আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩৮

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩৮
suraiya rafa

পুরোনো ধাঁচের আটপৌরে শ্যাওলা পরা বাড়িটার চারিপাশে ছড়িয়ে পড়েছে সকালের মিহি সূর্যালোক। দক্ষিণের জানালা জুড়ে নরম রোদের হাতছানি। চারিদিকে বর্ষার মাতন, সকাল সকাল ঝুরোঝুরো সোনালী আলোয় কর্দমাক্ত আঙিনার চিত্র যেন সদ্য বিবাহিতা হলদে রাঙা কিশোরী নববধূ। পরিষ্কার নীল দিগন্তে আজ শুভ্র মেঘের আধোও আধোও সুবিস্তীর্ণ প্রলেপ, দেখে মনে হয় দীর্ঘ আঁধারের প্রহর কাটিয়ে উজ্জ্বল হাসিতে মাতোয়ারা প্রকৃতি।
বাইরের প্রকৃতি আজ যতটা শান্ত আর নিরিবিলি, ঘরের অভ্যন্তরীন আবহ ঠিক ততটাই গুমোট। দমবন্ধকর অস্বস্তিদ্বায়ক মূহুর্ত, বসার ঘরে উপস্থিত কারোর মুখের রা নেই। ঈশানীর মা, মামা, নানী এমনকি ঊষা, সকলের মুখাবয়ব জুড়ে নেমে এসেছে অকৃত্রিম এক তমশা। প্রচণ্ড ক্ষুব্ধতায় ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে ফুটন্ত তেলে ভাজার ন্যায় অনবরত ফোঁসফাঁস করছেন রোকেয়া। ঘরময় বিরাজমান নৈঃশব্দ্য, এরই মাঝে বসার ঘরে এসে হাজির হয় ঈশানী।নাজুক পদচারণের প্রতিটি কদমে ভীরুতা সুস্পষ্ট। গত কয়েকটা দিন তীব্র জ্বরের দহনে অনেকটা ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করেছে তার পেলব মুখশ্রী, অক্ষিপুটে ক্ষয়িষ্ণু ভাব। আগের থেকে অনেকটা শীর্ণকায় লাগছে তার রুগ্ন শরীরখানি।পড়নের ক্রপ টপ আর লং স্কার্ট দুটোই ঢলঢল করছে। মেয়েটার পরিশ্রান্ত পদযুগলের প্রতিটি পদধ্বনি যেন বিরক্তির রেশ দিগুণ বাড়িয়ে তুলছে উপস্থিত সকলের।

মেয়ের এরূপ নীরব ভাবলেশহীন আগমন সহ্য হলোনা রোকেয়ার, তিনি অস্থির পদচারণায় এগিয়ে গেলেন সম্মুখে, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কোনোকিছুর ইঙ্গিত না দিয়েই শক্ত হাতের চপেটা’ঘাত বসালেন জ্বরে পুড়তে থাকা উৎপীড়িত শরীরের উপর। অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় ঝলসে উঠলো কোমল ত্বক , ঝাপসা চিত্তে নিজেকে জুতসই সামলানোয় অক্ষম ঈশানী, ফলস্বরূপ তাল হারিয়ে পরে গেলো শক্ত মেঝেতে। ক্ষুব্ধতায় ঝাঁঝিয়ে উঠলেন রোকেয়া, মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পরে যাওয়া মেয়েটার দিকে কঠিন দৃষ্টিপাত করে ক্রোধান্বিত স্বরে বললেন,
— মাহিনকে কি বলেছিস তুই?
কয়েকদিনের অসুস্থতার দরুন ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শরীর। ব্যথাতুর অচল মাংসপেশী, তবুও ধীরে ধীরে উঠে বসার চেষ্টায় অবিচল থেকে জবাব দিলো ঈশানী,
— আমি কিছুই বলিনি মাহিনকে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— দু’দিন বাদে বিয়ের তারিখ, অথচ আজ হঠাৎ সে বিয়েটা ভেঙে দিলো, এর কারণ কি?
কোনোমতে উঠে বসলো ঈশানী, পিঠে পরে থাকা একঝাড় রেশমের মতো লম্বা চুল সব এলোমেলো হয়ে লেপ্টে আছে কপালে, মুখে, এমনকি ঘাড়ের দু’পাশে । জ্বরের তোপে ঝিমঝিম করছে মস্তিষ্ক। শুষ্ক একটা ঢোক গিলে মায়ের অগ্নিদৃষ্টে চোখ মেলালো মেয়েটা, বললো,
— যে বিয়ে ভেঙেছে তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো, আমাকে কেন বলছো?
ঈশানীর এহেন দায়সারা প্রত্যুত্তরে ভলভলিয়ে র’ক্ত চড়ে উঠলো মস্তিষ্কে। আপন চিত্তের খেই হারিয়ে ক্ষুব্ধতায় সম্মুখে ঝুঁকলেন রোকেয়া , আক্রান্ত মেয়েটার পানপাতার মতো ঢলঢলে পেলব কপোলে আরও কয়েক ঘাঁ বসিয়ে দিলেন অকপটে।রাগে কটমট করতে করতে বললেন,

— অভাগী, অপয়া আমি কিছু বুঝিনা ভেবেছিস?কাল মাহিন তোর সঙ্গে দেখা করে গেলো, আর আজ গোটা বিয়েটাই ভেঙে দিলো। এটা কি এমনি এমনি? যেখানে সবকিছু ঠিকঠাক, সেখানে তুই কিছু না বললে, হুট করেই বিয়ে ভাঙবে কেন সে?আমাকে তোর এতটাই নাদান মনে হয়?
মায়ের কথায় ভাবান্তর হলোনা ঈশানীর, ও শুধু গ্রীবা ঘুরিয়ে দৃষ্টিপাত করলো সম্মুখে। সোফায় বসা প্রত্যেকটা মানুষ নীরব দর্শকের ন্যায় বিনাবাক্যে অবলোকন করছে সবটা। প্রত্যেকের চোখে বেজায় অনীহা, যেন এই দৃশ্যে মোটেও উদ্বিগ্ন নয় তারা। এমনকি মানবতার উৎপীড়ন টুকুও অনুপস্থিত তাদের মাঝে। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলনা। কেন কেউ একবারের জন্য বাঁধা দিলোনা মাকে? ছোট বোনের সামনেও কি এভাবে মা’র খাওয়া যায়? ঈশানীর নির্বোধ নির্লিপ্ততা অবলোকন করে ওর দু’বাহু ধরে সজোরে ঝাঁকিয়ে উঠলেন রোকেয়া,ক্রোধান্বিত হয়ে বলতে লাগলেন,
— সত্যি করে বল, কি বলেছিস মাহিনকে? বারবার নিজেকে অপয়া প্রমান করতে, মহল্লা বাসীর সামনে আমাদের নাক,কান কাটতে লজ্জা করেনা তোর? কিরে বল, একটু ও লজ্জা করেনা তোর?

— তুমি কি সত্যিই আমার নিজের মা? জন্মদাত্রী মায়েরা কি তাদের মেয়ের সঙ্গে এমন করেই কথা বলে?
টলমলে অশ্রুসিক্ত দু’নয়ন মুছে শান্ত নির্জীব স্বরে প্রশ্নটা ছুড়লো ঈশানী, সঙ্গে সঙ্গে নরম গালে হামলে পরলো তীব্র এক ক’ষাঘা’ত। প্রচণ্ড আ’ঘাতের তোড়ে ঝলসে উঠলো মুখমণ্ডল, মূহুর্তেই প্রতিটি আঙুলের ছাপে জমে গেলো জখমের র’ক্তাভ লালিমা। নরম তুলতলে কপোল দু’টো অশরীরীর ন্যায় ধারণ করলো কালচে বর্ণালী রূপ। প্রচণ্ড অনীহায়, বিনাবাক্যে দূরত্ব বাড়ালেন রোকেয়া , মা সরে যেতেই পাশ থেকে ভেসে এলো মামার কর্কষ আওয়াজ,
— প্রত্যেকবার বিয়ের কথা উঠলেই একটা না একটা কাহিনি সৃষ্টি করিস তুই। এমন কি গত কয়েকমাস যাবত কোথায় ছিলি, কি করেছিস সবটাই অজ্ঞাত। কিচ্ছুটি জানতে চাইনি আমরা, তোকে তোর মতো ছেড়ে দিয়েছি। অথচ এতোগুলা দিন বাদে, এতো কাহিনীর পরেও যখন মাহিনের মতো একটা ছেলে নিজে থেকে বিয়ের প্রস্তাব দিলো, আগ বাড়িয়ে তোর জীবনটা শুধরে দিতে চাইলো, তখন তুই কিনা,
এতোটুকু বলে থামলেন মামা, বিতৃষ্ণায় ফিরিয়ে নিলেন মুখ। কিয়ৎক্ষনের নীরবতা, অতঃপর সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে তিক্তস্বরে বলে উঠলেন,

— আমরা সব জানি, তুই একটা স’ন্ত্রাসীর জন্য এসব করছিস। কিন্তু তুই কি জানিস? তোর বাবাও দেশকে রক্ষা করতে গিয়ে এমন এক স’ন্ত্রাসী টেরোরিস্ট দলের হাতেই বন্দি হয়েছিলেন? আর তার কয়েকমাস পরেই…
ফের নীরবতায় আচ্ছাদিত হলো পুরো বসার ঘর। সবসময় রসিকতায় মজে থাকা দেবোরার কুঁচকানো মুখমণ্ডলেও আজ অনীহার লেশ।মুখ কাঁচুমাচু করে ঘরের এক কোণে বসে আছে ঊষা, মাঝেমধ্যেই চোখ উঁচিয়ে আড়ালে পর্যবেক্ষণ করছে সকলের অভিব্যক্তিটুকু।
খানিক বাদেই নীরবতার ইতি টানলো স্বয়ং ঈশানী, আলতো নিঃশ্বাস ছেড়ে বিদ্রুপাত্তক হেসে দৃষ্টিপাত করলো মামার পানে, ব্যথাতুর স্বরে বলে উঠলো,
— আর তোমরা কি করলে? আমার বাবা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে না করতেই, একটা ছোট্ট মেয়েকে মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করে তার মাকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দিলে।
অতর্কিতে থমথমে হয়ে উঠলো দৃশ্যপট। একরত্তি মেয়েটার মুখ থেকে বের হওয়া তীরের ফলার মতো তীর্যক বাক্যটি যেন নীরব যুদ্ধ লাগিয়ে দিলো প্রত্যেকের অন্তরে। নানী, মামা দু’জনই নির্বিকার বদনে চেয়ে আছেন ঈশুর পানে। অসহনীয় এই নীরবতা ভেঙে ফের বলতে উদ্যত হলো মেয়েটা,

— ওই ছোট্ট বাচ্চাটা কি দোষ করেছিল বলোতো মামা? বাবা, মা সবকিছু একসাথে কেড়ে নিয়ে নরক বানিয়ে দিয়েছিলে তোমরা আমার জীবনটাকে। তাহলে এখন আমার ভালোমন্দ নিয়ে এতো দুশ্চিন্তা কিসের তোমাদের?
ক্রন্দিত মেয়েটার পানে চাইলেন মামা। থমথমে গলায় বলে উঠলেন,
— তখন ছোটো ছিলি, কিন্তু এখন তো বড় হয়েছিস। বোঝার চেষ্টা কর, পরিস্থিতিটাই এমন ছিল যে…
বাক্য সম্পন্ন করতে পারলেন না মামা, তার আগেই গলা ছেঁড়ে চ্যাঁচিয়ে ওঠে ঈশানী,
— তোমরাও এবার আমার পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করো । আমি পারবো না অন্য কাউকে বিয়ে করতে। ও শেষ করে দিবে সব, ধ্বং’স করে ফেলবে তোমাদের অস্তিত্ব। তার চেয়েও বড় কথা আমি ওকে ছাড়তে পারবো না মামা।
শেষ বাক্যটা বড্ড নাজুক স্বরে বললো নীলাম্বরী। কথা কটা কর্ণগোচর হবার সঙ্গে সঙ্গে ফের ফুঁসে উঠলেন রোকেয়া, তরতরিয়ে এগিয়ে এসে বাড়ালেন সংকীর্ণতা,জ্বরের দাবদাহে গুটিয়ে যাওয়া মেয়েটার সরু বাহুটা চেপে ধরলেন শক্ত হাতে, ওকে টেনে তুলতে তুলতে তিরিক্ষি আওয়াজে ছুঁড়লেন কঠোর বাক্য বহর,
— বুঝেছি তুই শুধরাবার নস। নিজের মুখটা তো পোড়াবিই, সাথে আমাদের টাও।
কথা শেষ করে ঈশানী সমেত সিঁড়ির পানে অগ্রসর হলেন রোকেয়া,তক্ষুনি পেছন থেকে ভগ্ন স্বরে ডেকে ওঠেন দেবোরা,ভ্রুযুগল কুঁচকে শুধান,

— হডে লই যর ইতিরে?
পেছনে না ঘুরেই কঠোর অভিব্যক্তিতে জবাব দিলো রোকেয়া,
— একটা গুন্ডা মাস্তানের জন্য আজ যে মেয়ে নিজের বিয়ে ভেঙে দিতে পেরেছে, ঘরের বাইরে যেতে দিলে কাল সে আরও বড় কোনো অঘটন ঘটাবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? তাই যতক্ষণ না ও এসব পাগলামি বন্ধ করছে, ততক্ষণ অবধি ঘরের বাইরে এক পাও রাখতে পারবে না আর । আজ থেকে ঘরবন্দী থাকুক, যেদিন নিজের ভুল শুধরাতে পারবে, সেদিনই কেবল ওর ঘরের তালা খোলা হবে।
কথা বলতে বলতেই সিঁড়ি ভেঙে করিডোর অবধি চলে গেলেন রোকেয়া, ওদিকে মায়ের ভাবনা বোধগম্য হতেই পিলে চমকে গেলো ঈশানীর, তৎক্ষনাৎ শরীর ছেড়ে মেঝেতে বসে পরলো মেয়েটা, হাজার রকম জোরজবরদস্তি করে নিজের বাহুটা ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে বলতে লাগলো,

— ছাড়ো মা, আমি ঘরে যাবো না, তুমি আমাকে তালা মে’রে কক্ষবন্দি করে রাখতে চাইছো, কেমন মা তুমি?
রোকেয়া ছাড়লেন না, উল্টো মেয়েটাকে টেনে হিঁচড়ে ঘরের অভিমুখে নিয়ে যেতে যেতে বললেন,
— চুপচাপ বিয়ে করলে আজ আর এই দিন দেখতে হতোনা। আমার মেয়ে হয়ে একটা দে’শদ্রো’হী স’ন্ত্রাসীর সঙ্গে ঘুরে বেড়াবি, আর আমি মা হয়ে সেসব সহ্য করবো বলে তোর মনে হয়? একটা স’ন্ত্রাসী, যার কোনো ভবিষ্যত নেই, বাস্তবতা নেই, জীবনের নিশ্চয়তা নেই, একটা যাযাবর জানোয়ারের চাইতেও সে অধম। তার জন্য কিসের এতো দরদ তোর? লজ্জা করেনা একটা খু”নির হয়ে সাফাই গাইতে? জিসান আমাকে সব ব’লেছে,ওই জানোয়ারটা তোর সর্বনাশ করে ছেড়েছে। এসব কথা মানুষ জানাজানি হতে দিবো আমি ভেবেছিস? ম’রে গেলে ও না। তাতে যদি সারাজীবন নিজের মেয়েকে তালাবন্ধ করে করে রাখতে হয় তবে তাই রাখবো।

রুগ্ন শরীরটা অসাড় হয়ে আসছে, অতিরিক্ত টানাহেঁচড়ার ফলে জামা কাপড় ছিঁড়েফেড়ে একাকার। ধুলোবালিতে পরনের সফেদ স্কার্টটা কদাচিৎ বর্ণ ধারণ করেছে ইতিমধ্যে। নাজুক শরীরের জায়গায় জায়গায় তৈরি হয়েছে বীভৎস ক্ষ’তচিহ্ন, অথচ মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে জিসানের নাম। এতোটা নিচে কবে নামলো ছেলেটা? শেষমেশ কিনা মায়ের সামনে চরিত্রহীনা বানিয়ে ছাড়লো? পেছন থেকে ঠিক কিরূপ কলকাঠি নাড়ার পাঁয়তারা করছে জিসান? মোটেই বুঝে আসছে না মেয়েটার।
তবে এই মূহুর্তে মায়ের শেষ বাক্যটা ভেতর থেকে চূর্ণবিচূণ করে দিলো ঈশানীকে।
ফলস্বরূপ স্বচ্ছ মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে বসে চিত্ত চিঁড়ে কেঁদে ওঠে রমনী , বাঁধভাঙা হয় প্রগাঢ় বেদনার দহন, নিজেকে প্রমাণ করার প্রয়াসে অসহায়ের মতো আর্তনাদের ধ্বনিতে বলতে শুরু করে,

— তুমি নিজের মেয়েকে ভরসা না করে,একটা অচেনা ছেলের কথা কে এতোটাই প্রাধান্য দিচ্ছো যে তার কথায় তুমি আমাকে তালা মে’রে রাখতে চাইছো, কেন মা?
— জিসান মিথ্যে কিছুই বলেনি, ওই বাজে লোকটার জন্য তোর এসব পাগলামিই বলে দেয়,যে তুই আর পবিত্র নেই। এতো মাস ধরে ওই নিকৃষ্ট লোকটা নিজের কাছে রেখে অপবিত্র করেছে তোকে। না জানি আরো কি কি….
বাক্যের মাঝপথেই ক্রোধের তাড়নায় হাঁসফাঁস করে ওঠেন রোকেয়া, ভীষণ ব্যতিগ্রস্ত হয়ে নির্জীব জড়পিণ্ডের ন্যায় মেয়েটাকে হ্যাঁচরাতে হ্যাঁচরাতে ঘরের দিকে নিয়ে যেতে যেতে ঘৃণিত স্বরে আওড়ান,

— মানসম্মান সব শেষ করে দিয়েছে জানোয়ারটা।
রোকেয়ার তিরিক্ষি বাক্যে হৃদয় ছিঁড়ে এফোঁড় ওফোঁড় হলো দূর্বল ক্ষয়িষ্ণু মেয়েটার। ফের শুরু করলো অজস্র আহাজারি, অস্পষ্ট অপারগ স্বরে বারবার বলতে লাগলো,
— ওই জিসান একটা ধূর্ত মিথ্যাবাদী। এমন কিছুই ঘটেনি, অরণ্য আমাকে রে’প করেনি মা। বিশ্বাস করো অরণ্য আমাকে রে’প করেনি। আমি এখনো পবিত্র।
মেয়ের হৃদয় বিদারক বিলাপে বিন্দুমাত্র পিছুটান অনুভব করেন না রোকেয়া, উল্টো এক ধাক্কায় ঈশানীকে ঘরের মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দরজায় তালা লাগাতে লাগাতে তিনি রুক্ষস্বরে বলেন,
— একটা জানোয়ারের জন্য নিজের বিয়ে ভেঙেছিস, মাহিনের মতো সোনার টুকরো ছেলেকে পায়ে ঠেলে দিয়েছিস। এখনো তোর এসব মায়া কান্নায় বিশ্বাস করবো আমি ভেবেছিস? কখনোই না।
শরীরের অর্হনিশ ব্যথা, হৃদয়ের র’ক্তক্ষরণ, টালমাটাল মস্তিষ্ক সবকিছুকে নিদারুণ উপেক্ষা করে উঠে দাঁড়ালো ঈশানী, তড়িঘড়ি পায়ে সামনে অগ্রসর হয়ে দু’হাতে ধাক্কাতে শুরু করলো কাঠের দুয়ার।বিপরীত প্রান্তে নৈঃশব্দ্যের উদ্ভাসন । যার দরুন জাগ্রত হলো ব্যতিগ্রস্ততা, কোনোরূপ দ্বিধাবোধ না করেই এবারে গলা ছেঁড়ে ডাকতে শুরু করলো রমণী ,

— মা দরজা খোলো, একবার আমার কথাটা শোনো। আমি বের হবো,মাআআ!
কণ্ঠনালিতে দলা পাঁকানো অভিমান, বেদনার প্রকোপে সিক্ত হয়ে উঠছে সুগভীর নীলাম্বর নেত্রগহ্বর। মাত্রাতিরিক্ত ধকলে কথা বলার শক্তি ক্ষীণ,তবুও বন্ধ দরজায় অনবরত কড়াঘাত করে যাচ্ছে ঈশানী, ক্রন্দনরত বির্দীর্ণ আওয়াজে একনাগাড়ে শুধু বলছে,

—মা, মাআআ, নানী, ঊষা, আমি তোমাদের কি ক্ষতি করেছি? কেন এভাবে কষ্ট দিচ্ছো? কেন একটু বুঝতে চাইছো না আমায়? জিসানের সব কথা মিথ্যে। বিশ্বাস করো আমি পবিত্র। আমাকে কেউ স্পর্শ করেনি, যদিওবা কেউ সেটা করার স্পর্ধা দেখায় তবে ওই জানোয়ারটাই সবার আগে ঢাল হবে আমার। একবার বিশ্বাস করো আমাকে, মাআআআ….
হাজারটা প্রতিশ্রুতি বাক্য শুনিয়েও কোনোরূপ লাভ হয়না। মন গলে না কঠিন মানবী রোকেয়ার। ওদিকে ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত হয়ে অবশেষে দরজা ঘেঁষে ধপ করে মেঝেতে বসে পরে ঘরবন্দি ঈশু। অবচেতন রুগ্ন শরীরখানা কাঁপছে তিরতিরিয়ে, নিভু নিভু ঝাপসা দৃষ্টিসীমা, আ’ঘাতে আ’ঘাতে ক্ষ’তবি’ক্ষত সর্বাঙ্গ। তাও বেসামাল ক্রন্দন প্লাবনে ঢেউ তুলে ব্যাকুল চিত্তে আর্তনাদ করতে থাকে সেই মেয়েটা। যে কিনা সমগ্র ধরণির তরে ব্লাডি মনস্টারের একমাত্র দূর্বলতা। এক অশুভ মরীচিকার স্নিগ্ধ সাকুরা, তার ভগ্ন অধরের ফাঁক গলিয়ে অস্ফুটে ধ্বনিত হয় নিগূঢ় শব্দের বহর,
— আমি নিরুপায়, ওই জানোয়ারটা যে আমার রক্তে মিশে গিয়েছে। হৃদয়ের প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে যার অস্তিত্ব, তাকে আমি এ জীবনে ভুলবো কি করে মা?

আধুনিক ধাঁচের কাচ আচ্ছাদিত বিশালকার ডাইনিং টেবিলটা ভর্তি হয়ে আছে হরেক রকম সুস্বাদু খাবারের বহরে। প্রতিটি পদের অকৃত্রিম সুঘ্রাণ আর সুনিপুণ ডেকোরেশন দু’টোই জিভে জল আনার মতোই আকর্ষনীয়। এক দর্শনে চোখ বোলালে যে কেউ নিঃসন্দেহে গৃহিণীর রন্ধনশৈলীর তারিফ করতে বাধ্য।
তবে গৃহিণী আজ একা নয়, তার আমূল সহযোগীতায় লিপ্ত রয়েছে উৎসুক কন্যা নিঝুম। খালামনি রান্নাঘর থেকে যে খাবার গুলো বেড়ে দিয়েছে সেগুলো একটা একটা করে সন্তোর্পনে ডাইনিং এ সাজিয়ে তবেই এ্যাপ্রোন খুলে চেয়ার টেনে খেতে বসলো সে । খাবারের সুস্বাদু গন্ধে পেটের ভিতর গুরগুর আওয়াজ হচ্ছে ভীষণ,এভাবে বেশিক্ষন সামনে নিয়ে বসে থাকা দূরহ। অগত্যা তন্দ্রাকে উচ্চস্বরে ডেকে ওঠে নিঝুম ,

— খালামনি জলদি এসো,খাবার সব ঠান্ডা হয়ে গেলো তো।
আজকের মেনুর শেষ থালা সমেত একটু পরে ডাইনিং এ এসে হাজির হলেন তন্দ্রা জাওয়াদ। তাড়াহুড়ো করে তিন তিনটা প্লেট সাজালেন প্রথমে, অতঃপর প্রতেকটাতে সম পরিমাণ খাবার তুলে দিতে দিতে হুট করেই কি ভেবে যেন প্রশ্ন ছুঁড়লেন নিঝুমের উদ্দেশ্যে,
— ছেলেটাকে কিভাবে চেনো তুমি?
— কোন ছেলেটা?
অজ্ঞাত স্বরে ঠোঁট উল্টালো নিঝুম। একপল নিঝুমকে পর্যবেক্ষন করে ফের হাতের কাজ অবিরত রেখেই তন্দ্রা বলে ওঠেন,
— ওই যে সেদিন সন্ধ্যায় তোমাকে এগিয়ে দিলো।
তুষারের কথা উঠতেই অকৃত্রিম আড়ষ্টতায় মিয়িয়ে গেলো মেয়েটা ।ঠোঁট কামড়ে মাথা নমিত করলো সবেগে, হৃদ মাঝারে জাগ্রত হলো নিদারুণ এক উৎকণ্ঠা, মনেমনে ভাবতে লাগলো,
— খালামনি হঠাৎ তুষারের কথা কেন জানতে চাইছে? ভিলেনটার সঙ্গে আবার আমার বিয়ের চিন্তা ভাবনা করছে না তো? ইশশ!
আপন ভাবনায় সংকীর্ণতা উথলে উঠলো মনগহীনে। পুলকিত চিত্তের সুপ্ত লাজুকতা হামেশাই ধরা দিলো বাহ্যিক বদনে, গোলগাল কপোল দু’খানা রক্তাভ হয়ে উঠলো লজ্জার লালিমায়।
— কি হলো, বললে না যে কিভাবে চেনো?
খালামনির আকস্মিক বাক্যে ভাবনার জগত থেকে ছিটকে বেড়িয়ে এলো নিঝুম। তাড়াহুড়ো নিজের খাপছাড়া ভঙ্গিমা আড়াল করে বাম হাতে ঘাড় চুলকে জানালো,

— ওই আরকি, তোমাকে বললাম না ভার্সিটির বড় ভাই।
নিঝুম কথাটা বলতে না বলতেই ওর পানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন তন্দ্রা জাওয়াদ। খালামনির গভীর চোখের সুদীপ্ততা অচিরেই শঙ্কা বাঁধালো নিঝুমের অন্তর জুড়ে। ধরা পরে যাওয়ার ভয়ে আলগোছে শুষ্ক ঢোক গিললো মেয়েটা, জিভ নাড়িয়ে শব্দ উচ্চারণের মাধ্যমে বলতে চাইলো আরও কিছু।তবে তার আগেই তৃতীয় পক্ষের গমগমে স্বরে ইতি ঘটলো নিগূঢ় আলাপচারিতার। অতর্কিতে দু’জনেই দৃষ্টিপাত করলো পেছনে। হাফ স্লিভ টিশার্ট আর ট্রাউজার পরিহিত তাগড়া যুবকটি নির্লিপ্ত বদনে এগিয়ে আসছে এদিকেই। তদ্রাচ্ছণ্ন তার দু’নয়ন, খুব সম্ভবত ঘুম থেকে উঠেছে। যা দেখা মাত্রই মেকি গম্ভীরতায় দাঁত খিচলেন খালামনি, কর্কশ গলায় বললেন,
— এটা ঘুম থেকে ওঠার সময় ? ঘড়ির দিকে একবার তাকাও তো দেখি।
আধোও আধোও চোখ মেলে ঘড়ির দিকে দৃষ্টিপাত করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো যুবক। ঠোঁট ফুলিয়ে ঘুম জড়ানো গলায় বললো,

— দুপুর আড়াইটা বেজেছে কেবল। আমিতো ভেবেছিলাম এতোদিন পর বাড়িতে এসেছি সেই সেলিব্রেশনে সারাদিন ঘুমাবো আজ ।কিন্তু এই বাঁচাল মেয়েটা ঘুমাতে দিলেতো? সেই সকাল থেকে পকর পকর করেই যাচ্ছে ননস্টপ।
নিঝুমের খোলা চুলের একাংশ ধরে আচমকা টান মে’রে কথাটা বললো সে।
— আউচ!
চুলের ব্যথায় মৃদু আর্তনাদ করে ওঠে নিঝুম, বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে নাকের পাটা ফুলিয়ে বলে ,
— তুমি মুখ ধুয়েছো তূর্য ভাই?
— না ধুলে কি? তুই ধুয়িয়ে দিবি?
গ্রীবাদেশ সামান্য বাঁকিয়ে হেয়ালির স্বরে প্রশ্ন করে তূর্য। তীর্যক ভেঙচি কেটে মুখ ঘোরায় নিঝুম,দাঁতে দাঁত চেপে কিড়মিড়িয়ে বলে,

— আমার এতো ঠ্যাকা পরেনি।
— এহ ভাইয়ের বেলায় যত ঢং, জামাই কে তো পা ও ধুয়িয়ে দিবি।
তূর্যের কথায় চোখমুখ কালো করে ফেললো নিঝুম, খাবারের প্লেট সমেত ডাইনিং থেকে উঠে কাউচের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ভাব দেখিয়ে বললো,
— আমার জামাই, শুধু পা কেন?দরকার পরলে সব ধুয়িয়ে দিবো।
— শালি।
নিঝুমের যাওয়ার পানে চেয়ে অস্পষ্ট আওয়াজে ছোট্ট একটা অযাচিত শব্দ উচ্চারণ করলো তূর্য। তৎক্ষনাৎ ওকে চোখ রাঙালেন তন্দ্রা। ধমকের স্বরে বললেন,
— তূর্য! এই শিক্ষা তোমার?বোন কে শালি বলে কেউ? যাও মুখ ধুয়ে এসো।
মায়ের ধমক খেয়ে চুপসে গেলো তূর্য। ওপাশের কাউচে বসে মুরগীর রান চিবুতে থাকা নিঝুমের পানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করে মনেমনে বললো,
— সময় হোক , তোকে বাগে পেয়ে নিই একবার, তখন বোঝাবো কে কার পা ধোয়ায়।

জলস্রোতের ন্যায় গরগর করে অতিবাহিত হয়ে যায় সময়। অবিরাম এই সময়কে কেন্দ্র করেই মানব জীবনে রচিত হয় স্মৃতির অধ্যায়। কারোর স্মৃতি হৃদয় উজাড় করা আনন্দ উদ্দীপনের, কারোর বা বিষণ্ণতা আর বিভীষিকার।
গুনে গুনে তিনদিন অতিবাহিত হলো আজ। গত তিনদিন ধরেই নিজ বাড়িতে, নিজেরই ঘরে কারাবন্দি আসামিদের ন্যায় তালাবদ্ধ জীবনযাপন করছে ঈশানী। সেদিন মায়ের হাতের প্রচণ্ড মা’রে হাড় কাঁপিয়ে জ্বর এসেছিল ওর, যেই জ্বরের ইস্তফা ঘটেনি আজ অবধি।
একই ভাবে সকাল সন্ধ্যা সময় করে হানা দেয় তীব্র দাবদাহ। জ্বরের প্রকোপে ঠকঠক করে প্রকম্পিত হয় নাজুক সর্বাঙ্গ। নিদারুণ শিহরণে অহেতুক টলতে থাকে মস্তিষ্ক। জ্বরের তাড়নায় কাঁপতে কাঁপতে সারারাত ধরে আজেবাজে বিলাপ করে মেয়েটা,কখনো অজান্তেই কেঁদে ভাসায় অবচেতন দু’নয়ন। কখনো বা জ্বরের তোপে চেতনা হারিয়ে বেঘোরে পরে থাকে বিছানায়। এরপর যখন রাত পেরিয়ে সকাল হয়, তখন চিরাচরিত নিয়মে কমে আসে বাহ্যিক তাপমাত্রা।

প্রচণ্ড যাতনায় দিনাতিপাত করতে থাকা ঈশানীকে কেউ কখনো খুঁজতে আসে না, ঊষা এসে তিনবেলা খাবার দিয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু না পারতে সেই খাবার মুখেও তোলেনা মেয়েটা। প্রচণ্ড ঘৃণা, অভিমান,বিষণ্ণতায় গলা ভেদ করে খাবার নামেনা ওর।
এ নিয়েও গতকাল আরেকদফা ঝামেলা বাঁধিয়েছেন রোকেয়া, শেষমেশ না পেরে বেতের আ’ঘাত হাঁকিয়েছেন মেয়েটার সর্ব শরীরে। কেড়ে নিয়েছেন মোবাইল ফোন। তবুও একরত্তি টলাতে পারেনি ঈশানীকে। নিজ বাক্যে অটল নীলাম্বরী। যাই হয়ে যাক এরীশকে ভুলে যেতে পারবে না ও। ওর গতিহীন হৃদটা বরাবরের মতোই স্রোতের বিপরীতে চলছে। বাস্তবতা বুঝতে চায়না সে, জানতে চায় না ভবিতব্য।কেবল অনিমেষ চিত্তে খুঁজে বেড়ায় এক হৃদয়হীন মরীচিকাকে।
পরপর তিনদিন শুধু পানির উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে জীবন। সুষ্ঠু, সুন্দর,সাবলীল দিনগুলো হারিয়ে গিয়েছে বিভীষিকার অনলে। ফ্যাকাসে এলোমেলো নাজুক মুখটা যতটা না বেদনা ধরে রাখে, তার চাইতেও বেশি অভিমান ধরে রাখে ওর হৃদয়পিঞ্জর। মাফিয়া বস টার উপর এক আকাশ সমান অভিমান নীলাম্বরীর। এতোই যদি না দেখে নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যায়, তাহলে কেন খুঁজলো একবারও? নাকি সেদিনের গু’লির আ’ঘাতে এখনো মূমুর্ষ সে?

সর্বনাশা প্রণয়ের দাবানলে, জ্বলেপুড়ে খাক হয় অন্তঃকরন। নিজের ভাবনায় নিজেই অস্থির হয়ে ওঠে ঈশানী, করতে থাকে পরিত্রাণের সন্ধান। তখনই দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে ঊষা। হাতে খাবারের থালা। মেয়েটার চোখেমুখে কুণ্ঠা সুস্পষ্ট, যেন ঘরবন্দি ঈশানীর অসহায় অবচেতন রুগ্ন মুখখানা দেখে দুঃখের চাইতেও ভয় হয় বেশি তার। যার দরুন খাবার টা টেবিলে রেখে বিনাবাক্যে বেড়িয়ে যেতে উদ্যত হয় ঊষা।
অন্যান্য দিন কোনোরূপ কথাবার্তা না বললেও আজ হুট করেই ঊষাকে পিছু ডাকে ঈশানী, কণ্ঠনালিতে আওয়াজ নেই কোনোরূপ, তাও বহু কসরত করে ঝিঁমিয়ে ঝিঁমিয়ে মেয়েটাকে বলে,
— ঊষা, বোন আমার একটা মোবাইল ফোন এনে দিতে পারবি? তুই যা চাইবি আমি তোকে তাই দিবো।
ভয়ার্ত ঢোক গিললো ঊষা, তাড়াহুড়ো এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে বললো,
— না’রে আপু। মা জানলে মে’রে ফেলবে আমায়।

আঙুলের ইশারায় বেডটেবিলের ড্রয়ার টা দেখালো ঈশানী। লম্বা শ্বাস টেনে অস্ফুট স্বরে বললো,
— ওখানে অনেক গুলো পয়সা রাখা আছে, সব তোর। তবুও একটা ফোন খুঁজে দে না বোন। এখান থেকে না বেরোতে পারলে দেখবি সত্যিই ম’রে যাবো আমি।
কথাটুকু শেষ হতে না হতেই অকস্মাৎ চেতনা হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে ঈশানী। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলো ঊষা, বিস্ময়ে আপনাআপনি ফাঁক হয়ে যাওয়া মুখের উপর দু-হাত চেপে ধরে চ্যাঁচিয়ে উঠলো সবেগে,
— আপুউউউ!
ঊষার এই ঘর কাঁপানো নিগূঢ় চিৎকার পোঁছালো না নিচ তলায়। তার আগেই রিভলবার থেকে নিক্ষিপ্ত ধাতব বুলেটের প্রকাণ্ড আওয়াজে ঝনঝন করে প্রকম্পিত হয়ে উঠলো সমগ্র দোতলা বাড়ি। ভয়ের তোড়ে অবচেতন ঈশানীকে মেঝেতে ফেলে রেখেই জোর কদমে নিচের ঘরে ছুটলো ঊষা।
তরতর করে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে আসতেই দেখা মিললো একদল কালো পোশাক ধারী বিদেশি গোছের মূর্তিমানবের । জীবন্ত অশরীরীর ন্যায় স্নাইপার হাতে সটান দাঁড়িয়ে আছে লোকগুলো , যেন যুদ্ধ ময়দানের নির্ভীক সৈন্যদল। জেতার জন্য যারা পুরোপুরি প্রস্তুত।

আরেকটু গভীর নজরে লোকগুলোকে পরখ করতেই আঁতকে ওঠে কিশোরী ঊষা। অতর্কিতে মুখোমুখি হয় এক অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্যের। একজন কালো কোট পরিহিত ব্যক্তি। লম্বা, চওড়া, সুঠাম দেহী লোকটার ট্যাটু খচিত আঙুলের ভাজে নির্লিপ্তে খেলা করছে রিভলবার নামক চকচকে এক মা’র’ণাস্ত্র। কালো মাস্কের অন্তরালে তার অভিব্যক্তি অস্তিত্বহীন হলেও, ধূসর বাদামি চোখ দু’টো মৃ’তের ন্যায় শূন্য আর নির্জীব। সেদিকে নজর পরলেই কেমন কাঁপন ধরে ওঠে অন্তরে। যেন নির্জীব অভিব্যক্তিহীন চোখ দু’টোই তার অশুভ শক্তির আস্ফালন।
নির্বিকারে লোকটা এগোলো সম্মুখে, তার প্রতিটি নৈঃশব্দ্যিক পদচারণায় ক্রমশ স্তব্ধ হয়ে এলো শ্বাসপ্রশ্বাস। ওদিকে থমথমে এই আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি মোটেই গায়ে মাখলেন না রোকেয়া, রান্না ঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে এসে তিনি মুখোমুখি হলেন পৈশাচিক অস্তিত্বের, চারিপাশ অবলোকন করে ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন,

— কে আপনারা? আমার ঘরের দরজায় গু’লি মা’রার সাহস হয় কি করে আপনাদের? দেশে কি আইনকানুন নেই নাকি? নাকি আপনারা পৃথিবীতে নতুন ? আদব কায়দা কিচ্ছু জানেন না। যান,এক্ষুণি বেরিয়ে যান, নয়তো পুলিশ ডাকবো আমি।
রোকেয়ার কথায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করলো না মাফিয়া বস। একবার তাকানোর ও প্রয়োজন বোধ করলো না ভদ্রমহিলার পানে। দায়সারা বদনে অগ্রসর হতে লাগলো সম্মুখে। ঠিক তখনই পেছন থেকে ফের কর্কশ স্বরে চ্যাঁচিয়ে উঠলেন রোকেয়া প্রাচী,
— অনুমতি ছাড়া আমার ঘরে ঢুকেছেন, আবার দোতলায় যাচ্ছেন, সাহস তো কম নয়।
থমকালো মাফিয়া বস, স্থবির চিত্তে দাঁড়িয়ে গেলো সেখানে, অতঃপর পেছনে না ঘুরেই সিঁড়ির পার্শ্ববর্তী পদ্মাসন গেড়ে থাকা বিশাল ফ্লাওয়ার ভাজটিতে লা’ত্থি হাঁকালো সজোরে। তীব্র ক’ষাঘা’তে রোকেয়ার থেকে মাত্র কয়েক সেন্টিমিটারের দূরত্বে গিয়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে আঁচড়ে পরলো সেটি। অকস্মাৎ ঘটনায় ধড়ফড়িয়ে উঠে কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন রোকেয়া। তৎক্ষনাৎ পেছন থেকে তার মস্তিষ্ক বরাবর রিভলবার তাক করলো আরেকজন। মাথার উপর ব’ন্দুকের নলের স্পষ্ট উপস্থিতি অনুভব হতেই কলিজার পানি শুকিয়ে কাঠ গেলো ভদ্রমহিলার, চকিতে হাঁসফাঁস করে ঘাড় ঘোরাতে চাইলেন তিনি। তবে ব্যর্থ হলেন, তার আগেই পেছন থেকে ভেসে এলো কঠোর এক নিষেধাজ্ঞা,

— খবরদার, এক ইঞ্চি ঘাড় ঘোরালেই ট্রিগারে হাত চালাবো।
আতঙ্কে পুরোপুরি স্তম্ভিত হয়ে পরলেন রোকেয়া। ফলস্বরূপ ঘাড় ঘোরানোর কোনোরূপ স্পর্ধা না দেখিয়ে জীবন্ত পুতুল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন নির্বিকারে।
ওদিকে সিঁড়ির অভিমুখে অগ্রসর হতে গিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে ঊষার পানে দৃষ্টিপাত করে এরীশ। ভয়ানক লোকটার নির্জীব চাহনিতে থরথর করে কেঁপে ওঠে ভীতু ঊষা। সেসবে কোনোরূপ তোয়াক্কা না করে অভিব্যক্তিহীন গভীর স্বরে এরীশ বলে,
— ঈশানীর ঘরটা কোন দিকে?
কাঁপতে কাঁপতে আঙুল উঁচালো ঊষা, প্রবল আতঙ্কে কণ্ঠনালির আওয়াজটুকু পুরোপুরি লোপ পেয়েছে তার, সহসা কেবল তর্জনী দ্বারা ইশারায় বুঝিয়ে দেয় লোকটাকে।

ঘরের দরজাটা হাট করে খোলা,যার দরুন ঘরের বাইরে থেকেই মেঝেতে ভেঙেচুড়ে পরে থাকা চেতনাহীন মেয়েটাকে দেখে পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গেলো মাফিয়া বস। নিস্ক্রিয় জলন্ত হৃদয়ের ঠিক মাঝ বরাবর বিদ্ধ হলো অদৃশ্য এক ধারালো খ’ঞ্জর। অচিরেই থমকে গেলো নিঃশ্বাস। ঘরের দিকে যত এগিয়ে যাচ্ছে, ততই যেন প্রবল অস্থিরতা গ্রাস করছে অন্তঃকরণ। ভেতরের পৈশাচিক সত্তাটা বিদ্রুপ করে বলছে,
— তোর জন্যই হয়েছে এসব। শুধু শুধু পবিত্র এই সত্তাটাকে নিজের কালো অস্তিত্বের সঙ্গে না জড়ালেও হতো ।
বরাবরের মতোই বেপরোয়া মাফিয়া বস,শুনলো না অন্তরের বাঁধা। বেগবান চিত্তে এগোলো সম্মুখে। জোর কদমে নয়, ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ পদযুগলে এগিয়ে গিয়ে হাঁটু ভেঙে বসলো মেঝেতে।ঠিক সাকুরার মুখোমুখি হয়ে।পরপরই দু’হাত বাড়িয়ে তুলতুলে নাজুক শরীরটাকে সন্তোর্পনে তুলে আনলো ইস্পাত কঠিন বক্ষমাঝে। খসখসে পুরুষালি হাতে নরম শরীরটাকে আঁকড়ে ধরে অত্যন্ত কাতর স্বরে বিড়বিড়ালো,

— প্রেম আমার।
এতো যন্ত্রণা, এতো ভৎসনা, এতো অবহেলার মাঝেও একটুখানি উষ্ণ আলিঙ্গনের শরীরটা সচল হয়ে উঠলো রুগ্ন মানবীর। কোনোমতে চেতনা ফিরে এলে নিভু নিভু নয়নজোড়া মেলে সামনে তাকালো মেয়েটা। ঝাপসা, অস্পষ্ট দৃশ্যপটে ভেসে উঠলো পিয়ার্সড করানো চিরচেনা সেই ধূসর বাদামি শূন্য অক্ষিযুগল।সঙ্গে সঙ্গে দু’হাত বাড়িয়ে মাফিয়া বসের গ্রীবাদেশ জড়িয়ে ধরে সাকুরা, শুষ্ক অধর নাঁড়িয়ে রিনরিনে আওয়াজে ডেকে ওঠে,
— অরণ্য।

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩৭

কাউকে স্বস্তি কিভাবে দিতে হয় জানা নেই এরীশের। কারণ ওর উপস্থিতি বরাবরই সর্বসাকুল্যের অস্বস্তির কারণ । তবুও এই মূহুর্তে নিজের হৃদয়হীন অস্তিত্বকে বেমালুম ভুলে গেলো মাফিয়া বস। অচিরেই ঝুঁকলো নিজের প্রেমিক সত্তার নিকট, নিজেকে খানিক সাবলীল বানানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে মেয়েটার পৃষ্ঠদেশে স্নেহের করতল বুলিয়ে নিগূঢ় নির্লিপ্ত গলায় বলে উঠলো,
— এই তো আমি, তোমার কাছেই আছি। আর কেউ কষ্ট দিতে পারবে না তোমাকে। জাস্ট নো ওয়ান।

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩৯