আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩৭

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩৭
suraiya rafa

কক্সবাজার, বাংলাদেশ।
চকচকে কালো ক্রিস্ট্যাল দ্বারা তৈরীকৃত সুবিস্তৃত
ব্ল্যাকহোলের প্রতিটি কোণে কোণে ভর করেছে নৈঃশব্দ্য। গোলোক ধাঁধার মতো কালো রিসোর্টটির বাহ্যিক দেওয়াল গুলো বেষ্টন করে দাঁড়িয়ে রয়েছে demon Knight নামধারী একদল বিশেষ ধরনের রাশিয়ান সুরক্ষাকর্মী। মাফিয়া বসের সর্বোচ্চ সুরক্ষায় আপামর তৎপর তারা। প্রতিটি মানবের দানবীয় শরীরজুড়ে বীভৎস রঙ বেরঙের ট্যাটুর আস্তরণ , শরীর আবৃত কালো পোশাকের আস্তিনে চিকচিক করছে স্বর্ণাভ সিলমোহর, যার উপর ইংরেজি গুটি গুটি অক্ষরে লেখা,demon Knight। মূলত মাফিয়া সাম্রাজ্যের প্রতিকূল সময়ে দ্বায়িত্বে নিয়োজিত করা হয় এই বিশেষ ধরণের গার্ড’সদের। তারা এতোটাই শক্তিশালি এবং সুদক্ষ যে অক্ষিপুটের প্রতিটি পলকে নিজেদের অবস্থান এবং অভিব্যক্তি একযোগে বদলাতে সক্ষম। দৃষ্টি অম্বর এতোটাই সুক্ষ্ম যে , এক দর্শণে শত্রুর অভ্যন্তরে উদ্ভাসিত পদক্ষেপ গুলো জাদুকরী ইন্দ্রজালের ন্যায় গ্রাস করে ফেলে অকপটে।

সূর্যালোক মিয়িয়ে এসেছে, চকচকে লালাভ দ্যুতি এখন ক্ষয়িষ্ণু আঁধারের হাত ধরেছে, যেন যেতে হবে দূর বহুদূর। ব্ল্যাক হোলের সামনে বিস্তৃত জলরাশির তরঙ্গোচ্ছ্বাস। উথাল পাথাল ঢেউয়ে নাজেহাল তটদেশ। প্রকৃতি জুড়ে সন্ধ্যা নামায় উত্তাল সমুদ্রের ভয়াল গর্জনের সাথে সাথে নীল অন্তরিক্ষ থেকে উড়ে উড়ে ফিরছে শঙ্খচিলের ঝাঁক। এরই মাঝে এক ফেরারি পাখি গতিপথ হারিয়ে অকস্মাৎ প্রবেশ করে ব্ল্যাকহোলের দিগন্ত সীমায়, তার ছোট্ট চঞ্চু থেকে নির্গত কিচিরমিচির ডাক এক মূহুর্তে কর্ণ সচল করে তোলে demon Knight দের। সচকিত হয়ে ওঠে তারা,ভাবতে সময় নষ্ট করেনা এক ন্যানো সেকেন্ডও তার আগেই স্নাইপার তাক করে সুবিস্তীর্ণ দিগন্ত পানে, যেই পথ ধরে মুক্ত বিহঙ্গটি উড়ে যাচ্ছিল ঠিক সেই বরাবর। অতঃপর গগন কাঁপিয়ে নিক্ষিপ্ত হয় ধাতব বুলেট, চোখের সামনে ধরাশায়ী হয়ে বাতাসের বেগে জমিনে মুখ থুবড়ে পরে নিস্পাপ শঙ্খচিলের নিথর দেহবাশেষ। যেন মাফিয়া টেরিটোরির সুবিস্তীর্ণ ওই দিগন্তটাই তার জীবনের তরে কাল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তবে এইমূহুর্তে ব্ল্যাকহোলের বাইরের দৃশ্যপট যতটা থমথমে আর কলুষিত। অভ্যন্তরের রূপরেখা তার চাইতে বহুগুণ বিভীষিকাময়। কারণ প্যারাডাইস মাস্টারমাইন্ড তুষার ফিরে এসেছে। গত কিছুদিন যাবত বেশ কয়েকবার আক্রমণ হয়েছে এরীশের উপর। এরীশের উপর বললে ভুল হবে, যতবারই মাফিয়া বস তার সাকুরার সান্নিধ্যে গিয়েছে ততবারই কোনো না কোনো অতর্কিত হামলায় পন্ড হয়েছে তাদের সুন্দর সাবলীল মূহুর্ত গুলো। যেন কেউ বারবার চোখে আঙুল দিয়ে এরীশকে জানান দিচ্ছে,
— এই অধ্যায় তোমার জন্য নয়,পবিত্রের সংস্পর্শে অচিরেই ধ্বংস হবে তুমি, অসাবধানতায় আটকে যাবে আগন্তুকের ইন্দ্রজালে।
এরীশ পিছপা হতে জানেনা, হেরে যাওয়া তার অস্তিত্বে নেই, বরং গর্ত থেকে গোখরা বের করে সেই গোখরার সর্পিল বিষ দাঁত ভাঙার পৈশাচিক উল্লাসে আত্মতৃপ্তির অভিলাষ ঘটায় ব্লাডিবিস্ট রীশস্কা ।
সেদিন ক্যাফেতে হওয়া অতর্কিত হামলায় বিপত্তি ঘটেছিল অপার্থিব এক প্রেমানুভূতির। সাকুরার প্রতিটি ক্রন্দিত বাক্য,ইস্পাত কঠিন সৌষ্ঠব বক্ষের সংস্পর্শে গলানো মোমের ন্যায় আষ্টেপৃষ্টে লেপ্টে থাকা বর্ষণ সিক্ত তুলতুলে কোমল নারী দেহের প্রতিটি সুক্ষ্ম ভাঁজ, বাঁকানো ধনুকের ন্যায় শারীরিক উপত্যকা, ভ্যানিলার মিশেলে মেয়েলি এক সুঘ্রাণ সবকিছু এখনো অন্তঃগহীনে কাঁপন ধরায় মাফিয়া বসের। এতো বিপত্তি, এতো বিঘ্নতার মাঝেও কয়েক সেকেন্ডের সেই নিগূঢ় স্পর্শ যেন ঝড় বয়িয়ে দেয় সমগ্র কলুষিত অস্তিত্বে।যে দূর্বার অনুভূতির সমারোহ অগ্রাহ্য করার শক্তি স্বয়ং মাফিয়া বসের নেই।

ব্ল্যাক হোলের বাইরের দিকের গোলোক ধাঁধা যেন ভেতরের তুলনায় নিতান্তই সামান্য, ক্রিস্ট্যাল খচিত কুচকুচে কালো দূর্গের অভ্যন্তরে রয়েছে সুবিশাল আন্ডারগ্রাউন্ড। ভূর্গভস্ত্য সেই আন্ডারগ্রাউন্ডের ছোট্ট এক সেলের ভেতর থেকে ক্ষণে ক্ষণে বেরিয়ে আসছে গগন কাঁপানো ভয়াবহ আর্তনাদ। দূর্ভাগ্য বশত ইন্দ্রজালের ন্যায় বিস্তৃত এই আন্ডারগ্রাউন্ড ভেদ করে সেই আর্তনাদ ফার্স্ট ফ্লোর অবধি পৌঁছেছে কিনা সে হদিস অনুমান করা দুঃসাধ্য। অবশ্য অনুমান করার মতো কোনোরূপ তৎপরতাও নেই রোবটের ন্যায় নির্জীব গার্ড গুলোর মাঝে। জীর্ণশীর্ণ সেল, চারিদিকে তমশার ঘনঘটা, পুরো সেলটাকে ঘীরে রেখেছে একাধিক সশস্ত্র মাফিয়া গার্ড’স। মাথার উপর টিমটিমে রক্তিম আলোর দ্যুতি ছড়াচ্ছে বৈদ্যুতিক একটা কাচের বাল্ব। তার ঠিক নিচে কাঠের একটা চেয়ারের সঙ্গে আড়াআড়িভাবে বেঁধে রাখা হয়েছে জলদস্যু দলের প্রধান রিচার্ডকে।

পায়ের নখ থেকে শুরু করে মাথার চুল অবধি সমগ্র শরীর র’ক্তাক্ত তার। অবচেতনায় টলছে মস্তক। ছি’ন্নভিন্ন মাংস পিণ্ডল, এবড়োখেবড়ো ক্ষয়িষ্ণু ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে অতর্কিতে গড়িয়ে পরছে লালা মিশ্রিত উৎকট র’ক্ত প্রবাহ। যেন হিং’স্র এক জানোয়ারের কবলে ধরাশায়ী সে। বলবান স্থুলকায় শরীরটা লুটিয়ে পড়েছে সম্মুখে, তবুও তীব্র আগ্রাসনে ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তুষার,প্রচণ্ড ক্রোধে মস্তিষ্ক ফেটে পরছে তার। চিরাচরিত স্থির থমথমে চোখ দু’টোতে ভর করেছে পরাশক্তির ন্যায় দানবীয়তা, হাতের মুষ্টিটা ধীর গতিতে শক্ত করতে করতে দাঁতে দাঁত পিষলো তুষার, বীভৎস এক হুংকার ছেড়ে বললো,
— মানুষের মস্তিষ্ক পড়ার ক্ষমতা রাখে তুষার, যতবার মিথ্যা বলবি ততবার ধরে ফেলবো। উহুম মা’রবো না, বাঁচিয়ে রেখে নৃ’শং’সতার অনলে জীবন্ত জ্বালাবো তোকে।
শারীরিক যন্ত্রনায় অবচেতন হওয়ার উপক্রম, মুখের আকৃতি পাল্টে গিয়েছে ইতিমধ্যে, তবুও মৃদু অস্ফুট আওয়াজ বের হলো ঠোঁটের ফাঁক থেকে,

— আমি কেবল মাত্র ব্লাড ডায়মন্ড চাই অন্যকিছু নয়।
পুরুষালি সুডৌল নাসারন্ধ্র তরতর করে ফুলে উঠলো মূহুর্তেই, তামাটে বর্ণের ধারালো চোয়াল খানা শক্ত হলো ক্রোধে,বিক্ষিপ্ত নয়ন জোড়া রিচার্ডের আধোও আধোও চোখের মাঝে তাক করলো তুষার। যেন লক্ষ্য স্থীরকৃত সুক্ষ্ম এক মা’রণাস্ত্র, প্রগাঢ় চাহনি স্থির রেখেই ছুড়লো কঠোর বাক্য,
— আমি শেষ বারের মতো জিজ্ঞেস করছি তোর গড ফাদার কে? কি উদ্দেশ্য তার?
— আমিই আমার গড ফাদার, উদ্দেশ্য ব্লাড ডায়মন্ড।
কণ্ঠনালি ভেদ করে বাক্যটা বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ওর চোয়াল আর কণ্ঠনালির মাঝ বরাবর শক্ত হাতের আপার কাট বসিয়ে দিলো তুষার। মূহুর্তেই চোয়াল ভেঙে উঠে গেলো নাসাগ্রভাগে , ফের কয়েক সেকেন্ডের মাথায় জায়গা মত ফিরে এসে, ঝরঝর করে ভেঙে গেলো সামনের কয়েককপাটি দাঁত। অনিয়ন্ত্রিত র’ক্ত প্রবাহে সিক্ত হয়ে উঠলো লোকটার সমগ্র মুখমণ্ডল। অসম্ভব ক্রোধের তাড়নায় কাঁপছে তুষার, মুখগহ্বরে অবস্থিত মিন্ট ফ্লেভারের চুইঙ্গামটা ঠোঁটের সাহায্যে ছুড়ে ফেলে আবারও নতুন উদ্যমে আপার কাট দেওয়ার প্রস্তুতি নিলে পেছন থেকে ওকে কর্কষ স্বরে বাঁধ সাধলো কেউ,
— ডোন্ট ডু দিস।

পরিচিত ভরাট কণ্ঠস্বর কর্ণগহ্বর ছুঁতেই থমকালো তুষার। রাগান্বিত সত্তাটাকে খানিক পরাস্ত করে নির্দ্বিধায় পেছনে দৃষ্টিপাত করে সে। রক্তিম বাল্বের টিমটিমে আলেতে দেখতে পায়, কালো ফর্মাল শার্টের উপর মসৃণ ভেলভেট ওয়েস্ট কোট পরিহিত এক বলিষ্ঠ লম্বা অবয়ব। মুখের আদল ঝাপসা হলেও ব্লাডিমনস্টারকে চিনতে অসুবিধা হয়না তুষারের, অগত্যা কুর্নিশ জানিয়ে হ্যা সূচক মাথা নাড়ায় সে।
নিভৃত কদমে সম্মুখে অগ্রসর হয় মাফিয়া বস। এগিয়ে এসে শূন্য অভিব্যক্তিতে মূমুর্ষ লোকটার মুখোমুখি হয়ে বসলো সে। বাম পাশের উরুর উপর ডান পাশের উরুটা আড়াআড়িভাবে স্থাপন করে সঠান করলো পৃষ্ঠদেশ। হাতে রাখা হুইস্কির গ্লাসটা পাশে ছুড়ে ফেলতেই ঘর কাঁপিয়ে আওয়াজ হলো ঝনঝনিয়ে। সামান্য আওয়াজে শরীর জুড়ে খেলে গেলো হিমবাহ। আতঙ্কে র’ক্ত সরে গিয়ে ফ্যাঁকাসে হয়ে উঠলো জলদস্যু লিডার রিচার্ডের মুখমণ্ডল। অজান্তেই শুষ্ক একটা ঢোক গিললো সে। তৎক্ষনাৎ কণ্ঠনালিতে অনুভব হলো র’ক্তের বীভৎস নোনতা স্বাদ। কিঞ্চিৎ চোখ উঁচিয়ে ঝাপসা নয়নে দৃষ্টিপাত করলো নির্জীব অভিব্যক্তিহীন মরিচীকার পানে। অশুভ এক শূন্য দৃষ্টির মুখোমুখি হতেই ধড়ফড়িয়ে ওঠে তার সমগ্র অস্তিত্ব , এদিক ওদিক মাথা নাঁড়িয়ে ভয়ার্ত স্বরে বলতে শুরু করে,

— আমি কিছু জানি, আমি সত্যিই কিছু জানিনা।
মাফিয়া বস বিন্দু পরিমাণ কর্ণপাত করেনা সেসবে, উল্টো উদভ্রান্ত তুষারের পানে দৃষ্টিপাত করে ঠান্ডা গভীর গলায় বলে,
— কি হয়েছে তোমার আজ? একটু বেশিই ডিস্টার্ব মনে হচ্ছে?
রেগেমেগে তুষার কিছু একটা প্রত্যুত্তর করবে তার আগেই ফের গ্রীবা ঘোরালো এরীশ, রিচার্ডের র’ক্তাক্ত মুখটা গভীর দৃষ্টে পরখ করে ঠান্ডা আওয়াজে বলে ওঠে,
— ড্যাগারের হাতল দিয়ে মুখ ভেঙে দাওনি কেন? এখনো কথার বলার শক্তি কোথায় পায় ও?
মাফিয়া বসের এহেন শীতল ধারালো আওয়াজে বিস্ফোরিত হলো তুষারের দু’নয়ন। জুতসই প্রত্যুত্তর করার জন্যও তাকে ভাবতে হলো কিয়ৎক্ষন, ঠিক সেই মূহুর্তে কঠোর আওয়াজে আরেকদফা বি’স্ফোরণ ঘটালো মাফিয়া বস, হাতের রিভলবারের নলের সাহায্যে তুললে ধরলো লোকটা ভঙ্গুর চিবুক খানা, হাঁপরের ন্যায় ওঠানামা করা শ্বাসপ্রশ্বাসে কিঞ্চিৎ ব্যাঘাত ঘটলো বোধ হয়। যার দরুন বেরিয়ে এলো চোখের কোটর। সেদিকে স্থির দৃষ্টিপাত করে এরীশ বললো,
— র’ক্তপাত ঘটিয়ে অযথা নিজের এনার্জি নষ্ট করার মানে হয়না। আমি আপাতত এসবের মুডে নেই, চলো একটা গেইম খেলা যাক।

মাফিয়া বসের প্রতিটি পদক্ষেপের উপর আস্থা রয়েছে তুষারের, ফলস্বরূপ আশ্চর্য হলো সে। এখনো যন্ত্রের ন্যায় স্থির তার মুখাবয়ব। ওদিকে এরীশের বাক্যকে হেয়ালি মনে হলো রিচার্ডের নিকট, সে কপাল গোছালো খানিক, অস্পষ্ট আওয়াজে বললো,
— গেইম! কিসের গেইম?
ঠোঁটের আগায় খেলে গেলো ক্রূরতা,নেত্রদ্বয়ে উদ্ভাসিত পৈশাচিকতা ধরে রেখেই আত্মা কাঁপানো শীতল আওয়াজে জবাব দিলো মাফিয়া বস,
— মাই মোস্ট ফ্যাবারিট গেইম, রাশিয়ান রুলেট। নাম শুনেছো নিশ্চয়ই?
এ যেন শুধু নামে নয়, বস্তুত হৃদয়হীন এক পৈশাচিক এক আত্মা,দ্যা ব্লাডি মনস্টার। নয়তো এমন একটা নৃ’শংস গেইম কি করে কারও পছন্দের হতে পারে? অন্তরাত্মা একযোগে প্রকম্পিত হলো রিচার্ডের। মাত্রাতিরিক্ত শঙ্কায় সে ধড়ফড়িয়ে উঠে বললো,

— নাহ! এটা গেইম নয়, এটা একটা ম’রণফাঁদ।
— একজ্যাক্টলি। আজকের গেইমটা রাশিয়ান রুলেট থেকে একটু ভিন্ন, কারণ আজকের খেলায় তোমার কোনো প্রতিদ্বন্ধি নেই। তুমি একাই খেলবে, এবং তুমি একাই হারবে।
এরীশের কথায় উত্তেজনার মাত্রা দিগুণ হলো রিচার্ডের,সে তার স্থুলকায় মুমূর্ষু শরীরটাকে বাঁধনহারা করার চেষ্টায় নড়েচড়ে উঠলো ফের। প্রচণ্ড ব্যথায় গোঙাতে গোঙাতে বললো,
— মা’রলে এক্ষুনি মে’রে ফেলুন, শুধু শুধু এতো নাটকীয়তা কেন?
— এইটুকু সাহস নিয়ে ব্লাড ডায়মন্ডের স্বপ্ন দেখছো? দিস ইজ ইনসেইন! তোমাকে যে পাঠিয়েছে তার আরেকটু ঘিলুর প্রয়োজন। আই থিংক আন্ডারওয়ার্ল্ডের কোনো এক দূধের বাচ্চা সে, ধূর্ততা থাকলেও অভিজ্ঞতাটা ঠিকঠাক নেই, দ্যাট’স হোয়াই পদে পদে ভুল হয়ে যাচ্ছে।

কটাক্ষের স্বরে বাক্য কটা শেষ করে তীরের ফলার মতো এক ভ্রু উঁচালো এরীশ, রিচার্ড হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
— আগেও বলেছি এখনো বলছি, আমাকে কেউ পাঠায়নি আমি ব্লাড ডায়মন্ডের সন্ধ্যানেই এখানে এসেছি।
ওর প্রত্যুত্তর শুনে সিংহের মতো গর্জে উঠলো তুষার, চোয়ালটাকে শক্ত করে ফেললো এক নিমেষে, টেবিলের উপর সশব্দে দুহাত ভর করে ক্ষুদ্ধস্বরে জবাব দিলো সে,
— রাশিয়ান মাফিয়া টেরিটোরির অভ্যন্তরিণ বিষয় অন্য গ্যাঙস্টারদের সঙ্গে বিশ্লেষণ করা bratva এর নিয়ম বহির্ভূত বাস্টার্ড। আর সেখানে এ্যামাজনের তুচ্ছ এক পায়ারেটস হয়ে ব্লাড ডায়মন্ডের হদিস পেয়ে গেলি? পাইথন প্যারাডাইসকে এতো নির্বোধ মনে হয় তোর?
— ব্লাড ডায়মন্ডের উৎস কিন্তু এ্যামাজনই ছিল। সেখান থেকেই কেউ বা কারা সংগ্রহ করেছিল পাথরটি। তাছাড়া পাইথন লিডার কি আদৌও নিয়ক কানুনের তোয়াক্কা করে?

— তুমি অনেক কিছু জানো, আই এপ্রেশিয়েট। এপ্রেশিয়েট ফর ইওর মাস্টার। যে তোমাকে এসব বাঘা বাঘা ইনফরমেশন দিয়েছে, বাট আ’ম নট ইন দ্যা মুড ফর অল দিস বুলশিট। চলো রাশিয়ান রুলেট খেলা যাক।
প্রারম্ভে আঁতকে উঠলো রিচার্ড, কথা ঘোরানোর বেশ কসরত করেও লক্ষ্যচুত করা গেলো না ঈগলের ন্যায় শিকারী মাফিয়া বসকে। সহসা রিভলবার হাতে তুলে নিলো এরীশ,বুলেট চেম্বারে শুধু মাত্র একটা বুলেট প্রতিস্থাপন করে বাকি পাঁচটা স্লট ফাঁকা রেখে দিলো সে, অতঃপর জোর হস্তে ঘোরালো চেম্বারটিকে, যাতে কোন স্লটে বুলেট প্রতিস্থাপিত হয়েছে সেটি অজ্ঞাত থেকে যায়। রিভলবারটি পুরোপুরি গোলকধাঁধা বানানো সম্পন্ন হলে, রিচার্ডের নিকট সেদিকে বাড়িয়ে দিলো মাফিয়া বস, কণ্ঠে গাম্ভীর্যতা টেনে বললো,
— নাও স্টার্ট ইওর টার্ন, আমি ছয়টা প্রশ্ন করবো, প্রতিটি উত্তরে নিজেকে শ্যুট করবে তুমি। যদি তোমার উত্তর সন্তোষজনক মনে হয় তবে গেইম টি এখানে পজ। আর যদি পাইথন লিডারের সঙ্গে বিট্রে করার নূন্যতম চেষ্টাও করো, তবে স্লটে উপস্থিত একমাত্র বুলেটটা নিজের মাথায় নিজেই প্রবেশ করাবে তুমি। বুলেটের তীব্র কষাঘাতে নিজেই ছিন্নভিন্ন করবে নিজের বিশ্বাসঘাতক মস্তিষ্কটাকে।

পরিত্রানের উপায় নেই, মৃ’ত্যু অবধারিত জেনেও এই নৃ’শংস খেলায় নিজেকে লিপ্ত করলো রিচার্ড, রিভলবারের সরু নলটাকে মাথার পাশে তাক করে অনবরত ছুড়তে লাগলো ফাঁকা গু’লি। একবার দু’বার করে তিন বারই ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেলো সে। চার নম্বর ট্রিগার টানার সময় রাশভারি আওয়াজে প্রশ্ন ছুড়লো এরীশ ,
— হু ইজ ইওর গড ফাদার?
— নো ওয়ান, আমিই আমার গড ফাদার।
— শ্যুট ইওর সেল্ফ।
পাইথন লিডারের আত্না কাঁপানো বি’স্ফোরিত আদেশ। উপায়হীন রিচার্ড তাই করলো, পরপর দু’টি ফাঁকা গুলি বের হলো এবার ও। ভাগ্যের জোরে আরও কয়েক সেকেন্ড বেঁচে রইলো সে। কিন্তু এরপর? শেষ স্লটে তো ঠিকই বুলেট রয়েছে, এবং এটা সবার জানা। রিচার্ড নিজেও জানে ওর মৃ’ত্যু আসন্ন। মুখাবয়বে নিগূঢ় শূন্যতা ধরে রেখে এপাশ ওপাশ ঘাড় ফোটালো এরীশ ,পরপরই ছুড়ঁলো প্রশ্নের বহর,
— পৃথিবীতে ঠিক কি ধরনের দূর্বলতা রয়েছে তোমার? আর সেই দূর্বলতার উৎস কি?
এমন একটা তাৎপর্য পূর্ন সময়ে এরীশের এহেন উদাসীন প্রশ্নে কপাল বেঁকে গেলো তুষারের, বিরস মুখে উদ্ভব ঘটলো ব্যতিগ্রস্ততার, মনেমনে ভাবলো,

— কি বলছে এরীশ এসব? এখানে দূর্বলতা আসলো কোথা থেকে?
কিয়ৎক্ষন অতিবাহিত হলো নিগূঢ় নৈঃশব্দ্যে,বীভৎস অধর যুগল ঠকঠক করে কাপছে লোকটার, ক্ষ’তবি’ক্ষত মুখমণ্ডলে বিন্দু বিন্দু ঘামের অস্তিত্ব, জীবনের শেষ মূহুর্তের চরম স্বীকারোক্তি দানের ন্যায় এতোক্ষণে মুখ খুললো সে, নদীর স্রোতের ন্যায় শান্ত স্বরে জবাব দিলো,
— আমার দূর্বলতা একটাই আমার গার্লফ্রেন্ড রিয়ানা। যাকে আমি সবকিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসি, বেশি প্যাম্বার করি। তাকে ভালোবেসে নিজের জীবন আ’ত্মাহুতি দেওয়া আমার জন্য গর্বের। জানিনা এরপর কি হবে, আমার এই মৃ’ত্যুর খবর আদৌও তার নিকট পৌঁছাবে কিনা, তবে যদি কখনো সে জানতে পারে আমার এই বিশেষ আ’ত্মাহুতির কাহিনী, তাহলে নিশ্চয়ই সে আমাকে কাপুরুষের তালিকায় রাখবে না।এটা আমার বিশ্বাস।

রিচার্ডের শেষ স্বীকারোক্তিতে কয়েক মূহুর্তের জন্য থমকালো মাফিয়া বস, অন্য সময় হলে বোধ হয় এসব ভালোবাসা, দূর্বলতার কথা শুনলে পৈশাচিক হাসি বেড়িয়ে আসতো বুক ফেটে। করুনার স্বরে বিদ্রুপ করে উঠতো সমগ্র নিষিদ্ধ সত্তা। রূঢ় বাক্যের ঘাতপ্রতিঘাতে ধরাশায়ী করে ফেলতো বিপরীত পক্ষকে। কিন্তু আজ এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে তেমন কিছুই ঘটলো না,উল্টো রিচার্ডের মুখ থেকে তার ভালোবাসা রিয়ানার সম্মন্ধে শোনা মাত্রই মানস্পটে ভেসে উঠলো নাজুক নীলাম্বরীর তুলতুলে কোমল মুখশ্রী খানা। ভীষণ যাতনায় বুদ হয়ে এলো পাথর কঠিন হৃদযন্ত্র। অনুভূতির প্রকোপে অস্তিত জুড়ে জীবন্ত হলো সেই নিগূঢ় আলিঙ্গন,একটা তুলতুলে নমনীয় শরীরের প্রতিটি ভাঁজের সুস্পষ্টতা। সবকিছু ভুলে যেতে পারে এরীশ, কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের সেই সুমিষ্ট শারীরিক আলিঙ্গন টুকু এ জীবনে ভুলে যাওয়া অসম্ভব।
নিস্তব্ধতা গ্রাস করলো চারিপাশ, রিচার্ড তার রিয়ানাকে ভাবতে ভাবতেই শেষ গু’লিটা চালানোর প্রয়াসে রিভলবার তাক করলো নিজের মাথায়, জীবনের অন্তিম মূহুর্তে দাঁড়িয়ে নিজের ভালোবাসার কথা ভেবে চোখ থেকে বিসর্জন দিলো একফোঁটা বিষাদ মাখা অশ্রুজল। অতঃপর যখন ট্রিগার টানবে, তার আগেই অন্য একটা রিভিলবারের সাহায্যে ওর কপাল বরাবর শ্যুট করে দিলো মাফিয়া বস।

অকস্মাৎ এই কাণ্ডে সচকিত হয়ে উঠলো সকলে, রিচার্ডের নিথর দেহটা গতিহীন হয়ে লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে। বারুদের ঝাঁঝালো গন্ধে শ্বাসরুদ্ধ চারিপাশ, টকটকে তাজা র’ক্তের স্রোত যেন নয়া বিভীষিকার আস্ফালন। ভাবাবেগ শূন্য নির্বাক মাফিয়া বস। পায়ের কাছে মুখ থুবরে পরে আছে ম’রদেহ টা। পেনটহাউজে থাকলে এতোক্ষণে বোজোর সুস্বাদু নৈশভোজে রূপান্তিত হতো রিচার্ডের নির্জীব শরীরটা। ওদিকে ব্লাডিবিস্টের অভিব্যক্তিহীন ধারালো মুখাবয়ব পরখ করে বাক্য ছুড়লো তুষার ,

— আই থিংক দ্যা লাস্ট টাইম হি ডিড’ন্ট লাই এ্যট অল।
— আই নো।
ধীরে ধীরে রিভলবার নমিত করতে করতে ছোট্ট স্বরে প্রত্যুত্তর করে এরীশ।
— তাহলে গেইমের রুলস কেন ভাঙলেন?আর ওকে শ্যুটই বা কেন করলেন?
— কারণ আমি সেকেন্ড চান্স দিইনা।
অশুভ চিত্তের দায়সারা প্রত্যুত্তর। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো তুষার, কৌতুহলে মস্তিষ্ক ফেটে যাচ্ছে ওর, অগত্যা আরও একবার পিছু ডাকলো মাফিয়া বসকে।দৃঢ় আওয়াজে জানতে চাইলো,

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩৬

— আপনি হঠাৎ সবকিছু রেখে দূর্বলতার কথাই কেন জানতে চাইলেন এরীশ?
— কারণ ওর দূর্বলতাই ওর ধ্বং’সের কারণ। আর আমাদের উত্তরটাও সেখানেই লুকোনো। হু ইজ দ্যা গড ফাদার!
গমগমে আওয়াজে কথাটা বলে লম্বা পা ফেলে হনহনিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড সেল পরিত্যাগ করে এরীশ। যেন দিশাহীন এক উৎপীড়নে বড্ড বেশি ব্যতিগ্রস্ত তার অস্তিত্ব ।

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩৮