আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৫

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৫
suraiya rafa

সবুজ অভয়ারণ্যে ঘেরা আকাশ চুম্বি পাহাড় গুলো যেন একটির সঙ্গে অন্যটি গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দিনের পর দিন স্ব-উদ্যেগে রক্ষা করে যাচ্ছে এই পর্যটনের প্রানকেন্দ্র খাগড়াছড়িকে। তার উপর আবার যোগ হয়েছে মনসুন ওয়েদার, বর্ষাকালে বরাবরই প্রান ফিরে পায় প্রকৃতি, নতুন রূপে সজ্জিত হয় পার্বত্য এই অঞ্চল। সেই ভোর রাত থেকে শুরু হওয়া ঝিরিঝিরি বৃষ্টি এখনো বহমান, খানিক বাদে বাদে মেঘ ভেজা দমকা বাতাসে শরীরের লোমকূপ দাঁড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম, ঠান্ডাও লাগছে বেশ, পাহাড়ি জনপদ ঢাকা পরেছে কুয়াশার আস্তরে। আবহাওয়াটা এমদমই অনুকূলে নয়, তবে সদ্য যৌবনে পা রাখা একঝাঁক তরুণ তরুণীর নিকট এর চেয়ে থ্রিলিং আর এডভেঞ্চারাস বোধ হয় আর কিছু নেই, ওদের শরীরের জাগ্রত হরমোন আর উত্তপ্ত টগবগে রক্ত যেন একটাই কথাই বলে বারংবার,
“জীবন তো একটাই,বাঁচতে হলে প্রান খুলে বাঁচো। যেই ভাবে বাঁচলে এক জীবনে আর কোনো আপসোস থাকবে না।”

এরকম ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর প্রতিকূল আবহাওয়ার মাঝেই ঈশানীরা রিসোর্টে এসে উঠেছে, যেহেতু ওরা সকলে একরাত অতিবাহিত করবে এখানে , তাই সবার জন্য আলাদা আলাদা রুম বুক করা হয়েছে।
সকাল সকাল খাগড়াছড়ি পৌঁছে সবাই মিলে এখানকার স্থানীয় স্বাদের খাবার দিয়ে নাস্তা সেরে নিয়ে, গিটারের টুংটাং আওয়াজ তুলে গান ধরেছে একই সুরে,
শ্রাবনের মেঘগুলো জরো হলো আকাশে,
অঝোরে নামবে বুঝি শ্রাবনেই ঝরায়,
আজ কেন মন… উদাসী হয়ে,
দূর অজানায়… চায় হারাতে”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ঈশানীর ভালো লাগছিল না ওদের এসব হইচই, তাই ও একটু নিরিবিলি সময় পার করার উদ্দেশ্যে নিজের আর মৃণার জন্য বরাদ্দকৃত হোটেল রুমের বারান্দায় এসে দাড়ালো। রুমের টানা বারান্দা গুলো সব পাশাপাশি, একটা থেকে আরেকটার দূরত্ব কয়েক সেন্টিমিটার মাত্র, তারউপর ছাঁদ খোলা, কোনোরূপ প্রাইভেসী নেই বললেই চলে। কতৃপক্ষের এ কেমন সিদ্ধান্ত বুঝে উঠতে পারলো না ঈশানী, অগত্যা ঠোঁট উল্টে এদিক ওদিক চোখ ঘোরালো শুধু।
ঠিক এমন সময়, ওর পাশের টানা বারান্দায় এসে হাজির হলে জিসান, ঈশানী তখন ও আলগোছে হাত বাড়িয়ে রেখেছিল ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে। জিসান ওকে দেখতে পেয়ে একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলো,
— কি মিস সাহসী, রেডি তো? সবার খাওয়া শেষ হলেই হাইকিং এ বের হবো আমরা।
জিসানের কথায় প্রত্যুত্তর করলো না ঈশানী, কারণ তখন বাসে মৃণার মুখ থেকে নিজের আর জিসানের ভুল সম্পর্কের সমীকরণ শোনার পর থেকেই জিসানের উপর মেজাজটা চড়াও হয়ে আছে ওর।
ঈশানী চুপচাপ নির্লিপ্ত মুখে সামনে তাকিয়ে আছে দেখে জিসান পুনরায় বলে ওঠে,

— ভয় পাচ্ছিস কেন? আরেহ,আমি তো আছি তোকে প্রটেক্ট করার জন্য।
এবার আর চুপ থাকতে পারলো না ঈশানী, এতোক্ষণ ধরে ভেতরে পুষিয়ে রাখা রাগটা হুট করেই উগড়ে বেড়িয়ে এলো মুখ থেকে,তৎক্ষনাৎ জিসানের দিকে ঝাঁঝালো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, ঈশানী বলে উঠলো,
— কতবার বলেছি তোকে জিসান? নিজের খেয়াল নিজে রাখতে পারি আমি, আর নাতো আমি একটা ছোট বাচ্চা, আমাকে বোকা আর সরল ভাবাটা এবার বন্ধ কর। আজকের ট্রিপে তুই যদি সবার সামনে আমাকে এক্সট্রা কেয়ার দেখানোর ট্রাই করিস, কিংবা আমার আশেপাশে ও আসিস, তাহলে তোর আর আমার বন্ধুত্ব এখানেই খতম ।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে, গটগটিয়ে বারান্দা ছেড়ে রুমের ভেতরে চলে গেলো ঈশানী, ওদিকে ঈশানী চলে যেতেই জিসান একা একাই বিড়বিড় করে উঠলো,
— যাহ বাবাহ,কি করলাম আমি? আমার সাথে একটু বেশিই রাগ দেখাস তুই ঈশা, ইট’স নট ফেয়ার।

অবশেষে সকলের মতামতের উপর ভিত্তি করে, লোকালয় থেকে অনেকটা দূরে, যেখানে গিয়ে মেঘ আরা পর্বতমালা একত্রে মিলিত হয়েছে, যেখান থেকে প্রকৃতির নিয়মে মেঘের কোল ঘেঁষে তুফানের গতিতে ঝরঝরিয়ে রিছাং ঝর্ণা নেমে আসে, ঠিক তার উল্টো দিকের একটা নাম না জানা নির্জন পাহাড়ে হাইকিং করার সিদ্ধান্ত নিলো ওরা। প্রথম দিকে মেয়েরা একটু দোনোমোনো করছিলো কারন, একে-তো কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে, তার উপর এই জায়গাটাতে সারা বছরেও দু একবার মানুষের পা পরে কিনা সন্দেহ ।

কিন্তু সঙ্গে আসা বেশিরভাগ জনই গোঁ ধরে বসেছে, তারা এই ভয়ানক রকম উঁচু আর পিচ্ছিল পাহাড়েই উঠবে, তাতে যত বেলা আর যত পেরেশানি হয় হোক, অগত্যাই যাদের দল ভারী তারাই বিজয়ী হলো।
লোকচক্ষুর একদম আড়ালে,শুনশান জঙ্গলে ঘেরা একটা পাহাড়, ফকফকে দিনের আলোতেও কেমন চারিদিক ঘুটঘুটে আঁধারে ছেয়ে আছে, অথচ সবাই কিনা হইহই করে তলপিতলপা গুছিয়ে, প্রয়োজন মতো জিনিস আর লাঠি নিয়ে সেই জঙ্গলে ঘেরা অজানা পাহাড়েই ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে। স্থানীয় পাহাড়িরা দেখতে পেলে হয়তো ওদের যাত্রাপথে কড়া করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সেখানেই থামিয়ে দিতো, কিন্তু ভাগ্য ভালো তেমন কিছুই হয়নি, বরং ধাপে ধাপে সারাদিন একটু একটু করে বেয়ে উঠতে উঠতে শেষমেশ গোধূলি বেলায় গিয়ে ওরা পৌঁছালো নাম না জানা এই জংলী পাহাড়ের এক্কেবারে চূড়ায়।

আবহাওয়া তখন ভীষণ খারাপ, সারাদিন পাহাড় বেয়ে ক্লান্ত সকলে, শরীরে একরত্তি শক্তি অবশিষ্ট নেই কারোরই, অথচ এখন আবার রাত নেমে আসার আগেই এই পাহাড় থেকে বেয়ে নামতে হবে, এটা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ওদের সবার জন্য, কারণ এই মূহুর্তে সবাই ভীষণ ক্ষুদার্থ।
পাহাড়ের চূড়ায় উঠে যে যার মতো কাঁদা মাটির উপর শরীর ছেড়ে দিয়ে বসে বসে হাঁপাচ্ছে। সবার সাথে সাথে ঈশানী ও বেশ ক্লান্ত হয়ে পরেছে, এখানে আসার আগে ঈশানীর দেওয়া কড়া হুম’কি স্বরূপ জিসান ওর ধারে কাছে আসার সাহস পায়নি আর, এখনো আসছে না, যার ফলে ঈশানীর মাঝে অস্বস্তিটাও কম লাগছে। সারাদিন এতো পরিশ্রম করে শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তীব্র ব্যথা ছড়িয়ে পড়েছে ওর,হুট করে এতো উঁচুতে ওঠায় বমিও পাচ্ছে খুব। তবুও মনটা ভীষণ ফুরফুরে হয়ে আছে, যার দরুন একা একাই বসে নিজের হাত পায়ের কাটা ছেঁড়া গুলো খুঁটিয়ে দেখছে ঈশানী, পাহাড়ের ধারালো পিচ্ছিল পাথরের আঘাতে শরীরের অনেক যায়গা কেটে গিয়েছে ওর, সেগুলো থেকে হালকা র’ক্ত ও বেড়িয়ে আসছে, কিন্তু সেই র’ক্ত চোখে পরার আগেই ঝুম বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে মুছে আড়াল হয়ে যাচ্ছে মূহুর্তেই।
ওদিকে দু’হাতের উপর ভর করে বসে শরীরটা পেছনের দিকে এলিয়ে দিয়ে,ওদের টীম লিডারের উদ্দেশ্যে জিসান বলে ওঠে,

—- ভাই সামনের পাহাড়টা দেখেছেন? ইটস হিউজ, ওটা ক্লাইম্ব করলে কেমন হয়?
টীম লিডার তাসকিন ভাই জিসানের দৃষ্টি অনুসরণ করলেন, এবং তৎক্ষনাৎ ঘোর আপত্তি জানিয়ে বলে উঠলেন,
— অসম্ভব,ওইদিকে যাওয়ার অনুমতি নেই, সরকারের কড়া নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, এমনকি ওই জঙ্গলের সামনের রাস্তা দিয়ে অবধি কোনো ধরনের গাড়ি ঘোড়া চলাচল সম্পূর্ণ নিষেধ, সবসময় সেনাবাহিনীরা কড়া পাহাড়ায় থাকে ওই রাস্তায়। আই থিংক এই পাহাড়টা ক্লাইম্ব করাও আমাদের একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছে, এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দিনের আলো থাকতে থাকতে নিচে নামতে হবে, স্থানীয় কিংবা মিলিটারিটা দেখলে সমস্যা হতে পারে, তাছাড়া আকাশের অবস্থাও ভালো নয়, যখন তখন ঝড় উঠবে, আমাদের আর বিশ্রাম না নিয়ে শীঘ্রই নিচে নামার রাস্তা খোঁজা উচিৎ।
তাসকিন ভাইয়ের গলার আওয়াজ ক্ষীণ, কথার পারদে শঙ্কা, তা উপলব্ধি করতে পেরে মৃণার বয়ফ্রেন্ড ছেলেটা বলে ওঠে,

— টুরিস্ট এরিয়া, অথচ সরকার এভাবে যেখানে সেখানে নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে? আশ্চর্য!
— সামনে যে বিশাল জঙ্গলটা দেখছো, আই থিংক এটা টুরিস্ট এরিয়া নয়।
— তাহলে?
তাসকিন ভাইয়ের রহস্য জনক কথায় একযোগে প্রশ্ন ছুড়লো সকলে।
সবার প্রশ্নের তোপে পরে, তিনি গভীর ভাবনায় পরে গেলেন, অতঃপর কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলে উঠলেন,
— ওই জঙ্গলে কি আছে সেটা আমিও জানিনা, তবে ভয়’ঙ্ক’র কিছু আছে তা নিশ্চিত, কারণ স্থানীয়রা কেউ ওই জঙ্গলে ভুলেও পা রাখেনা। এর আগে ওই জঙ্গলে কোনো সাধারণ মানুষ গিয়ে আর ফিরে আসার রেকর্ড পাওয়া যায়নি, মেয়েদের ক্ষেত্রে যদিও বা ফিরে এসেছে কখনো কখনো, তবে তার সর্বস্ব হারানোর পরে। ডু ইউ গাইস আন্ডারস্ট্যান্ড হট আই মিন?

— আপনি বলতে চাইছেন ভুত প্রেত কিংবা ভ্যাম্পায়ার টাইপ কিছু? এগুলো কি আদৌও এক্সিস্ট করে?
বৃষ্টির মাঝে হুট করেই পেছন থেকে ভেসে আসা এক রিনরিনে নারী কন্ঠ শুনতে পেয়ে পেছনে চাইলেন তাসকিন ভাই, দেখলেন গ্রুপের সবচেয়ে চুপচাপ নীল চোখের মেয়েটা তার দিকে প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে, তাসকিন ভাই কিছুক্ষণ অবাক নজরে মেয়েটাকে পরখ করে, কিঞ্চিৎ হাসি উপহার দিয়ে জানালেন,
— আই ডোন্ট নো।
যেহেতু তাসকিন ভাইয়ের কথায় সবাই মোটামুটি স্তব্ধ, তাই এই পর্যায়ে জিসান তাড়াহুড়ো করে উঠে যেতে যেতে বললো,
— তাড়াতাড়ি করো গাইস, আকাশ কালো করেছে, ঝড় আসতে চলেছে, আমাদের যতদ্রুত সম্ভব নিচে পৌঁছাতে হবে।
জিসানের কথার পাছে মৃণা অসহায় স্বরে বললো,

— সে যতই তাড়াহুড়ো করো না কেন, এই পিচ্ছিল পাহাড় বেয়ে নামতে নামতে মিনিমাম দুই তিন ঘন্টা তো লাগবেই। তারমানে আমরা ঝড়ের কবলে পরবো নিশ্চিত।
ওদের কথার মাঝে তাসকিন ভাই ও এবার শরীরের ক্লান্তি ঝরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, অতঃপর তাড়াহুড়ো করে ক্লাইম্বিং এর সরঞ্জাম গুলো হাতে তুলে নিয়ে বললেন,
—- লেটস গো গাইস, এখানে আর অপেক্ষা করাটা ঠিক হবেনা।
সবাই যখন একে একে সাবধানে সরু পাথরের স্তর গুলো বেয়ে নেমে যাচ্ছিল ঈশানী তখনও সবার পেছনে , তাই জিসান নামতে নামতেই ঈশানীকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো ,

—হাত ধরবো?
এতোক্ষণে প্রকান্ড ঝড় শুরু হয়ে গিয়েছে, যে যার সুবিধা মতো নেমে যাচ্ছে, ঈশানী সবার পেছনে, ওঠার সময় যতটা না সহজ মনে হয়েছে, নামার সময় তারচেয়ে দিগুণ ভ’য় করছে ওর,ভুল বশত নিচের দিকে চাইলেই কেমন কলিজা শুকিয়ে আসছে, এমতাবস্থায় জিসানের আচানক প্রশ্নে ঈশানী চোখ দিয়ে কিছু একটা ইশারা করে জবাব দিলো,
—- তোর পায়ের নিচের পাথরটা কাঁপছে, চেয়ে দেখ।

ঈশানীর কথা মতো জিসান চেয়ে দেখলো সত্যিই তো পাথরটা ভীষণ কাঁপছে, এক্ষুণি গড়িয়ে পরলো বলে, তাই এবার আর কোনো দিকে খেয়াল দিলোনা জিসান, বরং তাড়াহুড়ো করে সুবিধা মতো নিচে নেমে যেতে লাগলো আপন গতিতে । কিন্তু জিসানকে সাবধান করতে গিয়ে এই ঝড় তুফানের মাঝে কখন যে ঈশানী নিজেই ভুল পাথরে পা দিয়ে পিচ্ছিল খেয়ে সোজা পাহাড়ের উল্টো দিকে গড়িয়ে পরেছে সেই হদিস আর কেউ রাখেনি। পরে যাওয়ার সময় শরীরের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে চিৎকার দিয়ে উঠেছিল ঈশানী, কিন্তু প্রচন্ড জোরে বাজ পরার আওয়াজে সেই চিৎকার কারোরই কর্ণকূহর অবধি পৌছায়নি তখন, আর নাতো কেউ খেয়াল করেছে যে ওদের মাঝে একজন সদস্য উধাও, খেয়াল করবেই বা কি করে? একে তো পাহাড়ি এলাকায় সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে আসছে,তারউপর তুমুল বর্ষন,সবাই তাড়াহুড়ো করে নিচে নামায় ব্যস্ত,
অগত্যাই যে যার প্রাণ হাতে নিয়ে ঈশানীকে ছাড়াই পর্বতের চূড়া থেকে ধীরে ধীরে সমতলের দিকে নেমে গেলো সবাই। আর সেই ভীত হরিণী স্বল্পভাষী নীল চোখের মেয়েটা গড়িয়ে পড়ে গেলো একেবারে পাহাড়ের খাদে, খাগড়াছড়ির সেই নিষিদ্ধ জঙ্গলের দোরগোড়ায়।

গোধূলি বেলা পেরিয়ে সন্ধ্যা রাতের পর্দা টেনে দিয়েছে দিবালোক, ধূসর মেঘে ছেয়ে আছে বিস্তৃত আকাশ,যেন একঝাঁক বুনো মহিষের পাল। ঝড় থেমেছে বহুক্ষণ, তাও ঈষান কোনে মেঘ গুড়গুড় করছে, আষাঢ়িয়া মৌসুম তার বর্ষনের তান্ডবে এখনো ইতি টানেনি তা বেশ ভালো মতোই ঠাওর করা যাচ্ছে।
স্যাতস্যাতে নির্জন গহীন বনে পাখিদের ঘরে ফেরার ঢল, আশেপাশের কোনো এক নর্দমা থেকে ভেসে আসছে কোলা ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ আওয়াজ। ওদিকে পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজে কানের পর্দায় তালা লেগে যাওয়ার উপক্রম, এমতাবস্থায় অদূরে একটা বিকট আওয়াজে মূহুর্তের মধ্যেই সবকিছু কেমন থমকে গেলো। নীড়ে ফেরার আনন্দে বিমোহিত বন্য পাখিরা আওয়াজ বন্ধ করে ডানা ঝাপ্টে যতদূর সম্ভব ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে পালিয়ে গেলো।
শব্দটা এতোই বিকট ছিল যে পাহাড়ের এককোনে অবচেতন হয়ে পরে থাকা ঈশানীও আচমকা উত্তেজনায় চোখ খুলে ফেললো ঠাস করে । তবে চোখ খুলে সামনের দিকে আর দৃষ্টিপাত করতে পারলো না মেয়েটা, কারন ইতিমধ্যে ওর দৃষ্টি বরাবর টর্চের তীক্ষ্ণ আলো জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লম্বা মতো কেউ।

নিদারুন ব্যথায় জর্জরিত ঈশানী তীক্ষ্ণ আলোক রশ্মি থেকে চোখ দুটোকে আড়াল করার প্রয়াসে দ্রুত হাত তুলে ছায়া টানলো চোখের উপর, অতঃপর ভাবতে শুরু করলো ও আসলে কোথায়? আর সামনে ফ্ল্যাশ হাতে দাড়িয়ে থাকা ওই দীর্ঘদেহী মানবটাই বা কে?
লোকটা এখনো একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে, ঈশানী নিজের কর্দমাক্ত শরীরটাকে টেনে তুলতে তুলতে সামনের দিকে খেয়াল করতেই দেখতে পেলো,সেদিনের সেই মাস্ক পরিহিত লোকটাকে। এভাবে জঙ্গলের মধ্যে হুট করেই কাউকে দেখে চেনা সম্ভব নয়, কিন্তু ওই আকর্ষনীয় পিয়ার্সিং করানো ভ্রু আর ধূসর বাদামী চোখ দুটো একদম তীরের ফলার মতোই গেঁথে আছে ঈশানীর মানস্পটে, যার দরুন চিনতে এইটুকু অসুবিধা হয়নি ওর, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো লোকটা এখনো মাস্ক আর কালো হুডি পরে আছে।

এই গহীন অভয়ারন্যে ঈশানী যখন অপরিচিত অথচ চেনা চোখ দুটো দেখতে পেলো তখন মনে মনে কিছুটা আস্বস্ত হলেও আ’তঙ্ক মুক্ত হতে পারলো না, কারণ ইতিমধ্যে লোকটা ওর মুখোমুখি হয়ে বসেছে। লোকটা হুট করে এভাবে কাছাকাছি আসতেই অজানা ভয়ে মুখ থেকে র’ক্ত সরে গেলো ঈশানীর।
ওর মনে আছে বিকেলে তাসকিন ভাই বলেছিল জঙ্গলটা বেশি ভালো নয়, এখানে মেয়েরা একবার পা রাখলে তাদের সর্বস্ব খুয়িয়ে তবেই ফিরে যেতে হয়, কেউ কেউ তো আর ফেরেই না। আর এখন এই মূহুর্তে তেমন কিছুই হবে নাতো? অবশেষে ঘুরতে এসে নিজের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা করে ফেললো নাতো ও? সেই ভয়ে আত্নার পানি শুকিয়ে কাঠ গিয়েছে ঈশানী,এতো উঁচু থেকে গড়িয়ে পরার পরেও শরীরের তীব্র য’ন্ত্রনা ভুলে নিজের সতীত্ব হারানোর ভয়ে থরথর করে কাঁপছে মেয়েটা, নিজের দু’হাত বুকের উপর আড়াআড়িভাবে রেখে শুষ্ক একটা ঢোক গিলে লোকটার উদ্দেশ্যে কাঁপা কাঁপা গলায় ঈশানী বলে ওঠে,

— আমার এতো বড় ক্ষতি করবেন না, আপনার পায়ে পরি, এরকম কিছু হয়ে গেলে মৃ’ত্যু ছাড়া আমার আর কোনো পথ থাকবে না,প্লিজ ছেড়ে দিন। আমাকে সাহায্য করুন।
ঈশানীর করুন কন্ঠে জানানো কাকুতি মিনতি কানে নিলোন লোকটা,উল্টো নিজের পুরুষালী খরখরে হাতটা ঈশানীর পিঠের দিকে নিয়ে আচমকা ঢুকিয়ে দিলো ওর জামার মধ্যে। তৎক্ষনাৎ গগন কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো ঈশানী। বিধিবাম, এই চিৎকার শোনার মতো মানুষ তো দূরে থাক একটা জন্তু জানোয়ারও নেই আসেপাশে।
— ছেড়ে দিন দয়া করে, এটা করবেন না।
লোকটা কয়েক সেকেন্ডের মাথায় নিজের হাতটা আবারও ঈশানীর শরীর থেকে বের করে এনে ওর চোখের সামনে ধরলো। নিজ শরীর থেকে লোকটার হাতের স্পর্শ সরে যেতেই পিটপিট করে চোখ খুললো ঈশানী, চোখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে ফ্ল্যাশ লাইটের ধবধবে আলোয় দেখতে পেলো, তার হাতের তালুতে একটা তেলতেলে জীবন্ত জোঁক। যা দেখে গা গুলিয়ে উঠলো ঈশানীর, ও তরিৎ গতিতে অন্য দিকে তাকিয়ে চোখ মুখ খিঁচে বলে উঠলো,

— ওটাকে সরান প্লিজ, আমার বমি পাচ্ছে।
লোকটা তাই করলো, অতঃপর টিশ্যু দিয়ে হাত মুছতে মুছতে গম্ভীর আওয়াজে বললো,
— এখানে কি করছো?
লোকটার রাশভারি আওয়াজে যেন হৃদয় কেঁপে উঠল ঈশানীর, একে তো গভীর হাস্কিস্বর, তারউপর প্রথম বারেই কেউ কাউকে তুমি করে ডাকতে পারে? কথার ধরন শুনে মনে হচ্ছে, যেন পুরো দুনিয়ায় অবাধ কতৃত্ব রয়েছে তার। হি ইজ দ্য ওয়ানলি ওয়ান।
ঈশানী চুপ করে ভ্রু কুঁচকে একধ্যানে তাকিয়ে আছে দেখে, লোকটা এবার আস্তে করে উঠে চলে যায়। লোকটা ওকে রেখে চলে যাচ্ছে ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই ঈশানী দ্রুত উঠে পরে, খুড়িয়ে খুড়িয়ে লোকটার পেছন পেছন হাটতে হাটতে বলে,

— পাহাড়ে এসেছিলাম বন্ধুদের সাথে হাইকিং এ।
— কেমন বন্ধু তোমার এভাবে ফেলে চলে গেলো?
লোকটার কথায় ভীষণ তিক্ততা, যেন ভালো করে কথা বলা তার ডিকশনারিতে নেই, তবুও আপাতত এই তিক্তভাষী লোকটাই লোকালয়ে ফেরার একমাত্র ভরসা, তাই বাধ্য মেয়ের মতোই নিচু গলায় জবাব দিলো ঈশানী,
—- আসলে ওদের কোনো দোষ নেই, আমিই ক্লাইম্ব করতে গিয়ে খাদে পড়ে গিয়েছি।
লোকটা সামনে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
— সরকারের নিষেধাজ্ঞা আছে, তা জানা সত্বেও তোমাদের এদিকটায় আসা একদম উচিৎ হয়নি।
— হুম তা ঠিক,
কথা বলার এই পর্যায়ে ওরা এসে থামলো একটা কালো জিপের সামনে। এই গহীন জঙ্গলে জিপ তার উপর জঙ্গলের মধ্যেই সরু রাস্তা, যা দেখে এই মূহুর্তে ঈশানীর চোখ কপালে, ফলস্বরূপ নিজের কথার খেইর হারিয়ে অস্ফুটেই ঈশানী বলে ওঠে,

—- এটা কি করে সম্ভব? এই পরিত্যক্ত জঙ্গলে এমন রাস্তা কে বানালো? অবিশ্বাস্য!
লোকটা জবাব দিলো না, বরং এগিয়ে গিয়ে উঠে বসলো জিপে। ঈশানী তখনও সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে, সংকোচ আর দ্বিধায় জর্জরিত সে।লোকটা জিপ স্টার্ট দিতে দিতে নিজের পিয়ার্সিং করা ভ্রু টা তীরের ছিলার মতো উঁচিয়ে বলে উঠলো,
— তোমাকে কি ইনভাইট করে এনে, তারপর বসাতে হবে?
লোকটার অকস্মাৎ তিরস্কারে দ্রুত এগিয়ে এসে জিপে চেপে বসলো ঈশানী, অতঃপর সিট বেল্টটা লাগাতে লাগাতে শুধালো,
—- আমি তো আমার ঠিকানা বলিনি, তাহলে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আপনি আমায়?
আবার সেই অনুভূতিহীন তীক্ষ্ণচাহনী। ধূসর চোখজোড়া মাদকাবিষ্ট, যেন এই চোখে তাকালে এক্ষুনি ঝড় উঠবে বক্ষপিঞ্জরে, শুরু হয়ে যাবে হৃদয়ের সেই নীল ব্যথা। এভাবে হুটহাট প্রশ্ন করার দ্বায়ে লোকটা তার চোখ দিয়েই যেন হুকুমের স্বরে গর্জে উঠলো মাত্র। কেমন বরফের মতো নির্জীব আর শূন্য সেই দৃষ্টি ।জিপের ফ্ল্যাশের স্পষ্ট আলোয় সেই শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকা বড় ই মুশকিল,আর বেদনাদায়ক। অগত্যাই চোখ নামিয়ে শুষ্ক একটা ঢোক গেলে ঈশানী।
ঈশানী চোখ নামিয়ে নিলে লোকটা জঙ্গলের আঁকাবাকা রাস্তায় গাড়ির টার্ন ঘোরাতে ঘোরাতে বললো,

—- এই রাতের বেলা জঙ্গল ছাঁপিয়ে লোকালয়ে পৌঁছানো সম্ভব নয়, রাস্তাঘাট কর্দমাক্ত হয়ে আছে, তাই আপাতত আমার বাড়িতে যাচ্ছো তুমি।
ঈশানী আর আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলো না, আসলে ও জিজ্ঞেস করার অবস্থাতেই নেই, সমস্ত শরীর কাঁদাপানিতে প্যাঁচপ্যাঁচ করছে ওর। পাহাড় থেকে পরে যাওয়ার কারনে বন বিছুটি তে লেগে শরীরের ভেতরের কাটা ছেঁড়া যায়গা গুলোতে নোংরা পানি লেগে বারুদের মতো জ্বলে উঠছে ক্ষনে ক্ষনে। এরকম নোংরা ভেজা জামা কাপড় পড়ে থাকলে নির্ঘাত আজ রাতেই নিউমোনিয়া ডায়েরিয়া সব একসাথে শুরু হবে।
ঈশানী সেই তখন থেকে মোচড়ামুচড়ি করে যাচ্ছে, তা দেখে মাস্ক পরিহিত লোকটা হুট করেই হার্ডব্রেক কষলো জিপে। অকস্মাৎ গাড়ি থেমে যাওয়ায় ঈশানী এবার প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো লোকটার পানে, তবে সে চাইলোনা ঈশানীর সেই প্রশ্নসূচক দৃষ্টি পানে, বরং একটানে নিজের পরিহিত কালো হুডির চেইনটা খুলে সেটাকে ঈশানীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

— চেঞ্জ করে নাও, আই থিংক এটা তোমাকে খুব ভালো ভাবে কাভার করে ফেলবে।
এই মূহুর্তে লোকটা ঈশানীকে ওর সব থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসটা অফার করলেও তাতে কোনোরূপ ধ্যান নেই ঈশানীর, ও তো স্রেফ তাকিয়ে আছে ওই ব্ল্যাক কার্গো প্যান্ট আর ব্ল্যাক স্কিনি স্যান্ডো গেঞ্জি পরিহিত সুঠাম দেহী অচেনা লোকটার দিকে। লোকটার চওড়া দেহ, ঢেউ খেলানো বক্ষস্থল, এইট প্যাক এ্যাবস সবকিছুই জিপের সফেদ আলোতে স্পষ্ট দৃশ্যমান। এভাবে একটা পুরুষকে এতোটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বোধ হয় এই প্রথম পর্যবেক্ষন করলো ঈশানী। লোকটার শারীরিক গঠন এতোটা নজর কাড়া যে হুট করেই ঈশানীর অযাচিত মন বলছে,
— আচ্ছা ওনার চেহারাটা দেখতে কেমন? নিশ্চয়ই খুব সুদর্শন। আচ্ছা উনিকি সত্যিই কোনো সুপারস্টার? নাকি আলফা ম্যান?

— এক্সকিউজ মি?
লোকটার রাশভারি আওয়াজে ধ্যান ভঙ্গ হয় ঈশানীর, ভ্রম কেটে যেতেই মূহুর্তের মধ্যে নিজের কর্মকান্ডে লজ্জিত হয়ে ঈশানী মনেমনে কয়েক ঘাঁ চপে’টাঘাত লাগিয়ে দিল নিজেরই গালে, কি নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে ছিল ও এতোক্ষণ,মনে হয় জীবনে সুদর্শন পুরুষ দেখেনি আর, ও যে এতোক্ষন লোকটাকে একধ্যানে পর্যবেক্ষন করছিল,ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য দ্রুত হস্তে হুডিটা গ্রহন করলো ঈশানী, অতঃপর মিনমিনিয়ে শুধালো,
— এখানেই?
লোকটা জীপ থেকে নেমে পেছনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
— হ্যা এখানেই।

চেনা নেই, জানা নেই ,হুট করেই একটা লোকের পরিহিত জামা গায়ে চড়ানো, ব্যাপারটাতে অস্বস্তি হওয়ার কথা ঈশানীর, কিন্তু তেমন কিছুই দেখা গেলো না ওর মাঝে, উল্টো পেছনের দিকে একটু উঁকি দিয়ে দেখতে পেলো লোকটা সত্যিই অন্য দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে, যা দেখে বড়সড় একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে দ্রুত চেঞ্জ করে নিলো ঈশানী। হুডিটা গায়ে চড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে একটা পুরুষালী কোলনের মাদকীয় সুবাস একেবারে নাক ছাপিয়ে হৃদয়ে গিয়ে ধাক্কা খেলো ওর। নামি-দামি বিদেশি ব্র্যান্ডেট ডার্ক স্মেল যুক্ত কোনো পার্ফিউম,তার সাথে মিলিত হয়েছে পুরুষালী শরীরের একটা ওয়াইল্ড মাদকীয় সুঘ্রাণ। দুটো মিলেমিশে একাকার হয়ে নাকে লাগতেই কেমন একটা ব্যাড বয় ভাইভ দিচ্ছে। এমন ঘোর লাগা কৃত্রিম পুরুষালী কোলনের সঙ্গে পরিচিত নয় ঈশানী, যার ফলে কলারের কাছ টা টেনে মুখের কাছে এনে আরও একবার নাক টেনে ঘ্রান নিলো ও, সঙ্গে সঙ্গে আবারও নেশাগ্রস্তদের মতোই ঘোর লেগে এলো দুচোখে। এটা আদতে কি পার্ফিউম জানা নেই ঈশানীর, তবে এই পুরুষালী সুঘ্রাণটা মাদকের মতোই হুডিটার দিকে খুব করে টানছে ওকে।

ব্যাপারটা ভীষণ অস্বস্তিকর, কেন হুট করেই এই লোকটার সবকিছু এতো আকর্ষনীয় লাগছে দু’চোখে জানা নেই ঈশানীর, তবে এই অযাচিত প্রশ্নের উত্তর খোঁজার উপযুক্ত সময় এটা নয়, সেই ভেবে,
হাঁটু সমান হুডিটা আরেকটু টেনেটুনে বড় করে, গার্ডারটা একটানে খুলে ভেজা চুলগুলোকে উন্মুক্ত করে দিয়ে পেছনে তাকিয়ে ডেকে উঠলো ঈশানী,
— হয়ে গিয়েছে।
ঈশানী ডেকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এসে পুনরায় জিপ স্টার্ট করলো লোকটা।
গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতেই লোকটা নাক টেনে অস্ফুটে বললো,
— ভ্যানিলা।
— উমম, কিছু বললেন?
— নাথিং।
সামনে ঘুটঘুটে অন্ধকার, দুই পাশে দানবের মতোই সটান দাড়িয়ে আছে পাহাড়ি গাছগাছালি, তার মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে একটা কাঁদামাটির সরু রাস্তা, ব্যাপারটা ভীষণ অদ্ভুত। গহীন জঙ্গলে কে এতো কসরত করে বানালো এই রাস্তা?

তাছাড়া ঈশানী না হয় হাইকিং এ এসে বিপ’দে পরেছে, কিন্তু উনি এখানে এই রাতের বেলা জীপ নিয়ে কি করছেন ? কলিজাতে ভয়ডর নেই নাকি? অসংখ্য দানাবাঁধা কৌতুহলে কিলবিল করছে ঈশানীর মাথাটা। একপর্যায়ে কৌতুহল দমাতে না পেরে সাহস করে কঠিন রাশভারি গোছের লোকটাকে একটা প্রশ্ন করেই ফেললো ঈশানী, আস্তে করে ঘাড় ঘুরিয়ে তার কালো মাস্কে আবৃত মুখের দিকে চেয়ে শুধালো,
—- বলছি যে আপনি এখানে কেন এসেছিলেন? না মানে এই রাত্রিবেলা গহীন জঙ্গলে একাএকা ভয় করেনি?
ঈশানী প্রশ্ন করার প্রায় কয়েক মিনিটের মাথায় লোকটা গম্ভীর গলায় বলে ওঠে,
—- বি’পদে পরেছো তাই সাহায্য করছি, এর বেশি আর কিছু জানতে চাইবে না, আমি উত্তর দেবোনা।
মুখের উপর এক্কেবারে চপে’টাঘাত ছুড়ে মারার মতোই শক্ত কন্ঠে কথাগুলো ছুড়ে মারলো লোকটা। তবুও ঈশানী জিদি গলায় বলে উঠলো,

— কিন্তু কেন?
লোকটা এবার স্পিডোমিটারের গতিবেগ বাড়িয়ে অকস্মাৎ চোখেচোখ রাখলো ঈশানীর, অতঃপর অনুভূতিহীন ডমিনেটিং হাস্কি কন্ঠে বললো ,
—-কারন আমি কাউকে কৈফিয়ত দিইনা, আর তোমাকেও দেবো না। তাই অযথা প্রশ্ন না করে নিজের মুখটা এখনই বন্ধ করো।
লোকটা ভীষণ কাঠখোট্টা, কথার পারদে পারদে অহংকার আর কতৃত্ব। আগাগোড়া দেখতে যতটা না সুদর্শন আর লম্বা,কথার টোন তার থেকেও বেশি ধারালো আর তিক্ত। এক কথায় নির্দয় লোক,অথচ সেই দেখা হয়েছে থেকে এই নির্দয় লোকটার প্রতিই এক অযাচিত অনাকাঙ্ক্ষিত দূর্বলতা আর আকর্ষন অনুভব করছে ঈশানী। কিছুতেই তাকে ভালো লাগার কোঠা থেকে সরানো যাচ্ছে না। কি একটা অসহনীয় অনুভূতি বলে বোঝানোর নয়।
তবে তার মাত্র বলা কড়া কথা গুলো ভীষণ মানে লেগেছে ঈশানীর, তাইতো আর কোনোরূপ প্রশ্ন করার আগ্রহ না দেখিয়ে চুপচাপ চোখ নামিয়ে নিলো ও।

লোকটার পরনে ব্ল্যাক স্যান্ডো গেঞ্জি আর অসংখ্য পকেট ওয়ালা কার্গো প্যান্ট, যার দরুন তার দু’বাহু পুরোপুরি উন্মুক্ত। চোখ দুটো নিচে নামাতেই চলন্ত জিপের আলেতে ঈশানী খেয়াল করলো লোকটা যে হাতে সৌন্দর্য বর্ধক মেটালিক ব্রেসলেট পরেছে ,ঠিক সেই হাতের বাহু থেকে কব্জি পর্যন্ত আবৃত করে আছে কিছু হিজিবিজি অঙ্কিত কালচে ট্যাটু। ট্যাটুর একেবারে শেষ মাথায় সাপের মতো কিছু একটা আঁকা, যেখানে গুটিগুটি ইংরেজি অক্ষরে লেখা, “python ”
—পাইথন মানে তো ভ’য়ংকর একধরনের মানুষ খেকো সাপ। তাহলে উনি এটা হাতে কেন লিখেছেন? আশ্চর্য!
ঈশানীর মনের প্রশ্ন, মনেই ধামাচাপা পরে গেলো,কারণ ততক্ষণে লোকটা গাছের মাথায় সুনিপুণ ভাবে তৈরি করা একটা টং ঘরের সামনে এসে জিপ থামিয়েছে।

সেখান থেকে হারিকেনের টিমটিমে রৌশনাই ভেসে আসছে একেবারে জমিন পর্যন্ত। মাথার উপরে এমন কাঠের তৈরি সুন্দর তকতকে ঘর দেখে আরও একদফা হতবাক হলো ঈশানী। গহীন জঙ্গলের মধ্যে রাস্তা, এখন আবার গাছের মাথায় টং ঘর, সবকিছুই যেন অবিশ্বাস্য। ঈশানীর ও খানিকক্ষণ সময় লাগলো নিজেকে এটা বোঝাতে, যে এসব কিছুই স্বপ্ন নয়, সব সত্যি।
গাড়ি থামিয়ে দু’কানে এয়ারপড লাগিয়ে, মইয়ের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে লোকটা ডাকলো ঈশানীকে,
— চলে এসো।

কোনোমতে হুডিটা টেনেটুনে একহাত বলিয়ে গাড়ি থেকে নামলো ঈশানী, কিন্তু হাঁটতে আর পারলো না, সারাদিনের ক্ষুধার্থ শরীর তারউপর এতোবড় একটা এ্যা’ক্সিডেন্ট, যার দরুন গাড়ি থেকে নেমে দাড়াতেই পা দুটো প্রচন্ড ব্যথায় টনটন করে উঠলো ওর। কিন্তু ঈশানী নিজের এই দূর্বলতার কথা কিছুতেই লোকটার সামনে স্বীকার করতে নারাজ, তাই গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে অবিশ্বাসের সুরে ঈশানী বলে ওঠে,
— আচ্ছা এতোবড় টং ঘর টা কার? কেই বা বানিয়েছে?
লোকটা ইতিমধ্যে কয়েক সিঁড়ি উঠে গিয়েছিল, কিন্তু ঈশানীকে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পরতে দেখে পুনরায় নিচে নেমে এসে বললো,
— আপাতত আমার ঘর, এখন উপরে চলো।
ঈশানী জবাব দেয় না, এক পা সামনেও বাড়ায় না, চুপচাপ শুধু অসহায় মুখে দাঁড়িয়ে থাকে।
ঈশানী এখনো দাঁড়িয়ে আছে, তার কথা শুনছে না, ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই চোখের রঙ পাল্টে গেলো লোকটার, অগত্যাই পেছনে ঘুরে কঠিন গলায় সে বললো,
—- ওকে ফাইন, না গেলে দাঁড়িয়ে থাকো এখানে । এসব নাটক দেখার সময় নেই আমার, আমি গেলাম।
—- আসলে আমি পায়ে খুব ব্যথা অনুভব করছি, হাটতে পারছি না।
লোকটা এভাবে ফেলে চলে যাচ্ছে দেখে আত্মসম্মানের মাথা খেয়ে আগ বাড়িয়ে কথাটা বলে উঠলো ঈশানী। এই গহীন জঙ্গলে একাএকা রাত্রি যাপন করার চেয়ে পছন্দের এই অচেনা পুরুষের কাছে একটু ছোট হওয়া ঢের ভালো। সেই ভেবেই কথাটা বলা।

ওদিকে পেছন থেকে ভেসে আসা রিনরিনে অপারগ আওয়াজটা শুনতে পেয়ে আবারও ঘাড় ঘোরালো লোকটা, অতঃপর দু’কদম পিছিয়ে এসে, কোনোকিছু না বলেই, ঈশানীকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় বানিয়ে দিয়ে, অকস্মাৎ ঝড়ের গতিতে ওকে কাঁধে তুলে নিয়ে মই বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করে সে।

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪

জীবনে এই প্রথম কোনো পুরুষ ঈশানীকে ছুয়েছে, তাও এতোটা কাছ থেকে এতোটা শক্ত ভাবে , বিষয়টা ভাবলেই ঈশানীর দম বন্ধ হয়ে আসছে,না চাইতেই তলপেটটা কেমন গুড়গুড় করে উঠছে, এভাবে হুট করে কোমড় চেপে ধরে কাঁধে তুলে নেওয়ার কি দরকার ছিল বুঝে আসলো না ঈশানীর। লোকটা একটু বেশিই ডমিনেটিং যেন, অনুরোধ, জিজ্ঞেসা, অনুমতি এসব তার ধাচে নেই একদমই, কেমন একটা লাগামহীন বেপরোয়া আচরণ তার। কিন্তু এখন তো তাকে নিয়ে এসব ভুলভাল ভাবনার সময় নয়।তাই সহসা কিছুটা সংকোচ নিয়েই লোকটার স্কিনি স্যান্ডো গেঞ্জিটা খামচে ধরে চোখ মুখ খিঁচিয়ে বন্ধ করে তার কাঁধের উপর পরে রইলো ঈশানী।
হয়তো মন গহীনের কোথাও একটা দৃঢ় বিশ্বাস জমেছে ওর, এই লোকটা ওকে পরে যেতে দেবে না, কিছুতেই না।

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৬