আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩৯

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩৯
suraiya rafa

সূর্যের তেজ নিস্ক্রিয়, আকাশ জুড়ে ধূসর মেঘের উদ্ভাসন। খানিকবাদে বাদে দিবালোকের দিগন্তে তেরছা হয়ে প্রস্ফুটিত হচ্ছে বিজলির উজ্জ্বল দ্যুতি, পরপরই বজ্রপাতের প্রকম্পনে ভাঙছে আকাশ। হুট করেই মর্জি পাল্টে হাস্যোজ্জল প্রকৃতি যেন ধারণ করেছে এক বি’ধ্বংসী দানবীয় রূপ।
ঈশানীদের দোতলা বাড়ির আবহও তার ব্যতিক্রম নয়, একদল রাশিয়ান মাফিয়া সৈন্যদের সশস্ত্র অবস্থান যেন হুট করেই পাল্টে দিয়েছে চিরাচরিত বাসস্থানের স্বকীয়তা। থমথমে গুমোট চারিপাশ। যেন পরাক্রমশালী নির্ভীক সম্রাটের অশুভ আগ্রাসনে ধরাশায়ী ভূখণ্ড। এক পা এদিক ওদিক হলেই আরম্ভ হবে হ’ত্যাযজ্ঞ, র’ক্তাভ লালিমায় প্লাবিত হবে ধরিত্রী।

ঘন্টার পর ঘন্টা মূর্তিমান হয়ে সবস্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন রোকেয়া প্রাচী। কোনো এক অযাচিত আশঙ্কায় বিন্দু বিন্দু ঘামে সিক্ত হয়েছে তার উজ্জ্বলাভ গমরঙা ললাটদেশ।মাথার অগ্রভাগে রিভলবারের নলের সুস্পষ্ট অস্তিত্ব । যার দরুন শারীরিক নড়াচড়া তো দূরে থাক ঠোঁট নাঁড়িয়ে সামান্য কোনো বাক্য নির্গমন করার ও স্পর্ধা হয়নি তার।
বসার ঘরের অপর প্রান্তের সোফায় মুখ কাঁচুমাচু করে নির্বিকার বসে রয়েছেন দেবোরা,তার কুচকাঁনো চামড়ার আড়ালে ঢাকা পরে যাওয়া ঝাপসা টলমলে নয়ন জুড়ে কুণ্ঠার আস্ফালন। যদিও দেবোরার মাথায় বন্দুক ঠেকায়নি কেউই, দু’জন কালো পোশাক ধারী এসে দু’পাশে দাঁড়িয়েছে শুধু। তবুও মেয়ের এহেন ধরাশায়ী পরিস্থিতি তার বুদ্ধিদীপ্ত অন্তরটাকে কাঁপিয়ে তুলছে ক্ষণে ক্ষণে।
শুনশান নীরবতায় আশঙ্কার পারদ বেড়েই চলেছে ক্রমাগত, রোকেয়ার মস্তিষ্কে রিভলবার ধরে রাখা অবস্থাতেই দোতলায় দৃষ্টিপাত করে আছে তুষার, তার তীর্যক চাহনি ঈশানীর ছোট্ট ঘরের পানে নিবদ্ধ। মূহুর্তটা রহস্যময়,সেই সঙ্গে আশঙ্কা জনক। এরীশ ইউভানের ভরসা নেই, তার বি’ধ্বং’সী প্রতিক্রিয়া যে প্রলয়ের চাইতেও বহুগুণ মারাত্মক।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— আরে আরে! এসব কি ?
বহুক্ষণের ভয়াবহ নিস্তব্ধতার ভাঙন ধরলো আচানক। এক সুকণ্ঠী রমণীর চঞ্চল আওয়াজে সুডৌল কপালখানি মূহুর্তেই বেঁকে গেলো মূর্তিমানবের, মুখাবয়ব জুড়ে প্রগাঢ় হলো থমথমে অভিব্যক্তি, চকিতে ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে দৃষ্টিপাত করলো সে। তার দৃষ্টি অনুকরণ করেই তরতরিয়ে ঘরের পানে অগ্রসর হলো নিঝুম। মাথার চুল, কাঁধের টোট ব্যাগ থেকে শুরু করে সমগ্র শরীরে তার ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ছাট। সেসবে বিন্দু পরিমাণ তোয়াক্কা না করে, তুষারের কুঁচকানো ললাটদেশে কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মেয়েটা, গলার আওয়াজে দৃঢ়তা টেনে ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো,

— কি করছেন আপনি এসব? কিভাবে একজন বয়জেষ্ঠ মানুষের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে রেখেছেন? আপনার কোনো মানবতা নেই?
দৃষ্টি ঘুরিয়ে দাঁতে দাঁত পিষলো তুষার, বিরক্তির স্বরে আওড়ালো,
— এসে গেছে মিস পকর পকর।
শব্দ কটা অস্পষ্ট হলেও শুনতে বিন্দু পরিমাণ অসুবিধা হলোনা নিঝুমের।ফলস্বরূপ তৎক্ষনাৎ প্রত্যুত্তরের সহিত ধ্বনিত হলো,
— আপনি কি তূর্য ভাইয়ের কাছ থেকে ট্রেনিং নেন নাকি? কিন্তু উনিতো সুপারস্টার মাহিনের এসিসট্যান্ট আর আপনি তো দেখছি জলজ্যান্ত এক ভিলেইন। কথা নেই বার্তা নেই যার তার কপালে বন্দুক ঠুকে দিচ্ছেন।
এমন একটা উদ্বেগপূর্ণ মূহুর্তে মেয়েটার শিশুসুলভ কোনো কথাই কর্ণগোচর হলোনা তুষারের। উল্টো ভীষণ বিরক্ত হয়ে দাঁতে দাঁত পিষলো সে। তিরিক্ষি আওয়াজে বলে উঠলো,

— জাস্ট শাট আপ! যেখান থেকে এসেছো সোজা ঘুরে সেখানে ফিরে যাও, কুইক।
— ফিরে যাবো মানে? আপনি আন্টির মাথা থেকে বন্দুক সরান আগে, হেয়ালি পেয়েছেন নাকি?
ঘাড় ঘুরিয়ে নিঝুমের পানে পূর্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তুষার। কুচকুচে কালো নেত্রগহ্বরে অকৃত্রিম অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ধরে রেখে অত্যন্ত রূঢ় স্বরে বললো,
— দিস ইজ মাই প্রফেশন। আমার কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে চাইলে বু’লেট বিদ্ধ করে তোমার ওই ছোট্ট মস্তিষ্কটা উড়িয়ে দিতেও দু’বার ভাববো না আমি।
কিছুটা কৌতুহল আর অনেকটা আশঙ্কায় হতচকিত হয়ে ওঠে দু’নয়ন। শুষ্ক একটা ঢোক গিলে বিহ্বলিত স্বরে নিঝুম শুধায়,
— প্রফেশন মানে? কে আপনি?
আশ্চর্য দৃষ্টে ঘরের চারিদিকে একপল চোখ বোলালো নিঝুম। ঘরময় কালো পোশাকধারী সশস্ত্র বাহিনীর অস্তিত্ব। যাদের দৃষ্টিতে ঘনীভূত হয়েছে অদ্ভুত অশুভ আগ্রাসন।ফের শুষ্ক ঢোক গলাধঃকরণ করে অস্ফুটে ঠোঁট নাড়ালো মেয়েটা,

— আপনি কি সত্যিই?
— ভিলেইন!
তুষারের প্রত্যুত্তরে চুপসে যাওয়া হৃদযন্ত্রটা ছলকে উঠলো অকস্মাৎ। মাত্রাতিরিক্ত কুণ্ঠায় এলোমেলো হয়ে নেতিয়ে গেলো অনুভূতির মাতন। অধর গলিয়ে বেড়িয়ে এলো অভিমানী কণ্ঠস্বর,
— কিন্তু আপনি এখানে কি করছেন? আর ঈশু কোথায়?
— এখানে কেন এসেছো ?
উল্টো প্রশ্ন ছুড়লো তুষার, ভীতিকর স্বরে নিঝুম জানালো,
— বেশ কিছুদিন হলো ঈশু মার্কেটে যাচ্ছে না, ওর ফোনটাও বন্ধ। তাই খোঁজ নিতে এসেছি।
মেয়েটার নির্লিপ্ত স্বীকারোক্তি এক মূহুর্ত ভাবালো তুষারকে। অচিরেই তার বুক চিঁড়ে বেড়িয়ে এলো ভারী এক গুমোট দীর্ঘশ্বাস। তুষারের বেমালুম নীরবতায় কিয়ৎক্ষণের সংকীর্ণতার ইতি ঘটালো নিঝুম। খানিক আগ বাড়িয়ে ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠলো ,

— আপনি প্লিজ বন্দুক টা নামান, আন্টিকে আতঙ্কিত দেখাচ্ছে। দেখুন এই ঠান্ডা আবহাওয়ার মাঝেও ওখানে দরদরিয়ে ঘামছেন নানী।
নিঝুমের ইশারা অনুসরণ করে দেবোরার পানে দৃষ্টিপাত করে তুষার, কুণ্ঠিত বৃদ্ধাকে দেখেও ভাবলেশহীন নির্দয় তার অভিব্যক্তি। একই ভঙ্গিমায় ঘুরে তাকালো ফের, জড়োসড়ো আড়ষ্ট চাহনিটুকু নির্দ্বিধায় এরিয়ে গিয়ে, কেবল থমথমে আওয়াজে উচ্চারণ করলো,
— ইডিয়ট!

প্রত্যুত্তরে নিঝুম কিছু বলবে তার আগেই সকলের দৃষ্টি ভেদ করলো অজ্ঞাত এক দৃশ্যপট। দোতলার সিঁড়ি ভেঙে নিস্তব্ধ কদমে আগমন ঘটালো মাফিয়া বস। তার শক্ত পেশিবহুল বাহু দুটো অতি সন্তোর্পনে আঁকড়ে ধরে রেখেছে নাজুক রমণীর ছোট্ট অসার শরীরটাকে। মাস্ক পরিহিত লোকটার প্রসস্থ বক্ষ মাঝে ভেঙেচুরে পরে আছে চেতনাহীন ঈশানী। অরণ্যকে আগে কখনো দেখেনি নিঝুম যার দরুন খেয়াল করলো না বিশেষ। আপাতত ওর পূর্ণ মনোযোগ স্থির হয়েছে অবচেতন মেয়েটার রুগ্ন শরীরখানিতে। শরীরে ওড়নার উপস্থিতি নেই, জুতা বিহীন মোম নরম ফর্সা পাদু’টোতে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ সুস্পষ্ট ।
ঈশানীর এহেন নিদারুণ নির্জীবতায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো নিঝুম। অহেতুক ভাবনায় সময় অতিবাহিত না করে দ্রুত পদযুগলে সামনে অগ্রসর হলো মেয়েটা। অক্ষি গহ্বরে আকাশসম দুশ্চিন্তা ধরে রেখে অস্ফুটেই ডেকে উঠলো প্রাণের বান্ধবীকে,

— ঈশু!
দিশাহীন চিত্তে দু’কদম এগুতে গিয়েও সরু কব্জিটাতে সুক্ষ্ম পিছুটান অনুভূত হওয়ার দরুন আচানক থমকে গেলো পদধ্বনি। খসখসে এক পুরুষালি করতল পাঁচ আঙুলের প্রগাঢ় বাঁধনে প্যাঁচিয়ে রেখেছে কব্জিটা। ঘটনার আকস্মিকতায় পেছনে চাইলো নিঝুম,অবলোকন করলো মূর্তিমান মানবটির দ্বিধাহীন অভিব্যক্তি। অযাচিত এই স্পর্শটুকু অনুভূতির ঝড় তুললো বক্ষপিঞ্জরে। কয়েক মূহুর্তের জন্য পারিপার্শ্বিক সকল টানাপোড়েনের ইস্তফা ঘটিয়ে ভালোলাগায় বুদ হলো অন্তঃকরণ। অজান্তেই একফালি লাজুক হাসির উদয় হলো ঠোঁটের কোণে । ঠিক সেই মূহুর্তে আচানক প্রকটিত বেনামি ভালোলাগার ইতি ঘটালো তুষার। টানটান রুক্ষ আওয়াজে কঠোর আদেশ ছুড়ঁলো সে,
— ডোন্ট মুভ।

ভাঙলো মতিভ্রম, তুষারের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ফের আগন্তুকের পানে চাইলো নিঝুম। ইতিমধ্যে দরজার সন্নিকটে চলে এসেছে মাফিয়া বস। বরফের ন্যায় শীতল অভিব্যক্তিহীন শূন্য তার ধূসর বাদামি নেত্রগহ্বর। সুদর্শন দৃষ্টির গহীনে কোমলতা কিংবা মাধুর্যতা দু’টোই অনুপস্থিত। আকর্ষনীয় নেত্রজুড়ে কেবলই পাষবিকতার ধ্বং’সা’ত্মক আগ্রাসন।অথচ তার বাহুডোরে আবদ্ধ এক তুলতুলে নারী শরীর। অতি আহ্লাদী সেই স্পর্শ, যেন বাহু মাঝে ভীষণ আদুরে এক ননিরপুতুল আগলে রেখেছে মাফিয়া বস।

মেয়েটাকে নিয়ে সামনে এগুতে এগুতে নির্বিকারে চোখ দ্বারা কিছু একটা ইশারা করলো এরীশ। তার তীর্যক ইশারায় অক্ষিপুটে পলক ছেড়ে রোকেয়ার মাথা থেকে রিভলবার সরালো তুষার। ওয়েষ্ট ব্যান্ডে সেটাকে গুঁজতে গুঁজতে গার্ডদের অ’স্ত্র নামানোর আদেশ করলো সে। এদিকে বিন্দু মাত্র ঘটনা আঁচ করতে না পেরে নীরব দর্শকের ন্যায় সকলকে নিগূঢ় দৃষ্টে পরখ করে চলেছে নিঝুম।

দরজার অভিমুখে পা রাখতে না রাখতেই পেছন থেকে গর্জে উঠলেন রোকেয়া,
— আমার মেয়েকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?
বিলীন হলো নৈঃশব্দ্য, বিনা পূর্বাভাসে থমকালো মাফিয়া বস। তার স্তব্ধ পদযুগল অনুসরণ করে জলদি এগিয়ে এসে পুনরায় পথরোধ করলেন রোকেয়া। ওই অশুভ অক্ষিগহ্বর দু’টো নিদ্বিধায় উপেক্ষা করে ছুঁড়লেন তেজস্ক্রিয় ক্রুদ্ধধ্বনি,
— গুন্ডামী করে, বন্দুক হাঁকিয়ে আমার মেয়েকে আমার বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, আমি কিন্তু পুলিশকে জানাতে একবারও পিছপা হবো না।
অকস্মাৎ চড়াৎ করে উঠলো মস্তিষ্ক, ফলস্বরূপ কোনোরূপ জবাবদিহিতা ব্যাতিত ভদ্রমহিলার হৃদপিণ্ড বরাবর পেছন থেকে রিভলবার চালাতে উদ্যত হয় তুষার, তার আগেই শীতল ভঙ্গিমায় গ্রীবা ঘোরালো মাফিয়া বস। অস্তিত্বহীন নির্জীব শূন্য তার অভিব্যক্তি। দানবীয় পরাশক্তির ন্যায় জলন্ত দু’নয়ন, যেন সদ্য উদগীরিত আগ্নেয়গিরির দাবানল।
লোকটার আঁধার কালো চাহনিতে অন্তরাত্মা খামচে উঠলো রোকেয়ার। সে ভড়কালো, পেছন থেকে মেয়ের উদ্দেশ্যে আঞ্চলিক বাক্যে হাঁক ছাড়লেন দেবোরা,

— বেশী নো বুজিস মাইয়াফুয়া, ইতেরারে যাইতো দে, নিজে বাঁচিলে, বা’র নাম।
(বেশি বুঝিস না মাইয়া, ওগরে যাইতে দে, নিজে বাঁচলে বাপের নাম।)
এতোক্ষণে মাফিয়া বসের কণ্ঠনালি ভেদ করলো বাক্যবহর, ধ্বনিত হলো নির্জীব গুরুগম্ভীর আওয়াজ,
— পুলিশ কেন,পুরো পৃথিবীর সকল ফোর্সকে একসাথে খবর দিয়ে পাহাড় সমান বেরিগেড তুললেও এরীশকে আটকানোর দুঃসাহস কারোর নেই।
কথাটুকু শেষ করে লম্বা পা ফেলে দরজার সামনে অগ্রসর হলো মাফিয়া বস, কিঞ্চিৎ ধরাশায়ী কণ্ঠে রোকেয়া বলে উঠলেন,

— আমার মেয়েকে এভাবে তুলে নিয়ে যাওয়ার কোনো অধিকার নেই আপনার।
ভদ্রমহিলার কথায় নূন্যতম প্রতিক্রিয়া দেখালোনা এরীশ। হনহনিয়ে বেড়িয়ে গেলো ঘর থেকে। তবে লনের কাছে যেতেই কি ভেবে যেন জিভের ডগায় গাল ঢেললো সে। অতঃপর পেছনে ঘুরে রোকেয়ার পানে ধারালো দৃষ্টিপাত করে শেষবারের মতো উচ্চারণ করলো,
— শুধু মাত্র এই একটা কারণে বেঁচে গেলেন! নয়তো এই শরীরে করা প্রতিটি আ’ঘাতের বিনিময়ে আপনাকে নরক দর্শানোর ইচ্ছে ছিল আমার।
আতঙ্কে সমগ্র শরীর শিউরে উঠলো রোকেয়ার। আটকানো তো দূরে থাক, মুখ ফুটে আর একটি কথাও উচ্চারণ করার স্পর্ধা হলোনা তার। কেবল জীবন্ত পুতুলের ন্যায় সিক্ত নয়নে অবলোকন করে গেলেন মাফিয়া বসের রুষ্ট পদচারণ।
সাইকোলজি বলে, সবচেয়ে অবহেলিত মানুষটার জন্যেও পৃথিবীর কোথাও না কোথাও এমন কারোর অস্তিত্ব রয়েছে , যার উদ্ভবই কেবল ওই অবহেলিত মানুষটাকে উন্মাদের ন্যায় ভালোবাসার জন্য। হোক সে বাস্তবতা কিংবা কোনো নিষিদ্ধ মরীচিকা।

নিস্তব্ধ সড়কে বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শাঁই শাঁই আওয়াজ তুলে এগিয়ে চলেছে রয়েল ব্লু থীমের রোলস রয়েস খানা। উর্ধ্বগামী বিলাসবহুল গাড়িটির পিছু নিয়েছে আরও গোটা দশেক কালো মার্সিডিজ। রোলস রয়েসের লিডারশীপ অনুকরণকারী প্রতিটি গাড়ির নিগূঢ় পর্যবেক্ষণই বলে দেয় তারা বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন। যেন তুষার আবৃত জঙ্গলে রাজত্ব চালিয়ে বেড়ানো বিশাল নেকড়ে প্যাক, যাদের একমাত্র কাজ হলো আলাফাকে অনুসরণ করা।
লোকালয়ের পথ ছাড়িয়ে সুবিস্তৃত পাহাড়ি হাইওয়ে ধরতেই পথিমধ্যে হঠাৎ ব্রেক কষলো রোলস রয়েস। তৎক্ষনাৎ একেএকে চাকার ঘর্ষনে বিকট আওয়াজ তুলে হার্ড ব্রেক টানলো সবগুলো মার্সিডিজ।

ঝমঝমে বারিধারায় মুখরিত ধরণি। গ্লাস ওয়াইপার টা চালু রেখেই গিয়ারে হাত চালালো এরীশ। গাড়ির চাকা পুরোপুরি স্থির হয়ে এলে, ঘাড় ঘুরিয়ে নির্লিপ্তে দৃষ্টিপাত করলো প্যাসেঞ্জার সিটে। এখনো চেতনা ফেরেনি মেয়েটার। টলমলে নিয়ন্ত্রণহীন মাথাটা অবলীলায় এলিয়ে পরেছে ব্যাকসিটে। ফ্যাকাসে বর্ণের নির্জীব মুখখানা কিয়ৎক্ষন নীরবে অবলোকন করে অচিরেই দু’জনার মাঝে সংকীর্ণতা বাড়ালো মাফিয়া বস। এক টানে নিজের অনেকটা সন্নিকটে নিয়ে এলো সাকুরাকে,পরপরই নির্দ্বিধায় হাত বাড়ালো সরু গলার মাঝে, ছোট ছোট কালচে ক্ষ’ত গুলোতে অনুভূতিহীত আঙুলের প্রলেপ বুলিয়ে তরতর করে খুলে ফেললো গলার কাছের দু দু’টো বোতাম।

কাঁধের দু’পাশ থেকে কাপড়ের আচ্ছাদন সরে যেতেই বেড়িয়ে এলো হাজারটা দগদগে ক্ষ’তচিহ্ন। গমরঙা ফর্সা পেলব ত্বক জুড়ে কেবলই তীক্ষ্ণ আ’ঘাতের পা’ষবিকতা। তুলতুলে নমনীয় শরীরের ভাঁজে এরূপ আ’ঘাতের উপস্থিতি মূহুর্তেই হিং’স্রতা জাগিয়ে তুললো ব্লাডি মন্সটারের অন্তরে। বুকের র’ক্ত তোলপাড় করা অস্থিরতায় একের পর পাঞ্চ বসাতে শুরু করলো গাড়ির ফ্রন্ট মিররে, অচিরেই ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হলো স্বচ্ছ কাঁচের আস্তরণ। ক্রোধে ফেটে পড়ে নতুন উদ্যমে গাড়ি কাঁপিয়ে নিক্ষিপ্ত করলো দানবীয় এক বিকট হুংকার,
— নিজের বাড়িতে এভাবে দিনের পর দিন অ্যাভিউস হয়েছো, আগে কেন বলোনি আমায়? হোয়াই! হাউ উইল আই টলারেট দিস পেইন নাও?
প্রবল আগ্রাসনে ফের গ্রীবা ফিরিয়ে বলিষ্ঠ করতলে অবচেতন ঈশানীর চিবুক ঝাঁকিয়ে উঠলো মাফিয়া বস। দাঁতে দাঁত পিষে হিসহিসালো,
— ইওর ওউন্ড আর বার্নিং মাই চেষ্ট।

নির্বিকার সাকুরা। মেয়েটার চেতনাহীন নিস্তব্ধতা ক্রমশ উন্মাদ করে তুলছে এরীশকে।প্রচন্ত ক্রোধে মাথাচাঁড়া দিয়ে উঠছে পৈশাচিকতা। মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে,অন্তরের যাতনায় আবারও কিছু বলবে, তার আগেই কিঞ্চিৎ আওয়াজ তুলে কেঁপে উঠলো গাড়ির ড্যাশবোর্ডে রাখা ওয়াকিটকিটা, আচানক আওয়াজে মতিভ্রম কাটলো এরীশের, কাঁধ সটান করে যন্ত্রটি হাতে তুলে নিতেই বিপরীত প্রান্ত থেকে ভেসে এলো তুষারের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর,
— ইজ এভরিথিং ওকে?
আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো এরীশ, নিচু স্বরে প্রতিক্রিয়া করলো,
— হু।
পরপরই লস হলো কানেকশন। বিরক্ত হয়ে ওয়্যারলেস যন্ত্রটিকে ব্যকসিটে ছুড়ে ফেললো এক ঝটকায় । কষ্ট কিভাবে প্রকাশ করতে হয় জানেনা এরীশ । রুক্ষ হৃদয়টা যে তীব্র যাতনায় কাতরাচ্ছে সেটাও বোধ হয় বোধগম্য নয় ওর। সহসা টালমাটাল চিত্তে গ্রীবা বাঁকিয়ে অবচেতন মেয়েটার উন্মুক্ত ত্বকের ভাঁজে নির্বিকারে অধর ছোঁয়ালো মাফিয়া বস ।প্রতিটি কালচে ক্ষ’ততে আদর মাখানো শুষ্ক ওষ্ঠপুটের নিগূঢ় প্রলেপ বুলিয়ে নীরবে কানের কাছে এসে স্থির করলো নেত্রদ্বয়। সাকুরার রেশমের মতো সিল্কি চুলের মাঝে খরখরে পুরুষালি আঙুলগুলো গুলো প্রতিস্থাপন করে শীতল আওয়াজে হিসহিসিয়ে বলে উঠলো ব্লাডি মনস্টার,

— আমি জানি তুমি ঠিক নেই। এই মূহুর্তে এটা করা অনুচিত, অন্যায়।
ভারী তপ্তশ্বাসের জের ধরে কিয়ৎক্ষন নীরবতা। পরপরই ধ্বনিত হলো মাদকীয় এক গভীর হাস্কিস্বর,
— বাট ইউ নো আ’ম হার্টলেস, নিষিদ্ধ জিনিস বরাবরই আকৃষ্ট করে আমাকে।
বাক্যটুকু শেষ করে আঙুলের বাঁধনে দৃঢ়তা টানলো এরীশ। অবচেতন মানবীর শুকিয়ে যাওয়া মুখশ্রীখানা অনেকটা কাছাকাছি এনে কুসুম কোমল ওষ্ঠাধরের মাঝে ডুবলো নির্দ্বিধায়। রক্তিম নমনীয়তার মাঝে ক্রমশ বিলীন হতে লাগলো নিষ্ঠুর পরাশক্তিধর রুক্ষ বেসামাল অধরযুগল।উদ্ভব ঘটলো নিষিদ্ধ বাসনার, ক্রমান্বয়ে প্রগাঢ় হলো অভিলাষ। উথাল পাথাল অনুভূতির তোড়নে টিমটিমিয়ে নিভে এলো বিদ্ধ হৃদয়ের মন্থর যাতনা। যার দরুন উপচে পড়া অমৃতসুধার অনলে দলিতমথিত হয়ে প্রেমানলের প্লাবনে অচিরেই বানভাসি হলো দু’টো একাগ্রতচিত্ত।

রয়েল ক্যারাভিয়ান, কক্সবাজার।
ব্ল্যাকহোলের নিকটবর্তী বন্দরে অবস্থিত আকাশচুম্বি এক ব্ল্যাক ক্রুজশীপ। গভীর জলরাশি দ্বিখণ্ডিত করে সমুদ্র বুকে বয়ে চলা একটুকরো রাতের শহর যেন এই রয়েল ক্যারাভিয়ান। অসংখ্য তলা বিশিষ্ট বিশালাকৃতির এই যুদ্ধ জাহাজের সর্বোচ্চ চূড়ায় পতপত করে উড়ছে bratva খচিত দু’টি কুচকুচে কালো পতাকা।
কক্সবাজার বন্দর সীমানা ছাড়িয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে নিশ্চল গতিতে এগিয়ে চলেছে জাহাজটি। উপত্যকা থেকে দূরত্ব খুব বেশি না হলেও ক্রুজশীপের অভ্যন্তরে দাঁড়িয়ে স্থলসীমান্ত অবলোকন করা পুরোপুরি অসম্ভব। সমুদ্রপৃষ্ঠের একপার্শ্বে ধূ ধূ বালুচর, আর বাদবাকি তিন দিকেই কিনারা বিহীন অগাধ জলরাশির উপাখ্যান। জাহাজের ভেতরের দিকটা বেশ সুসজ্জিত। মাফিয়া বসের জন্য বরাদ্দকৃত প্রতিটি কামরায় সুবিস্তীর্ণ ভেলভেট গালিচার আস্তরণ, মাথার উপর দফায় দফায় ঝুলে আছে এ্যান্টিকের ঝাড়বাতি আর হ্যাজাকের বহর। কক্ষের প্রতিটি কোণে কোণে বিচরণ করছে ওয়াইল্ড জেসমিনের বিমোহিত সুঘ্রাণ। এছাড়াও লাউঞ্জ, ক্যান্টিন,বার,সুইমিং পুল, শপিং মল,থিয়েটার, একাধিক মাস্টার বেডরুম থেকে শুরু করে সিক্রেট কামরা এবং আন্ডারগ্রাউন্ডের আলাদা আলাদা সেকশনে বিভক্ত প্রতিটি তলা। এক কথায় গভীর সমুদ্রপৃষ্টে বিচরণ করা সত্ত্বেও আভিজাত্য আর নান্দনিকতার অশেষ বৃত্তান্ত যেন এই রয়েল ক্যারাভিয়ান।

পুরো একটা দিন কেটে গেলো ঈশানীর নিস্তব্ধ অবচেতনায়। রাতের দ্বিপ্রহরে হানা দিয়েছে তীব্র বর্ষন। ক্রুজশীপে ফিরে আসার পরে কোনো এক অজ্ঞাত কাজে সারাটা দিন ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেছে এরীশ। আর যখন কাজের ফাঁকে একটুখানি সময় বের করে ছুটে এসেছে সাকুরার নিকট ততক্ষণে চিকিৎসা শেষে মাস্টার বেডরুম থেকে বেড়িয়ে গিয়েছে মাফিয়া বসের একান্ত ব্যক্তিগত কার্ডিয়ালজিষ্ট ডাঃ মাতভেই। তার কিছুক্ষণ পরেই ডাঃ মাতভেই কে অনুসরণ করে কক্ষ থেকে প্রস্থান করলো তুষার। স্তব্ধ পদযুগলে সম্মুখে এগুলো এরীশ। পরনে তার ফর্মাল ব্ল্যাক সিল্ক শার্ট। চিরাচরিত আঁধার ঢাকা নির্জীব তার সুডৌল মুখাবয়ব, অস্থিরতায় দু’টো বোতাম খুলে রাখার দরুন চিসেলকাটের ন্যায় তীক্ষ্ণ বক্ষভাজের অঙ্গসৌষ্ঠব স্পষ্ট দৃশ্যমান। চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায় অতিব সুদর্শন যুবক সে।

আগন্তুক মাফিয়া বসের এলোমেলো সৌন্দর্যে নৈঃশব্দ্যে দৃষ্টি বোলালো তুষার। অতঃপর স্থবির চিত্তে দাঁড়িয়ে রইলো দরজার সন্নিকটে । তুষারের নিকট এগিয়ে এসে সর্বপ্রথম ঘরের ভেতর দৃষ্টিপাত করলো এরীশ, সফেদ রঙা কোমল বিছানায় ঘুমন্ত অপ্সরীর ন্যায় নির্লিপ্তে শুয়ে আছে নীলাম্বরী। স্যালাইন চলছে এখনো,দু’আঙুলের ভাঁজে ক্যানুলার উপস্থিতি তার। নাসারন্ধ্রে আঁটকে আছে নাজাল ক্যানুলা নামক বিশেষ অক্সিজেন সরবরাহক।
নিথর সাকুরাকে দেখতে দেখতেই মাফিয়া বসের অ’গ্নিদগ্ধ বুক চিড়ে বেড়িয়ে এলো ভারী এক দীর্ঘশ্বাস। এতোক্ষণে নীরবতা ভাঙলো তুষার, গভীর শ্বাস টেনে বললো,
— ডাঃ মাতভেই সকালে আবার আসবেন।
— কি বলেছে ডক্টর? ওর জ্ঞান কখন ফিরবে?
— অতি শীঘ্রই, তবে….
কথার মাঝে কৌতুহল পেশ করে থমকালো তুষার। তৎক্ষনাৎ ওর পানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করলো এরীশ, এক ভ্রু উঁচিয়ে গভীর স্বরে আওড়ালো,

— কিন্তু!
কিয়ৎক্ষন নীরব থেকে ফের তুষার বললো,
— মিস ব্লু আইডের হার্ট সামান্য দূর্বল। ফলে আকস্মিক কোনো ঘটনা কিংবা কোনো নিউজ, হোক সেটা জয়ফুল অথবা শকিং দু’টোতেই তার মাত্রাতিরিক্ত হার্টবিট ফাস্ট হওয়ার প্রবণতা রয়েছে, যার ফলস্রুতিতে অতি উত্তেজনা বশত অনেক সময় হার্টঅ্যা’টাক অথবা মিনি হার্টঅ্যা’টাকের সম্ভাবনা প্রকট।
— এর রিকোভারি কি?
ছোট্ট করে প্রত্যুত্তর করলো এরীশ। তুষার জানালো,
— এ ব্যাপারে ডক্টর কিছু বলেনি।
— ওকে, আমি জেনে নিবো।

মাফিয়া বসের শূন্য দু’নয়ন আটকে আছে ঘরের মাঝে। ধূসর বাদামিগহ্বর জুড়ে বেগবান অস্থিরতা। সেই দৃশ্য পর্যবেক্ষন করে তড়িৎ বাক্য ছুঁড়লো তুষার। অনুভূতিহীন গম্ভীর স্বরে আওড়ালো,
— আপনি ডেভিল এরীশ, আর ভেতরে যে শুয়ে আছে ওই মেয়েটা একটা এ্যাঞ্জেল। আপনাদের দু’জনার মাঝে আলোবর্ষ তূল্য দূরত্ব,এক মহাকাশসম বিঘ্নতা। মরীচিকা হয়ে কি করে ছোঁবেন প্রস্ফুটিত আলোকে? এতো বাঁধা পেরিয়ে কি করে আগলাবেন ওই পবিত্রতাকে? বিস্ট কখনো বিউটির হদিস পায় শুনেছেন?
— আমি সমগ্র পৃথিবীর বিরুদ্ধে লড়তে রাজি তুষার , তবুও সাকুরাকে ছাড়তে নয়।
ঈশানীর পানে নিগূঢ় দৃষ্টিপাত করে তীর্যক কণ্ঠে
প্রত্যুত্তর করলো এরীশ।

মাফিয়া বসের অনুভূতির দৃঢ়তায় থমকে গেলো তুষার। কথা বাড়ানোর সুযোগ হলোনা আর, ফলস্বরূপ ঘাড় ঘুরিয়ে প্রস্থান করলো নির্বিকারে। কারণ ও জানে, এরীশ যখন একবার ভেবে নিয়েছে সাকুরা তার, তারমানে সমগ্র পৃথিবী তোলপাড় করে হলেও সাকুরার পবিত্রতা সুরক্ষিত রাখার দ্বায়িত্বটাও তার।
বিনাবাক্যে বেশ অনেকটা পথ অতিক্রম করার পর অকস্মাৎ পিছু ডেকে ওঠে এরীশ। চেহারায় পেশাদারিত্বের কঠোর অভিব্যক্তি টেনে জিজ্ঞেস করে,

— রিয়ানার কোনো খোঁজ পেলে?
পেছন ঘুরে না সূচক মাথা নাড়ালো তুষার, হতাশাগ্রস্ত স্বরে জবাব দিলো ,
— এখনো না। তবে শীঘ্রই পেয়ে যাবো, স্পাই টীম কর্মরত।
অক্ষিপুটে পলক ছেড়ে নির্বিঘ্ন প্রতিক্রিয়া জানালো এরীশ। পরপরই তুষার বলে উঠলো,
— একটা প্রশ্ন করবো এরীশ?
— সিওর।
— হঠাৎ স্থলসীমান্ত ত্যাগ করে ক্রুজশীপে কেন শিফট করলেন?
তপ্তশ্বাস ছেড়ে পুনরায় অবচেতন মেয়েটার পানে দৃষ্টি ঘোরালো এরীশ। শীতল কন্ঠে জানালো,
— যখন তখন রাশিয়া ফিরতে হবে আমাকে, তাই রিক্স নিতে চাইছি না।
মাস্টার মাইন্ড তুষারের বুঝতে অসুবিধা হলোনা মাফিয়া বসের দুশ্চিন্তার কারণ।যার দরুন বোধগম্য অভিব্যক্তিতে মাথা নাড়িয়ে নির্বিকারে প্রস্থান করলো সে।

ওদিকে তুষার চলে যেতেই নীরব পদচারণায় কক্ষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো মাফিয়া বস। ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে গিয়ে বসলো চেতনাহীন সাকুরার শিয়রে,
শূন্য চোখে ভর করেছে তার এক সমুদ্র অনুভূতির তোড়ন,নির্দয় পা’ষবিক সত্তাটা গুটিয়ে গিয়েছে অন্তরে। বিনাবাক্যে নির্জীব শীতল হাতখানি অবাধে বিচরণ করলো মেয়েটার সুশ্রী কপোলে। এই নমনীয়তা, এই পবিত্রতা, এই নাজুকতাটুকু বারংবার দিশেহারা করে তোলে মাফিয়া বস টাকে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়,সহসা নিগূঢ় দৃষ্টে সাকুরাকে পরখ করতে করতেই তার কণ্ঠনালি ভেদ করলো বেখেয়ালি বাক্যবহর,

— ডেভিল এ্যাঞ্জেল, বিউটি বিস্ট কি আসে যায় এসবে? যখন কিনা হার্টলেস ডেভিলটার সমগ্র মহাকাল থমকে দাঁড়ায় ওই নীলগহ্বরের অনিন্দ্য অলীকে।
ওয়েল, মাফিয়া বসের হৃদয়টা বেঈমানী করেছে বটে, তবে ভুল করেনি কিছু। কারণ, নারী জাতির চাহনি যে কতটা ভয়ংকর সুন্দর আর রহস্যময়, যে পুরুষ তাতে ঘায়েল হয়েছে কেবল সেই উপলব্ধি করেছে এর ইন্দ্রজালিক অদৃশ্য পরাশক্তিকে।

সারাদিনের অক্লান্ত ব্যস্ততার ইতি টেনে রাতের শেষ প্রহরে নিজ কক্ষে প্রবেশ করলো তুষার। রুমে এসেই যান্ত্রিক শরীরটাকে এলিয়ে দিলো নরম তুলতুলে বিছানায়। অগনিত বার এপাশ ওপাশ করেও ঘুম আসছে না কিছুতেই, অক্ষিপুট মেলে আছে নিরলস। শেষ রাতে মেঘমালা কেটে গিয়ে গভীর সমুদ্রমাঝে তরঙ্গিত জাহাজের জানালা গলিয়ে পূর্ণিমার আলো প্রবেশ করছে অকপটে। দূর আকাশের প্রজ্জলিত ওই চন্দ্রালোক পর্যবেক্ষন করতে করতেই কি ভেবে যেন শোয়া ছেড়ে উঠে বসলো তুষার। হাতের কাছে ল্যাপটপ, ফোন, ওয়াকিটকি সহ আরও অনেক আধুনিক প্রযুক্তি থাকা সত্বেও, বিছানা ছেড়ে এগিয়ে গেলো এ্যানালগ ফ্যাক্স মেশিনটার নিকট । বাহ্যিক দিক দিয়ে যন্ত্রটি এনালগ হলেও প্রযুক্তির কল্যানে ফাইভ-জি ক্ষমতা সম্পন্ন দক্ষতা এর। যার দরুন স্মার্ট ফোনের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় যন্ত্রটির পারদর্শীতা। মাফিয়া পেন্টহাউজে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যমে এই ফ্যাক্স মেশিন,আন্ডারওয়ার্ল্ডের সবরকম গোপনীয় তথ্য আদান প্রদানে ব্যবহৃত হয় এটি। তাইতো পৃথিবী থেকে যন্ত্রটি বহু আগে বিলুপ্ত হলেও মাফিয়াদের নিষিদ্ধ জগতে এর কার্যক্রম আজও অবিরত।
প্রথমে হাঁটু ভেঙে ফ্যাক্স মেশিনটার সামনে গিয়ে বসলো তুষার, অতঃপর দ্বিধাগ্রস্ত আঙুল নাড়িয়ে টাইপ করতে শুরু করলো,

— বহুদিন হলো ফ্যাক্স পাঠাচ্ছো না, ঠিক আছো তো তুমি? ঠিক থাকলে আমার জামাকাপড় গুলো হ্যান্ডওয়াশ করে রোদে শুকিয়ে রেখো। এখানে ড্রায়ারে শুকোনো কাপড়চোপড় ব্যবহার করতে বড্ড ইরেটেটিং ফিল হয় আমার, তাইতো একটা পোশাক একবারের বেশি পড়তে পারছি না। আর হ্যা, রুম যাতে একদম অগোছালো না থাকে, খুব শীঘ্রই রাশিয়া ফিরছি।
পুরো ম্যাসেজ লেখা শেষ হলে, লেখাগুলো অবলোকন করে ঠোঁট কামড়ে অস্ফুট হাসলো তুষার। অতঃপর সেকেন্ডের মাথায় নিজের চিরাচরিত থমথমে সত্তায় ফিরে এসে, সেন্ড বাটনে ক্লিক করে জলদি পায়ে ফিরে গেলো বিছানায়।

পাইথন প্যারাডাইস, রাশিয়া।
সন্ধ্যা আকাশে চাঁদের আস্ফালন। শীতের তীব্রতা কমে এসেছে ইদানীং, যার দরুন প্রাণ ফিরে পেয়েছে তুষার আচ্ছাদিত নির্জীব জঙ্গলটা। বেড়েছে জংলা পশুদের আনাগোনা। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুউচ্চ পেন্টহাউজের প্রতিদি কাচের দেওয়াল ভেদ করে জঙ্গল ছাপিয়ে ধেয়ে আসছে নিশাচর প্রাণীকূলের নিরলস হাউলিং।
অন্যান্য দিন বন্য প্রাণীর হাউলিং ভেসে এলেই প্রতিটি দরজা জানালার কাঁচ লাগিয়ে দেয় ফ্লোরা। তবে আজ চিরাচরিত অভ্যেসে ব্যতিক্রম ঘটেছে কিছুটা। সকাল থেকে শরীরটা ভালো নেই ওর। জ্বর জ্বর লাগছে ভীষণ, ফলস্বরূপ সন্ধ্যা অবধি দরজা আটকে বিশ্রাম নিয়েছে নিজের ঘরে। তবে লাউঞ্জ থেকে ফ্যাক্স মেশিনটার ভাইব্রেট আওয়াজ হতেই আর শুয়ে থাকতো পারলো না রুশকন্যা।হৃদয়ের নাজুক উৎকণ্ঠায় উঠে পরলো ক্লান্তি ছাপিয়ে। কোনো মতে ফ্রকটা ঠিকঠাক করে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো উর্ধ্বশ্বাসে। কিন্তু লাউঞ্জের দৃশ্যপট আজ পুরোপুরি ভিন্ন, ঘুটঘুটে তমশাচ্ছন্ন চারিদিক, স্টাফদের উপস্থিত শূন্য। পুরোপুরি ফাঁকা পেন্টহাউজ। অকস্মাৎ এহেন বিরূপ আবহে ভ্রু কুঁচকালো ফ্লোরা। এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে আড়ষ্ট কদমে সম্মুখে এগোতে এগোতে রিনরিনে আওয়াজে হাঁক ছেড়ে ডাকলো মেয়েটা,

— সবাই কোথায়? কেউ নেই এখানে?
নিস্তব্ধ পেন্টহাউজের চার দেওয়ালে বাঁধা প্রাপ্ত হয়ে ফ্লোরার কথাই বারংবার প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো চারিপাশে। অন্ধকার ফাঁকা লাউঞ্জে নিজের কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনিতে নিজেই কম্পিত হয়ে উঠলো ভীত সন্ত্রস্ত মেয়েটা। ব্যতিগ্রস্ত হয়ে আলো জ্বালালোর প্রয়াসে তড়িঘড়ি করে ছুটলো সুইচবোর্ডের দিকে। তবে আগ্রাসী আঁধারের প্রগাঢ়তায় গুলিয়ে গেলো গতিপথ, বিস্তৃত আসবাবের সঙ্গে ধাক্কা প্রাপ্ত হয়ে পিছিয়ে এলো কয়েককদম, ঠিক সেই মূহুর্তে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অসাবধানতায় মেয়েটার পিঠ গিয়ে ঠেকলো পুরুষালি এক শক্ত শরীরের সান্নিধ্যে। ঘুটঘুটে তমশাচ্ছন্ন ঘরে অকস্মাৎ কারোর উপস্থিত অনুভব করে আতঙ্কে ধড়ফড়িয়ে উঠলো নাজুক চিত্ত । প্রচণ্ড ভয়ে কণ্ঠনালির আওয়াজ লোপ পেয়েছে পুরোপুরি, অগত্যা ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজে ধ্বনিত হলো,

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩৮

— ক….কে?
শরীরের খুব কাছে, কানের লতিকা স্পর্শ করে হিসহিসিয়ে অধর নাড়ালো আগন্তুক,
—- প্রিন্সেস!
পরপরই অনুভূত হলো ঠোঁট গলানো নৈঃশব্দ্যিক এক কপট হাসির প্রসারণ।

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪০