আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪১
suraiya rafa
দিগন্ত জুড়ে বুনো মহিষের পাল। ঈশান কোণে জমাট বেঁধেছে ঘুটঘুটে আধারিয়া মেঘের ভেলা। আগন্তুক শ্রাবণের প্রলয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের ন্যায় কাঁপছে আকাশ। বারিধারা আসন্ন, মেঘ ভেজা দামাল হাওয়ায় এক টুকরো কাগজের ভেলার ন্যায় দুলছে ক্রুজশীপখানি। উত্তাল সমুদ্রের প্রতিটি তরঙ্গোচ্ছ্বাস দান’বীয় হুংকা’রে আঁছড়ে পরছে ভাসমান শহরটির গায়ে।
এহেন বৈরী আবহাওয়ার মাঝেও তিনতলার পুল ডেকে সটান দাঁড়িয়ে এরীশ। বলবান খরখরে করতল দুটো তার আটকে আছে ধাতব রেলিং এ। ওভার কোটের উপস্থিতি নেই, নেভি ব্লু সিল্ক শার্টের উপর কুচকুচে কালো ওয়েস্ট কোট দ্বারা আবৃত তার পেশীবহুল শরীর। নিভে আসা সূর্যের মৃদু রোশনাই এ কিঞ্চিৎ ঝিল ধরেছে কব্জিতে আটকানো সিলভার রোলেক্সখানি।পিয়ার্সড শোভিত অনুভূতিহীন নির্জীব অক্ষিদ্বয় ঢাকা পরেছে বিশালাকার চোদ চশমার অন্তরালে। অথচ তার অদ্ভুত দৃষ্টিযুগল অবলোকন করে নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যায় চাহনি তার সূদুর অন্তরিক্ষে নিবদ্ধ।
কিন্তু ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের লৌকিক ধারণা জানান দিয়ে যাচ্ছে কারোর সুস্পষ্ট উপস্থিতি। অতি সন্নিকটে সেই অস্তিত্ব, আশ্চর্য চাহনি।টলমলে নেত্রগহ্বরে জমেছে গাঢ় নীলের আভা। উথালপাথাল বৈরী হাওয়ায় ভ্যানিলার মাদকীয় সুঘ্রাণ। সবকিছু উপলব্ধি করে একমূহুর্ত থমকালো এরীশ, অতঃপর গভীর শ্বাস টেনে নিলো বুকচিঁড়ে। নিঃশ্বাসের ছন্দে তরঙ্গিত হলো তার পুরুষালি এ্যাডামস এ্যাপেল।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
অনুভূতিহীন মাফিয়া বসের নির্বিকার ভাবাবেগ অচিরেই কুণ্ঠিত করে তুললো ঈশানীকে।লোকটা কি ওর উপস্থিতি টের পায়নি? নাকি ইচ্ছে করেই অবজ্ঞা করে যাচ্ছে তখন থেকে? ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না রমণী। অগত্যা দাঁড়িয়ে না থেকে পিছু হাটলো দু’কদম। পুল ডেকের পাশেই শ্বেতকায় বিশাল বড় দৈত্যাকার এক স্কাল্পচার। বরফের দেশের এক শুভ্র মায়া নেকড়ে স্থীর দাঁড়িয়ে সেথায়, গগন পানে বাড়িয়ে রাখা গ্রীবাদেশের পাশেই বড়বড় ইংরেজি অক্ষরে খচিত, THE PYTHON LEADER IS HERE.
শ্বেতপাথরে আবৃত মায়া নেকড়ের অবয়বটি তার তীক্ষ্ণ মাং’সাশী দন্তপাটি বের করে দূর আকাশে মুখ বাড়িয়ে রয়েছে। এক দেখায় মনে হবে এক্ষুনি ভয়ং’কর হাউলিং ছেড়ে কাঁপিয়ে তুলবে চারিপাশ। ঝকঝকে নেকড়ের স্কাল্পচারটি মূহুর্তেই আকর্ষন কেড়ে নিলো ঈশানীর,কৌতুহলের পারদে নীলাক্ষি দু’টো চিকচিক করে উঠলো তার, বিনাবাক্যে এগিয়ে গেলো সেদিকে। যদিও রাশিয়ার বীভৎস নরকীয় স্মৃতিগুলো কোনো কালেই স্বস্তি দেয়না মেয়েটাকে, তবুও স্কাল্পচারটি দেখা মাত্রই ফ্লোরার কথা মনে পরে গেলো ওর। মানস্পটে জাগ্রত হলো রুশকন্যার সাথে অতিবাহিত করে আসা একাধিক বিমুগ্ধ স্মৃতির অধ্যায়।
ফ্লোরার ভাবনা মস্তিষ্কে উদয় হতেই এক চিলতে নিগূঢ় হাসি প্রস্ফুটিত হয় রমণীর অধর ভাঁজে, চিন্তায় মশগুল ঈশানী আনমনে হাত বাড়ায় মূর্তিমান অবয়বটির পানে।তৎক্ষনাৎ কয়েক সেন্টিমিটার দূরত্ব থেকে ভেসে এলো কর্কশ নিষেধাজ্ঞা,
— ডোন্ট টাচ্ ইট।
হকচকালো ঈশানী। মায়া নেকড়ের সুন্দর ক্রিস্ট্যাল খচিত চোখখানি স্পর্শ হতে হতেই থমকে গেলো করতল।অকস্মাৎ বাঁধা প্রদানে আড়ষ্টতায় জমে গিয়ে চাইলো পেছনে, নজরে এলো মাফিয়া বসের চৌকস দৃষ্টিযুগল।
আঙুলের সাহায্যে রোদ চশমা সরিয়ে অক্ষিপুটের মিলন ঘটালো লোকটি। মুখোমুখি দু’জনার দৃষ্টি জুড়ে অগাধ ব্যাকুলতা, নিখাঁদ অভিব্যক্তি,উথাল-পাতাল অনুভূতির জলোচ্ছ্বাস। কেবল অনুভূতিই নয়, আইন স্বীকৃত বৈধ পন্থায় একে অপরের পরিপূরক তারা। দিবালোকের মতোই স্বচ্ছ এ সম্পর্ক। অথচ দু’জনার অন্তরাত্মা ভেদ করে, অনুভূতি চিঁড়েফেড়ে মধ্যখানে দন্ডায়মান এক পাপ পূন্যের মহাপ্রাচীর। আলো আঁধারের কঠোর বিঘ্নতা। বাস্তবতা আর মরীচিকার অদৃশ্য বেড়াজাল।
পৃথিবীর সমগ্র বিঘ্নতাকে পায়ে ঠেলে, প্রথম কদমে সম্মুখে অগ্রসর হলো মাফিয়া বস।তিরতির করে চিঁড় ধরলো বেড়াজালে। স্তম্ভিত ঈশানী শুষ্ক একটা ঢোক গিলে অর্ধাঙ্গ মানবকে শুধালো,
— স্পর্শ করতে বাঁধা দিচ্ছেন, খুব দামী বোধ হয় এটা?
যদিও এই প্রশ্নটার প্রত্যাশা করেনি এরীশ, ওর সিক্রেট কামরায় যে নীলাম্বরীর পদচারণ ঘটেছে সে বিষয়ে অবগত মাফিয়া বস। তাহলে কি মেয়েটা এখনো ওকে ভয় পাচ্ছে? মস্তিষ্কে আগন্তুক প্রশ্নটাকে স্বভাবসুলভ উপেক্ষা করে গেলো সে, ছুড়লো শক্ত ভরাট কন্ঠস্বর,
— nope! Your every single touch is only belongs to me.
দ্বিধাহীন স্পষ্ট বাক্য। লোকটার এহেন অধিকারবোধে ভড়কালো ঈশানী। সংকীর্ণতা ঘিরে ধরলো তার সর্বাঙ্গে। চুপচাপ, ঘরমুখো হওয়া সত্ত্বেও কিঞ্চিৎ আড়ষ্টতায় র’ক্তিম আভা ছড়ালো পেলব কপোলে। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই প্রশ্ন ছুড়লো বিপরীত পক্ষ,
— তোমাকে মাত্রাতিরিক্ত লাল দেখাচ্ছে, জ্বর কমেনি এখনো?
এরীশের সহজ স্বীকারোক্তিটুকু কর্ণগোচর হতেই তরাগ করে চোখ তুললো মেয়েটা। হতবিহ্বল নয়নে মাফিয়া বসের তীক্ষ্ণ চেহারার পানে দৃষ্টিপাত করে মনেমনে ভাবলো,
— লোকটা আসলেই অনুভূতিহীন। কোনটা জ্বরের আভা আর কোনটা লজ্জার, সেটুকুও তার হৃদয় স্পর্শ করতে পারেনা।কি আশ্চর্য!
ফের দু’কদম সামনে এগোলো এরীশ, ফাটল ধরা অদৃশ্য প্রাচীর খানি ভেঙে চৌচির হলো এবার। নির্জীব মানবের শীতল দৃষ্টিতে হৃদযন্ত্র ছলকে ওঠে রমণীর। দু’হাতের সাহায্যে পরিধেয় ফ্রকটাকে মুঠোবন্দি করে গলা খাদে নামিয়ে অকস্মাৎ বলে ফেলে,
— আপনি আমাকে স্টক করেছেন এতোদিন,কিন্তু কেন?
মরীচিকাকে প্রশ্ন করার স্পর্ধা দেখিয়েও টললো না দু’নয়ন। অধিকারবোধ টুকু বোধ হয় প্রাপ্য মেয়েটার। থমকালো না বিপরীত পক্ষ,ধীর কদমে এগিয়ে এসে স্থির হলো নীলাম্বরীর সন্নিকটে, দূরত্ব ন্যানো সেন্টিমিটারের চেয়েও নগন্য। মেয়েটার নিঃশ্বাসের তালে ওঠানামা করা বিউটিবোন গুলো মোহাবিষ্টের ন্যায় আকর্ষন কেড়ে নিতে সক্ষম,সেদিকে একপল দৃষ্টিপাত করে গভীর স্বরে জবাব দিলো মাফিয়া বস,
— এরীশ কাউকে কৈফিয়ত দেয়না!
নাকের পাটা তিরতির করে ফুলে উঠলো রমণীর, অস্থির হয়ে বললো,
— আমার কি নূন্যতম প্রাইভেসীটুকু নেই?
— আমার কাছে নেই। শরীর থেকে শুরু করে আত্মা, তোমার সমগ্র অস্তিত্ব মুখস্থ হয়ে গেছে আমার। ডিটেইলস জানতে চাও?
তীর্যক বাক্য ছুড়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে কুটিলতায় ভ্রু উঁচালো মাফিয়া বস। তর্কে না পেরে মুখাবয়ব কুঁচকে এলো ঈশানীর। দাঁড়িয়ে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছে ভীষণ, সহসা পেছনে ঘুরে স্থান ত্যাগ করায় উদ্যত হতে হতে তেঁতো গলায় বিড়বিড়ালো,
— জা’নোয়ার!
শব্দটা উচ্চারণ করে সম্মুখে অগ্রসর হতে না হতেই কব্জিতে পোক্ত করতলের টান অনুভব করলো মেয়েটা। বিস্মিত হয়ে পেছনে দৃষ্টিপাত করার আগেই হ্যাঁচকা টানে ওর শীর্ণকায় শরীরটাকে সান্নিধ্যে নিয়ে এলো এরীশ । অকস্মাৎ মোলায়েম নারী পৃষ্ঠদেশ গিয়ে ঠেকলো পুরুষালি ইস্পাত কঠিন বক্ষভাঁজে।এবারে সর্বশেষ দূরত্বটুকু নিজ হাতে ঘুঁচিয়ে দিলো মাফিয়া বস। কোনোরূপ পূর্বাভাস ব্যাতিত খরখরে বলিষ্ঠ হাতখানা নিয়ে রাখলো রমণীর বুকের বাম পাশে। সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে মুখ থুবড়ে পড়লো দূরত্বের ঠুনকো বেড়াজাল।
ধনুকের মতো তীক্ষ্ণ শরীরের ভাঁজে এহেন আচানক পুরুষালি স্পর্শে জমে উঠলো নাজুক সর্বাঙ্গ। বাহ্যিক আড়ষ্টতা ছাপিয়ে খেই হারালো হৃদযন্ত্র, হাঁপরের মতো ধড়ফড় করতে লাগলো অন্তঃকরণ। ভীত মেয়েটার কুণ্ঠায় জমে আসা শরীরটাকে নির্দ্বিধায় উপেক্ষা করে গেলো মাফিয়া বস, লম্বা আঙুল গুলোকে নমনীয় নারী উপত্যকায় স্থীর রেখে আরও দিগুণ করলো স্পর্শ। অচিরেই সংকোচে কুঁকড়ে গেলো জমে আসা শরীর। ঠোঁট গলিয়ে বেড়োলো অপ্রস্তুত মৃদু আওয়াজ,
— আ..আম..আসলে…ছাড়ুন।
বেপরোয়া নি’র্দয় মাফিয়া বস বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করলো না সেসব অনুনয়ে।উল্টো স্পর্শে প্রগাঢ়তা টেনে গ্রীবাদেশ বাড়িয়ে ঝুকলো রমণীর নিকট। কানের কাছে মুখ নিয়ে হিসহিসিয়ে জানান দিলো তার ব্যাকুল অভিব্যক্তির। পেছন থেকেই গভীর হাস্কিস্বরে বলে উঠলো ,
— ইট’স বিটিং সো ফাস্ট । তোমার হার্ট যে এতো বেশি দূর্বল আগে কেন বলোনি? নি’র্দয়, দুর্ধ’র্ষ জা’নোয়ারটাকে কি করে ঠায় দিবে এই দূর্বল হৃদয়ে? কষ্ট হবেনা?
নিমেষেই কুণ্ঠিত হয়ে পরলো ঈশানীর নাজুক চিত্ত, তবে ব্যতিগ্রস্ত নয়। সম্পর্কের বৈধতা ওকে আত্নবিশ্বাস জুগিয়েছে, ঠেলেছে মরীচিকার অতলে। মুখে স্বীকার না করলেও সংস্পর্শে দাঁড়ানো লোকটার প্রতি এক আকাশসম ঘৃ’ণার উদ্ভাসন যেন সেই কবেই বিলীন হয়েছে মুগ্ধতায়। বোকা মেয়েটা শেষমেশ আবারও হোঁচট খেয়েছে নি’ষ্ঠুরতম মানবের কাঠিন্যতায়। তবে এবার ঈশানী একা নয়, ওর পাশাপাশি আরও একজন ভেসেছে প্রণয় প্লাবনে।
এরীশের কথার পাছে নরম রিনরিনে আওয়াজে কিছু একটা প্রত্যুত্তর করতে চাইলো রমণী, তবে ফুরসত পেলোনা বিশেষ। তার আগেই দৃষ্টিভেদ করে ক্রুজশীপের সর্বনিম্ন ডেক থেকে আচানক ঝড়ের বেগে পরপর বেড়িয়ে গেলো লোক বোঝাইকৃত দুটো স্পীডবোট। অযাচিত দৃশ্যে হতচকিত হলো ঈশানী। তৎক্ষনাৎ এরীশকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলো পুল ডেকের অগ্রভাগে। রেলিং এ এক হাত রেখে অন্যহাতে জলরাশি ভেদ করে ছুটে চলা ঝাপসা স্পীডবোট দু’টোকে ইশারা করে অবিশ্বাস্য গলায় শুধালো,
— ওরা কোথায় যাচ্ছে?
— বন্দরে।
রেলিং এর নিকট এগিয়ে এসে প্রত্যুত্তর করলো মাফিয়া বস। দমলো না ঈশানী, অস্থির হয়ে জানতে চাইলো,
— তারমানে বন্দর এখান থেকে খুব কাছে? তাহলে আমরা ক্রুজশীপে কি করছি?
— এটাই তোমার বাসস্থান, এডজাস্ট করে নাও।
মূহুর্তেই সাবলীল অভিব্যক্তি পাল্টে গেলো লোকটার। মুখাবয়ব জুড়ে উদ্ভব ঘটলো পরাশক্তির। ওর অনুভূতিহীন শূন্য ভাবাবেগ অবলোকন করে শুষ্ক ঢোক গিললো ঈশানী। জড়ানো কণ্ঠে বললো,
— স্পীডবোটের মাধ্যমে চাইলেই বন্দরে পৌঁছানো যাওয়া যায়, কিন্তু কতক্ষণ সময় লাগে?
বাক্য সম্পন্ন হওয়ার পরপরই নিজের শূন্য নেত্রগহ্বর জোড়া মেয়েটার পানে স্থির করালো মাফিয়া বস। আশঙ্কিত ভীত নীলাম্বরীর পানে পূর্ণ দৃষ্টিপাত করে দাঁতে দাঁত পিষে ছুড়লো তীর্যক বাক্যবান,
— হঠাৎ এতো প্রশ্ন করছো? ভুল করেও পালানোর স্পর্ধা দেখিও না, আমার হাত থেকে এ জীবনে নিস্তার নেই তোমার ।
— যদি সত্যিই পালিয়ে যাই কখনো?ত…
সর্বশেষ বাক্যটুকু ধ্বনিত হওয়ার আগেই অকস্মাৎ থাবায় ওর সরু কণ্ঠনালিখানা শক্ত হাতে চেপে ধরে ব্লাডিবিস্ট। হাতের বাঁধনের প্রগাঢ়তায় ব্যথায় ককিয়ে উঠলো ঈশানী, তবে কোনোরূপ বাঁধা প্রদান করলো না লোকটাকে। ভেতরের আত্মসংযমের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আগ্নেয়গিরির দাবানলের ন্যায় জ্বলে উঠলো মাফিয়া বস। উদ্ভব হলো ভেতরে রাজত্ব চালিয়ে বেড়ানো নি’র্দয় পৈ’শাচিক সত্তার। মোহাবিষ্টের ন্যায় সিগারেটপোড়া কালচে বাদামী অধরখানা বাড়িয়ে দিলো ঈশানীর কবুতরির কণ্ঠনালির সরু ফাঁকে। পরপরই অন্তরে কাঁপন ধরানো শীতল নির্জীব স্বরে প্রত্যুত্তর করলো,
— পৃথিবী তছনছ করে হলেও তুলে নিয়ে আসবো। এখানে, এই আমার কাছে।
এক মূহুর্ত নৈঃশব্দ্য।
পরপরই চোয়াল শক্ত করে স্বগোক্তিতে বিড়াবিড়ায় ব্লাডিমনস্টার,
— আমাকে সহ্য করার ক্ষমতা তোমার নেই, নয়তো এই মূহুর্তে…..
বাক্য সম্পন্ন হলোনা, তার আগেই টলমলে নীলনেত্রের আহত চাহনির মাঝে থমকে গেলো দৃষ্টিযুগল। এক লহমায় বাষ্পীভূত হলো অ’গ্নি তান্ড’ব। অসার হয়ে এলো হাতের বাঁধন। নিভে আসা ধূসর বাদামি চোখ দু’টোর মাঝে দৃষ্টিস্থাপন করে ঈশানীর স্মৃতিজুড়ে জাগ্রত হলো মাহিনের বলে যাওয়া ছোট্ট এক বাক্য,
— এটাকে ভালোবাসা বলেনা ঈশানী। ইট’স জাস্ট হিজ ভেনম অবসেশন। সময় পেরোলে ঠিকই মোহো কে’টে যাবে।
— সত্যিই কি তাই?
বক্ষগহ্বরে আচানক উদ্ভাসিত প্রশ্নটা বাড়িয়ে দিলো নিস্তব্ধতা। দু’জনের অন্তরের ব্যাকুলতা আজও অপ্রকাশিতব্যই রয়ে গেলো। অসহনীয় এই নীরবতার ইতি টেনে এরীশ কিছু বলবে। নিজের কর্মকাণ্ডে অনুতপ্ত হয়ে সাকুরাকে খানিক ধাতস্থ করবে। তার আগেই পিনপতন নৈঃশব্দ্যের ইতি ঘটালো পুল সাইডে ফেলে রাখা ওয়াকিটকিটা। যন্ত্রটি থেকে বারংবার এমারজেন্সি সিগন্যাল আসায় এগিয়ে গিয়ে সেটাকে মুঠোবন্দি করলো এরীশ। বোতাম চেপে মুখের সামনে তাক করতেই ওপাশ থেকে ধ্বনিত হলো কিছু সচকিত শব্দের বহর ,
— হ্যালো, হ্যালো লিডার, ডু ইউ কপি!
— ইয়েস কপি!
এপাশ থেকে সুপরিচিত সিগন্যাল পেশ হতেই, হকচকিয়ে উঠলো বিপরীত প্রান্ত। তৎক্ষণাৎ প্রচণ্ড উদগ্রীব স্বরে প্রত্যুত্তর করলো লোকটা,
— প্লিজ পিক আপ দ্যা ফোন। ইট’স আর্জেন্ট।
কোনোরূপ ব্যতিগ্রস্ত না হয়েই, কানের ফাঁকে এয়ারবাড’স গুঁজলো এরীশ। অতঃপর নৈঃশব্দ্য।
ওপাশের কোনোকিছুই ঠিকঠাক শুনতে পেলোনা ঈশানী। কেবল হতচকিত নয়নে অবলোকন করলো তার মাফিয়া বসের চিরাচরিত নির্জীব শূন্য অভিব্যক্তির আড়াল থেকে বেড়িয়ে আসা এক বি’ধ্বং’সী দা’নবীয় মুখাবয়ব। যার সুচারু দৃষ্টিযুগলে ভর করেছে নেকড়ে মানবের ন্যায় ভ’য়াব’হ হিং”স্রতা। বি”ধ্বং’সী অভিব্যক্তি ধরে রেখে শক্ত করতল দু’টো মুঠিবদ্ধ করে অচিরেই কঠোর স্বরে আদেশ ছুড়লো মাফিয়া বস,
— মস্কোর প্রতিটি এয়ারপোর্টে রেস্ট্রিকশন বসাও,প্রতিটি লবি সিলগালা করে দাও। বিমান তো দূরে থাক, একটা কাকপক্ষীও যাতে মস্কোর আকাশ অতিক্রম করার সুযোগ না পায়। মনে রেখো এটা পাইথন লিডারের আদেশ। এবারে বিশ্বা’সঘা’তকে’র র’ক্ত দিয়ে পাইথন প্যারাডাইসের কলুষতা ঘোঁচাবে এরীশ ইউভান।
ও পাশ থেকে কুর্নিশ জানিয়ে কলটা লাইনচ্যুত হতেই, ক্রোধের তাড়নায় ওয়াকিটকিটা গভীর সমুদ্রে ছুড়ে মে’রে দাঁতের মাঝে দাঁত পিষে স্বগতোক্তি গালি ছুড়লো এরীশ ,
— সন অব আ বিচ। আ’ল টি’য়ার ইওর এন্টা’য়ার বডি অ্যা’পার্ট।
মাফিয়া বসের অকস্মাৎ এহেন হিং’স্রা’ত্তক মনোভাবে আঁতকে ওঠে ঈশানী। শুষ্ক একটা ঢোক গিলে গলার স্বর খাদে নামিয়ে শুধায়,
— কি হয়েছে?
নির্বিকার এরীশ, কোনোরূপ জবাবদিহিতা না করেই লম্বা পা ফেলে গটগটিয়ে ত্যাগ করলো পুলডেক, তবে যাওয়ার আগে কি ভেবে যেন ফের এগিয়ে গেলো ঈশানীর অভিমুখে। কাছাকাছি এসে সাকুরার র’ক্তিম অধরে টুকরো চুমু খেলো আচানক। অতঃপর শুষ্ক অধরের ফাঁক গলিয়ে নির্জীব স্বরে ধ্বনিত হলো,
— টেক কেয়ার। মনে রেখো, আমি না ফেরা পর্যন্ত এই ক্রুজশীপের বাইরে পা রাখবে না। আই রিপিট, দুনিয়া উল্টে গেলেও না।
কথা কটা শেষ হলে সাকুরার প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করেই হনহনিয়ে বেড়িয়ে গেলো মাফিয়া বস। ওদিকে প্রস্থানকৃত লোকটার পানে অলীক দৃষ্টে চেয়ে রইলো রমণী। ছলছলে নীল নেত্রের কার্নিশে অজান্তেই জড়ো হয়েছে একফোঁটা বিষাদের জল। জলটুকু নির্বিকারে বির্সজন দিয়ে অর্ধাঙ্গের যাওয়ার পানে চেয়ে ব্যথাতুর স্বরে বিড়বিড়ালো রমণী,
— আপনি ঠিকই বলেছিলেন অরণ্য। মাফিয়ারা কখনো স্বাভাবিক জীবন, সাবলীল সম্পর্ক কিংবা ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি কিছুই দিতে পারেনা। তাও কেন অনবদ্য অনুভূতির অদৃশ্য ইন্দ্রজালে বেঁধে নিলেন আমায়? আপনি তো প্রলয়, তাও কেন ধ্বং’স না করে আগলে রাখছেন বারে বারে। কেন নিজের নিষিদ্ধ আত্মার মাঝে গুটিয়ে রাখতে চাইছেন আমার সরল অস্তিত্বকে? তবে কি আপনিও ভালোবাসেন?
প্রশ্নটা থেকেই গেলো অন্তরে। কেবল নীলাম্বরীর অনুভূতি ছাপিয়ে মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় কর্ণকূহরে এসে ডানা ঝাপটালো দুটো বিষণ্ণ গানের লাইন,
আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪০
” পথ ভুলে গেছি চলে দূরের কুয়াশায়,
তবু আমার ফিরে আসার সত্যিই নেই উপায়।…..
তুমি আমার জিতের বাজি,
তুমি আমার হার…..
কি করে বলবো তোমায়,
আসলে মন কি যে চায়,
কেন সে পালিয়ে বেড়ায়
তোমার থেকে…