আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪০

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪০
suraiya rafa

ধরণি জুড়ে নৈঃশব্দ্য। আঁধারিয়া তাণ্ডবে নিস্তব্ধ প্রকৃতি, ধারণ করেছে অশুভের ন্যায় নিষিদ্ধ এক আবহ। অদূর পাহাড়ের পাদদেশে উদ্ভব ঘটেছে র’ক্তাভ নিশুতির। পরিষ্কার দিগন্তের একঢাল সুবিস্তীর্ণ চন্দ্রকে প্রলয়ের স্বগতোক্তিতে গ্রাস করে নিয়েছে দীপ্তমান সূর্যপিণ্ড।
পূর্ণ চন্দ্রগ্রহনের প্রকোপে শুভ্রের উজ্জ্বল দ্যুতি ঢাকা পরেছে জলন্ত অগ্নুৎপাতের র’ক্তিম লালিমার অন্তরালে। সুউচ্চ পেন্টহাউজের চারিপাশ থেকে ভেসে আসছে নিশাচর প্রাণীর অবিরত আর্তনাদ। সবসময় বিস্তার আলো ছড়ানো পেন্টহাউজটি আজ ভয়াল তিমিরে আচ্ছাদিত, যেন জঙ্গলের গহীনতার মাঝে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো নিটোল অক্ষয় এক দানবীয় অশরীরীর উৎপাত।

মাথার উপর টিমটিমে এক জলন্ত বাল্বের উপস্থিতি,কক্ষের প্রতিটি কোণে ঝিমঝিম করছে নৈঃশব্দ্যিক নির্জীবতা। ডানে-বামে, সামনে পেছনে কোথাও কেউ নেই। সত্যিই নেই, নাকি এটা মতিভ্রম? চারিপাশের অসহনীয় নীরবতা যেন ঘুনোপোকার মতো অস্থির শূন্য করে তুলছে মস্তিষ্কটা। অধর থেকে শুরু করে হৃদপিণ্ড অবধি তরলের নমনীয়তা অনুপস্থিত। কলিজা শুকিয়ে কাঠ। কখন কিভাবে ঘটে গেলো এসব, সবকিছুই যেন এক বিভীষিকাময় ধোঁয়াসা। অগণিত প্রশ্নের আনাগোনায় টনটন করে উঠলো মাথাটা। পরিস্থিতি অবলোকনের প্রয়াসে সহসা নড়লো রুশকন্যা।
তবে তার ছোট্ট শরীরটা পুরোপুরি অবসন্ন, সর্বাঙ্গের এরূপ অপারগতায় খেই হারালো মস্তিষ্ক,তড়িঘড়ি করে দাঁড়াতে উদ্যত হলে শরীরের প্রতিটি পেশীতে আবিষ্কার করলো ডাকট টেপের পোক্ত বাঁধন।
নিজের এহেন ধরাশায়ী কঠিন পরিস্থিতি মূহুর্তেই কুণ্ঠিত করে তুললো ফ্লোরাকে। অস্পষ্ট মানস্পটে ভেসে উঠলো খানিক আগের ঘটনাবিশেষ। অমানিশার ভয়াল আঁধারে আচ্ছাদিত পেন্টহাউজ,তার পরপরই এক পাষবিক কপটতা মিশ্রিত পুরুষালি ঝঙ্কার,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— প্রিন্সেস!
সামান্য এক শব্দের শীতলতা কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল অন্তরে। কর্ণকূহর ছাপিয়ে নিগূঢ় অশুভের আস্ফালন যেন বিষক্রিয়ার ন্যায় ছড়িয়ে পরেছিলো নাজুক শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আতঙ্কে জমে উঠেছিল কণ্ঠস্বর। অগত্যা এক নিমেষেই চেতনা হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল তার পেলব মেয়েলী অস্তিত্ব।
আর যখন চেতনা ফিরে এলো তখন নিজেকে এক কারারুদ্ধ বন্দিনী দশায় আবিষ্কার করলো মেয়েটা। চারিপাশের প্রগাঢ় আঁধার ছুঁতে পারলো না ওর সুক্ষ্ম মস্তিষ্কককে, বাউন্ডারি বলের মতোই ইন্দ্রিয়ের পারদে পারদে অর্হনিশ ঘুরপাক খাচ্ছে একটাই প্রশ্ন, একটাই শব্দ,
— প্রিন্সেস।

সম্মোধনটা বেশ পরিচিত ঠেকলো ফ্লোরার নিকট। এক মূহুর্তের জন্য ভাবনায় ডুবলো রমণী । তবে জুতসই প্রতুক্তি খুঁজে পেলো না মস্তিষ্ক তার আগেই ভাবনার ছেদ ঘটালো নির্বাক এক আগন্তুক।
তার হাতে আবদ্ধ শেকল জাতীয় মেটালিক এক ধাতবের ঝনঝনানিতে টনক নড়লো ফ্লোরার। মানবের অস্তিত্ব টের পেয়ে ধড়ফড়িয়ে দৃষ্টিপাত করলো সম্মুখে। টিমটিমে আলোআঁধারির মাঝে প্রস্ফুটিত হলো হাস্যোজ্জল এক অবয়ব। যা দেখা মাত্রই চোখের সামনে সমগ্র দুনিয়া দুলে উঠলো মেয়েটার। প্রকম্পিত অন্তরাত্না। ভয়ের তাড়নায় তটস্থ হলো মুখশ্রী,শুষ্ক একটা ঢোক গিলে বাঁধন কবলিত হাতদুটো দ্বারা নিজ হাঁটু প্যাঁচিয়ে জড়োসড়ো হয়ে এক কোণে গুটিয়ে গেলো তৎক্ষনাৎ । ফের নীরব হাসির জোয়ার বয়ে গেলো বিপরীত প্রান্তরে। ভেসে এলো স্বচ্ছ কণ্ঠস্বর,
— হোয়াই সো অ্যাফরেইড প্রিন্সেস?
পরপরই ধ্বনিত হলো কপটতা মিশ্রিত তুমুল হাসির ঝঙ্কার। বিভ্রমে তিরতিরিয়ে কেঁপে উঠলো রুশকন্যার নাজুক চিত্ত, কণ্ঠস্বর ভেদ করলো রুষ্ট আওয়াজ ,

— আপনি আবার এসেছেন!
এগিয়ে এলো অবয়ব,বাল্বের সুক্ষ্ম আলোয় ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো তার পৈশাচিক হাসি উদ্ভাসিত সুডৌল চেহারাখানা। চোখের সামনে টমেটো প্রিন্সের চিরাচরিত সেই জোকার সুলভ অভিব্যক্তি ফুটে উঠতেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো ফ্লোরার। ক্রোধে ফেটে পরলো অন্তঃকরণ, চক্ষু স্থীর করে তীর্যক কণ্ঠে ছুড়ঁলো বাক্যের ফলা,
— পাইথন প্যারাডাইসে প্রবেশ করার দুঃসাহস কি করে হলো আপনার? কে ঢুকতে দিয়েছে?
ব্যাঙ্গাত্বক ভঙ্গিমায় ঠোঁট বাঁকালো এ্যালেক্স,স্থবির পদযুগলে সম্মুখে এগিয়ে এসে একহাঁটু ভেঙে বসলো নাজুক রমণীর সন্নিকটে। গ্রীবাদেশ বাঁকিয়ে ঝুঁকলো তার মুখের পানে, বেমালুম হেয়ালির স্বরে হেসে হেসে জানালো,
— বলেছিলাম না একবার কোনোকিছু ভালো লেগে গেলে সেদিকে বারবার নজর দেয় এ্যালেক্স। কেউ আটকাতে পারে না।
— আপনি দুঃসাহস দেখাচ্ছেন। এর ফল কি হবে ভাবতে পারছেন?
ফ্লোরার বজ্রধ্বনিত অগ্নিবাণকে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করলো না এ্যালেক্স, উল্টো হেয়ালির পারদ দিগুণ বাড়িয়ে বললো,

— কাকে ভয় দেখাচ্ছো প্রিন্সেস?আমাকে! এই টমেটো প্রিন্সকে? এরীশ এবং তুষারের অনুপস্থিতিতে শুধু মাত্র গার্ড’সদের ভরসায় নিজেকে এতোটা সুরক্ষিত ভাবা মোটেই উচিৎ হয়নি তোমার, মোটেই না।
কথার তালে তালে ক্রমশ ফ্লোরার ত্বকের সংস্পর্শে অধর ছোঁয়ায় এ্যালেক্স,যেন বিষাক্ত হাসির জোয়ারে গলে গলে পরছে তার কামুক স্পৃহা । বিতৃষ্ণায় চোখ বুঁজে এলো রুশকন্যার, সহসা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ছুড়ঁলো ঘৃণিত আওয়াজ,
— আপনি বোধ হয় ভুলে যাচ্ছেন এটা কার সাম্রাজ্য। বিশ্বাসঘাতক দের কীটপতঙ্গের মতো পায়ে পিষে ধ্বং’স করে দেয় এরীশ ইউভান, আপনাকেও ছাড়বে না।
মুখাবয়ব জুড়ে নিছক হেয়ালিপণা, গাম্ভীর্যের লেশমাত্র নেই চেহারায়, ফ্লোরার কথার পাছে খুকখুক স্বরে গা জ্বালানো হাসিতে কর্ণকূহর ঝাঁঝিয়ে তুললো এ্যালেক্স। দু’জনার মধ্যেকার সংকীর্ণতা বাড়িয়ে হিসহিসিয়ে জবাব দিলো ,

— তোমার মাফিয়া বস বি’শ্বাসঘা’তক ধ্বংস করে প্রিন্সেস। আমি টমেটো প্রিন্স বিট্রেয়ার তৈরি করি। বিশ্বাস হচ্ছে না তাই না?
এক মূহুর্ত নীরবতা, পরপরই এ্যালেক্স বললো,
— চারিদিকে তাকিয়ে দেখো, পাইথন প্যারাডাইসের ট’র্চার সেলে বন্দি হয়ে আছো তুমি। আর তোমার ট’র্চারার স্বয়ং আমি,এই টমেটো প্রিন্স। মাফিয়া বস কিংবা তার কোনো শক্তিই আজ তোমাকে আমার হাত থেকে নিস্ক্রিয়তা দিবে না প্রিন্সেস।
বাক্যটুকু শেষ করে নিশ্চল কদমে দু পা পিছিয়ে গিয়ে এরীশের ইজি চেয়ারটাতে গা এলিয়ে বসলো এ্যালেক্স। উরুর উপর উরু তুলে গাম্ভীর্যের স্বরে বললো,

— তাকাও প্রিন্সেস। চেয়ে দেখো টমেটো প্রিন্সের ক্ষমতা, আমি চাইলে ঠিক কি কি পারি ভাবো একবার।
থমকালো ফ্লোরা, চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে খুলে ফেললো নেত্রপল। ভয়ার্ত দৃষ্টে চারিদিক অবলোকন করতেই মুখ থেকে র’ক্তে সরে গেলো ওর। প্রবল আতঙ্কে শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে গেলো ঠান্ডা এক শীতল স্রোত, ভেতরের কুণ্ঠাকে পুরোপুরি দমিয়ে গলার আওয়াজ খাদে নামালো মেয়েটা। অতঃপর জড়ানো গলায় ডেকে উঠলো সকল কে ,
— গার্ড’স,গার্ড’স গিসি ইউসে?( সবাই কোথায়?)
বিদ্রুপ করে হাসতে লাগলো এ্যালেক্স, হাতে আবদ্ধ শেকলখানি নাড়াতে নাড়াতে কৌতুক স্বরে বললো,

— তুমি গার্ড’স খুঁজছো? আইমিন demon Knight দের? ওরা তো বহু আগেই তুষারের আদেশে মিশনে উড়াল দিয়েছে। আর বাদ বাকি যারা ছিল তাদের পরিস্থিতিটাও না হয় একবার দেখে নাও।
কথা শেষ হতেই অপারগ ভঙ্গিমায় ঠোঁট উল্টালো এ্যালেক্স। অতঃপর রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে অকস্মাৎ খুলে দিলো কক্ষের দরজাটি । দরজা খুলতে না খুলতেই তীর্যক এক আলোক রশ্মিতে চোখ ধাঁধিয়ে উঠলো ফ্লোরার,অচিরেই বুঁজে এলো অক্ষিপুট,ঝলসে যাচ্ছে নেত্রগহ্বর। তবুও আলোর তারতম্যকে পাছে হটিয়ে চোখ খুললো মেয়েটা, সুক্ষ্ম নজরে পর্যবেক্ষন করতেই সম্মুখে ভেসে উঠলো অবিশ্বাস্য একে দৃশ্যপট। দেখলো,
টর্চার সেলের শ খানেক গার্ডকে হাত মুখ বেঁধে নতজানু বানিয়ে তাদের মস্তিষ্কের অগ্রভাগে স্নাইপার ঠেকিয়ে রেখেছে অচেনা একদল সশ’স্ত্র বাহিনী। সম্মুখের দৃশ্যটুকু অবলোকন করতেই আরেকদফা হোঁচট খেলো মেয়েটা। অবিশ্বাস্য নজরে সবাইকে একপল পরখ করে বিহ্বলিত কণ্ঠে বলে উঠলো,

— অসম্ভব, পাইথন প্যারাডাইসের গার্ড’স সংখ্যা এর চেয়ে হাজার গুন বেশি, তাছাড়া প্যারাডাইস গেটে নিশাচর নেকড়ে প্যাক পাহারারত থাকে সর্বক্ষণ।
বাক্যটুকু শেষ হতেই ফের রিমোটের বোতামে আঙুল হাঁকালো এ্যালেক্স। সঙ্গে সঙ্গে দু’পাশ থেকে সংকুচিত হয়ে এলো শক্ত মেটালিক আস্তরণ। সমগ্র কক্ষজুড়ে ঝরঝরিয়ে নেমে এলো তমশা,পুনরায় আঁধার বিস্তৃত ঘরে তরাগ করে জ্বলে উঠলো সুক্ষ্ম ইলেট্রিক বাল্ব।
দরজাটা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে এলে, পায়ের সাহায্যে ইজি চেয়ারে হ্যাঁচকা টান মে’রে ফ্লোরার সন্নিকটে এগোলো এ্যালেক্স, বৈদ্যুতিক বাল্বের লালাভ আলোয় পৈশাচিক হাসির তোড়নে ঠোঁট প্রসস্থ হলো তার। মুখ বাড়িয়ে প্রত্যুত্তর করলো,

— ওই যে বললাম বিশ্বাসঘা’তক তৈরি করে স্বয়ং টমেটো প্রিন্স। আমার সুক্ষ্ম চাল গুলো বুঝে ওঠার ক্ষমতা তুমি কেন, তোমার প্রটেক্টর মাস্টার মাইন্ড তুষার জাওয়াদের ও নেই।
এতোক্ষণে ভেঙে চুরমার হলো আত্মবিশ্বাস।সংকুচিত হলো অন্তঃকরণ। নিজেকে সত্যি সত্যিই বিবর্জিত এক অসহায় নারী রূপে আবিষ্কার করলো ফ্লোরা। আপন সত্তাকে মনে হতে লাগলো হিং’স্র লকলকে শিকারীর মুঠোবন্দি এক ছোট্ট শিকার মাত্র।
হায়নারূপী এ্যালেক্সের কঠোর দৃষ্টিভেদ করে জমে এলো সর্বাঙ্গ,ঠোঁটের ফাঁকে প্রস্ফুটিত হলো নিরেট চাপা আর্তনাদ,

— কেন এভাবে টর্চার সেলে নিয়ে এসেছেন আমাকে? কি চাইছেন আপনি?
কোনোরূপ ভণিতা করলো না বিপরীত পক্ষ, অত্যন্ত রূঢ় স্বরে জবাব দিলো,
— বদলা, সবকিছুর বদলা। সেদিন তুষার যখন লাউঞ্জের মেঝেতে ফেলে কুকুরের মতো মে’রেছিল আমাকে, তখন তুমিইতো ট’র্চার সেলে নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছিলে তাইনা?
এ্যালেক্সের প্রত্যত্তরে হকচকালো ফ্লোরা, কোটর ছাড়ালো তার অভাবনীয় দৃষ্টিযুগল। কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে ভাবাবেগ বদলালো হায়না, ফ্লোরার হাতের বাঁধন খুলতে খুলতে ফের কণ্ঠে কৌতুক ঢেলে বলে উঠলো,
— চলো এসে গেছি ট’র্চার সেলে, তোমাকে নিয়েই এসেছি। এবার দেখি কে কাকে কত বেশি ট’র্চার করতে পারে। আজ যদি আমি জিতে যাই, তবে আমার ট’র্চারের প্রতিটি ক্ষ’তচিহ্ন সারাজীবন আতঙ্কের কলুষে ডোবাবে তোমায়।
লোকটার উন্মাদের ন্যায় গোলমেলে বাক্যগুলো মস্তিষ্ক ছুঁতে পারলো না ফ্লোরার, কারণ হাতের বাঁধন খুলে যেতেই পরিধেয় ফ্রকের পকেটে হাত গুঁজলো মেয়েটা,কিয়ৎক্ষনের নিশ্চলতা খেদিয়ে অকস্মাৎ তুলে আনলো চকচকে একটা রিভলবার, কোনোরূপ সময় নষ্ট না করেই সেটিকে দু’হাতে আবদ্ধ করে তড়িৎ বেগে তাক করলো টমেটো প্রিন্সের তীর্যক ললাটে।

নিস্ক্রিয় ভাবাবেগ শূন্য টমেটো প্রিন্স। ঘটনার আকস্মিকতায় বিন্দু পরিমাণ ভড়কালো না তার হায়নার ন্যায় সুচারু অবয়ব। নিটোল অভিব্যক্তি ধরে রেখেই ঠোঁটের কোণে উজ্জীবিত করলো শয়তানি মিশ্রিত ক্রূর উল্লাস।
লোকটার হাসির তরঙ্গে ক্রমান্বয়ে কাঁপছে ফ্লোরা। পরিপূর্ণ দক্ষতা আর আত্মবিশ্বাসের অভাবে রিভলবারে আবদ্ধ হাতদুটো অসার হয়ে আসছে ক্ষণে ক্ষণে। অপরিপক্ক তর্জনী দু’টো ট্রিগার টানার উচ্ছ্বাসে মরিয়া, অথচ ধরাশায়ী মস্তিষ্কটা ঘটনা পরবর্তী ভুলের আশঙ্কায় দ্বিধাগ্রস্ত। ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া হৃদয়টাকে শেষবারের মতো আগলালো মেয়েটা,নাজুক ভীতিকর কণ্ঠে খানিক দৃঢ়তা টেনে বললো,

— সেলের দরজা খুলে দে, নয়তো এই রিভলবারের ছয় ছয়টা বুলেট ঢুকিয়ে ঝাঁজরা করে ফেলবো তোর মস্তিষ্ক।
ফ্লোরার কথা শেষ হতেই সাইকোপ্যাথিক আওয়াজ তুলে ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো হিং’স্র দানবীয় সত্তা । ওর বিকট হাসির আওয়াজে ভয়ে তটস্থ হয়ে গেলো রুশকন্যা। আড়ষ্টতায় ঢিলে হয়ে এলো তার হাতের বাঁধন। তৎক্ষনাৎ এক থাবায় রিভলবারটা কেঁড়ে নিলো এ্যালেক্স ,আঙুলের সাহায্যে সেটিকে লোড করতে করতে বললো,
— গুলি চালানোর আগে লোড করতে হয় প্রিন্সেস। যেটা তুমি নও আগ বাড়িয়ে সেটা প্রদর্শিত করা বন্ধ করো, এসব দেখলে বড্ড হাসি পায় আমার, এনজয় করার মুড নষ্ট হয়। আমি ভালো করেই জানি bratva সম্বলিত মাফিয়া টেরোরিস্টের হাতের মুঠোয় থাকলেও তুমি পুরোপুরি একটা ইনোসেন্ট বাচ্চা । তুষার আর এরীশের কব্জাবন্দি তুলতুলে এক কবুতর ছানা। এ্যান্ড ইউ নো হোয়াট, আই লাভ পিজিয়ন।
নিজের দূর্বোধ্য পরিনতি আঁচ করতে পেরে অচিরেই বাকরুদ্ধ হলো ফ্লোরা। তৎক্ষনাৎ নিজের জরাজীর্ণ শরীরটাকে টেনেটুনে পিছু হটার প্রয়াস চালালো সবেগে। উচাটন চিত্তের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় ভর করেছে তার আতঙ্কের প্রলয়। এই বীভৎস রজনী, শত্রু কবলিত একাকী বিধ্বস্ত হৃদয়ের হাহাকার সব সবকিছুই শুধু স্বরণ করিয়ে দিচ্ছে তুষারের একটা মাত্র বাক্যকে,

— কতবার বলেছি মাফিয়া পেন্টহাউজে ইনোসেন্সির কোনো জায়গা নেই। এখানে টিকতে হলে ডেভিল হতে হয়, নয়তো মানুষরূপী হায়নাদের দং’শনে হরিণ শাবকের মতোই অস্তিত্ব হারাবে নিজের।কারণ তোমাকে রক্ষা করার জন্য সবসময় পেন্টহাউজে বসে থাকবো না আমি।
তুষারের কথাগুলো আজ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারলো ফ্লোরা। নিজের অস্তিত্ব হারানোর ভয়ে জর্জরিত হলো ভীত সন্ত্রস্ত অন্তরাত্মা। ফলস্বরূপ তড়িৎ বেগে পেছনে ঘুরে পালাতে উদ্যত হলো মেয়েটা। তক্ষুনি নখড় থাবায় ওর রেশমের ন্যায় স্বর্ণাভ চুলের গোছা আঁকড়ে ধরে হায়নাটা। বদলে যায় তার সাবলীল মুখের আদল, চিরাচরিত হাস্যোজ্জল জোকারি অভিব্যক্তি বিলীন করে প্রগাঢ় আঁধারে আবৃত হয়ে ওঠে নেত্রগহ্বর,চেহারায় প্রস্ফুটিত হয় পশুতুল্য হিং’স্রতা। মানসিক আতঙ্ক আর চুলের বিঘ্নতায় তীব্র আর্তনাদে ছটফট করে ওঠে ফ্লোরা , তবে এ্যালেক্সের শয়তানি হাসির জোয়ারে সেই আর্তনাদ বেমালুম তুচ্ছ শোনালো কর্ণগহ্বরে । ক্রন্দনরত ফ্লোরা ফোপাঁতে ফোপাঁতে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,

— ওরা তোমাকে ছাড়বে না টমেটো প্রিন্স। আজ আমার সঙ্গে যা যা অন্যায় করছো তারচেয়ে বহুগুণ ফেরত পাবে তুমি। খুব শীঘ্রই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে তোমার অস্তিত্ব, মিলিয়ে নিও।
— আচ্ছা!
বিদ্রুপাত্তক স্বরে শব্দটা উচ্চারণ করলো এ্যালেক্স। গ্রীবা বাঁড়িয়ে ফ্লোরার কানের সংস্পর্শে অধর ঠেকালো পরমূহুর্তেই। নৈঃশব্দ্যে হিসহিস আওয়াজে কিছু একটা অবগত করলো রুশ রমনীকে । যা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মাথার উপর যেন চৌচির হয়ে আকাশ ভেঙে পরলো মেয়েটার। পায়ের তলা থেকে সরে গেলো ভূমির আস্তরণ। শূন্য অনুরক্তির উদ্ভব ঘটিয়ে অবিশ্বাস্য চাহনি নিক্ষেপ করলো এ্যালেক্সের পানে, ঠোঁটের আগায় শয়তানি হাসিটা এখনো বিরাজমান পশুটার , সেদিকে আশ্চর্য দৃষ্টিপাত করে আহত স্বরে ফ্লোরা বললো,

— আপনি মিথ্যা বলছেন।
— প্রমান চাইছো? উপযুক্ত প্রমান দর্শালে তুষারের ঠিক কি হাল হবে ভেবে দেখেছো একবারও?
অকস্মাৎ বুকের র’ক্ত তোলপাড় করা অসহায়ত্বে বিদ্ধ হলো অন্তঃকরণ। অসহায়ত্বের চরম শিয়রে পৌঁছে গলা ছেড়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো নাজুক মেয়েটা। চঞ্চল আঁখিদ্বয়ে বাঁধভাঙা জলোচ্ছ্বাস, রিক্ত অভিলাষ। হাতের বাঁধনে দৃঢ়তা টেনে ক্রন্দনরত মেয়েটাকে আচানক ধাক্কা হাঁকিয়ে প্রস্তর কঠিন মেঝেতে ছুড়ে মা’রলো এ্যালেক্স। অন্যহাতে আবদ্ধ থাকা ধাতব শেকলটাকে রুশকন্যার সরু তুলতুলে শরীরের উপর আঁচড়ে ফেলে নিক্ষিপ্ত করলো পৈশাচিক এক বাক্যবহর,
— বি মাই স্লেইভ টুনাইট। জাস্ট টেইক অফ ইওর ক্লোথ’স।
ধরশায়ী ফ্লোরা। এদিক ওদিকে মাথা নাড়িয়ে করজোড় করলো দু’হাতে, ফোপাঁতে ফোপাঁতে অসহায় সুরে বলতে লাগলো,

— দয়া করুন,সম্ভ্রমহানী না করে মৃ’ত্যু দিন আমাকে।
মৃদু নিঃশ্বাস ছেড়ে ঠোঁট বাঁকালো এ্যালেক্স।প্রথমে কৌতুক করে হাসলো কিয়ৎক্ষন পরমূহুর্তেই মুখাবয়ব জুড়ে স্পষ্ট পৈশাচিকতা টেনে কঠোর আওয়াজে আদেশ করলো ফের,
— জাস্ট টেইক অফ ইওর ক্লোথ’স প্রিন্সেস। পুরো শরীরে একটা ক্ষুদ্র কাপড়ের অংশও যাতে অবশিষ্ট না থাকে।
দু’হাত বুকের উপর আড়াআড়ি ভাঁজ করে উদভ্রান্তের ন্যায় এদিক ওদিক মাথা নাঁড়ায় মেয়েটা। শিশুসুলভ বাদামি চোখ দু’টোতে অঝোরে অশ্রু নিপতিত করে, করুন স্বরে বলে,
— হাত জোর করছি, আমাকে ছেড়েদিন। এটা আমি করতে পারবো না। এর চাইতে বরং জীবনটা নিয়ে নিন।
— ঠিকাছে তাহলে আমিই সত্যিটা ফাঁস করে দিই। ধ্বং’স হয়ে যাক তুষার জাওয়াদ, সেই সাথে সাথে পাইথন প্যারাডাইস।

— নাহ!
স্বগোতক্তিতে চ্যাঁচিয়ে ওঠে ফ্লোরা,চোখের জল ছেড়ে দিয়ে বলে,
— খ…খুলছি।
ওর দৃষ্টি বরাবর রিভলবার তাক করলো টমেটো প্রিন্স, দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
— রাইট নাও।
চিত্ত চিঁড়ে হাউমাউ করে কেঁদে ভাসালো অপারগ ফ্লোরা, কাঁদতে কাঁদতে নির্জীব পুতুলের ন্যায় হাত চালালো ফ্রকের সুন্দর ফিতায়।
এবারে পায়ের পা তুলে বসলো এ্যালেক্স,এদিক ওদিক ঘাড় ফুটিয়ে লোভাতুর চাহনি দ্বারা ছোট্ট মেয়েলী শরীরটাকে পরিপূর্ণ গ্রাস করতে করতে ঠোঁট বাঁকিয়ে আওড়ালো,

— গুড গার্ল। ইওর বডি ইজ সো পার্ফেক্ট।
পুরোপরি ভাঙলো রমণী, অনুভূতি শক্তি বিলীন হলো বিভীষিকার অন্তরায়, আপন ভূষণের প্রতিটি আস্তরণ যেন আজ একেকটি চামড়া সমতুল্য, যা অনাবৃত করার সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য র’ক্তের স্রোতে প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে তার সিক্ত পেলব ত্বক।বীভৎস যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে হৃদযন্ত্র। তবুও অসহায়ের ন্যায় কাঁদতে কাঁদতে নিজেকে কলুষিত করতে বাধ্য রমণী । কোনো এক সত্যি লুকোনোর অগাধ প্রয়াসে তীব্র ঘৃণায় জর্জরিত হয়ে শরীরটাকে সমর্পন করে এক মানুষ রূপী হায়নার কবলে।
ফ্লোরা যখন পুরোপুরি রিক্তশূন্য, তখন ওর নিকট পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো এ্যালেক্স,মেয়েটার অনাবৃত দেহের ভাঁজে লালসার হস্ত বুলিয়ে উপহাস করে বললো,
— আজ আর কেউ বাঁচাতে আসবে না তোমায় প্রিন্সেস। আজকের পর থেকে তুষার, এরীশ এমনকি পুরো মাফিয়া প্যারাডাইস টের পাবে টমেটো প্রিন্সের ক্ষমতা । আমি চাইলে পাইথন লিডারের সুরক্ষিত জিনিসকেও এক ঝটকায় তছনছ করে দিতে পারি, আজকে এটাই তার প্রমাণ।

শরীর ছাঁপিয়ে কলুষিত হলো অন্তরাত্মা, দু’হাঁটু ভাঁজ করে উন্মুক্ত দেহখানি ঢাকার অনর্থক প্রয়াসে নিজেকে গুটিয়ে নিলো ফ্লোরা। নিজের নমনীয়তার কাছে হেরে গিয়ে উন্মাদের ন্যায় কাঁদছে মেয়েটা। সুশ্রী, চঞ্চলা,হাস্যোজ্জল চেহারাখানি পুরোপুরি বি’ধ্বস্ত আজ। টমেটো প্রিন্স তোয়াক্কা করলো না কোনো কিছুর। পরিধেয় শার্টটাকে শরীর থেকে খুলে ছুড়ে ফেললো অদূরে। অতঃপর চন্দ্রগ্রহনের অশুভ ছায়াতলে নির্বাসিত করলো নরম তুলতুলে নমনীয় শরীরটিকে। প্রগাঢ় আগ্রাসনে বিনাশ ঘটালো নিখাঁদ পবিত্রতার। নিজ হাতে ভেঙেচুরে নস্যাৎ করলো এক পুতুল কোমল অসহায় সত্তাকে।সূচনা গড়লো নরকীয় এক বি’ধ্বংসী ম’রণ ফাঁদের। যেই নিষিদ্ধ ম’রণ ফাঁদে আম’রণ নিমজ্জিত হবে স্বয়ং হায়নার অস্তিত্ব।

“ফ্লোরা” নামের মতোই নিখুঁত আধো আধো মায়ায় পরিপূর্ণ তার দু’নয়ন । অথচ মূহুর্তটা বিকৃত,আঁধার খচিত নিষিদ্ধ মাফিয়া সাম্রাজ্য আজ সত্যি সত্যিই গ্রাস করে নিলো তার সমগ্র সরলতাকে, গলা চেপে ডুবালো মরীচিকায় । মেয়েটার হৃদয় নিংড়ানো অপারগ চিৎকারে ভার হয়ে এলো চারিপাশ। লোকটার প্রতিটি পাষবিক স্পর্শ যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গের লেলিহান। তীব্র যন্ত্রণায় ঝলসে যাচ্ছে সর্বাঙ্গ। হিংস্র হায়নার প্রতিটি পদক্ষেপে ছিন্নভিন্ন হতে লাগলো অতিব কোমল মাংসপিণ্ডল। অন্তরের যাতনায় গলাকা’টা মুরগীর ন্যায় অবিরাম ছটফটানিতে ক্রমশ অসার হয়ে এলো অস্তিত্ব। নিজের সম্ভ্রম হারিয়ে রিক্ত মস্তিষ্কটা তখনও কোনো এক মানবের চিন্তায় মশগুল। বারে বারে বলে যাওয়া তার প্রতিটি সতর্কবাণী যেন এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে র’ক্তা’ক্ত করে তুলছে হৃদয়টাকে,

— তোমাকে রক্ষা করার জন্য সারাজীবন পেন্টহাউজে বসে থাকবো না আমি। নিজেকে সামলাতে শেখো ফ্লোরা।
এ যেন কোনো সাধারণ বাক্য নয়। ছিল অন্তর বিদ্ধকারী বিষা’ক্ত এক তীরের ফলা।
তুষার ব্যতিত কোনোকিছুই আর ছুঁতে পারলো মস্তিষ্ক। কেবল ধীরে ধীরে রক্তিম আঁধারে ডুবে যেতে লাগলো ধরিত্রী। বুঁজে এল টলমলে নেত্রপল। সেই সঙ্গে নিভে গেলো দুনিয়ার সমগ্র আলোকশিখা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অবিরত যন্ত্রণায় ধড়ফড় করতে থাকা হৃদপিণ্ডটা অবশেষে বিলীন হলো নিস্তব্ধতার অনলে।কোমল গোলাপি আভাযুক্ত সমগ্র শরীর জুড়ে পাষবিকতার আগ্রাসন। তীক্ষ্ণ আঁচড়ে র’ক্তে মাখামাখি সর্বাঙ্গ। ভেঙেচুরে পরে থাকা অনাবৃত নিথর দেহখানি এখন সম্পূর্ণ নিরুদ্বেগ। তবুও মুক্তি মিললো না হায়নার কবল থেকে। যেন মেয়েটার অন্তিম শ্বাসপ্রশ্বাস টুকুও আজ পুরোপুরি হরণ করায় উদগ্রীব হয়ে আছে লকলকে হিং’স্র দানব।

রাতের শেষ প্রহরে আপন বীরত্বের ইতি ঘটালো এ্যালেক্স। মেঝের উপর ভঙ্গুর চিত্তে পরে থাকা অবচেতন রমণীকে লক্ষ্য করে হাসলো নৈঃশব্দ্যে। অতঃপর উদ্যত হলো আরও ভয়াবহ কর্মকাণ্ডে। পকেট থেকে দিয়াশলাই বের করে জ্বালালো সেটিকে। উদ্দেশ্য, তার আগমের পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রমানকে নিশুতির আঁধারে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। তবে ভাগ্য স্বায় দিলোনা তাতে, কার্যসিদ্ধির আগেই,দরজার ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন স্বরে
ডেকে উঠলো কেউ, স্পষ্ট রুশ ভাষায় জানালো,
— জলদি করুন প্রিন্স। প্যারাডাইস গেট দিয়ে গাড়ির বহর প্রবেশ করছে অভ্যন্তরে, সম্ভবত গার্ড’সরা চলে এসেছে। আমাদের এক্ষুণি পালানো উচিত, নয়তো।
লোকটার পুরো বাক্য সম্পন্ন হওয়ার আগেই টর্চার সেলের দরজা খুলে হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে এলো এ্যালেক্স। উন্মুক্ত শরীরে শার্ট চড়াতে চড়াতে জলদি মাথা নাড়িয়ে বললো,
— লেটস গো।

রয়েল ক্যারাভিয়ান, কক্সবাজার।
শঙ্খচিলের কিচিরমিচির প্রলুব্ধ ধ্বনির হাত ধরে সূচনা হলো আরেকটি অপার্থিব সকালের। গতরাতের ধূসর মেঘমালার রেশ কাটিয়ে ঝলমলে সূর্যালোকে উষ্ণ চারিপাশ। পুরো এক নিশিত বিভ্রমের ইতি ঘটেছে প্রচণ্ড সকালে।চেতনা ফিরতেই গভীর জলরাশির উর্মিমালার তরঙ্গোচ্ছ্বাসে ভর করে হেলেদুলে বয়ে চলা ক্রুজশীপের মাস্টার বেডরুমে নিজেকে আবিস্কার করে ঈশানী।
শরীরটা হালকা ভীষণ, ক্লান্তির ছাপ কেটে গিয়ে মস্তিষ্ক জুড়ে ভর করেছে নিগূঢ় সজীবতা। নাজাল ক্যানুলা খোলা হলেও হাতেরটা এখনো সবস্থানে আবৃত। আড়মোড়া ভেঙে নড়েচড়ে উঠতেই সেদিকে লক্ষ্য করলো ঈশানী। হাতটাকে এদিকে ওদিক ঘুরিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টে ক্যানুলাখানি পরখ করতে করতে বিড়বিড়ালো,

— ক্যানুলা কোথা থেকে উদয় হলো? মা কি ডাক্তার ডেকেছিল কাল রাতে?
কালকের ঘটনা স্বরণ করতে গিয়ে হামেশাই মানস্পটে ভেসে উঠলো চিরচেনা পিয়ার্সড করানো নেত্রগহ্বরের অস্পষ্ট সেই চাহনিটুকু। ব্যাডবয় খচিত ওয়াইল্ড পারফিউমের মাস্কি সৌরভে নিস্পৃহতার অবসান। মরীচিকার আগমনে হৃদয়ে স্বস্তির প্লাবন, অবশেষে হাওয়ার গতিতে তার বক্ষভাঁজে আত্ননির্বাসন। তারপর? তারপরের ঘটনা সম্মন্ধে পুরোপুরি অজ্ঞাত ঈশানী। অগণিত কৌতূহলের তাড়নায় মস্তিষ্ক টনটন করে উঠলো রমণীর। সহসা হুড়মুড়িয়ে ছাড়লো বিছানা। ভীড়ু কদমে সম্মুখে অগ্রসর হয়ে মনেমনে আওড়ালো,

— তারপর কি করেছিল লোকটা? কাউকে মে’রে টেরে দেয়নি তো আবার!
আপন ভাবনায় হৃদয় খামচে ওঠে মেয়েটার, তড়িঘড়ি করে ছুটে যায় করিডোরে। সেখানে গিয়ে আরও একদফা থমকালো সে। নিজেকে মস্তবড় ক্রুজশীপে আবিষ্কার করে পিছিয়ে এলো কয়েক কদম। স্মৃতির পাতায় জাগ্রত হলো প্রথমবার ক্রুজশীপের সেই বীভৎস ঘটনাবিশেষ । যদিও সেসব এখন নিস্ফল অতীত মাত্র, তবুও সেই বিভীষিকাময় দিনগুলো আজও অস্থির করে তোলে ভীত সন্ত্রস্ত রমণীকে, স্বরণ করিয়ে দেয় নিজের বিধ্বস্ত ব্যথাতুর অতীতটাকে।
আবারও সেই বিশাল ক্রুজশীপ, সীমান্তহীন অগাধ জলরাশির উপাখ্যান । চারিপাশের দৃশ্য অবলোকন করে অস্বস্তিতে জমে গেলো অন্তঃকরণ। মানব শূন্য করিডোর। তৃষ্ণার্থ চাতকিনীর ন্যায় এদিক ওদিক দৃষ্টিপাত করে হতচকিত হলো দু’নয়ন। দৃষ্টি সীমানা জুড়ে নির্জীবতায় ছেয়ে আছে প্রান্তর। চেতনা ফেরার পরমূহুর্তে এহেন অপ্রীতিকর আবহ আতঙ্কিত করে তুললো নাজুক বক্ষপিঞ্জর।

অতর্কিতে ছুটলো মেয়েটা, স্বস্তিতে নয় বরং উদভ্রান্তের ন্যায় উর্ধ্বশ্বাসে। ছুটতে ছুটতেই এক বিশালাকৃতির কক্ষদারে এসে থমকালো পদযুগল। দরজাটা হাট করে খোলা, যার দরুন বাইরে থেকেই দৃশ্যগত হলো অজস্র মনিটর আর ল্যাপটপের বহর। একসঙ্গে এতোগুলো মনিটর অবলোকন করে হতভম্ব হলো রমণী। ভেতরের অপ্রতিরোধ্য কৌতুহলের তাড়নায় সিদ্ধান্ত বদলালো তৎক্ষনাৎ। এপাশ ওপাশ দৃষ্টিপাত করে সকলের অগোচরে আড়ষ্ট পদচারণায় প্রবেশ করলো অভ্যন্তরে।
তিমিরে আচ্ছাদিত সুবিস্তীর্ণ রুম। বৈদ্যুতিক আলোর উপস্থিতি না থাকলেও চারিপাশে সাজানো একাধিক ডেস্কটপ আর ল্যাপটপ স্ক্রিন শোভিত নীলাভ আলোয় পরিস্কার চারিপাশ। ভেতরে আসবাবের উপস্থিতি নগন্য। বৃহৎ গোলাকাল ডেস্কের সম্পূর্ণ অংশ জুড়ে কেবলই প্রযুক্তির অস্তিত্ব। ডেস্কের সম্মুখে অবস্থানরত গেমিং চেয়ারটা ফাঁকা পরে আছে। চেয়ারের আস্তিনে ঝুলছে কুচকুচে কালো এক হেডফোন। অতর্কিতে চেয়ারের ব্যাকসিটে হাত বোলালো ঈশানী। গভীর চিত্তে অনুধাবন করলো এখানে বসে কোনো জিনিসকে আয়ত্তে রাখে মাফিয়া বস। কিন্তু কি সেই জিনিস?

ভাবতে দেরী হলো ঈশানীর,বেখেয়ালি হাতের স্পর্শে সবগুলো মনিটরে একযোগে তার ই ঘরের লাইভ স্ট্রিমিং চালু হতে দেরী হলো না বিশেষ। রুমে অবস্থিত প্রতিটি কোণ,প্রতিটি বারান্দা, এমনকি শাওয়ার নেওয়ার জায়গাটা পর্যন্ত একেএকে ভেসে উঠলো ডেস্কটপ স্ক্রিনে। কাল সারারাত যেই কক্ষে ঘুমিয়েছিল, সেটারও পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাসছে মনিটরের পর্দায়।
ঘটনার আকস্মিকতায় ফাঁকা হয়ে গেলো অধরযুগল। এতোদিনে মেয়েটা উপলব্ধি করলো ওর সেই চব্বিশ ঘণ্টার স্টকার আর অন্য কেউ নয় স্বয়ং এরীশ ইউভান। স্তব্ধ হয়ে গেলো প্রতিটি ইন্দ্রিয়। অবিশ্বাসের তাড়নায় প্রকাণ্ড ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করলো অন্তরে। নিজের অজান্তেই ফাঁকা হয়ে যাওয়া মুখের উপর করতল ছোঁয়ালো ঈশানী।বিহ্বলিত স্বরে বলে উঠলো,

— এসব কি!
— এই ঘরে প্রবেশ নিষেধ।
অকস্মাৎ পুরুষালি রাশভারি আওয়াজটা শ্রবনেন্দ্রিয় ভেদ করতেই আঁতকে ওঠে ঈশানী। ভয়ার্ত এক শুষ্ক ঢোক গলাধঃকরণ করে পেছনে ঘুরতে উদ্যত হবে তখনই দ্বিতীয় দফায় গম্ভীর বাক্য ছুঁড়লো আগন্তুক,
— দরজার উপর নেইম-প্লেট দেখোনি? নো এন্ট্রি।
ভেতর ভেতর মেকি আত্নবিশ্বাস জমিয়ে ঘুরলো ঈশানী। সঙ্গে সঙ্গে চোখাচুখি হয়ে গেলো অপরপ্রান্তের তামাটে বর্ণের সৌষ্ঠব যুবকের সহিত। সান্নিধ্যে অগ্রসর হলো মূর্তিমান যুবক, পেছনের মনিটরে একপল দৃষ্টি ফেলে তপ্ত এক নিঃশ্বাস ছেড়ে গমগমে আওয়াজে শুধালো,
— এখানে কি করছো?
প্রত্যুত্তর করলো না রমণী। অভিমান সুলভ নাসারন্ধ্র ফুলিয়ে তীর্যক স্বরে বললো,
— এসব কি?

ইশারা তার মনিটরের পর্দায় নিবদ্ধ। সেদিকে দৃষ্টিপাত করে ঠোঁট উল্টালো তুষার। ভাবলেশহীন কণ্ঠে জানালো,
— দেখতেই পাচ্ছো, হি ওয়াজ জাস্ট স্টকিং ইউ।
তুষারের কথায় থমকে গেলো ঈশানী। মেজাজ চড়ে উঠলো সপ্তমে। ঝাঁঝালো কণ্ঠে তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো,
— জাস্ট! আপনার এটাকে জাস্ট মনে হলো? ঘরে- বাইরে, যেখানে-সেখানে ও আমাকে সব ভাবে দেখে নিয়েছে।কোনো কিছু আর বাকি নেই, আমার সবকিছু উন্মুক্ত ওর কাছে। আপনি জানেন একটা অবিবাহিত মেয়ের জন্য এটা কতোটা অসম্মানের? কতোটা অপমানের?
বাক্য শেষ হতেই সিক্ত হলো দু’নয়ন। নোনাজলের চিকন স্রোত বাঁধভাঙা হয়ে গড়ালো কপোলে। অভিব্যাক্তি বদলালো না তুষারের, সে একই ভঙ্গিমায় নির্বিকার স্বরে জবাব দিলো ,

— তোমার সেইফটির জন্যই এতোসব। আজ স্টকিং না করলে তোমার কারেন্ট সিচুয়েশন কিছুই জানা যেত না। পরিবারের অ্যা’ভিউসিভ কর্মকাণ্ডে হয়তো শীঘ্রই ম’রে যেতে তুমি ।
নির্দয়, পাষণ্ড গ্যাংস্টার। এর বাইরে কিছুই মাথায় এলো না ঈশানীর, ক্রন্দিত স্বরে আওড়ালো,
— তাই বলে এভাবে একটা মেয়ের সম্মান হরণ করে? আমার শাওয়ারের নিচেও,
কথা সম্পন্ন হলোনা মানবীর, দু’চোখ বুঁজে এলো সংকোচে। নির্দ্বিধায় প্রতুক্তি করলো বিপরীত পক্ষ,
— আই থিংক তার অধিকার রয়েছে।
ফের তেতে উঠলো ঈশানী, অস্থির পদচারণায় সম্মুখে এগোনোর পায়তারা করে রিনরিনে আওয়াজে বলতে লাগলো ,

— কোথায় সে? কেন এসব করলো? আমি জানতে চাই সবকিছু।
এরীশকে হাজার কথা শোনাতে শোনাতে বেড়িয়েই যাচ্ছিল ঈশানী, তক্ষুনি পেছন থেকে বাক্য ছুঁড়লো তুষার, হাতের ট্যাবলেট খানা ওর নিকট বাড়িয়ে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বললো,
— যাওয়ার আগে এটা একবার দেখে যাও।
অতর্কিতে কপাল গোছালো রমণী। টলমলে অশ্রুসিক্ত নীল চোখের গহীনে জড়ো হলো প্রশ্নের সমাগম। কয়েক পা পিছিয়ে এসে ট্যাবটাকে হাতে আগলালো সে। স্ক্রিনে দৃষ্টি বোলানোর আগে একপল তুষারের পানে চাইলো মেয়েটা। কুণ্ঠিত স্বরে শুধালো,

— কি এটা?
— নিজেই দেখে নাও।
ছোট্ট বাক্যে প্রত্যুত্তর করলো তুষার। দৃষ্টি নমিত করলো ঈশানী, ট্যাবের স্ক্রিনে ভাসমান লেখাগুলোতে নিগূঢ় দৃষ্টি বুলিয়ে বলে উঠলো,
— লেখাগুলো পড়ে তো রেজিস্ট্রি পেপারস মনে হচ্ছে, কিন্তু কার? তাছাড়া আমিই বা কি করবো এটা দিয়ে?
— ভালো করে পড়ো, মনোযোগ সহকারে।
তুষারের বাক্যটুকু শেষ হতে না হতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো রমণী । বারে বারে স্ক্রিনটাকে এদিক ওদিক নাড়াচাড়া করতে করতে অবিশ্বাস্য স্বরে আওড়ালো,
— এরীশ ইউভান ওয়েড’স ঈশানী তুজ কর্ণিয়া! এর মানে কি?
— এর মানে আইনগত ভাবে তোমরা বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ।
পুনরায় স্পষ্ট স্বীকারোক্তি ভেসে এলো ওপাশ থেকে। তরাগ করে চোখ তুললো ঈশানী।এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে প্রতুক্তি করলো,
— এটা অসম্ভব, আমি কোথাও কখনো সাক্ষর করিনি, আর নাতো এরীশ কখনো বলেছে আমায়।
ঠোঁট বাঁকালো তুষার, দু’হাত পকেটে পুরে পূর্ণ দৃষ্টিপাত করলো নীলাম্বরীর পানে।অতঃপর ভণিতা না করে জবাব দিলো,

— ইউ নো হোয়াট, মাফিয়া বস কখনো বলে কয়ে তোমার সম্মতি গ্রহন তারপর বিয়ের রেজিষ্ট্রি করবে না। হি ইজ দ্যা পাইথন লিডার। ওর মর্জি হয়েছে, তাই রেজিষ্ট্রি করে নিয়েছে, দ্যাট’স ইট। এবার নিশ্চিন্ত হতে পারো, অন্য কেউ নয় বরং বৈবাহিক সূত্রে তোমার হাসবেন্ড তোমাকে সকল পরিস্থিতিতে দেখে নিয়েছে।
তুষারের যুক্তি গুলো জুতসই বোধগম্য হলোনা মস্তিষ্কে, তার আগেই দস্যুর ন্যায় হানা দিলো আরেক প্রশ্নের বহর। সহসা প্রশ্ন ছুড়লো মেয়েটা,
— এখানে রেজিস্ট্রার লোকেশন ভ্যাটিকান সিটি দেখাচ্ছে, কিন্তু কেনো?পৃথিবীতে এতো এতো জায়গা থাকতে, ওই ছোট্ট দেশেই কেন বিয়ের আইনী কার্যক্রম সম্পাদন করলো মাফিয়া বস?
— কারণ ওই দেশে আইনগতভাবে ডিভোর্স সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অর্থাৎ তুমি চাইলেও কোনোদিন ছেড়ে যেতে পারবে না এরীশকে।

তুষারের শেষ জবাব শুনে অচিরেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো ঈশানী। নিস্প্রভ হতবুদ্ধি দু’নয়ন। এতোগুলো সত্যি একসঙ্গে যেন বজ্রপাতের ন্যায় হামলে পরলো নাজুক মস্তিষ্কে। থমকালো কার্যক্রম, কণ্ঠনালি রোধ হয়ে এলো দূর্বোধ্য এক অদৃশ্য শেকলে। যার দরুন স্থবির হয়ে পরলো মূহুর্ত। নীরবতায় গুমোট চারিপাশ।
হতবিহ্বল মেয়েটাকে ধাতস্থ করার প্রয়াসে তুষার আগ বাড়িয়ে কোনোকিছু বলতে যাবে, তার আগেই ভাইব্রেট আওয়াজ তুলে প্রকম্পিত হলো মুঠোফোন। নাম্বারটা পরিচিত ঠেকলো, সহসা কর্ণগহ্বরে এয়ারপড’স প্রবেশ করালো নির্বিঘ্নে। এপাশ থেকে কোনোকিছু বলার আগেই বিপরীত প্রান্ত থেকে ভেসে এলো পরিচিত এক ক্রন্দিত কণ্ঠস্বর। কোনোকিছুই স্পষ্ট নয়। নীরবে শুনলো আর্জি, অতঃপর থমথমে আওয়াজে জিজ্ঞেস করলো,

— কোথায় তুমি এখন?
ব্যাস এটুকুই, ওপাশের কথা শেষ হতে না হতেই বিনাবাক্যে প্রস্থান করে তুষার। ওদিকে পুরোপুরি স্তম্ভিত হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রয় নির্বাক হতবিহ্বল মানবী।

নিস্তব্ধ নিবিঢ় নীলাচল। কোথাও কোনো মানুষের উপস্থিতি নেই। ইনানীর সর্বশেষ প্রান্তরে একেবারে মানবশূন্য বন্দরে এসে স্পিডবোট থামালো তুষার। ছোট্ট সাইজের নোঙর খানা পানিতে ফেলে একলাফে নেমে এলো বালুচরে। করতলে আবদ্ধ রিভলবারটাকে লোড করতে করতেই এদিক ওদিক দৃষ্টি ফেলে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো চারিপাশ।
কোথাও কারও উপস্থিতি টের না পেয়ে তীক্ষ্ণ অক্ষিদ্বয় কুঁচকে এলো তুষারের। রাশিভারি থমথমে মুখাবয়বে ভর করলো নিগূঢ় বিরক্তি। কিন্তু ফিরে গেলো না। কিছু একটা ভেবে বালুচর ধরে যান্ত্রিক পদযুগলে সম্মুখে অগ্রসর হলো লোকটা। ইনানী ছাড়িয়ে কিছুদূর যেতেই দেখা মিললো নিঝুম নামক হাস্যোজ্জল অস্তিত্বের।
পরিধেয় পাজামাটা খানিক উপরে তুলে নির্বিঘ্নে বালুচরের উপর আঁকিবুঁকি করছে সে। যা দেখা মাত্রই আগ্নেয়গিরির দাবানল জ্বলে উঠলো মস্তিষ্কে। ট্রিগার চেপে রাখা আঙুলখানা বহু কসরতে সামলালো তুষার। উৎপীড়িত হলো না, বরং স্বভাবসুলভ থমথমে অভিব্যক্তিতে দাঁড়িয়ে রইলো সটান। ওদিকে তুষারকে দেখা মাত্রই সমুদ্র তট ছাড়িয়ে জলদি পায়ে শুষ্ক বেলাভূমির অভিমূখে ছুটে এলো নিঝুম। অধরমাঝে চিরাচরিত নিগূঢ় হাসির রেশ টেনে বললো,
— আমি জানতাম আপনি আসবেন। দেখলেন তো কেমন প্র্যাঙ্ক করলাম।

বাক্য শেষ হতে না হতেই ওর নাজুক কপোলে অতর্কিতে হামলে পরলো পুরুষালি শক্ত হাতের চ’পেটাঘা’ত। আ’ঘাতের প্রকোপ এতোটাই তীব্র ছিল যে গোছানো পরিপাটি চুল গুলো নিমেষেই এলোমেলো হয়ে আঁচড়ে পরলো মুখের উপর। ব্যথায় টনটন করে উঠলো নরম ত্বকের আবরণ। যতটা না ব্যথা শরীরে অনুভূত হলো তার চেয়ে বহুগুণ যাতনায় হৃদয়পিঞ্জর হাহাকার করে উঠলো মেয়েটার। কিয়ৎক্ষন বাদে র’ক্তাভ কপোলে করতল ছুঁয়িয়ে তুষারের পানে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিপাত করলো নিঝুম। ভয়ে তটস্থ তার মুখাবয়ব । চোখের কার্নিশে জড়ো হয়েছে একফোঁটা অস্রুশিক্ত নোনা জল। মূর্তিমান নির্জীব তুষারের কঠোরতা বিন্দু পরিমান টললো না তাতে। উল্টো ভয়ের তোড়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার পানে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষিপ্ত করে বললো,
— হাউ ডেয়ার ইউ? আমাকে মিথ্যে বলার সাহস হলো কি করে তোমার? ডোন্ট ইউ নো, আ’ম আ ফা’কিং গ্যাংস্টার? তাহলে কোন সাহসে প্র্যাঙ্ক করো তুমি আমার সাথে? আন্সার মি!
ক্রোধের তাড়নায় গর্জন করে উঠলো তুষার। আড়ষ্টতায় তিরতির করে কাঁপছে নিঝুম। চোখ দিয়ে ঝরে যাচ্ছে অবিরাম অশ্রুজল।

— আর কোনোদিন যদি আমাকে ফোন করার স্পর্ধা দেখিয়েছো, তাহলে খবর আছে তোমার।
মুখের উপর স্পষ্ট হুমকি ছুড়ে ঘাড় ঘুরিয়ে সোজা হাটা ধরে তুষার। এতোক্ষণে নীরবতা ভাঙলো নিঝুম, পেছন থেকেই চ্যাঁচিয়ে শুধালো,
— বিয়ে করবেন আমায়?
থমকালো পদযুগল। কোনোকিছু না ভেবেই দ্বিতীয়বার পেছনে দৃষ্টিপাত করলো যুবক। তার স্থিরতা অবলোকন করে ছুটে এসে সামনে দাঁড়ালো নিঝুম। বুকের ভেতর অনেকটা সাহস সঞ্চার করে জানালো,
— তূর্য ভাইয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে চাইছে খালামনি, বাবা মা ও এক পায়ে রাজি। কিন্তু আমিতো আপনাকে বিয়ে করতে চাই, শুধু একবার জানতে দিন আপনার গহীন মনের অনুরক্তিটুকু। একটুখানি দূর্বলতার আভাস দিন। আমি না হয় আপনার হয়ে’ই বাড়িতে কথা বলবো।
মেয়েটার অবুঝ বাসনায় বিরক্তবোধ করলো তুষার। দাঁতে দাঁত পিষে বললো ,

— তুমি কি বাংলা কথা বুঝতে পারো না?আ’ম আ গ্যাংস্টার।
— তাতে কি?
— মানে বোঝো গ্যাংস্টারের? এটা নাটক কিংবা সিনেমা নয়। আমার সঙ্গে জীবন জড়ানোর অর্থ কি আদৌও জানো সেটা ?
ঠোঁট উল্টে এদিক ওদিক মাথা নাড়ালো নিঝুম। অর্থাৎ জানেনা। ওর ভাবনার প্রত্যুত্তরে তুষার আরও কিছু কড়া নিষেধাজ্ঞা আরোপিত করবে তার আগেই বেঁজে ওঠে মুঠোফোন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেদিকে দৃষ্টিপাত করে তুষার। স্ক্রিনে ভাসমান রাশিয়ান নাম্বারে চোখ বুলিয়ে বেশ অবাক হলো যুবক। মনেমনে আওড়ালো,

— রাশিয়ান নাম্বার থেকে সরাসরি বিডি নাম্বারে কল ঢুকছে? হোয়াই! এটাতো bratva এর রুলস বহিভূর্ত, তারমানে কি এমারজেন্সি? সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো ওখানে? ফ্লোরা এখনো ফ্যাক্স পাঠায়নি, কিন্তু কেন?
হাজারটা প্রশ্নের তোড়ে থমকালো তুষার । অগত্যা রাশিয়ান ট্যাগ শোভিত নাম্বারটাকে এক মূহুর্ত নিস্প্রভ দৃষ্টে পরখ করে মোবাইল স্ক্রিনে তর্জনী চালালো সে । ফোনকল রিসিভ হতেই কানে তুললো যন্ত্রটি।
এরপর নিস্তব্ধতায় অতিবাহিত হলো কয়েক সেকেন্ড, মাত্র কয়েক সেকেন্ডের পরিক্রমায় যুবকের চিরাচরিত থমথমে অভিব্যক্তি বিলীন হলো বিদীর্ণ এক আহত চিত্তের অন্তরায়। শক্ত করতল দু’টো মুঠিবদ্ধ করে প্রস্তর খণ্ডের ন্যায় দণ্ডায়মান যুবক। এক মিনিট, দু মিনিট নয়, সেভাবেই কেটে গেলো অনেকটা সময়। দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই আচানক চোখের কার্নিশ ভেদ করে এক ফোঁটা শীতল পানীয় গড়ালো তার তীক্ষ্ণ চিবুকে।

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৩৯

যা দেখে বিষ্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে পরে নিঝুম। প্রথমে বিশ্বাস না হওয়ার দরুন, আকাশ পানে চেয়ে বৃষ্টির আনাগোনা উপলব্ধি করে মেয়েটা। যখন নিশ্চিত হয়ে যায় বৃষ্টি তো দূরে থাক কিঞ্চিৎ মেঘের আস্ফালন ও ঘটেনি দিগন্তে। তৎক্ষনাৎ হতচকিত দু’নয়ন কপালে উঠে গেলো ওর। অবিশ্বাস আর কুণ্ঠার একচ্ছত্র তাড়নায় থেমে থেমে বিড়বিড়ালো,
— আ…আপনি কাঁ…কাঁদছেন তুষার! এটা কি আদৌও বাস্তব, নাকি আমার মতিভ্রম?

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪১