আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪১ (২)

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪১ (২)
suraiya rafa

পাইথন প্যারাডাইস, রাশিয়া।
বিরস অশুভ আবহ। গত দু’দিন ধরে গুমোট পরিবেশটা রূপ নিয়েছে থমথমে নিস্তব্ধতায়। এ যেন প্রলয়ের পূর্বাভাস। প্যারাডাইস গেটের অভ্যন্তরে বুক চিতিয়ে নিটোল দাঁড়িয়ে থাকা সুউচ্চ ভবনে উপস্থিত প্রতিটি জীবন্ত অস্তিত্বকে ঘিরে ধরেছে প্রবল আ’তঙ্ক। পরাশক্তির নয়, বরং পাইথন লিডারের আগ্রাসী আ’ক্রমণের আশংকায় কীটপতঙ্গের ন্যায় তটস্থ সকলে ।
টমেটো প্রিন্সের অতর্কিত হাম”লার পর থেকেই প্যারাডাইস গেটের সশস্ত্র দেহরক্ষীরা দিনরাত অবিরত পারাহায় নিমজ্জিত। বাড়ানো হয়েছে দিগুণ জনবল। তবুও যেন কোনো এক অদৃশ্য দানবীয় আস্ফালনের তোড়ে সর্বদা কুণ্ঠিত তারা।

দিবালোকের অন্তিম প্রহরে এসে রেশ বাড়লো গুমোটতার। ঠান্ডায় জমে আসা জঙ্গলের হিমায়িত সরু রাস্তা ছাপিয়ে আগমন ঘটলো কুচকুচে কালো ব্ল্যাক মার্সিডিজের। আস্তেধীরে নয় স্পিডোমিটারের সর্বোচ্চ গতি নিশ্চিত করে যথারীতি উদভ্রান্তের ন্যায় এগিয়ে আসছে যান্ত্রিক গাড়িটি। দেখলে মনে হবে জুতসই গিয়ারে হাত না চালালে অচিরেই প্যারাডাইস গেট ভে’ঙেচুরে ভেতরে ঢুকে যাবে আগন্তুক।
সন্ধ্যা নাগাদ এহেন উদভ্রান্ত গাড়ির স্পিড পরখ করে সচকিত হয়ে পরলো গার্ড সকল। বাহুতে আটকানো সিলভার রাইফেলটাকে লোড করে সম্মুখে এগোলো সবেগে। তবে কালো মার্সিডিজ খানা গেটের কাছাকাছি আসা মাত্রই থমকে গেলো প্রত্যেকটি চঞ্চল পদযুগল। কোনোরূপ দ্বিধান্বিত না হয়ে তরতরিয়ে দু’পাশে সরে গেলো গার্ডসরা।
প্রথমে ভীতিগ্রস্ত হয়ে পরলেও, গেটের অভ্যন্তরে কেবল একটা মাত্র গাড়ির উপস্থিতি কিঞ্চিৎ স্বস্তি ঢাললো অন্তরে। যেহেতু শুধু মাত্র একটা গাড়ি প্রবেশ করেছে, তারমানে এটা পাইথন লিডার নয়। হতে পারে প্যারাডাইস গ্যাং’স্টার তুষার জাওয়াদের আগমন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আগে-পরে পেন্টহাউজ কোনোরূপ অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হলে সবার প্রথমে রাশিয়ায় ফেরে এরীশ, কিন্তু চিরাচরিত সেই নিয়মে বিরাট পরিবর্তন সাধিত করে এবারে সর্বপ্রথম রাশিয়া ফিরেছে তুষার। ব্যাপারটা রহস্যজনক, তবে আত’ঙ্কের নয়। কারণ উদভ্রান্ত পৈশাচিক কার্যকলাপে তুষারের চেয়ে বহুগুণ এগিয়ে এরীশ। গার্ডদের প্রবল বিশ্বাস তুষারের মাঝে মনুষ্যত্ব বোধ থাকলেও থাকতে পারে।
খুব বেশিক্ষণ দুশ্চিন্তার ফুরসত পেলোনা না স্থবির চিত্তে দাঁড়িয়ে থাকা মূর্তিমান গার্ড’স গুলো। তাদের গভীর ভাবনাকে থকথকে চামড়ার বুটের তলায় পিষে তড়িৎ বেগে বেড়িয়ে এলো মাস্টারমাইন্ড। অকৃত্রিম নির্জীব চাহনি তার। দু’হাতের মাঝে আঁটকে আছে দু’টো চকচকে রিভলবার। দু’টোই ধাতব বুলেট দ্বারা পরিপূর্ণ।

বি’ধ্বংসী এরীশ নয়, বরং সকল পরিস্থিতিতে নিজের গম্ভীর অভিব্যক্তিতে অটুট থাকা তুষারের অকস্মাৎ নৃ”শংসতা যেন কাঁপন ধরিয়ে দিলো উপস্থিত সকলের নিগূঢ় চিত্তে। সময় নষ্ট করলো না মূর্তিমানব, দিশাহীন পদচারণায় এগিয়ে আসতে আসতে যান্ত্রিক রোবটের ন্যায় দু’হাতে ছুড়তে লাগলো ধাতব বুলেটের বর্ষন। দৃশ্যপট বদলানোর মতোই এক নিমেষে বদলে গেলো আবহ। শীতকালীন বুনোফুলের সুবাস ছাপিয়ে বারুদের উৎকট ঝাঁঝালো গন্ধে ভরে উঠলো চারিপাশ। অতর্কিত বুলেটের ক’ষা’ঘাতে বিদ্ধ হয়ে যত্রতত্র ছিটকে পরতে লাগলো দেহরক্ষী গুলো। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে এলোপাতাড়ি গুলির বর্ষনে এক মূহুর্তে পুরো ময়দান খালি করে ফেললো গ্যাংস্টার মানব। রিক্তশূন্য হিং”স্র দৃষ্টিজুগল কেবল র’ক্তের তাড়নায় আগ্রাসী। যেন আশেপাশের সকলেই তার জানের শ’ত্রু।
খরখরে শীতল ভূমিতে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে বিকটাকার গুলির বর্ষন। র’ক্তস্নাত চারিপাশ। চমৎকার কারুকাজ শোভিত কৃত্রিম ঘাস আবৃত লন জুড়ে এখন কেবলই নৃ’শংস বিভীষিকা। ছিন্নভিন্ন মানবদেহ,অজস্র র”ক্তপ্লাবন সবকিছুকে নির্দ্বিধায় উপেক্ষা করে পেন্টহাউজের দিকে এগিয়ে গেলো তুষার।লোড করা রিভলবার দু’টো এখনো হাতে আবদ্ধ তার।

এলিভেটর ধরে সোজা গিয়ে পৌঁছালো লাউঞ্জে, ভেতরে প্রবেশ করে এক লহমায় নৃ’শংস’তার কবলে ধরাশায়ী করে ফেললো চারিপাশ। চোখের সামনে যাকে পেয়েছে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে তাকেই শ্যুট করে দিয়েছে সবেগে। পুরো লাউঞ্জটাকে যেন ভাসিয়ে দিয়েছে র’ক্ত গঙ্গায়। সেই সঙ্গে ওর ফর্মাল সফেদ শার্ট আর তামাটে মুখাবয়ব সবকিছু জুড়েই টকটকে রক্তাভ লালিমার উদ্ভাসন। যেন অশুভ বি”ধ্বংসীরাজ আজ স্বয়ং নতজানু হয়েছে মানবের নৃ’শংস’তার অনলে। বীভৎস র’ক্তের খেলায় অবিরত থেকে একপর্যায়ে গলা ছিঁড়ে চ্যাচিয়ে উঠলো তুষার,
— কোথায় ছিলে তোমরা সেদিন, কোথায়?এতোজন মিলেও যখন আমার স্নোফ্লেক্সকে সুরক্ষিত রাখতে পারনি। তাহলে এখনো বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই তোমাদের।

অন্তরের তাড়নায় সৌষ্ঠব শরীরের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে সম্মুখের কফি টেবিলটাকে এক ধাক্কায় আঁচড়ে ফেলে দিলো র’ক্ত প্লাবিত মার্বেল পাথরের শ্বেতকায় মেঝেতে। ঝনঝন আওয়াজে মুখরিত হলো চারিপাশ। অতঃপর হিং’স্র দানবের ন্যায় গজরাতে গজরাতে পেছনে ঘুরলো তুষার,ওদিকে ফ্লোরার ছোট্ট শোবার ঘরটা অবস্থিত । বিশাল কিচেন কাউন্টার অতিক্রম করে সেদিকেই এগুলো সে । এতোক্ষণের উদভ্রান্ত গতিবেগ পরাস্ত হয়ে এলো ক্রমশ। হৃদয় থেকে শুরু করে হাত,পা এমনকি সমগ্র অস্তিত্ব বরফের মতোই ঠান্ডা হয়ে আসছে যেন। মস্তিষ্ক যতই অগ্রসর হতে উদ্বিগ্ন, গোলাপি আভায় মোড়ানে রুশকন্যাকে দেখার তাড়নায় ব্যাতিব্যস্ত, হৃদযন্ত্রটা ততই অদৃশ্য শঙ্কায় মরিয়া।
সবসময় স্থবির ভঙ্গিমা ধরে রাখা নিটোল যান্ত্রিক শরীরটাও আজ কাঁপছে যাতনায়। শুধু কি যাতনা? আপসোস, আত্মগ্লানি,ওই তুলতুলে মুখে আচ্ছাদিত কদাচিৎ ক্ষতচিহ্ন সব, সবকিছু একযোগে পঙ্গপালের ন্যায় উন্মাদ করে তুলছে মস্তিষ্কটাকে। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে দিচ্ছে অসহনীয় বি’ষক্রিয়া।
জীবনে এটাই বোধ হয় প্রথমবার যখন কিনা তুষার পেন্টহাউজে ফিরেছে, আর ফ্লোরা উৎফুল্লতায় ছুটে না এসে, দরজা ভেজিয়ে নিজেকে কক্ষবন্দি করে রেখেছে ।

এই তো বছর দশেক আগের কথা, যখন কিনা ফ্লোরা প্রথমবার পা রেখেছিল পেন্টহাউজে। দশ বছরের ছোট্ট মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে অভিমানে নাক ফুলিয়ে প্রবেশ করেছিল এই নিষিদ্ধ দুনিয়ায়। হার জিতের লড়াই থেকে শুরু করে, কালো বাজারি, নারীপা’চা’র, ক্যাসিনো,রমরমা প্রস্টিটিউড ক্ল্যাব, দুনিয়া কাঁপানো অবৈধ হীরে পা’চার। সবশেষে অসহনীয় আর্তনাদ আর হাহাকারে মুখরিত পাষবিক র’ক্তের ইন্দ্রজাল খচিত আধারিয়া নিকোশ এই পেন্টহাউজ। সবকিছুই ছিল নিষ্পাপ ফ্লোরার অগোচরে। এতো এতো পাপাচারের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করার পরেও মাফিয়াদের কালো দুনিয়ার বীভৎস নৃ’শংস’তা বিন্দুমাত্র ছুঁতে পারেনি ওকে। হয়তো ছোঁয়ার সুযোগটাই দেওয়া হয়নি। কোনো এক অদৃশ্যমান গণ্ডি সারাক্ষণ সুরক্ষিত রেখেছে রুশকন্যার একমুঠো নাজুক সত্তাকে।

যার দরুন বরাবরই ওর আত্মাটা ছিল ফুলের ন্যায় নিষ্পাপ আর বারিধারার মতোই পবিত্র। অন্তর থেকে শুরু করে সমগ্র অস্তিত্বজুড়ে খেলা করতো নিদারুণ চাঞ্চল্যের অভিলাষ। যদিও এই চঞ্চলতায় বারবার নিষেধাজ্ঞা হাঁকিয়েছে তুষার, তবে কাজ হয়নি খুব একটা। সেই শুরুর দিন গুলো থেকে তুষার নামক যান্ত্রিক মানবের চোখ রাঙানি, কঠোর ধমক,এমনকি ঝাড়ি খেয়ে খেয়ে অভ্যস্ত মেয়েটা। সেই সঙ্গে অভ্যস্ত কনকনে শীতল আবহের মাঝেও মানুষটার জামাকাপড়ের যত্ননিতে। প্রথম প্রথম কষ্ট হলেও, ধীরে ধীরে কেমন ভালোলাগায় পরিনত হয়েছে এসব কাজ,ভয়ের আবরণ ছাপিয়ে অন্তরে উদ্ভব ঘটেছে ভালোবাসার। বয়সের সাথে সাথে স্রোত তরঙ্গের ন্যায় হু হু করে বৃদ্ধি পেয়েছে অধিকারবোধ। ততদিনে মাফিয়াদের পাপাচার, পাষবিক নৃ’শংস’তা কোনোকিছুই আর হৃদয় ছুঁতে পারতো না ফ্লোরার। সবকিছু পায়ে মারিয়ে রুশকন্যার সদ্য অঙ্কুরিত আবেগি চিত্তখানি ছিল অনুভূতির মাতনে বিভোর। হৃদয়ের সবটুকু জুড়ে সেই নিষ্ঠুরতম মানবের বিচরণ, যে কিনা প্রথমবার ঠায় দিয়েছিল নিজের চওড়া কাঁধের একাংশে। নাম সিটকে, কপাল কুঁচকে হলেও নিয়ে এসেছিল এই মস্কো শহরে।

কোনো এক মাফিয়া মিশনে গ্রে’নেড হা’মলায় জীবন খোয়াতে হয়েছিল ফ্লোরার বাবা মায়ের। তারা ছিলেন একযোগে পাইথন প্যারাডাইসের অন্যতম দু’জন গু’প্তঘা’তক এবং নির্ভীক দেহরক্ষী । আস্থাভাজন হওয়ার দরুন সবসময়ই নিজেদের দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডের দ্বারা প্রশংসা কুড়িয়েছেন তরুণ থেকে যুবকের কোঠায় সদ্য পদার্পন করা পাইথন লিডারের।
বিশ্বস্ত স্পাইদের এহেন অকাল মৃ’ত্যুর শেষ সংবাদটুকু বাড়ি অবধি পৌঁছে দেওয়ার জন্যই এরীশ নিজ উদ্যেগে তুষারকে পাঠিয়েছিল রাশিয়া থেকে প্রায় পনেরো শ মাইল দূরে ইয়াকুতিয়ার ছোট্ট এক প্রত্যন্ত গ্রামে। দিবালোকের প্রথম প্রহরেও রোদের আস্ফালন মলিন সেথায়। চারিদিকে শুধু বরফের আচ্ছাদন, স্বাভাবিক জীবন অতিবাহিত করা এক প্রকার দুঃসাধ্য বলা চলে। সেখানেই দেখা মিলেছিল সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপের ন্যায় এক কোমলপ্রাণ ফ্লোরার। “ফ্লোরা” নামের মতোই সুশ্রী তার দ্যুতি। তবুও দশ বছরের মেয়েটাকে দেখে মূর্তিমান তাগড়া যুবক তুষারের প্রথম যে শব্দটা মাথায় এসেছিল তা হলো, “স্নোফ্লেক্স”,অর্থাৎ তুষার কণা। স্নোফ্লেক্স মূলত সাধারণ কোনো তুষার কণা নয়, সূদুর অন্তরিক্ষ থেকে নিপতিত ষষ্ঠ কোণাকৃতির সুক্ষ্ম বরফের কণা। যা দেখতে অনেকটা জলজলে তারকারাজির মতোই আকর্ষনীয়।

বরফের আচ্ছাদনে জমে থাকা হিমায়িত গ্রামে একমাত্র বৃদ্ধা দাদির সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা ফ্লোরার। ওমন বৈরী আবহাওয়ার মাঝে সদ্য প্রস্ফুটিত ফুলের কলিখানা কেমন নেতিয়ে গিয়েছিল অযত্নে। যেন ঠিকঠাক পরিচর্যার অভাবে অচিরেই লাবন্যতা বিলীন হবে রুশকন্যার। তুষার যখন খবরটা জানিয়ে চলেই যাচ্ছিল, তখনই অযাচিত এক অনুরোধে দ্বায়িত্বের পাল্লা ভারী করে দিলেন ভদ্রমহিলা। দু’হাতে করজোড় করে শীর্ণকায় নাতনিকে দেখিয়ে কাকুতির স্বরে জানালেন,
— বছরের বেশিরভাগ সময়ই এখানে প্রচণ্ড ঠান্ডা । বরফে জমে থাকে সবকিছু। ফ্লোরাকে আমি ঠিকঠাক খাবার, পানীয়, কিংবা গরম কাপড়চোপড় কোনোটাই দিতে পারিনা।দু’দিন অন্তর ঠান্ডা জ্বর আর পেটের পীড়ায় ভুগতে থাকে মেয়েটা। আমার সঙ্গে সঙ্গে ফ্লোরার ও স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে দিনদিন। এমনটা চলতে থাকলে শীঘ্রই বড় কোনো অসুখে পরে জীবন খোয়াবে আমার নাতনি ফ্লোরানি।
তাছাড়া…

এক মূহুর্ত থমকালেন দাদি, তুষার প্রত্যুত্তর করলো,
— তাছাড়া!
— ওর বাবা মায়ের দূর্বলতার হদিস করার জন্য প্রায়সই গু’প্তচ’রের আনাগোনা লক্ষ্য করা যায় এদিকে । অতর্কিত স’ন্ত্রা’সী হামলার ভয়ে দিনরাত পালিয়ে বেড়াতে হয় আমাদের। এভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে আর কতোদিন সুরক্ষা করতে পারবো এই নিস্পাপ ফ্লোরানিকে, জানা নেই আমার।
বয়সের ভারে কুঁচকে যাওয়া কপোল বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়ালো ভদ্রমহিলার। দাদি ভ্যালেরিনার কথাটুকু শেষ হতেই গ্রীবাদেশ স্থির রেখে আড়চোখে ওপাশে দাঁড়ানো রুশ মেয়েটার পানে দৃষ্টিপাত করে তুষার। পুরাতন আলখাল্লায় মোড়ানো শীর্ণকায় শরীর। ঠান্ডায় জমে হীম হয়ে আসা ফ্যাকাসে বর্ণের তুলতুলে আদুরে মুখ। চড়ুই ছানার ন্যায় সরু হয়ে আসা ধোঁয়া ওঠা ফিনফিনে র’ক্তি’ম ওষ্ঠাধর। পিঠ ছুঁই ছুঁই ঈষৎ বাদামী সর্পিল চুলগুলো জবুথবু হয়ে আটকে আছে বিনীটুপির আস্তরণে।

ছোট্ট মেয়েটাকে একদৃষ্টে পরখ করে নিলো তুষার। পরপরই বিপরীত প্রান্ত থেকে ধ্বণিত হলো দাদির রুগ্ন কণ্ঠস্বর।
— যদি কোনো সমস্যা না হয় তুমি কি মেয়েটাকে মস্কোতে নিয়ে যেতে পারবে বাবা? যেখানে ওর বাবা মা থাকতো। আমার বিশ্বাস তারা শূন্যতার মাঝে দুনিয়া ত্যাগ করেনি, কিছুনা কিছু তো মেয়েটার জন্য ঠিকই রেখে গিয়েছে। আমি চাই আমার ফ্লোরানি সবসময় ভালো থাকুক, সুরক্ষিত থাকুক। ওর নিস্পাপ মুখের পবিত্রতাটুকু সারাজীবন এভাবেই অটুট থাকুক।
দাদি ভ্যালেরিনার ধারণা ভুল ছিলনা মোটেই। নিজেদের সারাজীবনের সবটুকু সঞ্চয় একমাত্র মেয়ে আর মায়ের জন্যই সংরক্ষণ করে গিয়েছিলেন ফ্লোরার বাবা মা। এবং সেই সঞ্চয়ের পরিমাণ মোটেই সামান্য নয়, বরং সাধারণ অংকের হিসেবে তা ছিল ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

কিন্তু তুষার তো দয়ালু নয়। কঠোরতা আর নির্জীবতায় আবৃত প্রস্তর খণ্ডের ন্যায় শক্ত ওর পাষণ্ড হৃদযন্ত্র। অনুভূতি নামক স্নায়ুকোষটুকু বিভীষিকায় বিলীন হয়েছে বহু আগেই। তবুও কি ভেবে যেন আজ চিরাচরিত সিদ্ধান্তে অনিয়ম ঘটালো যন্ত্র মানব। দুদণ্ড এগিয়ে গিয়ে দোরগোড়ায় আসীন মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে গভীর গলায় বললো,
— তৈরি হয়ে নাও, তুমি মস্কো যাচ্ছো।
তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়ায় ফ্লোরা, একছুটে দাদির উষ্ণ শালের পেছনে গা ঢাকা দিয়ে বলে,
— আমি যাবোনা দাদি। আমি চলে গেলে তোমার কি হবে?
নাতনীর উদ্বিগ্নতায় নিঃশব্দে মলিন হাসলেন ভ্যালেরিনা। বাইরের কনকনে ঠান্ডা ছাপিয়ে আন্তরিকতায় উষ্ণ হয়ে উঠলো তার রুগ্ন অন্তঃকরণ। মেয়েটাকে বাহুমাঝে আবদ্ধ করে ধাতস্থ করলেন আহ্লাদী স্বরে,
— আমি নিজেকে ঠিক সামলে নিবো ফ্লোরানি। তুই সুরক্ষিত থাকলে দেখবি দাদি ও সুস্থ হয়ে গিয়েছে।
গম্ভীর অভিব্যক্তির তুষারের পানে চেয়ে কুণ্ঠায় গুটিয়ে গেলো বালিকা, চোখের ইশারায় লোকটাকে ইঙ্গিত করে বললো,

— কিন্তু ওনাকে ভয় লাগছে।
দাদি বললেন,
— উনি তোকে ভালো জায়গায় নিয়ে যাবে সোনা। সেখানে পর্যাপ্ত খাবার আছে, গরম কাপড় আছে,ঘুমানোর জন্য আরামদায়ক বিছানাও রয়েছে। তারচেয়েও বড় কথা ওনারা তোকে সুরক্ষিত রাখবেন।
ভদ্রমহিলার কথায় হতবিহ্বল হলো তুষার। মাফিয়া পেন্টহাউজকে কি আসলেই ভালো কোনো জায়গা বলা যায়? আর সুরক্ষা, সেটা কি আদৌও সম্ভব?
যেখানে নিজের ছেলে পুত্রবধুর অকাল মৃ’ত্যুর জন্য একমাত্র মাফিয়ারা দায়ী, সেখানে ভ্যালেরিনার মুখে এমন একটা কথা বড্ড বেশি বেমানান ঠেকলো তুষারের নিকট। হতে পারে নিজের শতবর্ষীয় বিচক্ষণতা থেকেই এ কথা বলেছিলেন বৃদ্ধা।

সে যাই হোক, অবশেষে ভ্যালেরিনার বহু কসরতের পরে তুষারের সঙ্গে নিজ গৃহ ত্যাগ করেছিল ফ্লোরা। সন্ধ্যার আকাশে যখন শুকতারা জ্বলজ্বল করছিল, গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরে তখন তীর্যক শিখা ছড়াচ্ছিল হলদে রঙা কেরোসিনের প্রদীপ। ঠিক সেই সময়ে বিশেষ ধরণের ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে যাত্রা শুরু করে ওরা। এই গ্রামে গাড়ি প্রবেশ করানো দূরহ ব্যাপার, প্রচণ্ড ঠান্ডায় ইঞ্জিন শিথিল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রকট। তাই গ্রাম থেকে কয়েক ক্রোশ অদূরে জিপ দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছ তুষার। আপাতত সেই অবধি যাওয়ার একমাত্র অবলম্বন হলো এই কাঠের তৈরি লম্ফঝম্প ঘোড়ার গাড়িখানা।

গাড়িতে বসার পর থেকেই ঘুমের তাড়নায় টলছিল ফ্লোরা। বহুক্ষণ কান্নার দরুন শরীর ক্লান্ত ছিল ওর, সেই সাথে সন্ধ্যার পরপরই ঘুমিয়ে পরার বদঅভ্যেসটা জেঁকে বসেছে চোখের পাতায়।
বেঘোরে টলতে টলতে তন্দ্রাচ্ছন্ন রুশকন্যা যখন তুষারের কাঁধে লুটিয়ে পড়ছিল তৎক্ষনাৎ কর্কশ আওয়াজে বাঁধ সাধলো যুবক। ভ্রু কুঞ্চিত করে বলে উঠলো,
—খবরদার! আমার দিকে আসবেনা একদম। দূরে থাকো।
যুবকের কঠোর বাক্যে ধড়ফড়িয়ে ওঠে বালিকা। কোনোমতে নিজেকে সামলে, ঘুম জড়ানো গলায় রিনরিনিয়ে বলে,
— আমার ঘুম পাচ্ছে ভীষণ….
ব্যাস এটুকুই, পরপরই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে অজান্তেই ঢলে পরে ওই যান্ত্রিক মানবের চওড়া কাঁধের আস্তিনে। তারপর কি তুষার ওকে সরিয়েছিল? উহুম, বোধ হয় না।

টানা চব্বিশ ঘণ্টা আকাশ ভ্রমন করে, অবশেষে যখন পেন্টহাউজে ফিরলো তুষার, তখন যুবকের পেছনে ছোট্ট রুশ বালিকাকে দেখে অবাকের চরম শিয়রে পৌঁছেছিল এরীশ। দয়া মায়াহীন ব্লাডিবিস্ট খ্যাত রীশস্কা মেয়েটাকে পর্যবেক্ষণ করে কুটিল স্বরে শুধিয়েছিল,
— তুমিকি এই বাচ্চা মেয়েটাকে প্রস্টিটিউড ক্লাবে পাঠাতে চাইছো?
— না!
তৎক্ষনাৎ উদগ্রীব স্বরে প্রত্যুত্তর করে তুষার।
— তাহলে?
শুষ্ক একটা ঢোক গিলে মাফিয়া বসকে জুতসই কুর্নিশ জানিয়ে তুষার বলে,
— পেন্টহাউজে আমাদের একজন অথেনটিক রাধুনীর প্রয়োজন ছিল। তাই ওকে রান্না করার জন্য নিয়ে এসেছি এখানে । আজ থেকে পেন্টহাউজের রান্না থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক সকল কাজের দ্বায়িত্ব ওর।
তুষারের কথায় মেয়েটার আগাগোড়া পর্যবেক্ষন করে এরীশ। অতঃপর গম্ভীর স্বরে বলে,

— তোমার কি মনে হয় না, এসব কাজের জন্য এই মেয়েটা একটু বেশিই ছোট।
— কিছু করার নেই। আজ থেকে ওর বাবা মায়ের হয়ে ও নিজেই সার্ভ করবে এই মাফিয়া প্যারাডাইসকে।
পাইথন প্যারাডাইসের অত্যন্ত বিশ্বস্ত দু’জন স্পাইয়ের র’ক্ত ছিল স্বয়ং ফ্লোরা। তাই এরীশ ও আর এ ব্যাপারে না করেনি কখনো। তুষার যেভাবে চেয়েছে সেভাবেই থাকতে দিয়েছিল ফ্লোরাকে।
সেই থেকেই নিষিদ্ধ পেন্টহাউজের বিভীষিকার মাঝেই ডালপালা ছড়ানো স্নিগ্ধ পুষ্পরাজিকে এক অদৃশ্য বলয় হয়ে সর্বদা আগলে রেখেছিল মূর্তিমান পিশাচ।
অথচ তার এতোগুলো বছরের বাসনাকে এক রাতে ব্যাবধানে তছনছ করে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে এক পাষবিক হায়নার কলুষিত থাবা।

ফ্লোরার ঘরের সামনে থেকে অকস্মাৎ দু’জন নার্সের আগমনে ভাবনার ছেদ ঘটে তুষারের।বিভ্রম থেকে বেড়িয়ে সম্মুখে দৃষ্টিপাত করতেই দেখলো ওর র’ক্তে মাখা বীভৎস চেহারার পানে চেয়ে ভয়ে কাঁপছে মেয়ে দুটো। এই মূহুর্তে মস্তিষ্ক পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে আছে মানবের,অস্তিত্ব জুড়ে দাউদাউ করছে প্রতিশোধের দাবানল। অগত্যা হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে হুট করেই দু’হাত তুলে মেয়ে দু’টোর কপালে রিভলবার তাক করলো তুষার।
মূহুর্তেই কাঠের পুতুলের ন্যায় স্থির হয়ে গেলো তারা। মাত্রাতিরিক্ত শঙ্কায় ছলকে উঠলো হৃদযন্ত্র, একযোগে চোখমুখ খিঁচে ক্রন্দিত স্বরে বলতে লাগলো,
— মাফ করবেন, আ…আমরা কিছু করিনি। ডা. মাতভেই এর আদেশে চেকআপ করতে এসেছি শুধু ।
মেয়ে দু’টোর কাঙ্ক্ষিত স্বীকারোক্তিতে খানিক দমলো বিপরীত পক্ষ। নিঃশব্দে রিভিলবার দু’টো নামিয়ে কাতর স্বরে জানতে চাইলো,

— ও ঠিক আছে?
তুষারের নিস্ফল প্রশ্নে শুষ্ক ঢোক গিলে চোখ চাওয়া চাওয়ি করলো মেয়ে দু’টো। অতঃপর একজন থেমে থেমে বলে উঠলো,
— ব্লেডিং এখন নিয়ন্ত্রণে। ক্ষতস্থান গুলো ও শুকিয়ে এসেছে খানিক। আমরা নিয়মিত ড্রেসিন করে দিয়ে যাই, ফলে ইনফেকশনের সম্ভবনা নেই।
নার্স মেয়েটার সবগুলো কথা চোখ খিঁচে গিলে নিলো তুষার। রাশভারি কণ্ঠনালি খানা বুঁজে এসেছে য’ন্ত্রণায়। সহসা আর একটাও কথা না বাড়িয়ে হাতের ইশারায় তাদের প্রস্থান করতে বলে যুবক। অনুমতি পাওয়া মাত্রই তড়িঘড়ি করে প্রস্থান করে মেয়ে দু’টো। তুষার দাঁড়ায় না, রুশ বালিকার কক্ষের অভিমুখে এগিয়ে যায় ধীর পায়ে।
কক্ষের বাইরে তুষারের উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্রই ওপাশ থেকে দরজায় খিল দিলো ফ্লোরা। জমিয়ে রাখা আত্নবিশ্বাসটুকু এক ঝটকায় মুখ থুবড়ে পড়লো এবার । পুরোপুরি নাজেহাল মস্তিষ্ক, আহত অন্তঃকরণ। চিরাচরিত গম্ভীর থমথমে মুখাবয়ব জুড়ে কাতরতার উদ্ভাসন। তুষারের মনে হতে লাগলো কণ্ঠনালি ভেদিয়ে সামান্য একটা বাক্য ধ্বনিত করার চেয়ে কঠিন কাজ বোধ হয় পৃথিবীতে আর কিচ্ছু নেই। তবুও সেই দুঃসাধ্য সাধনে উদ্যত হলো সে, অসার হয়ে আসা জিহ্বাটাকে নাড়িয়ে ছুঁড়লো আহত কণ্ঠস্বর,
— স্নোফ্লেক্স কখনো ভাঙেনা, তারা আকাশ থেকে নিপতিত হয়ে নিজ উদ্যেগে বেমালুম গলে যায়। জানো নিশ্চয়ই?
ওপাশে নৈঃশব্দ্য।
ফের বলতে লাগলো মূর্তিমানব।

— ধরনী জুড়ে আচ্ছাদিত কঠিন তুষারের বুকে তুমি সেই নমনীয় স্নোফ্লেক্স। যাকে কেউ কখনো ভাঙতে পারেনা। সে আপন তরঙ্গে উচ্ছ্বাসিত। শুষ্ক বরফ পিণ্ডের অন্তঃস্থলে জমে থাকা অপার্থিব কারুকাজ তুমি ফ্লোরা, “আমার স্নোফ্লেক্স”। শক্ত তুষারের মাঝে আকাশ থেকে নেমে আসা সজ্জিত সেই তুষার কণা।যার শুভ্র সৌন্দর্যকে কখনো আঁধার স্পর্শ করতে পারেনা।
এতোকিছুর পরেও কোনোরূপ প্রত্যুত্তর ভেসে এলোনা ওপাশ থেকে।
আশাহত হলো অভিলাষী সত্তা । নিজেকে আর সামলাতে পারলো না যন্ত্রমানব। তীব্র আত্মগ্লানিতে ডুবে অকস্মাৎ কক্ষের সামনে হাঁটু ভেঙে বসে পরলো ধপ করে। পরপরই দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে উদভ্রান্তের ন্যায় হুংকার ছাড়লো অকস্মাৎ ,

— কেন সেদিন তোমার কথা শুনতে গেলাম আমি? কেন দিয়েছিলাম ওকে বাঁচার সুযোগ? সব দোষ আমার, আমিই সেদিন বাঁচতে দিয়েছিলাম ওই জা’নো’য়ার টাকে। সেদিন এই দু’হাতে এ্যালেক্সান্দ্রেয়র মৃ’ত্যু রচিত হলে, আজ এতোটা দূর্বিষহ যন্ত্রণা সহ্য করতে হতোনা তোমায় ফ্লোরা। সব দোষ আমার, সব দোষ, সব…..
উন্মাদনায় দু’হাতে আবদ্ধ রিভলবার দু’টো ছিটকে পরলো মেঝেতে। উদভ্রান্তের ন্যায় একই শব্দ বারবার উচ্চারিত করতে করতে শরীরের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ক্রমশ দেওয়ালের গায়ে ঘুষি হাঁকাতে লাগলো তুষার। নিজের কর্মফলের গ্লানির নিকট এ যন্ত্রনা যেন হামেশাই শিথিলতুল্য। ক্রোধের তাড়নায় বিদীর্ণ হলো দু’হাতের পৃষ্ঠদেশ। মূহুর্তেই দগদগে ক্ষ’তচিহ্নে ভরে উঠলো ফিনফিনে চামড়ার আবরণ। ক্ষ’তবি’ক্ষত মুঠোর ফাঁক দিয়ে গড়ালো তরতাজা র’ক্তস্রোত। তাও দমলো ক্রোধ। আপন কার্জে অবিরত মূর্তিমানব। নিজেকে ক্ষ’তবি’ক্ষত করার হাজারটা পায়তারা করেও যন্ত্রণা উপলব্ধি হচ্ছে না অন্তরে। এ কেমন পাথর কঠিন চিত্ত তার?
নিজেকে আ’ঘাত করার প্রয়াসে সফল না হলেও, ওর কাণ্ডে পরাস্ত হলো রুশ রমনী। দরজা খুলে অকস্মাৎ বেড়িয়ে এসে গলা চিঁড়ে চ্যাঁচালো মেয়েটা,

— থামুন!
থমকালো অস্তিত্ব। বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে তৎক্ষনাৎ ঘোরালো গ্রীবাদেশ। দেখলো ওর কাছেই অনেকটা সন্নিকটে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। পরনে তার হাঁটু সমান পাতলা ফ্রক। পিচ রঙা ফিনফনে কাপড়টা রুশকন্যার দূধে আলতা পেলব ত্বকের সঙ্গে একেবারে মিশে যেতে চাইছে যেন। অথচ পায়ের পাতা থেকে শুরু করে শরীরের প্রত্যেকটা অনাবৃত অংশে গভীর ক্ষ’তর অস্তিত্ব সুস্পষ্ট।
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের র’ক্ত র’ঞ্জিত হাতখানা বাড়িয়ে দিলো মেয়েটার গলার ভাঁজে। খরখরে পুরুষালি হাতটা আদুরে আস্ফালনে অতি সন্তোর্পনে বিচরণ করলো সেথায়। অতঃপর তুলতুলে কোমল অধর জুড়ে খেলে গেলো র’ক্তা’ক্ত বৃদ্ধাঙ্গুলির গভীর প্রলেপ। তীক্ষ্ণ আওয়াজে ধ্বনিত হলো,
— আমি ওকে ছাড়বো না ফ্লোরা, কিছুতেই ছাড়বো না। ওর পা’পাচারই ওর জন্য নরকের দুয়ার উন্মুক্ত করেছে। এবার শুধু নিক্ষিপ্ত হওয়ার পালা।

এতোক্ষণে দৃষ্টি তুললো রুশ রমণী। টলমলে চাহনির মাঝে জমে আছে তার অগাধ অভিমান,আধারের ন্যায় প্রগাঢ় বিষণ্ণতা । মেয়েটার আহত দৃষ্টিযুগল নজরে আসতেই দু’হাতে ওর স্নিগ্ধ কপোল জোড়া আগলে ধরলো তুষার। যুবকের র’ক্তে মাখামাখি হলো রমণীর পেলব ত্বক।
কিয়ৎক্ষন বাদে অতি সন্তোর্পনে ললাট নিয়ে ছোঁয়ালো রমণীর ছোট্ট ললাট দেশে । অতঃপর নদীর মতো শান্ত আওয়াজে উচ্চারিত করলো ক্ষুদ্র এক বাক্যবহর,
— আ’ম সরি। আ’ম রিয়েলি রিয়েলি সরি। তোমার সুরক্ষায় অপারগ হওয়ার অ’গ্নি’কুণ্ড সারাজীবন জলন্ত অঙ্গার হয়ে পোড়াবে আমায়। কিন্তু বিশ্বাস করো সেই বী’ভৎস দহন যতই বি’ধ্বং’সী হোক না কেন, আমি তার সবটুকু যাতনা মাথা পেতে নিবো নির্দ্বিধায়।
নির্বিকার ফ্লোরা এতোক্ষণে উপলব্ধি করলো রাশভারি কঠিন আওয়াজটা কেমন ভঙ্গুর হয়ে এসেছে, মনে হচ্ছে বুকের কান্না গিলে গিলে অতি ব্যগ্রতায় শব্দ গুলো উচ্চারণ করছে লোকটা। পরপরই নিজের র’ক্তমাখা অনাবৃত গলার ভাঁজে অনুভূত হলো টুপটুপ করে ঝড়ে পরা দু’ফোঁটা তপ্ত জলের অস্তিত্ব। ওর আর বুঝতে বাকি রইলো না এই জলের উৎস কোথায় ।

এই মানুষটার অশ্রুসিক্ত কৃষ্ণগহ্বরের পানে চোখ উঁচিয়ে তাকানোর সাহস হলোনা মেয়েটার। কেবল ঠোঁট নাড়িয়ে নির্জীব রিনরিনে আওয়াজে জানালো,
— এখানে দম বন্ধ হয়ে আসছে তুষার। মানুষের উপস্থিতি একটুও ভালো লাগছে না। অন্য কোথাও নিয়ে চলুন।
ফ্লোরার বলতে বাকি, অতঃপর এক মূহুর্তও বিলম্ব করলো না যুবক, তক্ষুণি দু’হাত বাড়িয়ে রমণীর কবুতরি পেলব অস্তিত্বকে তুলে নিলো শূন্যে। ঠকঠকে বুটের তলা র’ক্তে ভিজে একশা। চারিপাশে ছি’ন্নভি’ন্ন ম’রদেহে’র উপস্থিতি, সেসব নৃ:শংস’তা নির্বিঘ্নে উপেক্ষা করে এগিয়ে গেলো লাউঞ্জের দিকে।

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪১

মেইন গেট ছাড়িয়ে এলিভেটরের অভিমুখে অগ্রসর হতে হতে আপন বক্ষভাঁজে লেপ্টে থাকা নাজুক প্রেয়শীর পানে চাইলো একপল। পর মূহুর্তেই কানের এয়ারপড’স সচল করে গমগমে আওয়াজে ছুঁড়লো কঠোর আদেশ ,
— আমার কান্ট্রিসাইডের ভিলা টা যাতে রেডি থাকে। আগামী দু’টো দিন সেখানেই অতিবাহিত করবো আমি।

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪২