স্বামী।কই তার সঙ্গে তো কখনো ঘুরতে দেখিনা?তুই চাকরির নাম করে যার তার সঙ্গে বেলাল্লাপনা করে বেড়াবি,আর আমি বেঁচে থাকতে সেসব হতে দেবো ভেবেছিস?
মায়ের সঙ্গে অযথা তর্ক করে লাভ নেই। পরিস্থিতি কিংবা হৃদয়ের অনুরক্তি কোনোকিছুই বোঝার মানুষ মা নয়। সেই ভেবে আহত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফের নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায় ঈশানী। সঙ্গে সঙ্গে তিরিক্ষি আওয়াজ ভেসে আসে পেছন থেকে,
— কথার ছাপ ছাপ উত্তর না দিয়ে কোথায় যাচ্ছিস তুই? কোন গুন্ডাপান্ডার সঙ্গে ঘুরেছিস সত্যি করে বল। নয়তো এ বাড়িতে তোর আর জায়গা নেই।
ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো এবার। অপারগ হয়ে দাঁতে দাঁত চাপলো ঈশানী, পেছনে ঘুরে তীর্যক স্বরে বলে উঠলো,
— ভুলে যেওনা বাড়িটা আমার। দাদু মা’রা যাওয়ার আগে এই বাড়িটা তার একমাত্র নাতনির নামে উইল করে দিয়ে গিয়েছেন। অন্য কারোর নামে নয়। তাই এবার থেকে অহেতুক হয়রানি করা বন্ধ করো মা। আমাকে আমার মতো ছেড়ে দাও ।
তিক্ত কয়েকটা বাক্য উগড়ে দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে তরতরিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো ঈশানী। নিচ তলায় ঠায় দাঁড়িয়ে ফুঁসছেন রোকেয়া। মেয়ের যাওয়ার পানে চেয়ে রাগে গজরাতে গজরাতে বলে উঠলেন,
— কখনোই না, তোকে তোর মতো ছেড়ে দিলে আজ বাদে কাল আমার ঊষাকে এভাবেই দূরদূর করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিবি তুই। তার আগেই তোর ডানা ছাঁটতে হবে।
একমনে কথাগুলো বলে, মায়ের উদ্দেশ্য কথা ছুঁড়লেন রোকেয়া। বললেন,
— ওকে আর বাড়ির বাইরে পা রাখতে দেওয়া যাবে না মা।
মেয়ের কথায় খুব একটা কর্ণপাত করেন না দেবোরা। আপাতত সিরিয়ালের নেশায় মত্ত সে। অগত্যা লাঠি ভর করে টিভির দিকে যেতে যেতে বললেন,
—বিয়া দি ফেলা, বিয়া দি ফেলা, বিয়া ইবা দি দিলে বেক্কিন ঠিক অই যাইবো।
মস্কো, রাশিয়া।
দুপুরের মিহি রোদ ম্লান হয়ে এসেছে কিছুটা। সূর্য পশ্চিমে যাওয়ার আগেই ঢাকা পরেছে কুয়াশায়। তুষারপাত না থাকলেও প্রকৃতিজুড়ে বয়ে যাচ্ছে কনকনে শীতল হাওয়া। বিকেলের নরম রোদ উপভোগ্য নয়, বেশ ঠান্ডা চারিদিক। পেলব শরীরে দাদির বুনঁনকৃত উলের একটা গরম চাঁদর প্যাঁচিয়ে আজ বহুদিন বাদে প্যারাডাইস ভবনের বাইরে বেড়িয়েছে ফ্লোরা। গেটের কাছে তুষার দাঁড়িয়ে, আপাতত গুটিগুটি পায়ে সেদিকেই অগ্রসর হচ্ছে রুশকন্যা। গাড়ির ট্রাঙ্কে কিছু অ’স্ত্র আর গো’লাবারুদ ভরে নিচ্ছিল তুষার, এমতাবস্থায় গেটের নিকট এসে হাজির হলো ফ্লোরা। তুষার তাকালো না, নিজের কাজে অবিরত থেকে ছোট্ট করে বললো,
— তুমি?
— আবারও চলে যাচ্ছেন?
থমকালো তুষার, আস্তে করে ট্রাঙ্কের শাটার নামিয়ে দু কদম এগিয়ে এলো ফ্লোরার পানে। সূর্যের নরম আলোয় টকটকে দ্যুতি ছড়াচ্ছে রমনীর মাখন নরম ওষ্ঠাধর। সেদিকে একপল দৃষ্টি বুলিয়ে নির্লিপ্তে মাথা নাড়িয়ে হ্যা জানালো তুষার। ফ্লোরা নির্বাক, এদেশ সেদেশ করে পুরো ব্রক্ষ্মাণ্ড ঘুরে বেড়ানো তুষারের কাছে নতুন কিছু নয়। কেবল ফ্লোরার জিজ্ঞেস করার প্রচলণ টা নতুন। সেই তখন থেকে শুকনো মুখে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে ফ্লোরা। তুষার আগ বাড়িয়ে শুধালো এবার,
— ভেতরে যাবে না?
নিশ্চল বদনে হ্যা জানালো ফ্লোরা, তুষার বললো,
— এক মিনিট।
ক্ষীণ চোখ উঁচিয়ে লোকটার পানে নজর স্থাপন করে ও। তক্ষুনি গাড়ির ট্রাঙ্ক থেকে একটা চকচকে রুপোলী রঙের রিভলবার বের করে ফ্লোরার পানে এগিয়ে দিলো তুষার। বিরস মুখে বললো,
— এটা নাও।
রিভলবার দেখে হকচকালো ফ্লোরা। তৎক্ষনাৎ উদগ্রীব হয়ে শুধালো,
— এটা কেন!
— ফর ইওর সেইফটি পারপাস।
চকিতে হাত গুটিয়ে না করলো মেয়েটা । এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে আপত্তি জানিয়ে বললো,
— পেন্টহাউজে আমি এমনিতেই সুরক্ষিত। এটার প্রয়োজন হবেনা।
— না তুমি সুরক্ষিত নও। মাফিয়া টেরোটোরিতে এভাবে নিরস্ত্র থাকার কোনো মানেই হয়না। তুমি টমেটো প্রিন্সকে চেনোনা, তাই এতো নিশ্চিন্ত রয়েছো। কিন্তু তোমাকে এভাবে একা রেখে আমি নিশ্চিন্ত নই। যা বলছি চুপচাপ তাই করো, রিভলবার টা নাও।
তুষারের কঠোর নির্দেশে কুণ্ঠিত হয়ে হাত বাড়ালো ফ্লোরা। কম্পিত হস্তে তুলে নিলো রিভলবার। সেটাকে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে জড়ানো গলায় বললো,
— এর আগে কখনো অ’স্ত্র হাতে তুলিনি আমি।
— তোমার ইনোসেন্সি সবসময় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তোলে আমায়। দয়াকরে সাবধানে থেকো।
কথাটা শেষ করে গাড়ির অভিমুখে পা বাড়ালো তুষার। পরপরই পিছু ডাকলো রুশকন্যা , নির্লিপ্ত বদনে চাইলো চাইলো তুষার। মেয়েটা তরতরিয়ে এগিয়ে এসে বললো,
— কবে ফিরবেন আবার?
— জানিনা।
— আর এরীশ?
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো তুষার। মূর্তিমান শক্ত মুখাবয়বে কিঞ্চিৎ নমনীয়তা টেনে আস্বস্ত গলায় বললো,
— সময় হলে দু’জনই ফিরবো। আপাতত কিছুই বলতে পারছি না, এরীশ ঠিক নেই।
ফ্লোরাকে দ্বিতীয়বার প্রত্যুত্তর করার ফুরসত না দিয়ে ব্যগ্র পায়ে গাড়িতে উঠে বসলো তুষার। অতঃপর অক্ষিপুটে পলক ছাড়ার আগেই বিলাসবহুল রোলস রয়েসটা অদৃশ্য হয়ে গেলো জঙ্গলের আঁকাবাকার রাস্তার গোলোক ধাঁধায়।
কেটে গিয়েছে বেশ কয়েক দিন। দিন পেরিয়ে রাত হয়, ফের রাত পেরিয়ে দিন। এরীশের আর খোঁজ পায় না ঈশানী। যেন পৃথিবীতে থেকেও অদৃশ্যমান সে। বাস্তবতায় জুড়ে থাকা অবাস্তব এক মরীচিকা। বিষণ্ণতা কাটেনা ঈশানীর, হৃদয়ের ব্যথায় জমে নীল হয়ে আছে সমগ্র অস্তিত্ব। গত কয়েকদিন ধরে ব্যাহত হচ্ছে কর্মদিবস। নিজ মনের দিশাহীন আবেগানুভূতির কাছে ক্রমশই পরাস্ত ঈশানী।এই দোটানা, এই টানাপোড়েন সবকিছু দিনেদিনে গ্রাস করে নিচ্ছে ওর নাজুক স্বকীয়তা। কোথায় এর শেষ, জানা নেই নীলাম্বরীর।
ক্লান্ত বিকেলের আবহাওয়া বড্ড স্বস্তিদায়ক। গোধূলির রঙে র’ক্তিম আকাশ। নিভে আসা সূর্যের সোনালী ছটায় চকচক করছে পুরোনো কংক্রিটের বাড়িটা। আজ বহুদিন বাদে ছাঁদে এসেছে ঈশানী। শ্যাওলা পরা পাঁচিলের উপর দু’হাত রেখে চোখ মেলেছে শূন্য আকাশে। রাতভর বৃষ্টি হয়েছে কাল, চারিদিকে ভেজা মাটির সোঁদা এক গন্ধ। স্যাঁতসেতে ছাঁদের এককোণে বান্ধবীকে নিয়ে হুড়োহুড়িতে মেতেছে ঊষা। সেদিকে একপল চেয়ে আবেশে চোখ বুজলো ঈশানী। ঠিক তখনই কর্ণকূহরে ভেসে এলো চমৎকার পুরুষালি এক পরিচিত কণ্ঠস্বর।
— গুড আফটারনুন।
তরাগ করে চোখ খুললো ঈশানী, চকিতে পাশে তাকাতেই দেখলো হাস্যোজ্জল বদনে চেয়ে আছে মাহিন। ঈশানীর বিভ্রান্ত চেহারার পানে সুক্ষ্ম নজর বুলিয়ে ফের কথা পারে যুবক,
— বেশ আশ্চর্য হলে মনে হচ্ছে?
জোরপূর্বক হাসলো ঈশানী, মাহিন বললো,
— বেশ কিছুদিন হলো কোনো খোঁজ নেই তোমার, ঠিক আছো?
এবারও নির্বাক রমনী। ঠোঁটের আগায় সুপ্ত মেকি হাসিটা এখনো দৃশ্যমান। স্থির হলোনা মাহিন, নতুন উদ্যমে বলে উঠলো,
— তোমার মুখটা এমন শুকনো লাগছে কেন? জ্বর টর হয়নি তো? দেখি।
কথাটা শেষ করে ঈশানীর কপাল ছোঁয়ার প্রয়াসে হাত বাড়ালো মাহিন। তৎক্ষনাৎ তরিৎ বেগে পিছিয়ে গেলো ঈশানী। কণ্ঠনালি ভেদ করে সঞ্চারিত হলো ক্ষুদ্র বাক্যবান,
— জ্বর এসেছে।
— কবে থেকে?
— গত তিনদিন।
— আমাকে জানাও নি কেন?
এবারে থমকালো ঈশানী, দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে অকস্মাৎ বলে উঠলো,
— আমি এই বিয়েটা করতে পারবো না মাহিন। আমি চাই আপনি ভালো থাকুন সবসময়।
কয়েক মূহুর্ত স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো মাহিন। নিজেকে জুতসই সামাল দিতে বেশ কিছুটা সময় লাগলো তার। অতঃপর শুষ্ক একটা ঢোক গিলে শুধালো,
— এই সিদ্ধান্তের একমাত্র কারণ নিশ্চয়ই এরীশ ইউভান?
সচকিত হয়ে চোখ ঘোরালো ঈশানী,আশ্চর্য গলায় বললো,
— এরীশ ইউভান কে আপনি চিনলেন কি করে?
— গুগল করেছিল, তাছাড়া রাশিয়ান Bratva কে কে না চেনে?
কুণ্ঠায় চোখ নামালো রমনী,শান্ত স্বরে বললো,
— অরণ্য আমাকে ছাড়বে না মাহিন।
— আর তুমি?
কণ্ঠস্বর আহত শোনালো মাহিনের। তবুও স্থির কণ্ঠে জবাব দিলো ঈশানী,
— ওকে ভোলা বোধ হয় এ জীবনে সম্ভব নয়।
ঈশানীর নির্লিপ্ত জবাবে হতবিহ্বল হলো মাহিন। উদ্বিগ্ন স্বরে,
— কি বলছো আদৌও ধারণা আছে তোমার? ও একটা মাফিয়া টেরোরিস্ট। আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা এগুলো ওর ধাঁচে নেই। জানোয়ারের চাইতেও হিং’স্র ওর আগ্রাসন। এখন ও তোমার জন্য যা যা পা’গলামি করছে সবটা ওর ভেনম অবসেশন । বাস্তবতা বোঝার চেষ্টা করো ঈশানী। ও একটা আঁধারের নিশাচর ছাড়া আর কিচ্ছু নয়।
তপ্ত শ্বাস ফেললো ঈশানী,খোলা আকাশের পানে তাকিয়ে বললো,
— জানি। সব জানি। কিন্তু কি করবো বলুন? ওই জানোয়ারটা র’ক্তে মিশে গিয়েছে আমার। চাইলেও ভুলতে পারছি না। এই বাস্তবতা, এই সাবলীল জীবনযাপন সকল চাকচিক্য ছাপিয়ে ওই কালো দুনিয়ার নিষ্ঠুর মানবের জন্য হৃদয়ে দহন অনুভূত হচ্ছে সর্বক্ষন। ওই মাফিয়াটাকে ছাড়া আমার নিগূঢ় চিত্ত কিচ্ছু চাইছে না, আর কিচ্ছু না।
রমনীর অবুঝ আবেগের কাছে বেমালুম হার মেনে নিলো মাহিন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— দুনিয়া, সমাজ, বাস্তবতা এসবের কথা ভেবেছো একবারও। আদৌও এই পরিণয়ের কোনো স্বস্তিদায়ক পরিনতি দিতে পারবে মাফিয়া বস?
এবারও ভাবলেশহীন ঈশানী, নির্বিকার হয়ে বললো,
— আমার দুনিয়া, আমার সমাজ সবকিছু ওই খারাপ মানুষটাকে ঘিরেই আবর্তিত মাহিন। পরিনতির কথা জানিনা, তবে অরণ্য আমাকে কখনো ছেড়ে যাবেনা, এটা আমার বিশ্বাস।
— একটা টেরোরিস্ট কে বিশ্বাস করতে ভয় করছে না তোমার?
— আপনি ভয়ের কথা বলছেন, সেটা বহু আগেই পার করে এসেছি আমি।
— তারমানে তুমি জেনেশুনে অন্ধকারে পা বাড়াবে, আঁকড়ে ধরবে একটা মরীচিকাকে?
— পুরো দুনিয়ার কাছে মরীচিকা হলেও আমার কাছে এক সমুদ্র অনুভূতির নাম এরীশ ইউভান।
হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো মাহিন।মুখগহ্বরে অবস্থিত শেষ লালা টুকু গলাধঃকরণ করে নরম স্বরে বললো,
— আই আন্ডারস্ট্যান্ড। তবে তোমাকে নিয়ে সবসময় চিন্তিত থাকবো আমি।
পাশ ঘুরলো ঈশানী, হতচকিত হয়ে শুধালো,
— আপনি সত্যিই বিষয়টা এতো সহজে মেনে নিয়েছেন?
—আমিও কারোর জন্য ঠিক এমন ভাবেই অসহনীয় দূর্বলতা অনুভব করি ঈশানী। না বোঝার তো কিছু নেই। তুমি জানো গত কয়েকটা দিনে নিজের অনাগত বিয়ে,সংসার নিয়ে কত স্বপ্নই না দেখে ফেলেছি আমি?
অপরাধ বোধে মুখশ্রী চুপসে এইটুকুনি হয়ে গেলো ঈশানীর।মাহিনের ব্যথাতুর নেত্রদয় থেকে দৃষ্টি নমিত করে ফেললো সবেগে। আড়ষ্ট স্বরে বললো,
— আমি দুঃখিত মাহিন, আপনার মতো মানুষকে এভাবে ফিরিয়ে দেওয়া লজ্জাজনক।কিন্তু কি করবো বলুন? মনের বিরুদ্ধে যেতে পারছি না কিছুতেই।
— গিল্টি ফিল করতে হবে না। আমিও তো তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম একবার। তাও আবার বিয়ের দিন, সে হিসেবে তুমি যথেষ্ট ভালো কাজ করেছো।
বিনাবাক্যে দাঁড়িয়ে রইলো ঈশানী। ওর সুশ্রী মুখের পানে চেয়ে ম্লান হাসলো মাহিন,কণ্ঠে ধাতস্থতা টেনে বললো,
— ভেতরের অনুভূতিকে ঠিক এভাবেই প্রাধান্য দেওয়া উচিৎ, নয়তো আমার মতো হারাতে হয়। আই এপ্রেশিয়েট ইউ।
এক নিঃশ্বাসে কথা কটা বলে চিলেকোঠার দিকে পা বাড়ালো মাহিন। যাওয়ার আগে শেষবারের মতো পেছনে ঘুরে বলে উঠলো,
আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩৫
— বন্ধু ভাবতেই পারো। যে কোনো বিপদে নিঃসন্দেহে পাশে পাবে এই অধম কে।
— কথা দিচ্ছেন?
— দিচ্ছি।
নীল নয়না। অপ্সরীর মতো সুন্দর চোখ তার। নিখুঁত তার অপার্থিব সৌন্দর্য। সেই মেয়েটাকে পেয়েও পেলো না মাহিন। কেবল চিরতরে মুক্ত করে, তাকে দিয়ে গেলো নামহীন অজ্ঞাত এক প্রতিশ্রুতি “বন্ধু “।
মাহিন চলে গেলে ভারী এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এরীশের ভাবনায় ডুব দিলো ঈশানী, মনেমনে ভাবতে লাগলো,
— কোথায় সে, কতদিন হলো দেখা নেই।আচ্ছা মানুষটা এমন কেন? যখন থাকেনা তখন পুরো দুনিয়া জুড়ে নির্জীব তার অস্তিত্ব। আর যখন ফিরে আসে তখন নিজের অস্তিত্বের জানান দিতে প্রলয় বাঁধিয়ে বিনাশ করে ছাড়ে সর্বত্র।
ফ্লোরা, তুষার, মাহিন, ঈশানী সবার হৃদ মাঝারে আলাদা আলাদা করে একই সুরে বেজে উঠেছিল চোরাবালির দু’টো লাইন ,
কেন লাগে শূন্য শূন্য বড়,
তোমায় ছাড়া এতো,
তুমি কি তা বলতে পারো…..